মদ্যপন্থা ওরফে মধ্যপন্থা
মদ্যপান ভালো না মন্দ সে নিয়ে ইউরোপে কখনও কোনও আলোচনা হয় না–যেমন তাস খেলা ভালো না মন্দ সে-নিয়েও কোনও তর্কাতর্কি হয় না। কিন্তু একথা সবাই স্বীকার করেন। যে মাত্রাধিক মদ্যপান গহিত এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক যেরকম তাস খেলাতে মাত্রাধিক বাজি রেখে, অর্থাৎ সেটাকে নিছক জুয়ো খেলায় পরিণত করে সর্বস্ব খুইয়ে দেওয়া নিশ্চয়ই অনুচিত।
এ দুটো ব্যসন যে আমি একসঙ্গে উত্থাপন করলুম সেটা কিছু এলোপাতাড়ি নয়। কুরান শরিফে এ-দুটিকে একসঙ্গে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এ দুটির উৎপত্তিস্থল স্বয়ং শয়তান। তৎসত্ত্বেও ইদানীং পূর্ব পাকিস্তানের একখানি দৈনিকে আলোচনা হচ্ছে, মাত্রা মেনে, অতিশয় সাবধানে কিংবা স্বাস্থ্যলাভের জন্য সামান্য মদ্যপান করা শাস্ত্রসম্মত কি না? এ বিষয়ে উকৃষ্ট আলোচনার জন্য যতখানি মুসলিম শাস্ত্রজ্ঞান থাকা উচিত আমার সেটি নেই। এবং শাস্ত্র ছাড়া লোকাঁচার, দেশাচার নামক প্রতিষ্ঠান আছে। উভয় বাঙলার এই দুটি আচারে মদ্যপান নিন্দিত। বরঞ্চ পশ্চিম বাংলার কোনও কোনও জায়গায় তাড়ির প্রচলন আছে– পুব বাঙলায় সেটাও নেই, অন্তত আমার চোখে পড়েনি।
মোদ্দা কথা এই যে, ভারতবর্ষের শিক্ষিত সমাজে এবং অধিকাংশ অশিক্ষিত সমাজে মদ্যপান নিয়ে যে আলোচনা হয় সেটা নীতির দৃষ্টিবিন্দু থেকে, অ্যাজ এ প্রিন্সিপল। অর্থাৎ হিন্দুর কাছে গোমাংস যেমন আত্যন্তিকভাবে বর্জনীয় অতি সামান্য অংশ খাওয়াও মহাপাপ-মুসলমানের কাছে শূকরমাংসও সেইরূপ। তাই এদেশে মদ্যপান ঠিক সেইরকমই বর্জন করতে হবে কি না সেই প্রশ্নটা মাঝে মাঝে ওঠে।
ইতোমধ্যে ঔষধের মাধ্যমে অনেকেই সেটা প্রতিদিন পান করছেন– জানা-অজানায়। বেশিরভাগ টনিকেই পনেরো, সতেরো পার্সেন্ট অ্যালকোহল থাকে। একটি তরুণ অ্যালকোহলের তত্ত্ব না জেনে আমাকে এক বোতল টনিক দিয়ে বলল, অত্যুকৃষ্ট টনিক, স্যর! খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাথাটা চিম চিম করে, শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়। আমি মনে মনে বললুম, বটে! ফুর্তিটা টনিকের ওষুধ থেকে না ওই ১৭ পার্সেন্ট মদ থেকে সেটা তো জানো না বৎস! অর্থাৎ পুচ্ছটি উত্তোলন করে–ইত্যাদি। কারণ টনিকবর্জিত ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল সমন্বিত যে কোনও মদ্য পান করলেই মাথাটা চিম চিম করে শরীরে বেশ ফুর্তির উদয় হয়।
ভলতেয়ারের একটি আপ্তবাক্য এত বেশি সুস্বাদু, এত বেশিবার মনে পড়ে যে সেটা আবার বললে পাঠক যেন বিরক্ত না হন। ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের যখন অতি সামান্য কিছুটা ইউরোপে পৌঁছেছে তখন একশ্রেণির কুসংস্কারবাদী বলতে আরম্ভ করল, ভারতবাসীরা মন্ত্রের জোরে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। ওই সময় এদেরই একজন ভলতেয়ারকে শুধোয়, মন্ত্রোচ্চারণ করে একপাল ভেড়া মেরে ফেলা যায় কি না? ভলতেয়ার একটু বাকা হেসে বললেন, নিশ্চয়ই। তবে যাতে কোনও গোলমাল না হয় তার জন্য আগের থেকে পালটাকে বেশ করে সেঁকো খাইয়ে দিয়ো।
এই হচ্ছে আসল তত্ত্ব কথা– সেঁকোটাই সত্য; মন্ত্রটা থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।
ঠিক তেমনি ওই যে টনিকের কথা একটু আগে বললুম, তার ওই ১৭ পার্সেন্টটাই সত্য; বাকি যেসব ওষুধ-বিষুধ আছে সেগুলো থাকলে ভালো– ইত্যাদি।
ঠিক তেমনি ছেলে বাড়িতে নিজের চেষ্টায় পরিশ্রম করে যেটুকু শেখে সেইটেই সেঁকো, সেইটেই ১৭ পার্সেন্ট অ্যালকোহল। তারই জোরে ছেলে পরীক্ষা পাস করে– আমরা মাস্টাররা ক্লাসে যা পড়াই সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো; থাকলে ভালো, না থাকলে নেই।
এই যে দেশটা চলছে সেটা জনসাধারণের শুভ বা অশুভ বুদ্ধি দ্বারা সরকার যেটা আছে, সেটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো। এবং আজকাল তো আকছারই সেই মন্ত্রোচ্চারণও ভুলে ভুলে ভর্তি। থাক আর না। বৃদ্ধ বয়সে জেলে গিয়ে শহিদ হতে চাইনে!
ইউরোপীয়রা টনিকের অবান্তর মন্ত্রোচ্চারণ অর্থাৎ ওষুধটা বাদ দিয়ে শুধু অ্যালকোহলটাই খায়, তবে ১৭ পার্সেন্টের মতো কড়া করে নয়। কেউ খায় স্টাউট, কেউ খায় পোর্ট।
প্রাচ্যে ইহুদি, ক্যাথলিক ও পারসিদের ধর্মানুষ্ঠানেও কিঞ্চিৎ মদ্যের প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু যাজক সম্প্রদায়ের সকলেই অত্যধিক মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রচারকার্য করে থাকেন।
গল্পচ্ছলে প্রচলিত আছে :
দ্বিপ্রহর রাত্রে এক ধার্মিক যুবক
নিদ্রা যায়; ওই তার একমাত্র শখ।
একমাত্র সুখ তার ওই নিদ্রা বটে,
–পিতা তার বৃদ্ধ অতি, কখন কী ঘটে।
ভগিনীটি বড় হল, বিয়ে দেওয়া চাই
দিবারাত্রি খাটে, আহা, গোনে কড়ি পাই।
যৌবনের লোলচর্ম হল অস্থি-সার
নিদ্রাতেই ভোলে তাই নির্দয় সংসার ॥
আপনারা তো আর কেচ্ছা সাহিত্য পড়েন না। হায়, আপনারা জানেন না, আপনারা কী নিধি হারালেন! বিদ্যাসুন্দর পড়ে যখন আনন্দ পান, তখন কেচ্ছা সাহিত্যে নিশ্চয়ই পাবেন।
আমার নিজের বিশ্বাস, কেচ্ছা সাহিত্যের অনুপ্রেরণাতেই বিদ্যাসুন্দরের সৃষ্টি। তা সে যাক।
এবারে কেচ্ছাটাই শুনুন :
এই কেচ্ছা শোনে যেবা এই কেচ্ছা পড়ে
উত্তম চাইল পাবে রেশনে না লড়ে।
বারো আনা দরে পাবে কিলোর ইলিশ।
সরিষার তেল পাবে না সয়ে গর্দিশ।
দেড়টি টাকায় কিলো শোনো পুণ্যবান
খুশিতে ভরপুর হবে জমিন আসমান।
এ সংসারে যে মেলা পাপ মেলা দুঃখ সে বিষয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলো আসে কোথা থেকে? সেমিতি– অর্থাৎ ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলিম গুরুরা বলেন, শয়তান মানুষকে কুপথে নিয়ে গিয়ে পাপ-দুঃখের সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ভারতীয় তিনটি ধর্মেরই বিশ্বাস পূর্বজন্মের অর্জিত পাপপুণ্যের দরুন এ জন্যেও সুখ-দুঃখ দেখা দেয়– কাজেই হিন্দুধর্মে শয়তানের প্রয়োজন নেই। একদা কিন্তু এই হিন্দুধর্মেও শয়তান জাতীয় একটি অস্তিত্বের আবির্ভাব হয়ে উপযুক্ত প্র্যাকটিসের অভাবে লোপ পায়।
নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান যদিও মহাভারতে স্থান পেয়েছে তবু আমার বিশ্বাস মূল গল্পটি বৈদিক যুগেও প্রচলিত ছিল। গ্রিক দেবতা প্রমিথিয়ুস চোঙা বা নলের ভিতর করে আগুন চুরি করেন; নলরাজও ইন্ধন প্রজ্বলনে সুচতুর ছিলেন। স্বয়ং দেবতারা প্রমিথিয়ুসের শত্রুতা করেন। নলের শত্রুতা করে স্বয়ং দেবতারা দময়ন্তীর স্বয়ংবরে উপস্থিত হন– নলকে তাঁর বল্পভা থেকে বঞ্চিত করার জন্যে।
এই নলের শরীরে পাপ কলিরূপে প্রবেশ করেন। এই কলিই আর্যধর্মে শয়তানের অপজিট নাম্বার। মনে করুন সেই শয়তান বা কলি ওই নিদ্রিত যুবকটির সামনে দিল দেখা :
হঠাৎ দেখিল মর্দ সম্মুখে শয়তান
নিদ্রা তার সঙ্গে সঙ্গে হৈল খানখান।
শয়তানের হাতে হেরে ভীষণ তরবার।
আকাশ-পাতাল জুড়ে ফলাটা বিস্তার।
ত্রিনয়ন, কণ্ঠে তার নৃমুণ্ডের মালা
জিহ্বা তার রক্তময় যেন অগ্নি ঢালা।
ইটি আসলে কথকতা। অতএব তাবৎ বক্তব্য ছন্দে দিলে রসভঙ্গ হয়।
যুবক বেতস পত্রের ন্যায় কম্প্রমান!
শয়তান হুঙ্কার দিয়ে বলল, আজ থেকে স্বর্গ-মর্ত্য আমার পরিপূর্ণ দখলে এসেছে। তোকে আমি এই তরবারি দিয়ে দুই টুকরো করব। তার পূর্বে আমার স্তব গেয়ে নে।
যুবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার মরতে কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু আমি মরে গেলে আমার বৃদ্ধ পিতার জন্যে কে অন্ন আহরণ করবে? আমাকে তুমি নিষ্কৃতি দাও।
শয়তান ক্ষণতরে চিন্তা করে বলল, তোমাকে ছাড়তে পারি এক শর্তে। তুমি তোমার পিতাকে হত্যা কর। তা হলে তোমার সমস্যারও সমাধান হয়! শয়তান অট্টহাস্য করে উঠল।
পুত্র আর্ত ক্রন্দন করে বলল, অসম্ভব! সম্পূর্ণ অসম্ভব!
পিতা মোরে জন্ম দিল বাল্যেতে আরাম
কেমনে হইব আমি নেমকহারাম!
নেমকহারাম শুনে শয়তানের ক্রোধ চরমে পৌঁছেছে। কারণ সে একদা আল্লার সঙ্গে নেমকহারামি করেছিল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে হিত অবশ্য শয়তানের ধারণা অনুযায়ী যেটা হিত– বলল, তা হলে তুমি তোমার ভগিনীকে ধর্ষণ কর।
যুবা এবারে আর কোনও উত্তর দিল না। সে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল।
কিন্তু শয়তানের এ ব্যবস্থা মনঃপূত হবে কেন? সে চায় যুবাকে দিয়ে পাপ করাতে। তাই অন্য ট্যাকটিক অবলম্বন করে বলল, তোমাকে শেষ মুক্তির উপায় দিচ্ছি। এই নাও, এক পাত্র মদ্য পান কর।
যুবা ভাবে :
মদ্য পান মহা পাপ সর্ব শাস্ত্রে কয়।
এ পাপ করিলে গতি নরকে নিশ্চয়।
যাইব নরকে আমি নাহি কোনও ডর
শয়তানের শর্ত হীন, পাপিষ্ঠ, বর্বর।
অনিচ্ছায় সে করল মদ্য পান। তার পর কাহিনীটি সংক্ষিপ্ত।
মদ্যপান করে পরিপূর্ণ মত্তাবস্থায় পাপপুণ্যজ্ঞানহীন যুবা শয়তানের ওই হীন পাপিষ্ঠ বর্বর কর্ম দুটি করে ফেলল।
কাহিনীটি সর্বত্র বলা চলে না। কিন্তু যে মহাজন এটির কল্পনা করেন তিনি স্পষ্টত কাউকে ছেড়ে কথা বলতে চাননি, কোনও পাপ শেয়ার করতে চাননি। পৈশাচিক বীভৎস রস সৃষ্টি করে সর্বমানবের হৃৎকন্দরে ভগবানের ভয় প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন।
এ তো গেল এক পক্ষ। অন্য পক্ষ কী বলেন, তার অনুসন্ধান আমি বহুকাল ধরে করে আসছি। কারণ আরব তথা অন্যান্য প্রাচ্যভূমিতে এ তথ্য সর্বাদিসম্মত যে, হেন কাহিনী এ পৃথিবীতে নেই যার বিপরীত গাথাও নির্মিত হয়নি। সেটিও পেয়েছি।
কিছুকাল পূর্বে টুরিজম-প্রসার সংস্থার আমি সদস্য হয়ে যাই আমার একমাত্র গুণ যে, কোনও দেশই আমাকে দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারে না বলে আমি সে-দেশ থেকে সংক্ষেপে বিতাড়িত হই, ফলে আমার বহু দেশবাস, বহু দেশদর্শন হয়। এসব দেশের দেওয়ানি আদালতে দেউলেদের যে লিস্ট টাঙানো থাকে তার প্রত্যেকটিতে আমার নাম পাবেন। যদি কোনওটিতে না পান তবে বুঝে নেবেন সে দেশে আমি নাম ভাঁড়িয়েছিলুম। বস্তুত আমি কোনও দেশের, কি স্বদেশের কি বিদেশের, কারও কাছে অঋণী থেকে মরতে চাইনে।
সেই টুরিজম সংস্থার এক মিটিং-এ জনৈক সজ্জন সভারম্ভেই বলেন, ভদ্রমহোদয় ও মহিলাগণ, কর্মসূচি আরম্ভ করার পূর্বেই আমার একটি বক্তব্য নিবেদন করি।
প্রবাদ আছে, মুরগি-ঘরে যদি শ্যাল ঢুকতে দাও, তবে সকালবেলার মমূলেটটির আশা ত্যাগ করেই কর। তাই যদি দেশ থেকে মদ্যপান একদম ঝেটিয়ে বের করে দাও, তবে ইউরোপীয় টুরিস্টের আশা কর না; সে মমূলেটটি আমাদের প্লেট থেকে অন্তর্ধান করবে। অতএব, আপনারা এবং আপনাদের সরকার স্থির করুন, আপনারা টুরিজম্ চান, না দেশকে মদ্যহীন করতে চান। আমার কাছে দুই-ই বরাবর।
ভারি স্পষ্ট বক্তা। ওদিকে মুরুব্বিদের অনেকেই গান্ধীটুপি পরিহিত। এটাও চান ওটাও চান, কিন্তু কী করে উলঙ্গ ভাষায় বলেন, মদটা না হয় থাক। ওঁদের মতলব, এমন এক অভিনব কৌশল বের করা, যার প্রসাদে আণ্ডা না ভেঙেও মমলেট বানানো যায়! অতএব এসব ক্ষেত্রে যা উইদাউট ফেল করা হয় তাই সাব্যস্ত হল। পোস্টপোন কর।
মিটিঙের শেষে আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। আমি শঙ্কিত হয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিলুম। সরকারি পয়সায় লাঞ্চকে আমি লাঞ্ছনা নাম দিয়েছিলুম। ওদের ডিনারকে অনেকে সাপার বলতেন। আমি বলতুম suffer : সংক্ষেপে দুপুরে লাঞ্ছনা, রাত্রে suffer.
আমার অবস্থা দেখে সেই স্পষ্টভাষী বক্তা আমাকে সন্তর্পণে গাধা-বোটের মতো টেনে টেনে করিডরে রব করে দে ছুট ভদ্রতা বাঁচিয়ে। সেই হোটেলেই তাঁর কামরা ছিল। সেখানে বসে আমার হাতে মেনু এগিয়ে দিলেন। উক্তৃষ্ট আহারাদি এল। তার পূর্বে জিন এল, বিয়ার এল। তিনি খেলেন সামান্যই।
বললেন, যতসব আদিখ্যেতা। কোনও জিনিসে একটা ক্লিয়ার পলিসি নেই। বিশ্বসুন্দু লোক মদ খেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি দিক, এটা কেউই চায় না। ফ্রান্সের মতো অ্যালকহলিজম একটা সমস্যারূপে দেখা দিক, সেটাও কেউ চায় না। অথচ ইংরেজ তথা তাবৎ ইউরোপীয়রা বিজনেস পাকাঁপাকি করে দুপুরবেলা বারে দাঁড়িয়ে।
আমাকে বললেন, শুনেছি আপনি সাহিত্যিক। একটা ওই মতিফের (ধরনের) গল্প শুনবেন?
আমি বললুম আলবত, একশোবার।
হরপার্বতী সাইক জানেন? অর্থাৎ তাদের নিয়ে জনসাধারণের গল্প? তারা যে একে অন্যের সঙ্গে বাজি ধরেন?
এটা তারই একটা।
হরপার্বতী শূন্যমার্গে উড়ে যাচ্ছেন। আকাশ থেকে দেখতে পেলেন ঝাঁকে ঝাঁকে পুণ্যার্থী গঙ্গাস্নান করছে। পার্বতী তাই দেখে মৃদুহাস্য করলেন।
শিব বললেন, কী হল?
পার্বতী খিলখিল করে হেসে বললেন, এবারে তোমার নরকের পথ বন্ধ হল। বিষ্ণু বহুকাল ধরে যমের ওই পশ্চিমের বাড়িটা চাইছিলেন সেটা পেয়ে যাবেন। বেচারি যম! জানো, যমের সহোদর উকিল-ডাক্তারদের পসার কমে গেলে তাদের কী অবস্থা হয়?
পসার কমবে কেন? শিব শিবনেত্র হয়ে শুধোবেন।
কৌতুকে হাসিলা উমা কটাক্ষে লক্ষিয়া হর পানে। বললেন, কে আর যাবে নরকে? দেখছ। না, তামাম দুনিয়ার লোক হদ্দমুদ্দ হয়ে গঙ্গাস্নান করছে। সবাই হবে নিষ্পাপ। নরকে যাবে। কে? তোমাকে বলিনি পই পই করে ওই গঙ্গাটাকে তাড়াও। আমার হোস্টটি গল্প থামিয়ে শুধালেন, জানেন বোধহয়, গঙ্গা হলেন পার্বতীর সতীন!
গঙ্গা তরঙ্গিনী, শিবের শিরোমণি।
হোস্ট বললেন, শিব এই গঙ্গাস্নানের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন, কিন্তু তার পূর্বেই
হর প্রতি প্রিয়ভাবে কন হৈমবতী,
বৎসরের ফলাফল থাক, পশুপতি!
যমের রাজত্ব যাবে এইটুকু জানি
অমৃত-রেশন-শপও স্বর্গ নেবে মানি।
ভেজাল না হয় শুরু এই লাগে ভয়
স্বর্গের হাউসিং লাগি চিন্ত মহাশয়।
থুড়ি! আর কথকতা নয়। আমার হোস্ট এ-পদ্ধতি অবলম্বন করেননি।
শিব কল্কেটা রথের স্টারগার্ড-এ (আকাশে মাড়-এর পরিবর্তে আকছারই নক্ষত্র চূর্ণ উড়ে এসে রথটা ধূলিময় করে বলে ওটা স্টারগার্ড) কল্কেটা ঠুকে ঠুকে সাফ করতে করতে বললেন, কিছু ভয় নেই ডার্লিং। যারা স্নান করছে তারা এর পুণ্যফলে বিশ্বাস করে না।
পার্বতী তাজ্জব মেনে বললেন, সে কী! তাবৎ পুরাণে যে পষ্ট লেখা রয়েছে। এখন তো ছাপাও হচ্ছে, বেতারেও প্রচার হয়, যে-পণ্ডিত নেহরু
শিব তখনও ইন্ডিয়ার উপরে। ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া আইনের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি বললেন, আমার কথা বিশ্বাস কর, আমি প্রমাণ করতে পারি।
যথারীতি দুজনাতে বাজি ধরা হল– সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের ভিতর শিব প্রমাণ করবেন, গঙ্গাস্নান যারা করে তারা মা-গঙ্গার কল্যাণে নিষ্পাপ হল বলে বিশ্বাস করে না।
অতি প্রত্যুষে বাজির চুক্তিমতো পার্বতী রাজরাজেশ্বরীর মহিমাময় সজ্জা পরে কিন্তু অতিশয় বিষণ্ণ বদনে বসলেন গঙ্গাতীরে। আর তার কোলে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে রইলেন শিবঠাকুর– তাঁর সর্বাঙ্গে গলিত কুষ্ঠ!
গঙ্গাস্নান সেরে উঠে এ দৃশ্য দেখে প্রথম ব্রাহ্মণ অবাক। কৌতূহল দমন না করতে পেরে দরদী কণ্ঠে শুধাল, মা, এ কী ব্যাপার!
নিখুঁত ক্ষুদ্র দুটি নাসারন্ধ্র দিয়ে উষ্ণতম দীর্ঘশ্বাস ফেলে পার্বতী বললেন, বাবা, আমার কপাল। দেখতেই তো পাচ্ছেন, আমার স্বামীর অবস্থা। তবে ভগবানের দয়ায় এক গণক্তারের সঙ্গে দেখা। সে তার হাত দেখে বলেছে, কোনও নিষ্পাপ পুরুষ তাকে স্পর্শ করা মাত্রই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবেন।
ব্রাহ্মণ কাঁচুমাচু হয়ে হ্যাঁ মা, তা মা, বলে বাং মাছটির মতো মোচড় মেরে হাওয়া।
পার্বতী তো বজ্রাহত। লোকটা এইমাত্র গঙ্গাস্নান করে নিষ্পাপ হয়ে মা গঙ্গার কোল থেকে বেরিয়ে এল। তার মুখেও দয়ামায়ার চিহ্ন। তবে কি তবে কি গঙ্গাস্নানে তার বিশ্বস—! শিব মৃদুহাস্য করলেন।
কিছুক্ষণ পরেই আরেক স্নান-সমাপ্ত দ্বিজ। কথোপকথন পূর্ববৎ। বাং মাছের মোচড়টিও তদ্বৎ। পার্বতী দিশেহারা। ভোলানাথ আস্যদেশ বিস্তীর্ণ করলেন।
চলল যেন প্রসেশন। পার্বতীর গলা থেকে একই রেকর্ড বেজে চলল। ফল একই। ধূর্জটি গণ্ডা দুই হাই তুলে পদ্মনাভ স্মরণে এনে ঘুমিয়ে পড়লেন। দেবসমাজে এই হল ঘুমের বড়ি সনেরি।
করে করে বেলা দ্বিপ্রহর। ভেঙে গেছে প্রভাতের হাট, কোলাহল থেমে গেছে, জনপদঘাট পান্থহীন। গঙ্গাতীরও ভূতনাথের শ্মশানসম নির্জন।
অপরাহ্ন। পার্বতীর ক্লান্তি এসে গেছে। বললেন, নন্দীকে ডাকো, বাড়ি যাই। আমি হার মানলুম।
শিব বললেন, সন্ধ্যা অবধি থাকার কথা। তাই হবে।
এ তো কলকাতা নয় যে বাবুরা হাওয়া খেতে সন্ধেবেলা গঙ্গাতীরে আসবেন। কাগ-কোকিলও সেখানে আর নেই।
এমন সময় ক্ষীণ কনে দেখার মিলোয় মিলোয় আলোতে দূর থেকে দেখা গেল এক ইয়ার-গোছ নটবর। ডান হাত দিয়ে তুড়ি দিতে দিতে গান গাইছে, লে লে সাকি, ভর দে পেয়ালা। বা বগলে হাফ-পাট। বদনটি তার প্রফুল্ল। আপন মনে গান গাইতে গাইতে এদিক পানেই আসছে।
আসন্ন সন্ধ্যায় নির্জন গঙ্গাতীরে অপরূপ সুন্দরী দেখে সে থমকে দাঁড়াল। আপন মনে মাইরি বলতে না বলতে হঠাৎ তার চোখ গেল সিঁথির সিঁদুরের দিকে। মাতাল যে কখন আচম্বিতে অকারণ পুলকে নেচে ওঠে, আর কখন যে সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ লজ্জা পেয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সেটা পাকা শুড়ির গুঁড়িও আগেভাগে বলতে পারে না। এবং মাতালের পুলক এবং কুণ্ঠা দুই-ই তখন পৌঁছয় চরমে, হাফাহফি সন্ধিসুলের বেনের পথই যদি সে নেবে তবে তো সে নর্মাল! বোতলে পয়সা বরবাদ করবে কেন?
মাতালের কৌতূহল হল। তদুপরি সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবুদ্ধিও জাগ্রত হল। মেয়েটাকে সাবধান করে দেওয়া উচিত। এই ভরসন্ধেবেলায়–
কুণ্ঠায় যেন আপন পাঞ্জাবির ভিতর মায় পা দুখানা, সর্বশরীর লুকিয়ে নিয়ে বলল, মা, এই অবেলায়, আপনি এখানে, জানেন না, কী বলব, কিন্তু কেন?
পার্বতী মাতাল দেখে প্রথমটার সঙ্কুচিত হয়ে ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন। মাতাল কিন্তু মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ঠায় দাঁড়িয়ে। কী আর করেন জগন্মাতা পার্বতী? আর বলাও তো যায় না, মাতাল! কখন রঙ বদলায়।
থেমে থেমে বললেন, তার হ্রস্ব কাহিনী হ্রস্বতর নির্যাসরূপে।
সঙ্গে সঙ্গে মাতালের মুখে উৎসাহ আর আনন্দের দ্যুতি। হাসিও চাপতে পারে না।
কোনও গতিকে বলল, হায় রে হায়, এই সামান্য বিষয় নিয়ে মা, তোমার দুর্ভাবনা! তুমি এক লহমা বসো তো মা শান্ত হয়ে।
তার পর বলল, চতুর্দিকে কিন্তু চোর-চোট্টার পাল। হেঁ হেঁ মা, কিছু মনে কর না, ওই যে রইল বোতলটা তার উপর আধখানা চোখ রেখ।
বিড়বিড় করে আপন মনে বলল, এই মাঘের শীতের ভরসন্ধেবেলা চানটা না করিয়ে ছাড়লে না। মহামূল্যবান নেশাটাও মেরে যাবে দড়কচ্ছা। তা আর কী করা যায়?
ঝপ করে গঙ্গায় এক ডুব মেরে উপরে উঠে খপ করে ধরল শিবের ঠ্যাঙখানা।
বত্রিশ নয় যেন চৌষট্টিখানা দাঁত বের করে বলল, হল মা-জননী? এই সামান্য জিনিসটের জন্যে তুমি এতখানি ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল? ছিঃ মা, তোমার বিশ্বাস বড় কম!
মাঝ গাঙের দিকে তাকিয়ে বলল, ওইটে কি তোমাদের নৌকো? কে যেন ডাকছে? আমি তা হলে আসি। আমার আবার বেতো শরীর। পেন্নাম হই মা, বাবাজি সেরে তো উঠল– এবারে একটু ইয়ে মানে সাবধানে।
লাঞ্চ শেষ হয়ে এসেছে। সোফায় বসে সিগার ধরিয়ে হোস্ট বললেন, দেশ বোন-ড্রাই হোক কিংবা উচ্ছন্নে যাক– আমার কিচ্ছুটি বলার নেই। কিন্তু দু-একটা মাতাল না থাকলে ডেয়ারিং কাজ করবে কে?
আমারও নিজের কিচ্ছুটি বলার নেই। আমি দু পক্ষেরই বক্তব্য নিবেদন করলুম মাত্র।
আমি পক্ষ নেবই-বা কেন? এক পক্ষ বলছেন আমাকে ড্রাই করে ছাড়বেন, অন্য পক্ষ বলছেন, আমাকে ভিজিয়ে দেবেন। দু পক্ষেই দারুণ লড়াই।
দুটো কুকুর যদি একটুকরো হাড়ি নিয়ে লড়াই করে, হাড্ডিটা তো তখন কোনও পক্ষে যোগ দিয়ে লড়াই করে না।
.