১. শেখ মুজিব আর মেজরবৃন্দ
দেশের জন্যে আমি যা করছি,
কেউ তা অনুধাবন করলো না।
-শেখ মুজিবুর রহমান
আমি ১৫ তারিখে তা ঘটাতে যাচ্ছি;
মুজিবকে আমি চিরতরে সরিয়ে দিচ্ছি।
-মেজর ফারুক রহমান
.
১৯৭৫ সালের ১২ই আগস্ট। রাত হয়ে এসেছে। মেজর ফারুক তখন বেঙ্গল ল্যান্সার্স- এর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক। ঢাকা গলফ ক্লাবে সেদিন এক জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান—মেজর ফারুক ও তার তরুণী সুন্দরী স্ত্রী ফরিদার তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের (পার্টি) আয়োজন। আপ্যায়িত শ’খানেক অতিথির কারও এ অনুষ্ঠান ভুলে যাবার কথা নয়।
ফারুক আর ফরিদা একটি অতি জনপ্রিয় তরুণ দম্পতি। দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত, বিত্তশালী ও সভ্রান্ত পরিবারবর্গের সঙ্গে তাদের রয়েছে নিবিড় বন্ধন। ঐ সকল পরিবারের সদস্যরাই দখল করে আছেন সরকারী আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আর উচ্চ আদালতের বিচারকের ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহ। সুতরাং তাদের এ পার্টি ছিল সামাজিক ঘটনাপ্রবাহের একটা অংশ বিশেষ। স্বর্গলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মত ছিল আয়োজনের জৌলুস। কয়েক সপ্তাহ ধরে মৌসুমী বৃষ্টিতে সমস্ত শহরটি একেবারে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠেছিল কিন্তু ঐদিন চমৎকার সূর্যালোকের পর সুন্দর মনোরম মেঘমুক্ত রাতের আকাশ বিরাজ করছিল।
ফারুকের পূর্বপুরুষও সেনাবাহিনীতে ছিলেন। তাই পার্টিটি ছিল সামরিক ঐতিহ্যে বলীয়ান। ডজন খানেক নিয়ন রঙ্গীন বাতি লনের উপর সবরতের গ্লাস হাতে দলে দলে জমাট বাধা অতিথিদের মাথার উপরে যেন এক চাঁদোয়ার সৃষ্টি করেছিল। সেনাবাহিনী সদর দফতরের ব্যান্ডে সঙ্গীতের মূর্ছনায় আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ক্লাব ঘরের ভেতরে প্রীতিভোজের টেবিলগুলোতে প্রভূতভাবে সাজানো ছিল–খাসির মাংসের বিরিয়ানী, কাবাব, মাংসের তরকারী/রিজালা আর পরিমাণমত ফলের সালাদ।
ফারুকের মামা জেনারেল স্টাফ প্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আরও ছিলেন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের মিলিটারী সেক্রেটারী, ব্রিগেডিয়ার মাসহুরুল হক। ফারুকের জোয়ানেরা দম্পতির জন্যে উপহার হিসেবে নিয়ে আসে বেডরুমের জন্যে পাটের তন্ত্রজাত এক চমৎকার গালিচা। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়- স্বজন নিয়ে আসে টেবিল ল্যাম্প, কারুকাজ করা পাত্র, হরেক রকম রঙ্গিন কাগজে মোড়া নগরীর অভিজাত বিপণীকেন্দ্রগুলো থেকে বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী। ব্রিগেডিয়ার হক এসেছিলেন শেষের দিকে। শেষে এলেও তিনি উপস্থিত সকলকে ছাড়িয়ে গেলেন। তিনি সঙ্গে এনেছিলেন ‘গণভবন’ (শেখ মুজিবের সরকারী বাসভবন)-এর প্রধান মালীর তৈরী মৌসুমী ফুলের এক বিরাট তোড়া। তিনি ফুলের তোড়াটি ফরিদাকে উপহার দিয়ে ‘বাজিমাত’ করে দেন।
তিনদিন পর উপস্থিত সকলেই হয়তো রাতের ঘটনা প্রবাহ থেকে কোন সূত্র খুঁজে পাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পেলেন না কিছুই। এদিকে ব্রিগেডিয়ার হক নীরবে হয়তো তার বীরত্বের জন্যে তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে থাকবেন। সেদিন ফরিদার জন্য আনীত ফুলের তোড়াটি হয়তো তার জীবন বাঁচিয়েছিল।
কিন্তু ঐ উৎসবের রাতে ফারুকের মনের গোপন চক্রান্তটি সম্বন্ধে কেউ একটু আন্দাজও করতে পারেননি। তার মনে পড়ছে, তিনি সেদিন অস্বাভাবিকভাবে প্রাণখোলা ছিলেন। ‘আমি আমার স্বয়ংক্রিয় স্লাইড প্রজেক্টরটি মাত্র ৩,৫০০/- টাকায় বিক্রি করে ঐ পার্টিতে সমুদয় টাকা উড়িয়ে দিয়েছিলাম, তার জন্যে একটি ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছিল।’
তিনি যে কর্মে মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তাতে হয় তিনি ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ যাবেন, না হয় অমোচনীয়ভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে তাঁর নাম অক্ষয় করে রাখবেন।
‘আমি অনুষ্ঠানটা উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ঐটিই আমার জীবনের শেষ অনুষ্ঠান হতে পারত।’
অতিথিদের সবাই চলে গেলে, পারিবারিক ছোট একটি দল লনে কফির সঙ্গে সামান্য নাস্তা নিয়ে আলাপচারিতার জন্যে মিলিত হলো। আপ্যায়নকারীরা অতিথি সেবায় এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, নিজেদের খাবারের সুযোগও হয়ে উঠেনি। দম্পতিটির সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন, ফারুকের মা-বাবা, চট্টলা থেকে আগত ফরিদার মা এবং ফরিদার বড় বোন জোবায়দা (ডাকনাম টিঙ্কু)। আরও ছিলেন, জোবায়দার স্বামী, মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ঢাকায় অবস্থিত ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর অধিনায়ক।
ফারুক তার ভায়রাভাইকে একদিকে সরিয়ে নিয়ে এলেন। তিনি রশিদকে জানালেন, ‘আমি ১৫ তারিখেই তা ঘটাতে যাচ্ছি; শুক্রবার সকালেই আমি মুজিবকে জীবনের তরে সরিয়ে দিচ্ছি।’
রশিদ চমকে উঠলেন। সচকিতে রশিদ একবার চতুর্দিকে দেখে নিলেন, কেউ তো আবার ফারুকের গর্জন শুনে ফেলেনি! হঠাৎ যেন গোপন ষড়যন্ত্রের মাসগুলি উপসংহারের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হলো। কিন্তু রশিদ প্রস্তুত ছিলেন না। অনেকক্ষণ চুপ থেকে ফিস ফিস করে তিনি বললেন, ‘তুমি কি পাগল হয়েছো?’ এত তড়িঘড়িতে সব পন্ড হতে পারে। আমাদের তো সাথী অফিসার নেই। অস্ত্রশস্ত্রও নেই। আমরা কিভাবে তা সফল করব?
তেজোদ্দীপ্ত শানিত চোখে ফারুক অন্য মেজরটির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটাই আমার সিদ্ধান্ত’ রণ কৌশলের পরিকল্পনা আমার কাছে তৈরী করা আছে। আমি একা হয়ে গেলেও এগিয়ে যাব। তুমি ইচ্ছে করলে সরে দাঁড়াতে পার। তবে জেনে রেখো, ব্যর্থ হলে শাসকচক্র তোমাকেও ফাঁসিতে লটকাবে।’
আবারও রশিদ অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হচ্ছিল তিনি ফারুকের কথাগুলো হজম করছেন। অবশেষে হালকা-পাতলা, দীর্ঘদেহী আর্টিলারী অফিসার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফারুককে বললেন, ‘ঠিক আছে! যদি করতেই হয়, তবে কর। কিন্তু আমাদের এ নিয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। আরও কিছু অফিসার আমাদের সঙ্গে রাখা উচিত।’
শহরের অন্য প্রান্তে শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর পরিবার-এর লোকজন নিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডস্থ তাঁর নিজ বাড়ীতে নিশ্চিন্তে সময় কাটাচ্ছিলেন। ঐ বাড়ীটি তখনও দেশবাসীর চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। শেখ মুজিবের ছোট বোনের মেয়ের বিবাহ উপলক্ষে জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সকলে দু’দিন আগেই এখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাদের অনেকেই তাদের শ্রদ্ধা নিবেদন ও মহান নেতার আশীর্বাদ-এর জন্যে রয়ে গিয়েছিলেন। শ্ৰদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষ হলে বেগম মুজিব ভদ্রভাবে তাদেরকে বিদায় দেন। অবশেষে কতিপয় বাছাই করা লোক শেখ মুজিবের সান্নিধ্যে থেকে যান। অন্যান্যের মধ্যে মুজিবের প্রিয় বোনের স্বামী, আবদুর রব সেরনিয়াবাত উপস্থিত ছিলেন। তিনি বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন, মৎস্য ও পশুপালন মন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। আর একজন ছিলেন সেরনিয়াবাত-এর ছেলে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি তিনদিন পরে অলৌকিকভাবে পারিবারিক ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
ঐ রাত্রের পারিবারিক আলাপচারিতা সরকারী বিষয়াদিকেও সমভাবে প্রভাবান্বিত করা বিচিত্র কিছুই ছিল না। শেখ মুজিব এ দু’টিকে কখনও আলাদা করে দেখেননি। তাঁর সন্দেহ আর চক্রান্তের জগতেও তার প্রিয়তম ও নিকটতম লোকজন অনায়াসে বিশ্বাসের স্থান দখল করে বসেছিল। তাঁর প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের যে কোনো বিষয়ে আলোচনার সময়ে পরিবারের সকলকে তিনি ডেকে নিতেন। ঐ রাত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু।
আবুল হাসনাত সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, ‘মামা সেদিন শরৎকালীন বন্যার সম্ভাবনা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন। ঐ বন্যা ধানের প্রচন্ড ক্ষতিসাধন করে থাকে। তিনি আব্বাকে ভারত থেকে আমদানীতব্য ড্রেজারগুলো কালবিলম্ব না করে নদী খননের কাজে লাগাবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কৃষকের উপাখ্যান বর্ণনায় মুজিবের জুড়ি ছিল না। ক্ষণিকের মধ্যে, গ্রাম্য মোড়লের ন্যায়, এ দেশের মাটির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে এমন এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পটভূমিতে ঐ সময়ের সঙ্কটকে সাজিয়ে নিলেন। ততক্ষণে তাঁর তামাকের ‘পাইপ’ থেকে বেরিয়ে আসা সৌরভে সমস্ত ঘরটি মোহিত হয়ে উঠেছিল। শ্রোতাদের লক্ষ্য করে তিনি বলতে লাগলেন, ‘আমি তখন বেশ ছোট। ড্রেজার কোম্পানীতে চাকুরীরত বিলেতীদের সঙ্গে নদীর পাড়ে ফুটবল খেলতাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন এই উপমহাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। কোম্পানী তখন এসব ড্রেজার বার্জ বানিয়ে বার্মায় সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্যে সরিয়ে নিয়ে গেল। আর কোনদিন এগুলো ফিরে এলো না। আমি যেখানে খেলতাম, সেখানে এখন আর কোন নদী নেই—কেবল চর আর চর। আর সে কারণেই আজ আমরা প্রতি বছরই বন্যার শিকার।’
এ সমস্যার সমাধানকল্পে তিনি কি ভাবছেন কথাচ্ছলে জিজ্ঞাসা করা হলে, পরিবারের সবাইকে উদ্দেশ্য করে মুজিব বললেন—’আমার তো বন্যা নিয়ন্ত্রণের পর্যাপ্ত অর্থ হাতে নেই, তবে ড্রেজারতো পাচ্ছি। তোমরা দেখবে আমি কিভাবে নদীগুলোকে আঁচড়িয়ে ঠিক করে দিই। আমার ‘বাকশাল’ ঠিকই তা করে দেবে।
তারপরই তাঁর মানসিকতায় এক পরিবর্তন দেখা গেল। ঔৎসুক্যে ভরা একটা মানুষ হঠাৎ যেন অসাড়তায় ছেয়ে গেলেন। হাসনাত তার মামার বলা শেষ শব্দগুলো স্মরণ রেখেছে—’দেশের জন্যে আমি যা করছি তা কেউ বুঝতে পারলো না।’
ঐ মন্তব্যটি শেখ মুজিবুর রহমানের অমিয়বাণী। তিনি ততক্ষণে তাঁর প্রাণপ্রিয় বাঙ্গালীদের সঙ্গে তাঁর সারাজনমের ভালবাসায় যবনিকাপাত ঘটার কাছাকাছি চলে এসেছেন। এটা ছিল, এক প্রচন্ড প্রেম-বিদ্বেষ সম্পর্ক যা কেবল একটি অতিমাত্রায় ভাবাতুর ও উদ্বেলিত জাতির পক্ষেই সম্ভব। তাঁরা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে আখ্যায়িত করে দেবতার ভাবমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। দেবতুল্য মানব শেখ মুজিব তাঁর জাতির সঙ্গে তাদের আশা, আনন্দ, ক্ষোভ আর চক্রান্ত; তোষামোদ আর লোভ-লালসায় সমান প্রচণ্ডতায় একাত্ম হতেন। তিনি বলতেন, ‘জনগণকে ভালবাসার মধ্যেই আমার শক্তি নিহিত।’ আর আমার ‘দুর্বলতা’ হচ্ছে এই যে, আমি তাদেরকে অতিমাত্রায় ভালবাসি।’
সাড়ে তিন বছর আগে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই শেখ মুজিব তাদেরকে গুরুর মত শাসন করে আসছিলেন। কিছু অসুবিধের মধ্যে হলেও তাঁকে হঠাৎ করেই দেশের সাধিত ক্ষতিপূরণের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। তিনি অদম্য উৎসাহ-উদ্দীপনায় কাজ করতে লাগলেন এবং মঙ্গল চিন্তায় সদিচ্ছায় ভরপুর তাঁর এক সচিবালয় রচিত হলো। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ‘সত্যের সঙ্গে রাজনীতিকে’ গুলিয়ে ফেলেন। কেবল ড্রেজার দিয়ে যেমন করে তিনি বন্যা সমস্যার সমাধানের উচ্চাশা পোষণ করেছিলেন, তেমনি সব কিছুতেই তিনি সরলতার আশ্রয় নিতেন। অনিবার্য কারণেই যাদুর মত জনগণের ভালবাসা ম্লান হয়ে এলো আর তোষামোদের মধুর গুঞ্জন পরিণত হলো চরম তিক্ততায়।
এ সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি সত্ত্বেও এমনকি কট্টর সমালোচকবৃন্দ পর্যন্ত শেখ মুজিব কোনরকমে কার্যোদ্ধার করতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। তাদের কাছে এমনকি অন্যান্য বাংলাদেশীদের কাছেও তাঁর অক্ষমতা ধারণাতীত বিষয় ছিল। কিন্তু ঐ আগস্টের রাতটিতে অসম্ভবটিই সম্ভবের ইতিহাস সৃষ্টি করলো। সাঁজোয়া বাহিনীর গাড়ী অগ্রসর হতে শুরু করল, মেজররা দৃপ্তপদে এগিয়ে চললো।