৯. পাল্টা অভ্যুত্থান ও জেলহত্যা
ঐ বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝে টেলিফোনটা বেজে উঠলো। টেলিফোন উঠিয়ে আমি একজন লোকের কণ্ঠ শুনলাম : লোকটি বলছে, ‘আমি ডিআইজি / প্রিজন কথা বলছি। আমি মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলাপ করতে চাই।’
-মেজর আবদুর রশিদ
.
প্রেসিডেন্টের সরকারী বাসভবন অর্থাৎ বঙ্গভবন-এর নির্মাণ শৈলী অত্যন্ত চমৎকার হলেও এতে কোন সামরিক অবরোধ ঠেকানোর ব্যবস্থা রেখে নির্মাণ পরিকল্পনা করা হয়নি। ঔপনিবেশিক কায়দায় নির্মিত এই চমৎকার দালানটির বিরাট বিরাট রাস্তা আর রঙ্গীন রকমারী ফুলের সমারোহ সেকালের বিলাসিতা আর মনমোহিনী পরিবেশের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিদিনের ক্লেশ আর গ্লানি থেকে যেন অনেক দূরে তার অবস্থান। এ যেন এক ভিন্ন জগত। কেবলই জাঁকজমক চতুর্দিকে। কোন তড়িঘড়ির ব্যাপার নেই। সর্বত্রই যেন শৃঙ্খলার ছাপ। অথচ ২রা নভেম্বরের (১৯৭৫) ঐ ভয়ঙ্কর রাত্রিতে বঙ্গভবনকে একটি মিলিটারী ক্যাম্প-এর মত দেখাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো কোন এক আক্রমণকারীকে প্রতিহত করার বিপুল সমরসজ্জা চলছে সেখানে।
ট্যাংকের ইঞ্জিন চালু করার গর্জনে শত শত কাক আকাশে উড়ে শহরটিকে গরম করে তুলেছিলো। মুহূর্তের মধ্যেই বাকী ট্যাংকগুলো চালু হয়ে যাওয়ায় আর অন্য কোন কিছুর শব্দ কানে আসছিলো না। ট্যাংকগুলোর ৮টা ছিলো বঙ্গভবনে, ৮টা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আর ১২টা ছিলো ক্যান্টনমেন্টের ল্যান্সার লাইনে।
ফারুক তখন রশিদের পাশের কামরায় ঘুমুচ্ছে। রশিদ তাকে জাগিয়ে ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পদাতিক গার্ড বাহিনী পালিয়ে যাবার খবরটি জানিয়ে দু’জনে তৎক্ষণাৎ খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে বৈঠকে বসে পড়ে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মোতাবেক, ট্যাংকগুলোকে চালু করে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়। মেশিনগান আর স্টেনগান নিয়ে সৈন্যরা লম্বা বাউন্ডারী দেয়ালের নির্দিষ্ট স্থানে পজিশন নিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ট্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে নেয়ার আগে, ফারুক একটি মাত্র টেলিফোন করে। টেলিফোনটি করেছিলো তার এক বন্ধু আর্মি অফিসারকে। সে তখন সরকারের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার দায়িত্বে নিয়োজিত। বহিঃর্বিশ্বের সঙ্গে টেলিযোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার জন্যে ফারুক তাকে অনুরোধ জানিয়েছিলো। ঐ অফিসার তার কথা রেখেছিলো কিনা তা জানা যায়নি। তবে, রশিদ আর মোশতাক তাঁদের বিপক্ষে কাজ করার জন্যে ঐ সংঙ্কটময় মুহূর্তে প্রচুর অফিসারকেই লক্ষ্য করেছিলো সেদিন।
রশিদ প্রেসিডেন্টের অফিসে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে সে বিভিন্ন স্থানে সাহায্যের জন্যে টেলিফোন করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছিলো। প্রথমেই সে টেলিফোন করে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল জিয়াকে। সে জেনারেল জিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ঘটনার বর্ণনা করে এবং তার সাহায্য কামনা করে। জিয়া ব্যাপারটি ‘ভেবে দেখবেন’ বলে জানান। তারপর সেই ‘ভেবে দেখা’ আর কখনই হয়ে উঠেনি।
চীফ অব জেনারেল স্টাফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে রশিদ ফোন করে জিজ্ঞেস করে : ‘এ সব কি হচ্ছে, স্যার?’ ব্রিগেডিয়ার বলে, ‘কি হচ্ছে, তুমিই বলো।’ রশিদ সংক্ষেপে বর্ণনা শেষে প্রশ্ন তুলে, ‘আপনি এতে কি মনে করেন?’ ‘এখানে মনে করার কি আছে?’ গর্জে উঠে খালেদ। ‘পূর্বে যা প্রত্যাশা করা হয়েছিলো, এখন কেবল তাই শুরু হয়েছে। আমি এখনই বেরিয়ে পড়ছি। তুমি সেখানে অপেক্ষা করো। আমি পরে তোমাকে ডেকে নেবো।
রশিদের তৃতীয় ফোন বাংলাদেশ রাইফেলস্-এর সদর দফতরে। কিনতু সেখানেও কোন ভরসা পেলো না। তারপর ডায়াল করে এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে। তোয়াবকে রশিদের উদ্যোগেই বিমান বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করা হয়। তার বড় প্রত্যাশা ছিলো তোয়াবের উপর। অথচ সেখান থেকেও তাকে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়।
রশিদ উপায়ান্তর না দেখে, জেনারেল ওসমানীকে তাঁর ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ফোন করে। ঘটনাটা একটু বর্ণনা করে ওসমানীকে বঙ্গভবনে আসার অনুরোধ জানায় রশিদ। কিন্তু তখন তার বাসায় কোন গাড়ী না থাকায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি বঙ্গভবনে আসতে পারলেন না। কিন্তু বৃদ্ধ জেনারেল প্রেসিডেণ্টকে সাহায্য করার সম্ভাব্য সকল পন্থাই ঘুরে দেখেন। তিনি প্রথমেই বাংলাদেশ রাইফেলকে দুই ব্যাটালিয়ান সৈন্য প্রেসিডেন্টকে পাহারা দেয়ার জনে পাঠাতে নির্দেশ দেন। কিন্তু যেভাবে হোক, কোন বিডিআর বঙ্গভবনে পৌঁছাতে পারেনি। তারপর তিনি টেলিফোন করেন জেনারেল জিয়াকে। সেখানেও কোন আশাব্যঞ্জক সড় পেলেন না।
অবশেষে বহু খুঁজে তিনি চীফ অব জেনারেল স্টাফ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে তার ব্রিগেড লাইনে ধরতে পারলেন। ব্রিগেডিয়ার-এর সঙ্গে বৃদ্ধ জেনারেলের যে সংপ্তি ও কড়া কথা বিনিময় হয়, তাতে তিনি ধরে নিয়েছেন যে, ইতিমধ্যেই খালেদ অভিযানের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
ওসমানী : ‘খালেদ এ সব কি হচ্ছে?’
খালেদ : ট্যাংকগুলো হুমকির ভাব-ভঙ্গিমা গ্রহণ করছে কেন?
ওসমানী : কিসের হুমকির ভাব-ভঙ্গিমা? তুমি তোমার পদাতিক বাহিনী সরিয়ে নিয়ে আস। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, ট্যাংকগুলো তোমাকে কিছুই করবে না।
খালেদ : ঘাবড়াবেন না। আমি নিজেই সে ব্যবস্থা করে নিচ্ছি।
খালেদ মোশাররফ আর শাফাত জামিল বঙ্গভবন থেকে মেজরদেরেকে সরানোর জন্যে বহুদিন থেকে চেষ্টা করছিলো। শেখ মুজিবের হত্যার দিন খালেদ মোশাররফ নিজেই শাফাত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল এবং বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে প্রস্তুতি নিতে বলেছিলো। মধ্যরাতে আঘাত হানার জন্যে সৈন্য-সামন্ত প্রস্তুত অবস্থায় রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ঐ ‘এ্যাকশন’ আর কখনো নেয়া হয়নি। কারণ, এর আগেই খালেদ মোশাররফকে বঙ্গভবনে ডেকে পাঠানো হয়েছিলো এবং তৎপরবর্তী তিন দিন ধরে সে জামিলের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ করতে পারেনি।
শাফাত জামিল সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অব কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার জন্যে সেনাবাহিনীর প্রধান, জেনারেল জিয়ার সঙ্গে এক দফায় আলোচনা করে, কিন্তু জিয়া, এ ব্যাপারে ভালমন্দ কিছুই বলেননি। তিনি সম্ভবতঃ দু’কূলই রক্ষা করে চলছিলেন I
২৫শে অক্টোবর, জেনারেল জিয়া ব্রিগেডিয়ার শাফাত জামিলকে সেনা সদরে ডেকে পাঠান। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব বসা ছিলো। এই দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না বলে তিনি তাদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়ন কিংবা আরো জটিল করার মানসে তাদেরকে একা রেখে তিনি টয়লেটে চলে যান। দশ মিনিট পর তিনি বেরিয়ে আসেন। কিন্তু এর মধ্যে তাদের দু’জনের ভেতর কোন কথাবার্তা হয়নি।
১লা নভেম্বর, খালেদ মোশাররফ শাফাত জামিলকে নিয়ে চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্যে ঢাকা স্টেডিয়ামের আশেপাশে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় মিলিত হয়। সেখানে দু’জন জুনিয়র অফিসার অভ্যুত্থানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করার প্রস্তাব করলে, খালেদ মোশাররফ এতে ভেটো দেয়। সে আর কোন রক্তপাত দেখতে চায়নি। সিদ্ধান্ত হয় যে, পরদিনই বঙ্গভবনে আঘাত হানতে হবে। মেজরদেরকে তাদের ট্যাংকসহ সরিয়ে দিয়ে সরকারের ক্ষমতা কব্জা করতে হবে। একই সঙ্গে তারা জিয়াকে আটক করে, তাকে জোরপূর্বক অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হবে। তারপরে আর কোন দিক থেকে কোন রকম বিপদের সম্ভাবনা থাকবে না বলে ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করে।
পূর্ব পরিকল্পনামত ব্রিগেডিয়ার শাফাত জামিলের নির্দেশে বঙ্গভবনে পাহারারত ৩০০ সৈন্য (পদাতিক বাহিনীর) মধ্যরাতের পর অত্যন্ত গোপনে মেজর ইকবালের নেতৃত্বে বঙ্গভবন ত্যাগ করে ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে রিপোর্ট করে। এখান থেকেই পাল্টা অভ্যূত্থানের শুরু।
ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লাহর নেতৃত্বে একদল সৈন্য পাঠানো হয় জেনারেল জিয়াকে আটক করার জন্যে। তারা তাঁর বাড়ীতে সকল যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে জিয়াকে তাঁর হল ঘরে আটকিয়ে রাখে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একজন সশস্ত্র গার্ড ছিলো। অন্যদিকে, বেগম জিয়া তাঁর শোবার ঘরের টেলিফোন দিয়ে জেনারেল ওসমানী আর মেজর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলো।
মাত্র এক ঘণ্টা আগে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে রশিদের আলাপ হয়েছিলো। ইতিমধ্যে পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিলো। সে দ্বিতীয়বারের মতো জিয়ার নিকট ফোন করে। টেলিফোন উঠায় বেগম জিয়া। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিনি তাকে জানান যে, তার স্বামী এখন বন্দী। তিনি তার স্বামীর জীবনের নিরাপত্তার জন্যে পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিলেন। রশিদ তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। ‘ঘাবড়াবেন না। এ পর্যন্ত যদি ওরা তাকে কিছু না করে থাকে তাহলে ওরা তাকে আর কিছু করবে না। তবু, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন। কেবল তিনিই এখন আমাদেরকে বাঁচাতে পারেন।’
আসলেই, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া তখন তাদের জন্যে অন্য কোন পন্থা খোলা ছিলো না। কোন মানুষই মেজরদের কোন উপকারে আসতে পারেনি। ১৫ই আগস্টের পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত দেহের উপর পা রেখে তারা এতোদিন ধরে ক্ষমতা, ছল-চাতুরী আর মিথ্যা রাজনীতির যে ফানুস সৃষ্টি করেছিলো, তা ততক্ষণে সবদিক থেকে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছিলো I
এরই মাঝে ঘরের একটি টেলিফোন বেজে উঠে। রিং করেছে স্বয়ং খালেদ মোশাররফ।
খালেদ : আমরা এখন যুদ্ধে নেমে গেছি। সুতরাং এখন একটা ‘আপস-রফায়’ আসতে তোমার আপত্তি কি?
রশিদ : কিসের আপস-রফা?
খালেদ : চলে আসো এবং আমার সঙ্গে যোগ দাও। তোমার ভয়ের কোন কারণ নেই।
রশিদ : আমার অবস্থান জেনে নিন। আমি কেবল একবারেই বিশ্বাস করি— আমি ভুল করতে পারি, কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি না। বিশেষ করে, এই রকম অবস্থায় তো আপসের কোন প্রশ্নই উঠে না।
খালেদ : পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা এগিয়ে আসছি। শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমি দেখে নেবো।
রশিদ : আপনি যদি যুদ্ধ শুরুই করে থাকেন, তাহলে এটা আপনার ভাগ্যের উপর নির্ভর করবে। আমিও আপনাকে শেষ পর্যন্ত দেখে ছাড়বো।
অনেকক্ষণ ধরে একে অন্যকে গালাগালির পালা চললো। বাংলাদেশ গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালেও যুদ্ধটা তখনকার মতো টেলিফোনেই সীমাবদ্ধ রইলো।
ঐ সময়ে বঙ্গভবনের আসন্ন আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যে পুরোপুরি রণসাজে সজ্জিত। তারা দেখতে পাচ্ছিলো ব্রিগেডিয়ার শাফাত জামিলের ৪৬তম পদাতিক বাহিনী এগিয়ে আসছে। ভোরের আবছা আলোতে তাদেরকে অনেক দূর থেকে ক্ষীণভাবে দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু ঐ পদাতিক বাহিনীর সৈন্যেরা নিজেদেরকে নিরাপদে দূরত্বে রাখার চেষ্টা করছিলো। কেননা, ভারী মেশিনগান আর অন্যান্য অস্ত্র ঘুরিয়ে নিয়ে শত্রুর দিকে তাকে করে রাখার চেষ্টা চলছিলো ট্যাংকগুলোতে।
পাল্টা অভ্যুত্থান শুরু হবার কারণে বাহিরে যে সাংঘাতিক অবস্থা বিরাজ করছিলো তার প্রতিফলন প্রেসিডেন্ট ভবনেও পড়তে শুরু করে। একদিকে টেলিফোন বাজছে। অন্যদিকে নির্দেশের পর নির্দেশ জারি করা হচ্ছে। লোকজন খবর নিয়ে উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছুটাছুটি শুরু করেছে। এর মাঝে, রশিদ বাইরে অবস্থানরত সৈনিকদের উপরও নজর রেখে চলেছে। ভোর ৪টা বাজার একটু পরেই রশিদ আর একটি টেলিফোনের রিসিভার উঠায়। রশিদের ভাষায়, ঐ বিশৃঙ্খল অবস্থার মাঝেই টেলিফোনটি বেজে উঠে। টেলিফোন উঠিয়ে আমি শুনতে পেলাম, একজন ভারী কণ্ঠে কথা বলছে, ‘আমি ডিআইজি/প্রিজন কথা বলছি, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই।’
রশিদ মোশতাককে টেলিফোনটি দিলে, তিনি কিছুক্ষণ ধরে কেবল হ্যাঁ, হ্যাঁ, করতে থাকেন। তাঁর কথা পরিষ্কার বুঝা না গেলেও যে-কোন ব্যাপারেই হোক, তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন, এতে আর কোন সন্দেহ নেই।
টেলিফোনে যখন আলাপ চলছিলো, তখন ফারুক-রশিদের পরিকল্পিত ‘আকস্মিক পরিকল্পনা’ কার্যকরী করার জন্যে রিসালদার মুসলেহউদ্দিন তার দলবল নিয়ে কেন্দ্রীয়
কারাগারে চার নেতাকে খুন করার জন্যে ভেতরে প্রবেশের অপেক্ষারত। ভেতরে প্রবেশের প্রশ্ন নিয়ে বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে ডিআইজি কারাগারে এসে হাজির হয়। পরে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করে ডিআইজি, মুসলেহউদ্দিনকে তার দল নি’র কারাগারের ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেয়।
তাজউদ্দিন আর নজরুল ইসলাম কারাগারের একটি সেলে অবস্থান করছিলেন মনসুর আলী আর কামরুজ্জামান ছিলেন পাশের আর একটি সেলে। তাদেরকে তাজউদ্দিনের সেলে একত্রিত করা হয়। একত্রিত অবস্থায় খুব কাছে থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদেরকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। তাদের তিনজন সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারালেও তাজউদ্দিন পেটে ও পায়ে গুলি খেয়ে রক্তক্ষরণের ফলে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পরে মারা যান। পাশের সেলে অবস্থানরত কারাবন্দী জানায় যে, সে ওখানে মৃত্যু যন্ত্রণায় কোন একজনের আর্তনাদ শুনেছিলো। আর পানি পানি বলে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কাতরানোর মর্মভেদী শব্দও তার কানে আসছিলো। কিন্তু বর্বর ঘাতক, মুসলেহউদ্দিন ও তার গ্যাং চলে যাবার আগে সেলটিকে খুব শক্ত করে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে তাজউদ্দিনের মুখে এক ফোঁটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেনি।
১৯৭১-এর ডিসেম্বরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবী বাঙ্গালীদের যেমন করে নশংসভাবে হত্যা করেছিলো, এই হত্যাও ঠিক ঐভাবেই সংঘটিত হয়েছিলো। অথচ বুদ্ধিজীবীদেরকে জাতীয়ভাবে বৎসরে একবার স্মরণ করা হলেও ঐ চার নেতার ভাগ্যে সেটুকুও জুটলো না।
চার নেতাকে জেলে রেখে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যার ব্যাপারে জনমনে বিভিন্ন রকমের জল্পনা-কল্পনা থাকলেও অন্ততঃ ঐ সময়ের ক্ষমতাসীন সরকারের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত ছাড়া তা করা সম্ভব ছিলো না—একথা কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। তাজউদ্দিন হয়তো কোনভাবে তা বুঝতে পেরেছিলেন কিংবা ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। জেলে থাকাকালীন মিসেস তাজউদ্দিনের সঙ্গে যে দু’বার অল্পক্ষণের জন্যে তাঁর দেখা হয়, তার শেষেরটিতে ঐ ইঙ্গিতটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট মনে হচ্ছে। ‘পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমার মনে হয় না যে, জীবিত অবস্থায় আমরা কোনদিন জেল থেকে বের হতে পারব।’
১৯৭৫-এর নভেম্বরে, তিনজন সুপ্রীম কোর্ট জজের সমন্বয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেই সরকার ‘খালাস’ পান। কিন্তু জেনারেল জিয়া, তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর শাসনকালে ঐ তদন্ত কমিশনকে তাঁদের কাজ পরিচালনা করতে সম্মতি দেননি। কারণটি অবশ্য জানা যায়নি। সুতরাং কমিশন এমনিতেই . বাতাসে মিলিয়ে যায়। এই ঘটনাটি সব সময়ই জেনারেল জিয়ার স্মৃতিকে কলঙ্কের কালিমা মেখে রাখবে। আর যা- ই ঘটুক, সরকারী ইঙ্গিতে এই ধরনের জেলে বন্দী রেখে নির্মমভাবে হত্যা করা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্যতম লোমহর্ষক অপরাধ। এই সকল কারণেই আমাদের পতন আসে। আর বাংলাদেশও ঐ রক্তের ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়ে।
৩রা নভেম্বরের সকালবেলা। পরিস্থিতি ক্রমেই গরম আকার ধারণ করছে। জেনারেল ওসমানী বহু কষ্টে প্রেসিডেন্ট ভবনে এসে পৌঁছেছেন খালেদ মোশাররফ দু’জন কর্নেল আর দু’জন প্রাক্তন মেজর দিয়ে তার দাবীনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। দাবীনামার প্রথমটি এই যে, ট্যাংকগুলোকে নিরস্ত্র অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে হবে। দ্বিতীয়তঃ জেনারেল জিয়ার স্থলে অন্য একজনকে সেনাবাহিনী প্রধানের দায়িত্ব দিতে হবে। তৃতীয়তঃ মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পারবে —তবে তাঁর পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করতে হবে। অত্যন্ত ঔৎসুক্যের ব্যাপার এই যে, ঐ দাবীতে ফারুক আর রশিদের আত্মসমর্পণের কোন উল্লেখ ছিলো না। মোশতাক দাবীনামার ফিরিস্তি শুনে তা পালন করতে অস্বীকৃতি জানান এবং ভোর ৬টার পর থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি থাকছেন না বলে ঘোষণা করেন।
মোশতাক অফিসারদেরকে জানান যে, তিনি তাদের দাবী মেনে নিতে পারছেন না। কারণ, সকাল ৬টার পর থেকে তিনি আর প্রেসিডেন্ট থাকছেন না। তারা তখন জেনারেল ওসমানীকে জিজ্ঞেস করে। জেনারেল বলেন যে, খন্দকার মোশতাক যেহেতু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবেও তাঁর ক্ষমতা আপনা- আপনিই শেষ হয়ে গেছে। ডালিম কর্কশভাবে ওসমানীকে বলে, ‘তাদেরকে আত্মসমৰ্পণ করতে বলুন।’ আমি জানি, ‘আইয়ুব খান কেন আপনাকে বৃদ্ধ নকুল বলে ডাকতেন। কিন্তু এই অবস্থায় জেদ দেখাবার চেষ্টা করবেন না।’
সকাল ১০টা পর্যন্ত ঐ অবস্থাতেই চলতে থাকলো। এমন সময় পুলিশের আইজি বঙ্গভবনে টেলিফোন করে। তখন ডিফেন্স স্টাফ প্রধান, জেনারেল খলিলুর রহমান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তার ভাষায় : ‘পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তিনি আমাকে তাজউদ্দিন আর তার সহকর্মীদেরকে ঐ রাতেই সেলের ভেতরে হত্যা করা হয়েছে বলে জানান। খবর শুনে আমি আঁতকে উঠি। দেরি না করে আমি প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারী, মাহবুবুল আলম চাষীর নিকট ছুটে যাই এবং ঘটনাটি প্রেসিডেণ্টকে জানাতে বলি। সঙ্গে সঙ্গেই চাষী উঠে প্রেসিডেন্টের রুমে যান। এক মিনিটের মধ্যেই তিনি ফিরে এসে বলেন : ‘তিনি তা জানেন।
জেনারেল খলিল জেল হত্যায় মোশতাকের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে তাঁর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলেও তিনি ঘটনাটি আর কাউকে জানালেন না। পরে রশিদ আর ফারুকের দেশত্যাগের জন্যে বিপরীত পার্টির নিকট অনুরোধ জানান খন্দকার মোশতাক। খালেদ মোশাররফ আর শাফাত জামিল মোশতাকের অনুরোধে রাজী হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তাদেরকে ব্যাংককে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
এক পর্যায়ে মোশতাক নিজেও মেজরদের সঙ্গে প্রবাসে চলে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু খালেদ ও কথা শুনেনি। শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবের হত্যার সঙ্গে জড়িত — ডালিম, নূর, হুদা, পাশা আর শাহরিয়ারসহ মোট ১৭ সদস্যের একটি দল ফারুক আর রশিদের সঙ্গে প্রবাসে চলে যায়।
মেজরদের চলে যাবার পর মোশতাক আর কোনভাবেই পরবর্তী সরকারে থাকতে চাইলেন না। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বাড়ী আগামসিহ লেনে চলে যেতে চাইলেন। কিন্তু খালেদ মোশাররফ রাজী হলেন না। তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবেই পুনরায় দেখতে চাইলেন। মোশতাক রাজী হলেন। তবে শর্ত দিলেন দু’টি। একটি হলে–সেনাবাহিনীকে তাঁর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করতে হবে এবং তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে হবে। দ্বিতীয়টি হলো—মন্ত্রী পরিষদকে আনুষ্ঠানিকভাবে মিলিত হয়ে তাঁর প্রতি সমর্থন ও আস্থার কথা প্রকাশ করতে হবে। খালেদ মোশাররফ এতে খুশী হতে পারেনি। সে বরং উল্টো জেনারেল জিয়ার পরিবর্তে তাকে সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিয়োগ করার দাবী জানায়। জেনারেল ওসমানীর মতে, এতে বিমান বাহিনীর প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল এম. জি. তোয়াব আর নৌবাহিনীর প্রধান, কমোডর এম. এইচ, খানের সক্রিয় সমর্থন ছিলো। দু’দিন পরেই ঐ সক্রিয় সমর্থক দুই বাহিনীর প্রধানকে খালেদ মোশাররফের পোশাকের দুই কাঁধে জেনারেলের স্টার এবং ফিতা লাগাতে দেখা যায়। সেদিনই বাংলাদেশ অবজারভার প্রথম পাতায় তাদের ছবিটি ফলাও করে প্রকাশ করে। তারপর দু’দিন যেতে না যেতেই খালেদ মোশাররফ সিপাহী বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। আশ্চর্যের বিষয়, কোন দ্বিধা- দ্বন্দ্ব ছাড়াই ঐ দুই বাহিনীর প্রধান আবার জিয়ার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে।
মঙ্গলবার সকাল দশটায় খালেদ মোশাররফ সঙ্গে করে নিয়ে আসে মেজর জেনারেল খলিল, তোয়াব আর কমোডর খানকে। তারা একটি শোক সংবাদ নিয়ে এসে হাজির হয়। সংবাদটি ছিলো জেনারেল জিয়ার সেনাবাহিনীর চাকুরী থেকে ইস্তফা দান। জিয়া সংক্ষেপে তাঁর ইস্তফা পত্রে উল্লেখ করেন যে, তিনি রাজনীতিতে নিজেকে জড়াতে চান না। সে কারণেই সেনাবাহিনী থেকে সরে দাঁড়াতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সে যাই হোক, জীবনের হুমকির মুখে জিয়ার কাছ থেকে ইস্তফা আদায় করা হয়েছিলো বলে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয়। কারণ, তিনি ইস্তফা দেয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তার বাড়ীতে বন্দী অবস্থায় সময় কাটাচ্ছিলেন। জিয়াকে তার পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চালাতে হবে বলে তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে তাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। অন্যান্যদের মতো তিনি টাকা বানাতে পারেননি। অত্যন্ত করুণ হলেও সত্যি যে, একজন জেনারেল হয়ে চাকুরীতে ইস্তফা দেয়ার পর তিনি তাঁর একজন জুনিয়র অফিসারকে মাসিক তিনশত টাকা ভাড়ায় একটি বাড়ী করে দেয়ার জন্যে বলেছিলেন। কিন্তু স্যার,’ বিব্রত অফিসার জবাব দেয়, ‘এমন কি মোহাম্মদপুরের মতো জায়গায়ও আটশত টাকার কমে বাড়ী ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়।’
অভ্যুত্থানের নায়ক, খালেদ মোশাররফের জন্যে সেনাবাহিনীর প্রধান হবার পথ সুগম হয়ে গেলো। কেননা, জিয়া আর তার পথের কাঁটা হয়ে রইলেন না।
মোশতাক মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাকবেন বলে স্থির করলেন। ওসমানী, খালেদ, তোয়াব, কমোডর খান এবং জেনারেল খলিল সবাইকে উপস্থিত থাকার জন্যে বলে দিলেন। তারা যখন চলে যাচ্ছিলো, এমন সময় ‘ফোর্সেজ ইন্টেলিজেন্স’-এর ডাইরেক্টর, এয়ার কমোডর ইসলাম, তাজউদ্দিন ও তার সঙ্গীদের জেলের ভেতরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে খবর নিয়ে ছুটে আসে।
ওসমানী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘প্রচন্ড হৈ চে-এর সৃষ্টি হয়ে যায়। উপস্থিত কয়েকজন মন্ত্রী ভয়ে একেবারে জড়সড় হয়ে পড়ে। অন্যান্যরা সজোরে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়। আমরা সবাই একেবারে হতবাক হয়ে যাই। আমি ভেবে অস্থির হয়ে যাই এই জন্যে যে, আমরা আরো একবার চরম বর্বরতার আশ্রয় নিলাম।’
আর যাই হোক না কেন, মোশতাক একজন চমৎকার অভিনেতা। তিনিও অন্যান্যদের মতো সজোরে বিলাপ করতে শুরু করলেন। ভাবখানা এই রকম, যেন তিনি এই সংবাদ শুনে একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। কালবিলম্ব না করে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক ডাকলেন। মন্ত্রী পরিষদ জেল হত্যার ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে। তিনজন সুপ্রীম কোর্টের জজ সমন্বয়ে কমিশনটি গঠিত হয়। তারপর তাদের মধ্যে পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে এবং ফারুক, রশিদ আর দলের অন্যান্যদেরকে দেশত্যাগের অনুমতি নিয়ে এক প্রচণ্ড বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হয়।
খালেদ, জেনারেল খলিল, তোয়াব আর কমোডর খান ভেতরে এসে তারা সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য আর প্রেসিডেন্টকে মেনে চলার প্রতিজ্ঞা পেশ করে। কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের কেউ কেউ খালেদ মোশাররফকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করায় অসন্তোষ জ্ঞাপন করে। এ নিয়ে খন্দকার মোশতাক আর জেনারেল ওসমানীর মধ্যে চালাকিপূর্ণ কথাবার্তা বিনিময়ের এক পর্যায়ে সভায় ক্রোধান্বিত বাক্য বিনিময়ের সূত্রপাত হয়।
হঠাৎ দরজায় সজোরে চিৎকার শুনে ভেতরের গরম বাক্য বিনিময় থেমে যায়। শাফাত জামিল আরো পাঁচজন অফিসার নিয়ে স্টেনগান হাতে কেবিনেট রুমে জোরপূর্বক ঢুকে পড়ে। এতে কেবিনেট রুমে ত্রাসের সঞ্চার হয় এবং মন্ত্রীরা চেয়ার ছেড়ে যে যেভাবে পারে পালাতে চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মোশতাককে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায়। তাঁর মাথার উপর এক মেজর স্টেনগান ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওসমানী তাকে বাঁচানোর জন্যে দৌড়ে যান এবং অনুরোধের সুরে বলতে থাকেন, খোদার দোহাই কিছু করো না। এই অবস্থায় কিছু করা, পাগলামো ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলবে।
শাফাত জামিল মোশতাকের পদত্যাগ দাবী করে। সে প্রেসিডেন্টের দিকে লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘তুমি খুনী। তুমি জাতির পিতাকে খুন করেছো। জেলের ভেতর আটকে রেখে সংগোপনে চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছো তুমি। তুমি জবরদখলকারী। তোমার সরকার, বেআইনী সরকার। ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার কোন অধিকার তোমার নেই। তোমাকে অবশ্যই অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।’
তারপর জেনারেল খলিলের দিকে তাকিয়ে জামিল বলতে থাকে, ‘জেল হত্যার ঘটনাটি চেপে রাখার জন্যে আপনি দায়ী। আপনাকে আটক করা হলো।’
প্রচন্ড হট্টগোল বেশ কিছুক্ষণ চললো। যতবারই বন্দুকধারী অফিসারেরা মন্ত্রীদের প্রতি বন্দুকের নল উঠিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো, ততবারই ওসমানী তাদেরকে ধাক্কিয়ে ফিরিয়ে রাখছিলো। পরিশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে ওসমানী মোশতাককে বললেন, ‘ব্যাপার অত্যন্ত খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। আপনি বরং এখনই পদত্যাগ করুন।’ মোশতাক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। এতে অতন্তঃ ঐ গরম হওয়া কিছুটা ঠান্ডা হবার ভাব দেখা গেল।
মন্ত্রীদেরকে আবারো বসানো হয়। মোশতাকের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতিকে দেশের প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্যে শাফাত জামিল প্রস্তাব করে। আইনমন্ত্রী, মনোরঞ্জন ধর আপত্তি তোলে এবং জাতীয় সংসদের স্পীকারকে প্রেসিডেন্ট করার আইনগত ভিত্তির কথা জানায়। এতে জামিল ক্ষেপে গিয়ে বলেন, ‘রাখুন আপনাদের গালভরা আইনের বুলি। একটা হত্যাকে নিয়মানুগ করার জন্যে আপনারা দেশের শাসনতন্ত্রকে পাল্টাতে পেরেছেন। সুতরাং আপনারা এটাকে আবারও পাল্টাতে পারবেন। আমি বলছি, প্রধান বিচারপতিই প্রেসিডেন্ট হবেন।’
এতে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। অন্যদিকে—তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, শাহ্ মোয়াজ্জেম হোসেন, নূরুল ইসলাম মঞ্জুর এবং কে, এম ওবায়দুর রহমানকে তাদের পদত্যাগ পত্ৰ লিখার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়। পরে অবশ্য ঠাকুর আর শাহ্ মোয়াজ্জেমকে দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহার করার জন্যে আটক করা হয়।
এরপর কয়েক ঘণ্টা ধরে বঙ্গভবনে প্রচুর কাজ করা হয়। কেননা, কর্মরত কর্মচারীরা সরকার পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় কাজ-কর্ম সেরে নিচ্ছিলো। মোশতাকের সই নেয়ার জন্যে অনেক কয়টা চিঠিই তখন পর্যন্ত প্রস্তুত হয়ে গেছে। এর মধ্যে মেজরদেরকে দেশত্যাগের অনুমতি আর জেলহত্যা সংক্রান্ত চিঠি দু’টিতে সই করার জন্য খালেদ মোশতাকের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
৫ই নভেম্বর। বেলা ১টায় প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বঙ্গভবনে নিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞেস করেন। ওসমানী তাকে বলেন, ‘আপনাকে দেশের প্রেসিডেন্ট ‘নানোর জন্যে নিয়ে আসা হয়েছে।’ প্রধান বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে ঐ সম্মানের মালা গলায় নিতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ওসমানী বিচারপতিকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘খোদার দোহাই আপনি এই অনুরোধ রক্ষা করুন। আপনাকে দেশের প্রেসিডেন্ট হতেই হবে। তা না হলে দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলে কোন জিনিসই থাকবে না। এবং দেশটার একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
তারপরও তিনি ঐ অবস্থায় কোন ভূমিকা গ্রহণ করতে রাজী হলেন না। বিচারপতি ফিরে বাড়ী চলে এলেন। তারপরই খালেদ, শাফাত জামিল, ওসমানী, খলিল আর বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানগণ পেছনে পেছনে বিচারপতির বাড়ীতে যান। পরিশেষে, তারা তাকে প্রেসিডেণ্ট-এর দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য রাজী করাতে সক্ষম হন।
এইভাবে ১৯৭৫ সালের ৬ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম দেশের স্বাধীনতার চতুর্থ বৎসরে ৫ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ বাণী পাঠ করেন।