দ্বাদশ অধ্যায় – অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ আর প্রাণদণ্ড

১২. অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ আর প্রাণদন্ড

যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা না মরে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখো।

-জেনারেল জিয়াউর রহমান

.

১৯৭৬ সাল। ১৪ই এপ্রিল রোজ বুধবার। লেঃ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ আয়েশের সঙ্গে দুপুরের লাঞ্চটা সেরে নিয়ে লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে এসে পৌঁছেছে। লন্ডন থেকে রোম হয়ে তার ব্যাংকক যাবার কথা। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট এসকিউ ৭৩৪-এ ধরার জন্যে আনুষঙ্গিক কাজ-কর্ম সম্পাদন করে সে কাউন্টারে এসে কাউন্টারের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে : ‘আমরা কখন রোমে পৌঁছাব?’

‘না স্যার’, মেয়েটি জবাব দিলো। ‘এই ফ্লাইটে আমরা রোম যাচ্ছি না বরং রোমকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি। কারণ, রোমের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বিমান বন্দরের কর্মীরা ধর্মঘট করেছে।’

হঠাৎ করে বিমানের রুট পরিবর্তনের জন্যে রশিদের ব্যাংককে যাওয়া পণ্ড হতে বসেছে। রশিদ অস্থির হয়ে উঠলো। অস্থির স্বরে সে মেয়েটিকে বললো, ‘আমার ব্যাগগুলো ফিরিয়ে দিন। আমি আমার মত পরিবর্তন করেছি। আমাকে অন্য ফ্লাইট ধরতে হবে।’

তার ব্যাগগুলো নিয়ে রশিদ নিকটস্থ টেলিফোন কাউন্টারে ঢুকে পড়ে। রোম এয়ারপোর্ট-এর কাছে হোটেল জলিতে ফারুক তখন অবস্থান করছিলো। হোটেল জলিতে টেলিফোন করে ফারুককে সংযোগ দেয়ার জন্যে সে অনুরোধ করে। অপারেটর তাকে জানায় যে, ফারুক কিছুক্ষণ আগেই হোটেল থেকে বাইরে গেছে।

নিজে নিজে পণ করে ট্যাক্সি ধরে রশিদ কেনসিংটন হিল্টন হোটেলের ১০২৪ নম্বর রুমে চলে আসে। হিল্টনে এসে আবারো সে হোটেল জলিতে ফোন করে। দ্বিতীয়বারও ঠিক একই উত্তর পাওয়া গেলো। ফারুক আপাততঃ সেখানে নেই। জানালা দিয়ে চেরী ফুলের সুবাস মিশ্রিত ঠান্ডা বাতাস আসা সত্ত্বেও রশিদ ভীষণভাবে ঘামছিলো। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট রোম পৌঁছলে, সেই ফ্লাইটে তিন সদস্য বিশিষ্ট ‘হত্যাকারী দলের সঙ্গে ফারুকের একত্রে মিলিত হবার কথা। এখন, ঐ দলের মিলন হতে পারছে না এবং দু’মাস ধরে সযত্নে পরিকল্পিত ঢাকায় অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটি ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়েছে। রোমের বিমান বন্দর কর্মচারীদের ধর্মঘটই তাদের জন্যে বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালো।

এইটি মেজরদের (তখন ওরা লেঃ কর্নেল) দ্বিতীয় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা। খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে তাদেরকে ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর দেশত্যাগী হতে হয়। ফারুক, রশিদ এবং শেখ মুজিবের পরিবারকে খতম করার সঙ্গে জড়িত দলের অন্যান্যরাও ভেবেছিলো যে, লিবিয়ায় তাদের প্রবাস জীবন খুব সংক্ষিপ্ত হবে। ‘মাস দুই এক-এর বেশী হবে না’, ফারুক আমাকে জানিয়েছিলো। কিন্তু ডিসেম্বরের শেষের দিকে তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার চিরদিনের জন্যে না হলেও অনির্দিষ্টকালের জন্যে তাদের প্রবাস প্রত্যাশা করছিলো। প্রবাসীরা প্রচুর পরিমাণে প্রতিনিধি প্রেরণ, আবেদন-নিবেদন করলেও তার কোন জবাবই ঢাকা থেকে আসছিলো না। তাদেরকে পুরোপুরিভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলো। এমনকি, তাদের পরিবার-পরিজনকে তাদের প্রাপ্য বেতন-ভাতাদি পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। স্পষ্টতঃই তাদের অবগিত ছাড়াই এই দু’জনকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর গ্রহণ করানো হয়। এখন তাদের আর উর্দি পরিধান করার আইনসঙ্গত অধিকার রইলো না। বেদনাদায়ক হলেও ফারুক আর রশিদ এখন ডালিম, নূর আর হুদার মত অবসরপ্রাপ্ত অফিসাররা কাতারে চলে এলো। যাদেরকে ওরা অন্ততঃ মনে মনে এককালে ছোট চোখে দেখতো।

১৯৭৬ সালের জানুয়ারীর মাঝামাঝি তাদের মনোবল একেবারে নিম্নস্তরে নেমে আসে। ঐ সময়ে বিমান বাহিনী প্রধান, এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর জন্যে কিছু জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করার জন্যে লিবিয়ায় আসেন। অবশ্য তিনি এর কিছুই পাননি। তিনি ত্রিপলিতে থাকাকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে ফারুক, রশিদ আর ডালিম তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পায়। সেই সময়ে ওরা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে তাঁর সহযোগিতা কামনা করে। তোয়াব তাদের জন্যে ‘কিছু একটা করবে’ বলে কথা দেন। কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিমান বাহিনী প্রধান তাদের জন্যে সম্ভবতঃ কিছুই করতে পারেননি কিংবা করার চেষ্টাই করেননি। সুতরাং ১৫ই ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশে ফিরে যাবার অনুমতি চেয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে রশিদ একটি দু’পৃষ্ঠার চিঠি লিখে। চিঠিটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জামির- এর মাধ্যমে কূটনৈতিক ব্যাগে করে পাঠানো হয়েছিলো। চিঠিটির অংশ বিশেষ নিম্নরূপ :

‘কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এখানে আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের মানসিক অবস্থা এবং মনোবল উভয়েরই দারুণভাবে অবনতি ঘটছে। এতে করে সাংঘাতিক বিশৃঙ্খলা এবং অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করছে, যার ফলে এখন আমাদের

মাঝে প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এমন কিছু একটা ঘটলে তার জন্যে আমাদেরকে দায়ী করা উচিত হবে না। অনেকগুলো ব্যক্তিগত কারণ এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্যে এখন আর আমাদের পক্ষে লিবিয় সেনাবাহিনীর যে-কোন পদে চাকুরী করা সম্ভব নহে। তাছাড়া, কিছু আর্থিক ও মানসিক জরুরী কারণে আমাদের অবিলম্বে ঢাকায় আসা একান্ত প্রয়োজন।’

রশিদ আরো দু’টি দাবীর প্রতি জোর দেয়। একটি হলো—জেনারেল জিয়া তাদের প্রত্যাবর্তনে রাজী হলে, তিনি যেন সত্ত্বর তাদের যাতায়াত খরচ বাবদ ১৫,০০০ পাউন্ড স্টার্লিং পাঠিয়ে দেন। অপরপক্ষে, তিনি যদি নারাজ হন, তাহলে তাঁর অস্বীকৃতির কারণ তিনি যেন লিখিতভাবে জানিয়ে দেন। রশিদ আরো জানিয়ে দেয় যে, তিন সপ্তাহ অর্থাৎ ৭ই মার্চের মধ্যে যদি তারা এর কোন জবাব না পায় তাহলে, ‘তারা দল বেঁধে বা ব্যক্তিগতভাবে’ ঢাকায় ফিরে আসার জন্যে কোন বাধা নেই বলে মনে করবে।

তাদের এই শেষ প্রস্তাব আশাপ্রদ ফল দেয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী জেনারেল জিয়ার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) নূরুল ইসলাম শিশুকে সমস্যার সমাধান কল্পে বেনগাজীতে পাঠিয়ে দেন। শিশু তাদের সঙ্গে দলীয়ভাবে এবং এককভাবেও মিলিত হয়ে সমস্যার সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা চালায়। তাদেরকে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিকের পদসহ আরো অনেক সুবিধাদি প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও শিশুর প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করে। তখন শিশু বাংলাদেশে ফিরে যাবার ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করবে বলে আশ্বাস দেয়। কিন্তু এর জন্যে সময় লাগবে বলেও সতর্ক করে দেয়া হয়। রশিদ তখন দলের পক্ষ থেকে জিয়াকে একটি চিরকুট লিখে দেয়। এ চিরকুটে তাদের প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্তের জন্যে জিয়াকে আরো দু’সপ্তাহ সময় বাড়িয়ে দেয় এবং তাতে লেখা থাকে যে, দেশে ফিরে এসে দেশের উন্নতি আর গৌরবের স্বার্থে তারা তাদেরকে জিয়ার নেতৃত্বে সোপর্দ করবে। ২১শে মার্চ চলে গেলো। কিন্তু কোন জবাব এলো না। এতে প্রবাসী মেজররা সিদ্ধান্ত নেয় যে, জেনারেল জিয়াকে সরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাত করার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করবে।

আরো একবার ফারুক আর রশিদ মনে-প্রাণে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে। হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে দেশের ভেতরে কিছু ঘটানোর জন্যে টেলিফোন ছাড়া আর কোন মাধ্যম তাদের জন্যে বাকী রইলো না। লিবিয়া থেকে টেলিফোনে ঢাকাকে ধরা কষ্টকর বলে ফারুক ২৪শে মার্চ ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে যায়।

ফারুকের অনুপস্থিতিতে রশিদ দেশের একটি উৎসাহজনক বার্তা পায়। বার্তায় জানানো হয়, সরকার তাকে একটি সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা এসে তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঢাকার সফরে রশিদ তার স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে আনতে পারবে। ফারুক ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকায় তার স্ত্রীকেও রশিদের সঙ্গে দেশে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু বার্তাটিতে জোর দিয়ে বলা হয়, এ সময়ে ফারুক কিংবা তাদের অন্য কেউ দেশে ফেরার চেষ্টা করতে পারবে না। রশিদ ভাবলো এটা একটা শুভ লক্ষণ। হাজার মাইল দূরে বসে আর পরিকল্পনা করার দরকার হবে না। দেশে বসেই সে সবকিছু করে নিতে পারবে।

সময় ক্ষেপণ না করে রশিদ ফ্রাঙ্কফুর্টে ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ফারুক সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে দেশে ফেরার আগে লন্ডনে যাবে। কারণ, সেখানকার পোর্টম্যান হোটেলে সাময়িকভাবে অবস্থানরত এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবের সঙ্গে তার দেখা করা প্রয়োজন। ২৯শে মার্চ ফারুক লন্ডনে যায়। সে পোর্টম্যান হোটেলের কাছে অবস্থিত চার্চিল হোটেলে উঠে। তোয়াব সে সময় দুই কর্নেলের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু তারা যে কিছু একটা করতে যাচ্ছে সে ব্যাপারে তিনি মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাঁর সঙ্গে জিয়ার ব্যবহার তিনি ভুলেননি। কাজেই তিনি তাঁর উদ্দেশ্য সাধনে ফারুক-রশিদের সঙ্গে তাল মিলালেন। ফারুক তোয়াবের কাছ থেকে সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থান ও পরিবর্তনের তথ্যাবলীসহ রাজধানীর বর্তমান পরিস্থিতির একটা পূর্ণ ধারণা লাভ করে।

ফারুক আর তোয়াব তিনটি বৈঠকে মিলিত হন। সাভার ক্যান্টনমেন্টে ১৩টি ট্যাংক মোতায়েন আছে জানতে পেরে ফারুক বেশী খুশি হন।

সিপাহী বিদ্রোহের পর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে জেনারেল জিয়া বেঙ্গল ল্যান্সারকে দু’ভাগে ভাগ করেন। ৫০০ সৈন্য এবং ১৪টি ট্যাংক নিয়ে তিনি প্রথম বেঙ্গল ক্যাভালরি গঠন করেন। বেঙ্গল ল্যান্সারকে তিনি পাঠিয়ে দেন বগুড়াতে। ফারুকের অনুগত এই বাহিনীকে জিয়া ঠিক মতই বিভক্ত করে রাখেন। জিয়া ব্যক্তিগতভাবে ওদের উপর নজর রাখার জন্যে তিনি প্রথম বেঙ্গল ক্যাভালরিকে সাভারে রেখেছিলেন। তোয়াব ফারুককে জানান যে, কিছুদিন ধরে নূতন রিক্রুটদের প্রশিক্ষণের জন্যে সাভার ক্যান্টনমেন্টের ট্যাংগুলো প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সময়ে বাইরে আনা হয়। ফারুক এটাকে শুভ লক্ষণ বলে মনে করে। কারণ, প্রতিদিন ট্যাংক বের করার ফলে বিশেষ উদ্দেশ্যে কেউ যদি এগুলো বের করে তাহলে তা কারুর নজরে পড়বে না। ফারুক সিদ্ধান্ত নেয় যে, সাভার পৌঁছে সে তার লোকদের তালিম দিয়ে সুযোগ বুঝে ট্যাংকগুলো নিয়ে ঢাকা রওয়ানা দেবে। এইভাবে ট্যাংক দিয়ে জিয়াকে অপসারণ করে সরকারের ক্ষমতা দখল তার জন্যে তেমন কোন শক্ত কাজ হবে না।

ফারুক বেনগাজীতে ফিরে গিয়ে রশিদের সঙ্গে আলোচনা করে অতিদ্রুত একটি ‘অভিযান পরিকল্পনা’ তৈরী করে ফেলে। তাঁরা স্থির করে, দু’একদিনের ব্যবধানে তারা পৃথকভাবে লিবিয়া থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে। ফারুক তার ‘ঘাতকদল’ নিয়ে সিঙ্গাপুরে যাবে। ঐ দলে রয়েছে—মুসলেহউদ্দীন, মারফত আলী আর হাশিম। ওরা শেখ মনি আর জেল হত্যার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলো। তারা সিঙ্গাপুরে রশিদের সংকেতের জন্যে অপেক্ষা করবে। রশিদ একাই ঢাকায় চলে যাবে এবং স্ত্রীদ্বয় ও সন্তানেরা লিবিয়াতেই থেকে যাবে। কেননা, অযথা তাদেরকে নিয়ে ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া ঠিক হবে না বলে রশিদ মনে করেন।

ঢাকা পৌঁছে রশিদ লিবিয়াতে অবস্থানরত সামরিক অফিসারদের ফেরত নেবার আলোচনার ফাঁকে সে অভ্যুত্থানের প্রথম পর্যায়ের কাজগুলো সম্পন্ন করে নেবে। অভিযানে নামার আগে রশিদ দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি, বেঙ্গল ল্যান্সার আর বেঙ্গল ক্যাভালরিতে তাদের সমর্থনের লোক চিহ্নিত করে দল পাকানোর কাজটা করে ফেলবে। এরপরে দুই কর্নেলের জন্যে দু’টি বিকল্প থাকবে। প্রথমটি হচ্ছে, দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী আর আর্মড ইউনিট সিঙ্গাপুর থেকে ফারুকের ঢাকা পৌঁছানোর সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঢাকা বিমান বন্দর অবরোধ করবে। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে ফারুক জিয়াকে অপসারণ ও সরকার দখলের চেষ্টা চালাবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, ঢাকা বিমান বন্দরে বি আর্টিলারী ও ক্যাভালরির লোকেরা গোপনে অপেক্ষা করতে থাকবে। ফারুক বিমান থেকে নামার পর তারা গোপনে ফারুককে সাভার ক্যান্টনমেন্টে ট্যাংকের আশ্রয়ে নিয়ে যাবে। সুযোগ বুঝে ফারুক সাভার ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংক বের করে ঢাকায় পৌঁছাবে এবং সরকারকে উৎখাত করবে।

এই অভিযান পরিকল্পনাটি এতই সাদামাটা ছিলো যে, একটা অদ্ভুত কিছু না ঘটলে তা বাস্তবে পরিণত হওয়া সম্ভব ছিলো না। এতে চরম গোপনীয়তার প্রয়োজন ছিলো। তাদের একটা সমস্যাও ছিলো। লিবিয়াতে থাকাকালে প্রবাসী অফিসারদের মধ্যে সম্পর্ক খুব সুন্দর ছিলো না। অন্যান্যরা তাদের প্রবাস জীবনের জন্যে ফারুক আর রশিদকে দায়ী করতো। কিন্তু মুসলেহউদ্দীন, মারফত আলী আর হাশিমের অযোগ্যতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন ছিলো না। এই জন্যে অন্যান্যদের না জানিয়ে কেবল ঐ তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে এই পরিকল্পনার কাজ করার ব্যবস্থা গৃহীত হয়।

বেনগাজীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তির সঙ্গে তাদের অত্যন্ত চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছিলো। এদের একজনের নাম মেজর সালিম ইব্রাহিম। বেনগাজীতে পোর্ট ডাইরেক্টরের আবরণে তিনি ছিলেন আসলে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন অফিসার।

অন্যজনের নাম মেজর সোলায়মান।

তিনি ছিলেন সিরেনিকা প্রদেশের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। তিনি গাদ্দাফীর বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের একজন সদস্য ছিলেন। এই দুই লিবিয় অফিসার বিশেষ করে মেজর ইব্রাহিম বাংলাদেশী এই দুই কর্নেলের যথেষ্ট কাজে আসেন। তাদের সহযোগিতায় ফারুক রোমের জলি হোটেলে এবং রশিদ লন্ডনের কেনসিংটন হোটেলে যাবার সুযোগ পায়। রশিদের লন্ডন যাবার উদ্দেশ্য ছিলো তখন তথায় অবস্থানরত ডালিমকে তার পরিকল্পনায় টানার চেষ্টা করা। ডালিম রশিদের প্রস্তাবে সম্মতি জানালে, সেদিন রাতেই রশিদ ঢাকায় সেনাবাহিনীর এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার নূরুল ইসলাম শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। রশিদ ব্রিগেডিয়ার শিশুকে অনুরোধ জানায় ডালিমকে দেশে ফেরার অনুমতি দিতে। রশিদের অনুরোধে কাজ হয়। এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল রাজী হলে, রশিদ ডালিমকে ২০শে এপ্রিলের মধ্যে দেশে পৌছার নির্দেশ দেয়। ঐ সময় ফারুক আর রশিদ ঢাকায় অবস্থান করবে। রশিদ ১৫ই এপ্রিল লন্ডন থেকে ঢাকা যাবার কথা। কিন্তু রোমের ঐ বিমান কর্মীদের ধর্মঘট তার পরিকল্পনা ওলটপালট করে দেয়। অনেক চেষ্টার পর রোমে ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়। দু’জনে টেলিফোনে আলোচনা করে নূতন কর্মসূচী ঠিক করে। পরিবর্তিত সময়সূচী অনুযায়ী রশিদ ১৬ই এপ্রিল সিঙ্গাপুর এয়ার লাইন্সের ফ্লাইট নম্বর এসকিউ ৭৪২-এ ফ্লাইটে লন্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দর থেকে বিমানে উঠে। রোম বিমান বন্দরের এই ফ্লাইটে উঠে ফারুক আর তার তিন সহযোগী। ব্যাংকক পৌঁছানোর আগে তারা বিমানে পুরো পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে।

রশিদ ২০শে এপ্রিল ব্যাংকক থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছায়। সে ঢাকায় এলে তাকে তার আত্মীয়-স্বজন, ফারুকের মা-বাবা এবং প্রচুর বন্ধু-বান্ধব বিপুল সংবর্ধনা জানায়। ঐ সময়ে মিলিটারী গোয়েন্দা বাহিনী ও এনএসআই-এর অনেক অফিসার বিমান বন্দরে উপস্থিত হয়। তারা সবদিকেই কড়া নজর রাখে। রশিদ তার জন্যে রক্ষিত ক্যান্টনমেন্টের বাসায় চলে যায়। পরে, ঐ রাতেই সে ব্রিগেডিয়ার নূরুল ইসলাম শিশুকে নিয়ে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত করে। বন্ধুত্বমূলক পরিবেশে এই বৈঠক বেশ কিছুক্ষণ চলে। মাঝে নৈশভোজের জন্যে তাদের আলোচনা কিছুক্ষণের মত স্থগিত থাকে। জিয়া তাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলে, রশিদ সবকিছু খুলে বলে। জিয়া কথা প্রসঙ্গে ফারুক কোথায় এবং কেমন আছে জানতে চান। রশিদ বলে, ফারুক বেনগাজীতে আছে।’ জিয়া বললেন তাই নাকি। আমি তো রিপোর্ট পাচ্ছি, ফারুক এখন সিঙ্গাপুরে।’ কিন্তু রশিদ এসব অস্বীকার করে জিয়াকে বলে, আপনি সঠিক রিপোর্ট পাননি।’ জিয়া ততোধিক দৃঢ় কণ্ঠে জানালেন, আমি বিশ্বস্তসূত্রে এ খবর পেয়েছি। আমেরিকান সূত্রও একই তথ্য দিচ্ছে।’ রশিদ বুঝতে পারলো, থলির বেড়াল বেড়িয়ে গেছে। যে কোনোভাবেই হোক, তাদের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেছে। দ্রুত এই পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে এবং আরো অনেক সতর্কতার সাথে সামনে এগোতে হবে।

সিঙ্গাপুর থেকে ফারুকের ঢাকা আসার সময় ঠিক হয় ২৩শে এপ্রিল, শুক্রবার (শুক্রবারে জাতক তখনও ঐ দিনটাকে শুভ বলে মনে করছিলো)। রশিদ ঢাকায় এসে তার পরবর্তী দু’টি দিন ফারুকের আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্যে গোপনে কাজ করে যাচ্ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার নাকের ডগার উপর দিয়ে কাজ করে সে তার নিজের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীকে, বগুড়ায় অবস্থানরত বেঙ্গল ল্যান্সারের প্রয়োজনীয় অংশকে আর সাভারে অবস্থানরত ফার্স্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিকে চাঙ্গা করে তুলে। ঢাকা বিমান বন্দরে ফারুক নামার সঙ্গে সঙ্গে তাকে সাভার ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাবার জন্যে রশিদ একটা ‘ওয়াচ পার্টির’ ব্যবস্থা করে। এতসব প্রতিকূলতার মাঝেও কাজগুলো সম্পন্ন করে রশিদ বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়।

সিঙ্গাপুরে ফারুকের অবস্থান সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার অবগতি থাকলেও ঠিক পরিকল্পনা মত ফারুক ঢাকায় এসে পৌঁছায়। সাভারে পৌঁছালে সেখানকার প্রায় দু’হাজার সৈন্য তাকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করে। সৈন্যরা তাকে কাঁধে নিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে ‘ফারুক জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়টি জেনারেল জিয়ার কানে দিলে, তিনি তখনকার মত চোখ-কান বন্ধ করে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং সাময়িকভাবে ফারুককে ঢাকায় থাকতে অনুমতি দেন।

ডালিম আসে ২৫শে এপ্রিল। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবও দুবাই থেকে একই প্লেনে এসেছিলেন। জিয়া বিষয়টিকে অন্যভাবে নেন এবং এটিকে তোয়াবের অপসারণের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজে লাগান। ‘খুনী মেজরদের’ ঢাকায় অবস্থান করার ফলে, রাজনৈতিক অঙ্গনে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চরম উত্তেজনার ফলে বিরাট এক ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যেতে থাকে আর ক্যাভালরির সৈনিকরা উপরস্থদের নির্দেশ অমান্য করে ফারুক আর রশিদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করে। এদিকে তারা সীমাহীনভাবে একের পর এক জেনারেলদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মহড়া চালিয়ে যাচ্ছিলো। আবার অন্যদিকে ঢাকা, সাভার আর বগুড়ায় তারা বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো। অবশেষে ২৭শে এপ্রিল বগুড়ায় অবস্থানরত বেঙ্গল ল্যান্সারদের এনসিও সিপাইদের কাছ থেকে জেনারেল জিয়ার কাছে এক সংবাদ এলে অবস্থা চরমে পৌছে। ফারুককে আমাদের কাছে বগুড়ায় পাঠিয়ে দিন নতুবা আমরাই ট্যাংক নিয়ে ঢাকার দিকে রওয়ানা দেবো।’

সংবাদটি সেনাবাহিনী হেড কোয়ার্টারে প্রচুর অস্থিরতার সৃষ্টি করে। জেনারেল জিয়া সঙ্গে সঙ্গেই আরিচা ফেরী ঘাটে একটি ইনফান্ট্রি রেজিমেন্ট পাঠিয়ে দেন যাতে করে নদী পার হতে চাইলে তাদেরকে তারা প্রতিহত করতে পারে। পরে বেঙ্গল ল্যান্সারদেরকে শান্ত করার জন্যে জেনারেল জিয়া ফারুককে বগুড়ায় পাঠিয়ে দেন। এ সিদ্ধান্তটি দিয়ে জিয়া এক বিরাট ভুল করেছিলেন। বেঙ্গল ক্যাভালরি আর বেঙ্গল ল্যান্সারের সমর্থন ও নেতৃত্ব পেয়ে ফারুক খুশী হলো। দুই সশস্ত্র ব্রিগেডের বলে বলীয়ান হয়ে ফারুক জিয়ার উপর আঘাত হানার প্রয়োজনীয় শক্তি হাতে পেলো।

লেঃ কর্নেলের চিহ্ন কাঁধে ঝুলিয়ে ল্যান্সারের কালো উর্দি পরে রাজকীয় চালে ড্রাইভার- চালিত জীপে চড়ে ফারুক বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছায়। ল্যান্সারের অফিসারেরা এসব দেখে ঘাবড়ে গেলেও সৈন্যেরা উৎফুল্ল হয়ে উঠে। ফারুক সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘বগুড়া আমাদের অবস্থানের জায়গা নয়। আমাদের জায়গা ঢাকিয়। আমরা সেখানেই ফিরে যাবো।’ ফারুকের প্রাক্তন কমান্ডিং অফিসার কর্নেল মোমিন তাকে পরামর্শ দেয় যে, তার এমন কোন বোকামি করা উচিত হবে না, যার ফলে সৈন্যরা মারা পড়তে পারে। কারণ, ইতিমধ্যেই ওদের এ ধরনের ভয়ঙ্কর ভোগান্তির চরম অভিজ্ঞতা হয়েছে। ফারুকের তখন ঐ সমস্ত কথা শোনার মানসিকতা ছিলো না। কিন্তু রশিদের কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল’ না পাওয়া পর্যন্ত ফারুক বগুড়াতেই থেকে যেতে সিদ্ধান্ত নেয়। জেনারেল জিয়া একটা বড় ধরনের বিদ্রোহের আঁচ করতে পেরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৭শে এপ্রিল সন্ধ্যায় রশিদ আশ্চর্যের সঙ্গে দেখতে পায় যে, সে তার নিজ বাসায় বন্দী হয়ে গেছে। বাড়ীটা পুরোপুরিভাবে মিলিটারী গার্ড দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। ভেতরের কাউকে বাইরে যেতে এর বাইরের কাউকে ভেতরে আসতে দেয়া হচ্ছিলো না।

রশিদ বুঝতে পেরেছিলো, এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তাই সে গোপনে সংবাদ পাঠানোর ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছিলো। ঐ গোপন পথেই সে বগুড়ায় ফারুক আর সাভারে মুসলেহউদ্দীনের কাছে বিপদ সংকেত পাঠিয়ে সতর্ক ও তৈরী থাকতে বলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গেই তারা যুদ্ধের জন্যে তৈরী হয়ে যায়। কিন্তু সে জন্যেও জেনারেল জিয়া পরবর্তী দাবার গুটি সঠিক অবস্থানে দাঁড় করে রেখেছিলেন।

জেনারেল জিয়ার গার্ড রেজিমেন্ট থেকে কিছু লোক আর চারজন অফিসার মিলে রশিদকে তার বাসভবন থেকে সেনা সদর দফতরে নিয়ে আসে। সেখানে তাকে ছ’ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে সেখান থেকে রশিদকে জেনারেল জিয়ার অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। রশিদ জানায়, জিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কথা বলছিলেন। খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তাকে সেনাবাহিনীর প্রধান হতে সাহায্য করায় তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু তিনি জাতীয় স্বার্থে তাদের দলের সকলকে কিছু সময়ের জন্যে দেশের বাইরে অবস্থান করার উপর জোর দেন। জিয়া তাদেরকে বাংলাদেশ দূতাবাসে তাদের পছন্দনীয় পদে নিয়োগ করার আশ্বাস দেন। তিনি পরিষ্কার করে বলেন যে, কোন অবস্থাতেই অনুমতি ছাড়া তারা আর দেশে ফিরে আসতে পারবে না। জিয়া রশিদকে জানান যে, এখন থেকে প্রথম যে ফ্লাইটটি পাওয়া যাবে তাতে করেই তাকে দেশত্যাগ করতে হবে। রশিদ তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায়। কিন্তু এতে করে সিদ্ধান্তের কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই সময়ে থাই এয়ার লাইন্স-এর একটি ফ্লাইট ব্যাংকক যাচ্ছিলো। মিলিটারী পাহারায় তাকে বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়ে সে ডালিমকেও দেখতে পেলো। দু’ঘণ্টার মধ্যে তাদের দু’জনকে বিমানে উঠতে বাধ্য করা হলো। রশিদের দ্বিতীয় অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা এভাবেই নস্যাৎ করে দেয়া হলো।

ঢাকায় ফিরে আসার কড়া নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ফারুক ল্যান্সারের ট্যাংক নিয়ে বগুড়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকে। কর্নেল হান্নান শাহ্র নেতৃত্বে ৬ষ্ঠ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। সাভারেও একই অবস্থা গৃহীত হয়। মেজর জেনারেল মীর শওকত আলীর অধীনে ৪তম পদাতিক ব্রিগেড বেঙ্গল ক্যাভালরিকে তিনদিন ধরে ঘিরে রাখে। তার পর এটা পরিষ্কার হয়ে উঠে যে, পদাতিক বাহিনী জিয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। বিদ্রোহীদের অবস্থা নৈরাশ্যজনক। ফারুকও বুঝতে পারলো যে, তার ভাগ্য তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সুতরাং একটি হেলিকপ্টারে করে তার পিতা আর তার বোনকে বগুড়ায় পাঠিয়ে দিলে তারা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় এবং ফারুক নীরবে হেলিকপ্টারে এসে বসে। সৈন্যদের হতোদ্যম করে রক্তপাত এড়ানোর নামে ফারুক তাদেরকে ফেলে চলে আসে। এভাবেই ক্যাভালরি আর ল্যান্সারের বিদ্রোহের অবসান ঘটে। দু’মাস পর ১৫ই জুলাই, ১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়া বেঙ্গল ল্যান্সার ভেঙ্গে দেন। এই বিদ্রোহে ফারুক-রশিদের কিছুই ঘটেনি। অথচ তাদের অনুগত সৈনিকদের বহুসংখ্যক ফাঁসিতে ঝুলেছিলো। আর অনেককে পাঠানো হয়েছিলো জেলে।

জেনারেল জিয়া বিদ্রোহীদের শাস্তিদানের ব্যাপারে যথেষ্ট পক্ষপাতিত্ব করেন। বিদ্রোহের দায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরসেনানী, কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে চড়ানো হলেও তার চেযে বেশী পরিমাণ অপরাধে অপরাধী ফারুক, রশিদ আর ডালিমসহ অন্যান্য সহযোগীদের আরামে বিমানে চড়িয়ে দেশত্যাগের সরকারী ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ফারুক আর রশিদ দূতাবাসের চাকুরী নিতে অস্বীকৃতি জানালেও দলের অন্যান্যরা তা সানন্দে গ্রহণ করে।

অন্যদিকে, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার ব্যাপারে এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবের বিরুদ্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া না গেলেও তাকে ঐ বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত করানো হয় এবং সেই অভিযোগে তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। বঙ্গভবনে ডেকে জিয়া তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগের কথা বলেন সেগুলো হচ্ছে–বিদ্রোহীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ, আল-বদরদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকরণ এবং বিমানের একটি ৭০৭ বোয়িং কেনার ব্যাপারে অবৈধভাবে দেড় লাখ ডলার কামানোর অভিযোগ। তোয়াব ঐ সবগুলো অভিযোগ অস্বীকার করলেও ঐ সময়ে ঐখানেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এবং সেদিনই বিকেলে তাকে একটি লন্ডনগামী বিমানে জোর করে তুলে দিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। এইসব অপমান তোয়াব ভুলতে পারেননি।

১৯৭৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়া মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত- এর সঙ্গে পরবর্তী বছর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের সদস্য পদের ব্যাপারে আলোচনা ও সমর্থন আদায়ের জন্যে কায়রোতে যান। বাংলাদেশ ঐ পদের জন্যে শক্তিশালী জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা। সেই সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়ার জীবন-মৃত্যুর সমস্যা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিশরীয় প্রেসিডেন্টের অবগতিতে ছিলো। সৌভাগ্যক্রমে, মিশরীয় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করে বামপন্থী একটা দল ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালাবে বলে খবর পেয়ে যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা ২৮ এপ্রিল বিমান বাহিনী দিবসে আঘাতটি হানার পরিকল্পনা করে। জাসদ ও কমিউনিস্ট পার্টির উস্কানীতে ব্যাপারটি পরিচালিত হয় বলে জানা যায়। কায়রো থেকে জিয়া দেশে ফিরবেন ২৭শে সেপ্টেম্বর। পরদিন অর্থাৎ ২৮ তারিখে বিমান বাহিনী দিবস। ঐ দিবসে জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হবার পরপরই ঘটনাটি ঘটানো হবে বলে পরিকল্পিত তথ্যটি জিয়াকে জানানো হয়।

প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতের এই তথ্য শুনে জিয়া ঘাবড়ে যান। এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মিশরীয় গোয়েন্দা সূত্রটি জানায়, বিপ্লবী সিপাইরা এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত জিয়াসহ সকল পদস্থ অফিসারদের গুলি করে হত্যা করবে। মিশরীয় গোয়েন্দা সূত্রটি অবশ্য কোন্ ইউনিট এই ষড়যন্ত্রে জড়িত তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি।

২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় জিয়া বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ. জি. মাহমুদকে হাতে লিখে একটি ছোট নোট পাঠিয়ে দেন। তিনি ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারছেন না বলে নোটে উল্লেখ করেন। এতে কোন কারণ তিনি দেখাননি। কিংবা সাদাতের সতর্কবাণীর কথাও উল্লেখ করেননি। সম্ভবতঃ জিয়া বিমান বাহিনী প্রধানের আনুগত্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না বলেই তিনি তাকে সবকিছু খুলে বলেননি।

শেষ মুহূর্তে জিয়ার অস্বীকৃতিতে বিমান বাহিনী প্রধান বিপদে পড়েন। পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিলো যে, প্রেসিডেন্ট কোন কারণে মনক্ষুণ্ন হয়ে এই অনুষ্ঠানে আসতে অসম্মতি জানিয়েছেন। ঐ অবস্থায় মাহমুদ জিয়ার জায়গায় অন্য কাউকে দিয়ে অনুষ্ঠান সমাপন করবেন, না কি অনুষ্ঠান বাতিল ঘোষণা করবেন তা বুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত এমন কি ঘটনা ঐদিন ঘটে গেলো যার জন্যে অনুষ্ঠান আপনা-আপনিই মুলতবী হয়ে গেলো।

জাপান এয়ার লাইন্সের একটি ডিসি-৮ বিমান ১৫৬ জন যাত্রী নিয়ে বোম্বে থেকে উড্ডয়নের পরপরই হাইজ্যাক হয়। জাপানী রেড আর্মির হিদাকা কমান্ডো ইউনিটের পাঁচজন হাইজ্যাকার বিমানটি হাইজ্যাক করে ঢাকায় অবতরণ করতে বাধ্য করে। তারা তাদের দলের ৯ জন কর্মীকে জাপানের জেল থেকে মুক্তিদানের দাবী এবং যাত্রীদের- জিম্মী করে তাদের মুক্তিপণ হিসেবে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার দাবী করে। মধ্যরাতের মধ্যে তাদের দাবী মানা না হলে তারা একে একে সবগুলো যাত্রীকে খুন করবে বলে হুমকি দেয়।

ঢাকায় এই ধরনের আন্তর্জাতিক ঘটনা আর কোনদিন ঘটেনি। এই ঘটনায় কি পদক্ষেপ নেয়া উচিত সে জন্যে মন্ত্রীসভার জরুরী বৈঠক ডাকা হয়। মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত মতে বিমান বাহিনী প্রধান. এ. জি. মাহমুদ, বিচারপতি সাত্তার (ভাইস প্রেসিডেন্ট) এবং দু’জন ঊর্ধ্বতন বেসামরিক অফিসার নিয়ে কন্ট্রোল টাওয়ারে চলে যান। সেখান থেকে হাইজ্যাকারদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে থাকেন। এভাবেই বিমান বাহিনী দিবস স্থগিত হয়ে যায়।

২৮শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠান স্থগিত হয়ে যাবার কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের সৈন্যদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারলো না। দু’দিন পর বগুড়ায় ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিপাইরা বিদ্রোহ করে এবং তারা দু’জন নবীন লেফটেন্যান্টকে হত্যা করে। কয়েকজন অফিসারকে আটকও করে তারা।

পরদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টেও গোলযোগ দেখা যায়। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকেও একই ধরনের উত্তেজনার খবর আসে। জেনারেল জিয়া অবিলম্বে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্তাব্যক্তিদের নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে অস্ত্রভান্ডার ও স্ব স্ব সেনা ইউনিটের প্রতি কড়া নজর রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর জিয়া তাঁর কয়েকজন সঙ্গীসহ শহরের একটি গোপনীয় নিরাপদ স্থানে চলে যান এবং সেখানেই তিনি তাঁর অস্থায়ী হেড কোয়ার্টার চালু করেন। সম্ভবত : এতেই তাঁর জীবন রক্ষা পায়।

আর্মি ফিল্ড সিগন্যাল ব্যাটেলিয়নের সৈন্যেরা এ বিদ্রোহের আয়োজন করে। ঢাকার সিগন্যাল কমপ্লেক্স এর নেতৃত্ব দেয়। এদের বিদ্রোহ শুরুর সংকেত ছিলো—একটা পটকা বিস্ফোরণ ও পরে একটি রাইফেলের গুলি। সংকেত পাবার পরপরই সৈন্যেরা তাদের ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে এবং তাদের ইউনিটের অস্ত্রভান্ডার লুট করে। আকাশে ফাঁকা গুলি চালাতে চালাতে ওরা ‘সিপাহী বিদ্রোহের’ নামে শ্লোগান দিতে দিতে একত্রে মিলিত হয়।

সিগন্যালম্যানদের সঙ্গে নিকটবর্তী কুর্মিটোলা এয়ারবেইস থেকে কয়েকশত এয়ারম্যান এসে যোগ দেয়। রাত পৌঁছে তিনটার দিকে ৭০০ আর্মি ও ২৫ ট্রাক ভর্তি বিমান বাহিনীর স্টাফ কেন্দ্রীয় অর্ডন্যান্স ডিপো লুট করে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যায়। হাজার হাজার লিফলেটে সৈন্যদের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়। এর আগের বিদ্রোহের সময়ে জিয়া ছিলো নায়ক’ আর এবারের বিদ্রোহে তাকে বিশ্বাসঘাতক’ বলে আখ্যায়িত করে তাঁর ‘অবসান’ চাওয়া হয়।

সকাল ৫টায় ৭টি ট্রাকে ভর্তি হয়ে সৈন্য আর এয়ারম্যানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। তারা বিপ্লবী সরকারের নামে ঘোষণা দিতে আরম্ভ করে। কিন্তু তাদের নেতার নাম ঘোষণা করার আগেই নবম ডিভিশনের হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে রেডিও ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে বিদ্রোহ বিমান বন্দরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নৃশংস আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা প্রথমে বিমান বন্দরের হ্যাঙ্গারের সামনে দু’জন বিমান বাহিনীর তরুণ অফিসারকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর গ্রুপ ক্যাপ্টেন মাসুদকে বিমান বাহিনী প্রধানের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিমান বাহিনীর প্রধান অলৌকিভাবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান। সেখানে আরো যারা মারা যান তারা হচ্ছেন—গ্রুপ ক্যাপ্টেন আনসার আহমেদ চৌধুরী, উইং কমান্ডার আনোয়ার শেখ, স্কোয়াড্রন লীডার মতিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শওকত জান চৌধুরী এবং সালাহউদ্দিন, ফ্লাইং অফিসার মাহবুবুল আলম এবং আক্তারুজ্জামান এবং তিনজন পাইলট অফিসার এম. এইচ. আনসার, নজরুল ইসলাম এবং শরিফুল ইসলাম। বিদ্রোহীরা স্কোয়াড্রন লীডার সিরাজুল হকের ষোল বছরের ছেলে মোহাম্মদ এনামকেও হত্যা করে। বিদ্রোহীদের নৃশংস হত্যাকান্ডে মুহূর্তের মধ্যে বিমান বাহিনীর উড্ডয়ন ক্ষমতা অর্ধেকে নেমে আসে।

এই বিদ্রোহ মূলতঃ সেনাবাহিনীর সিগন্যাল ও বিমান বাহিনীর এয়ারম্যানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কোন পদাতিক ইউনিট এতে অংশগ্রহণ করেনি। জেনারল জিয়া ৪৬তম পদাতিক ব্রিগেড ও ৯ম ডিভিশনের সাহায্যে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনেন।

জেনারেল জিয়াকে বিদ্রোহীরা খুঁজে পায়নি বলে সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ২রা অক্টোবর সকাল ৮টার দিকে বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে থেমে যায়। কুর্মিটোলা এয়ারবেইস থেকে তিন ট্রাক ভর্তি অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এরই মধ্যে জাপানী সন্ত্রাসীরা হাইজ্যাক করা প্লেনটি নিয়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যায়। যাবার আগে ওরা দুই-তৃতীয়াংশ জিম্মীকে মুক্ত করে দিয়ে যায়। সেদিনই এই বিদ্রোহ দমনে সফলতার জন্যে মিশরের প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অভিনন্দন জানান।

প্রেসিডেন্ট জিয়া সহজেই অনুমান করতে পারলেন যে, এখন তাঁর কেবল সেনাবাহিনীর উপর নির্ভর করলেই চলবে না। এজন্যে তাঁর বেসামরিক দিক থেকেও সমর্থনের প্রয়োজন। তিনি প্রথমেই সেনাবাহিনীর মধ্যে কোন্দল এবং বিরোধ সৃষ্টিকারী লোকদের বাছাই করে অত্যন্ত কঠোর হস্তে তাদের উপর চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি ডাইরেক্টর জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, এয়ার ভাইস মার্শাল ইসলামকে বিদ্রোহের ব্যাপারে তাকে আগে থেকে সতর্ক করতে ব্যর্থ হবার কারণে বরখাস্ত করেন। তারপর তিনি একের পর এক দ্রুতগতিতে বগুড়ার ২২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ঢাকার চারটি সেনা ইউনিটকে বাতিল ঘোষণা করেন।

জেনারেল জিয়া বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকেও বাতিল করার চিন্তা করছিলেন।

এয়ার ভাইস মার্শাল মাহমুদ আমাকে জানিয়েছিলেন যে, দুই মাসেরও বেশী সময় ধরে বিমান বাহিনীর ভাগ্য দোদুল্যমান অবস্থায় কাটে। জিয়া তখন বিমান বাহিনীকে বাতিল করে দিয়ে এটিকে সেনাবাহিনীর একটি অঙ্গ হিসেবে আর্মি এভিয়েশন উইং নামে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন চীফ অব জেনারেল স্টাফ, মেজর জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল জিয়াকে এ ধারণাটি দিয়েছিলেন। ঐ অবস্থায় জিয়া কয়েক সপ্তাহ ধরে বিমান বাহিনীর প্রধান ও তার স্টাফদেরকে ঢাকা বিমান বন্দরের অপারেশনাল এলাকাতেই আসতে দেননি। বিমান বাহিনীর প্রধান ঐ বিদ্রোহের কবর থেকে রক্ষা পাওয়ায় জেনারেল জিয়া তাকে অবিশ্বাস করতে থাকেন। বিদ্রোহের উপর বিচার বিভাগীয় কমিশন তদন্ত করে মাহমুদকে নির্দোষ প্রমাণ করলেও তিনি জিয়ার অধীনে কাজ করা অসম্ভব বলে মনে করেন। তিনি ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন।

জিয়া ঐ সুযোগে তাঁর নিরাপত্তার জন্যে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ডে কিছু রদবদল করেন। তিনি জেনারেল মীর শওকত আলীকে যশোরে আর জেনারেল মঞ্জুরকে পাঠিয়ে দেন চট্টগ্রামে। সাড়ে তিন বছর পর সেখানে বসেই জেনারেল মঞ্জুর জিয়া হত্যার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন।

জেনারেল জিয়া এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সৈনিক আর এয়ারম্যানদের উপর ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য প্রতিশোধ নিয়ে তাঁর মনে প্রজ্জ্বলিত প্রতিহিংসার আগুন নির্বাপিত করেন। সরকারী হিসেব মতে তিনি ১৯৭৭ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত মাত্র দু’মাসের মধ্যে ১১৪৩ (এগারশত তেতাল্লিশ) জন সৈনিককে ফাঁসির দড়িতে লটকিয়ে হত্যা করেন। তাছাড়া বহুশত সৈনিককে তিনি দশ বছর থেকে যাবজ্জীবন পর্যন্ত সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করে জেলে পাঠিয়ে দেন। আইনগত পদ্ধতি আর ন্যায় বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে এ শাস্তির কাজ সমাপন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে চড় পৈশাচিক সাজার আর কোন নজির নেই। তিন/চারজনকে একবারে বিচারের জন্যে ডেকে ফাঁসির দন্ডাদেশ দেয়া হলো। জেনারেল জিয়া বসে বসে সেগুলো অনুমোদন করতেন এবং তার পরপরই তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হতো। উল্লিখিত পদ্ধতির সকল কাজই মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে সম্পন্নকরা হলো। তাঁর সহযোগীদের একজন আমাকে জানিয়েছিলো, জেনারেল জিয়া, প্রেসিডেন্ট আর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দ্বৈত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে তাঁর নিজের হাতে লিখে ঐ সকল হতভাগা সৈনিকদের দন্ডাদেশ অনুমোদন করতেন। বেসামরিক বন্দীরা স্মৃতিচারণ করে বলে, ‘কয়েক সপ্তাহ ধরে জেলখানার রাতগুলো সৈনিকদের আর্তচিৎকারে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিলো। তাদেরকে ফাঁসির মঞ্চে ঠেলে নিয়ে যাবার সময় তারা নির্দোষ বলে বুকফাটা চিৎকারে ভেঙ্গে পড়তো।

এই সকল হত্যালীলার জন্যে বিমান বাহিনী বা সেনাবাহিনীর কোন প্রতিষ্ঠিত আইন- কানুনকে মেনে চলা হয়নি। বিধি মোতাবেক, শাস্তির সময়ে কেবল জেনারেল কোর্ট মার্শাল মৃত্যুর দন্ডাদেশ প্রদান করতে পারে। জেনারেল কোর্ট মার্শালে কমপক্ষে পাঁচজন মিলিটারী জজ থাকে। এদের মধ্যে একজনকে অন্ততঃপক্ষে লেঃ কর্নেল হতে হবে এবং বাকী চারজনের কেউই ক্যাপ্টেনের নীচে হতে পারবে না এবং কমিশন প্রাপ্তির পর ক্যাপ্টেনদেরকে কমপক্ষে তিন বছর চাকুরী সম্পন্ন করতে হবে। অভিযুক্তদেরকে তাদের আত্মপক্ষ অবলম্বনের জন্যে পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। জেনারেল জিয়া দেখলেন যে, এই সকল নিয়ম-কানুন তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের পথে বিরাট অন্তরায়। সেজন্যে একটি ‘মার্শাল ল অর্ডার’ ঘোষণা করলেন। ঐ ঘোষণায় বিশেষ আদালতের নামে এমন কোর্ট তিনি সৃষ্টি করলেন, যেগুলোতে বিচারের জন্যে একজন লেঃ কর্নেলের সঙ্গে হাবিলদার ও তার কাছাকাছি পদমর্যাদার লোকেরা বসতে পারতো। দ্রুতগতিতে মামলার কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে এভাবেই ব্যবস্থা গৃহীত হলো।

এই উপমহাদেশের কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে নজির নেই। এক কলমের খোঁচায় জেনারেল জিয়া রাতারাতি দুই ডজনেরও বেশী এই ধরনের কোর্ট সৃষ্টি করলেন। ন্যায় বিচারের কোন প্রশ্নই সেখানে উঠতে পারে না। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো মাত্র। এমন একটি কোর্টের উদাহরণ নিম্নে বর্ণিত হলো। ঐটির নাম মার্শাল ল ট্রাইব্যুনাল নং–১৮, ঢাকা। কেস নং–১/১৯৭৭, তাং- ৮ই অক্টোবর, ১৯৭৭ সাল।

সংশ্লিষ্ট জজদের নাম :

১। লেঃ কর্নেল কাজী সলিমুদ্দীন মোঃ শাহরিয়ার

২। সুবেদার মো আবদুল হালিম

৩। নায়েক সুবেদার আবদুল হাকিম

৪। হাবিলদার আনোয়ার হোসেন

৫। হাবিলদার এম. এফ. আহমেদ ১৯৭৭ সালের ১লা/২রা অক্টোবর রাতে বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্তরা ছিলো :

১। ৬২৭৪০২৮ নায়েক এনামুল হক

২। ৬২৮৪৫৪ সিগন্যালার কাজী সাঈদ হোসেন

৩। ৬২৮১১৮৬ নায়েক আবদুল মান্নান

৪। ৬২৮৪৭৩৬ সিগন্যালার এস. কে. জাবেদ আলী

তারা সবাই নিজেদেরকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু তার কোন উপায় ছিলো না।

তিনজন অভিযোগকারী, সুবেদার সিরাজুল ইসলাম, নায়েক আবুল বাশার এবং ল্যান্স নায়েক আবদুল আলী দৌড়ে এসে উপস্থিত হয়ে যায়।

অভিযুক্তদের পক্ষে কোন সাক্ষী, প্রমাণাদি ছিলো না।

একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দেয় যে, সে দোষী বক্তিদেরকে অস্ত্রাগারে ঢুকে রাইফেল নিয়ে একটি আর্মির গাড়ীতে উঠে চলে যেতে দেখেছে। আর একজন অভিযুক্তদেরকে ব্যারাকের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে দেখেছে। তাদের কেউ ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে’ বলে চিৎকার করেছিলো।

অভিযুক্তদের একজন বলে সে ব্যারাকের সকলের শেষে ঘুম থেকে জেগেছিলো এবং সে সম্পূর্ণভাবে নিরপরাধ। আর একজন অভিযুক্তকারী বলে যে চিৎকার শুনতে পেয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে অস্ত্রাগার থেকে সেও একটি রাইফেল হাতে নিয়েছিলো। কিন্তু তারপরেই সে দেখতে পায় যে কোথাও কোন রকম যুদ্ধ বেঁধে যায়নি। সুতরাং সে তার অধিনায়কের নির্দেশে পরে অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়।

এই সকল সাক্ষী প্রমাণ আর অভিযুক্তদের বক্তব্যের উপর ভিত্তি করে বিশেষ সামরিক আদালত চারজনের সবাইকে দোষী বলে সর্বসম্মতিক্রমে রায় দেয় এবং মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রদান করেন। পরদিন, ৯ই অক্টোবর, স্বয়ং জেনারেল জিয়া ঐসব মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন করে মন্তব্য দেন : যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা না মরে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওদের গলায় ফাঁসি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখো।’ এই চারজন হতভাগাকে ১০ই অক্টোবর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

১৯৭৯ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল পাশা ছুটিতে দেশে ফেরার পথে ইসলামাবাদে যাত্রা বিরতি করে। তিনি তখন আংকারায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারী। ইসলামাবাদে বাংলাদেশ দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী মেজর (অবঃ) হুদার সঙ্গে তার দেখা করার ইচ্ছা। পাশা আবার হুদার বোনকে বিয়ে করার সুবাদে আত্মীয়তার সূত্রেও বাঁধা ছিলো। তারা দু’জনেই ১৯৭৫ সালের আগস্টে শেখ মুজিব আর তাঁর পরিবারকে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলো। ঐ সময় পিকিং-এ বাংলাদেশ দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারী লেঃ কর্নেল ডালিমও ইসলামাবাদে পৌঁছায়।

আবারো, প্রাক্তন মেজররা ঢাকা থেকে হাজার মাইল দূরে বসে বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাতের পরিকল্পনায় লিপ্ত হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা পরিকল্পনা স্থির করবে এবং পরে ফারুক ও রশিদ এতে যোগ দেবে। তাদেরকে বার বার ক্ষমতা করে বিদেশে লোভনীয় চাকুরী দেয়া হলেও এতে তারা সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। তারা আর এক দফায় ক্ষশতার লোভে লালায়িত হয়ে পড়ে।

পাশা, ডালিম আর হুদা দ্রুত একটি অভিযান পরিকল্পনা তৈরী করে ফেলে। স্থির হয়, তারা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবে যার একটি গোপন সেল থাকবে সামরিক বাহিনীতে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্যে গোপন কোড উদ্ভাবন করে। পাশার মতে, সরকার পরিবর্তন করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতা দখল করে সবার জন্যে ন্যায় ও সুবিচারের ব্যবস্থা করা। স্পষ্টতঃই তারা চাচ্ছিলো একটি বামপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু পাশা তার বন্ধুদেরকে সতর্ক করে দিয়ে বলে, ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে কোন কমিউনিজম বাংলাদেশে চলবে না। ইসলামিক ধাঁচের সমাজতন্ত্র আমাদের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। কারণ দেশের অধিকাংশ লোকই মুসলমান এবং ধর্মভীরু।

তারপরেই ষড়যন্ত্রকারীরা ঢাকার দিকে তাদের নজর ফিরায়। তাদের দলে নিয়ে আসে আর্টিলারীর লেঃ কর্ণেল দিদারুল আলম এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের লেঃ কর্নেল নূরুন্নবী খানকে। সেনাবাহিনীর জোয়ানদের হতাশাকে কাজে লাগিয়ে তাদের দলে টানার জন্যে দায়িত্ব দেয়া হয় জগন্নাথ কলেজের বামপন্থী ছাত্রনেতা মুনির এবং জাসদ কর্মী ও কৃষি ব্যাংকের ট্রেনিংরত অফিসার মোশাররফ হোসেনকে। ডালিম ও পাশার ইচ্ছে ছিলো তাদের মাধ্যমে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনও তারা আদায়ের চেষ্টা করবে। এ সময়ে ডালিম আর পাশা জাসদ এবং সর্বহারা পার্টির কয়েকজন নেতার সঙ্গেও দেখা করে।

পরিকল্পনার প্রাথমিক অগ্রগতিতে সন্তোষজনক ফল পেয়ে ডালিম ও পাশা তাদের কর্মস্থলে ফিরে আসার আগে তারা তাদের বামপন্থী বন্ধুদেরকে কিছু পরিমাণ অর্থ দিয়ে আসে যাতে করে তারা তাদের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ ছাড়াও তারা তাদেরকে একটি প্রেস বা বাস কেনার অর্থ পাঠাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রেস দেয়ার উদ্দেশ্য ছিলো বিপ্লব সংক্রান্ত কাগজপত্র ও লিফলেট ছাপিয়ে তা জনসমর্থনের জন্যে কাজে লাগানো এবং বাসের আয় দিয়ে গোপন কর্মকান্ড চালানো।

.

১৯৭৯ সালের ২৬ থেকে ২৯শে ডিম্বেরের মধ্যে ‘ঘাতকদল’ তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ও বাংলাদেশে পরিচালিত কাজের জন্যে অর্থ যোগানোর উদ্দেশ্যে আংকারায় মিলিত হয়। পাশা আংকারায় কর্মর। তার সঙ্গে যোগ দেয় লিবিয়া থেকে রশিদ, ইসলামাবাদ থেকে হুদা আর তেহরান থেকে নূর। কিন্তু ডালিম আর শাহরিয়ার অনিবার্য কারণবশতঃ যোগদান করতে পারেনি। তাছাড়া, ফারুক জানুয়ারী/১৯৭৭-এ একক প্রচেষ্টায় সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা চালানের দায়ে তখন পাঁচ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে জেলে ছিলো।

পাশার মতে, রশিদ তার এক লিবিয় বন্ধুর সহযোগিতায় ষড়যন্ত্রকারী দলকে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। এ কথাটি দিদারুল আলম এবং শাহরিয়ারকে জানিয়ে দেয়া হয় যাতে ষড়যন্ত্রের কাজ এগিয়ে নিতে ওরা অনুপ্রেরণা পায়। আংকারায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, মেজর জেনারেল (অবঃ) মামুন ব্যাপারটি বুঝে ফেলেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাটি পররাষ্ট্র দফতরকে জানিয়ে দেন। ওদিক থেকে এই ঘটনা প্রবাহের উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ পান জেনারেল মামুন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, পাশাও জেনারেল মামুনের কর্মকাণ্ডের বিষয় জেনে ফেলে। তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে পাশা রাষ্ট্রদূতকে অপদস্থ করে। অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপার এই যে, পাশার অতটা বেয়াদবির পরেও সে আংকারাতেই থেকে যায়। পররাষ্ট্র দফতর তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। তার ঠিক ৫ মাস পরেই পাশা আংকারাতে আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করে।

বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ২৭শে মে, ১৯৮০ সালে। এই সময়ে ডালিম, শাহরিয়ার আর হুদা বৈঠকে উপস্থিত থাকে। রশিদ কোন কারণে আসতে পারেনি। তার জায়গায় আসে ফারুক। ফারুককে কিছুদিন আগে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে লিবিয়ায় প্রবাসে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশে পরিচালিত কর্মকান্ড সম্বন্ধে দলের সকলকে অবহিত রাখা। দিদারুল আলম আর তার দল জুন মাসেই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেলার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছিলো। সে ভয় পাচ্ছিলো যে, তাদের গোপন সংস্থার কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গোপনীয়তা বেশীদিন রক্ষা করা যাবে না। কারণ, ততক্ষণে তাদের গোপন সংস্থা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছিলো।

ষড়যন্ত্রকারী দলটি জানতে পারেনি যে, ইতিমধ্যেই মিলিটারী গোয়েন্দা বাহিনী তাদের ব্যাপারটির উপর তীক্ষ্ণদৃষ্টি রেখে চলছিলো। সেনাবাহিনীর কর্মরত জোয়ান আর এনসিওদের বিপথগামী করার প্রচেষ্টার সময়ে তারা নিজেরাই ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় মেতে উঠে। লেঃ কর্নেল দিদারুল আলমের বিচারের শুনানী থেকে জানা যায়, প্রবাসী মেজরদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকালে কর্নেল দিদার কিছুসংখ্যক জাসদ নেতার সান্নিধ্যে এসে সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরে গোপন বিপ্লবী সেল সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। দিদারুল আলম ও তার দল সিদ্ধান্ত নেয়, ১৯৮০ সালের ১৭ই জুন তারা আর্টিলারীর ইউনিটগুলো আর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করবে। প্রথমেই তারা মেসের এবং বাসার অফিসারদের বন্দী করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। জেনারেল জিয়া তখন বিদেশ সফরে। সুতরাং তারা সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান জেনারেল এরশাদকে হত্যা করে রেডিও স্টেশন দখল করবে বলে মনস্থ করে। অন্য কোন দিক থেকে প্রতিরোধ আসলে তা তারা আর্টিলারী আর পদাতিক বাহিনীর শক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে বলে স্থির করে। এরপর তারা একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করবে এবং ঐ বিপ্লবী কাউন্সিল দিয়ে দেশ পরিচালনা করা হবে। আর ১৯৭৫-এর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সিপাহী বিদ্রোহের অসম্পূর্ণ দাবীগুলো বাস্তবায়িত করা হবে বলেও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

কাগজে-পত্রে এটি একটি সুপরিকল্পিত প্লান অব এ্যাকশন বলে মনে হলেও আসলে তা অশিক্ষিত ও অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে গঠিত দলের একটি অসীমিত প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। কারণ, তারা কি করছে, তা তারা অনুধবান করতে পারেনি। জোয়ানরা একে অন্যকে বলাবলি করছিলো। ‘চলো বিপ্লব করি। ভাবখানা এমন যেন তারা কোন একটা বনভোজনের প্রস্তাব করছে।’ মে মাসের শেষের দিকে কর্ণেল দিদার কাজী মুনিরকে জানায় : সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।

২৬শে মে একজন গোয়েন্দা নন-কমিশন্ড অফিসার ষড়যন্ত্রকারীদের বিলি করা একটি প্রচারপত্র আটক করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। জোয়ানরা যখন বুঝতে পারে যে, তাদের গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে গেছে তখন তারা কর্নেল দিদারকে পরিকল্পিত বিপ্লবের দিন এগিয়ে আনতে অনুরোধ করে। কিন্তু দিদারুল আলম তার মন স্থির করতে পারছিলো না। সম্ভবতঃ সে আরো একবার ভেবে নিচ্ছিলো। দিদার এক পর্যায়ে তার লোকদেরকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলে। অন্য এক সময়ে বলে যে, ‘এই সময়ে বিপ্লব সম্ভব নয়।’ কারণ জাসদের মধ্যে যে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে দেশের শাসনভার চালানো খুব কষ্টকর হয়ে পড়বে। এই কথা শুনে একজন সৈন্য ক্ষেপে গিয়ে বলে, ‘লাইবেরিয়ায় যদি ক’জন সার্জেন্ট দেশ পরিচালনা করতে পারে, তাহলে একজন লেঃ কর্ণেল বাংলাদেশ চালাতে পারবে না কেন?’ দিদার কোন জবাব দেয়নি। জোয়ানেরা ১৭ই জুন আঘাত হানার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যায়। অফিসাররা রাজী না হলে, সৈন্যেরা পালিয়ে যায়। দিদার ভারতে পালিয়ে যায়। ১৯৮০ সালের ১১ই নভেম্বর বাংলাদেশে ফেরার পর কুষ্টিয়ার এ্যামবাসেডর হোটেলে সে গ্রেফতার হয়। পাশাকে আংকারা থেকে আলোচনা করার জন্যে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। ১৮ই নভেম্বর ঢাকায় এলে পাশাকে তৎক্ষণাৎ আটক করা হয়। বাকীদেরকেও কিছুদিনের মধ্যেই আটক করা হয়।

সেনাবাহিনীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি এবং ষড়যন্ত্র করে সরকারের ক্ষমতা দখলের অভিযোগের প্রথমে পাঁচজনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালের ১০ই মার্চ মাত্র তিনজনকে বিচারের জন্যে সামরিক আদালতে হাজির করা হয়। তারা হচ্ছে : লেঃ কর্নেল দিদারুল আলম, লেঃ কর্ণেল নূরুন্নবী খান আর কৃষি ব্যাংকের প্রশিক্ষণার্থী অফিসার মোশাররফ হোসেন। কর্ণেল পাশা আর ছাত্রনেতা মুনির হোসেন সমস্ত দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষীতে পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে, ষড়যন্ত্রের গোড়ায় থেকেও পাশা তার সঙ্গীদের ফাঁসিয়ে দেয়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সরকারী কৌঁসুলী অভিযুক্তদের জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড প্রদানের সুপারিশ করেন। কিন্তু ২০শে মে বিচার শেষে রায়ে দেখা যায় যে, দিদারুল আলমের ১০ বছর কারাদণ্ড, মোশাররফ হোসেন দু’বছর কারাদণ্ড এবং নূরুন্নবী খান এক বছর কারাদণ্ড পায়। কাজী মুনির হোসেনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। আর ‘ঘাতক মেজর’ পাশা তার চাকুরীস্থল আংকারায় সসম্মানে ফিরে যায়, যেন কিছুই ঘটেনি। এই ছিলো জেনারেল জিয়ার খামখেয়ালির ধরন। তিনি তার মাত্র নয়দিন পরেই অন্য একটি অভ্যুত্থানে নিহত হন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *