একাদশ অধ্যায় – জিয়া একটি নাম একটি কিংবদন্তী

১১. জিয়া একটি নাম একটি কিংবদন্তী

আমি ক্ষমতা দখল করিনি। আমাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিলো।

-জেনারেল জিয়াউর রহমান

তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি তাঁর এক হাতে হত্যা এবং অন্য হাতে আহার করতে পারতেন।

—চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জিয়ার এক সহকর্মী

.

১৯৭১ সাল। ২৬শে মার্চের ভোরবেলা। রেডিওর কিছু স্ক্রিপ্ট লেখক, শিল্পী, প্রযোজক ও একজন কুশলীর একটি ছোট দল বাংলাদেশের জন্যে কিছু একটা করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সম্মিলিত হয়। এই ধরনের লোকদের জন্যে এটি একটি অভিনব ও সাহসী পদক্ষেপ বৈকি—–এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই শুধু চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এক রক্তাক্ত হত্যালীলায় এক হাজার নিরস্ত্র করা বাঙ্গালী সৈন্যকে খুন করে। শুধুমাত্র দশজনের এই ক্ষুদ্র দল এই খবরে কিছুটা শঙ্কিত হলেও তারা তাদের উদ্দেশ্যে অটল। প্রথমেই তারা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে রেডিও পাকিস্তানের খবর প্রচার বন্ধ করে দেয়। পরে তারা চট্টগ্রাম শহর থেকে কিছু দূরে কালুরঘাট থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। দু’দিন পরে অবশ্য ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করে তারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ নামে প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে।

বেতার কেন্দ্রের সুষ্ঠু প্রচার কার্যের জন্যে এই ক্ষুদ্র দলের একজন নেতা, বেলাল মোহাম্মদ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্-এর ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) রফিকুল ইসলামের কাছে নিরাপত্তা চায়। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তখন শহরের মধ্যস্থিত রেলওয়ের পাহাড় থেকে পাকিস্তানীদের সঙ্গে লড়ছেন তিনি কথা দিলেও সম্ভবতঃ তার অন্যত্র ব্যস্ততার জন্যে কথা রাখতে পারেননি। পরদিন বেলাল ও তার বন্ধুরা জানতে পায় যে, চট্টগ্রামের ১৬ মাইল দূরে পাটিয়াতে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যেরা অবস্থান নিয়েছে। ওরা পাকিস্তানী সরবরাহ জাহাজ ‘সোয়াত’ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের আদেশের উপর বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। বেলাল মোহাম্মদ জানায়, ‘আমরা বগুড়ার জনৈক মাহমুদ হোসেনের টয়োটা গাড়ী করে পটিয়া গিয়ে আমরা বেশ কিছু সশস্ত্র সৈন্য দেখতে পাই। তাদের অধিপতির কথা জিজ্ঞেস করলে তারা জানায় যে, তাদের অধিপতির নাম মেজর জিয়া। ঐ সময় পর্যন্ত আমরা তাঁর নামও শুনতে পাইনি। তাকে প্রস্তাব করায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেলেন। এবং বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ আমরা তিন ট্রাক সৈন্য নিয়ে কালুরঘাটে ফিরে এলাম। মেজর জিয়া তাঁর জীপে এবং আমরা আমাদের সাদা টয়োটা গাড়ীতে চড়ে এলাম। ‘বেলাল ও তাঁর বন্ধুরা জিয়ার আত্মবিশ্বাস দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। রাস্তায় বাঙ্গালীদের সঙ্গে দেখা হলেই জিয়া বলছিলেন, আমরা পাকিস্তানী হানাদারদের খতম করতে দু’দিনের বেশী সময় নেবো না। উর্দু ভাষীরাও আমাদের শত্রু। কারণ এরা পাকবাহিনীর সমর্থক। আমরা তাদেরও ধ্বংস করে দেবো।’ রেডিও স্টেশনের চারিদিকে সশস্ত্র সৈন্য মোতায়েনের কায়দা দেখে তারা আরো অভিভূত হয়েছিলো। সুতরাং স্টেশন ম্যানেজারের অফিসে জড়ো হয়ে তার প্রধান কর্মকর্তার চেয়ারটা সৌজন্যতায় জিয়াকে এগিয়ে দেয়। বেলাল স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমি বললাম, মেজর সাহেব, এখানে আমরা সবাই ‘মাইনর’ কেবল আপনি মেজর।’ আমাদের জন্যে আপনি স্বকণ্ঠে কিছু প্রচার করেন না কেন? আমি ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বলেছিলাম। কিন্তু তিনি সেটা গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেন। তিনি নিজ পকেট থেকে কলমটা বের করে তাঁর ভাষণের খসড়া তৈরী করে ফেললেন। ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান, এতদ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ এইভাবে ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চের ঘোষণার মাধ্যমে জিয়া ইতিহাসে তাঁর স্থান করে নিলেন।

জিয়া এইভাবে অনেকগুলো সৌভাগ্যের সমাহার আর সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মাত্র সাত বছরের মধ্যে একজন নাম না জানা মেজর থেকে লেঃ জেনারেল ও বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবার গৌরব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেখা গেছে, জিয়া কখনো কোন ব্যাপারে অতি উৎসাহী হয়ে নাক গলায়নি। সব সময়ই তিনি কারো না কারো উপর ভর দিয়ে ক্ষমতার দিকে পা বাড়িয়েছেন।

শেখ মুজিবকে হত্যার পাঁচ মাস আগে মেজর ফারুক যখন তাকে উৎখাতের পরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন জিয়া তাকে বিরত করার কোন চেষ্টা করেননি। শেখ মুজিবের হত্যার পর, জেনারেল জিয়া দ্বিধাহীনচিত্তে সেনাবাহিনী প্রধানের পদটি গ্রহণ করেন। কিন্তু এরপরে, খালেদ মোশাররফ আর শাফাত জামিল যখন, প্রেসিডেন্ট মোশতাক এবং মেজরদের সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করে এবং তা চূড়ান্ত রূপ দেয়, তখনো তিনি আর একবার নীরব ভূমিকা পালন করেন।

সিপাহী বিদ্রোহের সময় তাঁর জীবন রক্ষা এবং পরে সেনাবাহিনী প্রধানের পদ প্রাপ্তির জন্যে তিনি জোয়ানদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। কিন্তু তারপরেই আবার তিনি তাদের নেতা, লেঃ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) তাহেরকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়েছিলেন।

১৯৭৬-এর নভেম্বর প্রেসিডেন্ট সায়েমকে দিয়ে তিনি জাতির প্রতি সরকারের পবিত্র প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ব্যবস্থা করেন। তারপর সায়েমকে অনানুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই ক্ষমতা দখল করেন।

১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ তাঁর ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জিয়াকে খ্যাতির শীর্ষে উঠিয়ে দেয়, যদিও আসলে এর ত্রিশ ঘণ্টা আগেই ঐ একই বেতারকেন্দ্র থেকে অন্য একজন দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।

বেলাল মোহাম্মদ জানান যে, মোহাম্মদ আবদুল হান্নান নামে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী, ২৬শে মার্চ দুপুরবেলা কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে দৌড়ে আসেন। তিনি দাবী করেন যে, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট থেকে একটি ‘সংবাদ’ নিয়ে এসেছেন। এই সংবাদটি রেডিওতে প্রচার করতে হবে। তিনি স্টেশনের সবাইকে চাপ দিতে থাকেন। কর্তৃপক্ষ প্রথমে এটাকে একটা বানোয়াট বার্তা মনে করলেও পরে অনেক পীড়াপীড়ির কারণে বেলা আড়াইটায় বার্তাটি সম্প্রচার করতে দেয়া হয়। বার্তাটির ভাষায়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পীলখানা (তৎকালীন ইপিআর সদর দফতর) আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেছে। সেখানে তুমুল যুদ্ধ বেধে গেছে। এই অবস্থায় আমি শেখ মুজিবুর রহমান, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। জয় বাংলা। খোদা হাফেজ।’

তার পরদিন জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা ছিলো একটি সাহসিকতাপূর্ণ ও সুচিন্তিত প্রচেষ্টার ফসল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ হান্নানের প্রচারিত ঘোষণা চট্টগ্রাম এলাকার কিছু লোক ছাড়া আর কেউ শুনতে পায়নি। চট্টগ্রাম বেতারের ট্রান্সমিটার ছিলো মাত্র ১০ কিলোওয়াট শক্তিসম্পন্ন এবং তার শব্দ পৌঁছানোর এলাকা ছিলো মাত্র ৬০ মাইল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রথম দিনে সবাই শক্তিশালী ঢাকা রেডিও স্টেশন কর্তৃক প্রচারিত সামরিক আইনের ঘোষণা শুনতে ব্যস্ত ছিলো। তাছাড়া, বেলাল এবং তার দল কালুরঘাট যাওয়ার আগে রেডিওর সুইচ বন্ধ করে যায়। যার ফলে জনগণ চট্টগ্রাম বেতারের কিছুই শুনতে পায়নি।

জিয়ার ভাগ্য ছিলো সত্যিই সুপ্রসন্ন। পরের দিন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় জিয়ার ঘোষণা দেয়ার সময় চট্টগ্রামবাসীরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খোঁজ পেয়ে যায়। তাছাড়া, আরো সৌভাগ্যের ব্যাপার এই যে, ভারত কর্তৃক সারা দুনিয়ায় এই ঘোষণা সম্প্রচারিত হয়ে যায়। এইভাবে অপরিচিত মেজর জিয়া সর্বত্র এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। অথচ ২৬শে মার্চ পর্যন্ত এটিকে একটি রাজনৈতিক এবং বেসামরিক ব্যাপার বিবেচনায় ‘জিয়া’ বাংলাদেশ-আন্দোলনে নিজেকে জড়াতে চাননি।

মেজর রফিকুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে জিয়ার সমসাময়িক এবং চট্টগ্রামে দু’জন একসঙ্গেই কাজ করছিলেন। মেজর রফিক পরে আমাকে জানান যে, সে সময় খালেদ মোশাররফ ঢাকায় কোন একটি ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে কর্মরত। দেশের এই পরিস্থিতিতে খালেদ তার চট্টগ্রামস্থ সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে চলে আসেন অন্যান্যের সঙ্গে আলাপ শেষে তিনি মেজর জিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ করেন এবং তাকে চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে আঘাত হানতে অনুরোধ জানান। ঘটনাটি ২৪ তারিখে ঘটে। খালেদের ভাষায়, ‘আমাদের উপর আঘাত হানার আগেই ‘আমাদেরকে তাদের উপর আঘাত হানতে হবে—তা’ না হলে ওরা আমাদের সবাইকে জবাই করে ফেলবে।’ জিয়া খালেদকে নিরস্ত করতে গিয়ে মন্তব্য করেন, ‘ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবে না।’

মেজর রফিক আরো জানান যে, ২৬ তারিখে জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে ‘এম ভি সোয়াত’ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের কাজ তদারকি করার জন্যে রওয়ানা হয়ে যান। পথিমধ্যে তিনি শুনতে পান যে, পাকিস্তানী হানাদারেরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়ে বহু নিরস্ত্র বাঙ্গালী সৈন্য হত্যা করেছে। এই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গেই জিয়া ফিরে যেয়ে এবং বিদ্রোহে যোগ দেন। তারপরই তাঁর সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তিনি পটিয়ায় চলে যান, যেখানে বেলাল তাকে আবিষ্কার করেন।

স্পষ্টতঃই দেখা গেছে যে, জিয়া সবসময়ই কাজে-কর্মে তড়িঘড়ি এড়িয়ে চলতেন। কোন ব্যাপারেই হঠাৎ করে তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন না। সব কাজই তিনি ধৈর্য ও খুব সতর্কতার সাথে করতেন। তিনি কোন ঝুঁকি নিতে চাইতেন না। এবং কাউকে বিশ্বাসও করতেন না। তিনি আবেগকে দারুণভাবে সামলিয়ে নিতে পারতেন। এমনকি রাতের বেলায়ও তিনি কালো ‘সানগ্লাস’ পরতেন যাতে করে কেউ তাঁর চোখ স্টাডি করে তাঁর মনের গতি অনুধাবন করতে না পারে। জিয়া ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করে রাষ্ট্রেীয় সর্বময় ক্ষমতা তাঁর হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং যতদূর সম্ভব কাজ একাই করতে চেষ্টা করতেন। পাকিস্তানী মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিসেবে অনেকদিন কর্মরত থাকার ফলেই সম্ভবতঃ তিনি এইসব গুণাবলী অর্জন করে নিয়েছিলেন।

কমিশন প্রাপ্তির চার বছর পরই বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে জিয়াকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে নিয়োগ করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করার সময় তার এই পূর্ব অভিজ্ঞতা যথেষ্ট কাজে লাগে।

অন্যান্য সবকিছু বাদ দিলেও, জিয়া ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। কেউ কেউ তাকে আবার ‘সৈনিকদের সৈনিক বলেও ডাকতেন’। জিয়ার জন্ম ১৯৩৬ সালে এবং তিনি ১৯৫৩ সালে কাকূলে অবস্থিত পাকিস্তানের মিলিটারী একাডেমীতে যোগদান করেন। কিন্তু জিয়া সামরিক বিদ্যার পড়াশোনায় তেমন মেধার পরিচয় দিতে পারেননি। তবে, সম্ভবতঃ তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত তাঁর জীবন বৃত্তান্তে রেকর্ড করা আছে, ‘১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি খেমকারান সেক্টরে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। সেই যুদ্ধে তিনি ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটা কোম্পানীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।’ ১৯৬৬ সালে জিয়াকে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীর প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ঐ সময়ে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ফারুক আর রশিদও ছিলো। জিয়া কোয়েটার স্টাফ কলেজে যোগ দেন এবং রাইনে অবস্থানরত বৃটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিন মাস নিয়োজিত থাকেন। বিদেশে জিয়ার এটাই ছিলো একমাত্র নিয়োগ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে জিয়া একজন কিংবদন্তীর নায়ক। দেশের স্বাধীনতা ঘোষণার গৌরব তাকে আরো বেশী মহিমান্বিত করে তুলেছিলো। জিয়া অত্যন্ত সফলতার সাথে তাঁর ‘জেড ফোর্স’ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পরিচালিত করেন। সিলেটের রাউমারী থেকে তাঁর ‘জেড ফোর্স’ অভিযান পরিচালনা করতো। এই কৃতিত্বের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতার পর তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। সাহসিকতা, ব্যক্তিগত সততা এবং ভদ্র ব্যবহারের জন্যে তিনি সকলের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। স্বাধীনতার পর অন্যান্যদের মধ্য থেকে তাকে আলাদা করে বিবেচনা করা হয়। প্রমোশন আসতে থাকে দ্রুতগতিতে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারীতে তাকে কর্ণেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং একই বছর ১০ই অক্টোবর তাঁকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ২০শে আগস্ট তিনি সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান নিয়োজিত হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৯ বছর।

সেনাবাহিনীতে এতে চমৎকার ক্যারিয়ারের সুবাদে সৈনিকদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এই জনপ্রিয় জেনারেলই তাঁর সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে ২০টি বিদ্রোহ আর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সম্মুখীন হন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, সিপাহী বিপ্লবের সময়ে যে সেন্যরা জিয়াকে কাঁধে চড়িয়ে নাচতে নাচতে ক্ষমতায় বসায়, সেই সৈন্যেরাই বারংবার তাকে হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। অন্যদিকে, জিয়াও সাংঘতিক হিংস্র হয়ে উঠেন। ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবর জিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভ্যুত্থান ব্যর্থায় পর্যবসিত হলে, জেনারেল জিয়া যেভাবে তাঁর নিজের সৈন্যদের উপর ব্যাপকহারে বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালান। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে কোন জেনারেল এমনটি করেছেন বলে নজির নেই।

প্রথমদিকেই আমি এর প্রমাণ পেলেও এই শান্ত, সুশীল আর চমৎকার ব্যবহারের লোকটি অতটা নৃংশস হতে পারেন, আমি বিশ্বাসই করতে পারিনি। ঘটনাক্রমে, জিয়াকে খুব কাছে থেকে জানতো এমন একজন লোকের সঙ্গে আমার আলাপচারিতা হয়।

‘জিয়া কেমন লোক ছিলেন?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করি।

লোকটি তার পরিচয় গোপন রেখেছিলো। সে অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তারপর অনেকটা ফিসফিস করে আমাকে বললো, ‘জিয়া এমন এক মানুষ ছিলেন, যিনি এক হাতে হত্যা আর অন্য হাতে আহার করতে পারতেন। ‘

১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে বাংলাদেশের সপ্তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ সময়ের প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম এক ঘোষণায় তাঁর দায়িত্বভার জিয়ার হাতে তুলে দেন। ঘোষণার ভাষায় :

‘আমি, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করছি। এবং তাঁর কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করছি।’

এই ঘোষণার মর্মার্থ অনুযায়ী বিচারপতি সায়েম তাঁর শারীরিক অসুস্থতার, অক্ষমতার জন্যে জিয়াকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে ঐ ঘোষণা প্রদান করেননি। জেনারেল জিয়া, বিচারপতিকে ঐ ঘোষণা দেয়ার জন্যে বল প্রয়োগে বাধ্য করেছিলেন।

এর আগের বছর ২৮শে নভেম্বর জিয়া সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রেসিডেণ্ট সায়েমকে এক সঙ্গে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে রাখা তাঁর জন্যে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে। দু’টি পদেই প্রেসিডেন্ট সায়েম তাঁর ভূমিকা সঠিকভাবে পালন করে আসছিলেন। এই সময়ে হঠাৎ করে সায়েমের মতের বিরুদ্ধে পরবর্তী ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করতে বাধ্য করেন। এর পেছনে প্রকৃত কারণ ছিলো, জিয়া ঐ সময়ে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ গড়ার পরিকল্পনা করছিলেন। তিনি নির্বাচন দিয়ে তাঁর ঐ পরিকল্পনার মূলে কুঠারাঘাত করতে চাইলেন না। অথচ বিচারপতি সায়েম প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ফেব্রুয়ারীতে নির্বাচন দিতে চাইছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই প্রেসিডেন্ট সায়েম জিয়ার প্রতি খুশী থাকতে পারেননি। প্রেসিডেন্টের একজন নিজস্ব লোকের মাধ্যমেই জিয়ার কাছে খবর চলে যায় যে, দেশে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যে প্রেসিডেন্ট, জিয়াকে সরিয়ে অন্য একজন অধিকতর কম উচ্চাভিলাষী লোককে নিয়ে আসতে পারেন। ব্যাপারটিতে আদৌ কোন রকম সত্যতা ছিল কি-না, আমি নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে, তা চির সন্দেহভাজন জিয়ার মনে তড়িৎ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং তিনি সায়েমকেই পাল্টা সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।

উপরস্থ যতজন সামরিক কর্তাব্যক্তিকে সমবেত করতে পেরেছিলেন তাদের সবাইকে নিয়ে জেনারেল জিয়া বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্টের কাছে চলে আসেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি তাঁর নিকট ছেড়ে দিতে বলেন। দিনটি ছিলো রোববার। তখন কেবলই সন্ধ্যে ৭টা বেজেছে। জিয়ার সঙ্গে যারা এলেন তারা হচ্ছেন-ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এরশাদ, চীফ অব স্টাফ জেনারেল আবুল মঞ্জুর, নবম ডিভিশনের কমান্ডার জেনারেল মীর শওকত আলী এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর দুই প্রধান, প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী বিচারপতি আবদুস সাত্তারও সেই সময় উপস্থিত ছিলেন।

এই সভায় উপস্থিত একজন আমাকে পরে জানায় : সায়েম জেনারেল জিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদটি জিয়াকে না দেয়ার জন্যে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি বলেন, ‘আমি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছি। দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করার কাজ আমাকে শেষ করতে দিতে হবে। জিয়াও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। তিনি অন্যান্যদেরকেও এ ব্যাপারে কাজে লাগাচ্ছিলেন। বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট খাবার এবং বিশ্রাম না নিয়েই মধ্যরাতের পর পর্যন্ত এ নিয়ে যুক্তি, পাল্টা-যুক্তি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ সায়েম ঐ সভায় উপস্থিত কারো সমর্থন পেলেন না। অবশেষে বিচারপতি সাত্তার সায়েমকে বলেন, ‘ভাই, জিয়া যখন সিএমএলএ-এর পদটা নিতে চাইছে, পদটি আপনি তাকে দিয়ে দিন।’ রাত ১টার দিকে সায়েম একটু নরম হলেন। এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ হস্তান্তরের কাগজে স্বাক্ষর করেন। এরপর সায়েমকে সরিয়ে বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট পদ দখল করা জিয়ার জন্যে শুধু সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

ঐ কাগজে সই করার আগে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রতি আরো একটি বিরাট প্রস্তাব রাখেন। প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল জিয়াকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করার প্রস্তাব করেন। আমাকে জানানো হয় যে, জিয়া ঐ প্রস্তাবে অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরই তাঁর জটিল, ব্যক্তিত্বের মাঝে গোয়েন্দা মানুষটি মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে। একটু চিন্তা করে তিনি লেঃ জেনারেল হবার প্রস্তাবটি সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন। তাঁর ধারণা, মানুষ যেন তাকে বলতে না পারে যে, কেবল লেঃ জেনারেল হবার জন্যেই তিনি সিএমএলএ হতে চাইছিলেন। আসলে জিয়ার দরকার ছিলো কেবল ক্ষমতা আর প্রকৃত ক্ষমতা। গালভরা সুন্দর উপাধিতে তার মন ভরেনি।

সিপাহী বিদ্রোহ চলাকালে জোয়ানরা তাকে এনে সেনাবাহিনী প্রধানের পদে পুনর্বহাল করলে, জিয়া সম্ভবতঃ এটাকে দেশ শাসনের জন্যে তাঁর প্রতি এক রকম দৈব ইঙ্গিত বলে গ্রহণ করলেন। কয়েক বছর পরে জিয়া এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘আমি ক্ষমতা দখল করিনি। আমাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিলো।’ সুযোগ আর ক্ষমতার সদ্ব্যবহার সকলেই করতে চেষ্টা করে! এবং কোন জেনারেলই হয়তো দেশের সর্বোচ্চ পদের সুযোগটি হেলায় ছেড়ে দিতো না। কিন্তু জিয়ার উচ্চাভিলাষের সীমা ছিলো না। তিনি প্রেসিডেন্ট হবার পর আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার বাসনা মনে পোষণ করতে থাকেন।

১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরিকল্পনা এমনভাবে করা হয়েছিলো যাতে জিয়া সামরিক প্রেসিডেন্ট নন, বেসামরিক পোশাকে সামরিক প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। একজন সাংবাদিক তাকে ‘সাফারী স্যুট পরিহিত জেনারেল’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে জিয়া জনগণের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন। সন্দেহ নেই, তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস ছিলো সামরিক বাহিনী। ঐ সময়ে তিনি একাধারে সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর সর্বাধিনায়ক বহাল থেকে সেনাবাহিনীর উপর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করেছিলেন। ১৯৭৭ সালের এক ঘোষণায় জিয়া সংবিধানের কয়েকটি সংশোধন করেন। এর মধ্যে সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিস্ মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ সংযোজন করে জনগণকে এমন একটি ধারণা দেন যে, দেশটির সংবিধান ও পরবর্তী কার্যক্রম ইসলামী রঙে রঞ্জিত হয়ে উঠে। যদিও প্রকৃতপক্ষে দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ চরিত্রটির কোন পরিবর্তনই করা হয়নি’। আর একটি উল্লেখযোগ্য সংশোধনী হচ্ছে বাংলাদেশের জনগণকে এখন থেকে ‘বাঙ্গালী’ না বলে ‘বাংলাদেশী’ বলা হবে। শেখ মুজিবের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রভাব ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও পড়তে পারে বলে দিল্লীর কর্তাব্যক্তিরা মনে করতেন। এদিক থেকে জিয়ার ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দিল্লীতে সাদরে গৃহীত হয়।

বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেয়ার পরের দিনই এই পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন। এক মাস পরে অনুষ্ঠিত রেফারেন্ডামে তাঁর পক্ষে রায় পেতে ঐ পদক্ষেপগুলো কাজে আসে। এমনকি, ১৯৭৮ সালের জুনে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারেও এই পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই সকল অনুকূল পরিস্থিতির পরেও জেনারেল জিয়া তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জেনারেল ওসমানীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির আশ্রয় নিতে একটুও দ্বিধাবোধ করেননি। জিয়া বিরোধী দলগুলোকে মাত্র ৪০ দিনের নোটিশে নির্বাচনে আহবান করেন এবং মাত্র ২৩ দিন তাদের প্রচারণার সুযোগ দেন। অন্যদিকে তিনি নিজের নির্বাচনী প্রচারণার জন্যে সরকারী প্রশাসন যন্ত্রকে পুরোপুরি কাজে লাগান। সরকারী মালিকানাধীন টিভি, রেডিও এবং সংবাদপত্রকে একচ্ছত্রভাবে কাজে লাগানো হয়। সর্বোপরি, জেনারেল জিয়া একাধারে প্রেসিডেন্ট, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ছিলেন। আর কিছু ঘটুক বা নাই ঘটুক, এই সকল ক্ষমতার বলে এটা নিশ্চিত হয়েছিলো যে, পুলিশ এবং সরকারী কর্মচারীরা তাঁর পক্ষে কাজ করবে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল খলিলুর রহমানের মতে, একজন সিনিয়র জেনারেল ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে নির্দেশ প্রদান করেন যে, ‘যে কোন উপায়ে হোক’ নির্বাচনে জেনারেল জিয়ার বিজয় সুনিশ্চিত করতে হবে। তবে শতকরা ৭০ ভাগের বেশী ভোট যেন জিয়ার পক্ষে না দেখানো হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

জিয়া নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করলেন। কিন্তু একটা ভয়ঙ্কর সন্দেহ থেকে যায় যে, জিয়া ১৯৭৮-এর ঐ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে আদৌ যোগ্য ছিলেন কিনা। এই সন্দেহের পক্ষে প্রমাণসমূহ এতো শক্তিশালী যে, তাতে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্যে আসলেই যোগ্য ছিলেন না বলে প্রমাণিত হয়।

জিয়া কর্তৃক ঘোষিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ, ১৯৭৮ অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে পারবেন না :

(১) যার বয়স ৩৫ বৎসরের কম।

(২) যিনি এমপি নির্বাচনের জন্যে অযোগ্য।

(৩) যিনি সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। এমনকি, সংবিধান অনুযায়ী ঐ ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন না, যিনি সরকারী চাকুরী করেন এবং এতে করে বেতন গ্রহণ করে থাকেন।

জিয়া সেনাবাহিনীর চাকুরী থেকে ইস্তফা দেননি এবং তিনি তখন সেনাবাহিনী প্রধানের সক্রিয় দায়িত্বে নিয়োজিত। যা’ সংবিধান অনুযায়ী তাঁর ঐ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবার অযোগ্যতাকে প্রমাণ করে। এই পরিস্থিতিকে এড়ানোর জন্যে ১৯৭৮ সালের ২৯শে এপ্রিল তিনি দ্বিতীয় ঘোষণা (ত্রয়োদশ সংশোধনী), ১৯৭৮, জারি করেন।

ঐ অধ্যাদেশে বলা হয় :

(১) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে বহাল থাকবেন এবং তিনি প্রত্যক্ষভাবে কিংবা তাদের স্টাফ প্রধানদের মাধ্যমে তাদের পরিদর্শন, নির্দেশ প্রদান এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ব্যবহার করবেন।

(২) প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক অত্র প্রজাতন্ত্রের কোন চাকুরীতে নিযুক্ত এবং বেতন ভাতাদি ভোগ করছেন বলে বিবেচিত হবেন না।

এই দু’ট ধারা সংযোজন করে জিয়া সশস্ত্র বাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর উপর তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা বহাল রাখলেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অধ্যাদেশে নিজেকে সকল ত্রুটির ঊর্ধ্বে রাখতে প্রয়াস পেলেন। কিন্তু ১৯৭৮-এর ২রা মে, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখে এবং নির্বাচনের দিনেও জিয়া সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে বহাল ছিলেন। তার অর্থ এই যে, তিনি তখনও সেনাবাহিনীর সক্রিয় তালিকায় এবং সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত বেতনভোগী একজন কর্মচারী। তিনি ঐ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেননি। সুতরাং ঐ রকম সক্রিয়ভাবে সরকারী চাকুরীতে নিয়োজিত থেকে সংবিধানের ধারা মোতাবেক তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না।

এ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে যে, জেনারেল জিয়া, সেই সময়ের ডেপুটি চীফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল এরশাদকে, ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে চীফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করলেও তিনি ১৯৭৮-এর ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত চীফ অব আর্মি স্টাফের দায়িত্বভার নিজ হাতে রেখে দিয়েছিলেন। ১৯৭৮-এর ১লা ডিসেম্বর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের উপস্থিতিতে জেনারেল এরশাদকে তাঁর অফিসে ডেকে এনে হাতে লিখে ১৯৭৮- এর এপ্রিল মাসের তারিখ দিয়ে তাকে চীফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগের পত্র জারি করেন। আমাকে জানানো হয়েছিলো যে, কিছু সাংবিধানিক সমস্যা কাটানোর জন্যেই এই রকম ‘ব্যাক-ডেট’ দিয়ে কাজটা সমাধা করা হয়।

জিয়া তাঁর নিজের প্রমোশনের ব্যাপারেও কয়েকবার সেই আদেশ সংশোধন করে সর্বশেষ ৯/৪/১৯৭৯ ইং তারিখে ৭/৮/ডি-১/১৭৫-২৭০ নম্বর বিশিষ্ট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিজেকে ২৯/৪/১৯৭৯ ইং থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন। এবং ৯/৪/ ১৯৭৯ ইং তারিখে আর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৯/৪/১৯৭৮ ইং থেকে লেঃ জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই দলিল থেকেও এটা প্রমাণিত হয় যে, ১৯৭৮-এর জুনে তাঁর নির্বাচন ছিল অবৈধ এবং অসাংবিধানিক।

এই বৈধতা নিয়ে নির্বাচনের পূর্বে সেনাবাহিনীর একটা অংশ প্রশ্ন তুলে যে, জেনারেল জিয়া একই সঙ্গে সিইনসি, সিএমএলএ এবং সিএএস হিসেবে বহাল থেকে নির্বাচনে অংশ নিলে, তা সংবিধানের পরিপন্থীকে এবং তা আইন ও গণতন্ত্রের মূলনীতির বরখেলাপ বলে বিবেচিত হবে।

জিয়া ঐ সকল অভিযোগ অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলেন। তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘ওসমানী এমপি হয়েও কমান্ডার ইন চীফ পদে বহাল ছিলেন। আমি তো সিইনসি হয়ে তিন বাহিনী প্রধানের মাধ্যমে আমার ক্ষমতার ব্যবহার করছি মাত্র। আমার পদত্যাগ দেশের জন্যে খুব ভাল হবে না।

মার্শাল ল রেগুলেশন বলবৎ থাকায় সেদিন কোন কোর্টই তাঁর এই বৈধতার ব্যাপারে কোন প্রশ্ন তুলতে পারেনি। শুধু এই ক্ষেত্রেই জিয়া আইনকে তুচ্ছ ভেবে দূরে সরিয়ে রাখেননি। তিনি একের পর এক এই ধরনের কাজ করে যেতে থাকেন এবং মার্শাল ল কিংবা রাবার স্ট্যাম্প রূপী পার্লামেন্টকে তাঁর এ ধরনের প্রয়োজনে কাজে লাগান।

এই পদ্ধতিতে জেনারেল জিয়া সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করেন। এবং এ কাজে তিনি মার্শাল ল-কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে যথেচ্ছা ব্যবহার করেন।

তাঁর পরিবর্তিত নূতন পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ জেনারেল জিয়া প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন এবং প্রধানমন্ত্রীর চাকুরী তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হতে হবে, এমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট-এর বহির্ভূত এক-পঞ্চমাংশ মন্ত্রীদের নিয়োগ করার ক্ষমতা দেয়া ছিলো। যে-কোন বিলে তিনি তাঁর অসম্মতি দিতে পারতেন। পার্লামেন্টকে প্রেসিডেন্টের মতের বাইরে যাবার কোন উপায় ছিলো না। কেবল জাতীয় রেফারেন্ডাম-এর মাধ্যমেই পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্টকে ডিঙ্গাতে পারতো। জাতীয় স্বার্থে প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টকে না জানিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারতেন। তিনি তাঁর ইচ্ছেমত জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকতে, স্থগিত রাখতে এবং বাতিল করতে পারতেন। জিয়া কেবল তাঁর জন্যে আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার ব্যবস্থাকরণ বাকী রেখেছিলেন।

জেনারেল ওসমানী অভিযোগের সুরে বলেছিলেন, ‘ক্ষমতার পরিপূর্ণ কেন্দ্রীয়করণের ফলে প্রেসিডেন্ট জিয়া স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়েছিলেন। খন্দকার মোশতাক বলেছিলেন, ‘জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র একনায়কতন্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিলো। জনগণকে স্বপথে পরিচালিত করার জন্যে তিনি সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন।’

বাংলাদেশের মুকুটহীন রাজা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার পর জেনারেল জিয়া দেশ ও সমাজ উন্নয়নের সর্বাত্মক মনোনিবেশ করেন। প্রথমেই তিনি তাঁর ক্ষমতার উৎস সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলেন। সেনাবাহিনীতে তিনি নূতন ডিভিশন গঠন করেন। প্যারা মিলিটারী যেমন—পুলিশ, বিডিআর, আনসার ইত্যাদিকে শক্তিশালী করার জন্যে তিনি এগুলোর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত করেন।

শেখ মুজিবের আমলে যেখানে প্রতিরক্ষা বাজেট ছিলো মোট রাজস্ব বাজেটের শতকরা ১৩ ভাগ, সেখানে জিয়ার আমলে তা বেড়ে প্রায় তিনগুণে উন্নীত হয়। জিয়ার অর্থিৈতক ও রাজনৈতিক দর্শন ছিলো গ্রাম উন্নয়নে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং সবাইকে বিশেষ করে যুব সমাজকে উন্নয়নে শরীক করা। তিনি দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বলেন : আমাদের সকলের জন্যে একটি মাত্র শ্লোগান : ‘কাজ, কাজ, আর কাজ’।

উন্নয়নমূলক কাজের প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং যুক্তিযুক্ত শ্লোগানের মাধ্যমে জিয়া দেশপ্রেমিক জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। খাল খনন, রাস্তা তৈরী, বাঁধ নির্মাণ ইত্যাদি কাজে নিজে নেমে পড়েন এবং অন্যদেরকেও জড়িত করেন। এ সব কর্মসূচীর কিছু কাজ হয় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে আর কিছু কাজ হয় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর ভিত্তিতে। কিছু কাজ আবার নগদ অর্থের বিনিময়েও সম্পাদন করা হয়। প্রেসিডেন্ট নিজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ সকল কাজে অংশগ্রহণ করেন। কয়েকজন মন্ত্রী বলেন, সকল কাজে তাঁর সঙ্গী হবার জন্যে তাদেরকে ভোর চারটায় ডেকে পাঠানো হতো।

এই ধরনের প্রশংসনীয় উদ্যোগ এক নাটকীয় সুফল বয়ে আনে। ঢাকা শহর আগের তুলনায় অনেক বেশী সুন্দর হয়ে উঠে। বিদেশী সৌখিন জিনিসে বাজার ভরে উঠে। সর্বত্র বেশ একটা উন্নয়নের ছোঁয়া লেগে যায়। কিন্তু সে সময় দুর্নীতির মাত্রা দারুণভাবে বেড়ে যায়। জিয়া নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখার মানসে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেন।

সাভারে অবস্থিত একটি সোশ্যাল ইনস্টিটিউট-এর বরেণ্য প্রধান, ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাকে জানায়, এক সময়ে আমরা সকলেই তাকে বিশ্বাস করতাম। আমরা সকলেই বিশ্বাস করতাম যে, জেনারেল জিয়া সত্যিই দেশটিকে একটি প্রগতিশীল, সাম্যবাদী এবং জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চান। কিন্তু শীঘ্রই আমরা বুঝতে পারলাম যে, তিনি কেবল বড় বড় বুলি আওড়িয়ে চলছেন। তিনি ঐ সকল কথাকে জনগণের প্রতি তাঁর শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করতেন। তিনি কেবলই তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে কাজ করে যাচ্ছিলেন।

জেনারেল জিয়া ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত সৎ এবং অর্থ-সম্পদ কুক্ষিগত করার ব্যাপারে সকল দুর্নীতির ঊর্ধ্বে ছিলেন। সরকারের অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের লোকদের মতো ঢাকায় তাঁর কোন বাড়ী ছিলো না। প্রমাণ রয়েছে যে, তিনি একবার বেতন থেকে অগ্রিম উঠিয়ে কিছু আসবাবপত্র কিনেছিলেন। পরে তিনি সেই টাকা তাঁর বেতন থেকে কিস্তিতে কেটে পরিশোধ করেন। জিয়া মদ পান করতেন না। তিনি জুয়া খেলতেন না কিংবা তাঁর আর কোন সামাজিক অপরাধের সঙ্গে কোন রকম যোগসূত্র ছিলো না। কিন্তু তিনি তাঁর লোকজনকে এ ব্যাপারে দীক্ষা দান করেননি কিংবা তা প্রতিরোধ করার কোন ব্যবস্থাও গ্রহণ করেননি। উদ্দেশ্য ছিলো এই যে, এতে তাঁর সহচরগণ তাঁর প্রতি দুর্বল ও নির্ভরশীল হয়ে থাকবে। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলেও তাঁর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি ঐ সকল দুর্নীতি মেনে নিয়েছিলেন।

এগুলোর একটি হচ্ছে জিয়ার সৃষ্ট যুব কমপ্লেক্স। এই যুব কমপ্লেক্স দেশের বড় বড় হাট-বাজারের সংগৃহীত টাকা গায়েবের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সরকারী হিসেব মতে, ১৯৭৯-৮০ ও ১৯৮০-৮১ এই দুই অর্থ বছরে প্রায় সাড়ে বারো কোটি টাকা দেশের যুব

কমপ্লেক্সগুলো আত্মসাত করতে সক্ষম হয়। পরে, ১৯৮২ সালে ক্ষমতায় এসে জেনারেল এরশাদ যুব কমপ্লেক্স বাতিল ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে জেনারেল জিয়ার চরম অপব্যয়ের আর এক উদাহরণ হচ্ছে—খাল খনন কর্মসূচী। সরকারীভাবে বিপ্লবের প্রথম পর্যায় হিসেবে সংসদে এর জন্যে বিল আনয়ন করা হয়।

১৯৭৯ সালের ১লা ডিসেম্বর এই কর্মসূচীর উদ্বোধন করা হয়। গ্রীষ্মকালীন সেচের সুবিধার্থে ৯০০ মাইল নতুন খাল খনন ও পুরনো খাল পুনঃখনন করা কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়। এর লক্ষ্য ছিলো, ৬০ লক্ষ টন অতিরিক্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন করা। সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই কর্মসূচী চালানোর পরিকল্পনা ছিলো। এ উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট নিজে এবং মন্ত্রীবর্গ ও উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা খাল খনন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বিনা পারিশ্রমিকে কেউ কাজ করছে না। ফলে, বিনিময়ে খাদ্য এবং অন্যান্য সূত্র থেকে এই কর্মসূচীতে অর্থ যোগান দেয়া হয়। অথচ ঐ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় বিএনপি কর্মীদের পকেটে কিংবা স্থানীয় কর্মকর্তাদের পকেটে। অবশেষে জিয়ার মৃত্যুতে এই কর্মসূচীর অবসান ঘটে। এই কর্মসূচীর বদৌলতে সরকারকে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হয়।

১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে লন্ডনের স্পীকারস কর্ণার-এর অনুকরণে জিয়া ঢাকায় একটি মুক্তাঙ্গন’-এর উদ্বোধন করেন। মন্ত্রী তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, ‘যে কেউ তার অভিযোগ, আপত্তি সবকিছু খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করতে পারবে। একমাত্র রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি আক্রমণাত্মক উক্তি ছাড়া কোন বক্তব্যের জন্যে কারো বিরুদ্ধে কোন প্রকার ব্যবস্থা নেয়া হবে না।’ কিন্তু ‘মুক্তাঙ্গনে’ গোয়েন্দা বিভাগের লোকজনের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে কেউ সেখানে কোন বক্তব্য রাখতে সাহস পায়নি। কারণ জিয়ার প্রতি সকলেরই বিশ্বাস ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। সুতরাং ‘মুক্তাঙ্গন’ সংক্রান্ত পুরো ব্যাপারটিই হাসির খোরাকে পরিণত হয়।

জিয়ার আর একটি কাজ সকলের হাসির উদ্রেক করে। বিষয়টি ছিলো একটি রাজনৈতিক পরীক্ষা। ‘বিএনপি’র আদর্শ ও দর্শনের’ উপর তিনি মন্ত্রী ও দলীয় এমপিদের একটি লিখিত পরীক্ষা নেন। অন্য কেউ যাই মনে করুক, অন্ততঃ তিনি তা গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেন। তিনি শিক্ষক হিসেবে তাদের সঙ্গে অনেকগুলো ক্লাসও নিয়েছিলেন। জিয়ার মৃত্যুর মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ১২ই এপ্রিল, ১৯৮১ সাল, তিনি ঐ লিখিত পরীক্ষা নেন। এতে ৫০ জন মন্ত্রী ও দলীয় নেতা ঐ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু পাশ করেন মাত্র ১০ জন। অকৃতকার্যদের মধ্যে ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শাহ্ আজিজুর রহমান এবং উপ- প্রধানমন্ত্রী জামালুদ্দিন আহমেদ। এই ছিলো বিএনপি’র রূপ।

তবে বাংলাদেশের জন্যে জিয়ার যে সত্যিকার অবদান ছিলো তা হচ্ছে তিনি প্রথমবারের মতো দেশের লোকদের ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে গর্ববোধ করার পরিচয়ে পরিচিত করে তুলেন। ১৯৭৭ সালের এক ঘোষণায় তিনি জারি করেন যে, এখন থেকে দেশের জনগণ ‘বাঙ্গালী’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী’ বলে গণ্য হবে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা এ নিয়ে না ভাবলেও জিয়া এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে চিন্তা-ভাবনা করেন। তিনি সঠিকভাবেই অনুধাবন করেছিলেন যে, ‘বাংলাদেশী’ জাতীয়তাবাদ-সৃষ্টির লক্ষ্যেই জনগণ স্বাধীনতা যুদ্ধে চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছিলো।

বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আসলে ঐ সকল ঘটনাবলীরই মূল কথা। এটা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানীদের পছন্দের কোন ব্যাপার ছিলো না। বহু বছরের বঞ্চনা আর গঞ্জনা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী পাঞ্জাবী শাসকচক্র পূর্ব পাকিস্তানীদের মন একেবারে বিষিয়ে তুলেছিলো। সেই বঞ্চনার শিকার পূর্ব পাকিস্তানী বাঙ্গালীরা পাঞ্জাবীদের নজরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছিলো। ঐ সবের প্রতি প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশই হলো ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ গোড়ার কথা। এটা অনস্বীকার্য যে, সে সময় পূর্ব বাংলার বাঙ্গালীরা প্রবল চাপের সৃষ্টি না করলে বৃটেন হয়তো কোনমতেই ‘পাকিস্তান’ সৃষ্টিতে সম্মত হতো না। ইতিহাসে পাকিস্তানই প্রথম রাষ্ট্র বা সৃষ্টি হয়েছিলো ধর্মের ভিত্তিতে। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশী হলেও পাকিস্তানী শাসকরা কখনো বাঙ্গালীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেনে নেয়নি। তারা পূর্ব পাকিস্তানের কৃষ্টি, সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেও মেনে নেয়নি। বিশ বছর এক সঙ্গে থাকার পরও তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং পাকিস্তানের ১৯৬৯ সালের সাধারণ নির্বাচন ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের’ উপর ‘গণভোটের’ আকার ধারণ করে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সেই গণভোটের রায়ও মেনে নেয়নি। তারা তার জবাবে বাঙ্গালীদের উপর সামরিক শক্তির চরম প্রয়োগে লিপ্ত হয়। ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয় একটি নূতন দেশ, বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে বসবাসকারী বাঙ্গালীরাই ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের’ অধিকারী। জিয়ার দর্শনও ছিলো তাই।

জেনারেল জিয়া দেশের জনগণকে ‘বাংলাদেশী’ আখ্যা দিয়ে এবং সংবিধানকে কিছুটা ইসলামী রঙে রঞ্জিত করে জনগণের মনে অনেকটা তৃপ্তির ছোঁয়া লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তা সমাদৃত হতে থাকে। অন্ততঃ এ কারণে প্রেসিডেণ্ট জিয়া দেশের মানুষের মনে একটু জায়গা পাবেন।

জেনারেল জিয়া তাঁর দল বিএনপিতে সকল দল ও মতাদর্শের লোকদের একত্রে জমায়েত করেন। অসময়ে শেখ মুজিবের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয় বিএনপি। জিয়ার বিএনপি পাকিস্তানী দালালদের জন্যে তার সবগুলো সদর দরজা খুলে দিয়েছিলো। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে পদপ্রার্থীদের মধ্যে ২৫০ জনই ছিলো ঐ দালালগোত্রের রাজনীতিবিদ। তাদের অধিকাংশই শেখ মুজিবের আমলে পাকিস্তানী শাসকচক্র ও হানাদার বাহিনীর সঙ্গে দালালীর অভিযোগে অভিযুক্ত হয় এবং সাজা ভোগ করে। অর্থাৎ দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, জিয়া প্রথম মন্ত্রীসভা এমনভাবে সাজিয়েছিলেন; যেখানে পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন দালালের গোষ্ঠী আর মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানীরা একই সঙ্গে বসে দেশের ভবিষ্যৎ নীতি নির্ধারণ করছিলেন। অনেকে জিয়ার এই কার্যকলাপকে ধিক্কার জানায়। বাংলাদেশীরা যুক্তিসঙ্গত মানুষ। তারা ভাল করেই জানে যে, প্রতিহিংসা অনেকদিন ধরে – বুকের ভেতর চেপে রাখা যায় না। এতে আরো বেশী রক্তপাতের সম্ভাবনা থেকে যায়। দালালদের ব্যাপারটারও ছিলো অনেকটা ঐ রকম। তাই জেনারেল জিয়া ক্ষোভ চেপে না রেখে, তাদের জন্যে তাঁর পার্টির দরজা খুলে দেন। এনং নিজেকে ‘সমঝোতার ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তবে এটা ঠিক যে, জিয়া এ ধরনের সমঝোতা চাননি। নিজের সমর্থনকে ভারী করার উদ্দেশ্যেই তিনি এ পথ বেছে নিয়েছিলেন।

অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার যে, জিয়ার সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে দেশে তেমন কোন বড় ধরনের বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয়নি। জিয়ার আমলে এ রকম সৌভাগ্য থাকা সত্ত্বেও দেশের অর্থনীতিতে চরম দুরবস্থা বিরাজ করতে থাকে। স্বনির্ভর আন্দোলনের নেতাকেই বিদেশী সাহায্যের জন্যে হাত পেতে বসে থাকতে হয়। জিয়া দেশে একরকম এবং বিদেশে অন্যরকম ভাবমূর্তি দেখাতে শুরু করেন। তিনি দেশের জনগণকে স্বনির্ভরতার দীক্ষা দান করতে থাকলেও একই সময়ে তিনি বিদেশী সংস্থাগুলোকে অধিক থেকে অধিকতর সাহায্য প্রদানের জন্য ফুসলাতে থাকেন। তার এই দ্বিমুখী চরিত্র সহজেই ফাঁস হয়ে পড়ে। জনগণ এসব বুঝতে পেরে আসন্ন দুর্দিনের চিন্তায় শঙ্কিত হয়ে উঠে।

পাকিস্তানের পাঁচজন নামকরা সাংবাদিক এম. বি. নাভি জিয়া হত্যার মাত্র মাসখানেক আগে বাংলাদেশে বেড়াতে এসে, দেশের রাজনীতি আর দুর্নীতির এক করুণ চিত্র তুলে ধরেন।

মারকাস ফ্রান্ডা তার ‘জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ’ নামক সমীক্ষা গ্রন্থে বলেন, ‘একটি ক্ষুদ্র নব্যধনী শ্রেণীর হাতে বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত অর্থের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় দেশের পরস্পর বিরোধী দুই ধরনের অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে, একদিকে ঢাকা কেন্দ্রিক একটি শ্রেণী দিন দিন উন্নত ও ধনবান হচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলের অবস্থা খারাপ থেকে অধিকতর খারাপ হয়ে পড়ছে।’

এ ধরনের অবস্থায় সন্ত্রাস, অপরাধজনিত ঘটনা আর হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। জিয়া আর জনগণ~~এই উভয়পক্ষের জন্যেই রঙ্গিন স্বপ্ন স্নান হয়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক হত্যা আর ডাকাতি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। কুষ্টিয়ায় পুলিশ কনস্টেবলের হাতে জেলা প্রশাসক প্রহৃত হয়। স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায় এবং এতে পুলিশের হাত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। এ ধরনের অপকর্ম বাংলাদেশে এর আগে এমন ব্যাপকহারে ঘটতে কখনো শোনা যায়নি। ১৯৮০ সালের শেষে এবং পরবর্তী সালের প্রথমদিকে মুক্তিযুদ্ধ আর দালালগোষ্ঠীর মধ্যে একটা মুখোমুখি সংঘর্ষের অবস্থা সৃষ্টি হয়ে যায়। সেই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই এই দুই দলের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পাওয়া যেতে থাকে। পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিলো যে, দু’দলই দেশব্যাপী এক মহাসমরের লক্ষ্যে বারবার অস্ত্রশস্ত্র যোগানের কাজ চালিয়ে যাচেছ। জেনারেল জিয়ার ‘সমঝোতা নীতি’র ফলস্বরূপ এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।

১৯৮১ সালের জানুয়ারীর গোড়ার দিকে সরকারী ইঙ্গিতে পত্র-পত্রিকাগুলো জেনারেল জিয়া ও আওয়ামী লীগের মাঝে কোন একটা বুঝাপড়া চলছে বলে মত প্রকাশ করে। সাপ্তাহিক ইত্তেহাদ একটি সংবাদ দেয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, জেনারেল জিয়াকে শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছানোর অনুরোধ করেছেন। ঐ সময়ে শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থানরতা। ইত্তেহাদের মতে, আওয়ামী লীগ সমঝোতার জন্যে দু’টি শর্ত আরোপ করে। একটি হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা ঘোষণা করতে হবে। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটি নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে। পত্রিকাটি বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানায় যে, জিয়া দু’টি শর্তই মেনে নিতে রাজী হয়েছেন। ইত্তেহাদে বলা হয় যে, জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, তিনি মুজিব হত্যাকারী দলের অন্যতম সহযোগী লেঃ কর্নেল পাশাকে মুজিব হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করবেন। এ সময়ে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযোগে পাশার বিচার চলছিলো।

ভারতীয় প্রধানন্ত্রীর হস্তক্ষেপের কারণেই হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক, জেনারেল জিয়া শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। হাসিনা ৭ই মে, ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এলে তাকে এক বিরাট বিজয়ীর সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। হাসিনার প্রত্যাবর্তন ও তার সম্বর্ধনার বহর দেখে ‘দালালগোষ্ঠী’ যথেষ্ট শঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা মনে মনে ভাবতে থাকে যে, এবার তাদেরকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হবে। এ সময়ে বেশ কয়েকটি প্রকাশ্য ও গুপ্ত ঘটনা ঘটে। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ডগুলো ঘটানো হয়, যার কারণে জনগণ এতে সরকারের ইঙ্গিত রয়েছে বলে মনে করে এবং এ জন্যে সরকারকে অভিযুক্ত করে। কয়েকদিন পর জেনারেল জিয়া এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বীকার করেন যে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ ধরনের বহু গুপ্ত হত্যার তদন্ত করার জন্যে গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর রিপোর্ট প্রকাশে ব্যর্থ হওয়ায় সকলেই সরকারকে অভিযুক্ত করে এবং বলতে থাকে যে, এ ধরনের গুপ্ত হত্যাগুলোর ব্যাপারে সরকার ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রাখার ভান করছেন। ঐ সকল হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করার হেতু জিজ্ঞেস করা হলে জিয়া বলেন যে, ‘এর জন্যে একটু সময়ের প্রয়োজন হবে। কারণ প্রশাসনকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

প্রশাসন পরিবর্তনের কথা জিয়া এর আগেও কয়েকবার উল্লেখ করেছেন। তার পূর্বসুরি শেখ মুজিবের মতো জিয়াও নিজের নীতির ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে পারেননি। এই রকম পর্বত প্রমাণ অসন্তোষের জন্যে তিনি প্রশাসন এবং সাংবিধানিক গঠনকে দায়ী করেন। বিএনপি’র এক কাউন্সিল অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে জিয়া বলেন, ‘ঔপনিবেশিক শাসকের কাছ থেকে পাওয়া আইন-কানুন দিয়ে বিপ্লব সফল হতে পারে না। আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের আইন-কানুনকে সংশোধন ও ঢেলে সাজাতে হবে। আমরা প্রশাসনকে ধাপে ধাপে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করছি।

ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাকে জানান, ‘ঠিক শেখ মুজিবের শেষ দিনগুলোর মতো, রিপোর্ট এবং গুজব চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিলো যে, অচিরেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। জিয়া মারা না গেলেও ছয় মাসের মধ্যে দেশের ভেতরে একটা মারাত্মক গোলযোগের সৃষ্টি হতো। জিয়ার প্রশাসন যন্ত্র অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। জিয়া যেহেতু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিতে অক্ষম ছিলেন, সেজন্যে তার প্রশাসন আরো অধিক দুর্বল হয়ে পড়তো।’ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে ডঃ জাফরুল্লাহর একটা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি জিয়ার মৃত্যুর মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। জাফরুল্লাহ নিজেও আন্দাজ করতে পেরেছিলেন এবং সেই সম্বন্ধে একটি গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, জিয়া অতি সত্বর জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। এবং তিনি তাঁর সরকার পরিচালনার জন্যে একটি ‘বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠন করবেন। এর আগে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকাতেও এর একটা পরিষ্কার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিলো।

মুজিব হত্যার ছয় বছর পর জিয়ার ভাগ্যের চাকা পুরোপুরি একবাক ঘুরে গেলো। জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশ আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো। এবং শেখ মুজিবের মতো, জিয়াও সংবিধান বহির্ভূত পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঐ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালান।

জিয়ার চরিত্রে যে একটা সন্দেহ প্রবণতা কাজ করছিলো, সে জন্যে তিনি তার সর্বময় ক্ষমতার সামান্য একটুও হাতছাড়া করতে ভরসা পাচ্ছিলেন না। তিনি রাজনৈতিক সুবিধের বন্দীপাশে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করতে পারেননি, যা তাকে এবং তার বাংলাদেশকে রক্ষা করতে পারতো। শেষেরদিকে তাঁর সন্দেহ প্রবণতা চরমে পৌঁছে। জেনারেল জিয়া অত্যন্ত শক্ত হাতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ‘আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার অভিলাষ মনে মনে পোষণ করতে লাগলেন। কিন্তু সেই অভিলাষ স্থায়ী হলো না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *