কোষ্ঠী-বিচার

কোষ্ঠী-বিচার

আমি তো রেগে টং।

মুসলমান বাড়িতে সচরাচর গণস্কার আসে না, যদিও শুনেছি ঔরঙ্গজেবের মতো গোড়া মুসলমান, হিটলারের মতো কট্টর বিজ্ঞান-বিশ্বাসীরা নাকি রাশিকুণ্ডলী মাঝে-মধ্যে দেখে নিতেন। আমাদের বাড়িতে গণস্কার এসেছিল। তা আসুক। মেয়েরা জটলা পাকিয়েছিল। তা পাকাক। কাউকে রাজরানি, কাউকে রাজেশ্বরী, কাউকে ডাক্তার হওয়ার আশা দিয়ে গিয়েছে তা দিক, তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমি রাগে টং হলুম যখন শুনলুম, পাশের বাড়ির আট বছরের মেয়ে মাধুরীলতা, আমার বোনের ক্লাসফ্রেন্ড, সে-ও নাকি এসেছিল এবং গণকার বলেছে, তার কপালে বাল-বৈধব্য আছে।

বাল-বৈধব্য তার কপালে থাকতেও পারে, না-ও থাকতে পারে– আমি জানব কী করে, আর গণকারই-বা জানবে কী করে? আর যদি ধরেও নিই গণষ্কার জানতই, তবে সে বরাহমিহির সেটা বলতে গেল কেন মেয়েটাকে– ওই আট বছরের ফুলের মতো মেয়েটিকে?

এই দৈববাণীর ফল আরম্ভ হল পরের দিন থেকেই।

 মাধুরী শুরু করল দুনিয়ার কুল্লে ব্রত-উপবাস, পূজা-পারণা। ইতু, ঘেঁচু হেন দেবতা নেই যে সে খুঁজে খুঁজে বের করে বাড়িতে তার পুজো লাগায়নি। তার বাড়িতে ছিলেন আমাদের দেশে সবচাইতে নামকরা নিষ্ঠাবতী ঠাকুরমা- তিনি পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন, মাধুরীর পুজোপাটের ঠেলায়।

এসবের অর্থ অতি সরল। অতিশয় প্রাঞ্জল। মাধুরী ত্রিলোকবাসী সর্বদেব, সর্বমানব, এমনকি সর্ব ভূতপ্রেতকেও প্রসন্ন রাখতে চায়, যাতে করে তারা তাকে বাল-বৈধব্যের হাত থেকে ঠেকিয়ে রাখেন।

কিন্তু মাধুরীর মুখের হাসি শুকিয়ে গিয়েছিল আমার রাগ সেইখানটাতে। তার সর্বচৈতন্যে, সর্ব অস্তিত্বে মাত্র একটি চিন্তা; তাকে আমৃত্যু বাল্য-বৈধব্য বয়ে বেড়াতে হবে। এবং সে নাকি হবে শতায়ু! তার বাপ-ঠাকুরদা তাকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে তখন শুধু তার ডাগর চোখ দুটি মেলে তাকাত, কোনও কথা বলত না; স্পষ্ট বোঝা যেত আর সান্ত্বনাবাণী, স্তোকবাক্যে, তত্ত্বকথা তার মনের ওপর কোনও দাগ কাটছে না।

মাধুরী তেমন কিছু অসাধারণ সুন্দরী ছিল না। তবে হ্যাঁ, তার চোখ দুটির মতো চোখ আমি আর কোথাও দেখিনি। সেই চোখ দুটিতে তার আট বছর বয়সে যে মধুর হাসি আমি দেখতে পেয়েছিলুম সেটি আর কখনও দেখিনি। তার রঙ ছিল শ্যাম। কিন্তু মাধুর্যে ভরা। তাই সবসময়ই মনে হত, এ মেয়ের নাম মাধুরী সার্থক। সে সুন্দর নয়, মধুর। মধু তো আর গোলাপফুলের মতো দেখতে সুন্দর হয় না।

ষোল বছর বয়সে মাধুরীর বিয়ে হল। কুলীন ঘরের মেয়ে। সে-দিক দিয়ে অন্তত সবাই লুফে নেবে। ছেলেটি বিলেত-ফের্তা ইঞ্জিনিয়ার। মাদ্রাজে কর্ম করে। মাধুরীকে দেখে ওদের বাড়ির সকলেরই পছন্দ হয়েছে। আমি তখন বিদেশে।

আমার বোন মাধুরীকে বড় ভালোবাসত। তাই আমাকে লেখা তার চিঠি ভর্তি থাকত মাধুরীর কথায়। পুজোপাট তার নাকি বিয়ের পর আরও অসম্ভব রকম বেড়ে গিয়েছে। মাদ্রাজে গিয়ে পেয়েছে আরেক নতুন সেট দেবদেবী। ওঁয়ারা তো ছিলেনই, এঁয়ারাও এসে জুটলেন। হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলুম, শুক্কুরবারে শুক্কুরবারে মসজিদে শিরনি পাঠাতেও মাধুরীর কামাই যেত না।

বোন লিখেছিল, মাধুরীর স্বামীটি নাকি পয়লা নম্বরের বৈজ্ঞানিক, দেবদ্বিজে আদৌ ভক্তি নেই। মাধুরীর পালপার্বণের ঘটা দেখে সে নাকি রঙ্গ-রস করত, সেই পালপার্বণের আদিখ্যেতার –তার ভাষায়– কারণ শুনে নাকি হাসাহাসি করেছিল তার চেয়েও বেশি। তবে ছেলেটি খানদানি ঘরের ভদ্রছেলে ছিল বলে এসব কথা তুলে মাধুরীর মনে কষ্ট দিতে চাইত না।

কিন্তু মোদ্দা কথা– বোন লিখেছিল মাধুরী সুখী, মাধুরী স্বামী-সোহাগিনী।

যাক। চিঠি পেয়ে ভারি খুশি হলুম।

 তার ছ মাস পরে বজ্রাঘাত।

মাদ্রাজে যুদ্ধের সময়, এক্সপ্লোশন না বোমাপাতের ফলে মাধুরীর স্বামী আপিসের চেয়ারের উপরই প্রাণত্যাগ করে।

সেদিন আপিস যাবার সময় সে নাকি মাধুরীকে বলে গিয়েছিল, তোমরা বাঙালিরা বড় ঢিলে। সময়ের কোনও জ্ঞান নেই। আমি বাড়ি ফিরব সাড়ে পাঁচটায়। তোমাকে যেন তৈরি পাই। দশ মিনিটের ভিতরে যেন বেরোতে পারি। সিনেমা তোমার জন্য অপেক্ষা করবে না।

মাধুরী পাঁচটা থেকে তৈরি হয়ে বসে ছিল। কে জানে, কোন্ শাড়িখানা পরেছিল? সেই হলদে রঙেরটা? যেটা আমি তাকে প্রেজেন্ট করেছিলুম ওর রঙের সঙ্গে সুন্দর মানাত বলে? থাক ওসব। মোহনীয়া গল্প শোনাতে আমি আসিনি। সমস্ত ব্যাপারটাই এমনি ট্র্যাজিক যে তার ওপর অলঙ্কার চাপাতে ইচ্ছে করে না।

ছ-টা বাজল সাতটা বাজল করে করে রাত এগারোটা হল। মাধুরী তার স্বামীকে এই প্রথম অনপনকচুয়েল হতে দেখল— এবং এই শেষ।

আর পাঁচজন বাঙালিই প্রথম দুর্ঘটনার খবর পান। তাঁরা রাত এগারোটায় এসে মাধুরীকে খবরটা দেন। সঙ্গে এসেছিলেন মাধুরীর এক বান্ধবী ধর্মে তাঁর বিশ্বাস অবিচল ছিল বলে মাধুরীর সঙ্গে সখ্য হয়। তিনি খবরটা ভাঙেন। কী ভাষায়, সোজাসুজি না আশকথা-পাশপথা পাড়ার পর, জানিনে। তবে শুনেছি, মাধুরী একসঙ্গে এতজন লোককে রাত এগারোটার সময় বাড়িতে আসতে দেখেই কেঁদে উঠেছিল।

মাধুরী কলকাতায় ফিরে এল।

এখানেই শেষ? গণকারের কথাই ফলল? তা-ও নয়।

মাদ্রাজ ছাড়ার পূর্বে মাধুরী তার সখীকে তার কোষাকোষী আর সব পুজোপাটার জিনিসপত্র তার হাতে দিয়ে বলে, সমুদ্রে ডুবিয়ে দিতে। মাধুরী বলেনি কিন্তু সখী বললেন, ও বলতে চেয়েছিল, এত করেও যখন দেবতাদের মন পেলুম না, তখন তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আমার আর কী হবে? আমার তো অন্য আর কোনও জিনিসের প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়।

কলকাতায় ফিরে মাধুরী চাকরি নেয়। বস্তিতে করপরেশনের ইস্কুলে। সেখানে তার বসন্ত হয়। তার বোনঝি– ডাক্তার বলল, ওয়ান বিগ ব্লার্ব করবার কিছু নাই।

সে শতায়ু হয়ে বাল-বৈধব্যের যন্ত্রণা উপভোগ করেনি। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে সে গত হয়। পরোপকারে প্রাণ দেয়। সে জিন্নবাসিনী, অমর্ত্যলোকে অনন্ত স্বামী-সোহাগিনী।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *