অষ্টম অধ্যায় – মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ

৮. মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ

আমি টয়লেট গেলাম। সেখানে বসে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্যে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম।

-খন্দকার মোশতাক আহমেদ

.

সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিট।

একটা ট্যাংক পেছনে নিয়ে রশিদের জীপ ঢাকার আগা মসিহ লেনের একটি বাড়ীর সামনে এসে থেমে যায়। বাড়ীটি খন্দকার মোশতাক আহমেদের। বাড়ীটি পুরনো ফ্যাশনের তিনতলা দালান। ছোট্ট একটু জায়গার মধ্যে আরও অধিক পুরনো বাড়ী দ্বারা ঘেরা ছিলো এটি। ট্যাংকের বিকট গর্জনে ইতিমধ্যেই চারিদিকের পাড়া-প্রতিবেশীর জেগে উঠেছে। শত শত মানুষ এর আগেই ডালিমের মারাত্মক বেতার ঘোষণা শুনে হতচকিত হয়ে উঠেছিলো। ঐ অবস্থায় একটা ট্যাংক তাদের সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে, নাটকের পরবর্তী দৃশ্য অবলোকন করার জন্যে প্রচুর লোকের ভিড় জমে গেলো। সকলেই যার যার সুবিধেমত—কেউ জানালার ফাঁকে, কেউ ছাদের উপরে, কেউবা অন্য পথে নীরবে লক্ষ্য করছিলো। কিন্তু কেউ ট্যাংকের ধারে কাছেও আসতে সাহস পেলো না।

মোশতাক তাঁর উপরতলার বেলকনি থেকে ট্যাংক কামানের বিষাক্ত মুখ তাঁর বাড়ীর দিকে তাক করা দেখতে পেয়ে আঁতকে উঠেন। মুহূর্তের মধ্যেই রশিদ অত্যন্ত আলুথালু অবস্থায় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসতে লাগলো। হাতে একটি স্টেনগান আর পেছনে দু’জন সশস্ত্র সৈনিক।

মেজর রশিদ কিন্তু তার পূর্ববর্তী তিনটি আলোচনা সভায় তাকে শেখ মুজিবের স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারটি মোটেই গোপন রাখেনি। কিন্তু খন্দকার মোশতাক অন্য একজন রাজনীতিককে পুরোপুরি বিশ্বাস করার মতো অতটা কাঁচা লোক নহেন। তাছাড়া, ঐ রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে একজন সামরিক অফিসারকে বিশ্বাস করার তো প্রশ্ন উঠে না। ডালিমের বেতার ঘোষণার পর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে, তার উপরে আবার ট্যাংকের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে মোশতাক অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর মনে বিভিন্ন রকমের দুশ্চিন্তা উঠানামা করছিলো। পাল্টা অভ্যুত্থানে তাকে সরিয়ে দেয়ার পর মোশতাক ১৯৭৫-এর ১১ ও ১২ই ডিসেম্বর দু’টি দীর্ঘ সাক্ষাতকারে আমাকে ঐ ঘটনাবলীর পূর্ণ বিবরণ প্রদান করেছিলেন।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাকে হত্যা করতে এসেছিলো কি-না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তাদের হাতে ছিলো অস্ত্র এবং তাদেরকে অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো। ওরা কি করে, তা দেখার জন্যে আমি ওদের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার দিকে তাদের বন্দুক তাক করার পরিবর্তে তাদের দু’একজন আমাকে স্যালুট দিতে লক্ষ্য করে আমি কিছুটা হালকা বোধ করলাম। সুতরাং আমি সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনারা কি মনে করে এ পর্যন্ত এসেছেন?’ আর যাই হোক না কেন, মোশতাক একজন ভালো অভিনেতা।

রশিদ মোশতাককে জানায় যে, সে তাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের জন্যে নিতে এসেছে। এ কারণে তাকে এখন রেডিও স্টেশনে যেতেই হবে। শব্দগুলো মোশতাকের কানে যেন মধু বর্ষণ করছিলো। তবু তাঁর মনে একটা সন্দেহ রয়েই গিয়েছিলো। তখনও রশিদকে তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি তাকে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মেজরকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমরা যাব কিভাবে? আমরা কি আপনার জীপে চড়ে যাব, না কি আমার গাড়ীতে করে যাব?’ এ প্রশ্নের উদ্দেশ্য ছিলো যে, তিনি কি সসম্মানে তাঁর গাড়ীতে চড়ে যেতে পারবেন, না সামরিক জীপে বন্দী হয়ে যাবেন। রশিদ মোশতাককে বললো, গাড়ীর ড্রাইভারের উপর বিশ্বাস করা গেলে, তারা গাড়ীতেই যেতে পারেন। এখন মোশতাক আরও একটু স্বস্তি পেলেন। তারপর মোশতাক মেজরকে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমাকে একটু সময় দিতে হবে। আমার সামান্য একটু কাজ বাকী আছে। তারপর আমাকে আমার কাপড়-চোপড় পরতে হবে।

তিনি বলছিলেন, ‘আমি টয়লেটে গেলাম। সেখানে বসে পরবর্তী পরিস্থিতির জন্যে মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। টয়লেটে বসে আমি চিন্তা করার কিছুটা সময় পেয়েছিলাম।’

তারা সবাই গাড়ীর কাছে নেমে এলেন। মোশতাকের মনে তখনও কিছুটা সন্দেহ বিরাজ করছিলো, তিনি রশিদকে আরও একবার পরীক্ষা করে নিচ্ছিলেন। তিনি আমাকে জানান, ‘গাড়ীর দরজা কে খুলবে এ নিয়ে আমি কিছুটা গড়িমসি করছিলাম। ওরা যে আমাকে ফাঁকি দিচ্ছে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম। আমাকেই যদি দরজা খুলে গাড়ীর উঠতে হয়, তাহলে এর অর্থ হবে এই যে—ওরা আমাকে আসলে হত্যা করতে নিয়ে চলেছে। আর যদি দরজাটা আমাকে কেউ খুলে দেয়, তাহলে বুঝে নেব যে, ওরা আমাকে সসম্মানে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম।’

সমস্যা মিটে গেলো। একজন সৈন্য চৌকসভাবে এক স্যালুট দিয়ে গাড়ীর দরজা খুলে দিলো এবং অত্যন্ত নম্রভাবে আমাকে গাড়ীর ভিতরে বসার ইঙ্গিত করলো। মোশতাকের সন্দেহ ছুটে গেলো। তিনি জানান, ‘এটা ছিলো একটা আশ্চর্য নাটক।’

রেডিও স্টেশনে যাবার পথে মোশতাক দেখতে পেলেন যে, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে জনগণের মাঝে তেমন কোন দুঃখের বহিঃপ্রকাশ নেই। এতে তিনি আরও স্বস্তি পেলেন। তিনি বললেন, ‘জনগণকে শোকাহত মনে হচ্ছিলো। কিন্তু কিছু লোককে উল্লাসে চিৎকার করতেও দেখা গেছে।’

রেডিও স্টেশনে পৌঁছে মোশতাক তাঁর মাঝে আস্থা ফিরে পেতে থাকলেও তাঁর মনের কোণে একটা ভীতি তখনও উঁকি দিচ্ছিলো। মেজরেরা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিবের স্থলে তাকে বসালেও তিন বাহিনী প্রধান আর সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে তাঁর মনে একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। তিনি জানতেন যে, তাদেরকে কব্জা করতে না পারা পর্যন্ত তাঁর পুরো নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। সুতরাং তিনি রশিদকে বললেন যে, তিন বাহিনী প্রধানকেও এখানে নিয়ে আসতে হবে। রশিদ এটাকে একটা ভাল প্রস্তাব বলে মনে করলো। খন্দকার মোশতাককে তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে রেখে সে ক্যান্টনমেন্টের দিকে রওয়ানা দিলো। তথ্যমন্ত্রী ঠাকুর তখন মোশতাকের বেতার ভাষণ চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত। ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে রশিদ দেখতে পায় চীফ অব জেনারেল স্টাফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্ণেল শাফাত জামিল এবং আরো কিছু ঊর্ধ্বতন অফিসার সেখানে আলাপ করছে। সে চীফ অব জেনারেল স্টাফকে ট্যাংকের জন্যে কিছু গোলাবারুদ সরবরাহ করতে অনুরোধ জানালে সে সানন্দে রাজী হয়ে যায়। খালেদ মোশাররফ রশিদকে আরো আশ্বাস দেন যে, সে তাদের হয়ে তিন বাহিনীর প্রধানের সমর্থন আদায়ে সহযোগিতা করবে। আধা ঘন্টার মধ্যে সে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ, এয়ার ভাইস মার্শাল এ, কে, খন্দকার আর কমোডর এম, এইচ, খানকে নিয়ে এসে হাজির হলো। তাদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর উপ-স্টাফ প্রধান, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানও এলেন।

তিন বাহিনী প্রধানকে রশিদ তাদের কৃতকর্মের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয় এবং ঐ ব্যাপারে তাদের সহযোগিতা কামনা করে। সে তাদেরকে বলে, ‘আমরা দেশের বৃহত্তম স্বার্থেই তা করেছি।’ ‘আমরা আপনাদেরকে ত্যাগ করছি না এবং আমরা ক্ষমতায়ও যেতে চাচ্ছি না। আমরা বরং আপনাদের নেতৃত্ব চাই। সুতরাং আপনারা রেডিও স্টেশনে আসুন এবং যা কিছু করণীয় করুন।’

ফারুক যেমনি ধারণা করেছিলো, ঠিক তেমনি তা সত্যে পরিণত হলো। মুজিবের মৃত্যুর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই জেনারেলরা এক কাতারে এসে দাঁড়ালো। ঐ পরিস্থিতিতে কেউ মেজরদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সাহস পেলো না।

পরের পরিস্থিতি সম্বন্ধে খন্দকার মোশতাক আমাকে বিশদ বিবরণ প্রদান করেন, ‘আমি একজন উকিল।’ আমি জানি কিভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলতে হয়। আমকে যেহেতু দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়া হচ্ছিলো, সে জন্যে আমিও সামরিক বাহিনীর আনুগত্য আদায় করতে চাইলাম। সুতরাং আমি জেনারেল শফিউল্লাহর দিকে তাকিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম, ‘আমাকে বলুন, এ কাজ কি আপনি করেছেন?’ শফিউল্লাহ বেকায়দায় পড়ে গেলো। তার সামনেই ছিলো শেখ মুজিবের হত্যাকারী মেজরবৃন্দ। জীবনের ভয়ে সে পিছাতেও পারছিলো না। সুতরাং সে আস্তে আস্তে আমাকে বললো, ‘হ্যাঁ, আমরাই তো করেছি।’ তারপর একে একে আমি অন্য বাহিনীর প্রধানদেরও ঐ একই প্রশ্ন করলাম। তারাও ঠিক একই উত্তর দিলো। আমি বুঝতে পারছিলাম, ‘তারা সবাই অত্যন্ত ভীত- সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। এছাড়া ওদের আর কোন উপায়ও ছিলো না।

মোশতাক বলেই চললেন, ‘আমি তারপর তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম’ : ‘আপনারা আমাকে দিয়ে কি করতে চান?’ তারা আমাকে বললোঃ ‘আপনি দয়া করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করুন। এখন বাংলাদেশে আপনিই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব।’ ‘আমি তাদেরকে বললাম, আমি একজন বেসামরিক গণতন্ত্রমনা লোক। আমি ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারি এই শর্তে যে, আমার সরকার হবে একটি বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকার। আপনারা এতে মাথা ঘামাতে পারবেন না।’ (বিশ্বাসঘাতকতা, গুপ্তহত্যা, আর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে সরকারের গোড়াপত্তন, সে সরকারকে গণতান্ত্রিক সরকার-এর মর্যাদা দিতে গিয়ে তিনি কি বুঝাতে চাইছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করে আমি ঐ পরিস্থিতিতে মোশতাককে বিব্রত করতে চাইনি)।

মোশতাক বললেন, জেনারেলরা পাশের একটি কামরায় চুপিচুপি আলাপ করতে চলে গেলো। আধা ঘন্টা পরে তারা ফিরে এসে তাদের সম্মতি জ্ঞাপন করলো। তারপর তিনি একে একে সবাইকে নিয়ে তার সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করিয়ে বেতারে প্রচার করে দেন। ১১টা ১৫মিনিটে যখন তিনি তাঁর নিজের ভাষণ প্রচার করেন, তখন পুরো পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। মেজররা তাকে প্রেসিডেন্ট বানালেও তিনি তাদের ক্রীড়নক হতে চাননি।

প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাঁর প্রথম বেতার ভাষণে তিনি শেখ মুজিবের সমালোচনা করেন এবং সস্তা জনপ্রিয়তা লাভের জন্যে জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু প্রতারণামূলক কথা উচ্চারণ করেন। তিনি এই হত্যা আর অভ্যুত্থানকে ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনে’ করা হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সকলেই এই শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিলো। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে পরিবর্তন সম্ভব ছিল না বলেই সরকার পরিবর্তনে সেনাবাহিনীকে এগিয়ে আসতে হয়েছিলো। সেনাবাহিনী জনগণের জন্যে সুযোগের ‘স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে।’ মোশতাক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এও প্রতিজ্ঞা করেন যে, এই সরকার কখনও কোন ধরনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি কিংবা সামাজিক অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করবে না।’ কিন্তু তিনি সত্যের অপলাপ করেছিলেন। কারণ, হত্যার মত জঘন্যতম অপরাধের সঙ্গে তিনি আপোষ করে চলেছিলেন।

বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারেও খন্দকার মোশতাক জনগণের সঙ্গে শঠতার পরিচয় দেন।

ডালিমের ঘোষণায় ঐদিন সকাল বেলায় প্রত্যেকেই বিশ্বাস করে নিয়েছিলো যে, বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হবে। ফারুক, রশিদ দু’জনেই তা চাচ্ছিলো।

বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠিত করার নামে শেষ পর্যন্ত জনগণকে ঠকানোর দোষে মোশতাক নিজেই দোষী।

ঐদিন সকাল বেলায় ডালিমের বেতার ভাষণ থেকে প্রত্যেকেই ধারণা করেছিলো যে, বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়ে গেছে। ফারুক আর রশিদেরও ঠিক একই রকম ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু মোশতাক তাঁর মনে অন্য চিন্তা লুকিয়ে রেখেছিলেন। তিনি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি পাল্টাতে চাইলেন না। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তিনি অত্যন্ত সুচতুরভাবে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্তই জনগণের কাছে ঘোষণা করা থেকে বিরত রইলেন। এর পরিবর্তে তিনি প্রত্যেককে বোকা বানিয়ে তাঁর ভাষণের শুরুতে আল্লাহর নামটি জুড়ে দেন এবং ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে শেষ করেন। তাঁর ভাষণে আগাগোড়ায় বিভ্রান্তি আর প্রতারণার ছাপ ছিলো। ভাষণের পরে ৮৫% ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত দেশের জনগণের মনে একটা ধারণার জন্ম নিলো যে, দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হতে যাচ্ছে। তিক্ত সত্যটি তারা পরে জেনে ফেলেছিলো। বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়নি। শেখ মুজিবের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার আর তাঁর আভ্যন্তরীণ উদ্দেশ্য সাধনের ঘোষণা অপরিবর্তিত থেকে যায়। মোটকথা, প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগের ঐতিহ্যই বহন করে চলছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে খন্দকার মোশতাক তাঁর অবস্থান মজুবত করে নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে অভিযোগ তোলার আর সময় ছিলো না।

বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের একটা ভাল অংশ বৃটেনে বসবাস করে। বৃটেনবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের ভাষণ একটা সাংঘাতিক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। ডালিমের প্রথম ঘোষণায় বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার কথা শুনে সেখানকার ধার্মিক মুসলমানেরা অত্যন্ত উল্লসিত হয়ে উঠে। কিন্তু খন্দকার মোশতাক-এর বেতার ভাষণের মূল বিষয়টি জানার পর তারা নিতান্তই হতাশ হয়ে পড়ে। ভাষণের ব্যাখ্যা চেয়ে শত শত টেলিফোন কল লন্ডনের বাংলাদেশী দূতাবাসকে অতিষ্ঠ করে তুলে।

তাদের একজন ডেপুটি হাই কমিশনার ফারুক চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করে, ‘বাংলাদেশ কি ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে, না কি হয়নি?’ ডেপুটি হাই কমিশনার জানায় যে, তা ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়নি। তখন অত্যন্ত দুঃখ করে ঐ লোকটি বলে, —এটাই যদি হবে, তবে আপনারা শেখ মুজিবকে হত্যা করেছেন কেন?’

মোশতাকের বিভ্রান্তিকর ভাষণে বাংলাদেশীরাই কেবল বিব্রত হয়নি। দেশটিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্ররূপে ঘোষণা দেয়ার প্রশ্নে সৌদি আরবও বিব্রত বোধ করে। তারা বাংলাদেশের জনগণের জন্যে বহুবার শুভেচ্ছাবাণী পাঠালেও প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি দান স্থগিত রাখে। কারণ, তাদের ধারণা ছিলো, মুসলমান জনগণের জন্যে একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হওয়া উচিত।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। তিনি পরে শেখ মুজিবের ভ্রাম্যমান দূত নিয়োজিত হয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ১৯৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে বাদশাহ ফয়সালের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভার আলোকে তিনি আমাকে সৌদি আরবের অবস্থানের ব্যাখ্যা দেন।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর মতে, ধর্মনিরপেক্ষতা সংক্রান্ত বাংলাদেশ সংবিধানের আর্টিকেলে কি বুঝানো হয়েছে তার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন বাদশাহ ফয়সল। তিনি এমনভাবে বিষয়টা বর্ণনা করলেন, যা বাদশাহ সোলায়মানকেও অভিভূত করতে পারতো। ‘আমি বাদশাহকে বলেছিলাম যে, আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিভিন্ন সময়ে এই বিশেষ আর্টিকেলটার সূত্র ধরে বলেছি যে, এতে ধর্মহীনতা বুঝানো হয়নি। এর মানে এই যে, বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী সকল লোককে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সমান অধিকার দেয়া হবে। অর্থাৎ তারা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে। তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা করতে পারবে এবং তাদেরকে তাদের জীবনযাত্রায় সমান অধিকার দেয়া হবে। যেহেতু কেবল একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্ম ছাড়া ভিন্ন ধর্মাবলম্বী অতএব, রাজন্ আপনি বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ধরে নিতে পারেন।’

বিচারপতি চৌধুরী বলে যেতে লাগলেনঃ ‘ক্ষণিকের জন্যে মনে হয়েছিলো যে, বাদশাহ ফয়সল বুঝি আমার যুক্তিতে প্রভাবাম্বিত হয়েছেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি বললেন, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটি বাদ দিয়ে দেশটিকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করলে তিনি খুশী হবেন। তিনি অন্য একটা আর্টিকেলের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বলেন যে, ‘সংখ্যালঘুদের উপর কোন প্রকার উৎপীড়ন করা হবে না—বাক্যটিই তো তাদের সুরক্ষার জন্যে যথেষ্ট।’ বাদশাহ ফয়সলকে বোকা বানানো সম্ভব হলো না। তিনি ‘ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে’ স্বীকৃতি প্রদান করতে সম্মত হলেন না। কিন্তু বাদশাহ খালেদের নেতৃত্বে সৌদি আরব যখন শুনতে পেলো, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং দেশটিকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তখন তারা বাংলাদেশের জন্যে বহুদিনের অস্বীকৃত-স্বীকৃতি নিয়ে এগিয়ে আসেন। বিচারপতি চৌধুরী, মোশতাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে কি ধরনের বাক্যজালের সৃষ্টি করে তা আদায় করেছিলেন, সে আমার জানা নেই। তবে এটা সত্যি যে, নূতন প্রেসিডেন্ট দেশটির ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্রটির কোন পরিবর্তন সাধন করেননি।

খন্দকার মোশতাক তাঁর পরিকল্পনা মত কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রথমেই তিনি সামরিক শাসন জারি করে সারাদেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্যে কার্ফিউর নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু তাহলে কি হবে? এখানেও তিনি সাধারণ মানুষের ধার্মিক চেতনায় একটু রস লাগানোর ব্যবস্থা করলেন। তিনি একটুখানি কষ্ট স্বীকার করে হলেও শুক্রবারে জুম্মার নামাজ আদায় করার সুযোগের জন্যে তিন ঘন্টা সময় কার্ফিউ শিথিল করেন। তারপর তিনি একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করেন। দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এতে শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠ লোকদেরকে বাদ দেন। নূতনদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আর ডঃ এ, আর, মল্লিক। ডঃ মল্লিক ফারুকের মামা এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ডঃ মল্লিককে অর্থমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। নতুন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজনকে বরখাস্ত করেন এবং তাদেরকে বদলির তালিকায় নিক্ষেপ করেন। মোশতাক, গাজী গোলাম মোস্তফা আর আবদুস সামাদ আজাদসহ অনেক রাজনীতিবিদকে আটক করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে সাক্ষাতকারে মিলিত হন। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন নূতন শাসনের গুণগানে মত্ত হয়ে উঠে ।

পালা বদলের জন্যে চাটুকারদের কোন পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন হয়নি। মোশতাক আহমেদকে অভিনন্দন জানানোর জন্যে প্রেসিডেন্ট ভবনে চাটুকারদের ভিড় জমে উঠে। এমন কি যে-কোন একজন মেজর পেলেও তাকে অভিনন্দিত করতে ওরা ছাড়তো না। অভিনন্দন বাণী সম্বলিত টেলিগ্রাম আর পত্রাদি চতুর্দিক থেকে প্রচুর পরিমাণে আসতে শুরু করলো।

শেখ মুজিবের জন্যে এক ফোঁটা চোখের পানিও কেউ ফেললো না। মওলানা ভাসানী কয়েক মাস আগেই কেবল শেখ মুজিবের দ্বিতীয় বিপ্লবের প্রতি তার সর্বাত্মক সমর্থনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। এক্ষণে তিনি সময় ক্ষেপণ না করে খন্দকার মোশতাকের সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। বৃটেনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ আবদুস সুলতানও তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে।

ঢাকার ধানমন্ডিতে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রমাণাদি মুছে ফেলার জন্যে খন্দকার মোশতাক অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শেখ মুজিব, সেরনিয়াবাত আর শেখ মনি’র পরিবারের সবাইকে নীরবে বনানী গোরস্থানে কবরস্থ করার বন্দোবস্ত করা হয়। কেবল শেখ মুজিবের লাশ একটি বিমান বাহিনী হেলিকপ্টারে করে তাঁর নিজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার তাঁর পরিবারিক গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরের মতে, অভ্যুত্থান আর তাঁর হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু গ্রামবাসী মিলে শেখ মুজিবের পৈতৃক বাড়ী লুট করে। সম্ভবতঃ এটাই তাঁর সর্বশেষ অবমাননা।

খন্দকার মোশতাক আহমেদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত করে ফারুক এবং রশিদ সেনা সদরে ফিরে গিয়ে যোগদান করতে চাইলে, তাদেরকে যোগদান করতে দেয়া হলো না। সামরিক কমান্ডাররা তাদেরকে ভয় পাচ্ছিলো। খন্দকার মোশতাক এই সমস্যার সমাধান করেন। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যে তিনি দুই মেজরকে সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার ব্যবস্থা করেন।

শেখ মুজিবকে উৎখাতের ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক মেজরদেরকে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন। এখন আবার তিনি তাদেরকে সুরক্ষার বন্দোবস্ত করলেন। কিন্তু এতসব করলেও তাঁর পূর্বসুরির মতো তিনিও মূলতঃ সকল সামরিক বিষয়াদির প্রতি অবিশ্বাস আর অপছন্দ মনে মনে দৃঢভাবে পোষণ করতেন। তিনি নিজেও একজন গোড়া আওয়ামী লীগার ছিলেন। তিনি পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্যে তিনি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনকালে তিনি সামরিক বাহিনীকে তলিয়ে দেয়ার জন্যে নিবিষ্ট চিত্তে চেষ্টা করেন।

কিন্তু তাকে তার ‘পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়।’ এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিলো, সেনাবাহিনী স্টাফ প্রধানের পদটি নিয়ে। রশিদ আর ফারুক, সেনাবাহিনী প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর পরিবর্তে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছিলো। পরে, মোশতাকের সমর্থন না থাকলেও, তারা তাদের পছন্দমত বিমান বাহিনীর প্রধান হিসেবে অন্য একজনকে নিয়ে আসে। এই লোকটির নাম গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব। তোয়াব কলকাতায় প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের একজন ঊর্ধ্বতন বিমান বাহিনীর অফিসার হিসেবে কাজ করে। তোয়াব ঐ সময়ে অবসর গ্রহণ করে তার জার্মান বংশোদ্ভূত স্ত্রীকে নিয়ে মিউনিখে বসবাস করছিলো। রশিদ তাকে নিয়ে আসার জন্যে জার্মানীতে যায়।

মোশতাক দু’টি কারণে জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান হিসেবে নিয়োগ করতে অনীহা পোষণ করেছিলেন। প্রথম কারণ ছিলো; জিয়ার প্রতি তাঁর অবিশ্বাস। দ্বিতীয়ঃ অন্যান্য সিনিয়র আর্মি অফিসারদের ব্যতিক্রম হিসেবে জিয়া তাঁর সৈনিকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। এইটা ছিলো, মোশতাকের জন্যে একটা অসহনীয় ব্যাপার। কারণ, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এই ধরনের কমান্ডারকে অবশ্যই একজন সম্ভাব্য বিপদজনক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গণ্য করতে হবে। সুতরাং তিনি তাঁর পক্ষে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থাটাই অবলম্বন করলেন। তিনি জিয়াকে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিয়োগ করলেন। কিন্তু তাঁর অবস্থান সঠিকভাবে সুদৃঢ় রাখার বন্দোবস্ত করে নিলেন। তিনি তাঁর নিজের বাছাই করা একজনকে দিয়ে জিয়ার কার্যকারিতা চুল্লিতে উঠানোর ব্যবস্থা করেন।

রশিদ সেনাবাহিনীর সকল ব্যাপারে প্রেসিডেন্টকে উপদেশ প্রদানের কথা। কিন্তু তিনি রশিদকে না জানিয়েই তিন বাহিনীর প্রধানে উপরে কর্তৃত্ব করার জন্যে একটি পদ সৃষ্টি করেন। ঐ পদের নাম দিলেন—ডিফেন্স স্টাফ প্রধান। ডিফেন্স স্টাফ প্রধান হিসেবে তিনি বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে নিয়োগ করেন। মেজর জেনারেল এরশাদ তখন ভারতের একটা স্টাফ কোর্সে নিয়োজিত। তাকে চার মাসের মধ্যে দ্বিতীয় প্রমোশন দিয়ে জিয়ার ডেপুটি নিয়োগ করা হয়। পদোন্নতির দিক দিয়ে জিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে জিয়ার অধীনে চীফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবেই রাখা হলো। এই সকলের ঊর্ধ্বে ‘পাপা টাইগার’ বলে পরিচিত জেনারেল এম, এ, জি, ওসমানীকে তাঁর প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে স্থাপন করলেন। ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্ণেল ইন চীফ এবং তাকে তিনি সবচাইতে বেশী বিশ্বাস করতেন বলে প্রতীয়মান হতো।

প্রকৃতপক্ষে মোশতাক উল্টো পথেই চলছিলেন। তাঁর কার্যকলাপের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে দুঃখভরে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর পরে আমাকে বলেছিলো : ‘প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি দুর্ব্যবহারের দিক দিয়ে মোশতাক শেখ মুজিবকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চতুর এবং ধূর্ত। তিনি একজনকে আর একজনের পেছনে লাগিয়ে রাখতেন। এমনকি সরকারী আমলাদেরও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছিলেন।’ ঐ সময় জেনারেল জিয়া উপস্থিত ছিলেন। তিনিও তার কথার সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন।

২৬ শে সেপ্টেম্বর মোশতাক এক অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে শেখ মুজিবের হত্যাকারীদেরকে তাদের কৃত অপরাধ থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। এই অধ্যাদেশটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ‘দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫’ নামে একটি অসাধারণ গেজেট নোটিশে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় স্বাভাবিকভাবে প্রচার করা হয়নি। কারণ, পত্র-পত্রিকায় এ খবর প্রকাশ হয়ে গেলে, জনসাধারণের মাঝে এক প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারতো।

এই গোপন আইনটির মাধ্যমে মেজরদের সকল প্রকার অপরাধকে পরিপূর্ণভাবে ক্ষমা করে দেয়া হলো। কেবল তাই নহে, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত পরিকল্পনা, কুমন্ত্রণা, হত্যা ইত্যাদি সকল কাজের জন্যে মেজরবৃন্দ এবং তাদের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে ‘বেকসুর মাফ করে দেয়া হলো। যারা এই নূতন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা, একটা জাতির জনক আর তাঁর পরিবারের ২১ জন সদস্যকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তাদের জন্যে গোপনে ক্ষমা ঘোষণা আসলেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যাপার।

খন্দকার মোশতাক যেভাবে শেখ মুজিবের বুকের তাজা রক্তের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেঁটে এসে গদিতে বসেন। সেই অবস্থায় অবশ্য কেউ প্রত্যাশা করেনি যে, তিনি শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার করবেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া স্পষ্টতঃই একটা আলাদা ব্যাপার। আমাকে পরে বলা হয়েছিলো যে, কেবল রশিদ আর ফারুকই এই আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। কূটতার্কিক মোশতাক, নিজেও তাঁর চলার পিচ্ছিল পথে একটা ছোট্ট খুঁটি হিসেবে এই কর্মটির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

তিনি তো বেশ সুচতুরভাবেই অনেককে ‘নিরাপত্তা সনদ’ প্রদান করলেন। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের জন্যে ঐ ‘নিরাপত্তা সনদে’ স্বাক্ষর করেছিলেন কি-না, তা আমার জানা নেই। তবে নিশ্চিত সত্য যে, এই অধ্যাদেশের শর্তগুলো ঐ কর্মকে নিয়মানুগ করতে গিয়ে ব্যাপক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।

হত্যাকারীদের ক্ষমা ঘোষণা, ফারুক আর রশিদকে প্রমোশন দিয়ে লেঃ কর্ণেল-এ উন্নীতকরণ এবং সর্বোপরি, ৩রা অক্টোবর এক বেতার ভাষণে তাদেরকে ‘সেনাবাহিনীর সূর্যসন্তান’ বলে প্রশংসার যে বন্যা বইয়ে দেন তাতে সেনাবাহিনীর মনোবল আর শৃঙ্খলায় ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে। পরিষ্কার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো যে, বিদ্রোহ, ধ্বংস, হত্যা সেনাবাহিনীর অফিসার আর জোয়ানদের জন্যে অনুমোদনযোগ্য। কেবল ধরা না পড়লেই হলো। এসব কারণেই পরবর্তীতে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান আর সাত বছর পরে চট্টগ্রামে জেনারেল জিয়াউর রহমানের হত্যাও সংঘটিত হয়।

প্রথম বেতার ভাষণে খন্দকার মোশতাক অনেক লম্বা লম্বা বুলি আওড়ালেও গদিতে আসার দশ দিনের মধ্যেই তাঁর তেমন কোন অবদান ছিলো না বললেই চলে। তবে, একটা অবদান অবশ্য উল্লেখযোগ্য। তিনি তাঁর পরিহিত কালো নেহেরু টুপি’কে ‘জাতীয় মাথার পোশাক’ হিসেবে ঘোষণা দেন।

সে যাক, এই সময়ের মধ্যেই মোশতাক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার সম্ভাব্য সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেয়ার ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি হিসেব কষে দেখলেন যে, আসল হুমকি সেনাবাহিনীকে বাদ দিলে, আসছে তাঁরই পুরনো পার্টি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ বিরোধী দলীয় শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে বলে তিনি মনে করলেন। সুতরাং যখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে, দেশ শেখ মুজিবের হত্যাকে গ্রহণ করে নিয়েছে, তখনই আর বিলম্ব না করে মুজিবনগর সরকারের চারজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বকে পাকড়াও করার বন্দোবস্ত পাকা করে ফেললেন। ঐ চারজন হচ্ছে—তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামান। এখানে আবারও মোশতাক তাঁর স্বভাবজাত ছল-চাতুরির আশ্রয় নিলেন যাতে করে জনগণের আক্রোশ তাঁর উপর নিপতিত না হয়।

মনসুর আলী তখনও প্রধানমন্ত্রী। তাকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো হলো। খন্দকার মোশতাক সেখানে তাকে উচ্ছ্বাস ভরে গ্রহণ করেন। অথচ টেলিভিশনে যখন এই উচ্ছ্বাসভরা আন্তরিকতার ছবি জনগণকে দেখানো হচ্ছে, তখন বেচারা মনসুর আলীকে ঠেলে নিয়ে সংগোপনে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান আর তাজউদ্দিন আহমেদ-এর ভাগ্যেও তাই ঘটলো।

এই চার নেতা জেলে থেকে এক ‘আকস্মিক ষড়যন্ত্রের’ শিকার হয়। এই ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতেই মাত্র দু’মাস পরে এই জেলখানার ভেতরেই তাদেরকে পৈশাচিকভাবে খুন করা হয়।

খুন করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফারুক বলে যে, শেখ মুজিবকে ওরা যেভাবে উৎখাত করেছে, সেভাবে খন্দকার মোশতাকও তো উৎখাত হতে পারে। ঐ অবস্থায় ভারতের সহায়তায় কোন পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে গেলে, জেলের চার নেতার যে-কোন একজনকে টেনে এনে পাল্টা সরকার গঠনের ব্যবস্থা করা হবে। সুতরাং তাদেরকে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করাটাই ওরা নিরাপদ বলে মনে করে।

খন্দকার মোশতাক তাঁর গ্রামের বাড়ী ধোসপাড়ায় বেড়াতে গেলে ফারুক আর রশিদ মিলে এই পরিকল্পনা তৈরী করে।

ওরা একমত হয় মোশতাককে হত্যা করা হলে কিংবা একটা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটলে অবিলম্বে দু’টো কাজ করতে হবে। প্রথম কাজ হবে—প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরকারের শূন্যতা পূরণের জন্যে সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়াতে হবে। একই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে একটা ‘জল্লাদ বাহিনী’ দ্রুত কেন্দ্রীয় কারাগারে ছুটে গিয়ে তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী আর কামরুজ্জামানকে হত্যা করবে। হত্যা করার কাজটি দেয়া হলো ফারুকের তিন থেকে পাঁচ সদস্যের একটি ‘জল্লাদ বাহিনীর’ উপর। ওরা এই ধরনের কাজের জন্যে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এইটি ছিলো রিসালদার মুসলেহউদ্দিনের দল। এরাই ১৫ই আগস্টে শেখ ফজলুল হক মনিকে খতম করে এসেছিলো। এইভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পৈশাচিক নরহত্যার জঘন্য পরিকল্পনাটি চূড়ান্ত করা হয়।

তাৎক্ষণিক পরিকল্পনাটি বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিলো যেন তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করে। —ফারুক মত প্রকাশ করে। তার কথাই সত্যে পরিণত হয়েছিলো। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুত্থান পরিচালনা করলে ঐ জঘন্য পৈশাচিক পরিকল্পনাটি জঘন্যতম পরিণতির মানসে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে কার্যকরী করা হয়।

৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সাল। শেখ মুজিবের হত্যার পর মাত্র তিনটি সপ্তাহ অতিবাহিত হয়েছে। একজন অতিশয় করিৎকর্মা মধ্যবয়সী বাঙ্গালী অত্যন্ত চমৎকার একেবারে নিখাদ ‘সিল্কের আচ্ছাদন’ আর সাদা চুরিদার পায়জামা পরে পাকিস্তানের রাজধানী, ইসলামাবাদ থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছেছে। নাইটস্ত্রীজের এক অত্যন্ত ব্যয়বহুল হোটেল তার আস্তানা। টাকাটা তার কাছে কোন ব্যাপারই নহে। নাম তার মাহমুদ আলী। সে এক বিশেষ মিশনে লন্ডনে এসেছে। তার নিশ্চিত বিশ্বাস – বিজয়ের মালা তার গলায় পড়তে বাধ্য। কাজটা হলো—বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলীন করে, পাকিস্তানের পুনঃএকত্রীকরণ।

প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিশেষ দূত মাহমুদ আলী বাংলাদেশের নূতন শাসকের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করার উদ্দেশ্যেই এখানে তার আগমন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানী জেলখানা থেকে মুক্তি দেয়ার সময়ে মিঃ ভুট্টো তাঁর কাছে যে প্রস্তাব রেখেছিলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সেই বিশেষ ‘লিংক’ রক্ষার ব্যাপারে খন্দকার মোশতাক আহমেদ কতটা অগ্রগামী তা যাচাই করাই ছিলো তার বিশেষ দায়িত্ব।

মাহমুদ আলীর পরিকল্পনা তার গুরু, মিঃ ভুট্টোর চিন্তা-ভাবনাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। আমার সঙ্গে ঐ হোটেলে এক সাক্ষাতকারে সে বলেছিলো : ‘বাংলাদেশের জাতীয় বিষয়বস্তুর অবশ্যই বিলুপ্তি ঘটাতে হবে।’

একজন পুরনো মুসলিম লীগার হিসেবে পাকিস্তানে বসবাসকারী অন্যান্য বাঙ্গালীদের মতো, মাহমুদ আলীও বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারেনি। যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিলুপ্তি ঘটানোর জন্যে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো। সে অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে পাকিস্তানের পুনঃএকত্রীকরণের জন্যে সম্ভব সবকিছু করছিলো। চার বছর ধরে ‘জোঁকের’ মতো লেগে থেকে তার মতে, ‘সে আসল কার্যসিদ্ধির প্রকৃত সময় পেয়ে গিয়েছিলো। সে বিরামহীনভাবে ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলো এবং অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে মহত্তম সংবাদটি পাওয়ার প্রত্যাশায় প্রহর গুণছিলো।’

মাহমুদ আলীর এতো বেশী আনন্দের অবশ্য কারণও ছিলো। খন্দকার মোশতাকের পররাষ্ট্র নীতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কিছু মন্তব্য,

বিশেষ দূত হিসেবে পীর মোসলেহউদ্দিন (দুদু মিঞা)-কে পাকিস্তানে প্রেরণ, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কোলাবরেটর—শফিউল আজম, তোবারক হোসেন, সালাহউদ্দিন, এ, বি, এস, সফদর-এর মত লোককে সরকারের সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থাপন ইত্যাদি বিষয়াদি মাহমুদ আলীকে অনুপ্রাণিত করার ব্যাপারতো বটেই। আর সে জন্যেই সে পাকিস্তানকে পুনঃএকত্রীকরণের ‘মহান কর্মে’ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিলো।

মাহমুদ আলী আমাকে বলেছিলো, ‘খন্দকার মোশতাক তাঁর অপক্বতার জন্যে দেশটাতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হলেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মোশতাক ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে যে পট পরিবর্তন ঘটে তা উল্টে দেবে।’ সুতরাং সে কিছু মধ্যস্থতাকারীর সাহায্যে মোশতাকের নিকট একটা ‘কনফেডারেশন’ গঠনের প্রস্তাব করে। এইটি তার মতে, বাংলাদেশ আর পাকিস্তানকে ‘একনামে এক পতাকাতলে’ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করবে। অন্যান্য সম্পর্কাদির বিশদ বিবরণ পরে সুবিধেজনক পর্যায়ে সঠিক করা যাবে বলে সে মত প্রকাশ করে।

মাহমুদ আলী অত্যন্ত আস্থাভরে বলেছিলো, ‘আমি খন্দকার মোশতাককে বলেছিলাম, অপেক্ষা করতে গেলে বিপদ চলে আসতে পারে, এক্ষণেই কাজটা করে নেয়া উচিত। আমি তার কাছ থেকে যা চেয়েছিলাম তা হচ্ছে কেবলই এ ব্যাপারে তার সম্মতির ঘোষণা। বিস্তারিত দিক-পাশ পরেই ঠিকঠাক করা যাবে।’

আমি মাহমুদ আলীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কি আসলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ১৯৭১-এ বাঙ্গালীরা তাদের কলিজায় চিরদিন বিধে থাকার মতে যে চমৎকার অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলো, তার পরেও কি তারা পাকিস্তান ফিরে যেতে চাইবে। তাছাড়া, আরও তো বিপত্তির বিষয় অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে বিরাজ করছে। ‘কনফেডারেশন’ গঠন করা হলে, সর্বশক্তির উৎস হিসেবে একটা কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ সৃষ্টির ব্যাপারটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। সেই ক্ষেত্রে হয় ভুট্টোকে, না হয় মোশতাককে সর্বশক্তির উৎস থেকে সরে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু দু’জনের কেহই এ কাজটি করতে চাইবে না। বড়ই মজাদার ঐ উৎসের জায়গা। আর দু’জনেই বহু ছল, বল আর কৌশলের মাধ্যমে ঐ অভীষ্ট লক্ষ্যে এসে পৌঁছে গেছেন। মাহমুদ আলী স্বীকার করেছিলো যে, আসলে ভুট্টোই পাকিস্তানের পুনঃএকত্রীকরণের পথে বিরাট বাধা।

ভুট্টোজীর আসলে এ ধরনের পুনঃএকত্রীকরণের কোন ধারণা মনে ছিলো না। মাহমুদ আলী যেই সময়ে লন্ডনে আমার সঙ্গে এই আলাপে রত, সেই সময়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আজিজ আহমেদ নিউইয়র্কে জাতিসংঘের জেনারেল এসেম্বলি সেশনে তার বাংলাদেশী প্রতিপক্ষকে বলছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে একটি নিবিড় সম্পর্ক প্রত্যাশা করে- এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের যা হতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে বেশী কিছু নহে বিচারপতি চৌধুরীর মতে, আজিজ আহমেদ বলেছিলো, ‘কিছু অতি উৎসাহী ব্যক্তি রয়েছে, যারা অনেক কিছু পেতে চায়, কিন্তু আমরা তাদেরকে উৎসাহিত করছি না। তাদেরকে বাধা দিয়ে রাখতে হবে।’

মাহমুদ আলী দীর্ঘ তিন সপ্তাহ ধরে লন্ডনে বসে অপেক্ষা করছিলো, কখন সেই সাংঘাতিক ঘোষণাটি ঢাকা থেকে চলে আসে। কিন্তু তা আর কখনও এলো না। স্পষ্টতঃই বাংলাদেশ থেকে কেউ তাকে ঐভাবে লটকিয়ে রেখেছিলো। ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিতে মোশতাক কখনই সাহস পাননি। খন্দকার মোশতাক এমন কিছু একটা করতে চাইলে, মেজর ফারুক আর রশিদ তাকে সঙ্গে সঙ্গেই খুন করে ফেলতো। ওরা অত্যন্ত কট্টর জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ দুই যুবক। ফারুক আমাকে বলেছিলো, ‘কেউ যদি বাংলাদেশকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে চাইতো, আমি সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা উড়িয়ে দিতাম।

এদিকে দেরিতে হলেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো। এতে মোশতাকের মনোবল কিছুটা চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কিন্তু তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সকল প্রচারযন্ত্রকে হার মানিয়ে মোশতাকের নীতিমালার প্রতি জনগণের ব্যাপক বিভ্রান্তি গুঞ্জরিত হতে লাগলো। একদিকে, কিছু পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন কথাবার্তা আর ইসলাম, ইসলাম বলে চুঙ্গা গরম করার প্রয়াস। অন্যদিকে, শেখ মুজিবের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ নীতিকে দু’হাতে শক্তভাবে ধরে রাখার অপপ্রয়াস। এই বৈপরিত্যপূর্ণ অদ্ভুত দিকটি ১৯৭৫ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর একটি সরকারী শ্বেত্রপত্রে তুলে ধরা হয়।

শেখ মুজিবকৃত ভুলকর্ম জনসমাজে তুলে ধরার উদ্দেশ্য নিয়ে, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যাবলী চিহ্নিত করার জন্যে খন্দকার মোশতাক একটি ‘অর্থনৈতিক টাস্ক ফোর্স’ নিয়োগ করেন। এই টাস্ক ফোর্স’ ১২ দিনের রেকর্ড সময়ের মধ্যে তাদের রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল করে। এতে কিছু অস্পষ্ট মোটা বুলি সন্নিবেশিত করা হয় এবং শেখ মুজিবের চারটি স্তম্ভকে ( গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা আর জাতীয়তাবাদ) রাষ্ট্রের চার মূলনীতি বলে ধরে নিয়ে রিপোর্টের বিভিন্ন দিক ও সমাধানের বিশ্লেষণ করা হয়। ‘ঐতিহাসিক প্রয়োজনে’ ক্ষমতায় এসে খন্দকার মোশতাক সরকারের প্রথম শ্বেতপত্রে শেখ মুজিবের নীতিমালাকেই জাঁকজমকভাবে জনগণের নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দেয়া হয়।

জনগণ হতবুদ্ধি হবে, এতে আর বিচিত্র কি আছে? এসব দেখে মেজররা দিন দিন অধিক থেকে অধিকতর দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছিলো। তাদের মনে জাগছিলো, ‘তাহলে শেখ মুজিবকে হত্যা করার কি দরকার ছিলো?’

৩রা অক্টোবর, ১৯৭৫ সাল। খন্দকার মোশতাকের শাসন ৫০ দিনে উন্নীত হয়েছে। মোশতাক ‘জনগণের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত’ রেডিও আর টেলিভিশনে ঘোষণা করেন। অত্যন্ত সুচতুরভাবে, প্রচুর সময় হাতে রেখে, তিনি ঘোষণা দেন যে, ১৫ই আগস্ট (১৯৭৬ সাল) থেকে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হবে। আর পার্লামেন্টারী সরকার গঠনের জন্যে ২৮শে ফেব্রুয়ারী (১৯৭৭ সাল) সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ধূর্ত রাজনৈতিক চালটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। এবং সকল রাজনৈতিক বন্দী মুক্তির সরকারী ঘোষণাটি আরও বেশী সমাদৃত হয়। মোশতাক সুষ্ঠভাবে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে কোন রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এখন আর কোন ‘আটকের হুলিয়া’ রইলো না।’ মোশতাক আরো একবার চরম মিথ্যার আশ্রয় নিলেন। অন্ততঃপক্ষে, তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী আর কামরুজ্জামানের মতো চারজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তালাবদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলো। তাদের খুব শিগগির মুক্তির কোন সম্ভাবনাবই জানা ছিলো না।

মোশতাক তাঁর ভাষণে, মেজরদেরকে সেনাবাহিনীর ‘সাহসী সূর্যসন্তান’ নামে আখ্যায়িত করে তাদের কাটা ঘায়ে মলম লাগানোর ফন্দি আটলেন। কিন্তু জনগণ তার গলাভরা বুলি প্রত্যাখ্যান করলো। গত সাত সপ্তাহ ধরে তারা ঐ সূর্যসন্তানদের কেবল কলঙ্কজনক দিকগুলোই শুনে আসছিলো। চাটুকার সভাসদের দল, দুর্নীতিবাজ আমলার দল, ব্যবসায়ী মহল সবাই শেখ মুজিবের হত্যার মাত্র কয়েক ঘন্টা পরেই আবার যার যার কাজে বসে পড়ে। তারা আসল ক্ষমতার উৎস খুঁজে পেয়েছিলো। ফারুক স্মৃতিচারণ করে বলে, ‘টাকা বাদ দিলেও, আমি লক্ষ লক্ষ ডলার এক সপ্তাহের মধ্যে হস্তগত করতে পারতাম। কিন্তু আমি ঐ বেটাদের চেহারাও দেখতে চাইনি।’ রশিদ নিশ্চিত করে বলে যে, অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত এমন কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার প্রচুর টাকা বানিয়েছে বলে তার কাছে খবর আছে।

আর্টিলারী আর ল্যান্সারের কিছু অফিসার, এমনকি জোয়ান আর এনসিও-রাও বাদ যায়নি। যে যেভাবে পেরেছে, দু’হাতে লুটেছে। সুতরাং ফারুকের ‘বিপ্লব’ সরকারী শাসনযন্ত্র নির্মল করার মহান অভিযান—বিশেষ করে শেখ মুজিবকে হত্যা করার আসল উদ্দেশ্য, তার মতে, ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিলো।

ফারুক আর রশিদের আরো কিছু চিন্তার ব্যাপার ছিলো। প্রথমতঃ মোশতাক তাদের কথায় কান দিচ্ছিলেন না। তাদের যে-কোন পরামর্শ তিনি ‘আমলাতন্ত্রের গোলক ধাঁধায়’ ফেলে দিতেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে।’ কিন্তু সেগুলো নিশ্চিতভাবে নথির ভেতরে কবরস্থ হয়ে যেতো। দ্বিতীয়তঃ ফারুক আর রশিদকে দূরে রেখে ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সকল গৌরব মোশতাক আর তাহেরউদ্দীন ঠাকুর নিজেরাই নিতে সচেষ্ট ছিলেন। অথচ, ফারুক আর রশিদ এ জন্যে জনগণের স্বীকৃতি মনে-প্রাণে কামনা করছিলো।

‘হঠাৎ করেই মোশতাক আর তাহেরউদ্দীন ঠাকুর নায়ক বনে গেলো, অভিযোগ করে ফারুক।’ রশিদও একমত। ‘খন্দকার মোশতাকের আমাদের প্রতি অন্ততঃ কিছুটা কৃতজ্ঞ থাকা উচিত ছিলো। কেননা, আমরাই তাকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্যে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। তিনি তো তরতাজা রাজনীতিবিদ। বিশ্বাসঘাতকতা তাদের স্বভাব আর তা রক্তে মিশে আছে। তিনি কখনও সোজা পথে চলতেন না।’

দশ পৃষ্ঠার এক দলিলে তাদের কৃতকর্ম আর উদ্দেশ্যকে বিধৃত করে জনগণকে জানিয়ে দিতে মনস্থ করলো দুই মেজর। কিন্তু মোশতাক, তাদের প্রচারণাকে খুব সুন্দর চোখে দেখতে পারলো না। তিনি কায়দা করে পরামর্শ দিলেন যে, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর মেজরদের খসড়াটিকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দিতে পারবে। সুতরাং রশিদের খসড়াটি ঠাকুরকে দেয়া হলো। যেভাবেই হোক, ঐ খসড়ার উপরে কাজ আর কোনদিনই শেষ হলো না।

কোন সরকারী দায়িত্ব ছাড়াই মেজররা বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলো। কিন্তু মোশতাক মেজরদেরকে উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী আলোচনায় জেনারেলদের সঙ্গে যোগ দেয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন।

এমনই এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল শফিউল্লাহ। আলোচনা অনুষ্ঠানটি শেখ মুজিবকে হত্যার মাত্র চারদিন পরে সেনা সদরে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় ফরমেশন কমান্ডার আর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসারদেরকে ডাকা হয়েছিলো। ফারুক আর রশিদও উপস্থিত। জেনারেল শফিউল্লাহ সম্মিলিত অফিসারদের অবগতির জন্যে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট মোশতাক এই দুই মেজরকে পাঠিয়েছেন ওরা শেখ মুজিবকে হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করবে আর আমাদেরকে তা শুনতে হবে।’ রশিদ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথা দিয়ে শুরু করে এবং মোশতাককে কেন বসানো হলো তা বলতে চেষ্টা করে। আর কিছুদূর আগানোর আগেই কর্ণেল শাফাত জামিল ক্রোধান্বিত কণ্ঠে তাকে থামিয়ে দেয় এবং চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘মোশতাক আমার প্রেসিডেন্ট নয়। সে একজন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট, সে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নয়। আমি তার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করি না। সে একজন জবরদখলকারী, ষড়যন্ত্রকারী এবং হত্যাকারী। সুযোগ এলে প্রথমেই আমি তাকে উৎখাত করবো।’ এতে উপস্থিত অফিসারদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সভার পরিসমাপ্তি ঘটে। তারপরে মেজরবৃন্দ আর কোনদিন ফরমেশন কমান্ডারদের সভায় বক্তব্য না রাখলেও তাদের উপস্থিতি সেনা সদরে অনুভূত হতে থাকে। এমনি করেই খন্দকার মোশতাক সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা চুলোয় উঠিয়ে দিয়েছিলেন।

চতুর্দিকেই কেবল একটা অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছিলো। ঐ দুই মেজর সেনাবাহিনীতে থাকলেও সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা আর ‘চেইন অব কমান্ড’-এর বাইরে অবস্থান করছিলো। মাঝে মধ্যেই রশিদ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়ার অফিসে চলে আসতো এবং বিভিন্ন সমস্যাদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতো। এমনকি সুপারিশও প্রদান করতো। একই সময়ে বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ডার, কর্নেল মোমিন তার ডেপুটির কাছ থেকে নির্দেশ পেতো ফারুকের ঔদ্ধত্য জেনারেলদের ব্রিত করে তুলেছিলো।

সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর কর্ণেল শাফাত জামিলের ইঙ্গিতে একজন পদাতিক বাহিনীর অফিসার বঙ্গভবনে পাহারারত ল্যান্সারদেরকে পরাভূত করতে গিয়ে ধরা পড়ে। ব্যাপারটি প্রমাণসহ জেনারেল জিয়ার নিকট পেশ ক হয়। তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে কথা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি কিছুই করলেন না। রশি বলে যে, এই ধরনের প্রতিজ্ঞা বিস্মৃত হবার বহু অভিজ্ঞতা তার রয়েছে।

১। মেজরদের হাতে নিহত হবার পর শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঢাকাস্থ নিজ বাড়ীর সিড়ির গোড়ায় এলোপাথাড়িভাবে পড়ে আছেন। তখনও তার প্রিয় ধুমপানের পাইপটি শক্তভাবে ডানহাতে ধরে আছেন।

২। ঘাতকদের হাতে নিহত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।

৩। মেজর ফারুক রহমান, বেঙ্গল ল্যান্সার- এ উপ-অধিনায়ক। তিনি মুজিব-হত্যার কৌশলগত নক্সা তৈরী করেন।

৪। মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ, অধিনায়ক দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী। তিনি মেজর ফারুকের ভায়রা ভাই এবং মুজিব হত্যার সাথী বন্ধু।

৫। ১৯৭৪ সালে ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো। এককালের আপোষহীন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। অখন্ড পাকিস্তান খন্ডিত হবার পর শেখ মুজিব হলেন বাংলাদেশের জাতীয় জনক আর ভুট্টো হলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।

৬। স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষে শেখ মুজিব দেশে ফিরে এলে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাঁকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন। তিনি তাঁর গুপ্ত হত্যায় ইন্দন যুগিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালে মাত্র ৮৩ দিনের জন্যে দেশের প্রেসিডেন্ট হতে সক্ষম হয়েছিলেন।

৭। অসাধারণ অনুগামীবৃন্দ : বিমান বাহিনী প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল তওয়াব, নৌ বাহিনী প্রধান এডমিরাল এম, এইচ, খান, এক স্বল্পস্থায়ী অভ্যুত্থানের নায়ক জেনারেল খালেদ মোশাররফকে পদভুষন ব্যাজ পড়িয়ে দিচ্ছেন। তার একদিন পর সিপাহী বিদ্রোহে খালেদ নিহত হলে ঐ দুই প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের আনুগত্য স্বীকার করেন।

৮। আন্ধা হাফিজ, চট্টগ্রামের এক অন্ধ দরবেশ। তিনিই শেখ মুজিবকে হত্যা করার জন্য মেজর ফারুকের হাতে একটি কবচ তুলে দেন।

রশিদ বলে, ‘জেনারেল জিয়া আমাকে বলতেন, ‘রশিদ ঘাবড়িও না। যদি কিছু ঘে তবে তা আমার মৃতদেহের উপর দিয়েই ঘটবে।’ আমার বিশ্বাস, ‘হয় তিনি একজন কাপুরুষ অথবা অত্যন্ত চালাক লোক।’ তিনি ধারণা করে থাকতে পারেন যে, ‘আমরা একে অন্যকে খতম করবো, আর সেই সুবিধেটা তিনি ভোগ করবেন।’

খন্দকার মোশতাক ১২ই ডিসেম্বর ১৯৭৫, আমার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন যে, ২রা নভেম্বরের মধ্যে দেশের আপামর জনসাধারণ বুঝতে পারছিলো যে, দেশে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। জিয়াকে তিনি এর ইঙ্গিত দিলেও জিয়া তা প্রতিপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। মোশতাকের ভাষায় : ‘জিয়া একজন ছোটখাট মেজরের চেয়ে বেশী কিছু ছিলো না। সে ছিলো অনভিজ্ঞ, নির্বোধ অথচ উচ্চাভিলাষী। সে ক্যান্টনমেন্টকে রক্ষা করতে পারলো না। সে দেশকে কিভাবে রক্ষা করতো? অথচ সে বড়ই উচ্চভিলাষী।’

অক্টোবরের শেষের দিকে মোশতাক, ওসমানী, জেনারেল খলিল আর ফারুক-রশিদ মোটের উপর ধরে নিয়েছিলো যে, দেশে একটা অভ্যুত্থান আসন্ন হয়ে উঠেছে। জেনারেল খলিল, বিভিন্ন রিপোর্টের বরাত দিয়ে জানায় যে, জেনারেল জিয়া আর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ-এর কাছ থেকে অভ্যুত্থানের ইঙ্গিত ভেসে আসছে। ‘প্রথমে দুই মেজর তাদের দু’জনকেই (জিয়া+মোশাররফ) আটক করতে চেয়েছিলো। তারপর তারা একটি ব্রিগেড গঠন করে ঐ ধরনের সবাইকে আটক করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সম্ভব নয় বলে সেটাও বাদ দেয়া হয়। একথা জেনারেল খলিল বলেছিলো।

যে কারণেই হোক, জেনারেল ওসমানী জেনারেল জিয়াকে বিশ্বাস করতেন না। সে জন্যেই তিনি জেনারেল খলিলকে সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে আলাপে বসেন এবং জেনারেল জিয়াকে চাকুরীচ্যুত করার প্রস্তাব করেন। রশিদ দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে। সে বলে যে, জেনারেল জিয়া নয়, সরকারের প্রকৃত হুমকি হচ্ছে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর কর্ণেল শাফাত জামিল। রশিদ একটু বুদ্ধি করে মোশতাকের কানে একটা কথা উঠিয়ে দিলো যে, জিয়াকে সরানোর পেছনে ওসমানীর কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রেসিডেন্ট কথাটাকে খপ করে লুফে নিলেন। এবং অবস্থা বুঝে ওসমানীকে বললেন, ‘ঠিক আছে, আপনি যদি জিয়াকে সরাতে চান, তাহলে বলুন, তার জায়গায় কাকে দেয়া যায়? আমাকে কিছু নাম দিন।’ ওসমানী পরের দিন নাম জানাবেন বলে কথা দিলেন। তারপর দুই জেনারেল তাদেরকে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন।

তারপর রশিদ আর মোশতাক আধা ঘন্টা ধরে ঐ আলোচনার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন। শেষে তারা ধরে নেন যে, জেনারেল ওসমানী খালেদ মোশাররফের দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। রশিদ বলে, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, দেখি, ওসমানী খালেদ মোশাররফের নাম সুপারিশ করেন কিনা। যদি তিনি তাই করেন, তাহলে ধরে নেব যে, তিনি একটা অঘটন ঘটাতে চাইছেন।’

রশিদ নীচতলার শোয়ার ঘরে যাবার জন্যে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছিলো। এমন সময় একজন পাহারারত পুলিশ অফিসার ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে আসে এবং শ্বাসরুদ্ধকরভাবে বলতে থাকে; ‘স্যার, পাহারারত পদাতিক বাহিনীর লোকেরা সব পালিয়ে গেছে। তারা আমাদেরকেও চলে যেতে বলেছে। সাংঘাতিক যুদ্ধের সম্ভাবনা। আমাদেরও অবশ্যই পালানো উচিত বলে, তারা বলেছে।’

রশিদের চরম ভীতি বাস্তবে রূপায়িত হলো। পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *