বুড়ো-বুড়ি
চিঠি নাকি, বাবাজি আজান?
বিলক্ষণ, মসিয়ো… প্যারিস থেকে এসেছে।
চিঠিখানি যে খুদ প্যারিস থেকে এসেছে তাই নিয়ে সাদা-দিল্ বাবাজি আজানের চিত্তে রীতিমতো দেমাক।… কিন্তু আমার না। কে যেন আমায় বলে দিচ্ছিল, এই যে অ্যা জাহ্ন রুশো সরণির প্যারিসিনী বলা নেই কওয়া নেই, সাত সকালে হঠাৎ আমার টেবিলের উপর এসে অবতীর্ণ হলেন, ইনি আমার পুরো দিনটারই সর্বনাশ করবেন। ঠিক। ভুল করিনি; বিশ্বেস না হয় দেখুন :
আমার একটু উপকার করতে হবে, দোস্ত। তোকে একদিনের তরে তোর ময়দা-কল বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে এইগুইয়ের যেতে হবে… এইগুইয়ের বড় গগ্রাম, তোর ওখান থেকে পাঁচ ছ কোশ কিছু না, বেড়াতে বেড়াতে পৌঁছে যাবি। পৌঁছে অনাথাশ্রমের খোঁজ নিবি। আশ্রমের ঠিক পরের বাড়িটা একটু নিচু, জানালা-খড়খড়ি ছাই-রঙা, বাড়ির পিছনভাগে একটুখানি বাগান। কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়বি– দরজা হামেহাল খোলা থাকে আর ঘরে ঢুকেই আচ্ছা জোরসে চেঁচিয়ে বলবি, সজ্জনদের পেন্নাম জানাই! অমি মরিসের বন্ধু… তখন দেখতে পাবি একমুঠো সাইজের ছোট্ট একজোড়া বুড়ো-বুড়ি, ওহ! সে কী বুড়ো! বুড়ো, তার চেয়েও বুড়ো, আদ্যিকালের বুড়ো-বুড়ি তাদের বিরাট আরামকেদারার গর্ত থেকে তোর দিকে হাত তুলে ধরবেন, আর তুই তখন তাদের আমার হয়ে আলিঙ্গন করবি, চুমো খাবি, তোর সর্বহৃদয় দিয়ে, যেন ওঁরা তোরই। তার পর সবাই মিলে গাল-গল্প আরম্ভ হবে; ওঁনারা সুদু আমার সম্বন্ধেই কথা কইবেন, আর কিছুটি না, সুদু আমার কথা; হাজার হাজার আবোল তাবোল বকে যাবেন, তুই কিন্তু হাসবিনি… হাসবিনি কিন্তু বুঝেছিস?… এরা আমার ঠাকুদ্দা, ঠাকুমা, ওঁদের আগাপাশতলা প্রাণ একমাত্র আমি এবং আমাকে দশ বছর হল দেখেননি… দশ বছর– দীর্ঘকাল! কিন্তু কী করি বল! আমি– প্যারিস আমাকে জাবড়ে ধরে আছে; ওঁদের? ওঁদের আটকে রেখেছে বুড়ো বয়স… এদের যা বয়স, আমাকে দেখবার জন্য রওনা হলে পথিমধ্যে চালানি মালের মতো টুকরো টুকরো হয়ে যাবেন… কিন্তু আমার কপাল ভালো, তুই তো ভাই, হোথায় আছিস, বেরাদর আমার, ময়দাকলের মালিক তোকে আদর-প্যার করে বেচারি বুড়ো-বুড়িরা আনন্দ পাবে, যেন আমারই এ্যাটুখানিকে চুমো-চামা খাচ্ছে.. আমি অনেকবার আমাদের কথা ওঁদের বলেছি, এবং আমাদের গভীর বন্ধুত্ব সম্বন্ধেও, যেটি কি না…
জাহান্নামে যাক বন্ধুত্ব! ঠিক আজকের সকালটাতেই আবহাওয়াটি হয়েছে চমৎকার, কিন্তু বাউণ্ডুলের মতো যত্র-তত্র চর্কিবাজি খাওয়ার মতো আদপেই নয়। একে তো বইছে জোর হাওয়া, তদুপরি রৌদ্রটিও চড়চড়ে কড়া–প্রভাস অঞ্চলের খাঁটি দিন যাকে বলে। আমি ঠিক করে বসেছিলুম, দুটি পাহাড়ের ঢিপির মধ্যিখানে শুয়ে শুয়ে সমস্ত দিনটা কাটিয়ে দেব হুবহু একটি গিরগিটির মতো, সূর্যালোক পান করতে করতে আর পাইনগাছের মর্মরগান শুনতে শুনতে– এমন সময় এল ওই লক্ষ্মীছাড়া চিঠিটা… কিন্তু করা যায় কী কও? মিটা বন্ধ করলুম অভিসম্পাত দিতে দিতে, চাবিটা রেখে দিলুম বেড়ালটার আসা-যাওয়ার ছোট্ট গর্তটার ভিতর। লাঠিটা, পাইপটি ব্যস্, নাবলুম রাস্তায়।
বেলা প্রায় দুটোর সময় পৌঁছলুম এইগুইয়েরে। গা-টা খাঁ খাঁ করছে, সবাই খেত-খামারে। ধুলোয় ঢাকা এলমগাছে ঝিল্লি ঝি ঝি করছে যেন নির্জন খোলামাঠের মধ্যিখানে। অবশ্য সরকারি বাড়িটার সামনের চত্বরে একটা গাধা রোদ পোয়াচ্ছিল বটে, আর গির্জের সামনের ফোয়ারায় একপাল পায়রাও ছিল, কিন্তু অনাথাশ্রমটি দেখিয়ে দেবার মতো কেউই ছিল না। কিন্তু কপাল ভালো, হঠাৎ আমার সামনে যেন পরীর মতো আত্মপ্রকাশ করল এক বুড়ি। ঘরের সামনের এক কোণে উবু হয়ে বসে চরকা কাটছিল। শুধালুম তাকে। আর পরীটিরও ছিল দৈবীশক্তি। কড়ে আঙুলটি তুলে দেখাতে না-দেখাতে তৎক্ষণাৎ চোখের সামনে যেন মন্ত্রবলে আমারই সামনে দাঁড়িয়ে উঠল অনাথাশ্রমটি!… বিরাট, ভারিক্কি, কালো কুঠিবাড়ি। বেশ দেমাকের সঙ্গে তার দেউড়ির উপরের পাঁশুটে লাল রঙের প্রাচীন দিনের ক্রুশ–চতুর্দিকে আবার দু ছত্তর লাতিনও দেখিয়ে দিচ্ছে। ওই বাড়িটার পাশেই দেখতে পেলুম আরেকটি ছোট্ট বাড়ি। ছাইরঙের খড়খড়ি, পিছনে ছোট্ট বাগানটি… তদ্দণ্ডেই চিনে গেলুম, কড়া না নেড়েই ঢুকে পড়লুম।
আমার বাকি জীবন ধরে আমি সেই দীর্ঘ করিডরটি দেখব; মন্দ-মধুর ঠাণ্ডা, শান্ত-প্রশান্ত, দেয়ালগুলো গোলাপি রঙের, খড়খড়ির ভিতর দিয়ে দেখি বাগানটি যেন স্বচ্ছ রৌদ্রালোকে অল্প অল্প কাঁপছে, আর সার্সিগুলোর উপর ফুলপাতায় জড়ানো বেহালার ছবি আঁকা। আমার মনে হল আমি সেদে যুগের প্রাচীন সম্রান্ত দরবারখানায় পৌঁছে গিয়েছি।… করিডরের শেষপ্রান্তে, ডানদিকে, আধ-ভেজানো দরজার ভিতর দিয়ে আসছে দেয়ালঘড়ির টিক-টাক শব্দ, আর একটি শিশু স্কুলের বাচ্চার গলার শব্দে প্রতি শব্দে থেমে থেমে পড়ছে : তখন…সেন্ট…ইরেনে…চিকা…র…করে…বললেন…আমি…প্রভুর…যেন… গম..শস্য… আমাকে…ময়দা…হতে…হয়ে …ওই…সব…পশুদের…দাঁতের…পিষণে…। আমি ধীরে ধীরে মৃদু পদে সেই দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভিতরের দিকে তাকালুম।
শান্ত, অর্ধ দিবালোকে, ছোট্ট একটি কামরার ভিতর, গভীর একটা আরাম কেদারার ভিতর ঘুমুচ্ছেন এক অতি বৃদ্ধ। গোলাপি ছোট্ট দুটি গাল, আঙুলের ডগা অবধি সর্বশরীরের চামড়া কোঁচকানো, মুখ খোলা, হাত দুটি দুজানুর উপর পাতা। তাঁর পায়ের কাছে নীল পোশাক পরা ছোট্ট একটি মেয়ে মাথায় নাদের মতো টুপি, অনাথাশ্রমের মেয়েদের পোশাক পরা– সাধ্বী ইরেনের জীবনী পড়ছে– বইখানা আকারে তার চাইতেও বড়। এই অলৌকিক পুরাণপাঠ যেন সমস্ত বাড়িটার ওপর ক্রিয়া চালিয়েছে। বৃদ্ধ ঘুমুচ্ছেন তাঁর আরামকেদারায়, মাছিগুলো ছাতে, ক্যানারি পাখিগুলো এই হোথায় জানালার উপরে তাদের খাঁচায়। প্রকাণ্ড দেয়ালঘড়িটা নাক ডাকাচ্ছে– টি, টাক, টিক্ টা। সমস্ত ঘরটাতে কেউই জেগে নেই–সুন্দুমাত্র খড়খড়ির ভিতর যে একফালি সাদা সোজা আলো এসে পড়েছে তার ভিতর ভর্তি জীবন্ত রশ্মি-কণা– তারা নাচছে তাদের পরমাণু নৃত্যের চক্রাকারের ওয়ালট… এই ঘরজোড়া তন্দ্রালসের মাঝখানে সেই মেয়েটি গম্ভীর কণ্ঠে পড়ে যাচ্ছে : সঙ্গে… সঙ্গে… দুটো… সিংহ… লাফ… দিয়ে… পড়ল… তার… উপর… এবং তাঁকে… উদর… সাৎ.. করে… ফেলল… ঠিক ওই মুহূর্তেই আমি ঘরে ঢুকলুম। স্বয়ং সেন্ট ইরেনের সিংহদুটোও ওই সময়ে সে-ঘরে ঢুকলে এতখানি বিহ্বলতার স্তম্ভন সৃষ্টি করতে পারত না। সে-যেন রীতিমতো নাটকীয় আচমকা আবির্ভাব! বাচ্চাটা ডুকরে উঠল, বিরাট কেতাবখানা পড়ে গেল, ক্যানারিপাখিগুলো জেগে উঠল, দেয়ালঘড়িটা ঢং ঢং করে উঠল, বুড়ো প্রায় লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন– একেবারে হকচকিয়ে গেছেন– আর আমিও কেমন যেন বোকা বনে গিয়ে চৌকাঠে থমকে গিয়ে বেশ একটু জোর গলায় বলে উঠলুম : সুপ্রভাত, সজ্জনগণ! আমি মরিসের বন্ধু!
আহা! আপনারা যদি তখন তাঁকে দেখতে পেতেন– যদি দেখতে পেতেন, বেচারি বুড়োকে দেখতে পেতেন! দুই বাহু প্রসারিত করে আমাকে আলিঙ্গন করতে, আমার হাত দুখানা ধরে ঝাঁকুনি দিতে এগিয়ে এলেন, আর ঘরময় উত্তেজিত হয়ে ছুটোছুটি লাগিয়ে শুধু বলন,
হে দয়াময়, হে দয়াময়!…
তার মুখের সব কোচকানো চামড়া হাসিতে ভরে উঠেছে। আর তোতলাচ্ছেন,
আ মসিয়ো… আ মসিয়ো…
তার পর কামরার শেষ প্রান্তে ডাক দিতে দিতে গেলেন :
মামেৎ!
একটা দরজা খুলে গেল। করিডরে যেন একটা ইঁদুরের পায়ের শব্দ শোনা গেল… ওই যে মামেৎ! ওই একফোঁটা বুড়ি– কী যে সুন্দর দেখাচ্ছিল– মাথায় গিঁট বাঁধানো বনেট, পরনে কারমেলিট নাদের ফিকে বাদামি রঙের পোশাক, হাতে নকশাকাটা রুমাল আমাকে সেই প্রাচীনদিনের কায়দায় অভিনন্দন জানাবার জন্যে…ওঁদের দেখলেই কিন্তু বুকটা দরদে ভরে আসে, দুজনারই চেহারা একই রকমের! বুড়োর মাথার চুল বদলে দিয়ে বুড়ির বনে তাঁর মাথায় পরিয়ে দিলে তাকেও মামেৎ নাম দেওয়া যেত!… শুধু সত্যিকার মামেকে নিশ্চয়ই তাঁর জীবনে চোখের জল ফেলতে হয়েছে অনেক বেশি, আর তার সর্বাঙ্গের চামড়া কুঁকড়ে গিয়েছে আরও বেশি। বুড়োর মতো ওঁরও সঙ্গে অনাথাশ্রমের একটি ছোট্ট মেয়ে, পরনে অন্য মেয়েটার মতোই পোশাক, বুড়ির সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকে, কখনও তাঁর সঙ্গ ছাড়ে না– অনাথাশ্রমে আশ্রয়প্রাপ্ত দুটি বাচ্চা মেয়ে এই দুই
বুড়ো-বুড়িকে যেন আশ্রয় দিয়ে রক্ষণ করছে– এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী যেন আর কিছুই। কল্পনা করা যায় না।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বুড়ি আমাকে গভীর সম্মান-অভিবাদন জানাতে আরম্ভ করছিলেন, কিন্তু বুড়ো একটি শব্দ দিয়েই তার সসম্মান-অভিবাদন কেটে দু-টুকরো করে ফেললেন :
এ তো মরিসের বন্ধু…
সঙ্গে সঙ্গে বুড়ি কাঁপতে লাগলেন, কেঁদে ফেললেন, রুমালখানা হারিয়ে ফেললেন, মুখ রাঙা হয়ে গেল, টকটকে লাল, বুড়োর চেয়েও বেশি লাল… হায়, বুড়ো-বুড়ি! এঁদের সর্ব শিরায় আছে মাত্র একটি ফোঁটা রক্ত, আর সামান্যতম অনুভূতির পরশ লাগলেই সেই ফোঁটাটি মুখে এসে পৌঁছে যায়।
শিগগির, শিগগির চেয়ার নিয়ে এস… বুড়ি তার বাচ্চাটিকে বললেন।
জানালাটা খুলে দাও– বুড়ো তার বাচ্চাটিকে হুকুম দিলেন।
তার পর দুজনাতে আমার দু বাহু ধরে খুট খুট করে হেঁটে নিয়ে চললেন জানালার কাছে। সেটা পুরো খুলে দেওয়া হয়েছে যাতে করে ওঁরা আমাকে আরও ভালো করে দেখতে পান। আমরা এগিয়ে গেলুম আরামকেদারার কাছে। আমি বসলুম তাঁদের দুজনার মাঝখানে চেয়ারে। মেয়ে দুটি আমাদের পিছনে। তার পর আরম্ভ হল সওয়াল :
কী রকম আছে সে? কী করে সে? এখানে আসে না কেন? সুখে আছে তো?…
এটা, ওটা, সেটা–কত শত কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
আর আমি? তারা আমার বন্ধুবাবদে যেসব প্রশ্ন শুধোচ্ছিলেন সেগুলোর উত্তর আমার সর্বশ্রেষ্ঠ সাধ্যমতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তো দিলুমই– যেগুলো জানা ছিল; আর যেগুলো জানা ছিল না সেগুলো নির্লজ্জভাবে বানিয়ে বানিয়ে। আর বিশেষভাবে অবশ্যই কিছুতেই স্বীকার করলুম না যে, তার ঘরের জানালাগুলো ঠিকমতো বন্ধ হয় কি না সেটা যে আমি লক্ষ করিনি, কিংবা তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের!
তার ঘরের দেয়ালের কাগজগুলো কোন রঙের?… নীল রঙের ঠাকুমা, হালকা নীল– আসমানি রঙের ফুলের মালার ছবি আঁকা।…
–তাই না? বুড়ি একবারে গদগদ। তার পর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সোনার চাঁদ ছেলেটি!
বুড়ো সোৎসাহে যোগ দিলেন, সোনার চাঁদ ছেলে।
আর আমি যতক্ষণ কথা বলছিলুম, তারা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ক্ষণে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাচ্ছিলেন, ক্ষণে সামান্য স্মিতহাস্য করছিলেন, ক্ষণে চোখে চোখে ঠার মারছিলেন, ক্ষণে একে অন্যকে ঠিক ঠিক বুঝতে পারার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কিংবা বুড়ো আমার একটু কাছে এসে আমায় বলেন,
আরেকটু জোরে কও… ভালো করে শুনতে পায় না ও।
আর উনিও, আরেকটু চেঁচিয়ে লক্ষ্মীটি!… উনি সবকথা ভালো করে শুনতে পান না…
আমি তখন গলাটা একটু চড়াই; দুজনাই তখন একটুখানি স্মিতহাস্যে আমাকে ধন্যবাদ জানান। আর তাঁদের সেই হালকা ফিকে স্মিতহাস্যভরা দৃষ্টি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে তারা যেন আমার চোখের নিভৃততম গভীরে খুঁজে দেখবার চেষ্টা করেন তাঁদের মরিসের ছবি; আর আমার হৃদয়ও যেন আমার বন্ধুর ছবি তাঁদের চোখে দেখে একেবারে গলে যায়– আবছা-আবছা, ঘোমটা-ঢাকা। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, যেন অনেক দূরের থেকে, কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।
***
হঠাৎ বুড়ো তাঁর আরামকেদারার গভীর থেকে হকচকিয়ে উঠলেন :
আমার কী মনে পড়ল, মামেৎ.. সে বোধহয় এখনও দুপুরের খাবার খায়নি!
আর মামেৎ আর্ত হয়ে শূন্যে তুলে দিয়েছেন হাত দু খানা :
এখনও খায়নি!… হে দয়াময়, হে ভগবান!
আমি ভাবলুম, এখনও বুঝি মরিসের কথাই হচ্ছে; তাই তাঁদের বললুম যে, তাঁদের যাদু মরিস দুপুর হতে না হতেই খানার টেবিলে বসে যায় তার চেয়ে দেরি সে কস্মিনকালেও করে না। কিন্তু না, এবারে উঠেছে আমার কথা। আর আমি যখন স্বীকার করলুম যে আমি তখনও খাইনি, তখন যে ধুন্দুমার আরম্ভ হল সেটা সত্যি দেখবার মতো।
শিগগির শিগগির নিয়ে এস। ছুরি-কাঁটা সব– ও বাচ্চারা! টেবিলটা ঘরের মধ্যিখানে নিয়ে এস। রবারের টেবিলক্লথ, ফুলেল নকশাদার বাসন-প্লেটগুলো! আর অত হাসাহাসি না করলেও আমাদের চলবে, বুঝলে! আর জলদি, জলদি প্লিজ!
আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই, তারা জলদি জলদিই করেছিল! তিনখানা পেলেট ভাঙতে যতখানি সময় লাগার কথা তার পূর্বেই টেবিল, খাবার-দাবার, সব তৈরি।
সামান্য একটু ভালো-মন্দ নাশতা বই আর কিছু নয়–আমাকে টেবিলের দিকে নিয়ে যেতে যেতে মামেৎ বললেন। শুধু তোমাকে একলা-একলিই খেতে হবে। আমরা? আমরা সকালবেলাই খেয়ে নিয়েছি।
বেচারা বুড়ো-বুড়ি! যে কোনও সময়েই ওঁদের শুধোও না কেন, ওঁদের সবসময়েই ওই এক উত্তর, তাঁরা সকাল সকালই খেয়ে নিয়েছেন।
মামেতের দেওয়া নাশতা– দুধ, খেজুর আর একখানা আস্ত পাই; ওই দিয়ে কিন্তু মামে আর তার ক্যানারিপাখিগুলোর নিদেন আটদিনের খাওয়া-দাওয়া চলে যায়… তাই ভাবো দিকিনি, আমি একাই তাবৎ মালের শেষ কণাটুকু খেয়ে ফেললুম!… আর টেবিলের চতুর্দিকে সে কী কেলেঙ্কারি! ক্ষুদে দুই নীলাম্বরী একে অন্যকে কনুইয়ের গুতো মেরে ফিসূফিস্ করছিল, আর খাঁচার ভিতরে ক্যানারিগুলোর ভাব, যেন মনে মনে বলছে, দেখেছ! এ কেমন ভদ্রলোক। গোটা পাইটাই খেয়ে ফেলল!
কথাটা সত্যি। আমি প্রায় সমস্তটাই বেখেয়ালে খেয়ে ফেলেছি– কারণ আমি তখন ওই শান্ত শীতল ঘরটার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখছি সেখানে কেমন যেন প্রাচীন দিনের সৌরভ ভাসছিল… বিশেষ করে দুটি ছোট্ট খাট থেকে আমি আমার চোখ কিছুতেই ফেরাতে পারছিলুম না। প্রায় যেন ছোট্ট দুটি শিশুদের দোলনা। আমি কল্পনা করতে লাগলুম সকালে, অতি ভোরে বুড়ো-বুড়ি ঝালর-লাগানো পর্দাঘেরা খাটের গভীরে শুয়ে। ভোর তিনটে বাজল। ওইটেই সব বুড়ো-বুড়ির জেগে ওঠার সময়।
– ঘুমুচ্ছ, মামেৎ?
–না গো।
–কী বল, মরিস ছেলেটি বড় লক্ষ্মী না।
–সে আর বলতে, বড় লক্ষ্মী ছেলে!
আর সুদ্ধমাত্র একটির পাশে আরেকটি, বুড়ো-বুড়ির ছোট্ট দুটি খাট দেখে আমি ওদের দুজনার মধ্যে পুরোপুরি একটি কথাবার্তা কল্পনা করে নিলুম…
ইতোমধ্যে ঘরের অন্যপ্রান্তে, আলমারির সামনে একটা ভীষণ নাটকের অভিনয় চলছিল। ব্যাপারটা হয়েছে কী, ওই আলমারির সবচেয়ে উপরের থাকে রয়েছে এক বোয়াম লিক্যোর-ব্রান্ডিতে মজানো চেরি। এটা দশ বৎসর ধরে মরিসের জন্য অপেক্ষা করছে। এখন সেটাকে নামাতে হবে যাতে করে আমি এটার উন্মোচন-পর্ব সমাধা করতে পারি। মামেতের সর্ব অনুনয় উপেক্ষা করে বুড়ো স্বয়ং লেগে গেছেন সেটাকে পাওয়ার প্রচেষ্টায়। ভয়ে আড়ষ্ট বউ—আর উনি একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছেন সেটাকে পাড়তে… পাঠক, যেখানে আছ সেখান থেকেই ছবিটি দেখতে পাবে: বুড়ো কাঁপছেন, ঝুলে পড়ে লম্বা হবার চেষ্টা করছেন, ক্ষুদে নীলাম্বরী মেয়ে দুটি চেয়ারটাকে জাবড়ে ধরে আছে। পিছনে মামেৎ হাঁপাচ্ছেন– হাত দুটি দুদিকে মেলে ধরেছেন, আর এসব-কিছুর উপর ভাসছে মৃদু সুগন্ধি নেবুর সৌরভ খোলা আলমারির ভিতর থেকে, থাকে থাকে সাজানো কাপড়ের উঁই থেকে।
অবশেষে, অশেষ মেহন্নতের পর, সেই সুপ্রসিদ্ধ বোয়ামটি আলমারি থেকে বের করা হল, আর তার সঙ্গে টোলে টোলে ভর্তি একটি রুপোর মগ-পারা গেলাস মরিস যখন ছোট্ট ছিল সেই আমলের। গেলাসটি চেরি দিয়ে আমার জন্য কানায় কানায় ভর্তি করা হল; মরিস এই চেরি খেতে কতই না ভালোবাসত! চেরি আর ব্রান্ডি ভরতে ভরতে বুড়ো খুশ-খানা-সমঝদারের মতো আমার কানে কানে বললেন :
-বুঝলে হে, তোমার কপাল ভালোই বলতে হবে, হ্যাঁ, তোমার কথাই কইছি, এখন যা খাবে… আমার গিন্নিই এটি তৈরি করেছেন… খাসা জিনিস খাবে এখন।
হায়রে কপাল! ওঁর গিন্নি এটি তৈরি করেছেন সত্যি, কিন্তু চিনি দিতে গেছেন বেবাক ভুলে! তা আর কী করা যায় বলো! বুড়ো বয়সে কি আর মানুষের সবকিছু মনে থাকে! বেচারি মামে আমার, সত্যি বলতে কি তোমার চেরিগুলো অখাদ্যের একশেষ; হলে কী হয়, আমি চোখের পাতাটি পর্যন্ত না নাড়িয়ে তলানি অবধি সাফ করে দিলুম।
***
খাওয়া শেষ হওয়ার পর আমি উঠে দাঁড়ালুম ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্য। ওঁরা অবশ্যি সত্যই খুশি হতেন যদি আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতুম, যাতে করে ওঁরা লক্ষ্মী ছেলে মরিস সম্বন্ধে আরও কথা বলতে পারেন, কিন্তু বেলা তখন ঢলে পড়েছে, মিলটাও দূরে– বিদায় নিতেই হয়।
আমার সঙ্গে সঙ্গে বুড়োও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন।
–মামেৎ, আমার কোটটা!… আমি ওকে চতুর অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।
সত্যি বলতে কি, মামেৎ মনে মনে দ্বিধা বোধ করছিলেন, বেশ একটু শীত পড়েছে, এ সময় আমাকে চত্বর অবধি পৌঁছে দেওয়াটা ঠিক হবে কি না; কিন্তু সেটা মুখের ভাবে প্রকাশ করলেন না। শুধু শুনতে পেলুম, ঝিনুকের বোতামওলা, সোনালি নস্যি রঙের চমৎকার ফ্র-কোটটি পরিয়ে দিতে দিতে লক্ষ্মী ঠাকুরমাটি কর্তাকে নিচু গলায় শুধোলেন,
তোমার ফিরতে দেরি হবে না তো? কেমন?
বুড়ো একটু দুষ্টুমির মুচকি হাসি হেসে বললেন,
–হেঁ, হেঁ!…কী জানি…হয় তো বা…*[* যৌবনে যে ফুর্তিফার্তি করতে গিয়ে আর পাঁচজনের মতো মাঝে-মধ্যে দেরিতে বাড়িতে ফিরতেন, মামেৎ বকাঝকা করতেন, এটাতে ঠাট্টা করে তারই ইঙ্গিত।]
একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ওঁদের হাসতে দেখে বাচ্চা দুটি হাসল, আর খাঁচার কোণে বসে ক্যানারি দুটোও তাদের আপন ঢঙে হাসল… নিতান্ত তোমাকেই বলছি, পাঠক, আমার মনে সন্দ হয়, ওই চেরি-ব্রান্ডির গন্ধে ওরা সবাই বোধহয় একটুখানি বে-এক্তেয়ার হয়ে গিয়েছিলেন।
ঠাকুরদা আর আমি যখন রাস্তায় নামলুম তখন অন্ধকার হব-হব। একটু দূরের থেকে পিছনে পিছনে নীলপোশাকি ছোট্ট মেয়েটি আসছিল ওঁকে ফেরার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসবার জন্য বুড়ো ওকে দেখতেও পাননি। তিনি সগর্বে আমার বাহু ধরে চলছিলেন যেন কতই না শক্তসমর্থ মদ্দা জোয়ান। মামে ভরপুর হাসিমুখে দোরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলেন, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে খুশিতে মাথা নাড়ছিলেন যেন ভাবখানা এই যা-ই বলো, যা-ই কও, আমার বুড়া এখনও তো দিব্য চলাফেরা করতে পারে।*[*আলস্ দোদের শব্দে শব্দে অনুবাদ।]
.