দশম অধ্যায় – একটি স্মরণীয় রাত

১০. একটি স্মরণীয় রাত

‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই,
অফিসারদের রক্ত চাই।’

–সিপাহী বিদ্রোহের শ্লোগান

.

৩রা, ৪ঠা ও ৫ই নভেম্বর (১৯৭৫)—এই তিনদিন বাংলাদেশে কোন সরকার ছিলো না। খন্দকার মোশতাক তখন নামে মাত্র প্রেসিডেন্ট। ৬ই নভেম্বর পর্যন্ত তাঁর নামেই কাজ-কর্ম চলছিলো। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম ঐদিন সকালবেলা তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে, মোশতাক বঙ্গভবনের বন্দী জীবন-যাপন করছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ আর কর্নেল শাফাত জামিল তাকে বঙ্গভবনের নীচতলায় তাঁর কক্ষে নিরাপদে আটকে রেখেছিলো।

অভ্যুত্থানের দুই নেতাই তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা বদলের ব্যাপারে তারা ছিলো অটল। বাস্তব পরিস্থিতি যখন তাদের বিপরীতে, তখন তারা ক্ষমতা বদলের জন্যে ব্যস্ত।

মেজরদেরকে ব্যাংককে পাঠিয়ে খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীর প্রধান হবার জন্যে মোশতাক আর জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ওরা প্রধান বিচারপতিকে প্রেসিডেন্ট বানানোর জন্যে আর মোশতাককে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্যে যে ধরনের সাংবিধানিক কৃত্রিম অভিনয়ের আয়োজন করছিলো, ঐ মুহূর্তে আদৌ তার কোন প্রয়োজনই ছিলো না। এই সকল হাস্যাস্পদ কাজ করতে গিয়েই সে তার অবস্থান সুদৃঢ় করতে ব্যর্থ হয়। খালেদের উচিত ছিলো ঐ সময়ে তার অভ্যুত্থানের প্রতি জনগণের সমর্থন আদায় করার ব্যবস্থা করা। এতে করে তার জীবন রক্ষা পেতে পারতো।

খালেদ মোশাররফ আর শাফাত জামিল সরকারের ক্ষমতা দখল ও তাদের নিজেদের সেই ক্ষমতা নিজেদের প্রয়োজনে প্রয়োগ করতে পারেনি। জেনারেল ওসমানী কিংবা খন্দকার মোশতাককে তাদের কোন প্রয়োজন ছিলো না। সফল অভ্যুত্থান মানেই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারা। খালেদ সফল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে ঐ ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছিলো। খালেদ তখন সেনাবাহিনীর প্রধান কিংবা প্রেসিডেণ্ট—এমন কি দুটোই হতে পারতো। দুই হাতে সর্বময় ক্ষমতা তুলে নিতে ব্যর্থ হবার কারণেই তার পতন অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো। তিনদিন ধরে জনগণ বুঝতেই পারেনি যে, খালেদ মোশাররফ আসলেই ক্ষমতায় এসেছে। রাজনৈতিক শূন্যতার কারণেই তার শত্রুরা অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে ঐ শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে আসে। ৬ই নভেম্বর, দেশের নূতন প্রেসিডেণ্ট এ. এস. এম. সায়েম যখন খালেদের অভ্যুত্থানের কারণ এবং তার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যাদানে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময়েই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে চলে যায়। মহান সিপাহী বিদ্রোহের দাবানল ইতিমধ্যেই জ্বলে উঠে। এতেই তার করুণ পরিণতি ঘটে।

খালেদের অভ্যুত্থান বাদ দিলেও দেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কুড়িটিরও বেশী অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালানো হয়। সব কয়টা অভ্যুত্থানই ছিলো অদূরদর্শিতা আর অপরিপক্ক পরিকল্পনা দোষে দুষ্ট।

১লা নভেম্বরে খালেদ ও তার সঙ্গীরা ঢাকা স্টেডিয়ামের কাছে একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁয় যখন ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত, তখনই অন্য একটি দল অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায়। মোশতাক সরকারকে উৎখাতের জন্যে একটি অভ্যুত্থান অত্যাসন্ন বলে গরম গুজব সারাদেশের বাতাসকে ভারী করে রেখেছিলো। ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর জন্যে বামপন্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল আর সর্বহারা পার্টি সৈন্যদের মধ্যে বৈপ্লবিক চেতনার উস্কানি দিয়ে গোপনে বিপ্লবী সেল গঠন করে। সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান, জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেও একটি অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে আছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো। সে সময় পাকিস্তান ভাবাপন্ন দলগুলো নূতন পাকিস্তান গড়ার মানসে খন্দকার মোশতাকের চেয়ে অধিক বিশ্বাসযোগ্য কোন নেতার সন্ধান করতে থাকে। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে বলে, তখন ঢাকার বাতাস একেবারে রমরমা হয়ে উঠেছিলো।

খালেদের চাইনিজ রেস্তোরাঁ পরিকল্পনাটি অত্যন্ত অসময়োপযোগী প্রমাণিত হয়েছিলো। এর উদ্দেশ্যাবলীও ছিলো অনুদার। শান্তিপূর্ণভাবেই হোক কিংবা বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই হোক—–মেজরবৃন্দ আর তাদের ট্যাংকগুলোকে সরিয়ে সরকারের ক্ষমতা দখল করাই ছিলো ঐ ষড়যন্ত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, একই সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে আটক করে জোরপূর্বক তাকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা। ঐ দু’টি কাজ সম্পন্ন হবার পর খালেদ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নামে মাত্র মোশতাককে রেখে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চিন্তা করছিলো। কিন্তু শাফাত জামিল মোশতাকের নামটা একেবারেই সহ্য করতে পারতো না। অবশেষে ৩রা নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসেবে মোশতাককে রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু যখন পরের দিন জেলহত্যার ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়, খালেদ তাকে বাদ দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পায়নি। এতে আপাততঃ খালেদের পরিকল্পনায় বেশ কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়।

এই ব্যাপারে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তাদের পরিকল্পনার কোন পর্যায়েই বিকল্প সরকার গঠনের জন্যে তাজউদ্দিন আহমেদ কিংবা জেলে নিহত চার নেতার কাউকে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়নি। খালেদ গ্রুপের একজন প্রাণে বেঁচে যায়। সে তার পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা পোষণ করে। তার ভাষায়, ‘যেইভাবে আমাদের উপর অভিযোগ আনা হয়েছে, সেইভাবে খালেদ যদি তাজউদ্দিন কিংবা ঐ চারজনের যে-কোন একজনকে সরকার প্রধান করতে চাইতো, তাহলে মেজরদের আত্মসমর্পণের পরপর কি আমরা তাদেরকে মুক্ত করার জন্যে সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়ে জেলখানায় চলে যেতাম না? যেহেতু আমরা তা করিনি, এতে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের পরিকল্পনায় তাদের কোন স্থানই ছিলো না। আমরা ৪ঠা নভেম্বর দুপুরের আগ পর্যন্ত তাদের কথা আমাদের একেবারেই মনে ছিলো না। অথচ এর একটু পরেই আমরা জানতে পারি যে, ৩০ ঘণ্টা আগেই তাদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে খুন করা হয়েছে। ৩রা নভেম্বর তাজউদ্দিনকে উদ্ধার করতে গিয়ে যদি আমরা তার মৃত্যু দেথকে পেতাম, তাহলে মেজরের গোষ্ঠী কিংবা মোশতাক কেউই বেঁচে থাকতে পারতো না। এবং অভ্যূত্থানের ফলাফল হতো সম্পূর্ণ ভিন্নতর।’

এই বক্তব্যেই যুক্তি অকাট্য সন্দেহ নেই। কিন্তু এই যুক্তিও খালেদ মোশাররফের কোন কাজে আসতে পারেনি। খালেদ পুনরায় মুজিববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে বলে সকলের মনে তার প্রতি একটা ঘৃণা জন্মে যায়। তাছাড়া, দেশটিকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে বলেও জনমুখে তিক্ত ক্ষোভ প্রকাশ করতে শোনা যায়।

জাসদের প্রকাশিত ‘সাম্যবাদ’ পত্রিকায় খালেদের চারদিনের অভ্যুত্থান সম্পর্কে প্রচলিত ইতিহাস তুলে ধরে : ‘খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় এসেই দেশের উপর সোভিয়েত- ভারত রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কাজে লেগে যায়। আওয়ামী লীগ ও তার লেজুড় মনি-মোজাফফর চক্র প্রকাশ্যে শেখ মুজিবের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে লেগে যায়। আসলে খালেদ কি করেছিলো সেইটা বড় বিবেচ্য বিষয় নয়, ঐ রকম প্রতিকূল অবস্থায় সে কি করতে ব্যর্থ হয়েছিলো, সেটাই তার পতন নির্ধারণের মাপকাঠি বলে ধরা উচিত। ঐ সুযোগের চমৎকার সদ্ব্যবহার করে তার প্রতিপক্ষরা তার গায়ে ভারতীয় একখানা সীলমোহর লাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে ভারতীয় পত্র-পত্রিকা ও সরকারী রেডিও প্রচারণা খালেদ মোশাররফের গুণগানে মুখর হয়ে উঠে। ভুল বোঝাবুঝির জন্যে এটা খুব কম ছিলো না। জনগণ সন্দেহ করতে থাকে যে, এ অভ্যুত্থানের পেছনে নিশ্চয়ই ভারতের হাত থেকে থাকবে। দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ সন্দেহই জনমত তার বিরুদ্ধে যেতে সাহায্য করেছিলো।

মোশতাক আর মেজরদের উৎখাতের খবর শুনে উৎফুল্ল আওয়ামী লীগার, ছাত্র এবং মুজিব সম্পর্কিত দলগুলো রাস্তায় নেমে পড়ে। ৪ঠা নভেম্বর, মঙ্গলবার তারা ‘মুজিব দিবস’ হিসেবে পালন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, শহীদ মিনারসহ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে মিছিল বের হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে মুজিবের বাসভবনে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। পরদিনই তাজউদ্দিনসহ চার নেতার হত্যার প্রতিবাদে দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। তারপর ৭ই নভেম্বর, শুক্রবার শেখ মুজিবের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোকসভার আয়োজন করা হয়। এই সবই জনগণের মনে মুজিববাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে এই অভ্যুত্থানের সূচনা করা হয় বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তখন জনগণ মুজিব শাসনামলের দুঃস্বপ্ন সবেমাত্র কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছে। পরন্তু ফারাক্কা বাঁধের জন্যে তাদের মধ্যে ভারত বিরোধী চেতনা ও চরমে উঠেছিলো। সর্বোপরি, তারা যখন আবিষ্কার করলো আওয়ামী লীগের মিছিলে খালেদের মা ও ভাই নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন তারা বুঝে নেয় যে, অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত আর আওয়ামী লীগ জড়িত—এতে কোন সন্দেহ নেই। জাসদ আর মুসলিম লীগ সমস্ত শহর এবং ক্যান্টনমেন্টে হাজার হাজার লিফলেট আর পোস্টারে ভরিয়ে দেয়। এই অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত কাজ করছে বলে প্রচার তুঙ্গে উঠে। এর ফল হলো অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।

পরে এক সাক্ষাতকারে শাফাত জামিল আমাকে জানায়, ‘পরের দিন বুধবারের পত্রিকা দেখে খালেদ খুবই ঘাবড়ে যায়। টেলিফোন তুলে সঙ্গে সঙ্গে তার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘এটা তোমরা কি করেছো? তোমরা মিছিলে গেছো আর পত্রিকায় তোমাদের ছবি ছাপা হয়েছে। এটা করে তোমরা আমার দিন ফুরিয়ে দিয়েছো। আমি আর নাও বাঁচতে পারি।’ জামিলের ধারণা, খালেদ বুঝে নিয়েছিলো এ সবই তাদের বিরুদ্ধে চলে যাবে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, তাদের কেহই এ ব্যাপারে পাল্টা কোন ব্যবস্থা গ্রহণের কোন চেষ্টাই চালায়নি। অভ্যুত্থানের নেতারা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে উৎসাহিত কিংবা নিরুৎসাহিত কোনটাই করেনি। প্রথম তিন দিন যেখানে তাদের বিভিন্ন সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা উচিত ছিলো, সেখানে তারা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে। চতুর্থ দিন ছিলো ৬ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। সেদিন বিকেলে নূতন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে বেতার ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমার সরকার নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে মুসলিম বিশ্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন।’ তিনি বলেন যে, ‘শেখ মুজিবের হত্যায় সেনাবাহিনী জড়িত ছিলো না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আইন- শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হবে। এবং নিষ্কলুষ, নিরপেক্ষ প্রশাসন গড়ে তোলা হবে।’ এই সকল উদ্দেশ্যাবলী এতই প্রচ্ছন্ন এবং বাগাড়ম্বরবহুল ছিলো যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফের স্থলে নূতন মিলিটারী লীডার হবার একদিন পরেই তাঁর শাসনের প্রথম বছরের জন্যে ঐ সবগুলো নীতি কোন পরিবর্তন ছাড়াই দ্বিধাহীন চিত্তে তাঁর সরকারের নীতি হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন।

বিচারপতি এ. এস. এম. সায়েমের বয়স তখন ৫৯ বৎসর। যে-কোন মাপকাঠিতেই তিনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। অত্যন্ত খ্যাতিমান উকিল হিসেবে বহুদিন কাজ করার পর তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ হাই কোর্টের প্রথম ‘চীফ জজ’ নিয়োজিত হন। ১৯৭৩ সালে সুপ্রীম কোর্টের সৃষ্টি হলে, তিনি হন তার প্রথম প্রধান বিচারপতি। তিনি প্রেসিডেন্ট হয়ে মোশতাকের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে একেবারেই নারাজ ছিলেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ছিলেন নিবেদিত ও আন্তরিকতাপূর্ণ। সরকার প্রধান হিসেবে খালেদের অভ্যুত্থানকে তিনি মর্যাদার আসনে আসীন করেন। কিন্তু পরের দিন তাঁর ভাষণ সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার আগেই সিপাহী বিপ্লব শুরু হয়ে যায় এবং খালেদ এতে নিহত হন।

স্বল্পস্থায়ী অভ্যুত্থানে খালেদের একটিমাত্র ফায়দা হয়েছিলো। ঐ ফায়দাটি হচ্ছে তার সামরিক পদোন্নতি। ঢাকায় অবস্থিত সামরিক ইউনিটগুলোর নিয়ন্ত্রণ করলেও সে কখনো নিরাপদবোধ করেনি। কর্নেল শাফাত জামিলের ৪র্থ ও প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বেশ শক্তিশালী করে গড়া হয়েছিলো। কিন্তু একই সেনানিবাসে ফারুকের ল্যান্সার আর রশিদের আর্টিলারীও অবস্থান করছিলো। তাদেরক নিরস্ত্র করা হলেও তাদের থেকে যথেষ্ট ভয়ের সম্ভাবনা ছিলো। সুতরাং তাদেরকে ‘ব্লক’ দিয়ে রাখা প্রয়োজন হয়ে পড়ে। খালেদ এই উদ্দেশ্যে রংপুর থেকে ১০ম ও ১৫তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ডেকে পাঠায়। ওরা মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ‘কে’ ফোর্সের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। ঐ সময় সে তাদের সহায়তায় তার শক্তিবৃদ্ধি করতে প্রয়াস পায়

৫ই নভেম্বর মিলিটারী ফরমেশন কমান্ডারদের এক সম্মেলন ডাকে খালেদ। কিন্তু সে নিজে বা শাফাত জামিল কেউই ঢাকার অন্যান্য অফিসার বা সৈন্যদের প্রভাবিত করার চেষ্টাটুকুও করেনি। তারা এদেরকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। এটা ছিলো তাদের জন্যে একটা মারাত্মক ভুল। প্রকৃতপক্ষে, ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে দু’জন অফিসারের প্রতি খালেদ অতিমাত্রায় আস্থাশীল ছিলো তারাই সিপাহী বিপ্লবের সময় তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

৩রা থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত খালেদ মোশাররফ দেশের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তই দিতে পারেনি। এই সময়ের মধ্যে বিদেশের সঙ্গে মাত্র দু’টি চুক্তি সম্পাদিত হয়। তার মধ্যে বৃটেনের সঙ্গে এক কোটি পাউন্ড স্টারলিং-এর কাঁচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ চুক্তি এবং তুরস্কের সঙ্গে ৪৯টি রেলওয়ে মিটার গেজ প্যাসেঞ্জার কোচের জন্যে ৩০৯ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই দুটোই ঢাকার সিনিয়র কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও সম্পাদিত হয়। অভ্যুত্থানের নেতাদের এই ব্যাপারে কিছুই করণীয় ছিলো না। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘ভারতীয় দালাল’ বলে খালেদ-এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিলো, প্রেসিডেন্ট সায়েমের বেলায়ও তা হতে পারতো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ কেউ তুলেনি।

৬ই নভেম্বর মধ্যরাতের কিছু পরেই সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। দু’দিন ধরে ক্যান্টনমেন্টে অস্থির চিত্তে বেঙ্গল ল্যান্সার আর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর সৈন্যেরা জেনারেল জিয়া আর মোশতাকের পদত্যাগের ব্যাপারটি অবলোকন করে। ব্যাংকক ত্যাগের আগে ফারুক ও রশিদ তাদের আশ্বাস দিয়েছিলো যে তাদের কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু জিয়া, মোশতাক আর পাপা টাইগার নামে খ্যাত জেনারেল ওসমানীর অবর্তমানে সেই আশ্বাস যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিলো। তাদেরকে ছায়া দেয়ার জন্যে আর কেউ বাকী রইলো না। সৈন্যেরা তখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ আর কর্ণেল জামিলের করুণার পাত্রে পরিণত হয়ে পড়ে। জামিল বেশকিছু জায়গায় প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেছে যে, সে মুজিব হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। সৈন্যেরা মনে করলো, দশম ও পঞ্চদশ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে নিয়ে আসা হচ্ছে।

সৈন্যদের মানসিক অবস্থা যখন বিপর্যস্ত, তখন অর্থাৎ ৫ই ও ৬ই নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টসহ সারা শহরে হাজার হাজার প্রচারপত্র ছাড়া হয়। ডানপন্থী মুসলিম লীগ আর বামপন্থী জাসদ এই কাজগুলো করে। ঐ সময়ে জাসদ ছিলো নিষিদ্ধ রাজনৈতিকদল। কিন্তু এরা বসে থাকেনি। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীর ছদ্ম আবরণে জাসদ এ কাজগুলো পরিচালনা করেছিলো। একটি ব্যাপারে সকল রাজনৈতিক দলই (আওয়ামী লীগ ছাড়া) একমত পোষণ করেছিলো এই বলে যে, খালেদ একজন বিশ্বাসঘাতক, ভারতের দালাল এবং সে সকলের ঘৃণিত বাকশাল আর মুজিববাদ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।

জাসদ আরো একধাপ এগিয়ে যায়। তারা বলে যে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সৈন্যদেরকে তাদের স্বার্থের খাতিরে যথেচ্ছা ব্যবহার করছে। নির্যাতিত সাধারণ মানুষ আর সৈন্যদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি উপরস্থ কর্মকর্তাদের কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ নেই। এই রকম দিক নির্দেশ করে গণজাগরণের ডাক দিয়ে জাসদ ১২টি দাবী পেশ করে। এগুলোর মধ্যে ‘ব্যাটম্যান’ প্রথা বাতিল করে পদমর্যাদা আর পোশাক-পরিচ্ছদে অফিসার-জোয়ানে ভেদাভেদ দূরীকরণ, সুবিধাভোগী শ্রেণী থেকে অফিসার নিয়োগ না করে জোয়ানদের মধ্য থেকে অফিসার নিয়োগ; উন্নত বাসাবাড়ী; বেতন বৃদ্ধিকরণ; দুর্নীতি দমন এবং রাজনৈতিক বন্দী মুক্তিদান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। জাসদের ঐ সকল দাবী সৈনিকদের কাছ থেকে তাৎক্ষণিক সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়।

এই সকল সুচিন্তিত দাবীনামা একজন প্রাক্তন আর্মি অফিসারের উর্বর মস্তিষ্কের ফসল। তিনি আর কেউ নন লেঃ কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবু তাহের। তিনি কর্নেল তাহের হিসেবেই সর্বসাধারণের কাছে সমধিক পরিচিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন কমান্ডো হিসেবে আমেরিকায় তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তাকে পাকিস্তানে আটকে রাখা হলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে গিয়ে তিনি ভারতে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকেই বিপুল বিক্রমে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবস্থিত কামালপুর নামক একটি ছোট নদী বন্দরে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে এক আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে তাহের তার একটি পা হারান।

১৯৭২ সালে তাহেরকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল নিয়োগ করা হয়। পরে ৪৪ পদাতিক ব্রিগেডের (কুমিল্লা) কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। সেই সময় কর্নেল জিয়াউদ্দিন আর তাহের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ব্রিটিশ আর্মি পদ্ধতির বদলে ‘চাইনিজ’ স্টাইলে উৎপাদনমুখী পিপলস আর্মি গঠনের ইচ্ছা পোষণ করলে, তাদেরকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। তাকে একটি বেসামরিক চাকুরী প্রদান করা হয়। সেটি ছিলো ড্রেজার অর্গানাইজেশন-এর পরিচালকের পদ। কিন্তু জাসদের গোপনে সদস্যপদের মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগসূত্র রক্ষা করে চলছিলেন। এই যোগসূত্রকে ভিত্তি করে তিনি সেনাবাহিনীতে অফিসার আর জোয়ানদের মধ্যে একটা ভাঙ্গনের সৃষ্টি করতে সক্ষম হন এবং খালেদ মোশাররফ-এর সময়েই জোয়ানরা তার বিরুদ্ধে এবং অফিসার শ্রেণীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সুযোগ পেয়ে যায়।

৭ই নভেম্বর সকাল বেলায় জোয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে। সময় ক্ষেপণ না করে তারা অস্ত্রাগারে ঢুকে পড়ে। সেখান থেকে তারা স্টেনগান, রাইফেল আর অন্যান্য যা তাদের হাতের কাছে পায়, তাই গোলাবারুদসহ লুট করে যার যার হাতে তুলে নেয়। এর পরই তারা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ এবং ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, সুবেদারের উপরে অফিসার নাই’ ইত্যাদি শ্লোগানে মুখরিত করে সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে। স্পষ্টতঃই জাসদের শ্রেণী সংগ্রামের আহবানে সাড়া দিয়ে জোয়ানরা তাদের অফিসার নিধনে বেরিয়ে পড়ে। এইভাবে কর্নেল তাহের জোয়ানদের উস্কিয়ে দিয়ে তার নিজের বিপ্লবী চেতনার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।

এই সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম ধাক্কা লাগে ১০ জন তরুণ আর্মি অফিসারের উপর। ওরা তখন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী ব্যারাকের কাছে একটি অফিসার্স মেসে অবস্থান করছিলো। অফিসারদের একজনের ‘ব্যাটম্যান’ এই সময়ে বারান্দা দিয়ে চিৎকার করতে করতে বলতে থাকে, ‘জীবন নিয়ে পালান। সিপাহীরা আপনাদের খুন করতে আসছে।’ অফিসারেরা আর দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গেই সাদা পোশাকে মেসের পেছন দিকের দেয়াল টপকে চলে আসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের পেছনে ধানক্ষেতে। তারপর তারা গ্রামের লোকজনের সহযোগিতায় মিরপুর রোডের মধ্য দিয়ে শহরের নিরাপদ স্থানে চলে যায়। ঐ অফিসারদের একজন ছিলো বেগম জিয়ার ছোট ভাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সৈয়দ ইসকান্দার।

চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সদর দফতর থেকে টেলিফোন করে খালেদ মোশাররফকে সিপাহী বিদ্রোহের খবরটি জানানো হয়। তিনি হয়তো ব্যাপারটি পূর্বেই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। সে জন্যেই তিনি তার স্ত্রী আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে শহরের ভেতরে একটি গোপন জায়গায় পাঠিয়ে দেন। এদিকে শাফাত জামিলকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ রাত সাড়ে এগারোটায় বঙ্গভবনে চলে যান বাকী দুই বাহিনী প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করার জন্যে। সেখানে বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধান খালেদের সমমর্যাদায় ডেপুটি চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হবার আশাবাদ ব্যক্ত করে। এবং প্রেসিডেন্টকে চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর করার প্রস্তাব করে। খালেদ তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তিনি নিজেই সিএমএলএ হবার কথা প্রস্তাব করেন। এক ঘণ্টা ধরে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। এরই মধ্যে বিদ্রোহের খবর শুনে হঠাৎ করে তাদের সভা ভেঙ্গে যায়।

ঐ মুহূর্তেই খালেদ বঙ্গভবন ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শাফাত জামিল এখানে থেকে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে। অভ্যুত্থানের নেতা তার ব্যক্তিগত গাড়ীতে কর্নেল হুদা আর লেঃ কর্ণেল হায়দারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। তারা মিরপুর রোড ধরে শহর থেকে বাইরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ, ফাতিমা নার্সিং হোমের কাছে এসে তাদের গাড়ী বিকল হয়ে পড়ে। খালেদ ক্লিনিক থেকে দশম ইস্ট বেঙ্গল সদর দফতরে ফোন করে জেনে নেন সেখানে যাওয়া তার জন্যে নিরাপদ কি না। সেখান থেকে তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করা হয়। তিন অফিসার মিলে শেরে বাংলা নগরে যান এবং দশ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে রাত্রি কাটায়।

পরদিন সকালে নাস্তা খাবার কিছুক্ষণ পরেই বেঙ্গল ল্যান্সার আর দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর কয়েকজন জোয়ান এসে দশম ইস্ট বেঙ্গলকে বিদ্রোহে যোগ দিতে আহবান জানায়। সঙ্গে সঙ্গেই গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। এর মাত্র কয়েক মিনিট পরেই ক্যাপ্টেন আসাদ আর ক্যাপ্টেন জলিল মিলে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা আর হায়দারকে কমান্ডিং অফিসারের কক্ষে গুলি করে হত্যা করে।

বাংলাদেশের জনমত খালেদ মোশাররফের প্রতি নির্দয় প্রমাণিত হয়। অনেকের মতে, খালেদ ছিলো বিশ্বাসঘাতক। এবং দেশকে ভারতের কাছে বিক্রি করে দিতে চাইছিলেন। কিন্তু পরে এটা প্রমাণিত হয় যে, খালেদ আসলে বিশ্বাসঘাতক ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার। রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার অভাবে তিনি তার কাজ সম্পন্ন করতে পারেননি।

১৯৮৪ সালে ঢাকায় প্রকাশিত ‘দি রোড টু ফ্রিডম’ বইয়ে ফারুক ও রশিদ তাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে খালেদকে তারা একজন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক বীর বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা বলে, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের সৃষ্ট জাতীয় দুরবস্থা কাটানোর প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন।’ ফারুক ও রশিদের মতে ‘আসল ষড়যন্ত্রকারী হচ্ছেন জেনারেল জিয়া। তিনি নভেম্বরের ২ তারিখে ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খালেদ তার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন।’ মেজরদের মতে, আওয়ামী লীগের মিছিলে খালেদের মা আর ভাইয়ের উপস্থিতিতে যে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হয় জেনারেল জিয়া তাকে পুঁজি করে ফায়দা আদায়ের সুযোগ নেন। এইভাবে ষড়যন্ত্র আর দুর্ভাগ্য—এই দুইয়ের সম্মিলিত ক্রিয়ার ফলে খালেদ মোশাররফের মতো একজন দেশপ্রেমিকের মর্মান্তিক পতন ঘটে বলে মেজর মত প্রকাশ করে।

সারা ঢাকা শহরব্যাপী এই সিপাহী বিপ্লব দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। রাত একটার মধ্যেই সিপাইরা পুরো ক্যান্টনমেন্ট এলাকা দখলে নিয়ে আসে। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ একের পর এক ফাঁকা গুলি আকাশে ছুঁড়তে থাকে। অন্যেরা উত্তেজিত শ্লোগান দিতে দিতে অফিসারদের খোঁজ করতে থাকে। হাবিলদার সারোয়ারের নেতৃত্বে বেঙ্গল ল্যান্সারের একদল সৈন্য চলে যায় জেনারেল জিয়াউর রমানের বাসভবনে। চারদিন ধরে গৃহে বন্দী জেনারেলকে তারা মুক্ত করে। নৈশ পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই জিয়াকে উল্লসিত জোয়ানরা কাঁধে করে নিয়ে যায় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর দফতরে। আকস্মিক ঘটনা পরিবর্তনে জেনারেল তখন বিস্ময়ে বিহ্বল। অজানা, অচেনা অনেক সৈনিকের সঙ্গে তিনি করমর্দন ও আলিঙ্গন করে। এই সকল নাটকীয়তার পরপরই তিনি জেনারেল খলিলকে টেলিফোন করে বলেন : ‘আমি মুক্ত। আমি বেশ আছি। আমার জন্যে কিছু ভাববেন না। আপনি দয়া করে খবরটা মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের জানিয়ে দিন।’

জেনারেল খলিল অন্যান্য কাজে অধিক ব্যস্ত থাকায় খবরটা তিনি তখনই বিদেশী মিশনগুলোকে দিতে পারেননি। সকালবেলা যখন তিনি ঐ মিশনগুলোতে রিং করেন, জেনারেল খলিল জানতে পান যে, জেনারেল জিয়া ইতিমধ্যেই তাদের সঙ্গে কথা বলা শেষ করেছেন।

জেনারেল জিয়া তাঁর উদ্ধারকারীদেরকে বলেন, তারা যেন জেনারেল মীর শওকত আলী, জেনারেল আবদুর রহমান এবং কর্নেল আমিনুল হককে তাঁর কাছে হাজির করে। সৈন্যেরা তাদেরকে নিয়ে এলে, তিনি তাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কোলাকুলি করেন। সৈন্যদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যে তিনি তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। জিয়া তাদেরকে বলেন, ‘আমি আর রক্তপাত চাই না।’ তাদের সঙ্গে আলাপের কিছুক্ষণ পরে জিয়া বঙ্গভবনে তখনও অবস্থানরত কর্নেল শাফাত জামিলকে টেলিফোন করে বলেন, ‘এখন সবকিছুই ভুলে যাও এবং সৈন্যদেরকে একত্রিত করো!’ কিন্তু জামিল এর কিছুই করেনি। স্মৃতিচারণ করে জামিল জানায়, ‘আমি সেদিন তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত রূঢ় ব্যবহার করি। আমি তাকে জানিয়ে দেই যে, আমি তাঁর জন্যে কিছুই করছি না। সকালেই আমরা এর একটা সুরাহা করবো।’ জিয়া আর একটি কথাও না বলে টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। জামিল আরো বলে, ‘আমরা ভেবেছিলাম, সৈন্যেরা আমাদের সমর্থন করবে। কিন্তু ওরা তা করলো না। আসলে ওদেরকে আমরা বুঝতে পারিনি। ঐটাই ছিলো আমাদের মারাত্মক ভুল।’ এর কিছুক্ষণ পরেই প্রায় দেড়শ’ জোয়ান এবং কর্নেল তাহেরের বেসামরিক সমর্থক অভ্যুত্থানের নেতাদের খুঁজে বের করার জন্যে বঙ্গভবনে ঝঞ্ঝার বেগে ঢুকে পড়ে। পালাবার চেষ্টা করলে শাফাত জামিল পা পিছলে পড়ে যায় এবং সে তার একটি পা ভেঙ্গে ফেলে। পরে তাকে তিন মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। এই দুর্ঘটনার বদৌলতেই কোনক্রমে তার প্রাণরক্ষা পেয়েছিলো।

রাত দেড়টায় জোয়ানরা রেডিও স্টেশন দখল করে নেয়। তারা কর্মরত রাত্রিকালীন কর্মীদের জানায় যে, ‘জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিপাহী বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে এবং তা চলতে থাকবে।’ বিস্মিত কর্মকর্তারা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। তারা যখন বুঝতে পারলো যে, সৈন্যেরা এবার তাদের হুমকির কারণ নহে, তখন তারাও ওদের আনন্দ উল্লাসে যোগ দেয়। উল্লসিত কিছু সৈনিক আর বেসামরিক লোক নিয়ে কতকগুলো ট্যাংক ঢাকা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় চলাচল করতে দেখা যায়। এবার ঐ ট্যাংক দেখে লোকজন ভয়ে না পালিয়ে, ট্যাংকের সৈনিকদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে আসে এবং উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে।

তিনদিন ধরে তারা মনে করছিলো যে, খালেদ মোশাররফকে নিয়ে ভারত তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা খর্ব করার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এতক্ষণে তাদের সেই দুঃস্বপ্ন কেটে গেলো। জনতা সৈনিকদেরকে দেশের ত্রাণকর্তা বলে অভিনন্দিত করে। সর্বত্রই জোয়ান আর সাধারণ মানুষ খুশিতে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি শুরু করে। রাস্তায় নেমে সারা রাতভর তারা শ্লোগান দিতে থাকে। ‘আল্লাহু আকবর, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, সিপাহী বিপ্লব জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ ইত্যাদি। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিলো, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের গণজাগরণের মতো জনমত আবার জেগে উঠেছে। ঐটা ছিলো সত্যিই একটা স্মরণীয় রাত।

রেডিওতে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে জেনারেল জিয়া ঘোষণা করেন যে, তিনি সাময়িকভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার হাতে নিয়েছেন। দেশের এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর অনুরোধে তিনি এই কাজ করেছেন। তিনি বলেন, তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে তিনি এই দায়িত্ব পালন করত চেষ্টা করবেন। জিয়া একতা, কঠোর পরিশ্রম আর উৎসর্গের মানসিকতা সৃষ্টির ডাক দিয়ে দেশটিকে আবার সচল করে তুলতে সকলকে অনুরোধ জানান। গত ৩ তারিখ থেকে। খালেদের অভ্যুত্থানের সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস, আদালত, বিমান বন্দর, মিল-কারখানা ইত্যাদি পুনরায় খুলে কাজ চালু করতে অনুরোধ জানান। তিনি আরো বলেন, আল্লাহ আমাদের সকলকে সাহায্য করুন।’

জিয়ার সংক্ষিপ্ত আবেগপূর্ণ এবং সময়োচিত ভাষণ সারাদেশে জাতীয়তাবাদের জোয়ার বইয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে এর আগেও একবার তিনি জনমনে আশার সঞ্চার করেছিলেন। এবারও যেন তিনি আর একবার বাংলাদেশকে পুনঃস্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ দিলেন।

৭ই নভেম্বর ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। ইতিমধ্যে অনেক সিনিয়র আর্মি অফিসার জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নিয়েছে। এরই মাঝে চলে আসে কর্নেল (অবঃ) আবু তাহের। জেনারেল তাকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং অন্যান্যের মতো তার সঙ্গেও কোলাকুলি করেন। আরও কিছু কথাবার্তার পর তাহের জেনারেল জিয়াকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চাইলে, উপস্থিত অন্যান্য অফিসাররা নিরাপত্তার কারণে জেনারেল জিয়াকে রেডিও স্টেশনে যেতে বারণ করে। এতে কর্নেল তাহের রেগে আগুন হয়ে উঠেন। কিন্তু তারাও কম গেলো না। জেনারেল জিয়াকে রেডিও স্টেশনে না পাঠিয়ে, তারা বরং একটি রেকর্ডিং ইউনিটকে জিয়ার বাসায় নিয়ে আসে। এইভাবে ঐ শুক্রবার সকালে জিয়ার রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।

ঐদিন দুপুরের পরে কর্নেল তাহের জিয়াকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সেখানে রুম ভর্তি উত্তেজিত সৈন্যদের উপস্থিতিতে তাহের তাদের ১২ দফা দাবী সম্বলিত কাগজটি জিয়ার অনুমোদনের জন্যে সামনে এগিয়ে দেয়। জিয়া অনেকটা বাধ্য হয়েই ঐ দাবীনামায় সই করেন। তাকে আরো একবার রেডিওতে বক্তৃতা করার অনুরোধ জানানো হলো। জিয়া বক্তৃতা করলেন। কিন্তু অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তিনি ঐ ১২ দফা দাবী বেমালুম চেপে যান। তিনি বরং তাকে সমর্থন জানানোর জন্যে জনগণকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, তিনি কোন রাজনৈতিক দল বা গ্রুপের সদস্য নন। এবং আর বিলম্ব না করে, সৈনিকদেরকে তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ফিরে যেতে আহবান জানান।

এদিকে কর্নেল তাহের আর একবার জিয়াকে দিয়ে তার ১২ দফা দাবী অনুমোদন করিয়ে নিতে চেষ্টা করে। সকাল ১১টায় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারীর সদর দফতরে জিয়া ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্যে একটি সভা ডাকেন। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, বিমান বাহিনীর প্রধান তোয়াব, নৌবাহিনীর প্রধান এম. এইচ. খান, প্রেসিডেন্টের সচিব মাহবুবুল আলম চাষী এবং কর্নেল তাহের। তাহেরকে এ সভায় ডাকা হয় এ জন্যে যে, সিপাহী বিপ্লবের সময়ে তাদের সমর্থকেরা সবচেয়ে বেশী তৎপর ও সোচ্চার ছিল। সভায় দেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন তা নিয়ে প্রথমেই আলোচনা শুরু হয়। জেনারেল ওসমানী আর চাষী, মোশতাককে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্বহাল করার প্রস্তাব করলে, জেনারেল খলিল আর তাহের তার বিরোধিতা করে। পরে বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সভায় সিদ্ধান্ত পুরোপুরি জিয়ার ইচ্ছানুযায়ী গৃহীত হয়নি। দিনের সকালের দিকেই কেবল তিনি সিএমএলএ-এর দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। অভ্যুত্থানের নেতা হিসেবে জিয়া নিজেই সিএমএলএ হিসেবে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল খলিল যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেন যে, প্রেসিডেন্টের হাতেই সিএমএলএ-এর দায়িত্ব থাকা উচিত। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার উপরে কারো ক্ষমতা থাকা ঠিক হবে না। কর্নেল তাহেরও জেনারেল খলিলের যুক্তিতে একমত হয়। সুতরাং প্রেসিডেন্ট সায়েমকেই সিএমএলএ বানানো হলো। জেনারেল জিয়া, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর প্রধানের ন্যায় ডেপুটি চীফ মার্শাল ল এ্যাডমিনিস্ট্রেটর ক্ষমতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। জিয়া তাঁর এই অবমাননা হজম করে নিলেও তিনি জেনারেল খলিলকে কখনো ক্ষমা করেননি।

তারপর আলোচনা হয় দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে। অবশেষে, কর্নেল তাহের সিপাইদের ১২ দফা দাবী অনুমোদনের জন্যে সভায় উত্থাপন করে। কিন্তু সভায় উপস্থিত কেউ এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেনি। পরবর্তী দিনগুলোতে তাহেরও তার প্রতি এই অবমাননা ভুলতে পারেনি। আর সে জন্যেই জাসদ এবং তার বিপ্লবী পিপলস আর্মিকে দিয়ে সে জিয়াকে উৎখাতের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলো কয়েকবার।

৭ই নভেম্বর ঢাকার শেরে বাংলা নগরের কাছে খালেদ মোশাররফ ও তার দু’জন সঙ্গীর নিহত হওয়া ছাড়া তেমন কোন হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেনি। অফিসার হত্যা প্রকৃতপক্ষে শুরু হয় পরের দিন অর্থাৎ ৮ই নভেম্বর। সেদিন কমপক্ষে ১২ জন অফিসারকে খুন করা হয়। এদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, লেঃ মুস্তাফিজুর রহমান, মেজর আজিম, ডেন্টাল সার্জন করিম এবং আর্মির লেডী ডাঃ চেরী উল্লেখযোগ্য।

জেনারেল জিয়া এ হত্যাকাণ্ডের জন্যে জাসদকে দায়ী করে। এই ঘটনার ছয় সপ্তাহ পরে আমার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে জিয়া বলেন, জাসদ তার স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা হয়। দেশের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। কারণ এতে করে সেনাবাহিনীতে প্রয়োজনের তুলনায় অফিসারের সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগে নেমে আসে।

আবদুর রব, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জলিল এবং মোহাম্মদ শাহজাহান জেল থেকে মুক্তি পায় ৭ই নভেম্বর। মুক্তি পেয়েই তারা জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের উদ্দেশ্যে সৈন্যদের একত্রিত করার চেষ্টা চালায়। এই ধরনের প্রচারপত্রে এবং লিফলেটে ক্যান্টনমেন্ট এলাকা প্লাবিত করে দেয়। সৈনিকদের ১২ দফা দাবী আদায়ের জন্যে কর্নেল তাহেরের ‘বিপ্লবী সৈনিক সংঘের ‘ ছত্রছায়ায় সৈন্যদের একত্রিত হওয়ার আহবান জানানো হয়। তাদের দাবী পূরণ না হাওয়া পর্যন্ত তাদের অস্ত্র জমা না দেয়ার জন্যে নির্দেশ দেওয়া হয়। এইভাবে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে বিপ্লবীদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়।

ঢাকা সেনানিবাসের সেনা সদর অবরোধাধীন একটা ক্ষুদ্র দুর্গের রূপ ধারণ করে। জিয়া এবং তাঁর সেনা সদরে কর্মরত লোকজনকে ৭ দিন ধরে ঐ অফিসের ভিতরেই নাওয়া, খাওয়া এবং ঘুমানোর কাজ সেরে নিতে হয়। সুবিধের জন্যে তাঁরা এ কাজ করেননি, করেছিলেন বাধ্য হয়ে।

সেনা সদরের নিরাপত্তার জন্যে জেনারেল জিয়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৭ম, ৯ম, ১১তম ও ১২তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডো দলকে অতি দ্রুতগতিতে ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন। ৯ তারিখের মধ্যেই ঐ কমান্ডো দলগুলোকে ঢাকায় নিয়ে আসা

হয়। তাদেরকে সেনা সদর দফতরের আশেপাশে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। এতে করে জাসদের ক্রমাগত হুমকির মোকাবেলায় আর্মি হেড কোয়ার্টার যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে। ইতিমধ্যেই জেনারেল জিয়া সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান ও পোশাকের প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণসহ অবমাননাকর সৈনিকদের ‘ব্যাটম্যান’ প্রথা বাতিল করার ঘোষণা প্রদান করেন। এতে সেনাবাহিনীর জোয়ানদের মধ্যে যথেষ্ট স্বস্তি ফিরে আসে এবং বিপ্লবী ভাব কেটে যেতে থাকে। এছাড়া, জেনারেল জিয়া ঐ সময়ে রেডিও এবং টিভিতে ভাষণের মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র থেকে সতর্ক থাকার জন্যে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়ে পরিস্থিতি নিজের আয়ত্তে আনার প্রয়াস পান। তিনি আরও বলেন যে, তিনি নিজে এবং তার সেনাবাহিনী সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ আর তাঁর সরকারও নির্দলীয় এবং অরাজনৈতিক। উপরন্তু, গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে তাঁর সরকার নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করবে বলে তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস প্রদান করেন।

বাঙ্গালীর অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী এবং দোদুল্যমান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যেই জেনারেল জিয়া ঐ অবস্থায় নিজেকে সঠিক স্থানে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বাঙ্গালী জাতি তাদের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তনে অত্যন্ত তৎপর হলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশীরা ‘মধ্যপন্থী’। ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক চরমপন্থা তারা পছন্দ করে না। সম্ভবতঃ শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বুঝে নিতে পেরেছিলেন। সে জন্যেই তিনি তাঁর মৃত্যুর মাত্র তিন দিন আগে ‘বাকশাল’ পার্টির এক বিরাট সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে তাঁর কর্মীদের উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘আজকের ভয়ের কারণ হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত বেশী প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে। তোমরা তোমাদের সারাজীবন ধরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে তাদের জন্যে কাজ করতে পার। কিন্তু যদি একটা ভুল করে ফেলো, তাহলে তোমার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে যাবে। এটাই বাংলাদেশের আইন।’

কর্নেল তাহের আর জাসদ বাংলাদেশের মানুষকে তাদের স্বাভাবিক ইচ্ছার বাইরে ঠেলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। সে কারণেই তারা ব্যর্থ হয়েছিলো। আর্থিক সুবিধে আর হেয় ভাবাপন্ন ‘ব্যাটম্যান’ প্রথা উঠিয়ে নেয়ার ফলে জোয়ানদের মনে বিপ্লবের পক্ষে সমর্থন দ্রুত লোপ পেয়ে যায়। ক্যান্টনমেন্ট পরিপূর্ণভাবে শান্ত হয়ে পড়ে। ২৩শে নভেম্বরের মধ্যে জেনারেল জিয়া জাসদের উপর আক্রমণ চালানোর জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান। তিনি ঐ রাতে রেডিও এবং টেলিভিশনে যখন বলছিলেন, ‘আমরা আর কোন বিশৃঙ্খলা বরদাস্ত করবো না। আর কোন রক্তপাতকেও সহ্য করা হবে না, তখনই সশস্ত্র পুলিশ শহরে বেরিয়ে পড়ে নির্দেশিত লোকজনের খোঁজে। প্রথমেই যাদেরকে আটক করা হয় তারা হলো—রব, জলিল, হাসানুল হক ইনু এবং ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ (তাহেরের বড় ভাই)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় কর্নেল তাহেরকে বন্দী করা হয়। এতে করেই মহান ‘সিপাহী বিপ্লবের’ কার্যতঃ সমাপ্তি ঘটে।

দুইদিন পরে কর্ণেল তাহেরকে উদ্ধার করার এক নাটকীয় অভিযান চালানো হয়। ভারতীয় হাই কমিশনার, সমর সেনকে হাইজ্যাক করে জিম্মি রেখে তাহেরকে উদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অথচ অভিযান চালনাকারী ছয়জনের মধ্যে চারজনই ঘটনাস্থলে নিহত হয়। এর ফলে জনমত তাহের এবং জাসদের বিপক্ষে চলে যায়। জেনারেল জিয়া সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন এবং প্রায় ১০,০০০ জাসদ কর্মীকে জেলে পাঠিয়ে দেন।

কর্নেল তাহেরকে ১৯৭৬ সালের ২১শে জুন, প্রায় সাত মাস আটক থাকার পর, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষভাবে ঘটিত একটি ‘সামরিক আদালতের’ সামনে বিচারের জন্যে হাজির করা হয়। তার সঙ্গে আরো ৩৩ জনকে হাজির করা হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। তাদের মধ্যে ২০ জনেরও বেশী সৈনিকসহ জাসদের ঊর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ ছিলো। কর্নেল তাহের বিপ্লবী গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বের কথা বিচারকদের কাছে অস্বীকার করেনি। তার স্বীকারোক্তিতে সে সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টা চালানোর কথাও উল্লেখ করে। ঐ অবস্থায় তাহেরকে যে কোন একটি সাধারণ কোর্টে বিচার করেও দোষী সাব্যস্ত করা যেতো। কিন্তু তাকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলানোর বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যেই বিশেষ সামরিক আদালত গঠনের পদক্ষেপ নেয়া হয়।

কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে আনীত প্রথম অভিযোগটিই আশ্চর্যজনকভাবে অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। অভিযোগটি হচ্ছে—১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বৈধভাবে’ গঠিত সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা চালানো। ব্যাপারটি কি আসলে সত্যি? আসল সত্যি তো অন্য জায়গায়! ৭ই নভেম্বর কর্নেল তাহের তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নিয়ে সিপাহী বিপ্লব ঘটিয়ে তখন ক্ষমতার অধিকারী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে, জেনারেল জিয়াকে বন্দী দশা থেকে মুক্তি করে এবং তাকে ক্ষমতায় বসতে অন্যান্যের সঙ্গে সহযোগিতা প্রদান করে। সুতরাং অভিযোগটি পরিপূর্ণভাবে উল্টো করে সাজাতে হয়েছিলো। তাহেরকে তার আত্মপক্ষ অবলম্বনের যুক্তিসঙ্গত সুযোগও দেয়া হয়নি। বিচারের দিনই কেবল তাকে তার অভিযোগগুলো সম্বন্ধে অবহিত করা হয়। বাকী সব কাজই আশ্চর্যজনক ও রহস্যজনক তড়িঘড়ির মধ্যে সমাপন করা হয়। কর্ণেল তাহেরকে ১৭ই জুলাই, ১৯৭৬ সালে ভোরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর দন্ডাদেশ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে তার ‘ক্ষমার আবেদন’ ২০শে জুলাই নাকচ করা হয় এবং পরদিন অর্থাৎ ২১শে জুলাই ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাকে মহাপ্রয়াণে ঠেলে দেয়া হয়।

তাহেরের মৃত্যু একটি ‘হুকুমের হত্যা’। এটি ছিলো বিচার বিভাগীয় পদ্ধতির এক অমার্জনীয় লঙ্ঘন। ঘটনাটি জিয়ার এবং এ কাজে তাঁর সহযোগীদের গায়ে প্রচুর কালিমা লেপে দেয়।

আমি প্রেসিডেন্ট সায়েমের সঙ্গে কয়েকবার চেষ্টা করেও ঐ পরিস্থিতির উপর একটি সাক্ষাতকার নিতে ব্যর্থ হই। জিল্লুর রহমান খান তাঁর বই ‘লীডারশীপ ক্রাইসিজ ইন বাংলাদেশ’-এ প্রেসিডেন্ট সায়েমকে বিচারক হয়ে অবিচারকসুলভ আচরণের জন্যে সমালোচনা করেন। এই ঘটনাটি বিচারপতি সায়েমের প্রশংসনীয় ইতিহাসকে ম্লান করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।

তাহেরের স্ত্রী, লুৎফা একটি চিঠিতে তার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোর এক মর্মভেদী বর্ণনা দিয়েছিলো। চিঠিটি কিশোরগঞ্জ থেকে ১৮ই আগস্ট, ১৯৭৬ সালে লেখা হয়। চিঠিটি লিলজের বাংলাদেশ : ‘দি আনফিনিশড রেভুল্যশন’ গ্রন্থে ছাপা হয়। চিঠিটির মতে :

২০শে জুলাই ১৯৭৬ বিকেলে তাহেরকে জানানো হয় যে, ২১ তারিখ সকালে তার মৃত্যুর দন্ডাদেশ কার্যকরী করা হবে। তিনি তাদের সংবাদ গ্রহণ করেন এবং সংবাদ বাহকদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তারপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় তিনি তার রাতের ডিনার শেষ করেন, পরে একজন মৌলভীকে আনা হয়। সে এসে তাকে তার পাপের জন্যে ক্ষমা চাইতে বলে। তাহের বলেন, ‘তোমাদের সমাজের পাপাচার আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। আমি কখনও কোন পাপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি নিষ্পাপ। তুমি এখন যেতে পার। আমি ঘুমবো।’ তিনি একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে গেলেন। রাত তিনটার দিকে তাকে জাগানো হলো। কতক্ষণ সময় বাকী আছে, জিজ্ঞেস করে সে জেনে নিলো। সময়টা জেনে নিয়ে তিনি তার দাঁত মাজলেন। তারপর সেভ্ করে গোসল করলেন। উপস্থিত সকলেই তার সাহায্যে এগিয়ে এলো। সকলকে মানা করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি আমার পবিত্র শরীরে তোমাদের হাত লাগাতে চাই না।’ তার গোসলের পর অন্যদেরকে তিনি তার চা তৈরী করতে ও আমাদের প্রেরিত আম কেটে দিতে বললেন। তিনি নিজেই তার কৃত্রিম পাখানি লাগিয়ে প্যান্ট, জুতা ইত্যাদি পরে নিলেন। তিনি একটি চমৎকার শার্ট পরে নিলেন। ঘড়িটা হাতে দিয়ে সুন্দর করে মাথার চুল আঁচড়ে নিলেন। তারপরে উপস্থিত সকলের সামনে তিনি আম খেলেন, চা পান করলেন এবং সিগারেট টানলেন। তিনি তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ‘হাসো। তোমরা এমন মনমরা হয়ে পড়েছো কেন? মৃত্যুর চেহারায় আমি হাসি ফুটাতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাভূত করতে পারে না।’ তার কোন ইচ্ছা আছে কি না জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বলেন, ‘আমার মৃত্যুর বদলে, আমি সাধারণ মানুষের শান্তি কামনা করছি।’ এরপর তাহের জিজ্ঞাসা করেন, ‘আরো কি কিছু সময় বাকী আছে?’ তারা উত্তর দিলো। ‘সামান্য বাকী।’ তিনি তখন বললেন, ‘তাহলে আমি তোমাদেরকে একটি কবিতা আবৃত্তি করে শুনাবো।’ তিনি তখন তার কর্তব্য আর অনুভূতির উপর একটি কবিতা পাঠ করে শুনালেন। তারপর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, এবার আমি প্রস্তুত। সামনে চলো। তোমরা তোমাদের কাজ সমাধান করো।’ তিনি ফাঁসি কাষ্ঠে আরোহণ করে দড়িটা তার গলায় নিজেই পরে নিলেন এবং তিনি বললেন, ‘বিদায় দেশবাসী। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’

আ. স. ম. আবদুর রবকে ঐ আদালতেই দশ বৎসরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। কিন্তু পরে এক ক্ষমা ঘোষণায় তিনি মুক্তি লাভ করেন। তিনি তাহেরের ফাঁসি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে জানান, জেনারেল জিয়ার পক্ষে কর্নেল তাহেরকে বাঁচতে দেয়া সম্ভব ছিলো না। কারণ, তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক জোয়ান আর জুনিয়র অফিসারদের ‘প্রতীক স্বরূপ।’ তাহের নিজেও তার মৃত্যুকে ‘শাহাদাত বরণ’ বলে আলিঙ্গন করেছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে তিনি তার স্ত্রী আর ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন : ‘এইভাবে যদি জীবনকে উৎসর্গ করা না যায়, তাহলে সাধারণ মানুষের মুক্তি আসবে কিভাবে?’ আবু তাহের যা চেয়েছিলেন তা আর হলো কৈ? কিন্তু তাহেরের প্রেতাত্মা, জিয়ার পাঁচ বছরের শাসনামলে বিশটিরও বেশী অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জিয়াকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে। এবং পরিশেষে যুব অফিসারদের বন্দুকের গুলির বৃষ্টিতে জিয়াকে ধরাশায়ী করে তাহেরের প্রেতাত্মা অনন্তের পথে পাড়ি জমায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *