দু-হারা

দু-হারা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে বরোদার বিখ্যাত মহারাজা সয়াজি রাওয়ের কাছে আমি চাকরি নিয়ে যাই। শহরের আকার ও লোকসংখ্যা গুজরাতের অন্যান্য শহরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু স্বাধীন রাজ্য বলে ছোটখাটো মিউজিয়াম, তোষাখানা, চিড়িয়াখানা, রাজপ্রাসাদ, পালপরবে গাওনা-বাজনা এবং আর পাঁচটা জিনিস ছিল বলে একদিক দিয়ে দেখতে গেলে পাশের ধনী শহর আহমদাবাদের তুলনায় এর আপন বৈশিষ্ট্য ছিল।

আজ আর আমার ঠিক মনে নেই, মহারাজা নিজে মদ না খেলেও তার কটি ছেলে দিবারাত্র বোতল সেবা করে করে বাপ-মায়ের চোখের সামনে মারা যান। ওঁদের মদ খাওয়া বন্ধ করার জন্য কিছুদিনের তরে তিনি তাবৎ বরোদা শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ড্রাই করে দেন, কিন্তু তাতেও কোনও ফলোদয় হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাকি ছিলেন একমাত্র ধৈর্যশীল রাও। একেও সাদা চোখে বড় একটা দেখা যেত না।

মহারাজার বড় ছেলের ছেলে–তিনিই তখন যুবরাজপ্রতাপসিং রাও-ও প্রচুর মদ্যপান করতেন– এ নিয়ে বুড়ো মহারাজার বড়ই দুঃখ ছিল কিন্তু নাতি তখনও দু কান কাটা হয়ে যাননি। রাজা হওয়ার পর তিনিও সম্পূর্ণ বেসামাল হয়ে গেলেন এবং ভারত স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর তিনি আকাট মূর্খ ইয়ারবক্সির প্ররোচনায় ভারতের সঙ্গে লড়াই করতে চেয়েছিলেন। তিনি গদিচ্যুত হওয়ার পর তার ছেলে ফতেহ্ সিং রাও মহারাজা উপাধি পান– এবং বর্তমান ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে সংযুক্ত বলে অনেকেই তাকে চেনেন। শুনেছি, মানুষ হিসেবে চমৎকার।

কিন্তু এসব অনেক পরের কথা।

বুড়া মহারাজার মদ্যের প্রতি অনীহা ছিল বলে বরোদা শহরে সংযমের পরিচয় পাওয়া যেত– বিশেষ করে যখন অন্যান্য নেটিভ স্টেটে মদ্যপানটাই সবচেয়ে বড় রাজকার্য বলে বিবেচনা করা হত, ও প্রজারাও যখন রাজাদর্শ অনুকরণে পরাজুখ ছিল না।

কিন্তু বুড়া মহারাজা বিস্তর বিলাতফেৰ্তা জোগাড় করেছিলেন বলে প্রায়ই কারও না কারও বাড়িতে পার্টি বসত। দু-এক জায়গায় যে মদ নিয়ে বাড়াবাড়ি হত না, সে কথা বলতে পারিনে। তবে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করত গৃহকর্তার আপন সংযমের ওপর।

এরই দু-একটা পার্টিতে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। ভুল বললুম, পরিচয় হয়। কারণ এরকম স্বল্পভাষী লোক আমি জীবনে কমই দেখেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি চুপ করে বসে থাকতেন একপাশে, এবং অতিশয় মনোযোগ সহকারে ধীরে ধীরে গেলাসের পর গেলাস নামিয়ে যেতেন। কিন্তু বানচাল হওয়া দূরে থাক, তাঁর চোখের পাতাটিও কখনও নড়তে দেখিনি। আমি জানতুম, ইনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছর দশেক পূর্বে ডক্টরেট পাস করে বরোদায় ফিরে এসে উচ্চতর পদে বহাল হন। আমিও বন্ থেকে বছর তিনেক পূর্বে পাস করে আসি ও তিনি যেসব গুরুর কাছে পড়াশোনা করেছিলেন, আমিও তাদের কয়েকজনের কাছে বিদ্যার্জন করার চেষ্টা করি। আমি তাই আশা করেছিলুম তিনি অন্তত আমার সঙ্গে দু-চারিটি কথা বলবেন–ব বিশ্ববিদ্যালয়, তার সহপাঠী, তার আমার উভয়ের শুরু, রাইন নদী, শহরের চতুর্দিকের বন-নদী-পাহাড়ের পিকনিক নিয়ে তিনি পুরনো দিনের স্মৃতি ঝালাবেন, নিদেন দু-একটা প্রশ্ন জিগ্যেস করবেন। আমি দু-তিনবার চেষ্টা দিয়ে দেখলুম, আমার পক্ষে তিনি বন্ থেকে পাস না করে উত্তর মেরু থেকে পাস করে থাকলে একই ফল হত। সাপের খোলসের মতো তিনি বন শহরের স্মৃতি কোন আঁস্তাকুড়ে নির্বিকার চিত্তে ফেলে এসেছেন। আমি আর তাঁকে ঘাটালুম না।

এরপর কার্যোপলক্ষে আমি এক-আধবার তাঁর দফতরে যাই। এক্ষেত্রেও তদ্বৎ। নিতান্ত প্রয়োজন হলে বলেন ইয়েস, নইলে জিভে ক্লোরোফরম মেখে নিয়ে নিশ্চুপ।

বাড়ি ফিরে এসে তার থিসিসখানা জোগাড় করে নিয়ে পড়লুম। অত্যুকৃষ্ট জর্মনে লেখা। নিশ্চয়ই কোনও জর্মনের সাহায্য নিয়ে। তা সে আমরা সবাই নিয়েছি এবং এখনও সর্ব অজর্মনই নিশ্চয়ই নেয়, কিন্তু ইনি পেয়েছিলেন সত্যকারের জউরির সাহায্য। তবে তিনি এখন কতখানি জর্মন বলতে এবং বুঝতে পড়তে পারেন তার হদিস পেলুম না। কারণ বরোদায় আসে অতি অল্প জর্মন, তারাও আবার ইংরেজি শেখার জন্য তৎপর। তদুপরি তৃতীয় ব্যক্তির সাক্ষাতে দেখা হলে এবং সে যদি জর্মন না জানে তবে তার অজানা ভাষায় কথা বলাটা বেয়াদবিও বটে। এতাবৎ হয়তো তাই শ্ৰীযুত কাণের সামনে জর্মন বলার কোনও অনিবার্য পরিস্থিতি উপস্থিত হয়নি।

এর পরে আরও দু বৎসর কেটে গেছে ওই একইভাবে। তবে ইতোমধ্যে আমার সর্বজ্ঞ বন্ধু পারসি অধ্যাপক সোহরাব ওয়াডিয়া আমাকে বললেন, আপন অন্তরঙ্গ জাতভাইদের সঙ্গে নিভৃতে তিনি নাকি জিভটাতে লুব্রিকেটিং তেল ঢেলে দেন এবং তখন তাঁর কথাবার্তা নাকি flows smoothly like oil. রসনার ওপর অন্যত্র তার সংযম অবিশ্বাস্য।

এই দু বছর কাটার পর আমার হাতে ফোকটে কিঞ্চিৎ অর্থ জমে যায়। দয়াময় জানেন সেটা আমার দোষ নয়। সে যুগে বরোদায় খরচ করতে চাইলেও খরচ করার উপায় ছিল না। ওদিকে জর্মনিতে হিটলারের নাচন-কুদন দেখে অন্তত আমার মনে কোনও সন্দেহ রইল না, তার ওয়াটস্ নাচ এবারে জর্মনির গণ্ডি ছাড়িয়ে বাইরেও গড়াবে। এবং সেটা আকছারই গড়ায় প্রতিবেশী ফ্রান্সের আঙিনায়। দুই দেশেই আমার বিস্তর বন্ধু। এইবেলা তা হলে তাদের শেষ দর্শনে যাই। ১৯১৮ সালে জর্মনরা আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে ও রণাঙ্গনে গ্যাসও চালায়। এবারে শুরুই হবে ওসব দিয়ে অনেক দূরপাল্লার বোমারু এবং জঙ্গিবিমান নিয়ে, তীব্রতর বিষাক্ত গ্যাস নিয়ে। ধুন্দুমার শেষ হলে আমার কজন বন্ধু যে আস্ত চামড়া নিয়ে বেরিয়ে আসবেন বলা কঠিন।

১৯৩৮-এর গরমিকালে ভেনিস মিলান হয়ে বন্ শহরে পৌঁছলুম। জাহাজে বিশেষ কিছু লক্ষ করবার ফুরসত পাইনি। প্রথমদিনেই আলাপ হয়ে যায় এক ফ্রেঞ্চ ইভোচায়নার তরুণীর সঙ্গে। অপূর্ব সুন্দরী। অপূর্ব বললুম ভেবেচিন্তেই। আমার নিজের বিশ্বাস এবং আমার সে-বিশ্বাসে আমার এক বিশৃপর্যটক বন্ধু সোসাহে সায় দেন– দোআঁসলা রমণীরা সৌন্দর্যে সবসময়ই খাঁটিকে হার মানায়। পার্টিশনের পরের কথা বলতে পারিনে, কিন্তু তার পূর্বে কলকাতার ইলিয়ট রোড, ম্যাকলাউড স্ট্রিটের যে অংশে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সুন্দরীদের হাট বসত- খারাপ অর্থে নেবেন না– সেরকমটা আমি প্যারিস-ভিয়েনা কোথাও দেখিনি।

কিন্তু এ তো গেল আর্যে আর্যে সংমিশ্রণ। কিন্তু ইভোচায়নায় ফ্রেঞ্চ আর্য রক্ত ও চীনা মঙ্গোলিয়ান রক্তে সংমিশ্রণ। এ জিনিস আমার কাছে অপূর্ব বলে মনে হয়েছিল। শুধু আমার কাছে নয়, অন্য অনেকেরই কাছে। কিন্তু হলে কী হয়, পানির দেবতা বদর পীর আমার প্রতি বড্ডই মেহেরবানি ধরেন– সপত্নদের কেউই একবর্ণ ফরাসি বলতে পারেন না। আমি যে অত্যুত্তম ফরাসি বলতে পারি তা-ও নয়। কিন্তু কথায় আছে, শয়তানও বিপদে পড়লে মাছি ধরে ধরে খায়। তরুণী যাবেন কোথায়! জাহাজে অবশ্য দু-একটি পাড় টুরিস্ট ছিলেন যারা ফরাসি জানেন, কিন্তু পাড় টুরিস্ট হতে সময় লাগে– বয়সটা ততদিন কিছু চুপ করে দাঁড়িয়ে যাত্রাগান দেখে না– পাঁড় টুরিস্ট হয় বুড়ো-হাবড়া। ওদিকে সুভাষিত আছে, বৃদ্ধার আলিঙ্গন অপেক্ষা তরুণীর পদাঘাত শ্রেয়।

প্রবাদটা উল্টো দিক থেকেও আকছারই খাটে। আমার তখন তরুণ বয়স, তদুপরি আমি বাঙলা দেশের লোক গায়ে বেশ কিছুটা চীনা-মঙ্গোল রক্ত আছে। তরুণীর সেটা ভারি পছন্দ হয়েছে– বলতেও কসুর করলেন না।

আমার তখন এমনই অবস্থা যে ওঁর সঙ্গে পৃথিবীর অন্য প্রান্ত অবধি যেতে পারি। অবশ্য জানি, পৃথিবীটা গোল আবার মোকামে ফিরে আসব নিশ্চয়ই, এই যা ভরসা।

ভেনিস পৌঁছে জানা গেল, এ জাহাজ পৃথিবীর অন্য প্রান্ত অবধি যায় না। ইনি শুধু মাকু মারেন ইতালি ও বোম্বাইয়ের মধ্যিখানে। আমাদের মধ্যে প্রেম হয়েছিল গভীর, কিন্তু ব্যাডমিন্টনের শাটল কক্ হতে যতখানি প্রেমের প্রয়োজন ততখানি তখনও হয়ে ওঠেনি। আসলে সবকিছু ভণ্ডুল হয়ে গিয়েছিল সফরটা তেরো দিনের ছিল বলে। তেরো সংখ্যাটা অপয়া। বারো কিংবা চোদ্দ দিনের হলে হয়তো একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যেত। ভেনিস বন্দরে সজল নয়নে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিলুম। আমার যেসব সপত্নরা (আজকের দিনের ভাষায় পুংসতীন) ফরাসি জানত না বলে বিফল মনোরথ হয়েছিল তাদের মুখে পরিতৃপ্তির স্মিতহাস্য ফুটে উঠেছিল। বিদ্যেসাগর মশাই নাকি মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলে উল্লাস বোধ করতেন; জানিনে তিনি কখনও এমন হাসি দেখেছেন কি না যেটা দেখলে মানুষের মাথায় খুন চাপে।

ব্রেন্নার পাস, অস্ট্রিয়া হয়ে জর্মনিতে ঢুকলুম। বন শহরে পৌঁছলুম সন্ধ্যার সময়।

বন প্রাচীন দিনের গলি-খুঁচির শহর। একে আমি আপন হাতের উল্টো পিঠের চেয়েও ভালো করে চিনি। মালপত্র হোটেলে নামিয়ে বেরিয়ে পড়লুম প্রাচীন দিনের সন্ধানে।

ওই তো সামনে হাসে রেস্তোরাঁ। দেখি তো, আমার দোস্ত বুড়ো ওয়েটার হাস্ এখনও টিকে আছে কি না। যেই না ঢোকা, হাসের সঙ্গে প্রায় হেড-অন্ কলিশন। বুড়ো হাস্ বাজিকর। দু হাতে সে একসঙ্গে পাঁচ প্লেট দু হাতে চার প্লেট, পঞ্চমটা এই চারটের মধ্যিখানে, উপরে সুপ রান্নাঘর থেকে খাবারঘরে তার চির প্রচলিত পদ্ধতিতে নিয়ে আসছিল। কোনওগতিকে সামলে নিয়ে হুঙ্কার দিল, ওই রে, আবার এসেছে সেই কালো শয়তানটা! আমি বললুম, তোর জান নিতে। হিটলার তোর জান নেবে–তুই ইহুদি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে সেই লোকটার কথা ভাবলুম, যে দুঃখ করে বলেছিল, হায় মা, টাক তো দিলি, কিন্তু ক-এর সঙ্গে আকারটা দিতে ভুলে গেলি। আমি বললুম, ইহুদির কালো চুল দিলি, মা, কিন্তু তার পকেটের রেস্তটা দিতে ভুলে গেলি। হামৃকে শুধালুম, তোমার ডিউটি কটা অবধি? ন-টা। তা হলে কাইজার কার্লে এসো ন-টায়। কেন? আমেরিকার পয়সাওলা কাকা মারা গেছে নাকি? না, কোলারে। সে আবার কোথায়? ভারতবর্ষে সোনার খনি। ওহ! তা হলে একটা গোল্ড-ডিগার সঙ্গে নিয়ে আসব।

গোল্ড-ডিগার মানে যেসব খাবসুরৎ মেয়ে প্রেমের অভিনয় করে আপনার মনি-ব্যাগটি ফাঁকা করতে সাহায্য করে। আপনারই উপকারার্থে। পোকা লাগার ভয়ে সেটাতে বাতাস খেলাতে চায়।

গোরস্তানে ঢুকলে আমরা চেনা লোকের গোরের সন্ধান করি; অচেনা লাইব্রেরিতে ঢুকলে চেনা লেখকের বই আছে কি না তারই সন্ধান করি প্রথম। বন্ শহর নতুনত্ব অত্যন্ত অপছন্দ করে; তৎসত্ত্বেও দু-চারটে নতুন রেস্তোরাঁ কাফে জন্ম নিয়েছে। সেগুলো তদারক করার কণামাত্র কৌতূহল অনুভব করলুম না। কে বলে মানুষ নতুনত্ব চায়?

কুকুর যেরকম পথ হারিয়ে ফেললে আপন গন্ধ এঁকে এঁকে বাড়ি ফেরে, আমিও ঠিক তেমনি সাত দিন ধরে আজ ভেন্‌সবের্গ, কাল গোডেসবের্গ, পরশু জীবেনগেবের্গে, পরের দিন রাইনে লঞ্চ-বিহার করে করে আপন প্রাচীন দিনের গন্ধ খুঁজে খুঁজে কাটালুম; আর শহরের ভিতরকার গলি-ঘুচির রেস্তোরাঁ-বারের তো কথাই নেই।

অষ্টম দিনে ডুসলডর্কে আমার প্রাচীন দিনের সতীর্থ পাউলকে ট্রাঙ্ক করলুম। প্রথমটায় সে একচোট গালাগালি দিল আমি কেন আগে জানাইনি। আমি বললুম, কেন? বেতার তো আমার টুরের খবর প্রতিদিন বুলেটিনে ঝাড়ছে।

শুধাল, কোন্ বেতার? দক্ষিণ মেরুর?

না, কন্সানট্রেশন ক্যাম্পের।

এই! চুপ চুপ!

না রে না, ভয় পাসনি। তোদের ফুরারের সঙ্গে আমাদের এখন খুব দোস্তি। তিনি গোপনে আমাদের দু-একজন বেসরকারি নেতাকে শুধিয়েছেন, তিনি যদি ব্রিটেন আক্রমণ করেন তবে ভারতীয়েরা তার মোক নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে কি না।

থাক্ থাক্। আজ সন্ধ্যায় দেখা হবে।

অমি বললুম, হাইল হিটলার।

 রিসিভার রাখার এক মিনিট যেতে না যেতে টেলিফোন বাজল। রিসিভার তুললুম। অপর প্রান্ত থেকে অনুরোধ এল বামাকণ্ঠে, আমি কি ডক্টর সায়েডের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

কথা বলছি।

 আমি ট্রাঙ্ককল দফতর থেকে কথা বলছি। খানিকক্ষণ আগে আপনি ডুসলডর্ফে ট্রাঙ্ককল করেছিলেন না?

সর্বনাশ! পাউলের ভয় তা হলে অমূলক নয়। নিশ্চয়ই নাৎসি স্পাই। আমাদের কথাবার্তা ট্যাপ করেছে। ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, হ্যাঁ।

আপনি ইন্ডিয়ান?

কী করে—

না, না, মাফ করবেন আপনার জর্মন উচ্চারণ খুবই খাঁটি, কিন্তু কি জানেন, আমি ট্রাঙ্ককল একচেঞ্জে কাজ করি বলে নানান দেশের নানান ভাষা নানান উচ্চারণের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। শুধু কণ্ঠস্বর নিয়ে সবকিছু বুঝতে হয় বলে অল্প দিনের ভিতরেই এ জিনিসটা আমাদের আয়ত্ত হয়ে যায়।

আশ্চর্য নয়। মানুষ তার মাতৃভাষার বৈশিষ্ট্য বিদেশি ভাষা বলার সময় আপন অজান্তে প্রকাশ করে ফেলে আর ওকিবহাল ব্যক্তি সেটা ধরে ফেলতে পারেন। শুনেছি লন্ডনের কোন এক আর্ট একাডেমির অধ্যক্ষ যে কোনও ছবি দেখেই বলে দিতে পারতেন, কোন দেশের লোক এটা একেছে। একই মডেল দেখে দেড়শোটি ছেলে স্কেচ করেছে; তিনি দিব্য বলতে পারতেন, কোনটা ইংরেজের, কোনটা চীনার, আর কোনটা ভারতীয়ের। এবং যদিও মডেলের মেয়েটি ইংরেজ তবু সবচাইতে ভালো এঁকেছে ইন্ডিয়ান। মনকে এরই স্মরণে সান্তনা দিলুম, তবে বোধহয় আমার জর্মন উচ্চারণ জর্মনদের চেয়েও ভালো।

অনেক ইতিউতি করে নারীকণ্ঠ বলল, আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি বার বার ক্ষমা চাইছি, আমি কি পাঁচ মিনিটের জন্য আপনার দর্শন পেতে পারি? আমার একটু দরকার আছে। সেটা কিন্তু জরুরি নয়; আপনার যেদিন যখন সুবিধে হয়।

তাড়াতাড়ি বললুম, পাঁচ মিনিট কেন– পাঁচ ঘণ্টা নিন। আমি এখানে ছুটিতে। দিন ক্ষণ আপনিই ঠিক করুন।

কাল হবে? আমার ডিউটি বিকেল পাঁচটা অবধি। আপনার হোটেলের পাশেই তো কাফে হুশ্লাগ। সেখানে সাড়ে পাঁচটায়? আমি আপনাকে ঠিক চিনে নেব। বন্ শহরে আপনিই হয়তো একমাত্র ইন্ডিয়ান।

পরদিন কাফের মুখেই একটি মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, গুটটাখ! হের সায়েড!

আমি বললুম, গুটনটাখ, ফ্রলাইন–

এস্থলে প্রথম পরিচয়ে আপন নাম বলা হয়। ফ্রলাইন (কুমারী, মিস) কী একটা অস্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, আমি ঠিক ধরতে পারলুম না। কিন্তু নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন না হলে এস্থলে দুবার প্রশ্ন করা– বিশেষ করে মহিলাকে আদব-দুরস্ত নয়।

দেহের গঠনটি ভারি সুন্দর, আঁটসাঁট, দোহারা। প্রলম্বিত বাহু দুখানি এমনি সুডৌল যে, মনে হয় যেন দু গুচ্ছ রজনীগন্ধা। রাস্তার উজ্জ্বল আলোতে দেখছিলুম বলে লক্ষ করলুম কনুইয়ের কাছে মণি-খনির মতো দুটি টোল। গোটা দেহটি যেন রসে রসে ভরা। শুধু দেহটি দেখলে যে কেউ বলবে, মধুভরা পূর্ণ যুবতী।

কিন্তু মুখটির দিকে তাকানো মাত্র যে কোনও মানুষের মনের ভাব সম্পূর্ণ বদলে যাবে। ব্লাউজের গলার বোতাম থেকে আরম্ভ করে মাথার চুল পর্যন্ত–মনে হল এ যেন অন্য বয়সের ভিন্ন নারী। মুখের চামড়ায় এক কণা লাবণ্য এক কাচ্চা মসৃণতার তেল নেই। গলার চামড়া পর্যন্ত বেশ কিছুটা ঝুলে পড়েছে। সিকি পরিমাণ চুলে পাক ধরেছে। আর চোখ দুটি– সেগুলোর যেন দর্শনশক্তিও হারিয়ে গিয়েছে– জ্যোতিহীন, প্রাণহীন। এর বয়স কত হবে?– শুধু যদি মুখ থেকেই বিচার করতে হয়? আর সে কী বিষণ্ণ মুখ! বয়স বিচারের সময় সেই বিষণ্ণতাই তো হবে প্রধান সাক্ষী– জ্যোতিভ্রষ্ট চক্ষুতারকার চেয়েও কণ্ঠদেশের লোলচর্মের চেয়েও।

ইতোমধ্যে আমরা কাফেতে ঢুকে আসন নিয়েছি। মহিলাটি– না যুবতীটি, কী বলব? (সেই যে কালিদাসের গল্পে বুড়ো স্বামীর ধড়ের সঙ্গে জোয়ান ভাইয়ের কাটা মুণ্ড জুড়ে দিয়েছিল এক নারী)– ইতোমধ্যে দস্তানা খুলে নিয়েছেন। মুখের সঙ্গে মিলিয়ে বেরুল হাত দুখানা রসে ফাটো-ফাটো দেহের সঙ্গে মিলিয়ে নয়– নির্জীব, কোঁকড়ানো চামড়া, ইংরেজিতে বলে ক্রোজ ফিট, কাকের পা! অতি কষ্টে নিজেকে সামলেছিলুম!

বললেন, আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ করেছি। অর্থাৎ তিনি বিল শোধ করবেন। অন্য সময় হলে এ বারতা আমার কর্ণকুহরে নন্দন-কাননের স্বর্ণোজ্জ্বল মধুসিঞ্চন করত। কিন্তু এই বিষণ্ণ মুখের সামনে আমার গলা দিয়ে যে কিছুই নামবে না। বললুম, আমি যখন এখানে পড়তুম–

বাধা দিয়ে শুধোলেন, আপনিও পড়েছেন নাকি?

এই ও-টার অর্থ কী?

আমি বললুম, তখন তো কোনও অবিবাহিত রমণীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করা আমাদের মধ্যে রেওয়াজ ছিল না।

তার কণ্ঠটি ছিল এমনিতেই ক্ষীণ— এখন শোনাল মুমূর্ষ প্রায়। যেন মাফ চেয়ে বললেন, ব্যত্যয় সবসময়ই দুটো একটা থাকে। কিন্তু দয়া করে আপনি এসব গায়ে মাখবেন না। আমি আপনার অপ্রিয় কোনও কাজ করতে চাইনে।

কাফেতে এ সময়ে জর্মনদের ইয়া ইয়া লাশ ভামিনীদের ভিড়। ওয়েট্রেস এক কোণে একটি খালি টেবিল দিল। বুঝলুম, মহিলাটি পূর্বাহেই টেবিলটি রিজার্ভ করে রেখেছিলেন। ব্যাগ খুলতে খুলতে বললেন, আপনি কী খেতে ভালোবাসেন? চা নিশ্চয়ই। কিন্তু এদেশে যে চা বিক্রি হয় সে তো অখাদ্য। তবে আমার কাছে ভালো চা আছে। আমি লন্ডন থেকে সেটা আনাই। ব্যাগ থেকে বের করে একটি ছোট্ট পুলিন্দা তিনি ওয়েট্রেসের হাতে তুলে দিলেন। সে কিছু বলল না বলে বুঝলুম, এ ব্যবস্থায় সে অভ্যস্ত।

আমাদের অর্ডার না দেওয়া সত্ত্বেও ভালো ভালো কেক, স্যানউইজ, টার্ট উপস্থিত হল। বুঝলুম, এগুলো পূর্বের থেকেই অর্ডার দেওয়া ছিল।

কিছুক্ষণ পরে জিগ্যেস করলেন, আপনাদের দেশের খুব বেশি ছাত্র জর্মনিতে পড়তে আসে না– কী বলেন?

আমি বললুম, অতি অল্পই। তা-ও বেশিরভাগ শিখতে আসে সায়ান্স আর টেকনিকাল বিদ্যা।

একটু হেসে বললেন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আপনি হিউম্যানিটিজের। আর বন তো তারই জন্য বিখ্যাত। তবে এখানে এসেছেন অল্প ভারতীয়ই। আপনারা যারা এসেছিলেন, ভারতে তাদের কোনও সংঘ আছে কি, যার মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে আপনারা যুক্ত থাকতে পারেন?

আমি বললুম, না। এমনকি আমি এদের মাত্র দু একজনকে চিনি। ভারতবর্ষ বিরাট দেশ বলে আমি চায়ে চুমুক দিলুম। তিনি বললেন, ডিব্ৰুগড় থেকে দ্বারকা, কুলু থেকে কন্যাকুমারী। আমি তো অবাক! আশ্চর্য হয়ে বললুম, আপনি অত ডিটেল জানলেন কোথা থেকে? এখানকার শিক্ষিত লোককে পর্যন্ত ইভার (ভারতীয়) আর ইন্ডিয়ানার (রেড ইন্ডিয়ান) এ দুয়ের পার্থক্য বুঝিয়ে বলতে হয়।

এবং তার পরও কেউ কেউ আপনাকে শুধোয়, আপনি সেটাল আফ্রিকানার (সেন্ট্রাল আফ্রিকান) না জুড় ইটালিয়েনার (সাউৎ ইটালিয়ান)?

আমি আরও আশ্চর্য হয়ে বললুম আপনি অতশত জানলেন কী করে?

পরে বলব। কিন্তু আপনি ভারতে বন-এর ছাত্রদের সম্বন্ধে কী যেন বলছিলেন?

ভারতের বুদ্ধিজীবীর প্রধান অংশ থাকেন কলকাতায়। সেখানে থাকলেও খানিকটা যোগসূত্র থাকে। আমি থাকি ছোট্ট বরোদায়–

অস্ফুট শব্দ শুনে আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালুম। দেখি, তার পাংশু মুখে যে দু-ফোঁটা রক্ত ছিল তা-ও অন্তর্ধান করেছে। ভয় পেয়ে শুধালুম, কী হল আপনার?

ঢোঁক গিলে খানিকটা সামলে নিয়ে বললেন, ও কিছু না। আমি অনিদ্রায় ভুগে ভুগে দুর্বল হয়ে পড়েছি। এখানে বড় লোকের ভিড়। সব বন্ধ। আমি আমার অফিস-ঘরের জানালা শীত-গ্রীষ্ম সবসময় খোলা রাখি।

আমি বললুম, তা হলে খোলায় চলুন। তার পর শুধালুম, আপনার সহকর্মী অন্য মেয়েরা কিছু বলে না?

প্রথমটায় ঠিক বুঝতে পারেননি। পরে বললেন, ও। আমি এককালে টেলিফোন গার্লই ছিলুম। এখন তারই বড় অফিসে কাজ করি। অ্যাডমিনিসট্রেটিভ কাজ। কিন্তু আগেরটাই ছিল ভালো।

বাইরে বেরিয়ে আসতেই আমি বললুম, আমার মনে হচ্ছে আপনি বেশি হাঁটাহাঁটি করতে পারবেন না। তার চেয়ে চলুন, ওই যে প্রাচীন যুগের একখানা ঘোড়ার গাড়ি এখনও অবশিষ্ট আছে, তাই চড়ে রাইনের পাড়ে গিয়ে বসি।

মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

আস্তে আস্তে শুধোলেন, গেলটুনার যে ঋগ্বেদের জর্মন অনুবাদ করেন সেইটের ওপর নির্ভর করে যে একটি ইংরেজি অনুবাদ ভারতবর্ষ থেকে বেরোবার কথা ছিল, তার কী হল?

আমি এবারে সত্যই অবাক হলুম। গেলটুনারের অনুবাদ অনবদ্য। গত একশো বছরে ঋগ্বেদ সম্বন্ধে ইউরোপ তথা ভারতে যত গবেষণা হয়েছে গেলটুনারের কাছে তার একটিও অজানা ছিল না, এবং অনুবাদ করার সময় যেখানে যেটি দরকার হয়েছে সেখানে সেইটে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এ মহিলাটি যে অতিশয় সমীচীন ও সময়োপযোগী প্রস্তাবটির কথা বললেন সে সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতুম না। বিস্ময় প্রকাশ করে বললুম, কিন্তু আপনি এসবের খবর পেলেন কোথায়?

তিনি চুপ করে রইলেন। গাড়ি মন্থর গতিতে বেটোফেনের প্রতিমূর্তির পাশ দিয়ে মনসটার গির্জে পেরিয়ে, ইউনিভার্সিটি হয়ে রাইনের পাশে এসে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকে নেমে তাকিয়ে দেখি, মহিলার মুখ তখনও ফ্যাকাসে। প্রস্তাব করলুম, ওই কাফেটার খোলা বারান্দায় গিয়ে বসি, আর আপনি কিছু একটা কড়া খান। ওয়েটরকে বললুম কন্যাক নিয়ে আসতে।

দুই ঢোঁক কন্যাক্ খেয়ে যেন বল পেলেন। বললেন, আমি এখনও অবসরমতো কিছু কিছু ইভলজির চর্চা করি। বছর বারো পূর্বে যখন আরম্ভ করি তখন পূর্ণোদ্যমেই করেছিলুম।

তার পর আবার অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করলেন। রাইনের জলের উপর তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দু একখানা মোটর বোট আসা-যাওয়া করছে মাত্র। বাতাস নিস্তব্ধ। এমনিতেই রাইনের সন্ধ্যা আমাকে বিষণ্ণ করে তোলে, আজ যেন রাইনের জলে চোখের জল ছলছল করছে।

মহিলাটি বললেন, কাল থেকে ভাবছি, কী করে কথাটি পাড়ি।

যে কোনও কারণেই হোক মহিলাটি যে বেদনাতুর হয়ে আছেন সে কথা আমি ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি। বললুম, আপনি দয়া করে কোনও সঙ্কোচ করবেন না। আমাদ্বারা যদি কোনও কিছু করা সম্ভব হয়, কিংবা সুদ্ধমাত্র আমাকে কিছু বলতে পেরে আপনার মন হালকা হয়–

মানুষকে ক্রমাগত সান্ত্বনার বাক্য দিয়ে প্রত্যয় দিতে থাকলেই যে সে মনস্থির করতে পারে তা নয়; বরঞ্চ কথা বন্ধ করে দিলে সে আপন মনে ভাববার এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছবার সুযোগ পায়। আমি বন্-বয়েল শহরের মাঝখানে রাইনের উপরের পাথরের মোটা মোটা থামের তুলে-ধরা বিস্তীর্ণ স্পানওলা সুন্দর সেতুটির দিকে তাকিয়ে রইলুম। লোহার পুল কেমন যেন নদীর সঙ্গে খাপ খায় না– পাথর যেন জলের সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়, উভয়েরই রঙ এক।

দুনিয়াতে হেন তালা আবিষ্কৃত হয়নি যেটা কলেকৌশলে, কখনও-বা পশুবল প্রয়োগ করে, কখনও-বা মোলায়েম আদরসোহাগ করে খোলা যায় না; ওদিকে আবার গেস্তাপো, ওগপু এ সবকটা পদ্ধতি এবং আরও মেলা নয়া নয়া কৌশল খাঁটিয়েও বহু মানুষের মনের তালা খুলতে পারেনি। এবং হঠাৎ অকারণে কেন যে সেটা খুলে যায় তার হদিস কনফেশনের পাদ্রিসায়েব থেকে আরম্ভ করে আমাদের যৌবনকালের টেগার্ট পাষণ্ডও সন্ধান পায়নি।

মহিলা জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা বলুন তো, দময়ন্তী নিদ্রাভঙ্গের পর দেখলেন নলরাজ নেই; তার পর তাঁর ইহজীবনে যদি নলের সঙ্গে আদৌ সাক্ষাৎ না হত তবে তিনি নল সম্বন্ধে বা আপন অদৃষ্ট সম্বন্ধে কী ভাবতেন?

নলোপাখ্যানের উল্লেখে আমি আশ্চর্য হলুম না। যে রমণী গেলটুনারের বেদানুবাদের সঙ্গে সুপরিচিতা, নলরাজ তো তাঁর নিত্যালাপী আত্মীয়!

আমি একটু ভেবে বললুম, রসরাজও তো বৃন্দাবনে শ্ৰীমতীর কাছে ফিরে যাননি। তবু তো তিনি তাঁর প্রতি প্রত্যয় ত্যাগ করেননি। মহাত্মা উদ্ধব যখন বৃন্দাবন দর্শন করে মথুরা ফিরে এলেন তখন রসরাজ সব শুনে বলেছিলেন, বিরহাগ্নি যদি তার এতই প্রবল হয় তবে তিনি জ্বলেপুড়ে ভস্ম হয়ে যাননি কেন? কী বেদরদী প্রশ্ন! কিন্তু শ্রীরাধা সেটা জানতেন বলে উদ্ধবকে বলতে বলে দিয়েছিলেন, তার অবিরাম অশ্রুধারা সেই অগ্নি বার বার নির্বাপিত করছে– তনু জরি জাত জো ন অপুঁয়া ঢর উপো –যুদুপতি শেষ প্রশ্ন শুধান, আমার বিরহে তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়নি কেন? এর উত্তরও উদ্ধব শিখে নিয়েছিলেন, আপনি একদিন না একদিন বৃন্দাবনে ফিরবেন এই প্রত্যয়ই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

দময়ন্তী নিশ্চয়ই প্রত্যয় ছাড়েননি।

মহিলা বললেন, তুলনাটা কি ঠিক হল? শ্রীরাধা তো মাঝে মাঝে শ্রীকৃষ্ণের সংবাদ পেতেন, তিনি কংস বধ করেছেন, তিনি কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে শান্তি স্থাপনার্থ দৌত্য করেছেন, জনসমাজের বৃহত্তর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন এই ভেবে মনে সান্ত্বনা পেতেন–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, এবং রুক্মিণীকে– সে কুমারী আবার শিশুপালের বাগদত্তা বধূ– বিয়ে করেছেন, তার পর সত্যভামাকে, সর্বশেষ ভালুকী–

আমি নিজের থেকে থেমে গেলে পর মহিলাটি বললেন, শ্রীকৃষ্ণের উদাহরণ আপনিই তুলেছিলেন; আমি তুলিনি।

আমি বললুম, আপনি দময়ন্তীর কথা তুলেছিলেন- ভগবান করুন, আপনার নল যেন

তিনি মাথা নাড়তে আমি চুপ করে গেলুম।

 বললেন, আপনি গোডেসবের্গ চেনেন?

 আমি বললুম, বা রে, সেখানে তো আমি এক বছর বাস করেছি।

প্রফেসর কিফেল সেখানে বাস করতেন। আমরা ছিলাম তার প্রতিবেশী। আমি প্রতিদিন বন শহরে আসতুম চাকরি করতে। হঠাৎ একদিন দেখি তার পরের স্টপেজ হোঋ-ক্রয়েৎসে একজন বিদেশি উঠলেন। মুখোনা বিষণ্ণ। সেদিন আর কিছু লক্ষ করিনি। কাইজার প্লাসের স্টপেজে উনিও নামলেন। আমি বইয়ের দোকান র্যোরশাইটে কাজ করতুম। আপন অজান্তেই লক্ষ করলুম বিদেশি ইউনিভার্সিতে ঢুকলেন।

তিন-চার মাস প্রায় রোজই একই ট্রামে যেতুম, ভদ্রলোকের প্রতি আমার কোনও কৌতূহল ছিল না কিন্তু লক্ষ করলুম, বিদেশির বিষণ্ণ ভাব আর কাটল না।

তার পর একদিন তিনি আমাদের দোকানে এসে ঢুকলেন। আমি এগিয়ে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাতে তিনি একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। ভাবলুম এ আবার কোন দেশের লোক? এত লাজুক কেন?

ভাঙা ভাঙা জর্মন ভাষায় এক জর্মন ইলজিস্টের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ চাইলেন। আমি একটু আশ্চর্য হলুম : জর্মনিতে বসে জর্মনের লেখা বই পড়লেই হয়। বললুম, এটা লন্ডন থেকে আনাতে হবে। তার পর কিন্তু কিন্তু করে বললুম, মূল জর্মনটা পড়লেই তো ভালো হয়।

তিনি বললেন, আমার আছে, কিন্তু বুঝতে বড় অসুবিধা হয়। সঙ্গে সঙ্গে বইখানা পোর্টফোলিও থেকে বের করে কাউন্টারের উপর রাখলেন।

আমি তখনও ইন্ডলজির কিছুই জানতুম না– নামটাম টুকে নিয়ে তাঁকে দু-চারখানা ভালো অভিধান, সরল জর্মন বই, ব্যাকরণ দেখালুম। আমি ইংরেজি জানতুম বলে তার ঠিক কোন কোনটা কাজে লাগবে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের মতো সৎপরামর্শ দিলুম। আমি যেটা দেখাই সেটাই তিনি কিনে ফেলেন। শেষটায় আমিই হেসে বললুম, এগুলো শেষ করুন। এর পরের ধাপের বই আমি বেছে রাখব। টাকা দিয়ে বইগুলো নিয়ে যখন চলে গেলেন তখন দেখি তার ইভলজির বইখানা কাউন্টারে ফেলে গেছেন। তা যান, কাল ট্রামে দিয়ে দিলেই হবে।

ইন্ডিয়া সম্বন্ধে এই আমার প্রথম পাঠ। এবং এখনও সে বইখানা মাঝে মাঝে পড়ি। ভিন্টারনিৎসের ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস। এ বই দিয়ে আরম্ভ না করলে হয়তো ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি আমার কৌতূহল অঙ্কুরেই মারা যেত।

ভিন্টারনিৎস লেখেন অতি সরল জর্মন; তাই আশ্চর্য হলুম যে বইয়ের মালিক এতদিনেও এতখানি জর্মন শিখে উঠতে পারেননি কেন?

আমি চেপে গেলুম যে, ঠিক এই বইখানাই ভিন্টারনিৎস শান্তিনিকেতনে আমাদের পাঠিয়েছিলেন।

আর পাঁচজন জর্মনের তুলনায় বিদেশিদের সম্বন্ধে আমার কৌতূহল কম। বইয়ের দোকানে কাজ করলে ইচ্ছা-অনিচ্ছায় জাত-বেজাতের বই পড়া হয়ে যায়। আমার কৌতূহল নিবৃত্তি হয়ে গিয়েছিল অনেকখানি– ওই করে।

কিন্তু এই লোকটির প্রতি কেমন যেন আমার একটু দয়া হল। তবু এটা ঠিক, আমি নিশ্চয়ই গায়ে-পড়ে তাকে সাহায্য করতে যেতুম না। তবে একথাও ঠিক, ভিন্টারনিৎসের বেদ অনুচ্ছেদে উষস্ আবাহন এবং জুয়াড়ির মনস্তাপ দুটোই আমার কল্পনাকে এক অপূর্ব উত্তেজনায় আলোড়িত করেছিল। ঊষামন্ত্র লিরিক, রহস্যময়, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, আর অবিশ্বাস্য বলে মনে হল যে, ওই একই সময়ে অতিশয় নিদারুণ বাস্তব জুয়াখেলা ও জুয়োড়ি-জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা একই সঞ্চয়নে স্থান পেয়েছে। আমার বাবা ছিলেন গ্রিক ভাষার অধ্যাপক। স্কুলে আর পাঁচটা ছেলেমেয়ে যা গ্রিক শেখে সেটা ম্যাট্রিক পাসের পরই ভুলে যায়। আমার পিতা সেটা হতে দেননি। এখন আমার ইচ্ছে হল সংস্কৃত শেখার। তাই তার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করলুম। আমি তাঁর জন্য ভিন্টারনিৎসের জর্মন থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে দিতুম, আর তিনি আমাকে সংস্কৃত পড়াতেন।

আমার মনে সর্বক্ষণ নানা প্রশ্নের উদয় হচ্ছিল, কিন্তু মহিলাকে বাধা দিলুম না।

ততক্ষণে কাফেতে উল্লাস, হৈ চৈ পড়ে গিয়েছে। জর্মন জনগণের বহুদিনের মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। ঘড়ি ঘড়ি খবর আসছে, নাৎসি বিজয়-সেনানী কীভাবে অস্ট্রিয়ার শহরের পর শহর দখল করে যাচ্ছে, তারা কীভাবে সর্বত্র উদ্বাহু অভিনন্দিত হচ্ছে।

আমি একটু মুচকি হেসে বললুম, ভালুকও মানুষকে আলিঙ্গন করে শুনেছি, কিন্তু সে আলিঙ্গন– যা গে।

মহিলাটি একটু চমকে উঠলেন। বললেন, এসব মন্তব্য আপনি সাবধানে করবেন। কী করে জানলেন, আমি নাৎসি নই?

আমি হেসে বললুম, জলবত্তরল– আপনি তো সংস্কৃত জানেন। তার মানে যে-জন বেদ পড়েছে, সে-ই জানে বেদের আর্যধর্মের সঙ্গে নাৎসিদের এই আর্যামির বড়ফাটাইয়ের সূচ্যগ্র পরিমাণ সম্বন্ধ নেই। কিন্তু আপনি চিত্তবিক্ষেপ হতে দেবেন না। তার পরের কথা বলুন।

একটু চিন্তা করে বললেন, প্রথমে সাহচর্য, তার পর বন্ধুত্ব, সর্বশেষে প্রণয় হল আমাদের দুজনাতে।

এবারে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তিন বছরের প্রণয়– তার পর দশ বছর ধরে আমি তার কোনও খবর পাইনি। এই দশ বছর আমার একা একা কেটেছে। এই দীর্ঘ তেরো বছরের কথা আপনাকে বলতে গেলে ক মাস ক বছর লাগবার কথা তার সামান্যতম অনুমান আমার নেই।

এই শেষের দশ বৎসর কী করে কেটেছে, এখন কী করে কাটছে সেটা বোঝাবার চেষ্টাও আমি করব না। আর সেটা শোনাবার জন্যও আমি আপনার দর্শন কামনা করিনি। এই যে বন্ বিশ্ববিদ্যালয় আমরা পেরিয়ে এলুম, এখানে পড়বার সময় ঠিক একশো বছর আগে, আমাদের সবচেয়ে সেরা লিরিক কবি হাইনে একটি চার লাইনের কবিতা লেখেন :

প্রথমে আশাহত হয়েছিনু
ভেবেছিনু সবে না বেদনা;
তবু তো কোনো মতে সয়েছি।
কী করে যে সে কথা শুধিয়ো না।

 তীব্র বেদনার তীক্ষ্ণ প্রকাশ দেবার চেষ্টা করেছেন হাইনে বার বার, কিন্তু হার মেনে উপরের চতুষ্পদীটি রচেন। একশো বছর ধরে দেশ-বিদেশে লক্ষ লক্ষ নরনারী সেগুলো পড়ছে

এবারে আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমাদের পোয়েট টেগোর তার প্রথম যৌবনে এক জর্মন মহিলার কাছ থেকে অল্প জর্মন শেখার পরেই তাঁর শুটিদশেক কবিতা বাঙলায় অনুবাদ করেন। আপনি যেটি বললেন সেই চতুষ্পদীটিও তাতে আছে।

প্রথম যৌবনে তিনি কি শোক পেয়েছিলেন?

তাঁর প্রাণাধিকা ভ্রাতৃবধূ আত্মহত্যা করেন। কিন্তু সে কথা আরেকদিন হবে। আমি নিজে কাপুরুষতম এসকেপিস্ট; তাই দুঃখের কথা এড়িয়ে চলি। তার চেয়ে আপনাদের সেই তিন বছরের আনন্দের কথা বলুন।

প্রথম বছর কেটেছে স্বপ্নের মতো। স্বপ্ন যেমন চেনা-অচেনায় মিশে যায়, হঠাৎ চেনা জিনিস, চেনা মানুষ মনে হয় অচেনা, আবার অচেনা জন চেনা, এ যেন তাই। তাঁকে যখন মনে হয়েছে এর সবকিছু আমার চেনা হয়ে গিয়েছে তখন হঠাৎ মনে হয়েছে যেন ইনি আমার সম্পূর্ণ অজানা জন। আবার কেমন যেন এক প্রহেলিকার সামনে অন্ধকারে ব্যাকুল হয়ে হাতড়াচ্ছি– মধ্যরাত্রে হঠাৎ তার ঘুমন্ত হাত পড়ল আমার গাঁয়ের উপর আর সঙ্গে সঙ্গে আমার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। আমার চৈতন্যে তখন বিশ্বব্যাপী মাত্র একটি অনুভূতি– এই লোকটির মাঝেই আমার অস্তিত্ব, আমার অন্য কোনও সত্তা নেই। গোডেসবের্গের পিছনে নির্জনে গভীর পাইন বনে সকাল থেকে পরের দিন ভোর অবধি কাটিয়েছি একটানা, রাইনের ওপারে বরফ ভেঙে ভেঙে উঠেছি মারগারেটেন হ্যোহ অবধি, ফ্যান্‌সি বলে শ্যাম্পেনের পর শ্যাম্পেন খেয়ে আমি অবশ হয়ে শুয়ে পড়েছি ডান্স-হলের সামনের ঘাসের উপর তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বাড়িতে।

কেন জানিনে, হঠাৎ জিগ্যেস করে বসলুম, উনি কখনও বে-এতেয়ার হতেন না?

বললেন, আশ্চর্য, আপনি যে এ-প্রশ্ন জিগ্যেস করলেন! না, কখনো না। এখানকার পড়দের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে তাকে খেতে দেখেছি বহুবার, চোখের পাতাটি পর্যন্ত নড়ত না। অথচ তিনি একাধিকবার আমাকে বলেছেন, তার জানামতে তার সাত পুরুষের কেউ কখনও মদ খায়নি।

কিন্তু প্রথম বছরের চেয়েও অন্তত আমার পক্ষে মধুরতর আর গৌরবময় শেষের দুই বছর।

এক বৎসর ক্লাস আর সেমিনার করার পর অধ্যাপকের আদেশে তিনি আরম্ভ করলেন তাঁর ডক্টরেট থিসিসের প্রথম খসড়া–অবশ্য ইংরেজিতে। মোটামুটি তিনি কী লিখলেন সে সম্বন্ধে তিনি আমার সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন।

থেমে গিয়ে তিনি অত্যন্ত করুণ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কাছে আমার একটা ভিক্ষা আছে–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, ছি ছি। আপনি আমাকে এখনও চিনলেন না!

চিনেছি বলেই চাইছি। এখন যা বলব, আপনি প্রতিজ্ঞা করুন, কাউকে বলবেন না।

আমি তাঁর হাতে সেই শুষ্ক, জরাজীর্ণ হাতে চাপ দিলুম।

প্রথম পরিচ্ছেদের কাঁচা খসড়া পড়ে আমি অবাক। একেবারে কিছুই হয়নি বললে অত্যুক্তি হয়, কিন্তু এতে যে কোনও বাধই নেই, বক্তব্য কোন্ দিকে যাচ্ছে তার কোনও নির্দেশ নেই আছে গাদা গাদা ফ্যাক্টস, এবং তার মধ্যেও কোনও সিসটেম্ নেই।

কারণ ইতোমধ্যে আমি যে খুব বেশি সংস্কৃত শিখেছি তা নয়, তবে আপনি তো জানেন, জর্মন, ফরাসি এবং ইংরেজি, মাত্র এই তিনটি ভাষাতেই ইন্ডিয়া সম্বন্ধে এত বই লেখা হয়ে গিয়েছে যে সেগুলো মন দিয়ে বার বার পড়লে, নোট টুকে মুখস্থ করলে কার সাধ্য বলে আপনি সংস্কৃত জানেন না! যেদিন তিনি আমায় প্রথম তার থিসিসের সাবজেক্ট গুপ্তযুগের কালচারাল লাইফ- বলেন সেদিন থেকেই আমি ওই বিষয়ের ওপর যা পাওয়া যায় তাই পড়তে আরম্ভ করেছি, নোট টুকেছি, মুখস্থ না করেও যতখানি সম্ভব মনে রাখবার চেষ্টা করেছি। আর সংস্কৃত তো সঙ্গে সঙ্গে চলছেই। আপনি তো আমাদের সিস্টেম জানেন। তাই তিন মাস যেতে না যেতেই আমি র‍্যাপিড় রিডিং সিসটেমে খানিকটা বুঝে কিছুটা না বুঝে কালিদাসের সব লেখা এমনকি কালিদাসের নামে প্রচলিত অন্য জিনিসও পড়ে ফেলেছি। তবে আমার ব্যাকরণজ্ঞান এখনও কাঁচা, যদিও গ্রিকের সাহায্যে শব্দতত্ত্বে আমার কিছুটা দখল আছে।

ওঁর ইংরেজিটা যে আমি জৰ্মনে অনুবাদ করব সেটা তো ধরেই নেওয়া হয়েছিল। তারই অছিলা নিয়ে আমি সমস্তটা ঢেলে সেজে লিখলুম। পাছে তাঁর আত্মসম্মানে লাগে তাই বললুম, তুমি এ-কাঠামোর উপর আরও ফ্যাটের কাদামাটি চাপাও, রঙ বোলাও।

ইতোমধ্যে আমার বইয়ের দোকান আমাকে পাঠাল লন্ডন, অক্সফোর্ড, কেমব্রিজে আমাদের বইয়ের বাজার প্রসার করতে। তিনিও তার প্রফেসরের কাছ থেকে ছুটি নিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ও ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে মাল-মশলার সন্ধানে যাবার জন্য।

সে সুযোগের অবহেলা আমি না করে আমাদের প্রকাশিত আর বিরল আউট অব প্রিন্ট কিছু কিছু বই নিয়ে দেখা করতে গেলুম লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল স্টাডিজের ইন্ডলজি-অধ্যাপকদের সঙ্গে। তাঁরা আমায় ভারি খাতির করলেন, কেউ কেউ চা-য় ডিনারে নিমন্ত্রণও করলেন। আমি ঘুরেফিরে শুধু গুপ্ত যুগের কালচারাল লাইফের দিকে কথার মোড় ফেরাই। ওঁরা অকৃপণ হৃদয়ে আপন আপন গবেষণার ফল বলে যেতে লাগলেন। একদিন এক অধ্যাপকের বাড়িতে নিমন্ত্রণে ছিলেন আরও দুজন ইন্ডলজির অধ্যাপক। আমি গুপ্ত যুগ টুইয়ে দিতেই লেগে গেল তিন পণ্ডিতে লড়াই। ঘণ্টাখানেকের ভিতরই পরিষ্কার হয়ে গেল তিনজনার তিন থিসিস। একজন বললেন : গুপ্ত কেন, তার পরবর্তী যুগেরও সব নাট্যের কাঠামো গ্রিক নাট্য থেকে নেওয়া। দ্বিতীয়জনের বক্তব্য : গুপ্ত যুগের চোদ্দ আনা কৃষ্টির মূলে দ্রাবিড়। বেদ উপনিষদ রামায়ণ মহাভারতের চোরাবালির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে গুপ্ত যুগে এসে নির্মল তৃষাহরা হ্রদে পরিণত হয়েছে। আর তৃতীয়জনের মতে গুপ্ত যুগের বেশিরভাগ পরবর্তী যুগের– গুপ্ত যুগের নামে পাচার হচ্ছে। যেরকম ওমর খৈয়ামের দু-শ বছর পরের রচনা বিস্তর চতুষ্পদী তাঁর সঙ্কলনে ঢুকে গেছে।

ভোরের প্রথম বাস্ ধরে আমরা যে-যার বাসায় ফিরেছিলুম।

তার পূর্বে আমি সবিনয়ে শুধিয়েছিলুম, আমি তাঁদের বক্তব্যের কিছু কিছু ব্যবহার করতে পারি কি না। তিনজন একবাক্যে বলেছিলেন, আলবত, নিশ্চয়, অতি অবশ্যই। এসব তো কমন নলেজ। তাই দয়া করে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো না। আমাদের বদনাম হবে যে আমরা কমন নলেজ গবেষণা বলে পাচার করি। একেই বলে প্রকৃত বিনয়!

বাসে বাসেই আমি যতখানি স্মরণে আনতে পারি শর্টহ্যান্ড টুকতে আরম্ভ করি। বাড়ি ফিরে বিছানা না নিয়ে যখন কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি তখন বন্ধু বিছানায় বসে চোখ কচলাতে কচলাতে বেড়-টির জন্য ঘণ্টা বাজালেন।

অক্সফোর্ড-কেমব্রিজেও অধ্যাপকদের সাহায্য পেলুম।

তার পর বনে ফিরে এসে সেইসব বস্তু গুছিয়ে, খসড়া বানিয়ে ফেয়ার কপি টাইপ করে, তাঁর প্রোফেসরের মেরামতির পর সে অনুযায়ী আবার টাইপ করে পরিপূর্ণ থিসিস তৈরি হল।

আমি বললুম, অর্থাৎ–

তিনি ব্যাকুল হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, না, না, না। আপনি ভুল ইনফারেন্স্ করছেন। সংস্কৃত ভাষাটি ছিল তার সম্পূর্ণ করায়ত্ত। হেন ব্যাকরণ নেই যার প্রত্যেকটি সূত্র, নিপাতন, আর্যপ্রয়োগ তার কণ্ঠস্থ ছিল না। কঠিন কঠিন টেস্ট দু-বার না পড়েই তিনি অর্থ বের করে দিতে পারতেন। বললে বিশ্বাস করবেন না, তিনি তাঁর অধ্যাপককে এই দুরূহ ব্যাপারে সাহায্য করতেন। তাঁর থিসিসে যে অসংখ্য বস্তু মূল সংস্কৃত থেকে নেওয়া হয়েছে তার অনুবাদে তো কোনও ভুল পাবেনই না, আর সেগুলোই করেছে তার বইখানাকে রিচ ইন টেকচারসমৃদ্ধশালী। তাঁর কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ–

আমি বাধা দিয়ে বললুম, আমি আপনার প্রত্যেকটি কথা মেনে নিচ্ছি।

 রমণীটি বড়ই সরলা। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, বাঁচালেন। এসব কথা আমি এ জীবনে কাউকে বলিনি। এবং আরেকটা কথা, ওঁকে তো ভাইভাও দিতে হয়েছিল।

আমি বললুম, নিশ্চয়ই। ভাইভাতে কোন ক্লাস, আর রিটনে (অর্থাৎ) থিসিসে কোন ক্লাস পেয়েছিলেন সেটা আর শুধালুম না। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

হঠাৎ মহিলাটি চমকে উঠে বললেন, ছি ছি! অনেক রাত হয়ে গিয়েছে; ওদিকে আপনার ডিনারের কথা আমি একবারও তুলিনি। কোথায় খাবেন বলুন?

আমি কিন্তু কিন্তু করছি দেখে বললেন, আমার ফ্ল্যাটে যাবেন? এখানেই, বেশি দূরে না। গোডেসবের্গের সে বাড়িতে আমি আর যাই না।

আমি ইতোমধ্যে একাধিকবার লক্ষ করেছি যে, মহিলাটি এখনও তার ক্লান্তি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তাঁকে বাড়িতে শুইয়ে দেওয়াই ভালো।

মোড় নিতেই দেখি সেই প্রাচীন দিনের শেষ ঘোড়ার গাড়িখানা যেন আমাদের জন্যই দাঁড়িয়ে। মহিলাটি যে আমলের কথা বলছিলেন তখন এরও ছিল ভরা যৌবন। আমি বললুম, কি হে যাবে নাকি?

টপ্ হ্যাট তুলে বাও করে বলল, নিশ্চয়ই, স্যার। ঘোড়াকে বলল, চল্ বারবা রসসা গোডেসবের্গ।

আমি চেঁচিয়ে বললুম, না হে না–

বলল, সরি, স্যর! এই বছর পাঁচেক পূর্বেও তো আপনাকে ফ্যান্‌সি ডান্স থেকে ভোরবেলা হোথায় নিয়ে গিয়েছিলুম! হা হহা, হা হহা, আপনি তখন ভারি জলি ছিলেন, স্যর, নামবার সময় ঝপ করে আমার হ্যাঁটটি কেড়ে নিয়ে হাওয়া। হাহহা– পরে আমার ওল্ড উম্যান বলে কি না আমি হ্যাঁট বন্ধক দিয়ে বিয়ার খেয়েছি। হাহা হাহা! চল, বারবা রসা।

মহিলাটি হেসে উঠলেন। তাঁর চেনা দিনের ভোলা দিনের দমকা বাতাস যেন হঠাৎ গলিটাকে ভরে দিয়ে সব শুকনো পাতা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল রাইন বাগে। শহরের গলির ভিতর নির্বাসিত সুসান্ দিবাস্বপ্নে যেরকম তার গাঁয়ের নদীটিকে শহরের গলি দিয়ে বয়ে যেতে দেখেছিল।*[* সরু গলির মোড়ে যখন দিনের আলো ঝরে
ময়না দাড়ে গাহে এমন গাইছে বছর ধরে।–ওয়ার্ডসওয়ার্থ, অনুবাদক সত্যেন দত্ত।] 

তখনও আমার বয়েস ছিল কম, জানতুম না, আমার কপালে ভাগ্যবিধাতা লিখে রেখেছেন এমনই দুর্দৈব যে তখন আমার অন্ধ কারাগারে না বইবে চেনা দিনের ভোলা দিনের বাতাস, না বইবে সুসানের গ্রামের নদী– স্মৃতির আবর্জনা উড়িয়ে নিতে ভাসিয়ে দিতে।

গাড়ি-ভাড়াটা দেবার পর্যন্ত মোকা পেলুম না।

গেট খুলে বাড়িতে ঢোকার সময় শুনি, কোচম্যান বলছে, চ বারুবা রসূসা, দেখলি তো, তখনি তো তোকে বলিনি অন্য সোয়ারি নিনি। আজ আর না। চ, বাড়ি যাই। আমার দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, রেতে-বেরাতে যখন খুশি ওই সামনের গলিতে ঢুকে পয়লা বাড়ির সামনে বলবেন, ডার্লিং বাবা রসা! সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি পাবেন তৈরি। সম্রাট বারবা রসার মতো আপনার বাবা রসাও দেখবেন ক্রুসেড লড়তে হোলি ল্যান্ডে যেতে তৈরি।

জর্মন কেন, প্রায় সব জাতের লোকই কোনও বিশেষ দেশ ভ্রমণ করে এলে বা সে দেশ নিয়ে চর্চা করলে আপন বাড়ি ভর্তি করে ফেলে সে দেশের ভালোমন্দ মাঝারি রাবিশ-জাঙ্ক-বিলজ কিচ দিয়ে। এর বাড়িতে পরিপূর্ণ ব্যত্যয় না হলেও একথা কেউ বলতে পারবে না যে ইনি সারাজীবন শুধু ইন্ডিয়া ইন্ডিয়াই করেছেন। মাত্র একখানি ছবি– অজন্তার। রাহুল-জননী পুত্রকে তথাগতের (তিনি ছবিতে নেই) সামনে। আর লেখা-পড়ার টেবিলের উপর সাংখ্যকার মহর্ষি কপিলের একটি মূর্তি। ইনি এটি জোগাড় করলেন কোথা থেকে? ওটা মূলে মূর্তি কি না জানি নে হয়তো-বা রিলিফ। আমি দেখেছি ছবিতে– বহু বৎসর হল।

কিন্তু অত বড় বড় ঘরওলা ফ্ল্যাট তিনি পোষেন কী করে?

আমার অনুমান ভুল নয়। ফ্ল্যাটে ঢুকে আমাকে আসন নিতে অনুরোধ করে তিনি সোফায় শুয়ে পড়লেন। একটু মাফ-চাওয়ার সুরে বললেন, আপনাদের দার্শনিক সর্বপল্লী মহাশয় নাকি লেখাপড়া পর্যন্ত খাটে শুয়ে শুয়ে করেন।

ফটোগ্রাফে মহারানি ভিক্টোরিয়ার বৃদ্ধ বয়সের যে ছবি দেখি হুবহু ঠিক সেই পোশাক পরে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যখণ্ড যেন ঘরে এসে ঢুকলেন। মহিলা আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমার আইমা। ঠাকুরমার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাড়িতে আসেন। তার ছেলে-নাতিরা ভালো ভালো ব্যবসা করেন। আইমা কিন্তু আমার সঙ্গেই থাকতে ভালোবাসেন।

আমি বার বার বললুম, আমি নিরামিষাশী নই, আমার আহারাদির জন্য তুলকালাম করে রাইনের জলে আগুন লাগাতে হবে না, আমি সব খাই, টিনের খাদ্যেও অরুচি নেই।

মহিলা বললেন, জানেন কি, হিটলার কড়া নিরামিষাশী?

আমি বললুম, তা হলে নিরামিষ ভোজনের বিপক্ষে আরেকটা কড়া যুক্তি পেলুম। আর আপনি?

ক্লান্তির সুরে বলল, আইমা যা দেয়, তাই খাই।

 আমি বললুম, আপনি তা হলে বৌদ্ধ ভিক্ষুণী!

অন্তত হিটলারের মতো জৈন গৃহীও নই।

ইনি সব জানেন।

আমাকে চেয়ারটা কাছে টেনে আনবার অনুরোধ করে বললেন, আচ্ছা, আপনি নিওরসিস, সাইকসিস, মনমেনিয়া ইদে ফিস– এসব কথাগুলোর অর্থ জানেন?

আমি বললুম, যারা এসব নিয়ে কারবার করেন, তাঁরাই কি জানেন? এই যে আমরা নিত্য নিত্য ধর্ম, নীতি, মর্যালটি, রিয়ালিজম, আইডিয়ালিজম শব্দ ব্যবহার করি, এগুলোর ঠিক ঠিক অর্থ জানি? তবে আপনি যেগুলো বললেন, তার ভিতর একটা জিনিস সব কটারই আছে : কোনও একটা চিন্তা সর্বচৈতন্যকে এমনই গ্রাস করে ফেলে যে মানুষ তার থেকে অহোরাত্র চেষ্টা করেও নিষ্কৃতি পায় না।

দুষ্মন্ত যেরকম বলেছিলেন, তিনি শকুন্তলার চিন্তা মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারছেন না, অপমানিত জন যেরকম আপ্রাণ চেষ্টা করেও অপমানের স্মৃতি মন থেকে তাড়াতে পারে না– বার বার সেটা ফিরে আসে। তার পর বললেন, কিন্তু আশ্চর্য, কালিদাস অপমানের সঙ্গে বিরহবেদনার তুলনা দিলেন কেন? শকুন্তলা তো দুষ্মন্তকে কোনও পীড়া দেননি– অপমান দূরে থাক!

আমি বললুম শত্রু কাছে এসে দহন করে; মিত্র দূরে গিয়ে দহন করে। দুজনেই দুঃখ দেয় শত্রু-মিত্রে কী প্রভেদঃ

শহতি সংযোগে বিয়োগে মিত্রমপ্যহো।
উভয়য়োর্দুঃখ দায়িত্ব কো ভেদঃ শত্ৰুমিত্রয়োঃ?

 দুশমন দুষ্মন্তকে অপমানিত করলে তার যে বেদনা-বোধ হত, শকুন্তলার বিরহও তাকে সেই পীড়াই দিচ্ছিল। তাই বোধহয় কালিদাস উভয়কে পাশাপাশি বসিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও কিছুদিন পূর্বে বলেছেন, তার জন্মদিন ও মৃত্যুদিন কাছাকাছি এসে গেছে। একই মন্ত্রে দুজনকে আহ্বান জানাবেন।

ঘরের আলো যদিও সূক্ষ্ম মলমলের ভিতর দিয়ে রক্তাঙ্গীণ গোলাপি আভার মতো মোলায়েম, তবু শ্ৰীমতী দু হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছিলেন।

এবারে উঠে বসে আমাকে বললেন, আপনাকে সর্বক্ষণ আমার আপন কথা বলে উৎপীড়িত করার ইচ্ছা আমার নেই– বিশেষ করে বাড়িতে টেনে এনে।

আর এখন বার বার মনে হচ্ছে কী লাভ? নিউরটিক ইত্যাদি যে শব্দগুলো বললুম, তার ক-টা আমার বেলা প্রযোজ্য আমি জানিনে। কিন্তু এ-কথা দৃঢ়নিশ্চয় জানি, আমি নর্মাল নই। কখনও মনে হয়, আমার এই অনুভূতিটা সত্যের ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত, আবার হঠাৎ মাঝরাতে জেগে উঠে দেখি, সেটা সম্পূর্ণ মতিভ্রম। একটা ইদে ফি– ফিট আইডিয়া থেকে কিছুতেই নিষ্কৃতি পাইনে, এবং নিজের কোনও সিদ্ধান্তকে আর অবিচল চিত্তে গ্রহণ করতে পারিনে। তাই দয়া করে আপনি এই নিউটিক, মনমেনিয়াকের কোনও কথা গায়ে মাখবেন না।

আমি বললুম, তথাস্তু (এবং সংস্কৃতেই বলেছিলুম)। কিন্তু আপনি কী যেন জানবার জন্য আমাকে ফোন করেছিলেন?

আরেক দিন হবে। আপনি এখানে আর কতদিন আছেন?

অন্তত দেড় মাস। কয়েকদিনের জন্য ডুসলডর্ফ যাব, সেই যে বন্ধু পাউলকে ট্রাঙ্ককল করেছিলুম, তার ওখানে। আপনিও চলুন না।

বললেন, মন্দ নয়; পরে দেখা যাবে।

ইতোমধ্যে আইমা একটা বরফে ভর্তি অত্যুজ্জ্বল রুপালি বালতিতে করে এক বোতল শ্যাম্পেন আর এক বোতল মোজেল নিয়ে এসেছেন।

আমি বললুম সর্বনাশ! আইমা কী যেন একটা বললেন। শুধু মাটিলডে শব্দটি বুঝতে পারলুম। তা হলে এর ক্রিশ্চান নাম ওই।

তিনি বললেন, হোখ ডয়েচস্ হাই জর্মন– ব্যুনেন আউস্প্ৰাখে দিয়ে উচ্চারণ করার ফ্যাশান আইমার কুমারী বয়সে চালু হয়নি বলে আমরা এখনও আলজাসের ডায়লেক্ট বলি। আর বোতলগুলো যদিও অত পুরনো নয়, তবু আমার পিতার আমলের। শ্যাম্পেন নাকি পুরনো হলে খারাপ হয়ে যায়। ভালো না লাগলে মোজেলটা খাবেন।

আমি নিজে খাই আর না-খাই, এর মনে যদি একটু রঙ লাগে তবে আমি খুশি।

শুধালুম, আপনি কি এখনও ভারতীয় শাস্ত্রের চর্চা রেখেছেন? আপনার বিশেষ ইন্টারেসট কিসে?

বিষয়টা কঠিন নয়। আপনি নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, বৈদিক যুগে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার ছিল। এমনকি হোমযজ্ঞেও স্ত্রী-পুরুষে সমান অধিকার।

আমি বাধা দিলুম, ইন্ডলজি আমার সাবজেক্ট নয়। আপনি সবিস্তার না বললে মোষের সামনে বীণা বাজানোর মতো হবে।

তিনি বললেন, সে কী, আপনি তো ইন্ডিয়ান!

আমি বললুম আপনাদের ইহুদিদের মতো আমারও লয়েলটি দ্বি-ধা। আমাকে আমার পারিবারিক মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগ রাখতে হয় আর যে দেশে পুরুষানুক্রমে আছি তার অতীত গৌরবেও আমার হিস্যে আছে। তবে আমাদের দেশের মেজরিটি আপনাদের নাৎসিদের মতো নয়। আমাদের মুসলমান কবি কাজীকে হিন্দুরা মাথায় তুলে নাচে, আর সেদিন নাৎসিদের একখানা বইয়ে পড়ছিলুম, ইহুদি হাইনে সম্বন্ধে বলছে, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে অপরিচিত। উচ্চাঙ্গের রসিকতা বলতে হবে। যে লোককে ১৮১৭/২০ থেকে তাবৎ জর্মনি ও পরবর্তী যুগের রসগ্রাহী বিশ্বজন চেনে তিনি ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হঠাৎ অপরিচিত হয়ে গেলেন, যেদিন হিটলার চ্যানসেলর হলেন!

তার পর তাড়াতাড়ি বললুম, কিন্তু এসব থাক। আপনার কথা বলুন।

বৈদিক যুগে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার। স্মার্ত যুগেই সেটা কমতে আরম্ভ করল। করে করে শেষ পর্যন্ত সতীদাহ পর্যন্ত।

তার পর তিনি যেরকম সবিস্তর ধাপে ধাপে নামতে লাগলেন তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। স্মৃতির আমি জানি সামান্যই কজন হিন্দুই জানে, স্মার্ত পণ্ডিত ভিন্নঃ মৰাদি যেসব শাস্ত্রকারদের নাম তিনি বললেন, তার বারো আনাই আমার অজানা। এবং যেটা আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল সেটা এই যে, সর্বদাই তিনি চেষ্টা করছিলেন প্রত্যেক বিধানের পিছনে কী অর্থনৈতিক কারণ থাকতে পারে সেটা খুঁজে বার করার। অন্যতম মূল সূত্রস্বরূপ তিনি গোড়াতেই বলেছিলেন, কার্ল মার্কস বলেছেন, যুগান্তকারী সামাজিক বিবর্তনের পিছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কারণ –কিন্তু সেটা আমি একমাত্র কারণ বলে স্বীকার করিনে; সার্টেনলি, যদিও সেটা দি মোস্ট ইমপর্টেন্ট কারণ। এই সূত্রটি তিনি বার বার অতি সুকৌশলে প্রয়োগ করছিলেন।

সে রাত্রে তিনি যা বলেছিলেন তার সিকিভাগ লিখতে গেলে আমাকে একখানা পূর্ণাঙ্গ থিসিস বানাতে হয়!

শেষ করলেন এই বলে, শুনেছি, আপনাদের মডার্ন মেয়েরা এখন নাকি তাদের সর্ব পরাধীনতা, দুরবস্থার জন্য স্মৃতিকারদের অর্থাৎ পুরুষদের দোষ দেয়। কিন্তু সম্পূর্ণ দোষ ওঁদের নয়। মেয়েদেরও আছে। সে কথা আরেকদিন হবে। আইমা নোটিশ দিয়েছেন।

ইতোমধ্যে আমি একটি গেলাস চেয়ে নিয়ে সেইটে মোজেলে ভরে আইমার জন্য রান্নাঘরে নিয়ে যেতে বুড়ি প্রাচীন দিনের পদ্ধতিতে দাঁড়িয়ে উঠে দু হাতে দু দিকের স্কার্ট সামান্য তুলে কার্টসি করলেন। বললেন, না বাছা, অতখানি না। বসার ঘরে এসে মাটিলডের গেলাসে প্রায় সবখানি ঢেলে দিয়ে স্বাস্থ্য পান করলেন।

আমি মাটিলডেকে বললুম, আপনি না বলছিলেন, আপনি নিওরটিক? কিন্তু এতক্ষণ ধরে আপনি যে শাস্ত্র-চর্চা করলেন তার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত তো যুক্তিসঙ্গত প্রতিজ্ঞা, প্রত্যক্ষ ও ন্যায়সঙ্গত অনুমোদনের দৃঢ়ভূমির ওপর নির্মাণ করলেন। এমনকি নিওরসিসের পুনরাবৃত্তি প্রমাদ থেকেও আপনার ধারাবাহিক প্রামাণ্যবিন্যাস সম্পূর্ণ মুক্ত।

মাটিলডে ম্লান হাসি হেসে বললেন, নিওরসিস, অনুভূতির রোগ। তার হৃভূমি আমাদের হৃৎপিণ্ডে, স্মৃতিশাস্ত্র মস্তিষ্ক রাজ্যের নাগরিক।

তার পর ভেবে বললেন, সেখানেও যে হৃৎপিণ্ডের নিপীড়ন একেবারে পৌঁছায় না তা নয়। সেখানেও কিছুটা ইদে ফিস্ এসে গিয়ে মস্তিষ্ককে নতুন কিছু করতে দেয় না। অর্থাৎ আমি সেই স্মৃতিশাস্ত্রে স্ত্রীজাতি থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনও নতুন কিছুর সন্ধানে লাগতে পারিনে। এই বিষয়ে অত্যন্ত কাঁচা বই বেরুলেও, ওটাতে যে কোনও তত্ত্ব নেই জেনেশুনেও সেইটেই পড়ি। দেখি তার বক্তব্য কোথায় কোথায় আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ক্লিক্ করছে, যার কোথায় কোথায় করছে না। এতে করে কোন নবীন জ্ঞান সঞ্চয় হয়, কোন চরম মোক্ষপ্রাপ্তি! আর ওদিকে পড়ে রইল জ্ঞান-বিজ্ঞান ভুবনের নবাবিষ্কৃত খনির নব নব মণি-ভাণ্ডার– অবহেলা অনাদরে। ঠাকুরমাকে এনে দিলুম বড়দিনের নতুন স্কার্ট, জ্যাকেট, বনেট, জুতো। ঠাকুরমা মুখ গুঁজে রইলেন তাঁর স্ত্রী-ধনের সারাটোগা সিন্দুকের ভিতর। সেনিলিটি, ভীমরতি, ইদে ফিকস্।

চলুন– আইমার প্রতি সুবিচার করতে। এমনিতেই না, সেখানে অতি অবশ্য এ-সব কথা তুলবেন না।

আইমার রান্নার বর্ণনা দেব না। সুশীল পাঠক, তোমার আশি বছরের পাক্কা-পাচিকা ঠাকুরমা যদি থাকেন তবে তুমি অনায়াসে বুঝে যাবে, এঁরা মিন-নোটিশে, দ্বিপ্রহর রাত্রেও কী ভানুমতির ভোজবাজি দেখাতে পারেন।

এখানে ভোজ আমি ভোজন অর্থেই নিচ্ছি। বিক্রমাদিত্য-মহিষীর ইন্দ্রজালও অবশ্য তাতে রয়েছে। আর আমাদের জনপদ কাহিনীতেও আছে, ভোজরাজদুহিতা কালিদাসকে ভোজ দিয়ে পরিতুষ্ট করতেন।

মে মাসে রাত একটায় রাইনল্যান্ডেও বেশ শীত পড়ে। বেরোবার সময় মাটিলডে জোর করে আমার স্কন্ধে তাঁর হাল্কা ম্যাটলটি চাপিয়ে দিয়েছিলেন।

বারবা রসসার কথা যে আমার মনে ছিল না তা নয়। কিন্তু আমার হোটেল কাছেই।

ভেনুসর্বেকভেক-এ নেমেই সামনে পড়ে কাসলের বোটানিক্যাল গার্ডেনের চক্রাকার পরিখা। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দেখি অসংখ্য কুমুদিনী সৌরভজাল বিস্তার করেছে। চর্তুদিক নিঝঝুম নীরব। আমাদের গ্রামাঞ্চলের চেয়েও নীরব কারণ সেখানে বেওয়ারিশ কুকুর, বনের শেয়াল, দম্ভী মোরগা কেউ না কেউ নিস্তব্ধতা ভাঙবেই। দূরে কাইজার প্লৎসে দু-চারখানা মোটরের আনাগোনা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু এরা নিরীহ নিদ্রালুর ঘুম ভাঙানোর জন্যই যে মোটরে হর্ন থাকে সেটা এখনও জানতে পারেনি।

বুকের ভিতরটা কীরকম মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। আমি কবি নই, আর্টিস্ট নই– আমার হৃদয় স্পর্শকাতর নয়, কিন্তু অকালে বিনাদোষে হৃতযৌবনা, কিংবা আমার ছোট বোনের সখী তরুণী মাধুরীর থানকাপড়, কিংবা রবীন্দ্রনাথের বিধবা মল্লিকা একমাত্র রুগ্‌ণ সন্তানকে জলে বিসর্জন দিয়ে মকবাহিনীর কাছ থেকে লব্ধস্বাস্থ্য সন্তানকে ফিরে পাবার আশায় কঙ্কণ-বলয়হীন হাত দুখানি বাড়িয়ে যখন দেখে— দেখে সব মিথ্যা, সব বঞ্চনা– এসব দেখলে কিংবা কবি দেখালে আমার মতো মূঢ় জড়ভরতও চট করে দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে পারে না।

আমি কি ভালোবাসিনি?– আমার মতো অপদার্থ ক্ষণতরে ভালোবাসা পেয়েও ছিল– পথের ভুলে অপদার্থের প্রাণের কূলে বসন্তপবন হঠাৎ কখন এসে যায়, আর যাবার সময় ছেড়ে যায় তার অঞ্চল থেকে গ্রীষ্মের খরতাপ, রৌদ্রদাহ, তৃষ্ণাবাণ। ইচ্ছা করেই। কিন্তু সেকথা থাক। খ্রিস্টের বদনাম ছিল, তিনি মদ্যপ, তিনি নর্তকীকে সাহচর্য দেন। তিনি সব দেখেই বলেছিলেন, কাউকে বিচার করতে যেও না। পয়গম্বর বলেছেন, তোমার সবচেয়ে বড় দুশমন তোমার দুই কাঁধের মাঝখানে–অর্থাৎ তুমি নিজে। তবে কে তোমার প্রতি অবিচার করেছে সে অনুসন্ধানে আপন জান্ পানি কর কেন?

এর ভিতরকার জলন্ত বহ্নিশিখা এঁর মুখ আর হাত দু-খানিই পুড়িয়ে ফেলল কেন? ওই দুটিই মানুষের ভিতরকার মানুষকে প্রকাশ দেয়– সুখ-দুঃখ, আশা-নৈরাশ্য, তার জন্ম-মৃত্যু। বিশেষ করে মানুষের হাত দু-খানি প্রকাশ করে তার পরিবারের ঐতিহ্যগত স্পর্শকাতরতা, চিন্তাশীলতা কিংবা সে দুটি রসে রসে ভরা। মূঢ় জনের হাত দু-খানি কচ্ছপের খোলের মতো।

ইনি কি জানতেন, যখন তার বন্ধুর থিসিস তিনি টাইপ করে দিচ্ছিলেন যে, প্রত্যেকটি হরপে ঠোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার আপন কফিন-বাক্সের ডালায় স্বহস্তে একটি একটি পেরেক পুঁতছেন।

স্বামী-সোহাগিনী কার্লোটা পাগলিনীর মতো ছুটে এলেন সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের কাছে প্যারিসে, তার পর গেলেন তার ভাশুর প্রবল প্রতাপান্বিত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সম্রাটের কাছে পায়ে পড়লেন তাঁদের, তোমরাই আমার স্বামীকে পাঠিয়েছিলে মেকসিকোর সম্রাট করে। আমাকে সামান্য একমুঠো সৈন্য দাও। আমি তাকে বাঁচাতে পারব।

ওদিকে স্বামী মাকসিমিলিয়ান প্রহর গুনছেন কার্লোটার প্রত্যাবর্তন কিংবা অবধারিত মৃত্যুর জন্য। দ্বিতীয়টাই হল। খোয়ারেসের আদেশে তাঁকে দাঁড়াতে হল বন্দুকধারী সৈন্যদের সামনে। এমপেরর মার্কসিমিলিয়ান ক্ষাত্রধর্মের শেষ আভিজাত্যের প্রতীক– মৃত্যুবেদিতে দাঁড়াবার পূর্বে বন্দুকধারীদের প্রত্যেককে তিনি একটি একটি করে সোনার মোহর দিলেন।

সব খবর কার্লোটা পেলেন, প্যারিস-ভিয়েনায় ছুটোছুটির মাঝখানে। তার মাথার ভিতর কী যেন একটা ঘটে গেল। তার চোখে দেখা দিল এক অদ্ভুত দ্যুতি যার দিকে কেউই তাকাতে পারত না। পারলে তার সম্মুখ থেকে পালাত।

তার পর দীর্ঘ ষাট বৎসর ধরে তিনি কথা বলতেন ওপারের লোকের সঙ্গে। আর বার বার ফিরে আসতেন ওই এক কথায়; তাঁর স্বামীকে বলতেন, মাল, মাল, সব দোষ আমারই। আমারই সব দোষ।

আমি বিমূঢ়ের মতো কিছুতেই ভেবে পাইনে মানুষের দোষ কোথায়, তার পাপই-বা কী পুণ্যই-বা কী?

কী সদাশিব, শান্ত এই বন্ শহর। কিন্তু তাই কি? চেস্টনাট গাছের ঘন পাতা থেকে ঝরে পড়ল আমার হাতের উপর এক ফোঁটা হিমিকা। কার এ অশ্রু? আমি জানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে খুব কম মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসত– আদৌ আসত কি না জানিনে– তাই ছাত্রেরা প্রণয় জমাত বন্-বালাদের সঙ্গে। তার পর টার্ম শেষ হতেই অনেকেই চলে যেত ভিন্ন ইউনিভার্সিতে। তাই এ-প্রেমের নাম সেমেস্টার-লিবে বা এক টার্মের প্রণয়। কারও কারও প্রেম অবশ্য অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী হত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাই আপন আপন অধ্যয়ন সমাপন করে উড়ে চলে যেত এদিক-ওদিক। আর পড়ে রইত বন্-বালাদল তাদের অশ্রুজল নিয়ে।

বন্-এর আপন তরুণদলই এ পরিস্থিতির সঙ্গে সুপরিচিত।

আমার একটি ঘটনা মনে পড়ল। আমার এক বান্ধবীকে রাত্রিবেলা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ঘরমুখো রওনা হয়ে কয়েক পা এগিয়েছি এমন সময় শুনতে পেলুম বান্ধবী একতলার দিকে ডাকছে তার ঘুমন্ত ভাইকে নিচের সদর দরজা খুলে দেবার জন্য। আমার উল্টো দিক থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটি তরুণ। সে ভেবেছে মেয়েটি বুঝি আমাকে ডাকছে, আর আমি সাড়া না দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমাকে পাস করার সময় মিনতি-ভরা মৃদুকণ্ঠে বলল, এত কঠিন হৃদয় হবেন না, য়ুঙার হার (ইয়াং জেন্টলম্যান)।

সে রাত্রে বন্-এর গলিঘুচি বেয়ে বেয়ে অনেক ঘোরাঘুরি করেছিলুম। মনটা বড় অশান্ত। ভোরের দিকে হঠাৎ রোদের একজন পুলিশ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বুটের হিলে হিলে ক্লিক করে সেলুট দিল। আমি বললুম গুটন্ আবৃন্ট।

পুলিশ বলল, গুড মর্নিং বলাই কালোপযোগী হবে। ভোর হতে চলেছে।

তার পর গলা নামিয়ে বলল, এই নিয়ে আপনাকে তিনবার ক্রস করলুম। ইস্ট ভাস লো? এনিথিং রং?

এ শহরের পুলিশও দরদী। আমি বললুম, না, অনেক ধন্যবাদ।

বলল, এরকম ছন্নের মতো একা একা রাতভর ঘোরাঘুরি করে কী লাভ? চল, ওই বেঞ্চিটায় বসে আমার সঙ্গে একটা সিগারেট খাবে।

আমি নিজের প্যাকেট বের করলুম। আমার সিগারেট নিতে খুব সহজে রাজি হল না।

বলল, তুমি ভ্যাগাবন্ড নও, রাস্তাও হারাওনি, এবং চুরিতে যদি হাতেখড়ি হয়ে থাকে তবে সে অতি সম্প্রতি। আমি তোমাকে কিছুটা চিনি। কয়েক বছর আগে যখন এখানে ছাত্র ছিলে তখন আমার বিটেই তোমার বাসা ছিল। তার পর কিছুদিন তোমাকে না দেখতে পেয়ে বুঝলুম আর পাঁচটা ফেৎলেস টমাটোর মতো (জর্মনরা কেন টমাটোকে fathless বলে, জানিনে) পাস করে দেশে চলে গেছে। কিন্তু জানো, তোমাকে সে পর্যায়ে ফেলা যায় না। বিশ্বাস করবে না, তুমিই পয়লা বিদেশি যে পরীক্ষা পাস করার পর চলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছ। কিছু মনে করো না, আমি বড় খোলাখুলি কথা বলি। হ্যাঁ, তোমার সেই প্ল্যাটিনাম ব্লন্ড বান্ধবী গেল কোথায়? তোমাদের দুজনার চুল ছিল এই শহরের দুই এস্ট্রিম। সবাই তাকাত।

আমি বললুম, ও! মার্লেনে? সে বিয়ে করে ফ্রিজিয়ান দ্বীপে চলে গেছে।

তাই বুঝি ছন্নের মতো?

আমি ধীরে ধীরে বললুম, না, আজ একটি মেয়ের জীবনকাহিনী শুনে বড় দুঃখ হল। মন শান্ত হচ্ছিল না।

বলল, সরি।

সিগারেট শেষ করে শুপো উঠে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, তোমার পার্সনাল ব্যাপারে আমি টু মারতে চাইনে সে তো স্বতঃসিদ্ধ! তাই শুধু বলি এই বন্ শহরে ক্রাইম এতই কম হয় যে, দুষ্টের দমন অপেক্ষা শিষ্টের পালন করতে হয় আমাদের অর্থাৎ পুলিশের বেশি। আর্তের সাহায্য করতে গিয়ে কিন্তু আমি বার বার দেখেছি, সত্যকার সাহায্য করা অতি কঠিন, প্রায় অসম্ভব। জর্মনে একটা কথা আছে : মমতায় ভরা এই যে মায়ের শরীর, যে তার বাচ্চার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত, সে কি পারে তার মুমূর্ষ শিশুকে তার মরণে সাহায্য করতে? এইটুকু দুধের বাচ্চাকেও মরতে হয় আপন মরণ। যে অজানা পথে যেতে ত্রিশ বছরের জোয়ানও ভয় পায়, আট বছরের শিশুকেও সেই পথে পা দিতে হয়।

কে কার সাহায্য করতে পারে?

পারেন শুধু মা মেরি।

আবার দেখা হবে, য়ুঙার হ্যাঁর, শুধু শুধু মনখারাপ না করে হোটেলে গিয়ে শুয়ে পড়। আর দরকার হলে পুলিশের পুৎসির খবর নিয়ো।

বড় দুশ্চিন্তায় পড়লুম। আমার ছাত্রজীবনের ল্যান্ড-লেডি এখন থাকেন ব্যুকেবুর্গ নামক ছোট্ট শহরে। তার পাশে একটা গ্যারিসন। তিনি এসেছিলেন বলে, এবং আমার খবর জানতেন বলে আমাকে ফোন করলেন, বললেন জরুরি খবর আছে। তাঁকে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলুম তাঁর প্রিয় আম রাইন রেস্তোরাঁয়। সেখানে গিয়ে দেখি, তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমার বিস্ময় প্রকাশ করার পূর্বেই তিনি বললেন, নাৎসিদের গোয়েন্দাগিরি চরমে পৌঁছেছে। এঁদের অনেকেই দূর থেকে সুদ্ধমাত্র ঠোঁটের নড়া থেকে কথা বুঝে নিতে পারে। তাই বাইরেই জরুরি গোপন কথাটা সেরে নিই।

খবরের কাগজে নামগন্ধ নেই, লার্ক-হক জানে না, কিন্তু আমরা গ্যারিসনের কাছে থাকি, আমাদের কাছে ট্রপ মুভমেন্ট লুকানো অসম্ভব। পরশু রাতে প্রায় পঁচিশ হাজার সৈন্য গেছে চে-সুড় এটেন্ সীমান্তে। লড়াই যদি আচমকা লেগে যায়, তবে আপনি ইন্ডিয়ান, অতএব ব্রিটিশ, অতএব শত্রু। নজরবন্দি হয়ে থাকবেন। দেশ থেকে টাকা আসবে না। দুরবস্থার চরম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাই দেখেছি।

তার সদুপদেশ– না বললেও আমি বুঝলুম ইংরেজ লড়াই হারলে যে তার নিজস্ব আবিষ্কার করা ভাষায় বলে বাহাদুরিকে সাথ হটনা (বীরত্বের সঙ্গে পলায়ন! শোলার পাথর বাটি, ডুববেও ভাসবেও) সেইটি আমার অবলম্বন করা।

বললুম, চলুন, ভিতরে গিয়ে খেতে খেতে চিন্তা করি।

এ-রেস্তোরাঁর সঙ্গে ল্যান্ড-লেডির নিদেন চল্লিশ বছরের পরিচয়। মালিক, ওয়েট্রেস, সবাই উদ্বাহু হয়ে তাকে অভিনন্দন জানাল।

হঠাৎ যদি এখন আমাকে জর্মনি ত্যাগ করতে হয়, তবে তার পূর্বে মাটিলডেকে তার শেষ প্রশ্ন শুধোবার একটা সুযোগ দিতে হয়।

টেলিফোনে তাঁকে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ জানালুম আর টাপে-টোপে বোঝালুম, আমার বিশেষ প্রয়োজন।

ফিরে আসতে ফ্রাউ এশ ফিসফিস করে বললেন, কাউন্টারের পিছনে ওই ওয়েট্রেসটিকে লক্ষ করুন। বেচারি পড়েছিল এক পিচেশের পাল্লায়। একটা গরিব ডাক্তারির ছাত্র করে ওর সঙ্গে প্রণয়। মেয়েটি পুরো ছ বছর ওর খরচা যোগায়। কথা ছিল শেষ পরীক্ষার পর সে তাকে বিয়ে করবে। পরীক্ষা পাসের তিন দিন পরে বদমাইশটা এক খানদানি, ধনী মেডিকেল স্টুডেন্টকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে করেছে।

মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। আমি যেসব ঘটনা শুনতে চাইনে সেগুলোই যেন গেস্টাপো ডালকুত্তার মতো আমার পিছনে লেগেছে।

এশ বললেন, কিন্তু ধন্যি মেয়ে! রেস্তোরাঁর এই যে মালিক, সে মেয়েটাকে বড় স্নেহ করে। সে তো রেগে তার উকিল ভাইকে ফোন করে বলল, লাগাও দু-দুটো মোকদ্দমা একটা ফৌজদারি, একটা দেওয়ানি। ব্যাটাকে আমি জেলে পচাব, আর ব্যাটার ডাক্তারি লাইসেন্স দিয়ে টয়লেট পেপার বানাব। কিন্তু ওই যে বললুম, ধন্যি মেয়ে, কিছুতেই রাজি হল না কড়ে আঙুলটি পর্যন্ত তুলতে। কী আকাট, কী আকাট মেয়েগুলো!

আমি কিছু না বলে বিরাট এক পিস কাঁচের দেওয়ালের ভিতর দিয়ে মাটিলডের জন্য পথ চেয়ে রইলুম। দেখা পাওয়া মাত্র বাইরে গিয়ে তাকে সবকথা বললুম।

মাটিলডে কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে বললেন, আমি অনেককিছু আজ সকালবেলা একচেঞ্জে গিয়েই জানতে পেরেছি। আমরা সবকিছুই জানতে পাই। এমনকি, বার্লিনস্থ ফ্রান্সের রাজদূত মঁসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে পর্যন্ত কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়েছেন।

আমাকে একটু ভাবতে সময় দিন।

 খাওয়ার পর হোফ গার্ডেনে বেড়াতে বেড়াতে স্থির হল, কাল সকালের গাড়িতে আমি প্যারিস চলে যাব। ফাড়াটা কেটে গেলে আমি ফের বন চলে আসব। নইলে সে তখন দেখা যাবে।

ফ্রাই এশকে আমরা মনসটার গির্জে অবধি পৌঁছে দিলুম। আচার-নিষ্ঠ রমণী পথে আমার মঙ্গলের জন্য একটা বাড়তি মোমবাতি কিনলেন– মা মেরির পদপ্রান্তে জ্বালাবেন বলে।

মাটিলডেকে একসচেঞ্জে পৌঁছে দিয়ে বললুম, আপনার সঙ্গে ডিনার খাব। কটায় আসব?

পাঁচটার পরে যে কোনও সময়।

হিটলারের ওপর পিত্তিটা চটে গেল। একটা নিরীহ বঙ্গসন্তানকে তার ছুটিটা আরামসে কাটাতে দেয় না। কিন্তু গোস্সাটা অবিমিশ্র নয়। একটা অস্ট্রিয়ান ভ্যাগাবন্ড, যুদ্ধে ছিল মাত্র করপরেল, সে কি না আমাদের দুশমন মহামান্য ইংলন্ডেশ্বর– যার রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না, (অবশ্য ফরাসিরা বলে, ইংরেজকে ভারতীয়দের সঙ্গে অন্ধকারে ছেড়ে দিতে স্বয়ং ব দিয়ো –করুণাময় সৃষ্টিকর্তাও সাহস পান না) এবং তাঁর সবৃ কনজারভেটিভ পুষ্টিকে প্রায় চার বছর ধরে তুর্কি নাচন নাচাচ্ছে, এ-সুসমাচারটি কানে এলেই মনে হয়, ইটিকে লিপিবন্ধ করার জন্য নয়া নয়া মথি মার্কের প্রয়োজন।

অপরাহ্নের এই মধুর আলোতে কার না শরীর অলস আবেশে ভরে যায়। কাইজার পাৎসের ফোয়ারের উপর ক্ষণে ক্ষণে রামধনু লাগছে। পাশে, সেই ১৯৩০ থেকে পরিচয়ের বুড়ো উইলি দিশি-বিদেশি খবরের কাগজ বেচছে। জর্মন কায়দায় সে দি টাইমস-কে টে টিমেস উচ্চারণ করত বলে আমরা কৌতুক অনুভব করতুম। কাছে এসে কানে কানে বলল, সব বিদেশি কাগজ বাজেয়াপ্ত। একটা বাজে কাগজ কী করে এসে গেছে, সক্কলের দৃষ্টি এড়িয়ে। আমার মেয়ে পড়ে বলল, প্যারিস লন্ডনে ধুন্দুমার। বলে পুট করে আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিল কাগজখানা।

নাহ্! এখন পড়ে কী হবে? তার চেয়ে তাকিয়ে থাকব চেনাট সারির দিকে, নাকে আসবে বোটানিকসের সুগন্ধ, কানে আসবে পপেলস্ডফের এভিনিউর কাচ্চাবাচ্চাদের খেলাধুলার শব্দ, কিংবা কারও খোলা জানালা দিয়ে পিয়ানো প্র্যাকটিস। কিংবা

পা দুটো লম্বা করে একটা বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে নিয়েছি।

সামনে মাটিলডে। আপিস থেকে বাড়ি আসা-যাওয়ার পথ তার এইটেই। বললেন, কী স্বপ্ন দেখছিলেন?

আমি বললুম, সেই যে চীনা দার্শনিক বলেছিলেন, স্বপ্নে দেখলুম আমি প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছি। জেগে উঠে চিন্তায় পড়লুম, এই যে আমি ভাবছি আমি মানুষ, সে কি তবে প্রজাপতির স্বপ্ন? প্রজাপতি স্বপ্ন দেখছে, সে মানুষ হয়ে সোনালি রোদে রুপালি ঝরনার কাছে বসে চা খাচ্ছে।

মাটিলডে বললেন, স্বপ্নে যদি কিছু একটা হবেই, তবে প্রজাপতিটা লক্ষ্মীছাড়া মানুষ হতে যাবে কেন? বরঞ্চ রুপালি ঝরনা হলেই পারে। কত না পাহাড়, কত না সবুজ মাঠ, কত না পাইনবন পেরিয়ে সে হবে প্রশস্ত নদী, তার বুকের উপর দিয়ে ভেসে যাবে নলরাজের রাজহংস, ভরা পালে উড়ে যাবে ময়ূরপঙ্খী, তার বুকে কখনও উঠবে ঝড়ঝঞ্ঝা, কখনও প্রতিবিম্বিত হবে পূর্ণ চন্দ্র। সর্বশেষে সে পাবে তার চরম মোক্ষ পরমা শান্তি-সমুদ্রের সঙ্গে আপন সত্তা মিলিয়ে দিয়ে।

আমি বললুম, অন্তত মানুষ এই স্বপ্নই দেখেছে : নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ –আসলে সেটা কবি রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন।

উত্তর মেঘ ও যক্ষের স্বপ্ন।

কিছু উত্তর না দিয়ে মনে মনে বললুম, হায় সৃষ্টিকর্তা, প্রেমের ঠাকুর! কোথায় না এ-রমণী এসব কথা বলবে তার দয়িতের সঙ্গে, আর কোথায় সে এসব বলছে আমার মতো কলাগাছকে। ওমর খৈয়াম তাই পৃথিবীর উপর থুথু ফেলতে চেয়েছিলেন।

মাটিলডে কী খবর জানতে চান, সেটা আমি মোটামুটি অনুমান করতে পেরেছি, কিন্তু হায়, আমি তো তাঁকে এমন কিছু বলতে পারব না, যা শুনে তাঁর বেদনাভার লাঘব হবে। তাই তিনি সেটা না শুধালেই আমি শান্তি পাই। কিন্তু আমি যদি তাঁকে শুধোবার সুযোগ না দিই, তবে কি সেটা আমার পক্ষে অন্যায় হবে না? কাল যাচ্ছি প্যারিস। যদি সত্যি লড়াই লেগে যায়, তবে আমাদের দুজনাতে পুনরায় দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

যা হয় হবে, আমি তাকে সে সুযোগ দেব।

ব্যালকনিতে লম্বমান হয়েছি দুখানা ডেক চেয়ারে। বললুম, দুজনার ভালোবাসা যদি কোনও কমন ইনটারেস্টের চতুর্দিকে গড়ে ওঠে, তবে সেটা হয় বড় প্রাণবন্ত, মধুর ও দীর্ঘস্থায়ী। ব্রাউনিং আর মিসেস ব্রাউনিং দুজনা একে অন্যের মধ্যে মিশে যেতেন কবিতায় কবিতায়। এমনকি, শুষ্ক বিজ্ঞানও দুজন মানুষকে একই রসের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। আপনার কথা যখনই ভাবি, তখনই মনে পড়ে প্রফেসর ও মাদাম কুরির কথা।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর তিনি বললেন, আপনার এ কথাটি কালিদাসও বলে গেছেন। গৃহিণী, সচিব ইত্যাদি–অতখানি আশা আমি কখনও করিনি। এবং আমি আমাদের প্রণয়ের প্রথমদিন থেকেই জানতুম, ডিগ্রি পাওয়ার পরই তিনি চলে যাবেন আপন দেশে–না, দাঁড়ান, জানলুম কিছুদিন পরে। সংস্কৃত পড়াবার সময় তিনি মহাভারত থেকেও কিছুটা বেছে নেন। তাতে ছিল কচ ও দেবযানীর উপাখ্যান। আপনি ভাববেন না, তিনি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে ওই উপাখ্যানটিই আমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। তা হলে হয়তো তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। কিন্তু কী জানি, কে জানে–।

হঠাৎ যেন দিশে পেয়ে বললেন, দেখুন, কাল আপনাকে কথাটা বলেছিলুম, সেটা আবার, আরও জোর দিয়ে বলি, আমি নিওটিক, আমার মন যখন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছয়, তখন মনে হয়, সেইটেই ধ্রুব। আবার পরে দেখি, সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

হঠাৎ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিকৃত কণ্ঠে বললেন, শুধু এই দশ বছরের যন্ত্রণা মিথ্যা নয়।

ক্ষীণ চন্দ্রালোকে দেখি দু হাতের ফাঁক দিয়ে বয়ে বেরুচ্ছে চোখের জল। কত বৎসরের চাপা কান্না, কে জানে? এর পূর্বেও তিনি তার বেদনার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু চোখ দুটি ছলছল করতেও দেখিনি। আর এ যে-ধারা নেমে এসেছে, এ তো কোনও পরিণত বয়স্কা রমণীর কান্না নয়, এ যে অবুঝ শিশুর কান্নার মতো। ইনি যখন শাস্ত্রালোচনা করেন তখন মনে হয়, ইনি আমার পিতার বয়সী, দৈনন্দিন আচরণে মনে হয়, ইনি আমার বড়দিদির বয়সী। আর এখন? এখন দেখি তিনি কাঁদছেন আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট, আমার অভিমানিনী ছোট বোনের মতো। সে কোনও যুক্তি-তর্ক শোনে না, কোনও সান্ত্বনা মানে না। যেন সে এই বিশ্বসংসারে একেবারে একা– তার সঙ্গী শুধু তার চোখের জল।

কী আছে বলার, কী যায় লেখা?

 কিন্তু তাঁর আত্মসংযম অসাধারণ। বছরের পর বছর চোখের জল চেপে রাখার ফলে শুকিয়ে গেছে তার মুখ আর হাত দুখানা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর জীবনে এই তাঁর প্রথম ভেঙেপড়া।

তার কান্নার ভিতর দিয়ে তিনি শুধু একটি অনুযোগ প্রকাশ করেছিলেন। ডিগ্রি লাভের কয়েকদিন পরই তাঁর বন্ধু দেশে ফিরে যান। বন স্টেশনে তিনি তাকে বিদায় দেন।

তার পর তার কাছ থেকে একখানা চিঠি না, একখানা পোল্টকার্ড না, একটি ছত্র মাত্র না। নববর্ষে, জন্মদিনেও না। সেই যে বন স্টেশন থেকে তিনি বিলীন হলেন, তার পর তিনি বেঁচে আছেন কি না, সেকথাও মাটিলডে জানেন না। মাটিলডে তাঁকে দুখানা চিঠি লিখেছিলেন।

আমি জানতুম, এইবারে আমার অগ্নিপরীক্ষা আসবে, কিন্তু পূর্বেই বলেছি, আমি স্থির করেছিলুম, আমি প্যারিস পালিয়ে গিয়ে সেটা এড়াব না।

এপারে ওপারে যে পারই হোক, হয়ে যাক।

যে প্রশ্ন তিনি বার বার শুধোতে গিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বে শুধোতে পারেননি, আমি নিজের থেকেই তার উত্তর দিলুম।

ধীরে ধীরে বললুম, আমি ডা, কাণেকে চিনি। চিনি বললে ভুল বলা হবে। সামাজিক অনুষ্ঠানে লৌকিকতার দু-চারটি কথা হয়েছে মাত্র।

এবারে আমারও কড়া একটা কিছু খাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। তারই ছল করে ঘরের ভিতরে চলে গেলুম। ইনি এটা সয়ে নিন।

ফিরে এলে মাটিলডে শুধোলেন, বরোদা তো ছোট শহর; উনি নিশ্চয়ই জানেন, আপনিও বনের ছাত্র ছিলেন। সে নিয়ে কোনও কথাবার্তা হয়নি?

না, আমি চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু উনি কোনও কৌতূহলই দেখালেন না। তবে আপনি নিশ্চয় জানেন, উনি কথা বলেন অত্যন্ত কম।

মাটিলডে এক ঝটকায় খাড়া হয়ে বসলেন। প্রথমটায় বিস্ময়ে যেন বাক্যহারা। কী বললেন আপনি! পারঙ কথা বলেন কম! আমার সঙ্গে তো অনর্গল কথা বলতেন!

মনে পড়ল আমার বন্ধু সোহরাব ওয়াডিয়ার মন্তব্য। পাণ্ডুরঙ শঙ্কর কাণে সম্বন্ধে। বললুম, যখন দেখলুম তার কৌতূহল অত্যন্ত কম, তখন আমিও তার সম্বন্ধে কোনও খবর নিইনি। তৎসত্ত্বেও তাঁর কথা উঠলে আমার এক বন্ধু বলেছিলেন, আপনজনের মাঝখানে– ওই যে আপনি বললেন– উনি অনর্গল কথা বলেন।

মনে হল, মাটিলডে যেন খানিকটা সান্ত্বনা পেলেন। তাতে আশ্চর্য হবার কী? কবি রুমির দিকে তাঁর গুরু রাস্তায় তাকে ক্রস করার সময় একবার মাত্র একটুখানি স্মিতহাস্য করেছিলেন। সেইটুকুর অনুপ্রেরণায়ই তিনি রচলেন তার মহাকাব্য।

এইবারে আমার শেষ বক্তব্যটুকু বলার সময় এসেছে।

আমি বললুম, মাটিলডে, ডা. কাণের কী করা উচিত ছিল না-ছিল সে জানেন বিধি। হয়তো আপনাকে যাবার পূর্বে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে গেলে ভালো হত, হয়তো না করে ভালোই করেছেন। আপনি যদি নিওরটিকই হয়ে গিয়ে থাকেন আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না– তা হলে উনি যাই করতেন না কেন, আপনি ভাবতেন, তার উল্টোটা ভালো হত।

কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা এই : কাণে বরোদার রাজপ্রাসাদের গোপন-বিভাগে কাজ করেন। সেখানকার আইন অনেকটা ফরেন অফিসের মতো। জানেন তো, বিদেশিনীকে বিয়ে করাও ওদের মানা। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সে-অনুমতিও তারা দেয়– ওদের সিনিকাল বিশ্বাস, বরঞ্চ মানুষ তার স্ত্রীর কাছ থেকে জিনিস গোপন রাখতে পারে, প্রণয়িনীর কাছ থেকে কিছুতেই নয়; এই তো সেদিন গোয়েবলসের মতো প্রতাপশালী মন্ত্রীও এই ধরনের ব্যাপারে হিটলার কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়েছেন। নেটিভ স্টেট মাত্রই চক্রান্তের চাণক্যালয়– আর রাজপ্রাসাদ! সেখানে পরস্পরবিরোধী একাধিক গোপন বিভাগ একে অন্যের বিরুদ্ধে সর্বক্ষণ চক্রান্ত-কর্মে মত্ত। আপনার সঙ্গে পত্রালাপ ধরা পড়তই একদিন না একদিন, এবং তাঁর শত্রুপক্ষ যে সেটা কীভাবে কাজে লাগাত তার কল্পনাও আমি করতে পারিনে। কাণেকে বৃহৎ সংসার পুষতে হয়– তিনিই একমাত্র উপার্জনক্ষম।

দাঁড়িয়ে বললুম, এইবারে উঠি। কাল প্রভাতে প্যারিস গমন। হিটলার আমার সব প্রোগ্রাম তছনছ করে দিয়েছেন। সবাইকে আজ রাত্রেই চিঠি লিখে জানাতে হবে। তার ওপর প্যাকিং রয়েছে।

মাটিলডে যেন চিরকালের মতো দাঁড়ালেন। আমার কাঁধের উপর হাত রেখে প্রায়ান্ধকারে আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন। আমার মনে হল, আমি যেন তার চোখে একটুখানি জ্যোতি দেখতে পেয়েছিলুম। সত্য জানেন অন্তর্যামী।

কিন্তু মিথ্যে বলেছিলুম আমি মাটিলডেকে। অন্তর্যামী যেন ক্ষমা করেন। আমি কাণের সাফাই গাইনি। আমি চেয়েছিলুম, মাটিলডের বুকের রক্ত দিয়ে গড়া তার বল্লভ যেন ধূলিতলে লুণ্ঠিত না হয়। মাটিলডের জীবন তারই ওপর নির্ভর করছে।

প্যারিসে পৌঁছনো মাত্রই শুনি, চেক সীমান্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। হিটলার সৈন্য অপসারণ করেছেন। আমি আমার জাহাজের প্রিয়ার অনুসন্ধানে বেরোলুম না। কারণ, বনে থাকতেই তাঁর রোদনভরা প্রথম চিঠি পাই, আমি এখানে বাঁচব কী করে? এ যে বড় হৃদয়হীন জায়গা। তুমি এখানে চলে এসো না, ডার্লিং।

ভ্যাগ্যিস আমি যাইনি। দু দিন পরে দুসরা চিঠি কাল সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে বেড়াতে গিয়েছিলুম। ভেরি ইনটারেসটিং! মনে হচ্ছে এখানে তিন বছর কাটাতে পারব। সাদা চিঠির কাগজে সাদা কালিতে লেখা প্রিয়ার প্রাঞ্জল বাণীটি বুঝতে আমার লহমা-ভর সময়ও লাগেনি। বস্তুত প্রথম চিঠি থেকেই সেটা আমার বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। যে বলে, প্যারিস হৃদয়হীন, সে নিশ্চয়ই সেখানে পৌঁছনো মাত্রই পড়ি-মরি হয়ে, উদোম হিয়া নিয়ে হিয়ার সন্ধানে বেরিয়েছিল। ধন্য আমি, এহেন উদারহৃদয়ার সঙ্গে আমার হার্দিক পরিচয় হয়েছিল। ইনি কাণে গোত্রের নন; নিঃশব্দে, নীরবে মহাশূন্যে লীন হন না। প্যারিস ধন্য। মার্কিন প্রবাদ আছে, পুণ্যশীল মার্কিন মাত্রই মৃত্যুর পর জন্ম নেয় প্যারিসে।

আম্মো বেকার দিন কাটাইনি, কারণ, আমার যে কোনও কাজ নেই। করে করে তিন দিনের জায়গায় কেটে গেল দু মাস। সর্বনাশ! প্যারিস বড়ই সহৃদয়, কিন্তু দরাজ-দিল নয়। কিপটেমি শিখতে হলে প্যারিসের খাঁটি বাসিন্দাদের সঙ্গে এক সপ্তাহ বসাই যথেষ্ট। শেষটায় রু্য দা সমরারের ইন্ডিয়া ক্লাবে জাতভাইদের সর্বনাশ করে তাদের তহবিল তছরুপ করে বিজয়গর্বে বন ফিরে এলুম। একদা নেপোলিয়ন যেরকম প্যারিস থেকে বেরিয়ে হেলায় কলোন-বন্ জয় করেছিলেন।

মাটিলডেকে আমার ওপর বেশি চাপ দিতে হল না। আমি সুড়সুড় করে তাঁর ফ্ল্যাটেই ঢুকলাম।

রবিবারে একসঙ্গে গির্জেয় গেলুম।

আইমা দেখি কাণের কাছ থেকে বেশ দু-চারটে ইন্ডিয়ান ডিশ বানাতে শিখে নিয়েছিলেন। আর মাত্র তিন দিন বাকি। ভেনিস বন্দরে জাহাজ ধরে বোম্বাই পাড়ি দেব। ট্রাভেল আপিসে ভেনিস অবধি ট্রেনের টিকিট কেটে বাড়ি ফিরে দেখি ধুন্দুমার। গলা-কাটা মুরগির মতো দুই রমণী এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন।

সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য! কাণে রাজপ্রাসাদের ঠিকানা দিয়ে মাটিলডেকে কেবল করেছেন, ভারতীয় ডাক্তারের উপদেশে তিনি কঠিন রোগে আক্রান্ত তার ছেলেকে ইউরোপ পাঠাচ্ছেন। মাটিলডে তার দেখভাল করতে পারবেন কি না, যেন কেবল করে জানান।

মাটিলডের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি কেবুলের জবাব তো দিয়েছেনই, এখন বসে গেছেন আরেকটা কেবৃলের মুসাবিদা করতে। আর আমাকে প্রশ্ন, ছেলেটার বয়স কত, কী ব্যামো হতে পারে, সে নিরামিষাশী কি না, এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সে নামবে কোন বন্দরে? তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতে চান, নইলে তাকে দেখবে কে? মুসাবিদা বন্ধ করে ফোন করেন কখনও বা ট্রাভেল আপিসকে কখনও-বা তার দপ্তরকে পাওনা ছুটির মজুরির জন্য। হঠাৎ সবকিছু বন্ধ করে লেগে যান প্যাক করতে হয় যাবেন মার্সেই, নয় রোম। সেখান থেকে ইটালিয়ান যে কোনও বন্দরে পৌঁছানো যায় ঘণ্টা কয়েকের ভিতর। নইলে এখান থেকে খবর পেয়ে তিনি ইটালিয়ান বন্দরে পৌঁছতে না পৌঁছতে জাহাজ হয়তো ভিড়ে যাবে সেখানে; ট্রাভেল দফতর অভয় দেয়, তিনি মানেন না। ইতোমধ্যে তারা পিয়ন মারফত পাঠিয়ে দিয়েছে, বোম্বাই-ভূমধ্যসাগরের তাবৎ জাহাজ কোম্পানির টাইমটেবল। আমি সেগুলো অধ্যয়ন করতে লেগে গেলুম গভীর মনোযোগ সহকারে।

তাঁর দ্বিতীয় কেবল যাওয়ার পর মাটিলডের মনে জাগল আরেক ঝুড়ি বাস্তব-অবাস্তব প্রশ্ন। তৃতীয় মুসাবিদায় তিনি বসে যান।

হাত নিঙড়াতে নিঙড়াতে পায়চারি করেন আর বলেন, মাইন গট, মাইন গট হে ভগবান, হে ভগবান!

হঠাৎ ছুটে এলেন আমার কাছে। মুখ থেকে শেষ রক্তবিন্দু অন্তর্ধান করেছে। আর্তকণ্ঠে শুধালেন, হঠাৎ যদি যুদ্ধ লেগে যায়, তবে কী হবে? আমি শান্ত কণ্ঠে বললুম, নিরপেক্ষ সুইটজারল্যান্ডে চলে যাবেন। সেখানে চিকিৎসার কোনও ত্রুটি হবে না। যক্ষ্মা হলে যে সেখানেই যেতে হবে সেকথা আর তুললুম না। শুধু বললুম, বরোদার কেবল মহারাজার অজান্তে আসতে পারে না; আপনি তার সাহায্য পাবেন। জর্মন পররাষ্ট্র দফতর বরোদার মহারাজকে প্রচুর সম্মান করে। তিনি আশ্বস্ত হলেন।

গভীর রাত অবধি পাশের ঘরে তাঁর মৃদু পায়চারি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লুম।

 দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যাবেলা আমাকে বললেন, তিনি মনস্থির করেছেন, আমার সঙ্গে পরের দিন ভেনিস যাবেন।

ট্রেনে উঠেই তিনি হঠাৎ অত্যন্ত শান্ত হয়ে গেলেন। ভেনিস না পৌঁছনো পর্যন্ত এখন আর কিছু করার নেই।

গভীর রাত্রে স্লিপিং কোচের ক্ষীণালোকে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি কী প্রশান্ত মমতাময় তাঁর মুখচ্ছবি! খানিকক্ষণ পরই ইটালিতে ঢুকব– যে দেশের মাদোন্না-মাতৃমূর্তি সর্ব বিশ্বে সমাদৃত হয়। আমার মনে হল আমার এই মাটিলডের মুখে যে মাদোন্নার ছবি ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে এ ক-দিন ধরে প্রহরে প্রহরে, সে তো যে কোনও গির্জার দেবিকে উজ্জ্বল করে দিতে পারে। এ রমণী গর্ভে সন্তান না ধরেও মা-জননী মাদোন্নাদের ভিতর শাশ্বত আসন পেল।

কেন পাবে না? জাতকে আছে, একদা নিদারুণ দুর্ভিক্ষের সময় এক ভিখারিণী নগরপ্রান্তে খর্জুরবৃক্ষের অন্তরালে শিশুসন্তান প্রসব করে পৈশাচিক ক্ষুধার উৎপীড়নে গ্রাস করতে যাচ্ছিল তাকে। তারই পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক বন্ধ্যা শ্ৰেষ্ঠিনী, সন্তান কামনা করে মহাকালের মন্দিরে পূজা দিতে। মাতৃস্নেহাতুরা অনুনয় করে নবজাতককে কিনতে চাইলেন। পিশাচিনী অট্টহাস্য করে উত্তর দেয়, তার ক্ষুধা মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা করতে পারবে না। বরনারী বললেন, তবে তিষ্ঠ; এই যে আমার বন্ধ্যাবক্ষের সুপুষ্ট স্তন, অকর্মণ্য নিষ্ফল এ স্তন কোনও শিশুকে দুগ্ধ যোগাতে পারেনি– এটা আমি খর্জুরপত্র দ্বারা কর্তন করে তোমাকে দেব। তোমার ক্ষুধা নিবৃত্ত হবে। পাগলিনী আবার অট্টহাস্যে বলল, তুমি জানো না, আপন হাতে আপন মাংস কর্তন করাতে কি অসহ্য বেদনা, তাই বলছ। রমণী বাক্যব্যয় না করে কর্তন আরম্ভ করতে না করতেই দরদর বেগে নির্গত হল সেই বন্ধ্যা স্তন থেকে রক্তের বদলে অফুরন্ত মাতৃদুগ্ধ। ভিখারিণী-শিশু উভয়েই সে দুগ্ধ পান করে পরিতৃপ্ত হল। অলৌকিক অবিশ্বাস্য এ ঘটনার কথা শুনে তথাগতের শিষ্যরা তিনজনকেই নিয়ে এলেন তার সামনে। অমিতাভ সানন্দে বললেন, মাতৃস্নেহ অলৌকিক ক্রিয়া উৎপাদনে সক্ষম।

বঞ্চিতা মাটিলডের মুখে দিব্য জ্যোতি দেখা দেবে না কেন?

.

ভেনিস বন্দরে জাহাজের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মাটিলডে আমার হাত ধরে বার বার অনুরোধ করলেন, আমি যেন বোম্বাই পৌঁছেই কেবল করি, ছেলেটি কবে কোন জাহাজে ইউরোপ পৌঁছচ্ছে। তার চোখে জল, কিন্তু তাতে আনন্দের রেশও ছিল।

বোম্বাই পৌঁছে খবর নিয়ে জানলুম, ছেলেটি চলে গেছে। মাটিলডেকে পাকা খবর জানিয়ে দিলুম।

বরোদায় পৌঁছবার মাসখানেক পরে বন্ধু ওয়াডিয়া– তাঁকে এসব কিছুই বলিনি– কথায় কথায় বললেন, কাণের ছেলেটি কখন যে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে কেউ টের পায়নি। খাটের উপর একখানা চিরকুট পাওয়া যায়। অসুস্থ শরীর নিয়ে সে চিরজীবন কারও বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি।

আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোয়নি। হা হতভাগ্য! তুমি জানতেও পারলে না, স্বয়ং মা মেরি তোমার জন্য বন্দরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন।

আর মাটিলডে!

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *