৫. দুঃসময়
সর্বত্রই কেবল সঙ্কট বিরাজ করছিলো।
—শেখ মুজিবুর রহমান।
.
১৯৭৪ সাল। গ্রীষ্ম থেকে শরৎকাল পর্যন্ত সময়টা বাংলাদেশের অনেকের কাছেই তাদের জীবিতকালের স্মৃতির পাতায় একটা জঘন্যতম অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ১৯৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত হত্যার তান্ডবলীলার স্মৃতি প্রত্যক্ষদর্শীর শিরা-উপশিরায় রক্ত সঞ্চালন আজও থামিয়ে দেয়। কিন্তু সবাই স্বীকার করে নিয়েছে যে, ঐ দামেই স্বাধীনতাকে কিনতে হয়েছিলো। মুক্তি সংগ্রামের অন্ধকার ঘুটঘুটে দিনগুলোতেও প্রত্যেকটি বাঙ্গালীর অন্তরে এক নূতন জীবনের প্রত্যাশার আলো ধিকিধিকি করে জ্বলছিলো। কিন্তু স্বাধীনতার তৃতীয় বছরে পা দিতে না দিতেই ঐ প্রত্যাশার আলো দপ্ করে নিভে গেলো।
আমদানী আর বিতরণ প্রক্রিয়ার প্রত্যেকটি স্তরে দুর্নীতি, কালোবাজারী, চোরাচালানী ইত্যাদির বদৌলতে খাদ্য সরবরাহ অবনতির দিকে ধাবিত হতে লাগলো। চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলো। তারপরই দেশের প্রায় অর্ধেক এলাকা প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ডুবিয়ে দিলো। মানুষ-খেকো বাঘের মতো দুর্ভিক্ষ সদর্পে সারাদেশ ছেয়ে গেলো। গ্রামগুলোতে মশা-মাছির মতো মানুষ মরতে শুরু করলো।
শেখ মুজিব নিজেই সরকারীভাবে পরে স্বীকার করেছিলেন যে, খেতে না পেয়ে প্রায় ২৭,০০০ লোক মরে গেছে। ঐ হিসেবটা আসলে যথেষ্ট কম ছিল। শুধু উপোস করাই নয়, তার ফলশ্রুতিতে পুষ্টিহীনতা, টিকে থাকার ক্ষমতা হ্রাস, রোগ ইত্যাদিতে মরেছে তারও বেশী। কমপক্ষে ৩০ লক্ষ লোক উপোস সীমার নীচে বসবাস করছিলো। সুতরাং ঐ হিসেবে দুর্ভিক্ষের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা লক্ষের ঘরেই হয়ে থাকবে। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঐ হিসেবের অন্তর্ভুক্ত হবার পর শেখ মুজিব জেনারেল এ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দেয়ার জন্যে নিউইয়র্ক যাচ্ছিলেন। বিমানে উঠার পূর্ব মুহূর্তে তিনি তার মন্ত্রীদেরকে দেশের ৪,৩০০টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে লঙ্গরখানা খোলার জন্যে নির্দেশ প্রদান করলেন। শেষ পর্যন্ত ৫,৭০০ লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিলো। ঐগুলোতে প্রতিদিন তিরিশ-চল্লিশ লাখ ‘না-খাওয়া’ মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কেবল একবেলা সামান্য কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।
লাখে লাখে মানুষ গ্রাম ছেড়ে খাবারের সন্ধানে শহরের দিকে ধাবিত হতে থাকে। হাজার হাজার লোক রাজধানী ঢাকার দিকে ছুটে আসে এই প্রত্যাশায় যে, বঙ্গবন্ধু তাদের জন্যে অন্ততঃ দু’মুঠো ভাতের সংস্থান করে দেবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাদের পেটের আগুন নিভানোর কোন ব্যবস্থাই করতে পারলেন না।
হাজার হাজার ছিন্নমূল জনতা আর ভিক্ষুকের দল ঢাকায় চলে এলে, সরকার বিব্রত হয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ৩রা জানুয়ারী ‘ঢাকার শহর পরিচ্ছন্ন’ করার জন্যে এক ব্যাপক অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই লক্ষ ছিন্নমূল আর বস্তিবাসী জনতাকে জোর করে, হয় তাদের গ্রামের বাড়ীতে, না হয় শহর থেকে বেশ দূরে সরকার সৃষ্ট ‘ক্যাম্পে’ যেতে বাধ্য করা হয়। তিনটি ঐ ধরনের ক্যাম্পের মধ্যে ডেমরায় অবস্থিত ক্যাম্পের অবস্থা ছিলো জঘন্যতম। গার্ডিয়ান পত্রিকা (১৮/২/৭৫ইং) ঐ ক্যাম্পটিকে ‘মুজিবের লোকদের সৃষ্ট দুর্যোগ এলাকা’ নামে আখ্যায়িত করেছিলো। ক্যাম্পটির অবস্থা ছিলো সত্যিই হৃদয় বিদারক। ঐ ক্যাম্পটিতে ৫০ হাজারেরও বেশী লোককে জড়ো করা হয়েছিলো। চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রক্ষীবাহিনী দ্বারা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এতগুলো লোকের জন্যে কয়েকটা পায়খানা আর সামান্য কয়টা টিউবওয়েলের বন্দোবস্ত রাখা হয়েছিলো। ঔষধের কোন সরবরাহ ছিলো না। নামেমাত্র কিছু রেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। ঐ ক্যাম্পের অবস্থা এতই অমানবিক ছিলো যে, সেখানে একজন সাংবাদিক দেখতে গেলে, এক হতভাগ্য ছিন্নমূল ক্যাম্পবাসী বুড়ো বলেছিলো, ‘আমাদেরকে খাইতে দেন, আর না হয় গুলি কইরা মারেন।’
শেখ মুজিব সুকৌশলে ঐসবের জন্যে তাঁর পার্টির লোকদেরকে এবং মন্ত্রীবর্গকে দোষারোপ করে যাচ্ছিলেন। জনগণও তাই করছিলো। জনগণ ভাবছিলো অন্ততঃ শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন না। এম, আর, আখতার মুকুল, শেখ মুজিবের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ মানুষ ছিলেন। মুকুল আমাকে একটা মজার গল্প শুনিয়েছিলেন। সময়টা ছিলো ১৯৭৫ সালের মার্চ মাস। শেখ মুজিব, বিরোধী দল জাসদ-এর কিছু নেতৃবর্গের সঙ্গে গোপনে সম্পর্কে রাখছিলেন। জাসদ সিদ্ধান্ত নিলো, ১৭ই মার্চ তারা এক বিরাট জনসভা করবে পল্টনে। সেখানে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে এক বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনে আক্রমণ চালাবে। শেখ মুজিব গোপন সম্পর্কের মাধ্যমে তাদেরকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবনের দিকে লেলিয়ে দিলেন। মন্ত্রী অবশ্য পরিবার- পরিজন নিয়ে কিছুদিনের জন্যে শহরের বাইরে ছিলো। উচ্ছৃঙ্খল জনতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ীতে আক্রমণ চালালো। রক্ষীবাহিনী সময়মতো গুলি চালিয়ে এগারোজনকে হত্যা করলো। এভাবে তিনি চমৎকারভাবে তার নিজের উপর পরিকল্পিত আক্রমণ প্রতিহত করলেন। উল্লেখযোগ্য, সেদিন তার ৫৩তম জন্মবার্ষিকী ছিলো।
রক্তপাত ক্রমাগতভাবে বেড়েই চললো। মুজিব নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে, রাতের অন্ধকারে বিরোধীদের আক্রমণে প্রায় ৪,০০০ আওয়ামী লীগ পার্টির কর্মী নিহত হয়েছিলো। এর মধ্যে পাঁচজন সংসদ সদস্যও ছিলো। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর জানিয়েছিলো যে, ঐ সকল হত্যাকান্ডের অধিকাংশের কারণই ছিলো আন্তঃদলীয় কলহ। খন্দকার মোশতাক আহমেদ জানালেন যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর নির্দেশে, রক্ষীবাহিনী যখন গভীর রাতে হানা দিয়ে বাড়ী থেকে জোর করে লোকজনকে ধরে নিয়ে যেতো, তখন তাদের স্ত্রী, মা-বোনের আর্ত-চিৎকারে পুরনো ঢাকার আকাশ ভারী হয়ে উঠতো। রক্ষীবাহিনীর নিয়ে যাওয়া ঐ লোকজন আর কোনদিন ফিরে আসতো না।
অব্যবস্থা আর দুর্নীতির কারণে দিন দিন দুর্যোগের মাত্রা কেবল বেড়েই চলেছিলো। এসবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে, শেখ মুজিব বলেছিলেন যে, জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থতার কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না। এ কারণে তিনি নয়জন মন্ত্রীকে তাঁর পরিষদ থেকে বাদ দিলেন। কিন্তু ক্ষুদ্র কর্মচারী আর দলীয় লোককে শাস্তি প্রদান করলেন। এবং চোরাচালানী আর মজুতদার পাকড়াও করার জন্যে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিলেন। শেষের কাজটিই ছিলো বহু মারাত্মক ভুলের অন্যতম, যা তাঁর পতনকে তরান্বিত করেছিলো।
এতদিন ধরে সেনাবাহিনী দূরে বসে কেবল লক্ষ্য করেছিলো, বাঙ্গালী জাতির সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন কিভাবে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছিলো। এতদিনে তারা ঐ দুঃখজনক বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। তারা তা করতে চায়নি। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ রাজনীতিকদের একগুঁয়েমী থেকে অনিবার্য কারণেই দেশকে রক্ষা করাকে দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব বলে মনে করলো। এভাবেই সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে টেনে আনা হলো যার ফলশ্রুতিতে ঘনিয়ে এলো মুজিবের ধ্বংসের প্রহর।
প্রধানমন্ত্রীত্বের বিরাট দায়িত্বে থেকেও তাঁর ক্ষমতার মোহ কাটেনি। আরও বেশী ক্ষমতা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসার পরিকল্পনায় মুজিব মত্ত হয়ে উঠলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ফ্রান্স/আমেরিকান কায়দায় রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের প্রবর্তন করবেন, তিনি তাই করলেন এবং ভয়ানক পন্থায়।
প্রথমে, তিনি দেশব্যাপী ‘জরুরী অবস্থা’ ঘোষণা করলেন ২৮শে ডিসেম্বর, ১৯৭৪ইং তারিখে। জনগণকে সকল মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেন। তাঁর কোন কাজে যেন কোর্ট বাদ সাধতে না পারে, সেজন্যে তিনি কোর্টের সকল ক্ষমতা খর্ব করলেন। তারপর তিনি জাতীয় সংসদে তার সর্বময় ক্ষমতার পক্ষে সকল আইন পাস করিয়ে নিলেন। জাতীয় সংসদকে দিলেন কেবলই একটা উপদেষ্টার মর্যাদা আর তার হাতে সকল ক্ষমতার উৎস’ হিসেবে বিরাজ করার বিষয়টি আইনসিদ্ধ করে নিলেন।
এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ সকল পরিবর্তনে রাবার স্ট্যাম্প প্রদানের কাজ শেষ করলো। বন্দী সংবাদপত্রের দল তাঁর অনুমোদনের জয়গানে তাল মিলালো। চাটুকারের দল খুশীর চিৎকারে ফেটে পড়লো। শেখ মুজিব তাঁর এ কর্মকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যা দিলেন। তাঁর মতে, ‘এ বিপ্লব শোষণ আর অন্যায় থেকে দুঃখী মানুষের মুক্তি বয়ে আনবে।’ তিনি ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হলেন।’ মাত্র তিন বছরের মধ্যে একজন মহান পার্লামেন্টারিয়ান প্রবল পরাক্রমশালী একনায়কে রূপান্তরিত হলেন। সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজ হাতে কেন্দ্রীভূত করে, সর্বসাধারণের সকল সমালোচনা আর বিরোধিতাও যেন নিজের উপর টেনে নিয়ে এলেন। এক্ষণে আর মন্ত্রী, সরকারী কর্মচারী আর দলীয় লোকদের উপর নিজের দোষ ‘ট্রান্সফার’ করার সুযোগ রইলো না। এত বড় একজন চতুর রাজনীতিবিদের জন্যে এটা ছিলো এক মারাত্মক ভুল।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে কয়েকজন যুব আর্মি অফিসার এমন এক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে যা, পরবর্তীতে শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডকে সরাসরি প্রভাবাম্বিত করেছিলো। ঢাকা লেডিজ ক্লাবে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে মেজর ডালিম আর তার সুন্দরী সহধর্মিণীকে নিয়ে ঐ ঘটনার সূত্রপাত। শেখ মুজিবের ডান হাত এবং রেডক্রসের চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার ভাই, মিসেস ডালিমের উপর কিছু আপত্তিকর মন্তব্য করে। বাদানুবাদের এক পর্যায়ে গাজীর ভাড়াটে গুন্ডাবাহিনী যোগ দেয় এবং দম্পতিটিকে বেইজ্জতি করে। এমন কি, ঐ ঠগিদের দল তাদেরকে (দম্পতি) ‘কিডন্যাপ’ করার প্রচেষ্টা চালায়। ঘটনা শুনে ডালিমের সহকর্মী আর্মি বন্ধুরা এর একটা দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বিলম্ব না করে তাদের সৈন্য-সামন্তের একটা দল সঙ্গে নিয়ে ওরা দু’টি ট্রাকে ভর্তি করে ঐ গুন্ডাবাহিনীর তালাশে বেরিয়ে পড়ে এবং সবশেষে গাজী গোলাম মোস্তফার বাংলো তছনছ করে তাদের অপারেশনের সমাপ্তি টানে।
উভয় পক্ষ থেকেই শেখ মুজিবের কাছে বিচার যায়। শেখ মুজিব একটি মিলিটারী পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করে অফিসারদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার জন্যে বিচারের ব্যবস্থা করে। এতে ২২ জন যুবা অফিসারকে চাকুরীচ্যুত করা হয় কিংবা জোরপূর্বক অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। এদের মধ্যে মেজর ডালিম, মেজর নূর আর মেজর হুদাও ছিলো। এতে করে যুবা অফিসারদের মধ্যে শেখ মুজিবের উপর একটা দারুণ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, যার পরিণাম হয়েছিল অত্যন্ত মারাত্মক।
কিন্তু ঐ সময়ে মুজিবের জীবনের উপর যে গুরুত্বপূর্ণ হুমকিটা ঝুলছিলো তা ঠিক সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নয়। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা দিক থেকে তার পরিষ্কার আভাষ ভেসে আসছিলো।
ঘটনাচক্রে মাও পন্থী সিরাজ শিকাদার ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি একটা এলাকা থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।
জাকারিয়া চৌধুরীর মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানোর জন্যে। শেখ মুজিব তাকে তাঁর আয়ত্তে আনতে চাইলেন। কিন্তু শিকদার কোন রকম আপোষ-রফায় রাজী না হলে, মুজিব পুলিশকে ‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ গ্রহণ করতে বলে দিলেন।
জাকারিয়া বললো, সিরাজ শিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেসকোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঐ সময়ে সরকারী প্রেসনোটে বলা হয় যে, ‘পালানোর চেষ্টা কালে’ সিরাজ শিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায় যে, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিষ্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো। সিরাজ শিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারা শহরে রটে গেলো। ১৯ বছরের যুবতী শামীম, তাঁর ভাই-এর হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সে আমাকে বলেছিলো, ‘আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলভার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।’ শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের জন্যে ‘প্রেসিডেন্ট পুরস্কার’ লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।
শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন। সে স্মৃতিচারণ করে বললো, ‘আমি ভয়ানক বেপরোয়া হয়ে উঠছিলাম।’ ‘আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে আমার গুলির দূরত্বের ভেতরে আনতে পারলাম না।’ ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশ চলে যায়।
১৯৭৪ সালের জুলাই মাস। মেজর ফারুক ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার্স-এর ব্র্যাভো স্কোয়াড্রন নিয়ে ডেমরায় চলে আসে। শেখ মুজিবের নির্দেশক্রমে এক নাটকীয় ‘পরিচ্ছন্ন অভিযান’- এর অংশ হিসেবে ফারুকের পোস্টিং হলো সেখানে। কয়েকদিনের মধ্যেই ফারুক ডাকাত দলের ‘আড্ডাখানা’ বলে পরিচিত নারায়ণগঞ্জ রোডের আশপাশের এলাকা একেবারে পরিচ্ছন্ন করে ফেলে। ঐ এলাকার ত্রাস সৃষ্টিকারী ‘ডাকাত সর্দার’ এক বিশ বছরের যুবক। নিজেকে সে একজন আওয়ামী লীগার বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। ফারুক তাকে গ্রেফতার করলে, সে পরিষ্কার ভাষায় স্বীকার করে যে, এ যাবত সে মাত্র ২১ (একুশ) জনকে নিজ হাতে দুনিয়া থেকে বিদায় করে পরপারে পাঠিয়ে দিয়েছে। ফারুক পরে আমাকে বলেছিলো, ‘আমি তাকে এ কাজ করার কারণ জিজ্ঞেস করলে, সে তার ‘ওস্তাদের’ নির্দেশে তা করেছে বলে জানায়।’ ‘ঐ বদমায়েশের ওস্তাদ স্বয়ং শেখ মুজিব। সুতরাং তার কীইবা আমি করতে পারতাম?’ যুবকের ঘটনাটি মেজরকে সাংঘাতিকভাড়ে নাড়া দেয়। ‘আওয়ামী লীগারদের যথেচ্ছা কর্মকাণ্ডে যে কোন রকমের ‘এ্যাকশান’ নিতে গেলেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এক বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো। সেনাবাহিনী বিভিন্ন জায়গা থেকে চোরাচালান, মজুতদারী, হত্যা ইত্যাদির অভিযোগে শত শত লোককে গ্রেফতার করে। কিন্তু ঢাকা থেকে একটা টেলিফোনেই ঐ সকল লোকজন ‘বেকসুর খালাস’ হয়ে যেতো।
ফারুক জানালো, সে একটা লিখিত নির্দেশ পায়। ঐ নির্দেশে বলা হয় যে, সে কাউকে গ্রেফতার করলে, তার নিজ দায়িত্বেই তা করতে হবে। কোন অঘটন ঘটে গেলে, তার জন্যে তার রেজিমেন্টাল কমান্ডার কিংবা ব্রিগেড কমান্ডার কেউই দায়ী হবে না। ফারুক বললো, ‘এর অর্থ ছিল এ রকম যে, আমাদেরকে অনাচার, দুর্নীতি দূর করতে হবে।’ কিন্তু আওয়ামী লীগ দেখলেই থমকে দাঁড়াতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই এক দুঃখজনক ছেলেখেলায় পরিণত হয়েছিলো।
ঠিক ঐ সময়েই সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হলো—নক্সালদের মূল উৎপাটনের জন্যে। শেখ মুজিব নিজেই এই নির্দেশ প্রদান করেন। আসলে মুজিব চেয়েছিলেন, নক্সালদের নামে সিরাজ শিকদার আর কর্ণেল জিয়াউদ্দিনকে খতম করতে। ফারুক এ নির্দেশ পালনে উৎসাহী হতে পারলো না। সে ঐ ধরনের নির্দেশ পালন না করার সিদ্ধান্ত নিলো। সে বললো, ‘আমি মার্কসবাদীদের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলাম না।’ কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে অনুপ্রাণিত করছিলো তা হচ্ছে যে, ঐ ছেলেরা তো দেশের জন্যে যথেষ্ট করেছে। আদর্শগতভাবে তারা হয়তো ভুল পথে যেতে পারে—কিন্তু তারাতো দেশের কোন ক্ষতি করেনি। সুতরাং যখনই ফারুক তাদের কাউকে ধরতে পারতো, চুপিচুপি সে নিজেই তার মুক্তির ব্যবস্থা করে দিতো।
একবার টঙ্গীতে মেজর নাসের তিন ব্যক্তিকে আটক করে। এরা তিনটি খুনের আসামী ছিলো। নব বিবাহিত এক দম্পতি তাদের গাড়ীতে টঙ্গী যাবার পথে মোজাম্মেল নামে এক দুর্ধর্ষ আওয়ামী লীগার ও তার সহকর্মীরা তাদের উপর হামলা চালায়। গাড়ীর ড্রাইভার আর আরোহীকে (স্বামী) খুন করে তারা মেয়েটির উপর ধর্ষণ চালায়। তিনদিন পর মেয়েটির রক্তাক্ত লাশ একটা পুলের কাছে রাস্তায় উপর পাওয়া যায়।
মেজরের হাতে ধৃত এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত মোজাম্মেল, মেজর নাসেরকে তিন লক্ষ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলো। মোজাম্মেলের ভাষায়, ‘ব্যাপারটিকে সরকারী পর্যায়ে নেয়ার ব্যবস্থা করবেন না। আজ হোক, কাল হোক, আমাকে আপনার ছেড়ে দিতেই হবে। সুতরাং টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতে আপনার আপত্তি কেন?’ নাসের এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে মনে করে কোর্টে সোপর্দ করে। কিছুদিন পরই ঐ তিনটি নৃশংস খুনের আসামী মোজাম্মেলকে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে দেখে সকলেই বিস্মিত হয়ে যায়। সেনাবাহিনীতে ঘটনাটি আরও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ কান্ডটি শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপেই সম্ভব হয়েছিলো।
ঐ ঘটনাটি ফারুক আর তার সহকর্মীদেরকে চমকিয়ে দেয়। টঙ্গী তাদের জীবন নদীর বাঁক ঘুরিয়ে দেয়। ফারুক বললো, ‘আমরা এমন এক সমাজে বসবাস করছিলাম, যেখানে অপরাধীরা নেতৃত্বে দিচ্ছিলো। বাংলাদেশ যেন ‘মাফিয়ার’ কর্তৃত্বাধীনে চলে গেলো। আমরা সম্পূর্ণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠলাম। এখানে এমন এক সরকার কায়েম হয়েছিলো যে সরকার খুনের মতো জঘন্য কাজে শক্তি যোগাতো। আর এমন সব চরম কর্মকান্ড ঘটাতো যেগুলো থেকে ঐ সরকার, জনগণকে বাঁচানোর কথা ছিলো। তা আর চলতে দেয়া যাচ্ছিলো না। আমরা তাঁকে খতম করার সিদ্ধান্ত নিলাম।’
ঐ দিনই মেজর ফারুক শেখ মুজিবকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলো। সে স্মৃতিচারণ করে বললো, ‘আমি সাংঘাতিক উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ক্যাপ্টেন শরফুল হোসেনকে বলেছিলাম, ‘শরফুল’ এভাবে বেঁচে থাকা একেবারেই অর্থহীন। চলো, আমরা শেখ মুজিবকে এক্ষুণি খতম করে দিই।’
ফারুক তার মনের কথা ব্যাখ্যা করে চললো, ‘তোমার কি মনে পড়ে, শেখ মুজিবের ফিরে আসার খবর শুনে আমরা কিভাবে কান্নায় (খুশিতে) ভেঙ্গে পড়েছিলাম? তোমার কি মনে আছে, সমস্তটা দেশ, সবগুলো মানুষ খুশিতে পাগল হয়ে উঠেছিলো। এই মানুষটাকে প্রায় দেবতার আসনে বসানো হয়েছিলো।’ ১৯৭২ সালে তিনি যদি আমাদেরকে বলতেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা আওয়ামী লীগারদেরকে কিংবা ব্রিগেড কমান্ডারদেরকে ঘিরে ফেলো। আর তাদেরকে বেঁধে নদীতে ফেলে দাও।’ আমরা ঠিক তাই করতাম। কেন করতাম? কারণ, শেখ মুজিব তা করতে বলেছেন। কি জন্য করতে বলেছেন? এ প্রশ্নটি হয়তো কেউ করতো না। আমিও করতাম না। আমরা ভাবতাম, আমরা একটা দেশ পেয়েছি, একজন নেতা পেয়েছি। আমরা যে কোন কাজই করতে প্রস্তুত। কোন সমস্যাকেই আমাদের সমস্যা মনে হতো না। অথচ শেখ মুজিব জনগণের এ ধরনের অনুভূতিকে ধ্বংস করে দিয়ে শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ-এর জন্য দিলেন।
ফারুক বললো যে, টঙ্গীর ঐ ঘটনাটি তাকে বিদ্রোহী বানিয়েছিলো। সে বললো, ‘এরপর থেকে প্রমোশন, কোর্স, ক্যারিয়ার ইত্যাদির প্রতি আমার আর কোন মোহ রইলো না। আমি কেবল একটা জিনিসই সারাক্ষণ ভাবতাম- কিভাবে ‘এ সরকারের পতন ঘটানো যায়।’
এই সময়ে ফারুক তার ভায়রাভাই, মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত ছিল। মেজর রশিদ তখন বোম্বের নিকটবর্তী দেওলালীতে চৌদ্দ মাসের একটি গানারী স্টাফ কোর্সে অংশগ্রহণ করছিলো। রশিদের অবর্তমানে ফারুক অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কিংবা ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলো। ফারুক তার নাম উল্লেখ করেছিলো—কর্ণেল আমিন আহম্মেদ, মেজর হাফিজ, মেজর সেলিম, মেজর নাসির, মেজর গাফ্ফার, স্কোয়াড্রন লীডার লিয়াকত প্রমুখ। তাদের সকলেরই পরিকল্পনা ছিলো দীর্ঘমেয়াদী। কিন্তু ফারুক খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে উদ্গ্রীব ছিলো। কিন্তু রাজনীতির জন্যে সে নিজেকে অনেক কাঁচা বলে মনে করলো। সে ভাবলো, তার অনেক কিছু জানা প্রয়োজন। সে জন্যে তার অনেক পড়াশুনা করা প্রয়োজন বলে সে ঠিক করলো।
১৯৭৪ সালে শরৎকালে ফারুক কয়েক ডজন বই পড়া শেষ করলো। ঐগুলির মধ্যে চেগুয়েভেরার ডায়েরী, চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর কিছু বই, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যার উপর একটি থিসিস গুরুত্বপূর্ণ। মার্কসবাদী চিন্তাধারায় সে প্রভাবাম্বিত হতে পারলো না। মার্কসবাদ বাংলাদেশের জন্যে কোন সমাধান দিতে পারবে বলে তার মনে হলো না। বাংলাদেশের অবস্থার সঙ্গে কোন বইয়েরই সে মিল খুঁজে পাচ্ছিলো না।
ঐ সময় সে ইন্দোনেশিয়ার শোকার্নো উত্খাতের পরিকল্পনার কিছু রচনা পড়ার সুযোগ পায়। শোকার্নোর সঙ্গে মুজিব উৎখাতের পরিকল্পনার কিছু মিল খুঁজে পেয়ে ফারুক মুজিব হত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
সে স্মৃতিচারণ করে বললো, ‘আমি আমাকে জিজ্ঞেস করলাম, যদি মুজিবকে শোকার্নোর মত গদিচ্যুত করে একটি প্রাসাদে আটকে রাখা হয়? বক্তব্যটার উপর আমি নিজে নিজেই অনেকক্ষণ বিতর্ক করলাম। পুরো সেনাবাহিনী কিংবা দেশের সব মানুষ যদি আমাদের সঙ্গে থাকতো তাহলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু সংখ্যায় আমরা ছিলাম খুবই নগণ্য। আমরা যদি তাকে বন্দী করতাম, তাহলে তাঁর নামে অন্য একটা পাল্টা শক্তি আমাদেরকে সরিয়ে দিতো। আমি তাও জানতাম যে,তিনি ভারতের উপর সাংঘাতিকভাবে নির্ভরশীল। সব সময়ই একটা সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছিল যে, কেউ ভারতীয়দেরকে শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে ডেকে নিয়ে আসতো কিংবা ভারতীয়রা মুজিবের উৎখাতের ব্যাপারে প্রতিবাদ জানাতো, এমনকি তাকে সহায়তা করার জন্য তাদের সেনাবাহিনীকেই পাঠিয়ে দিতো। ঐ পরিস্থিতিতে তাকে মেরে ফেললেও কোন ফায়দা হতো না। কেননা, ইতিমধ্যেই দেশটা ভারতের অধীনে চলে যেতো।
ফারুক আরো বললো, ‘আমার তখন মনে হয়েছিলো, শেখ মুজিব মারা গেলে, দেশের ভেতরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না।’ অন্ততঃ ভারতের পতাকা উড়িয়ে দেশের ভেতরে প্রবেশ করার কোন হেতু থাকবে না। এক অর্থে, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করে তাঁর নিজ মৃত্যুর পরোয়ানাতেই যেন স্বাক্ষর দান করেছিলেন। আমরা তাকে শোকার্নোর মতো সরিয়ে রাখতে পারলাম না। আমার শুধু এটাই মনে হলো যে, এর কোন বিকল্প নেই। মুজিবকে মরতেই হবে।
মুজিব প্রায়ই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেড়াতে যেতেন। আর এই ভ্রমণের জন্যে তিনি হেলিকপ্টারকেই পছন্দ করতেন। ফারুক প্রথমে মুজিবকে হেলিকপ্টারে মারার পরিকল্পনা করেছিলো। স্কোয়াড্রন লীডার লিয়াকত তখন ফ্লাইট কন্ট্রোল অফিসার। ফারুক লিয়াকতকে অনুরোধ করেছিলো যে, যখন মুজিবকে নিয়ে হেলিকপ্টার আকাশে উড়বে, তার আগেই পিস্তলসহ সে সঙ্গে থাকবে। তারপর রেডিও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে মুজিবকে গুলি করে মারা হবে এবং মুজিবের মৃতদেহ সুবিধেজনক একটা নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তারপর তারা গন্তব্যস্থলের দিকে যেতে থাকবে যেন কিছুই ঘটেনি। ইতিমধ্যে ফারুক এবং অন্যান্যরা নীচে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ফারুক নিজেও একজন শৌখিন পাইলট। মুজিবকে হত্যা করার জন্যে এটাই সবচেয়ে সুবিধেজনক পরিকল্পনা বলে তার কাছে মনে হলো। কিন্তু পরে এই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়েছিলো। ইতিমধ্যেই ঢাকায় একটি গুজব বেশ রমরমা হয়ে উঠলো। শেখ মুজিব সংবিধান কিছু রদবদল করে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হবেন। এবং দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করবেন। অন্যান্যদেরকে না জানিয়ে ফারুক নিজে নিজে একটা বিরাট ‘অভিযান পরিকল্পনা’ তৈরী করতে লাগলো। তখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ১৯৭৪ সাল। মাত্র কিছুদিন আগে তারা মুজিবের হেলিকপ্টার হাইজ্যাক করার পরিকল্পনা বাদ দিয়েছে।
ফারুক সামরিক কায়দায় অগ্রসর হলো। প্রথমেই লক্ষ্যবস্তু সনাক্ত করে নিলো। অবশ্য, মুজিবই প্রথম লক্ষ্যবস্তু। তার জন্যে পরে হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন কিছু নাম সে ঐ তালিকায় সংযোজন করে নিলো। এদের মধ্যে ছিলেন——ফারুকের চাচা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও মনসুর আলী। অন্যদিকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। যথেষ্ট অনুসন্ধান এবং তাদের উপর লক্ষ্য রাখার পর ফারুক ঐ তালিকা আরও কমিয়ে নিয়ে আসে। শত্রুর পাতায় সে মাত্র তিনজনের নাম লিখে রাখলো। মুজিব, তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, আর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত। ওরা ছিলো শেখ মুজিবের সবচেয়ে কাছের এবং প্রভাবশালী লোক। ফারুকের শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো— এই তিনজনকেই মরতে হবে।
ঢাকার অভিজাত ধানমন্ডি এলাকাবাসীরা সাধারণতঃ রাত দশটায় আনন্দ-উল্লাস আর সম্ভোগে মেতে উঠে। তখন শীতকাল। প্রতিদিনই রাত দশটার কাছাকাছি সময়ে ময়মনসিংহ রোডের উপর একটি রিক্সা থেকে একজন বিষণ্ণ চেহারার লোক বেরিয়ে আসতো। লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে ৩২নং রোডের ভেতরে ঢুকে পড়তো। লোকটার গায়ে বুশ-শার্ট, পরনে লুঙ্গি আর পায়ে চপ্পল। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর ঠান্ডা বাতাসে বিশ্রামরত ঐ এলাকার গৃহভৃত্যদের থেকে লোকটাকে খুব একটা আলাদা মনে হতো না। একটামাত্র পার্থক্য ছিলো এই যে, ওরা ছিলো প্রাণ বাঁচানোর কর্মে ব্যস্ত আর এই বিষণ্ন লোকটা ছিলো ‘মৃত্যুর দূত।’ বিষণ্ণ মানুষের বেশে মেজর ফারুক রহমান ‘দোযখের শিকারী কুকুরের’ ন্যায় শেখ মুজিবের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো।
ফারুক কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না। সেজন্যে সে নিজেই শেখ মুজিবের গতিবিধি, তাঁর অভ্যাস, তাঁর কাজ, তাঁর খাবার জায়গা ইত্যাদি লক্ষ্য রাখছিলো। যাতে করে চূড়ান্ত মুহূর্তে সামান্য ভুলের প্রশ্নও না উঠে।
ফারুক যে আর্টিলারী ব্যবহার করার চিন্তা করেছিলো, তা নিয়ে সে বিরাট মুশকিল পড়ে গেলো। আর্টিলারী ব্যবহার করার ‘কৌশলগত পরিকল্পনা মানচিত্র’ তার কাছে ছিলো না। একটা মাত্র ঐ ধরনের মানচিত্র ছিলো সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে। ঐ মানচিত্র চেয়ে নেয়া, এমনকি ঐটার উপর এক পলকের দৃষ্টি ফেলাও যথেষ্ট সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে। এই ভেবে ফারুক বাংলাদেশ পর্যটন ব্যুরো থেকে একটা ‘গাইড বই’ নিয়ে, তাতে রক্ষিত শহরের ছোট একটা মানচিত্রকে কেন্দ্র করে নিজের পায়ে হেঁটে পদক্ষেপ মেপে মেপে দূরত্ব নিরূপণ করলো এবং আর্টিলারীর পজিশন নিজ পরিকল্পনায় স্থির করে নিলো। এতসব পরিশ্রম আর দারুণ দুশ্চিন্তার মাঝে তার দিন কটছিলো। অন্ততঃ দৈনিক তিনটা ভ্যালিয়াম-৫ না খেয়ে সে ঘুমুতে পারছিলো না। কিন্তু ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি ঠিকই তার সকল কৌশলগত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হয়ে গেলো। সে ক্যু-এর জন্যে তখন প্রস্তুত।
মেজর রশিদ তার গানারী স্টাফ কোর্স শেষ করে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া যাবার জন্যে আবেদন পেশ করে। ফারুক সঙ্গে সঙ্গেই রশিদকে লিখে পাঠালো, ‘ঢাকায় কি ঘটছে তুমি জান না’ এখনই তোমাকে আমার প্রয়োজন।
কোর্স শেষ করে রশিদ কাল বিলম্ব না করে মার্চের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে পৌঁছালো। ফারুক রশিদকে তার পরিকল্পনা খুলে বললো। রশিদ তাতে তার সম্মতি জ্ঞাপন করলো। দুই বন্ধুতে মিলে শেখ মুজিবকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনায় ডুবে গেলো।
একটা প্রশ্ন আমার মাথায় হঠাৎ উঁকি দিয়ে উঠলো, তারা ক্ষমতা দখল করার পর দেশের শাসনভার কিভাবে ভাগাভাগি করবে। এ ব্যাপারে রশিদকে জিজ্ঞেস করলে সে জবার দিলো, ‘যদি আমরা ক্ষমতায় যেতাম তাহলে, একজন অত্যন্ত ভালো সৈনিক হিসেবে ফারুক সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হতো’। এমনকি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও তার অধীনে রাখা হতো। আমি বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব ভার নিতাম।
‘তাহলে শাসন ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী কে হতো?’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। ‘আমরা ঠিক ক্ষমতায় যাবার জন্যে এটা করিনি। তাছাড়া, আমরা তা করলেও ঠিক হতো না।’ দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে রশিদ জবাব দিচ্ছিলেন।
‘তার মানে দেশ চালানোর যোগ্যতা তোমাদের কারুরই ছিলো না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
‘আসলে তা নয়, যথেষ্ট জনসমর্থনের দরকার ছিল আমাদের দুই মেজর প্রকৃতপক্ষে, এমন একজন লোককে খুঁজছিলো যে, শেখ মুজিবের না করা কাজগুলো করতে সক্ষম হবে। এই লক্ষ্যে তারা দু’জনেই শেখ মুজিবের চেয়ে যোগ্যতর একজন লোকের সন্ধান করছিলো।
এ প্রসঙ্গে ফারুক জানালো। আমাদের প্রথম পছন্দ ছিলো জেনারেল জিয়া। কারণ একমাত্র তাঁর উপর আমাদের মোটামুটি কিছুটা আস্থা ছিলো। এ ব্যাপারে অনেক জুনিয়র অফিসার জেনারেল জিয়ার সঙ্গে আলাপ করে দেখতে চাইলেও কেউ তাকে প্রস্তাব দিতে সাহস পায়নি। ফারুকই শেষ চেষ্টা করে দেখতে মনস্থ করলো।
জেনারেল জিয়া ছিলেন ফারুকের দশ বৎসরের সিনিয়র। পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক থাকাকালীন ফারুক তাকে দেখেছে। যথেষ্ট সুখ্যাতির অধিকারী জিয়া সেনাবাহিনীতেও খুব জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে একটা ভাল ধারণা ছিলো সকলেরই। ১৯৬৫ সালে তিনি দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশনপ্রাপ্ত হন। পরে তাকে ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সরিয়ে দেয়া হয়। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে তিনি কাজ করেছেন পাঁচ বছর। ১৯৬৬ সালে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ফিরে এসে, রাইনের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতেও জিয়া তিন মাস কাজ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙ্গালীদের উপর চড়াও হলে, চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করে জেনারেল জিয়া প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। পরে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ‘জেড’ ফোর্স গঠন করে আরো বেশী খ্যাতির অধিকারী হন। সে কারণেই দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর দ্রুত পদোন্নতি ঘটে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে কর্ণেল, ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছর অক্টোবর তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
ফারুক বলে, ‘ঐ সময় জেনারেল জিয়ার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ছিলো। আমার ইচ্ছে ছিলো, সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে দেশের শাসনভার তুলে নেয়ার অনুরোধ জানাবো।’
দেশের এই দুঃসময়ে জিয়ার মতো একজন নেতার দরকার বলে ফারুকের মনে হলো। তাই সে বহু চেষ্টায় জিয়ার সঙ্গে একটা সাক্ষাৎকারের বন্দোবস্ত করে নিলো।
ফারুকের ভাষায়, ‘আমি সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান এবং একজন মেজর জেনারেল- এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলাম।’ আমি যদি তাকে সোজাসুজি বলতাম, ‘আমরা দেশের প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করতে চাই, তাহলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে তাঁর পাহারাদার দিয়ে গ্রেফতার করে জেলে পুরতেন। আমাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ঐ ব্যাপারটির দিকে আসতে হয়েছিলো।
ফারুক বলে চললোঃ প্রকৃতপক্ষে আমরা দেশের দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি ইত্যাদি দিয়ে আলাপ করতে করতে ঐ পর্যন্ত পৌঁছালাম। আমি বললাম, দেশে একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। জিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি।’ আমরা আপনার সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনা করি।
ফারুকের মতে, জেনারেল জিয়ার উত্তর ছিলোঃ ‘আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তোমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি কিছু একটা করতে চাও, তাহলে তোমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এ সবের মধ্যে টেনো না।’
১৯৭৬ সালের জুলাই মাস। লন্ডনে মুজিব হত্যার উপর একটা টিভি অনুষ্ঠান করছিলাম। ফারুকের বলা কথা নিয়ে জেনারেল জিয়াকে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করলাম। জিয়া তা অস্বীকারও করলেন না—আবার স্বীকারও করলেন না। পরিবর্তে তিনি কোন প্রশ্নের জবাব দেয়া থেকে বিরত রইলেন। আমি পুনরায় জবাব পাবার প্রচেষ্টা চালালে, তিনি আমাকে বহু বছর ধরে দেশের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করলেন।
১৯৭৫ সালের মার্চ মাসেই ফারুক তার পরিকল্পনা কার্যকর করবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। এ সিদ্ধান্তের পেছনে তেমন কোন বিশেষ কারণ জড়িত ছিলো না। জেনারেল জিয়াকে ঐ অভ্যুত্থানে শরীক করতে না পারায় ফারুক ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছিলো। সে পরে স্কোয়াড্রন লীডার লিয়াকতকে অনুরোধ জানায়, যাতে সে কয়েকটি মিগ-এর সাহায্যে মুজিবের বাড়ীকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। ফারুক বললো, ‘আমি বাড়ীটা ঘিরে রাখবো আর তুমি তোমার মিগ দিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ লিয়াকত অনেকটা নিরাসক্তভাবে বলেছিলো, ‘ঠিক আছে, তাই হবে।’ ফারুক স্থির করলো সে মার্চের তিরিশ তারিখেই অভিযান পরিচালনা করবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলাপের জন্যে তৈরী হলো ফারুক। সে ভেবেছিলো যে, সবাই তার দুঃসাহসিক কর্মকান্ডে যোগ দেবে। কিন্তু না। সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলো, সে ছাড়া বাকী সবাই নিষ্ক্রিয়। ফারুক বললো, আমি আমার জীবনের প্রতি সবচেয়ে বেশী বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। মেজর হাফিজ, কর্ণেল আমিন এবং আহমেদ চৌধুরীর মতো আরো অনেকে শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিলো। ওরা সবাই খুব বড় বড় বুলি আওড়িয়েছিলো, রাতভর আলোচনা করে ‘এটা করবো ওটা করবো’ ইত্যাদি মন্তব্য করলো। কিন্তু যখন কাজের সত্যিকার সময় এলো, কেউই আর এগিয়ে এলো না। ঐ দিন অবশ্য শেখ মুজিবও দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন। সেদিন তার পিতা মারা যান।
ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতা ফারুককে মুজিব হত্যার ব্যাপারে অধিকতর সংকল্পবদ্ধ করে তুললো। শেখ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনা এখন থেকে ফারুকের নিজস্ব বিষয়ে রূপ নিলো। সেও বুঝে নিলো যে, কাজটা তাকে একাই করতে হবে। কিন্তু প্রথমদিকে তার উপর থেকে সন্দেহটা কাটিয়ে উঠতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিলো। ফারুক বললো, যাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ হচ্ছিলো, তাদের সবাই বলতে লাগলাম ব্যাপারটা ভুলে যেতে। তারা যেন ভাবে আমি ঠান্ডা হয়ে গেছি। সে জন্যে এ প্রসঙ্গে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা আমি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে যে আমি আর কিছু ভাবছি না এটা লোকজনকে বুঝাবার জন্যে ফরিদাকে নিয়ে প্রতিটা সামাজিক অনুষ্ঠানে, বনভোজনে এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যেতে শুরু করলাম।
বাংলাদেশের অবস্থা টল-টলায়মান। অথচ মুহূর্তের জন্যে হলেও ফারুক দম্পতি যেন ওসবের কোন খবরই রাখে না। ওরা যেন ঝামেলাবিহীন, এক সুখী দম্পতি। ইতিমধ্যেই ফারুক গোপনে মুজিবের চতুর্দিকে মাকড়সার জাল বোনা অব্যাহত রেখেছিলো।
এই কৌশলগত পরিকল্পনার জন্যে তার ৮০০ লোকের প্রয়োজন ছিলো। কারণ, রক্ষীবাহিনীকে ঠেকানো সহ অন্যান্য পথ বন্ধ করার জন্যে এই পরিমাণ সৈন্য তাকে সঙ্গে রাখতেই হবে। ফারুক অবশ্য চায়নি অপ্রয়োজনীয় রক্তপাত হোক। কিন্তু কিছু যাচাই- বাছাই করে সে ভেবে দেখলো অন্ততঃ ৩০০ লোক হলেও উদ্দেশ্য সাধনে তেমন কোন বেগ পেতে হবে না। ঐ পরিমাণ সৈন্য তার নিজের অধীনেই বর্তমান ছিলো। ১৯৭২ সালে ফার্স্ট বেঙ্গল ল্যান্সার্স-এর সংখ্যা সে নিজেই বাড়িয়েছিলো। পরে, সে ঐ সৈন্যদের মধ্য থেকে বাছাই করে কিছুসংখ্যক সৈন্য কমান্ডো স্টাইলে ট্রেনিং প্রদান করে। সেগুলোকে সে হান্টার কিলার টিম’ বলে ডাকতো। ওরা ছিল অত্যন্ত বিশ্বাসী, স্থায়ী এবং নীরব ধরনের। ফারুকের এ ধরনের ১৫০টি টিম ছিলো, যাদের উপর সে সব সময় নিশ্চিতভাবে নির্ভর করতে পারতো। এই সময়ে মেজর রশিদ এক বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হলো। ভারতের গানারী স্টাফ কোর্স সমাপনান্তে সঙ্গত কারণেই তাকে যশোহরের গানারী স্কুল বদলি করে দেয়া হলো। এতে করে সৈন্যদের উপর তার কমান্ড কার্যকরী না হবার পন্থায় পড়ে গেলো সে। তবু, শেষনাগাদ এক মাসের ছুটি নিয়ে রশিদ তাদের পরিকল্পনার উপর কাজ করার জন্যে ঢাকায় রয়ে গেলো।
সে সেনানিবাসে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনায় যোগ দিলো। রশিদ এক পর্যায়ে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার, কর্ণেল শাফাত জামিলের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ তুলে দিলো। বাংলাদেশে কি পরিমাণ নৈরাজ্য বিরাজ করছিলো তা নিয়ে কথা হতে হতে শাফাত জামিল রশিদকে জিজ্ঞেস করে বসলোঃ ‘হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, আমরা কি করবো?’ রশিদ মুহূর্তের মধ্যে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে নিয়ে কর্ণেলকে বললো, ‘না স্যার, আমি তা বলছি না।’ আপনার নির্দেশ ছাড়া কি আমি কিছু করতে পারবো। আর যাই হোক, ‘আপনি আমার ব্রিগেড কমান্ডার।’ রশিদের টনক নড়লো। সে তৎক্ষণাৎ ফারুককে সতর্ক করে দিয়ে বললো, ‘সাবধান, কোন অফিসারকে বিশ্বাস করো না। এখানে এমন অনেকে রয়েছে যারা দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। তখন আমাদের বিপদ হয়ে যাবে।’
ঐ সময়ে রশিদ কর্ণেল জামিলের সঙ্গে তার বদলির ব্যাপারে আলাপ করছিলো। কর্ণেল নিজ থেকেই রশিদকে ঢাকায় থেকে যেতে বলেছিলো। কিন্তু রশিদ তা বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু ঠিকই কর্ণেল শাফাত জামিলের অপ্রত্যাশিত সহায়তায় মেজর রশিদ আবার ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকাস্থ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে এলো।
ফারুক অত্যন্ত আনন্দিত হলো। দুই ভায়রাভাই মিলে অন্যান্যদের সাহায্য ছাড়াই তাদের পরিকল্পনা এগিয়ে নিতে পারবে। ২য় ফিল্ড আর্টিলারীর ছিল ৬টি ইতালীয় হাউইটজার, ১২টি যুগোশ্লাভীয় ১০৫ মিঃ মিঃ হাউইটজার এবং ৬০০ সৈন্য। ফারুকের ছিল ৩০টি টি-৫৪ ট্যাংক এবং ৮০০ সৈন্য। রশিদের আর্টিলারী এবং তার ল্যান্সার দিয়ে রক্ষীবাহিনী এবং শেখ মুজিবকে সাহায্যকারী যে কোন পদাতিক বাহিনীকে প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে ফারুকের দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো। এখন কেবল একটা সমস্যাই রয়ে গেলো। তা হলো কারো মনে সন্দেহ না জাগিয়ে এই দুটো শক্তিকে একত্রিত করতে হবে। রশিদ এর সমাধান নিয়ে এলো।
সেনাবাহিনীর সদর দফতরের নিয়ম অনুযায়ী বেঙ্গল ল্যান্সার্স মাসে দু’বার ট্রেনিং এক্সারসাইজ পরিচালনা করতে পারে। এই এক্সারসাইজের উদ্দেশ্য ছিল—অন্ধকারে সৈন্যদের নিজ নিজ অস্ত্রশস্ত্র বেছে নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত হবার কৌশল সম্বন্ধে সম্যক অবগত করা। ছয়মাস ধরে তাদের এই দুই বাহিনীর রাত্রিকালীন মহড়ায় মহল্লার সকলেরই ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রের গুলির আওয়াজ সহ্য হয়ে যাবে। কাজেই বেঙ্গল ল্যান্সার রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হলে কেউ সেটাকে সন্দেহের চোখে দেখার অবকাশ আর থাকবে না। মেজর রশিদ তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পেশ করে যে, তার আর্টিলারী ও বেঙ্গল ল্যান্সারের একত্রে ট্রেনিং-এর সুযোগ করে দেয়া প্রয়োজন। এতে করে দু’পক্ষই অনেক কিছু শিখতে পারবে। সেনাসদর এই প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত মনে করে অনুমতি দিলো। ফলে, ফারুকের ট্যাংক আর রশিদের আর্টিলারী একত্রিত হলো।
এই সময় ফারুক তার ভয়ঙ্কর উদ্দেশ্যের উপর স্বর্গীয় মঞ্জুরী সিদ্ধান্ত নিলো। ফারুক তাই চট্টগ্রামের হালিশহরে এক বিহারী পীরের নিকট উপস্থিত হলো। মুজিব হত্যার ব্যাপারে তার ভূমিকাও কম ছিলো না।
চট্টলার ঐ পাহাড়ী পীরের নাম আন্ধা হাফিজ। আন্ধা হাফিজ জন্মলগ্ন থেকেই অন্ধ। তিনি তাঁর ধর্মপরায়ণতা আর অতীন্দ্রিয় সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার দুর্লভ ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। তার বহু ভবিষ্যদ্বাণী নিষ্ফল না প্রমাণের কারণে তার ভক্ত অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিলো। ফারুকের শ্বশুর পক্ষও অন্ধ পীরের ভক্ত। ফারুক তাঁর সঙ্গে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলো। সুযোগও মিলে গেলো অচিরেই। ঐ সময়ে বেঙ্গল ল্যান্সারের জন্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর অদূরে দু’দিনের ‘রেঞ্জ ফায়ারিং’-এর সিডিউল পড়লো। ফারুক ২রা এপ্রিলেই আন্ধা হাফিজের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলো।
ফারুকের হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্ধ পীর অনেকক্ষণ ধরে কি যেন ভাবলেন। ফারুক কি যেন একটা কাঁপুনী তার হাতে অনুভব করতে পারছিলো। ফারুকের মনের কথা পীরকে বলার আগেই আন্ধা হাফিজ বলে উঠলেন, ‘আমি জানি, তুমি ভয়ঙ্কর একটা কিছু করতে যাচ্ছ। করতে চাও কর, তবে মনে রেখো, আমি তোমাকে যে নীতি অনুসরণ করতে বলছি, তা যদি তুমি পালন না কর, তাহলে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।’ তিনি তারপর, ফারুককে বিশ্বস্ততার সঙ্গে অবশ্যই তিনটা নীতি মেনে চলতে নির্দেশ দিলেনঃ (১) আল্লাহ আর ইসলামের জন্যে ছাড়া ব্যক্তিগত লাভের জন্যে কিছু করবে না। (২) শক্তি অর্জন কর। (৩) সঠিক সময় বেছে নাও। তিনি মেজরকে আরও তিনমাস অপেক্ষা করার পরামর্শ দিলেন।
ফারুক বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলো। স্বর্গীয় ইঙ্গিতের সঙ্গে যেন তার ধারণা অলৌকিকভাবে মিলে গেলো। আন্ধা হাফিজের নির্দেশিত তিনমাস অপেক্ষার পর যে সময় আসছে তা ফারুকের নিজের নির্ধারিত ‘অভ্যুত্থানের উৎকৃষ্ট সময় এর সঙ্গে টায়টায় মিলে গেলো। তার মন বলছিলো, ঐ সময়ে কাজ করতে গিয়ে সে ব্যর্থ হতে পারে না।
৭ই জুন, ১৯৭৫ সাল। শেখ মুজিব কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করলেন। তিনি মনে করলেন দেশের প্রশাসনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিরাট বিজয় লাভ করেছেন। এই ব্যবস্থা বাস্তবে বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করে এবং দেশের রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক সর্বময় ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ন্যস্ত হয়। তিনি ১৯৭২ সালে অভিষিক্ত প্রধানমন্ত্রিত্বের ক্ষমতার চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান হয়েছিলেন একথা ঠিক জোর দিয়ে বলা যায় না। তখনও অবশ্য তার প্রতিটি কথাই আইন আর প্রতিটি ইচ্ছাই নির্দেশে পরিণত হয়েছিলো। অদ্ভুত ঘটনাবহুল তাঁর সাড়ে তিন বছর শাসনমলে জনপ্রিয়তা দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছিল। যার কারণে তিনি অধিকতর ক্ষমতার অধিকারী হয়ে একনায়কতন্ত্র কায়েমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন।
ফাঁকা বুলি উড়িয়ে তিনি এবং তাঁর শাসনযন্ত্র—এ পরিবর্তনকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করলেন। প্রকৃতপক্ষে, এটা ছিলো এক ধরনের ‘প্রাসাদ ষড়যন্ত্র’ যা দেশ থেকে মূল্যবোধ, গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার আর গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গলাটিপে হত্যা করেছিলো।
মুজিব শুরু করলেন প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় তাঁর নিজের মাঝে ক্ষমতার ফোয়ারা সৃষ্টির কাজ। ঐ বছরই জানুয়ারী মাসে জাতীয় সংসদে পাস হয়ে গেলো সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী। এই সংশোধনীর বলে মুজিব পার্লামেন্টের উপর ক্ষমতাসীন হলেন আর দেশে একনায়কতন্ত্রই কেবল নাজিল করলেন না, তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েমেরও ক্ষমতা পেয়ে গেলেন।
শেখ মুজিবের উক্ত ব্যবস্থার ফলে সকল বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকান্ডের দরজা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। বাকশালের সদস্য না হয়ে কারও পক্ষে কোন ধরনের রাজনীতি করার আর সুযোগ রইলো না।
১৯৭৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে বাকশাল-এর শাসন ব্যবস্থা কায়েম হবার কথা ছিলো। ইতিমধ্যেই শেখ মুজিব একেবারে সর্বনিম্ন স্তর থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত দলীয় কাঠামো এবং বিভিন্ন স্তরের নির্বাহী ও কার্যকরী কমিটিসমূহ গঠনের কাজও সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন। শেখ মুজিব নিজেই প্রেসিডেন্ট ও দলীয় চেয়ারম্যান রয়ে গেলেন। রাজনৈতিক দিকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাঁর নিকটতম লোকদের নিয়ে একটি ১৫ সদস্য বিশিষ্ট নির্বাহী কমিটি গঠন করেন। সেখানে ক্ষমতাশালী তিনজন পার্টি সেক্রেটারির মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনিও ছিলো।
তারপরের পর্যায়ে ছিলো ১১৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় কমিটি। তার নীচে ছিলো ২১ থেকে ৩২ সদস্য বিশিষ্ট ৫টি কমিটি যা শ্রমিক, কৃষক, যুবক, ছাত্র আর মহিলাদের নিয়ে কাজ করার কথা। সবগুলি কমিটির প্রত্যেকটি সদস্যই স্বয়ং শেখ মুজিব কর্তৃক নিয়োজিত। এইভাবে ৬১টা জেলার জন্যেও ৬১ জন গভর্ণর মুজিব নিয়োগ করলেন। জেলা গভর্ণরগণ বাংলাদেশ রাইফেলস, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ এবং ঐ এলাকায় অবস্থিত সেনাবাহিনী ইউনিটের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিলো।
এ সবই প্রমাণ করে যে বাকশাল ছিলো শেখ মুজিবের আর এক রাজনৈতিক খেলার চমক- -এতে দেশ পুনর্গঠনের কোন উদ্দেশ্যই নিহিত ছিলো না। ‘বাকশাল’ সৃষ্টিই হয়েছিলো মুজিবের সকল বিরোধিতার অবসান ঘটাতে। হচ্ছিলোও তাই। ধারালো নখর সমৃদ্ধ প্রসারিত বাঘের ভয়াল থাবার মতো বাকশাল এদেশের প্রতিটি মানুষের মাথার উপর এক বিভীষিকার মতো বিরাজ করছিলো। সেই বাঘের ঘাড়ে চড়ে বসেছিলেন শেখ মুজিব। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর ঐ ভয়ঙ্কর ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষা ১৯৭৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পূর্ণ হতো। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গণতন্ত্রের সমূলে ধ্বংস সাধন আর এক ব্যক্তির শাসনের বিরুদ্ধেও কোন রকম গুরুত্বপূর্ণ গণপ্রতিবাদ-এর সূচনা হলো না। চতুর্দিকে তাঁর চাটুকারের দল এই ‘দ্বিতীয় বিপ্লবকে’ স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির এক বিরাট পদক্ষেপ বলে মাঠে-ময়দানে চমৎকার বক্তৃতা দিতে থাকে। এমনকি পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দও মন্তব্য করে, ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাকশালের সদস্য হয়ে কাজ করার সুযোগ পেলে, আমরা গর্বিত বোধ করবো।’ শেখ মুজিব এতে খুশী না হয়ে পারেন কি করে?
২১শে জুলাই ১৯৭৫ সাল। ঢাকায় আয়োজিত এক সভায় শেখ মুজিব মনোনীত জেলা গভর্ণরদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখলেন।
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তিনি তাদের উদ্দেশ্যে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘আজ বাকশাল সদস্যদের সতর্ক থাকার কারণ হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের জনগণ খুব বেশী প্রতিক্রিয়াশীল। তারা তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। এই কথা তোমাদের মনে রাখা ভালো। তোমরা সারা জীবনভর নিবেদিত প্রাণ কাজ করে যাবে। যদি তোমরা একটা ভুল কর, তাহলে তোমরা বাংলাদেশের মাটি থেকে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এইটা বাংলাদেশের আইন।’ দুর্ভাগ্যক্রমে, শেখ মুজিব নিজেই তাঁর সতর্কবাণী কর্ণপাত করলেন না। এরই মধ্যে তাঁর ভ্রান্তির পাহাড় সৃষ্টি হয়ে গেলো।