দ্বিজ

দ্বিজ

এই গত শারদীয়া বেতার জগতে কোষ্ঠীবিচার নামক একটি কথিকা এ-অধম নিবেদন করে। বিবরণটি ছিল সত্য ঘটনা অবলম্বনে বর্ণিত। তৎসত্ত্বেও আমার এক দোস্ত সেটি পড়ে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হন। আমি সবিনয় বললুম, ব্রাদার, এটা বরহ জলজ্যান্ত ঘটেছিল; আমাকে দুষছ কেন? তিনি বললেন, তুমি সেটি রসস্বরূপে প্রকাশ করতে চেয়েছ; সেক্ষেত্রে সত্যি-মিথ্যের কোনও অজুহাত নেই। একদম খাঁটি কথা। তাই এবারে কিন্তু যেটি নিবেদন করব সেটি পড়ে তিনি প্রসন্ন হবেন, এমত আশা করি, আর আপনারা পাঁচজন তো আছেনই! এই সুবাদে আরেকটি সামান্য বক্তব্য আমার আছে। হিন্দু-মুসলমান বাঙালি-অবাঙালি কাউকেই আমি বেদনা দিতে চাইনে। দিলে সেটা অজানিত এবং তার জন্যে এইবেলাই বে-কৈফিয়ত মাফ চেয়ে নিচ্ছি। কিন্তু আমার বক্তব্য দুষ্টবুদ্ধিজনিত ভ্রমাত্মক সপ্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত সেটি সংহরণ করতে আমি অক্ষম– এটা গুরুর আদেশ।

এদানির কিছু লোক আবার আমার কাছ থেকে প্রাচীন দিনের শান্তিনিকেতন সম্বন্ধে ভালোমন্দ শুনতে চান। আমি তাঁদের লুক্কায়িত বক্তব্যটিও বিলক্ষণ মালুম করতে পেরেছি; সেটি এই, যা বুড়োচ্ছ, দুদিন বাদেই ভীমরতি ধরবে এবং তখন হয়ে দাঁড়াবে একটি চৌকস লিটারারি বোর; যদ্যবধি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে সওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তোমার আপন কথা ধানাই-পানাই না করে আশ্রমের কথা কও, গুরুদেবের কথা কও ইত্যাদি।

তাই সই। দেশকাল ঠিক ঠিক রাখব। পাত্র ভিন্ন নামে ভিন্ন বেশে আত্মপ্রকাশ করবেন।

১৯২০/২১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কলেজ কোর্স খোলেন। ওই সময় গাঁধীজি সরকারি স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের গোলামি-তালিম বর্জন করতে আহ্বান জানান। ফলে ভারতের সর্বপ্রদেশ থেকে যেসব মেধাবী ছিল, গাঁধীজির বাণী গ্রহণ করল তারা, জমায়েত হল শান্তিনিকেতনে। আর এলেন কয়েকটি খাজা মাল, যারা বছরের পর বছর পৌনঃপুনিক দশমিকের পাইকিরি হিসাবে বেধড়ক ফেল মেরে যাচ্ছিলেন। অবশ্য এঁদের একজন বলেছিলেন, ওইস অ্যানসার বুক লিখেছিলুম, স্যার, যে এগজামিনার বলল এনকোর। তাইতে ফের একই পরীক্ষা দিতে হল। এঁদের মধ্যে আমার মতো গুণ্ডাপ্রকৃতির দু-চারটি কাবেল সন্তান ছিলেন।

ইতোমধ্যে এলেন বিশ্বনাথ তিরুমল রাও অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম্ থেকে। একে নিয়ে যখন দু দলে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল তখন ধরা পড়ল ইনি বরের পিসি, কনের মাসি। অর্থাৎ ইনি যেমন অনেকটা ইন্দ্রনাথের মতো অন্ধকার রাস্তায় স্যাডিস্ট ক্লাস-টিচারের মাথায় হঠাৎ কম্বল ফেলে তাকে কয়েক ঘা বসিয়ে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে এখানে চলে আসেন, ঠিক তেমনি কলাভবনে প্রবেশ করার পর দেখা গেল, তিনি একই হাতে পাঁচটা তুলি নাচাতে পারেন– যাদুকররা যেমন পাঁচটা বল নাচায়। স্কেচে ওস্তাদ, ফিনিশে তালেবর।

তদুপরি আরেকটি অতিশয় আশ্রমপ্রিয় সদগুণ তার ছিল, যার প্রসাদাৎ তিনি সর্বত্রই ককে পেতেন। উচ্চতায় যদ্যপি পাঁচ ফুট দুই, কিন্তু পেশিগুলো যেন মানওয়ারি জাহাজের দড়া দিয়ে তৈরি, এবং ফুটবল-চৌকস। বীরভূমের কাকরময় গ্রাউন্ডে ডজন খানেক আছাড় খেয়ে সর্বাঙ্গে রক্তলাঞ্ছন আঁকার পরও তিনি বুলেটবেগে ছুট লাগাতে কসুর করতেন না এবং হাসিমুখে। বিচক্ষণ জন সে হাসিতে নষ্টামির গোপন চিহ্ন দেখতে পেত।

আমাদের দোস্তি প্রথমদিন থেকেই। নাম যখন শুধালুম সেটা দ্রুতগতিতে দায়সারার মতো বলে নিয়ে জানাল, ওটা ভোলা নাম। আমার ডাকনাম চিন্নি। তোমার?

সীতু।

পরবর্তী যুগে চিন্নি, ওরফে মি. রাও, স্বৰ্গত শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দিল্লিতে কাজ করে। তার ভুলে ভর্তি অনর্গল বাঙলা কথার তুবড়িবাজি রাশভারী শ্যামাপ্রসাদের মুখেও কৌতুকহাস্য এনে দিত এবং বিশেষ করে ওই কারণেই তিনি চিন্নিকে মাত্রাধিক স্নেহ করতেন। চিনি উত্তম ইংরেজি বলতে পারত, কিন্তু তার বক্তব্য, দিল্লির মন্ত্রণালয়ই হোক আর ভুবনডাঙার ঝুরঝুরে চায়ের দোকানই হোক, সে তার শান্তিনিকেতনে শেখা বাঙলা ছাড়বে কেন? স্বয়ং গুরুদেবের সঙ্গে সে বাঙলায় কথা কইত নির্ভয়ে চারটিখানি কথা নয়, এবং শ্যামাপ্রসাদ এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করে, চিন্নির ডজন ডজন ভুল-ভর্তি বাঙলা সম্বন্ধে বলতেন, রাও কিন্তু তার বাঙলা প্রতিদিন ইমপ্রুভ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভুল বাড়ছে!

শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিত্ব রিজাইন দিলে পরে চিন্নিও তার জুতো থেকে দিল্লির ধুলো ঝেড়ে ফেলে মাদ্রাজ চলে যায়। সেখান থেকে ইউনেস্কোর আহ্বানে তাইল্যান্ড কলম্বো, জিনিভা, ওয়াশিংটন, বাগদাদে কীর্তিজাল বিস্তার করে।

সে যে দড়মালে তৈরি সেটা আশ্রমে তার আঠারো বছর বয়সেই ধরা পড়ে। সেখানে স্কুলের ছেলেরা দু বেলা উপাসনা করে, প্রস্তাব হল আমাদেরও করতে হবে। চিনি উচ্চকণ্ঠে জানিয়ে দিল সে নাস্তিক। ফৈসালা করার জন্য আমাদের মিটিং বসল। প্রিন্সিপাল মেসেজ পাঠালেন, তিনি চান, আমরা যেন উপাসনা করি। চিন্নি বলল, স্কুলের ছেলেদের বাপ-মা উপাসনার কথা জেনেশুনেই বাচ্চাদের এখানে পাঠিয়েছেন। আমাদের অধিকাংশই এসেছি তাদের অমতে (একথাটা খুবই খাঁটি; আমাদের গার্জেনদের অধিকাংশই ছিলেন সরকারি চাকুরে; তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনে সায় দেন কী প্রকারে? আমার পিতাকে তো ইংরেজ রীতিমতো ভয় দেখায়)। আমরা সাবালক; আমি নাস্তিক। চিন্নি পার্লামেন্টেরেনও বটে– তার দোস্ত মসোজিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল, তুমি তো ক্রিশ্চান; তোমার সর্ব প্রার্থনা পাঠাতে হয় প্রভু যিশুর মাধ্যমে। আশ্রমের উপাসনায় যোগ দেবে কী করে? আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো মিয়া ভাই (মুসলমান)! পাঁচবেকৎ নেমাজ করিস (করব বলে বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এসেছিলুম)। সভাপতির দিকে তাকিয়ে বলল, ওর ঘাড়ে আরও দুটো চাপানো কি ধর্মসম্মত? ইত্যাদি, ইত্যাদি। রেভারেন্ড অ্যানড্রজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সভাকে রাজি করাতে। পাদ্রিসাহেবের যাবতীয় স্কিল, তদুপরি তাঁর সরল আন্তরিকতা, তিনি সবকিছু প্রয়োগ করে খুব সুন্দর বক্তৃতা দেন। কিন্তু ভোটে চিন্নিপন্থিরা কয়েকটি ভোটে জিতে গেল। তখন সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হল, গুরুদেব যা আদেশ দেবেন তাই হবে। অ্যানদ্ভুজ সাহেবকেই আমরা দূত করে পাঠালুম।

গুরুদেব মাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করেন– না।

এই গেল চিন্নির পরিচয়।

ইতোমধ্যে আরেকটি ছেলে এল অন্ধ থেকে। মাধব রাও। সে-ও চমৎকার ফুটবল খেলে।

***

রাজ রাজমহেন্দ্ৰবরাম নগর– অর্থাৎ রাজমনড্রির শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও চিন্নির বন্ধু। তিনি চিন্নিদের বাড়ির ছেলের মতো। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ব্রাহ্মছাত্র অন্ধ্রদেশের শ্রীযুক্ত চালাময় গুরুদেবের প্রচুর কবিতা গল্প উপন্যাস এবং বিশেষ করে তাঁর ধর্ম সম্বন্ধীয় রচনা অনবদ্য তেলেগুতে অনুবাদ করেন। জগন্নাথ রাও সেগুলো পড়ে আকণ্ঠ রবীন্দ্রভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। চিন্নির আশ্ৰমাগমনের ফলে তাঁর আশ্রমদর্শনের সদিচ্ছা প্রবলতর হল। চিন্নিকে আকস্মিক আনন্দদানের উদ্দেশ্যে তাকে কোনওপ্রকারের নোটিশ না দিয়ে শুধু চিন্নির পিতামাতাকে জানিয়ে এক শুভপ্রাতে রওনা দিলেন কলকাতা অভিমুখে।

কলকাতায় উঠলেন বড়বাজার অঞ্চলে এক অন্ধ মেসে। সেখানে শুধোলেন, শান্তিনিকেতন কী প্রকারে যেতে হয়? কেউ কিছু জানে না বলে টাইমটেবল জোগাড় করা হল– সেখানেও শান্তিনিকেতনের সন্ধান নেই। তখন একজন বলল, কাছেই তো পোয়েটের বাড়ি; সেখানে গেলেই জানা যাবে। শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও তাই করলেন। সেখানে দেখেন বিশ্বভারতী পাবলিকেশন্স দফতর খোলা বটে, কিন্তু লোকজন কেউ নেই। শেষটায় একটি ছোকরা কেরানিকে আবিষ্কার করা হলে সে বলল, হাওড়া থেকে যেতে হয়, সে কখনও ওখানে যায়নি। যারা যাওয়া-আসা করেন, তারা সবাই গেছেন শোনে। শান্তিনিকেতনের কে এক মিস্টার রাও সেই ভোরে হাসপাতালে মারা গেছেন।

জগন্নাথ রাও ত্রিভুবন অন্ধকার দেখলেন। সম্বিতে ফিরে আর্তকণ্ঠে শুধোলেন, কে? ছোকরাটি বলল, বড়ই দুঃখের বিষয়। মিস্টার রাও আশ্রমের হয়ে ফুটবল খেলতে যান শিউড়িতে। সেখানে খেলাতে জোর চোট লাগার ফলে তারা হার্নিয়া স্ট্রেনগুলেটেড় হয়ে যায়। অ্যান্ড্রজ সাহেব এখানকার হাসপাতালকে জরুরি চিঠি লিখে লোকজনসহ তাঁকে পাঠান কাল রাত্রে। সবই করা হয়েছিল, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।

জগন্নাথ রাও টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। চিনি ওয়ালটেয়ারে আরেকবার এই রকম খেলার মাঠে বেহুঁশ হয়।

রাস্তা থেকে আবার ফিরে গেলেন ছোকরাটির কাছে। শুধোলেন, তার বাড়িতে তার পাঠানো হয়েছে? ছোকরাটি বলল সে জানে না।

জগন্নাথ রাও মেসে ফিরে এসে শয্যা নিলেন। দেশবাসীরা পরামর্শ করে তাঁর কথামতো চিন্নির বাড়িতে তার পাঠালেন দুঃসংবাদটা জানিয়ে।

জগন্নাথ রাওয়ের কোনওই ইচ্ছা আর রইল না শান্তিনিকেতন যাবার, কিন্তু তিনি পরিবারের বন্ধু এখন এতদূর কলকাতা অবধি এসে যদি সবিস্তার খবর নেবার জন্য সেখানে না যান তবে সবাই দুঃখিত হবেন।

নিতান্ত কর্তব্যের পীড়নে জগন্নাথ রাও হাওড়া গিয়ে, বোলপুরের ট্রেন ধরলেন।

বিকেলের দিকে যখন আশ্রমে পৌঁছলেন তখন গেস্ট হাউসে হিতলাল (বর্তমান কালোর দোকানের কালোর পিতা) ভিন্ন কেউ ছিল না–হিতলাল ইংরেজি জানে না। জগন্নাথ বিছানাপত্র সেখানে রেখে বেরুলেন কলাভবনের সন্ধানে। চিনি তাঁকে কলাভবনের ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখত।

সে কলাভবন বাড়ি আর নেই। তবে তার ভিতটা এখনও দেখতে পাওয়া যায়, গুরুদেবের দেহলী বাড়ির কাছে, বোলপুর যাবার রাস্তার পাশে।

কলাভবন সে সময়টায় নির্জন থাকে। নিচের তলায় কাউকে না পেয়ে তিনি সিঁড়ি দিয়ে ল্যান্ডিঙে পৌঁছে সেখান থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন—

আমি যাচ্ছিলুম বোলপুর নস্যি কিনতে; হঠাৎ শুনি, সেই অবেলায় কলাভবনে শোরগোল, স্পস্ট চিনতে পেলুম আর্টিস্ট রমেন চক্রবর্তীর গম্ভীর গলা। কিন্তু আর্ত কন্ঠে… তুমি যাও, শিগগির যাও, জল নিয়ে এস। আমি ততক্ষণে দেখছি–

তিন লক্ষে সেখানে পৌঁছে দেখি, চিন্নি দেহলী বাড়ির দিকে কালবোশেখী বেগে ছুটেছে। আমি সেদিকে খেয়াল না করে সিঁড়ি বেয়ে মাঝখানে উঠে দেখি কে একজন লোক দু-পা ইয়া ফাঁক আর দু-হাত ইয়া লম্বা করে ধূলি-শয়নে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। জোয়ারের সমুদ্র বেলাতটকে মড়া ফিরিয়ে দিলে সে যেরকম শুয়ে থাকে। ঠোঁটদুটো তার কাঁপছে, আর বিড়বিড় করে বলছে, চিন্নি, চিন্নি! চক্রবর্তী বললেন, সে আবার কী? তিনি বিশ্বনাথ রাওয়ের ডাকনাম জানতেন না। আমি বুঝিয়ে বললুম। চক্রবর্তী বললেন, দেখো তো সৈয়দ, ডাক্তার এসেছে কি না, বিকেলে তো মাঝে-সাঝে আসে। আমি বললুম, দেখি, মনে তো হচ্ছে ভিরমি কেটে যাচ্ছে।

খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখি, ওদের কেউই আর সেখানে নেই।

চিন্নি ভালো অভিনয় করতে জানে। রাত্রে তার ঘরে সে দেখাল জগন্নাথ রাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ তাকে দেখে সে আর চক্রবর্তী তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন– থমকে গিয়ে কাঁপতে লাগলেন। দু হাত দু দিকে দুটো হাঁটুর সঙ্গে একতালৈ মৃগী রুগির মতো কাঁপতে কাঁপতে ধপাস। চিন্নি বলল, অবশ্য আমার মুখেও জগন্নাথ বিস্ময় দেখতে পেয়েই ভয় পেয়েছিল আরও বেশি। ভাগ্যিস রমেনবাবু সঙ্গে ছিলেন! আমাকে ওই আবছায়া আলোতে একলা-একলি দেখতে পেলে তার কোনও সন্দেহ থাকত না যে, আমার ভূত কলাভবনের মায়া কাটাতে না পেরে সন্ধ্যার নির্জনে সেখানে আবার এসেছে।

হঠাৎ দেখি জগন্নাথ রাওয়ের মুখ এক্কেবারে রক্তহীন, মাছের পেটের মতো পাঁশুটে হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে যা বললেন তা শুনে রমেনবাবুর মতো ঠাণ্ডা মাথা স্থিরবুদ্ধির লোক পর্যন্ত অচল দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণে জগন্নাথের খেয়াল গেছে যে, তিনি চিন্নির বাপ-মাকে তার করে জানিয়ে বসে আছেন যে, চিন্নি নেই।

আমি তেড়ে বললুম, আপনি তো আচ্ছা– নেভার মাইন্ড!–রাও তো আপনাদের দেশে প্রত্যেক সেকেন্ড ইডিয়ম।

জগন্নাথ বার বার বলেন, চিন্নি তো আমায় জানায়নি যে আরেকজন অন্ধ্রবাসী এসেছে। তার ওপর ফুটবল, তার পর পেটে

রমেনবাবু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ওহে! এতক্ষণ তো খুব রগড় করলে! শোন, ব্যাপারটা সিরিয়াস! অ্যান্ড্রজ সাহেবের কাছে যাও। আর কারও টেলিগ্রাম বাপ-মা বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। গুরুদেব তো বার্লিনে!

সাহেব মোটেই চটলেন না। নাস্তিক চিন্নির জন্য খাঁটি খ্রিস্টান ছ পাতা লম্বা তার করলেন সব বুঝিয়ে। আর আমি চিন্নিকে তাঁর সামনেই বললুম, এবার প্রার্থনা করোগে, বাড়িতে যেন ভালো-মন্দ কিছু একটা না হয়। দুই অন্ধ ভাইজ্যাগ বাগের ট্রেন ধরলেন।

চিন্নি ফোককে ছুটি মেরে হপ্তা তিনেক পরে ফিরল। আমরা শুধালুম, কী, আপন ছেরাদ্দ সাপটাবার মতো ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলি তো? হুঁকোটা লে, খুলে ক!

চিন্নি বলল, টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল দেরিতে। ইতোমধ্যে দাদাকে আনানো হয়েছে মাদ্রাজ থেকে। বাড়িতে কান্নাকাটি সে আর কি বলতে অবশ্য আমার শোনা কথা। যেদিন তার পৌঁছল সেদিন বামুন এসেছে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে। আর ট্র্যাজেডিটা দেখ, বাড়িসুদ্ধ সবাই শোকে এমনি বিকল যে, কে একজন তারটা সই করে নিয়ে একপাশে রেখে দিয়েছে, ঘণ্টা দুই কেউ খোলেনি, ভেবেছে, কী আর হবে কন্ডলেন্স্ টেস্। খুলেছিল শেষটায় আমার ছোট ভাই। সে-ও নাকি প্রায় ওই জগন্নাথ রাওয়ের মতো পাঙাশ মেরে রাম ইডিয়টের মতো গা-গা ডাক ছেড়েছিল। বাকিরা ভাবল, আবার কে মরল? তার পর কেউ বিশ্বাস করে না তারটাকে, যদিও সবাই করতে চায়। অ্যানড্রজ সাহেব এত বিখ্যাত লোক, তিনি আমাদের চিন্নিটার জন্য ইত্যাদি…।

শেষটায় বিশ্বাস করেছিলেন বটে, কিন্তু আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত কারও কারও মনের ধোকা কাটেনি।

রাত্রে ছাতের উপর পাশাপাশি শুয়ে আছি দুজনাতে। আমি বললুম, চিন্নি, ঘুমুলি?

না।

আর তোর মা?

বিশ্বাস করবিনে, সেটা ভারি ইনট্রেটিং। জগন্নাথ রাওয়ের তার পৌঁছানোর পর থেকেই মায়ের মুখে শুধু এক বুলি, কিছুতেই হতে পারে না। আমার ছেলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। এই তো বছরের পয়লা দিনে আমি গণকার ঠাকুরকে ফি-বছরের মতো এবারও সবকটা ছেলের কোষ্ঠী দেখিয়েছি। তিনি এবারও বলেছেন, চিন্নির সামনে ফড়াটি পর্যন্ত নেই। 

চিন্নি বলল, যখন পুরুতঠাকুর শ্রদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছে তখনও তার মুখে ওই এক বুলি, কী হবে এসব ব্যবস্থা করে? গণকার বলেছে, এ বছরে চিন্নির জ্বর-জ্বালাটি পর্যন্ত নেই। 

কে তাঁর সঙ্গে কথাকাটাকাটি করে বোঝাবে চিনি নেই?

 আর শ্রাদ্ধে যা টাকা খরচা হওয়ার কথা ছিল সেটা মা দিয়েছে গণৎকারকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *