অদৃষ্টের রঙ্গরস
আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাবৎ ভারতবর্ষে লেগে গেল ধুন্ধুমার। বাদশাহ হবেন কে?
এস্থলে স্মরণ করিয়ে দিই যে, আর্য এবং একাধিক আর্যেতর জাতির মধ্যে প্রথা– রাজার মৃত্যু হলে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র বিনা বাধায় সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তুর্কমানিস্তানের মোগলদের ভিতর এরকম কোনও ঐতিহ্য ছিল না। তাদের ছিল জোর যার মুলুক তার। আরবদের ভিতর গোড়ার দিকে এই একই প্রবাদ অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট (খলিফা) নিযুক্ত হতেন, তবে জোরের বদলে সেখানে ছিল চরিত্রের, শৌর্যবীর্যের, জ্ঞান-বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই বলা হত, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হবেন খলিফা হন-না তিনি হাবশি (নিগ্রো)। এবং সেটাও ঠিক করা হত গণভোট দিয়ে।
তাই মোগল রাজা মারা যাওয়া মাত্রই, কিংবা তিনি অথর্ব অসমর্থ হয়ে পড়লেই লেগে যেত রাজপুত্রদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ। কোনও কোনও সময় রাজার নাতিরাও এবং অন্য বাজে লোকও এই লড়াইয়ের লটারিতে নেবে যেতেন। অবশ্য রাজরক্ত না থাকলে তার সম্রাট হবার সম্ভাবনা থাকত না। পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, ফররুখসিয়ারের রাজত্বের শেষের দিক থেকে মুহম্মদ শাহ বাদশা রঙিলার সিংহাসনারোহণ পর্যন্ত সিন্ধু দেশের সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিল্লিতে সিংহাসনের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন। রাজার পর রাজাকে তাঁদের হাতে পুতুলের মতো নাচতে হয়েছে। কিন্তু খ্যাতি, শক্তি, অর্থবলের মধ্যাহ্নগগনে থাকাকালীনও তাঁদের কারও তখৃৎ-ই-তাউসে বসবার দুঃসাহস হয়নি। সৈয়দ পয়গম্বরের বংশধর– তিনি সম্মান পাবেন। মসজিদে, মক্তবে, মাদ্রাসায়– রাজসভায় কবিরূপে, ঐতিহাসিকরূপে সমাজে গুরুরূপে, কিন্তু মোগল রাজবংশের রক্ত তাঁদের ধমনীতে ছিল না বলে দিল্লির হিন্দু-মুসলমান তাঁদের বাদশাহ-সালামতরূপে কিছুতেই এঁদের স্বীকার করত না। ঠিক ওই একই কারণে মারাঠা ও ইংরেজ দিল্লির সিংহাসনে বসতে চায়নি। সিপাহি বিদ্রোহ চূর্ণবিচূর্ণ না করা পর্যন্ত ইংরেজ স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়াকে ভারতের অধীশ্বরী বলে ঘোষণা করার সাহস পায়নি। এবং সেটাও করেছিল অতিশয় সভয়ে।
রাজা ও সার্বভৌম আমিরের মৃত্যুর পর যুবরাজদের ভিতর ভ্রাতৃযুদ্ধের মারফতে কে সবচেয়ে শক্তিশালী সেটা বের করা তুর্কমানিস্তানের ছোট ছোট প্রদেশে প্রবল বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে না। কিন্তু ভারতের (এবং অনেক সময় কাবুল কান্দাহার গজনির ওপরও দিল্লির আধিপত্য থাকত) মতো বিরাট দেশে এ প্রকারের যুদ্ধ বিকট অরাজকতা ও দীর্ঘকালব্যাপী অশান্তির সৃষ্টি করত। লোকক্ষয়, অর্থক্ষয় তো হতই,–অনেক সময় একই ভূখণ্ডের উপর ক্রমাগত অভিযান ও পাল্টা অভিযান হওয়ার ফলে সেখানে চাষবাস হত না, ফলে পরের বৎসর দুর্ভিক্ষ হত। সাধারণজনের বাড়িঘরদোর তো নষ্ট হতই, কলাসৃষ্টির উত্তম উত্তম নিদর্শনও লোপ পেত। এইসব যুদ্ধবিগ্রহের ফলেই ইউরোপের তুলনায় এদেশে বেঁচে আছে অতি অল্প রাজপ্রাসাদ। কোনও কোনও স্থলে পলায়মান সৈন্য পথপ্রান্তের প্রতিটি ইদারাতে বিষ ফেলে যেত। ফলে বৎসরের পর বত্সর ধরে পার্শ্ববর্তী জনপদবাসীর একমাত্র জলের সন্ধান অব্যবহার্য হয়ে থাকত।
এই দলাদলি মারামারি থেকে, কি দিল্লি-আগ্রার মতো বৃহৎ নগর, কি সুদূর সুবের (প্রভিন) ছোট শহর, আমির-ওমরাহ, সিপাহসালার, ফৌজদার প্রায় কেউ নিষ্কৃতি পেতেন না। কারণ এঁদের প্রায় প্রত্যেকেই আহ্বান, আদেশ, অনুনয়-ভরা চিঠি পেতেন প্রত্যেক যুযুধান, রাজপুত্রের কাছ থেকে আমাকে অর্থবল সৈন্যবলসহ এসে সাহায্য কর। তখন প্রত্যেক আমিরের সামনে জীবনমরণ সমস্যা দাঁড়াত আখেরে জিতবে কোন ঘোড়াটা, ব্যাক্ করি কোনটাকে? অতিশয় বিচক্ষণ কূটনৈতিকরাও রং হর্স ব্যা করে আপন, এবং কোনও কোনও স্থলে সপরিবার, প্রাণ দিয়ে ভুলের খেসারতি দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষ থাকবার উপায় ছিল না। মোগল রাজপুত্র মাত্রই ইংরেজি প্রবাদটাতে বিশ্বাস করতেন, ওয়ান হু ইজ নট উইদ্ মি ইজ এগেস্ট মি, যে আমার সঙ্গে নয়, সে আমার বিপক্ষে।
নির্ঝঞ্ঝাটে প্রতিষ্ঠিত বাদশাদের তো কথাই নেই, অতিশয় টলটলায়মান সিংহাসনে বসে দুদিনের রাজাও সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিতেন সেপাই-শান্ত্রি, ফাঁসুড়ের দল– তাঁর নিকটতম আত্মীয়দের উভয় চক্ষু অন্ধ করে দেবার জন্য যেন তারা চিরতরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সিংহাসন লাভের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা না করতে পারে। শান্তিকামী, ধর্মাচরণে আজীবন নিযুক্ত, সিংহাসনে আরোহণে সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক জনেরও নিষ্কৃতি ছিল না। নিষ্কৃতি ছিল একমাত্র পন্থায়– আত্মীয়-স্বজন দশ-দেশ ত্যাগ করে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। তবে সেটাও করতে হত আগেভাগে পরিপূর্ণ শান্তির সময়। একবার ধুন্ধুমার লেগে যাওয়া মাত্রই তামাম দেশে এসে যেত এমনই অশান্তি, লুটতরাজ যে তখন আর বন্দরে গিয়ে জাহাজ ধরার উপায় থাকত না। এমনকি পরিপূর্ণ শান্তির সময়ও আগেভাগে শেষরক্ষা বাবদে কসম খাওয়া যেত না– মক্কাতে নির্বাসিত বাইরাম খান নাকি পথমধ্যে গুজরাতে আকবরের গুপ্তচর দ্বারা নিহত হন।
ইংরেজ ফারসিতে লিখিত ইতিহাসরাজির সবকটাকেই গণ্ডায় আণ্ডা মিলিয়ে নিন্দাবাদ করে বলেছে, এ-সবেতে আছে শুধু লড়াই আর লড়াই। বিবেচনা করি, ওগুলোতে যদি গণ্ডায় গণ্ডায় শান্তিকামী পীর-দরবেশ ঘুরে বেড়াতেন, কিংবা তার চেয়েও ভালো হত যদি রাজা-প্রজায় সবাই মিলে চাঁদনি চৌকে হাল্লেলুইয়া হৰ্ষরব তুলে ইংরেজের আগমনী গান ধরতেন, তা হলে বোধহয় শ্বেত সমালোচকেরা সন্তুষ্ট হতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মোগলরা যে-ঐতিহ্য সঙ্গে এনেছিল সেটা তার বিকৃততমরূপে দেখা দিল তাদের পতনের সময়। ফলে স্বার্থে স্বার্থে যে সংঘাত উপস্থিত হল তার সমাধান যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কোনও পন্থায় সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিকরা সেসব যুদ্ধের বর্ণনা না দিয়ে দি নেশন অব শপলিফটারসের জন্য সেই সঙ্কর্মের টেকনিক্ বয়ান করলে সত্যের অপলাপ হত।
কিন্তু এসব ইতিহাস শুধু যুদ্ধে যুদ্ধে ভর্তি ছিল একথা বললে আরেকটা খুব বড় সত্য গোপন করা হয়। এদের প্রচুর সাহিত্যিক মূল্যও যে ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তার পূর্বেই একটি সত্য স্বীকার করে নিই। বিদেশাগত কিছু লোক ভিন্ন এদেশের কারওরই মাতৃভাষা ফারসি ছিল না। এবং মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষাতে শত ভেল্কিবাজি দেখাতে পারলেও সেখানে সত্যকার সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বও অনস্বীকার্য যে, সাহিত্য যে উপাদানে নির্মিত হয় তার অভাব ভারতবর্ষে রচিত ফারসি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তুলনা দিয়ে বলা যায়, রামায়ণের কাহিনী যত কাঁচা ভাষাতেই রচা হোক না কেন, তার চিত্তাকর্ষণী শক্তি কিছু না কিছু থাকবেই।
তাই ফারসি ভাষায় রচনাকারী ঐতিহাসিকরা হামেশাই কোনও বাদশার রাজত্বকালের তাবৎ লড়াই, বাদশার প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের জন্য আমিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কূটনৈতিক চতুরঙ্গ ক্রীড়ার মারপ্যাঁচ ইত্যাদি বর্ণনা করার পর পঞ্চমুখ হতেন বাদশার বিবাহের সালঙ্কার বর্ণনা দিতে; সেই উপলক্ষে সম্মিলিত কবিকুলের বর্ণনা দিতে, এবং সর্বশেষে বাদশার ব্যক্তিগত গুণাগুণের উল্লেখ করতে। সবসময় যে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে সমর্থ হতেন তা নয়, কিন্তু বাদশা সজ্জন হলে তাঁর গুণ বর্ণনায় পঞ্চমুখ হতে কোনও অসুবিধাই উপস্থিত হত না।
যেমন গুজরাতের এক বাদশা ছিলেন অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ, পুণ্যশীল। তাঁর জীবিতাবস্থায়ই গুণমুগ্ধ প্রজাসাধারণ তাঁর নাম দেন অল-হালি পুণ্যশীল। মিরাৎ-ই সিকন্দরি গুজরাতের প্রখ্যাত ইতিহাস। তার লেখক অল-হালিমের সময়কালীন যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা দেবার পর পরমানন্দে হুজুর বাদশার সর্বপ্রকারের পুণ্যশীল খামখেয়ালির বর্ণন-পর্বে প্রবেশ করেছেন। কে বলবে তখন আমাদের এই ঐতিহাসিক শুধু যুদ্ধবিগ্রহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই উল্লাস বোধ করেন। বস্তুত এই অনুচ্ছেদে প্রবেশ করার পর মনে হয় তাঁর যেন আর কোনও তাড়া নেই, মাথুরে পৌঁছনোর পর কীর্তনিয়ার যে অবস্থা হয়। এ ইতিহাস তাকে যে একদিন শেষ করে তামাম্ শুদৃ লিখতে হবে সে ভাবনা তার চৈতন্য থেকে যেন সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।
হুজুর অল-হালিমকে এক বিদেশাগত পাঁচক এক নতুন ধরনের পোলাও খাওয়ালে পর হুজুর পরম পরিতৃপ্তি প্রকাশ করে বললেন, উজির! আমার প্রজারা কি কখনও-সখনও এ রকমের পোলাও খায়? উজির স্মিতহাস্য করে বললেন, হুজুর, তা কখনও হয়! হুজুর বললেন, একা একা খেয়ে আমি কেমন যেন সুখ পাচ্ছিনে। হুকুম দিলেন, মহল্লা মহল্লায় বিরাট বিরাট পাত্রে করে যেন হুবহু ওইরকমের পোলাও তৈরি করে তাবৎ আহমদাবাদবাসীদের খাওয়ানো হয়। আমাদের ঐতিহাসিকটি যেন ঈষৎ আমোদ উপভোগ করে ইঙ্গিত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হুজুরের এসব খামখেয়ালির অপব্যয় দেখে ভারি বিরক্ত হতেন।
তা সে যা-ই হোক-তাবৎ আহমদাবাদবাসী সেদিন কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দিনভর ফিস্টি খেল। যে সাবরমতীর পারে বসে বহু যুগ পরে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুধিত পাষাণ রচেছিলেন সেই সাবরমতীর পারে সেদিন আর কেউ ক্ষুধিত রইল না।
ঠিক ওইরকমই দিল্লির শেষ মোগলদের কোনও এক বাদশার বিয়ের শোভাযাত্রায় উঁচু হাতির পিঠ থেকে রুপো দিয়ে বানানো ফুল রাস্তার দু পাশের দর্শকদের উপর মুঠো মুঠো ছড়ানো হয়। ঐতিহাসিক খাফি খান–কিংবা খুশ হা-চন্দ বা অন্য কেউ হতে পারেন, আমার মনে নেই- যখন তার ইতিহাস লিখলেন তখন দিল্লির বড় দুঃখের দিন। সেই আঁকজমক শান-শওকতের স্মরণে যেন উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, এ অধমও সেই দর্শকদের মধ্যে ছিল। সে-ও তার কুর্তার দাম (অগ্রভাগ, অঞ্চল) দু হাত দিয়ে প্রসারিত করে উদ্গ্রীব আকাক্ষায় প্রতীক্ষা করল। এ অধমের কী সৌভাগ্য, কী খুশ-কিস্মাৎ! আম্বো তিনটে ছোট ছোট ফুল পেয়ে গেলুম। জয় হোক দিল্লিশ্বরের! জগদীশ্বর তাকে দীর্ঘজীবী করুন!
এ যুগের ইতিহাস বিষাদময়, কিন্তু ঘটনাবহুল বলে একাধিক ফারসিজ্ঞ হিন্দুও তার সুদীর্ঘ বিবরণ লিখে গিয়েছেন। তার একটি ঘটনার বর্ণনা দেবার জন্য বক্ষ্যমাণ লেখন। কিন্তু তৎপূর্বে এক লহমার তরে আহমদাবাদ ফিরে যাই।
মিরাৎ-ই সিকন্দরি ইতিহাস বলে, অল্-হালিম্ আহমদাবাদের দুর্দান্ত শীতে লক্ষ করলেন, গৃহহীনদের দুরবস্থা। আদেশ দিলেন যে, প্রতি চৌরাস্তায় যেন সন্ধ্যার পর কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো হয়। বহু গৃহহীন এমনকি গৃহস্থও সেই আগুন ঘিরে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে গাল-গল্প, গান-বাজনা করে রাত কাটাত। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে অল্-হালিম্ বৃহৎ আবাস নির্মাণ করে দিলেন– ভিখিরি-গরিবদের বসবাসের জন্য। ঐতিহাসিকরা বলতে পারবেন, এ ধরনের পুয়োর হোম পৃথিবীর এই সর্বপ্রথম কি না।
শীতে যাতে তারা কষ্ট না পায় তার জন্য লেপের ব্যবস্থাও হল। মিরাৎ-ই-সিকন্দরির লেখক বলছেন, কিন্তু এসব লক্ষ্মীছাড়া ভ্যাগাবন্ডদের কেউ কেউ আপন আপন লেপ বিক্রি করে দিয়ে মদ খেত। খবরটা কী করে জানি হুজুরের কানে গিয়ে পৌঁছল। আমার মনে সন্দেহ হয়, হয়তো-বা আমাদের সেই সিনিক প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আজম্ সাহেবই মজা চেখে চেখে বাঁকা নয়নে তাকিয়ে হুজুরের অপব্যয়ের চরম পরিণামটি হুজুরেরই খেদমতে পেশ করেন!
তিনি নিজে করে থাকলে সেটা বুমেরাঙের মতো তারই কাছে ফিরে আসে। হুজুর বললেন, এটা কী করে ঠেকানো যায়, বল তো উজির। উজির অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবখানা করলেন, স্বাধীন সম্রান্ত আসমুদ্র রাজস্থানব্যাপী গুর্জরভূমির মহামান্য সম্রাটের অতিমান্য প্রধানমন্ত্রী নেপাতা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন না! হুজুর কিন্তু উজিরের অতশত সূক্ষ্মানুভূতির পশ্চাদ্ধাবন করেন না। বললেন, রাতটা ভেবে দেখ। উজির-ই আলা যেভাবে কুর্নিশ করে বিদায় নিলেন তাতে মনে হল না যে, তিনি ত্রিযামা-যামিনী অনিদ্রায় যাপন করবেন।
পরদিন ফজরের নামাজের পরই, অর্থাৎ ব্রাহ্ম-মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রীর তলব পড়ল। হুজুর সহাস্য আস্যে তাঁকে বললেন, বুঝলে হে উজির সাহেব, আমিই কাল রাত্রে চিন্তা করে দাওয়াইটা বের করেছি। প্রত্যেককে আলাদা লেপ না দিয়ে চার-চারজনকে এক-একটা করে বড় লেপ দাও। চারজনই তো আর মদের গোলাম হবে না যে একজোট হয়ে লেপ বিক্রি করে দেবে। যারা খায় না তারা ঠেকাবে।
এ ধরনের চুটকিতে মিরাৎ-ই-সিকন্দরি ভর্তি। তাছাড়া দীর্ঘতর কাহিনীও এ কেতাবে আছে। এমনকি বিশাল বিরাট বীরপুরুষ মুহম্মদ বেগড়ার (এর গোঁফ নাকি এতই দীর্ঘ ছিল যে তিনি তার দুই প্রান্ত মাথা ঘুরিয়ে পিছনে এনে ঘাড়ের উপরে গিঠ বেঁধে রাখতেন!) যৌনজীবনও তিনি নির্বিকারচিত্তে সালঙ্কার বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রাদেশিক ইতিহাস বলে, এ কেতাব তার ন্যায্য মূল্য পায়নি।
শেষ মোগলদের ইতিহাসে একটি অতিশয় হতভাগ্যের জীবন ও একটি ঈষৎ হাস্যরস-মিশ্রিত ঘটনা– এই দুই আমার মনে আসে। পুজোর বাজারে অন্য পত্রিকায় একটা করুণ রস লিখে আমার রেশন খতম। দ্বিতীয়টাই শুনুন।
পূর্বেই নিবেদন করেছি মোগলসম্রাট মাত্রেরই মৃত্যু হলে রাজপুত্রদের ভিতর লাগত যুদ্ধ। আওরেঙ্গজেবের মৃত্যুর পরও তার ব্যতিক্রম হল না। লড়াই জিতে বাদশাহ হলেন শাহ আলম বাহাদুর শাহ। পাঁচ বৎসর রাজত্বের পর তাঁর মৃত্যু হলে পুত্র জাহান্দার শাহ তখতে বসলেন। মোগল বংশের ওপর আর কেউ এর মতো কলঙ্ক-কালিমা লেপন করেননি। একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। একটি বাইজি– লালকুনওরকে তিনি দিয়েছিলেন বেগমের সম্মান ও তাঁকে নিয়ে বেরোতেন দিল্লির প্রকাশ্য রাস্তায় মদ্যপান করতে।* তখনকার দিনে আজকের পানওলার দোকানের মতো মদের দোকান থাকত– অর্থাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চো করে একপাত্র মদ্যপান করে ফের অন্য দোকানে আরেক পাত্র করে করে বাড়ি পৌঁছানো যেত। কিংবা রাস্তায় গড়াগড়ি দেওয়া যেত। হুজুর বাদশাহ সালামত সেই বাইজি লালকুনওরের পাশে দাঁড়িয়ে এইসব অতি সাধারণ শ্রেণির দোকান ও তাদের খদ্দেরের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে করতে পাত্রের পর পাত্র গলায় ঢালতেন এবং লালকুনওরের তো কথাই নেই। তিনি একদা যে হাফ-গেরস্থ অঞ্চলে (ফরাসিতে হুবহু একেই বলে দেমি-দ, এদের স্ত্রীলোক বাসিন্দা দেমিমঁদেন) তাঁর ব্যবসা চালাতেন, সেখানকার লোফাররা এসে সেখানে জুটত। বাদশাহ সালামত দরাজ দিলে ঢালাই পাইকিরি হিসেবে মদ্য বিতরণ করতেন। তখনকার দিনে দিল্লির বাদশারা বয়েলের গাড়ি চড়ে বেড়াতে ভালোবাসতেন। তার ড্রাইভারও সেই সর্বজনীন গণতান্ত্রিক পানোৎসবে অপাঙক্তেয় হয়ে রইত না। রাস্তায় ভিড় জমে যেত। আমির-ওমরাহ হঠাৎ এসে পড়লে পাল্কি ঘুরিয়ে নিতেন; পদাতিক ভদ্রজন এই বেলেল্লাপনার মাঝখানে পড়ে ব্ৰিত না হওয়ার জন্য গুত্তা মেরে ডাইনে-বাঁয়ের কোনও দোকানে আশ্রয় নিতেন।
[*এ যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে হিটলারের প্রধান সেনাপতি ব্লমবের্ক বৃদ্ধ বয়সে ভালো করে অনুসন্ধান না করে তাঁর স্টেনোকে বিয়ে করে ফেলেন। অথচ ইনি একদা একাধিক শহরে দেমি-দেন ছিলেন। বিয়ের রাত্রে পৃথিবীর এই সর্বপ্রাচীন ব্যবসায়ের মেয়েরা তাদের পাড়ায়। পাড়ায় বিয়েটা সেলেব্রেট করে– যেন তারা সমাজে কল্কে পেয়ে গেল এবং শুধু তাই না, যেসব পুলিশ তাদের ওপর চোটপাট করত তাদের ফোন করে তাদের হেলথ ড্রিঙ্ক করে। পরে হিমলার দলিল-দস্তাবেজসহ হিটলারের কাছে কেলেঙ্কারিটা ফাস করলে পরে তিনি ব্লবের্ককে রিটায়ার করতে আদেশ দেন।]
মুসলমান শাস্ত্রে মদ্যপান নিষিদ্ধ। অবশ্য দেশবাসী জানত যে রাজা-বাদশারা এ আইনটি এড়িয়ে যান, কিন্তু তারাও চক্ষুলজ্জার খাতিরে খোলাখুলিভাবে সচরাচর মদ্যপান করতেন না। এ যুগে রাজা ফারুক প্রায় জাহান্দার শার মতো আচরণ করে কাইরোর জনসাধারণের আক্কেল গুডুম করে দেন। রোজার মাসে আবার বলছি উপবাসের মাসে তিনি তাঁর নিত্যপরিবর্তিত দেমি-দেন নিয়ে প্রশস্ত দিবালোকে এক বার থেকে আরেক বারে ঘুরে বেড়াতেন মাতা এবং প্রাসাদের অন্যান্য মুরুব্বিদের সর্ব সদুপদেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। এরই পরিত্যক্তা এক দেমি-দেন প্রেয়সী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই মহাপুরুষটি গুরুভোজন বা অত্যধিক পানের ফলে গতাসু হবেন। বন্ন ভক্ষণ করে রাজ্যচ্যুত অবস্থায় ইনি অধুনা রোম শহর থেকে সাধনোচিত ধামে গেছেন– ঝিনুকের ভিতরকার বস্তু মাত্রাধিক খাওয়ার ফলে।
তা যা-ই হোক, জাহান্দার শাহ একদিন ইত্যাকার রোদ মারতে মারতে বেএক্তেয়ার হয়ে যান না হওয়াটাই ছিল ব্যত্যয়– এবং আধামাতাল গাড়োয়ান হুজুর ও লালকুনওরকে কোনও গতিকে গাড়িতে তুলে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়ে লালকেল্লা পানে গাড়ি চালায়। বয়েল দুটো সর্বশ্রেষ্ঠ জাতের। পথ চিনে সোজা কেল্লার ভিতরে প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লালকুনওর টলতে টলতে প্রাসাদে ঢুকলেন। বয়েল দুটো চলল– আপন মনে বয়েলখানার দিকে, কারণ গাড়োয়ান সম্পূর্ণ বেহুশ।
ঘণ্টাখানেক পরে পড়ল খোঁজ খোঁজ রব। বাদশা কোথায়, বাদশা কোথায়? এ যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। খবরটা যদি রটে যায় তবে বাদশার যে কোনও ভাই, চাচা, ভাতিজা নিজেকে রাজা বলে অবশ্যই ঘোষণা করবেন এবং তা হলেই তো চিত্তির। বিরাট লালকেল্লা তন্ন তন্ন করে খোজা হল, কিন্তু হুজুর যেন মহাশূন্যে অন্তর্ধান করেছেন।
তখন এক সুবুদ্ধিমানের মাথায় অলৌকিক অনুপ্রেরণা এল। এক মাইল দূরের বয়েলখানাতে অনুসন্ধান করে দেখা গেল, হজুর অঘোর নিদ্রায়, গাড়োয়ানও তদ্বৎ।
বলা বাহুল্য, পথচারী মদ্যপায়ী মহলে হুজুর অতিশয় জনপ্রিয় হলেও আমির ওমরাহ মায় প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনি জানতেন; জাহান্দার শাহ তখৎ-হীন হলে তাঁরও নবীন রাজার হাতে জীবন সংশয়– সকলেই তার ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন।
ওদিকে দুই প্রধান আমির সিন্ধু দেশের সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি ব্যাক করছেন অন্য ঘোড়া– জাহান্দার শাহ্-এর ভ্রাতা আজীম্ উশ-শান-এর পুত্র সুদর্শন, সুপুরুষ–বলা হয় তৈমুরের বংশে এরকম বলবান সুপুরুষ আর জন্মাননি- ফররুখসিয়ারকে। তারা দিল্লির দিকে রওনা হয়েছেন সিংহাসন অধিকার করতে। যুদ্ধে জাহান্দার পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন। সিংহাসন হারিয়ে তিনি যত না শোক প্রকাশ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি মর্মবেদনা প্রকাশ করলেন, বার বার বেদনাতুর, মিনতিভরা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে, আমার লালকুনওকে আমার কাছে আসতে দাও, দয়া করে লালকুনওরকে আসতে দাও। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তখনই তাদের স্বরূপ দেখাতে আরম্ভ করেছেন–অর্থাৎ তারা গ্লাডস্টোনের মতো কিংমেকার, তারা রাজা ম্যানুফেকচার করেন– লাকুনওর অনুমতি পেলেন জাহান্দার-এর বন্দি জীবনের সাথী হওয়ার।
অধম শুধু পটভূমিটি নির্মাণ করছে; নইলে জাহান্দার শাহ বা ফররুখসিয়ার কেউই আমার লক্ষ্য প্রাণী নন। তবু ফররুখসিয়ার সম্বন্ধে যৎসামান্য বলতে হয়। ইনি বুদ্ধি ধরতেন কম, এবং যে কূটনীতিতে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেইটে প্রয়োগ করতে চাইতেন দুই ধুরন্ধর পকৃসিদ্ধ, অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের একজন প্রধানমন্ত্রীর ও অন্যজন প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ করে বাদশা সালামতকে প্রায় উপেক্ষা করে রাজত্ব চালনা করতে লাগলেন। নানাপ্রকার মেহেরবানি বণ্টন করে দুই ভাই শক্তিশালী আমির-ওমরাহ গোষ্ঠী নির্মাণ করলেন এবং প্রত্যক্ষত সন্দেহ রইল না যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে যা-ই করুন না কেন, শাহি ফৌজ তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। বেচারা বাদশাহ ক্রমেই ক্ষমতা হারাতে লাগলেন এবং শেষটায় চেষ্টা দিলেন, যেসব ভাগ্যান্বেষী অ্যাডভেনচারাররা ইরান-তুরান থেকে দিল্লি আসত তাদের নিয়ে একটা দল সৃষ্টি করতে।
একদা এদের মধ্যে যারা সত্যকার কৃতবিদ্য কিংবা রণবিশারদ তারা দিল্লি দরবারে ও জনসাধারণের ভিতর সম্মান পেতেন। কিন্তু পাঁচশো বসুর মোগল রাজত্ব চলার পর দিল্লির খাসবাসিন্দা মুসলমান ও হিন্দুগণ একটা জোরদার স্বদেশী পার্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন। সৈয়দ ভাইরা ছিলেন এ দলের নেতা। (দুর্ভাগ্যক্রমে এ যুগের ঐতিহাসিকরা এই স্বদেশী দলের মাহাত্ম্য পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করেননি; আর ইংরেজ ঐতিহাসিক অবশ্যই চাইত না যে, এরই অনুকরণে নিত্য নবাগত ইংরেজ ভাগ্যান্বেষীদের বিরুদ্ধে ভারতে একটা স্বদেশী পার্টি গড়ে উঠুক)।
নিরুপায় হয়ে ফররুখসিয়ার তার শ্বশুর যোধপুরের রাজা অজিত সিংকে দিল্লিতে আসবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে দূত পাঠালেন। কারণ তখন তিনি সত্যই বুঝে গিয়েছিলেন। যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তাঁকে আর বেশিদিন বরদাস্ত করবেন না। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে অন্য ক্রীড়নককে তখৎ-ই-তাউসে বসাবেন।
অজিত সিং দিল্লি পৌঁছানো মাত্রই সৈয়দরা তাঁকে সংবর্ধনা করতে অগ্রসর হলেন– বাদশা সালামত তখন কার্যত লালকেল্লায় বন্দি। তারা ওই স্বদেশী বিদেশির জিগিরটি উচ্চকণ্ঠে গাইলেন। অজিত সিং-ও বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, সৈয়দদের সঙ্গে মোকাবেলা করার মতো শক্তি তার নেই। ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করা বাবদে তিনি সম্পূর্ণ সম্মতি স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছিলেন কি না বলা কঠিন।
সৈয়দদ্বয় ফররুখসিয়ারকে ধরে আনবার জন্য অন্দরে সৈন্য পাঠালেন। হারেমে রমণীরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে উঠলেন। তুর্কি রমণীদের সাহস যথেষ্ট, নূরজাহান-জাহানারা অতি কৃতিত্বের সঙ্গে তাবৎ ভারত শাসন করেছেন, কিন্তু এঁদের ভিতর কেউ সেরকম ছিলেন না, কিংবা হয়তো দম্ভী ফররুখসিয়ার এঁদের মন্ত্রণায় কর্ণপাত করেননি। অবশ্য তাকে সবলে টেনে আনতে দূতদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ তাঁর শরীরে ছিল অসাধারণ বল।
সৈয়দদ্বয়ের সামনে তাকে আনা হলে তাঁদের একজন আপন কলম-দান খুলে, চোখে সুরমা (কাজল) লাগাবার শলাকা ঘাতকের হাতে দিলেন। ফররুখসিয়ারকে সবলে চিৎ করে ফেলে অন্ধ করা হল। তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, ওই নিষ্ঠুর কর্ম যে করেছিল সে তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধ করেনি সে ভেবেছিল, বলা তো যায় না, হয়তো একদিন তিনি আবার রাজা না হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী হবেন, তখন সে মৃত্যুদণ্ড তো এড়াবেই, হয়তোবা বখশিশও পেতে পারে। ফররুকসিয়ারকে নহবতখানায় বন্দি করে রাখা হল। লালকেল্লার আজকের দিনের প্রধান প্রবেশপথ ও দেওয়ান-ই-আম-এর মাঝখানে এটা পড়ে।
ওদিকে কিন্তু দিল্লির অন্য এক মহল্লায় এক ভিন্ন কমেডি শুরু হয়েছে।
সৈয়দদ্বয় অনেক চিন্তা ততোধিক তর্কবিতর্ক আলোচনা করে স্থির করেছেন যে, ফররুখসিয়ারের খুড়ো রফি-উশ-শানের (ইনি আজিম-উশ-শানের পরের ভ্রাতা আওরঙ্গজেবের দৌহিত্র) জ্যেষ্ঠ পুত্র তরুণ মুহম্মদ ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসানো হবে। সেই মর্মে দূত পাঠানো হয়েছে রফি-উশ-শানের হাভেলিতে। সেখানে ইব্রাহিম তাঁর ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনসহ বাস করেন।
দূতের দল উপস্থিত হওয়ামাত্রই হাভেলিতে উচ্চৈঃস্বরে বামাকণ্ঠের ক্রন্দন রোদন চিৎকার অভিসম্পাত আরম্ভ হল।
কারণটা সরল। কয়েকদিন ধরেই দিল্লি শহর শত রকমের গুজবে ম-ম করছে। ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হলে হতেও পারেন যদিও অনেকেই প্রাণপণ আশা করছিলেন, অজিত সিং যা-ই করুন, আপন জামাতাকে সিংহাসনচ্যুতি থেকে রক্ষা করবেন নিশ্চয়ই, নইলে তাঁর নিধন অবধারিত ও দিল্লিবাসীদের কাছে যে ব্যক্তি পুত্রকে হত্যা করে তার চেয়েও ঘৃণ্য– যে তার মেয়েকে বিধবা হতে দেয়। কিছুদিন পর ফররুখসিয়ার নিহত হওয়ার পর অজিত সিং রাস্তায় বেরোলেই তার সশস্ত্র পাইক-বরকন্দাজকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা। করে রাস্তার ছোঁড়ারা তাঁর পাল্কির দুই পাশে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে ঐক্যতান ধরত, দামাদকুশ, দামাদকুশ জামাতৃহন্তা, জামাতৃহন্তা! পুত্রকে হত্যা করে কেউ এভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে আমার স্মরণে আসছে না।)
ফররুখসিয়ার সিংহাসন হারালে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের যে কার প্রতি নেক্-নজর–অবশ্য যে-ই রাজা হোন তাঁকে হতে হবে ভ্রাতৃদয়ের হস্তে পুত্তলিকা মাত্র– পড়বে তার কিছু স্থিরতা ছিল না। দূতরা তাই যখন হাভেলির সামনে এসে সুসংবাদ দিল, তারা এসেছে সমারোহ। সহকারে নবীন রাজা মুহম্মদ ইব্রাহিমকে তাঁর অভিষেকের জন্য নিয়ে যেতে, তখন সবাই নিঃসন্দেহে ভাবল এটা একটা আস্ত ধাপ্পা। আসলে আর কেউ বাদশা হয়ে দূত পাঠিয়েছেন ইব্রাহিমকে ছলে বলে পকড় করে নিয়ে গিয়ে হয় হত্যা করতে, নিদেন অন্ধ করে দিতে– যাতে করে পরবর্তী প্রতিদ্বন্দীরা সম্পূর্ণ নির্মূল হয়; এ রেওয়াজ তো রাস্তার ভিখিরি পর্যন্ত জানে, জানবে না শুধু রাজবাড়ির হারেমের মহিলারা! তওবা! তওবা!!
বিরাট বাড়ি। বিস্তর কুঠুরি, চিলেকোঠা। তদুপরি এসব কারবার তো দিল্লি শহরে হামে-হাল লেগেই আছে। তাই দু-চারটে গুপ্তঘর, পালিয়ে যাবার সুড়ঙ্গও যে নেই, এ কথাই বা বলবে কে? হারেম-মহিলারা তড়িঘড়ি ইব্রাহিম ও তার ছোট ভাই রফি উদ্-দৌলাকে কোথায় যে লুকিয়ে ফেললেন তার সন্ধান পেতে আদৌ যদি পাওয়া যায়– লাগবে সময়। ওদিকে দূতদের পই পই করে বলা হয়েছে, তারা যাবে আর আসবে, ছররার মতো দ্রুতবেগে, এবং পথমধ্যে যেন তিলার্ধকাল বিলম্ব না করে। কারণটি অতিশয় স্বপ্রকাশ। দিল্লি শহরের দুগ্ধপোষ্য শিশু পর্যন্ত জানে, একবার যদি খবর রটে যায় এবং সেটা কিছুমাত্র অসম্ভব নয়– যে ফররুখসিয়ার সিংহাসনচ্যুত হয়ে গিয়েছেন এবং সে সিংহাসন তখনও শূন্য তা হলে আওরেঙ্গজেব-বংশের যে কোনও রাজপুত্র দুঃসাহসে ভর করে নিজেকে বাদশা বলে ঘোষণা করে দেবে। সৈয়দ-ভায়েরা বিলক্ষণ জানতেন যে, যদিও আমির-ওমরাহ সোওয়ার-সেপাই তাদের পক্ষে, তবু এ তত্ত্বটি ভুললে বিলকুল চলবে না যে, ফররুখসিয়ার ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় সম্রাট। তার পর আরেকটা কথা। আওরেঙ্গজেবের এক বংশধর যদি অন্য বংশধরকে খেদিয়ে দিয়ে সিংহাসন দখল করেন, তবে জনসাধারণ হয়তো কোনও পক্ষই নেবে না। কিন্তু সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তো কোনও রাজাদেশে, সিংহাসনে হক্কধারী কোনও রাজপুত্রের হুকুমে বাদশাহ ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করেননি। তারা কে? আসলে সিন্ধু প্রদেশের দুই ভাগ্যান্বেষী। একজন ফররুখসিয়ারের প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন প্রধান সেনাপতি। অর্থাৎ তার কর্মচারী এবং তাঁরই নুননেমক খেয়েছেন অন্তত দু-টি বছর ধরে। তাই মনিবকে সিংহাসনচ্যুত করে এঁরা যে অপকর্মটি করলেন এটা নেমকহারামির চূড়ান্ত! দিল্লির জনসাধারণ উজবুক নয়। তারা যদি ক্ষেপে যায় তবে সৈন্য-সামন্ত নিয়েও দিল্লিকে ঠাণ্ডা করা রীতিমতো মুশকিল হবে।
অতএব সৈয়দদের সর্বাপেক্ষা জরুরি প্রয়োজন, তড়িঘড়ি আওরেঙ্গজেবের কোনও সন্তানকে সিংহাসনে বসিয়ে তার কাছ থেকে ফরমান নিয়ে আইনত এবং ঐতিহ্যগত পন্থায় দিল্লির রাজভক্ত প্রজাগণকে মোকাবেলা করা।
কিন্তু দূতরা গুপ্তঘরের সন্ধান পাবে কী করে? বাচ্চাটিকে কেড়ে নিতে চাইলে বেড়ালটা পর্যন্ত মারমুখো হয়ে ওঠে। এরা আবার তুর্কি রমণী– যুগ যুগ ধরে ইয়া তাগড়া তাগড়া মর্দকে কড়ে আঙুলের চতুর্দিকে ঘুরিয়েছে।
অবশ্যই পাঠক প্রশ্ন করতে পারেন, ফররুখসিয়ায়কে হারেমের ভিতর থেকে ধরে আনা গেল, আর এখন এই চ্যাংড়াটাকে কাবু করা যাচ্ছে না?
ব্যাপারটা সরল। ফররুখসিয়ারের হারেমের তুর্কি রমণীরা যে বাদশার সঙ্গে সঙ্গে সর্ব সম্মান হারিয়ে বসেছেন। এরা বাধা দিলে সেপাইরা তাদের ওপর প্রয়োগ করবে পশুবল। এরা জানে দুদিন বাদেই এইসব নিষ্প্রভ, হতজ্যোতি, লুপ্তসম্মান সুন্দরীদের পাঠিয়ে দেওয়া। হবে সোহাগপুরাতে। আল্লা জানেন কোন কারসিক এই পরিত্যক্তা রমণীদের দীনদরিদ্র নির্লজ্জভাবে অবহেলিত শেষ আশ্রয়স্থলকে সোহাগপুরা নাম দিয়েছিল। এরা সেখানে পাবেন সে গ্রাসাচ্ছাদন। তার বীভৎস বর্ণনা থেকে আমি পাঠককে নিষ্কৃতি দিলুম।… কিন্তু যে ইব্রাহিম এখন রাজা হতে চললেন তাঁর মুরুব্বিদের তো ভিন্ন শিরঃপীড়া।
তাই নতুন রাজাকে আনতে গিয়ে দূতদের প্রাণ যায় যায়। মরিয়া হয়ে তাঁর মা, মাসি, জ্যেঠি, খুড়ি এককথায় তাবৎ রমণীরা আরম্ভ করেছেন দূতের গুষ্টিকে বেধড়ক ঠ্যাঙাতে। হেঁড়া জুতো, খোঁচা-খোঁচা খ্যাংরা-খররা হেন বস্তু নেই যা দিয়ে তাঁরা ওদের পেটাতে কসুর করছেন। বেচারিরা খাচ্ছে বেদরদ মার, দু হাত দিয়ে যতখানি পারে সে মার ঠেকাবার চেষ্টা করছে। একখানা কাঠির ঝাটার সপাং করে মুখের উপর মার– সেটা কোন জঙ্গিলাটের কোন অস্ত্রের চেয়ে কম! বেচারিরা এদের গায়ে হাত তোলা দূরে থাক, ঠেলাটি পর্যন্ত দিতে পারে না। কালই তো এরা লালকেল্লার প্রাসাদে গিয়ে আবাস নেবেন। তখন বেচারিদের হালটা হবে কী? খুদ বাদশা সালামতের পিসিকে মেরেছিল ধাক্কা, খুড়িকে মেরেছিল কনুই দিয়ে গুত্তা— বেয়াদবি বেতমিজি তবে আর কাকে বলে! বন্দ কর ব্যাটাদের পিঞ্জরা সেঁ, ঝুলিয়ে রাখো বদমাইশদের লাহোরি দরওয়াজার উপর! সৈয়দ-ভায়ারা কি তখন আর তাদের স্মরণে আনবেন।
এই একতরফা জেনানা আক্রমণ, তথা গৃহনির্মিত সাতিশয় মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্রের দফে দফে বয়ান প্রত্যেক ঐতিহাসিক দিয়েছেন বড়ই প্রেমসে। এই মারপিটের বর্ণনাতে পৌঁছে এ যুগের ঐতিহাসিকরা ভাবেন, তারা যেন বেহেশতে পৌঁছে গেছেন—নড়বার নামটি পর্যন্ত করেন না।
আর আর্তচিৎকার উঠছে সম্মার্জনী-লাঞ্ছিত হতভাগ্যদের দোহাই আল্লার, কসম আল্লার, পয়গম্বর সাক্ষী, আমরা কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। আমরা এসেছি হুজুরকে তার ন্যায্য তখৃতের উপর বসাতে। কিন্তু অরণ্যে রোদন আর জনারণ্যে রোদনে ফারাক থাকলে জনসমাবেশকে অরণ্য নাম দেওয়া হল কেন?
ওদিকে দুই কিং-মেকার্স বা রাজা নির্মাণের রাজমিস্ত্রি মহা প্রতাপান্বিত শ্ৰীযুত সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি লালকেল্লার দিওয়ান-ই-আম-এর ভিতর বসে আছেন যেন কাঠ-কয়লার আগুনে আঙ্গিঠার উপর। দূতের পর দূত পাঠিয়ে যাচ্ছেন রফি-উশ-শানের হাভেলিতে, কিন্তু সে যেন সিংহের গুহাতে মানুষ পাঠানো। কেউই আর ফিরে আসে না। যে যায়, সে-ই বঁটা-পেটার দয়ে লীন হয়ে যায়, কিংবা রাস্তা দিয়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে অগুরু-চন্দনকাঠের ভাষায় বোঝাতে চেষ্টা করে যে, প্রতিটি মুহূর্ত জীবন-মরণ সমস্যা সঙ্কটময় করে তুলছে। ভিতরে একপাল লোক ছুটেছে গুপ্তঘরের সন্ধানে, তাঁদের পিছনে ছুটেছে জেনানা-রেজিমেন্ট পেটিকোট-পল্টন আসমান-ফাটানো চিল্লি-চিৎকার করতে করতে। সর্বপ্রকারের সংগ্রামনভিজ্ঞ আপনাদের সেবক, এই দীন লেখক, তাদের হাতে যেসব মারণাস্ত্র আছে, তাঁদের রণকৌশল, বৃহনির্মাণাদির আর কী বর্ণনা দেবে? বাবুর্চিখানার খুন্তি সাঁড়াশি থেকে আরম্ভ করে সেই মোগল যুগে কত কী থাকত তার বর্ণনা দেব নিরীহ বাঙালি, আমি! মাশাল্লা!
চতুর্দিকে, আকাশে-বাতাসে সেই অভূতপূর্ব উত্তেজনা, দ্রুতগতিতে ধাবমান বহুবিধ নরনারী, চিৎকার আতাঁরব, আল্লার শপথ, রসুলের নামোচ্চারণ, হজরত আলির অনুকম্পার জন্য করুণ ফরিয়াদ, মহরমের দিনের ইমাম হাসান-হুসেনের ঝাণ্ডা নিয়ে কাড়াকাড়ি যেন, এমন সময়
এমন সময় অতি ধীরে ধীরে একটি বালক বালকই বটে, কারণ সে অজাতশত্রু অজাতগুফ– ওই যে হোথা মুদির দোকান দেখা যাচ্ছে, সেখান থেকে ধীরে ধীরে এই হাভেলির সামনে এসে একবারমাত্র সেই হুলস্থুল কাণ্ডের দিকে একটা শান্ত দৃষ্টি ফেলে বাড়িতে ঢুকল। তার পরনে নুনময়লা সুতির পাজামা, তার উপর একটা অতি সাধারণ কুর্তা। মাথায় টুপিটি পর্যন্ত নেই, পায়ে চটি আছে কি না ঠিক ঠাহর হল না। সে কুর্তার সামনের দিকটার (পূর্বোল্লিখিত দামন বা অঞ্চল) দুই খুঁট দুই হাত দিয়ে এগিয়ে ধরে তাতে সামলে রেখেছে পায়রাকে খাওয়াবার দানা। স্পষ্ট বোঝা গেল, এইমাত্র পাড়ার মুদির দোকান থেকে সে বেসাতিটা কিনে এনেছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে তার বুঝতে বিলম্ব হল না যে, হট্টগোলের উৎপাতে পায়রাগুলো উধাও হয়ে গিয়েছে। তখন তার খেয়াল গেল চতুর্দিকে ছুটোছুটি আর চেল্লাচেল্লির দিকে। সে কিন্তু নির্বিকার। আস্তে আস্তে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করতে লাগল– বাড়িটা যেন চাঁদনি চৌক।
এবারে বাইরে শোনা গেল এক পদস্থ অশ্বারোহীর কটুবাক্য আর তীব্র চিৎকার– ইনি অন্ততপক্ষে ফৌজদারই হবেন। ওরে সব না-মর্দ, বেওকুফ, বেকার নাকম্মার দল। এই এখখুনি বেরিয়ে আয়, কাম খতম করে। নইলে হজরত আলীর ঝাণ্ডার কসম খেয়ে বলছি, তোদের কিয়ামতের শেষ-বিচারের দিন এই লহমাতেই হাজির হবে। আল্লার গজব, আল্লার লানৎ তোদের ওপর, তোদের বা-বাচ্চার ওপর।
এই হুঁশিয়ারি, এই দিব্যিদিলাশা যেন তিলিস্মাৎ-ভানুমতীর কাজ করল।
দূতদের দুজনার দৃষ্টি হঠাৎ গেল সেই দামনে-দানা-ভরা বালকটির দিকে। লাফ দিয়ে পড়ল সেই দুই নরদানব তার উপর। এক ঝটকায় তাকে কাঁধে ফেলে দে-ছুট দে-ছুট দেউড়ির দিকে, দেউড়ি ছাড়িয়ে রাস্তা পেরিয়ে আল্লায় মালুম কোন দিকে! কী যে ঘটল কিছুই বোঝা গেল না। সঙ্গে সঙ্গে উঠল বামাকুলের আর্তনাদ ইয়াল্লা, এরা যে রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে গেল রে। ধরো, পাকড়ো ওদের। পাকড়ো পাকড়ো, জানে ন্ পায়, যেতে না পায় যেন! ইয়া রহমান, ইয়া রহিম।
কিন্তু কে ধরে তখন কাকে?
হারেমের মেয়েরা ভাবতেই পারেননি যে, রফি-উশ-শানের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র নাবালক বাচ্চা রফি-উদ্-দরজাকে ধরে এরা চম্পট দেবে। যতক্ষণ এরা জেনানা জঙ্গিলাট হয়ে সার্বভৌম মহম্মদ ইব্রাহিম আর মধ্যম রফি-উদ্-দৌলাকে পঞ্চত্ব, কমসেকম অন্ধত্ব থেকে রক্ষা করেছিলেন, ততক্ষণে, যার নিরাপত্তা সম্বন্ধে কোনও ভয়-ভীতি ছিল না, সেই সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা রফি-উদ্-দরজাৎকে নিয়ে দুশমন উধাও হয়ে গিয়েছে।
আজব সেই লড়াই তাজ্জবভাবে ফৌরন থেমে গেল। দোস্ত-দুশমন কোনও পক্ষের কেউ মারা গেল না, হার মানল না, সন্ধি করল না, ধরা দিল না– আচানক্ সবকুচহ্ বিলকুল ঠাণ্ডা!
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় দিওয়ান-ই-আম্ থেকে নহবখানা পর্যন্ত পাইচারির বদলে ছুটোছুটি আরম্ভ করেছেন। এঁরা বিস্তর লড়াই লড়েছেন, জীবন এঁদের বহুবার বিপন্ন হয়েছে, কিন্তু এবারে তারা যেরকম ঘেমে-নেয়ে কাঁই হয়ে গেলেন এরকমটা আর কখনও হননি। ক্রোধে, জিঘাংসায় তারা শুধু একে অন্যকে বলছেন, যে-কটা না-মর্দকে তারা পাঠিয়েছিলেন তাদের জ্যান্ত শরীর থেকে চামড়া তোলবার হুকুম দেবেন, নয় ফোঁটা ফোঁটা গরম তেল তাদের ব্রহ্মতালুতে ঢেলে ঢেলে নিধন করবেন।
এমন সময় সেই দুই পাহলোয়ান এসে উপস্থিত শাহজাদা রফি-উদ্-দরজাৎকে সঙ্গে নিয়ে।
শাহজাদা হোক আর ফকিরজাদাই হোক, সে কিন্তু পুঁটুলি পাকিয়ে দু হাত দিয়ে জোরে পাকড়ে আছে পায়রার দানা-ভর্তি তার কোঁচড়। এসব বাদশা-উজিরের ব্যাপার দিল্লি শহরে এখন আছে তো তখন নেই কিন্তু পায়রার দানা কটি পায়রার দানা, শাহজাদা মিয়া রফির কাছে এটা ভয়ঙ্কর সত্য।
ইতোমধ্যে সৈয়দ ভায়ারা হুঙ্কার দিয়ে উঠেছেন, কম্বৎ, না-দা– এ কাকে ধরে এনেছ তোমরা? বাদশা হবেন বড় ভাই, ধরে আনলে ছোটটাকে! তোমাদের জ্যান্ত না পুঁতলে–
সৈয়দদ্বয় তখন নাগরিক, ফৌজদার এমনকি তৈমুরের বংশধর, বাবুর-হুমায়ুনের পুত্র-পৌত্র বাদশাহ-সালামদের ও জান-মালের মালিক। এসব কথা দূত দুটি ভালো করেই জানে। কিন্তু আজকের আঁটার মার তাদের করে দিয়েছে বেপরোয়া। চরম বিরক্তি আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, যা পেয়েছেন তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হোন। আর আমাদের মারুন আর কাটুন, যা খুশি করুন।
দুই ভাই তাড়াতাড়িতে ব্যাপারটা জানতে পেরে বুঝলেন, এখন আবার নতুন করে পাইক-বরকন্দাজ পাঠিয়ে বড় দুই ভাইয়ের একজনকে তারা ইব্রাহিমের চেয়ে রফি-উদ-দৌলাকে পছন্দ করেছিলেন বেশি– ধরে আনাতে সময় লেগে যাবে বিস্তর। আজকের ভাষায় ততক্ষণ টাইম-বম্ ফেটে যাবে।
একে দিয়েই তা হলে কাজ চালিয়ে নিতে হবে। গত্যন্তর কী?
আর ও নিয়ে মাথা ঘামিয়েই-বা লাভ কী? ইব্রাহিমই হোক আর রফি-উদ্-দৌলাই হোক, যেই হোক, তাকে তো হতে হবে ওঁদের হাতেরই পুতুল। সে পুতুল তার মায়ের গর্ভ-ফ্যাক্টরি থেকে পয়লা চালানে বেরিয়েছে, না তেসরা কিস্তিতে তাতে কীই-বা যায় আসে? ফরাসি সম্রাটের চেয়েও সরল কণ্ঠে তখন তারা বলতে পারতেন, লে তা সে নু ভারতবর্ষ? সে তো আমরা দু ভাই! বাদশাহ যে কোনও গড়-ড্যাম আওরঙ্গজেব-বংশের গর্ভস্রাব।
নবীন রাজার অভিষেকের জন্য দুই ভ্রাতা তাঁর দুদিকে চলেছেন রাজার দুই বাহু ধরে। আল্লা জানেন, কার আদেশে তাঁর দুই বদ্ধমুঠি শিথিল করার ফলে এই এখন পায়রার দানা ঝরঝর করে দিওয়ান-ই-আমের পাথরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ল।
চতুর্দিকে সৈয়দদের মিত্র ও পরামর্শদাতা আমির-ওমরাহ তাদের মহামূল্যবান কিংখাবের পাগড়ি, শুভ্র মলমলের আঙ্গারাখা, তার ভিতর দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে নিচের সাচ্চা জরির বোনা সদরিয়ার সোনালি আভা, কোমরে কাশ্মিরের সর্বশ্রেষ্ঠ শাল দিয়ে তৈরি কোমরবন্ধ, তার বা দিকে গোঁজা জাতির মতো জামৃদর অস্ত্র, ডাইনে ঝুলছে দিমিশকের তলোয়ার খাপের উপর মুষ্টিতে বিচিত্র মণিমাণিক্যের জড়োয়া কাজ, পরনে সাটিনের পায়জামা, পায়ে জরির কাজ করা শুড়-তোলা সিলিমশাহি। উষ্ণীষে মুক্তোর সিরর্পেচ, বুকে মোতির হার, হাতে হীরের আংটি।
এদের ভিতর দিয়ে চলেছেন বাদশাহজাদা। পরনে নুনময়লা পাজামা, গায়ে মামুলি কুর্তা। ব্যস। পাঁচ লহমা পরে যিনি হবেন দিল্লিশুরো বা জগদীশুরো বা! এ যে জগদীশ্বরের কৌতুকবোধের চূড়ান্ত নিদর্শন।
সৈয়দদের একজন শাহজাদার মাথায় বসিয়ে দিলেন তাঁর আপন পাগড়ি মস্তকাভরণহীন অভিষেক কল্পনাতীত। সেই বিরাট সাইজের পাগড়ি শাহজাদার কানদুটো গিলে ফেলল। অন্য ভ্রাতা তাঁর মুক্তোর সাতলখা হার পরিয়ে দিলেন তাঁর গলায়। ময়লা কুর্তার উপর সে মালা দেখাল ঘোলা জলের উপর রাজহংস!
এবং রফি-উদ্-দরজাৎ এই বেশেই বসলেন– যা-তা সিংহাসনের উপর নয়– আসল ময়ূর-সিংহাসনের উপর। এ-ও আরেক রঙ্গ। কারণ সচরাচর মোগল বাদশারা বসতেন আটপৌরে সিংহাসনের উপর। ফররুখসিয়ারের অভিষেকের বাত্সরিক পরব না অন্য কোনও উপলক্ষে তোষাখানা থেকে আগের দিন ময়ূর-সিংহাসন আনানো হয়েছিল; সেটা তখনও তোষাখানায় ফেরত পাঠানো হয়নি বলে যেন কন্ট্রাস্টটা চরমে পৌঁছনোর জন্য পাজামা-কুর্তা পরে শ্ৰীযুত রফি বসলেন তারই উপর!
এর পরের ইতিহাস আরও চমকপ্রদ, আরও অচিন্ত্যনীয়। কিন্তু তার ভিতর খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে যাবেন, কিন্তু এরকম কৌতুকজনক বড়-কিছু একটা পাবেন না। আমি একেবারে কিছু পাইনি। শুধু খুন আর লড়াই। নৃশংস আর বীভৎস। আমি তাই বাকিটা সংক্ষেপেই বলি– নিতান্ত যারা ছোটগল্প পড়ার পরও শুধোন, তার পর কী হল? তাঁদের জন্য।
সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় শত্রুর শেষ রাখতে নেই বলে ফাঁসুড়ে পাঠিয়ে ফররুখসিয়ারকে খুন করালেন। এক বছরের ভিতরই ধরা পড়ল রফি-উদ-দরজাতের যক্ষ্মা। সে বছর যেতে না যেতেই তিনি মারা গেলেন। মারা যাওয়ার পূর্বে তিনি তার বড় ভাই রফি-উল-দৌলাকে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনিও ওই বৎসরই মারা গেলেন। তার পর বাদশা হলেন মুহম্মদ শাহ বাদশাহ। তিনি প্রায় ত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেন। ইতোমধ্যে সৈয়দ ভ্রাতাদের দুর্দিন ঘনিয়ে এল। একজন আততায়ীর ছুরিকাঘাতে নিহত হলেন, অন্যজন বন্দি অবস্থায় বিষপ্রয়োগবশত।
বস্তুত এ যুগের ইতিহাস পড়লে বার বার স্মরণে আসে :
রাজত্ব-বধূরে যে-ই করে আলিঙ্গন।
তীক্ষ্ণধার অসি পরে সে দেয় চুম্বন!
.