শ্রীচরণেষু
কতকগুলি খেলা প্রায় সব দেশের ছেলেমেয়েরাই খেলে। যেমন মনে কর, কানামাছি কিংবা লুকোচুরি। আবার মনে কর সাঁতার কাটা; সাহারার মরুভূমিতে, কিংবা মনে কর খুব বড় শহরে, যেখানে নদী-পুকুর নেই, সেখানে যে সাঁতার কাটাটা খুব চালু হতে পারে না, সেটা অনায়াসেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। জল আছে অথচ সাতার কাটাটা লোকে খুব পছন্দ করে না, তা-ও হয়। শীতকালে ইউরোপের সব নদী-পুকুর জমে বরফ হয়ে যায় না, তবু সেই পাথর-ফাটা শীতে কেউ পারতপক্ষে জলে নামতে চায় না সাঁতারের তো কথাই ওঠে না।
খেলাধুলো তাই নির্ভর করে অনেকটা দেশের আবহাওয়ার ওপর। কিছু না কিছু জল প্রায় সব দেশেই আছে, তাই কাগজ বা পাতার ভেলা সবাই জলে ভাসায়। কিন্তু যে দেশে ঝমাঝ-ঝম্ বৃষ্টি নেমে আঙিনা ভরে গিয়ে চতুর্দিকে জল থৈ-থৈ করে না, সে দেশের ছেলে-মেয়েরা আর দাওয়ায় বসে আঙিনার পুকুরে কাগজের ভেলা ভাসাবে কী করে? অথচ ভেলা-ভাসানোর মতো আনন্দ কম খেলাতেই আছে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার কথা ভেবে গান রচেছেন :
পাতার ভেলা ভাসাই নীরে
পিছন পানে চাইনে ফিরে।
আর ছেলেমেয়েদের জন্য শিশু ভোলানাথের এ কবিতাটি তোমরা নিশ্চয় জানো :
দেখছ না কি নীল মেঘে আজ
আকাশ অন্ধকার?
সাত-সমুদ্র তেরো-নদী।
আজকে হব পার।
নাই গোবিন্দ, নাই মুকুন্দ,
নাইকো হরিশ খোঁড়া–
তাই ভাবি যে কাকে আমি
করব আমার ঘোড়া।
কাগজ ছিঁড়ে এনেছি এই
বাবার খাতা থেকে,
নৌকো দে-না বানিয়ে– অমনি
দিস, মা, ছবি এঁকে।
রাগ করবেন বাবা বুঝি।
দিল্লি থেকে ফিরে?
ততক্ষণ যে চলে যাব
সাত-সমুদ্র-তীরে।
ভারি চমৎকার কবিতা! কিন্তু বাকিটা আর বললুম না। যাদের পড়া নেই, তারা যেন শিশু ভোলানাথখানা খোলে, এই হচ্ছে আমার মতলব।
তা সে কথা যাক। বলছিলুম কি, আবহাওয়ার ওপর খেলাধুলো অনেকটা নির্ক্স করে। আমাদের দেশ জলে ভর্তি, বিশেষ করে পুব বাঙলা, তাই আমাদের খেলাধুলো জমে ওঠে জলের ভিতরে-বাইরে। তেমনি শীতের দেশে বরফ পড়ে বিস্তর, আর তাই নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলোর অন্ত থাকে না। ধুলো বলা অবশ্যি ভুল হল, কারণ বরফে যখন মাঠ-ঘাট, হাট-বাট সবকিছু ছেয়ে যায়, তখন তামাম দেশে একরত্তি ধুলোর সন্ধান আর পাওয়া যায় না।
কাবুলে যখন ছিলুম, তখন জানালা দিয়ে দেখতুম, ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে পেঁজা বরফের গুড়ো হাতে নিয়ে ঢেলা পাকিয়ে একে-ওকে ছুঁড়ে মারছে, সে ঢিল ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে চট করে সরে যাবার চেষ্টা করছে। যদি তাগমাফিক লেগে গেল তবে তুমি ওস্তাদ ছেলে, হাতের নিশান ভালো, হয়তো একদিন ভালো বোলার হতে পারবে। আর না লাগলেও তা নিয়ে ভাবনা করা চলবে না, কারণ ততক্ষণে হয়তো তোমার কানে এসে ধাই করে লেগেছে। আর কারও ছুঁড়ে মারা গোলা। কানের ভিতর খানিকটা বরফের গুঁড়ো ঢুকে গিয়ে কানের ভিতরকার গরমে গলতে আরম্ভ করেছে। ভারি অস্বস্তি বোধ হয় তখন মনে হয় যেন কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে। তখন খেলা বন্ধ করে কান সাফ করার জন্য দাঁড়াতে হয়। আর ছোঁড়াছুড়ির মধ্যিখানে ও রমধারা দাঁড়ানো মানেই আর পাঁচজনের তাগ হওয়া। মাথা নিচু করে যতক্ষণ তুমি কান সাফ করছ, ততক্ষণে এ-দিক, ও-দিক, চতুর্দিক থেকে গোটা দশেক গোলাও খেয়ে ফেলেছ।
তা বয়েই গেল। বরফের গোলা যত জোরেই গায়ে এসে লাগুক না কেন, তাতে করে চোট লাগে না। গায়ে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই গোলা চুরমার হয়ে যায়। কিছুটা বরফের গুঁড়ো অবশ্যি জামা-কাপড়ে লেগে থাকে। তা সেটা হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেললেই হয়–না হলে গরম জামাকাপড়ের ওম লেগে খানিকক্ষণ বাদে বরফ গলে গিয়ে কাপড় ভিজিয়ে দেবে।
বরফ জমলেই এ খেলা জমে উঠত। আর আমি কাজকর্ম ধামাচাপা দিয়ে জানালার কাছে। গিয়ে বসতুম।
এ খেলায় সত্যিকার ওস্তাদ ছিল একটি সাত-আট বছরের ছেলে। খেলার মধ্যিখানে সে এমনি চর্কিবাজির মতো ঘুরত যে তার গায়ে গোলা ছেড়ে কার সাধ্যি। আর আমাদের দেশের পাকা লেঠেলের মতো সে একাই জন আষ্টেককে অনায়াসে কাবু করে ফেলত। ভারি মিষ্টি চেহারা, পাকা আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল, নীল চোখ, আর সেই দু চোখে যেন দুনিয়ার যত দুষ্টুমি বাসা বেঁধে বসে আছে। নাম ইউসুফ, পাশের বাড়িতে থাকে, আর তার বাপ আমাদের কলেজের কেরানি। আমাকে পথে পেলে সেলাম করে কিন্তু সসম্ভ্রম সেলামের সময়ও চোখের দিকে তাকালে মনে হত ছেলেটা কোনও এক নতুন দুষ্টুমির তালে আছে। যদি জিগ্যেস করতুম, কীরকম আছিস? তা হলে একগাল হেসে কী একটা বলত, যার কোনও মানে হয় না। কিন্তু সেই হাসির ফাঁকে ফাঁকেও আমি স্পষ্ট দেখতে পেতুম কোনও একটা দুষ্টুমির সুযোগ পেলে সে আমাকেও ছাড়বে না।
সে-ই একদিন বাড়ি বয়ে এসে সোৎসাহে খবর দিয়ে গেল, আমি তাদের স্কুলে বদলি হয়ে এসেছি। তার চোখে-মুখে হাসি আর খুশি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, আমি তার চোখে যেটি লক্ষ করলুম সেটি হচ্ছে এইবার আসুন স্যর, আপনাতে আমাতে এক হাত হয়ে যাবে। আমি যে খুব ভয় পেলুম তা নয়, কারণ ছেলেবেলায় আমিও কম দুষ্ট ছিলাম না।
ওদের স্কুল বড় অদ্ভুত। পাঁচ-ছ বছরের ছেলেদের ক্লাস ওয়ান থেকে আই-এ ক্লাসের ছেলেরা একই বাড়িতে পড়ে। তাই সেটাকে পাঠশালা বলতে পার, হাইস্কুল বলতে পার, আর কলেজ বললেও বাধবে না। আমি বদলি হলুম কলেজ বিভাগে– ফাস্ট আর সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেদের ইংরেজি পড়াবার জন্য। এ দু ক্লাস পড়িয়ে আমার হাতে মেলা সময় পড়ে থাকত বলে একদিন প্রিন্সিপাল অনুরোধ করলেন, আমি যদি ম্যাট্রিক ক্লাসের ছেলেদেরও ইংরেজি পড়াই তবে বড় উপকার হয়। আমি খানিকটে ভেবে নিয়ে বললুম, তার চেয়ে আমাকে বরঞ্চ ক্লাস ওয়ানে পড়াতে দিন। আসছে বছর ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও প্রোমোশন দেবেন– অর্থাৎ আমি টু-তে পড়াব, তার পরের বছর থ্রিতে। এই করে করে যাদের কলেজে টেনে নিয়ে আসতে পারব তাদের ইংরেজিজ্ঞান থেকে বুঝতে পারব আমি ভালো পড়াতে পারি কি না। প্রিন্সিপাল তো কিছুতেই মানেন না; বলেন, সে কী কথা! আপনি পড়াবেন ক্লাস ওয়ানে! আমার প্রস্তাবটার তত্ত্ব বুঝতে তাঁর বেশ খানিকটা সময় লাগল। কাবুলি প্রিন্সিপালের বুদ্ধি থাক, গুরুজনদের নিন্দে করতে নেই।
ওদিকে ক্লাস ওয়ানে হৈ হৈ রৈ রৈ। কলেজ বিভাগের অধ্যাপক আসছেন ক্লাস ওয়ানে পড়াতে!
আমার তখন আদপেই মনে ছিল না ইউসুফ ক্লাস ওয়ানে পড়ে। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকতেই দেখি, সে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সবাইকে কী যেন বোঝাচ্ছে। অনুমান করলুম, প্রতিবেশী হিসেবে সে আমার সম্বন্ধে যেটুকু জানে সেটুকু সকলকে সগর্বে সদম্ভে জানিয়ে দিচ্ছে। আমার চাকর আবদুর রহমানের সঙ্গে ইউসুফের আলাপ-পরিচয় ছিল। আর আবদুর রহমান ভাবত তার মনিবের মাথায় একটুখানি ছিট আছে। আবদুর রহমান যদি সেই সুখবরটি ইউসুফকে দিয়ে থাকে, আর সে যদি ক্লাসের সবাইকে সেই কথাটি জানিয়ে দেয়, তবেই হয়েছে!
ক্লাসে মাস্টার ঢুকলেই কাবুলের ছেলেরা মিলিটারি কায়দায় সেলুট দেয়– আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ। আমি ক্লাসে ঢুকতেই ইউসুফ তড়াক করে সুপারি গাছের মতো খাড়া হয়ে মিলিটারি সেলুটের হুকুম হাঁকল। তার পর খুশিতে ডগমগ হয়ে আপন সিটে গিয়ে বসল।
পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই ইউসুফ উঠে দাঁড়াল। বাইরে যেতে পারি, স্যর? আমি বললুম যা, কিন্তু দেখ, আমি বাইরে যাওয়া-যাওয়ি জিনিসটা মোটেই পছন্দ করিনে। যাবি আর আসবি। নিশ্চয় স্যর। বলে আরেকটা মিলিটারি সেলুট ঠুকে বেরিয়ে গেল।
এক মিনিট যেতে না যেতে ইউসুফ ফিরে এল। তাই তো, ছেলেটা তা হলে অতটা দুষ্টু নয়। কিন্তু আরও তিন মিনিট যেতে না যেতে আমার ভুল ভাঙল। ইউসুফের পাশের ছেলেটা পড়ার মাঝখানে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, স্যর, আমার পকেট ভিজে গিয়েছে এই ইউসুফটা আমার পকেটে বরফের ঢেলা রেখেছিল। ইউসুফ আরও চেঁচিয়ে বলল, না স্যর, আমি রাখিনি। ছেলেটা আরও চেঁচিয়ে বলল, আলবাত তুই রেখেছিস।
ইউসুফ বলল, তোর ডান পকেট ভেজা, আমি তো বাঁ দিকে বসে আছি। ছেলেটা বলল, তুই না হলে বরফ আনল কে? তুই তো এক্ষুনি বেরিয়ে গিয়েছিলি।
হট্টগোলের ভিতর আমি যে তাবৎ তর্কাতর্কি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলুম তা নয় কিন্তু কথা কাটাকাটিটা মোটের ওপর এইরকম ধারায়ই চলেছিল। বিশেষ করে শেষের যুক্তিটা আমার মনের ওপর বেশ জোর দাগ কাটল। ইউসুফ না হলে বরফের ঢেলা আনল কে? আর বরফ তো আগের থেকে ঘরে এনে জমিয়ে রাখা যায় না– গলে যায়।
রাগের ভান করে কড়া হুকুম দিলুম, ইউসুফ, তুই বেঞ্চির উপর দাঁড়া।
ইউসুফ বিন্দুমাত্র আপত্তি না করে তড়াক করে পলটনি কায়দায় বুট দিয়ে খটাস করে শব্দ করে বেঞ্চির উপর দাঁড়িয়ে ফের সেলট দিল। পূর্বেই বলেছি আফগানিস্তান মিলিটারি দেশ ছোট ছেলেরা পর্যন্ত পলটনি জুতা পরে আর হুকুম তামিল করার সময় পলটনি সেলুট ঠোকে।
ভাবলুম ইউসুফ আমাদের দেশের ছেলের মতো বসি, স্যর? বলে অনুনয় করবে। আদপেই না। চাঁদপানা মুখ করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। শেষটায় আমিই হার মানলুম। বললুম, বস্। আর ওরকম করিসনে। ইউসুফ আরেকবার সেলুট জানিয়ে বসে পড়ল।
বাড়ি ফেরার সময় বুঝতে পারলুম, সব দেশের খেলাধুলা যেরকম আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে, দুষ্টুমিটাও ঠিক সেরকম অনেকটা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশের ছেলেরা বরফের গুঁড়ো পাবে কোথায় যে তাই নিয়ে দুষ্টুমি করবে?
তার পর দু-তিন দিন ইউসুফ ঠাণ্ডা। ভাবলুম প্রথমদিনের সাজাতে হয়তো ইউসুফের আক্কেল হয়ে গিয়েছে। আর জ্বালাতন করবে না।
আমাদের দেশ গরম, তাই ঘরে ঘরে পাখার ব্যবস্থা থাকে। কাবুল ঠাণ্ডা, তাই সেখানে ক্লাসে ক্লাসে আগুন জ্বালাবার ব্যবস্থা। একদিন ক্লাসে ঢুকে দেখি ঘরভর্তি ধুয়ো, আর চিমনির আগুন নিভে গিয়েছে।
ছেলেরা কাশছে আর ইউসুফ পাতলুনের দুই পকেটে হাত পুরে অত্যন্ত বিষণ্ণ নয়নে তাকিয়ে আছে। দেশে টানাপাখার দড়ি ছিঁড়ে গেলে যেরকম চাপরাসির সন্ধানে ছেলে পাঠানো হয় আমি তেমনি বলোম, চাপরাসিকে ডাকো। ইউসুফকে পাঠানো আমার মতলব ছিল না। কিন্তু সে চট করে এক্ষুনি ডাকছি স্যর বলে হুট করে বেরিয়ে গেল। থামাবার ফুরসত পেলুম না।
মিনিট তিনেক পরে এলেন খু প্রিন্সিপাল। মুখে কেমন যেন একটু বিরক্তি। বললেন, আপনি নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? আমি তো অবাক!
সে কী কথা! আমি আপনাকে ডেকে পাঠাব কেন? আমার দরকার হলে আমি নিজেই তো আপনার কাছে যেতে পারি। আমি তো ডেকে পাঠিয়েছি চাপরাসিকে, আগুন নিভে গিয়েছে বলে। প্রিন্সিপালের মুখ থেকে বিরক্তির ভাব কেটে গিয়ে দেখা গেল রাগ। ইউসুফের দিকে ফিরে বললেন, তবে তুই আমাকে ডাকলি কেন?
ইউসুফ তার ড্যাবড্যাবে চোখ হরিণের মতো করুণ করে বলল, আমি তো শুনলুম, প্রিন্সিপাল সায়েবকে ডেকে নিয়ে আয়। তা কী জানি ওঁর ফারসি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি হয়তো। প্রিন্সিপাল ইউসুফকে দুই ধমক দিয়ে চলে গেলেন।
কী ঘড়েল ছেলে রে বাবা! আমি বিদেশি বলে যে খুব ভালো ফারসি বলতে পারিনে তার পুরো সুযোগ নিয়ে সে আমাকে একদফা বোকা বানিয়ে দিল।
ততক্ষণে চাপরাসি এসে আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই আগুন জ্বলতে চায় না। ঘর আরও ধুয়োয় ভরে গিয়েছে। ছেলেরা কাশতে আরম্ভ করেছে, কারও কারও চোখ দিয়ে জল বেরুচ্ছে, আমার তো প্রায় দম বন্ধ হবার উপক্রম। চাপরাসি ততক্ষণে হার মেনে চলে গিয়েছে বুড়ো চাপরাসির সন্ধানে –সে যদি কিছু করতে পারে। ইউসুফ বলল, স্যর, জানালাগুলো খুলে দিই?
আমি বললুম, দাও। দম বন্ধ হয়ে তো আর মারা যেতে পারিনে।
এক মিনিটের মধ্যে হু হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের ভিতর ঢুকে আমাদের হাড়ে হাড়ে কাঁপন লাগিয়ে দিল। পড়াব কী, আর পড়বেই-বা কে? আমাদের দেশে যেরকম ভয়ঙ্কর গরমের দিনে ক্লাসের পড়ার দিকে মন যায় না, কাবুলে তেমনি দারুণ শীতের মাঝখানে পড়াশোনা করা অসম্ভব। হাতের আঙুল জমে গিয়েছে, কলম ধরতে পারছিনে, বইয়ের পাতা ওল্টানেনা যায় না। ছেলেরা ততক্ষণে আবার আপন আপন দস্তানা পরে নিয়েছে– আর দস্তানা-পরা হাতে লেখা, পাতা ওল্টানো, এসব কাজ আদপেই করা যায় না।
ততক্ষণে বুড়ো চাপরাসি এসেও হার মেনেছে। কিন্তু লোকটা বিচক্ষণ। খানিকক্ষণ চেষ্টা দেওয়ার পর বলল, ধুয়ো উপরের দিকে না উঠে ঘর ভরে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ধুয়ো বেরোবার চোঙা কেউ বন্ধ করে দিয়েছে।
তদারক করে দেখা গেল বুড়ো ঠিক কথাই বলেছে। চোঙার ভিতরে, উপরের দিকে হাত চালানোতে বেরিয়ে এল একটা ক্যানাস্তারার টিন, ছেঁড়া কম্বল দিয়ে জড়ানো। বোঝা গেল, বেশ যত্নের সঙ্গে, বুদ্ধি খরচ করে চোঙাটি বন্ধ করা হয়েছে, যাতে করে ধুয়ে উপরের দিকে না গিয়ে সমস্ত ক্লাস ভরে দেয়।
আমি হুঙ্কার দিয়ে বললুম, চোঙা বন্ধ করল কে?
সমস্ত ক্লাস এক গলায় বলল, নিশ্চয়ই ইউসুফ। আর কে করতে যাবে?
ইউসুফের দুশমন গোলাম রসুল বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকি তখন ইউসুফ ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।
ইউসুফ বলল, আমি যখন ক্লাসে ঢুকলুম তখন গোলাম রসুল ছাড়া আর কেউ ক্লাসে ছিল না। নিশ্চয়ই ও করেছে।
গোলাম রসুল চটে গিয়ে বলল, মিথ্যেবাদী।
ইউসুফ মুরুব্বির সুরে বলল, এই, স্যরের সামনে গালমন্দ করিসনে।
কী জ্যাঠা ছেলে রে বাবা! বললুম, তুই এদিকে আয়।
কুইক মার্চে সামনে এসে সেলুট দিল। আমি বললুম, তোকে ভালোরকমের সাজা দেওয়া উচিত। আজকে সমস্ত ক্লাসের পড়া নষ্ট করেছিস। ঢোক গিয়ে টেবিলের তলায়। চুপ করে সেখানে বসে থাকবি, আর কথাটি কয়েছিস কি তোর গলা কেটে ফেলব।
সুড়সুড় করে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকল।
কাবুলের ক্লাসে মাস্টারমশায়দের টেবিল বিলিতি কায়দায় বানানো হয়। অর্থাৎ তার তিন দিক ঢাকা। শুধু মাস্টার যেদিকে বসেন সেদিকটা খোলা। মনে কর খুব বড় একটা প্যাকিং কেসের ডালাটা খুলে নিয়ে তাই দিয়ে টেবিল বানাও আর খোলা দিকটায় পা ঢুকিয়ে দিয়ে বাক্সটা দিয়ে টেবিলের কাজ চালাও। আমি ঠিক তেমনি ভাবে বসে, আর ইউসুফ চুপ করে ভিতরে। নড়নচড়ন নট কিচ্ছ।
মনে হল ইউসুফের তা নিয়ে কোনও খেদ নেই; কারণ পঞ্চাশ মিনিটের পিরিয়ডের প্রায় আধঘণ্টা সে ধুয়ো, প্রিন্সিপাল, আর চাপরাসি দিয়ে বরবাদ করে দেবার বিমলানন্দ আপন মনে রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে।
আমি ছেলেদের পড়াতুম মুখে মুখে। চেঁচিয়ে বলতুম I go, সমস্ত ক্লাস আমার পরে বলত I go, আমি বলতুম We go, ক্লাস বলত We g০, এরমধারা you go, you go, কিন্তু Rahim goes, Karim goes, তার পর হুঙ্কার দিয়ে বলতুম Rahim and Karim go-0-0-0।
ওদিকে ইউসুফ চুপচাপ। জিগ্যেস করলুম– তুই বলছিস না কেন রে! বাক্সের অথবা টেবিলের, যাই বল– ভিতর থেকে ইউসুফের গলা শোনা গেল ও তো আমি জানি। আমি বললুম, বলে যা, সে সমস্ত কনজুগেশনটা ভুল না করে গড় গড় করে আবৃত্তি করে গেল। হু! ছেলেটা শয়তান বটে, কিন্তু পড়াশোনায় ভালো।
ঘণ্টা পড়ল। বললুম, ইউসুফ বেরিয়ে আয়। সুড়ুৎ করে বেরিয়ে এল। বললুম, বল্ আর কখোনও করবিনে। কী যেন একটা বিড়বিড় করে বলল, ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ততক্ষণে ক্লাস ডিসমিস করে দিয়েছি বলে সে একটা ছোটাসে ছোটা সেলুট সেরে ডবল মার্চ করে বেরিয়ে গিয়েছে। তখন বুঝতে পারলুম, দুষ্টুমি করবে না এ প্রতিজ্ঞা করতে সে নারাজ, তাই তাড়াতাড়ি কেটে পড়েছে।
রেজিস্টার, বই, খড়ি, ডাস্টার গুছিয়ে নিয়ে যেই দাঁড়াব বলে টেবিলের তলা থেকে পা টেনে আনতে গিয়েছি অমনি দু পা-ই আটকা পড়ে গেল। কী ব্যাপার! ঘাড় নিচু করে দেখি, আমার দু জুতোর দুই ফিতে একসঙ্গে বাঁধা।
কী করে হল? এ তো বড় তাজ্জব! অবশ্যি, বুঝতে সময় লাগল না। আমার অভ্যাস পা দু-খানি একজোড় করে বসার। ইউসুফ তারই সুবিধে নিয়ে অতি আস্তে আস্তে ফিতের গিঠ খুলে দু ফিতে অর্থাৎ দুই জুতো একসঙ্গে বেঁধে দিয়েছে! আর সে এমনি মোলায়েম কায়দায় যে, আমি কিছুই টের পাইনি!
আমি হার মানলুম।
বাড়ি ফেরার পথে দূর থেকে দেখি, বাড়ির দেউড়ির সামনে ইউসুফ আমার চাকর আব্দুর রহমানকে হাত-পা নেড়ে কী সব বোঝাচ্ছে, আর বিরাট-বপু আব্দুর রহমান সর্বাঙ্গ দুলিয়ে হেসে কুটিকুটি। আমাকে দেখেই ইউসুফ চটপট চম্পট।
পরদিন কলেজে যাবার সময় আব্দুর রহমান জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বলল, একরকম বোতামওলা বুট ফিতেওলা জুতোর চেয়ে ভালো।
আমি চটে গিয়ে বললুম, বস্ বস্, আর জ্যাঠামো করতে হবে না।
.