পুচ্ছ (প্র)দর্শন
কুকুর মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে– এ তথ্য কিছু নতুন নয়। কিন্তু কুকুরের কাটা লেজের অবশিষ্ট চার আঙুল পরিমাণ একটা ছ ফুট লম্বা তাগড়া জোয়ানকে বাঁচিয়েছে এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু যে-ব্যক্তি এ ঘটনাটির বর্ণনা আমাকে দেন, তিনি অনেকের কাছেই সুপরিচিত এবং তারা সকলেই সানন্দে শপথ করতে প্রস্তুত হবে যে, শ্ৰীযুত বিনায়ক রাও শিবরাম মসোজিকে কেউ কখনও মিথ্যা-ভাষণ করতে শোনেননি।
আমার শুধু ক্ষোভ যে, বিনায়ক রাও যখন আমাকে প্রাগুক্ত ঘটনার সঙ্গে বিজড়িত তাঁর হিমালয় ভ্রমণ বর্ণন করে যান, তখন আমার সুদূর কল্পনাদৃষ্টি দিকচক্রবালে এতটুকু আভাস দেখতে পায়নি যে, আমার মতো নগণ্যজনও একদিন বাঙলা সাহিত্যের সংস্পর্শে আসবে; নইলে সেদিন আমি সাতিশয় শ্রদ্ধা ও যত্নসহকারে বিনায়ক রাওয়ের ভ্রমণকাহিনীটি সবিস্তার লিখে রাখতুম। কারণ আমাদের পরিচিত জন নিত্য নিত্য মানসসরোবর দর্শনে যায় না; তা-ও পিঠে মাত্র একটি হ্যাঁভারস্যাক নিয়ে। পরবর্তী যুগে আমাকে এক মারাঠা দম্পতি বলেন যে, মানসসরোবরে (না মানস সরোবরে তাই আমি জানিনে) যাবার পথে ডাকাতের ভয় আছে বলে তাঁরা সঙ্গে সেপাইশান্ত্রি নিয়ে যান।
বিনায়ক রাও শ্ৰীযুত নন্দলালের শিষ্য এবং শিক্ষাশেষে তিনি গুরু নন্দলালের সহকর্মীরূপে কলাভবনে সহকারী অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। নন্দলাল যেরকম দেব-দেবীর ছবি আঁকতেন, বিনায়ক রাও তেমনি ভারতীয় দৃষ্টিবিন্দু থেকে ভারতীয় বাতাবরণে, ভারতীয় বেশভূষায় মান্না মা-মেরির একাধিক ছবি এঁকে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ইউরোপীয় চিত্রকরদের মান্না দেখে দেখে আমরা ভুলে গিয়েছিলুম যে, মা-মেরি প্যালেস্টাইন-বালা এবং প্যালেস্টাইন প্রাচ্যভূমি। বিনায়ক রাওয়ের একখানি উৎকৃষ্ট মান্না কিছুদিন পূর্বেও এলগিন রোডের একটি গির্জার শোভাবর্ধন করত।
তিনি যে চিত্রকর ছিলেন, তার উল্লেখ করছি আমি অন্য কারণে। আর্টিস্ট মাত্রেরই অন্যতম প্রধান গুণ যে, তারা কোনও বস্তু প্রাণী বা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো (ক্যারেকটারিস্টিক) লক্ষ করেন এবং ঠিক সেইগুলো মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে প্রকাশ করতেই আমাদের কাছে রূপায়িত বিষয়বস্তু প্রাণবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ভ্রমণ-কাহিনী বর্ণনার সময় বিনায়ক রাও দৃশ্যের পর দৃশ্য মাত্র কয়েকটি ক্যারেকটারিস্টিক শব্দের দ্বারা প্রকাশ করতেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি হিমালয়ের গিরি-পর্বত-তুষার-ঝঞ্ঝা চট্টি-কাফেলা সব যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেতুম। সেটা এখানে এখন আমার পক্ষে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। কারণ আমি কোনও অর্থেই আর্টিস্ট নই।
বিনায়ক রাওয়ের গভীর বন্ধুত্ব ছিল এক জাপানি ভদ্রলোকের সঙ্গে নাম খুব সম্ভব ছিল– এতকাল পরে আমার সঠিক মনে নেই- হাসেগাওয়া। পাঁচ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্য হয় কি না হয়, কিন্তু তার প্রত্যেকটি পেশি ছিল যেন ইস্পাতের স্প্রিং দিয়ে তৈরি। প্রায় কিছু না খেয়েই কাটাতে পারতেন দিনের পর দিন এবং বীরভূমের ১১০ ডিগ্রিতেও তাঁর মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন দেখা যেত না। বিনায়ক রাওয়ের সঙ্গে তার আরেকটা বিষয়ে ছিল হুবহু মিল, দুজনাই অত্যন্ত স্বল্পভাষী। হাসেগাওয়াই প্রস্তাব করেন মানসসরোবরে যাওয়ার।
আমার আজ মনে নেই, কোন এক সীমান্তে গিয়ে ওই পুণ্যসরোবরে যাবার জন্য পারমিট নিতে হয়। বিনায়ক রাও আমাকে বললেন, সব সরকারই বিদেশিদের ডরায়, ভাবে ওরা গুপ্তচর, কী মতলব নিয়ে এসেছে, কে জানে। ওসব জায়গায় তো যায় মাত্র দু ধরনের লোক। তীর্থযাত্রী, আর যেটুকু সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারবারি লোক– ওরা যায় ক্যারাভান বা কাফেলার দল বানিয়ে। আমি খ্রিস্টান, হাসেগাওয়া বৌদ্ধ; মানসসরোবর আমাদের কারওরই তীর্থ হতে পারে না। তবু ফর্মে লিখে দিলুম তীর্থযাত্রী, নইলে পারমিট অসম্ভব। হাসেগাওয়া বললেন, আমরা গা-ঢাকা দিয়ে রইব, যতদিন না পারমিট পাই, পাছে আমাদের স্বরূপ না ধরা পড়ে। ইতোমধ্যে তোমাকে মাউন্টেনিয়ারিং বা পাহাড় চড়ার আর্টে তালিম দেব। বিনায়ক রাও বললেন, আমি তো মনে মনে হাসলুম। হাসেগাওয়ার তুলনায় আমি তো রীতিমতো পায়লওয়ান। আমি পাহাড় চড়ি চড় চড় করে– ও আবার আমায় শেখাবে কী? কিন্তু ভুল ভাঙল প্রথমদিনই। পাশেই ছিল একটা ছোটখাটো পাহাড়। সেইটে দিয়েই হল আমার প্র্যাকটিস শুরু। হাসেগাওয়া আমাকে পই পই করে বার বার বললেন, কনে-বউটির মতো চলি চলি পা পা করে ওঠো, নইলে আখেরে পস্তাবে। আমি মনে মনে বললুম, দুত্তোর তোর পা পা। চড় চড় চড় করে উঠতে লাগলুম চড়াই বেয়ে বাঘের শব্দ পেলে বাঁদর যে-ধরনে সোদরবনে সুন্দরী গাছ চড়ে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মশাই, ঘণ্টাদুই পরে দেখি অবস্থা সঙ্গিন। আর যে এক কদমও পা চলে না। ভিরমি যাবার উপক্রম। সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় আমি বসে পড়লুম একটা পাথরের উপর। ঘন্টাটাক পরে হাসেগাওয়া আমাকে পাস্ করলেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হেসে। তিনি চূড়ায় উঠলেন। আমি বসে বসে দেখলুম। নেমে এলেন। বিশ্বাস করবেন না, সৈয়দসাহেব, আমার আত্মাভিমানে লাগল জোর চোট।
আমি বললুম, দাক্ষিণাত্যের তিরু আন্নামলাইয়ের রমণ মহর্ষির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। তিনি অরুণাচল পাহাড়ের উপর কাটান চল্লিশ না পঞ্চাশ বছর কিংবা ততোধিক। পাহাড়টা কিছু মারাত্মক উঁচু নয় কিন্তু ঝড়ে-বাদলায়, গরমে-ঠাণ্ডায়, কখনও-বা অত্যন্ত অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে তাঁকে দিনে অন্তত একবার করে ওঠানামা করতে হত। এক পুণ্যশীলা গ্রামের মেয়ে তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসত পাহাড়ের তলায়, যেখানে আজকের দিনের আশ্রম। তিনিও আমাদের ওই চলি চলি পা পা-র উপদেশ দিয়েছেন, খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে। তার পর বল।
বিনায়ক রাও বললেন, পরদিন আরেকটা পাহাড়ে চেষ্টা দিলুম। সব জেনেশুনেও আমার কিন্তু ওই কনে-চাল কিছুতেই রপ্ত হচ্ছিল না। আর হাসেগাওয়া প্রতিদিন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পাস্ করতেন ও জিততেন লজ্জাকর মার্জিন রেখে।
আমরা দিনের পর দিন প্রহর গুনছি–পারমিট আর আসে না, ওদিকে আমরা জনমানবহীন পাহাড়গুলো চড়ছি আর ভাবছি, আত্মগোপন করেছি উত্তমরূপেই। কিন্তু ইতোমধ্যে সিজন যে বেশ এগিয়ে গিয়েছে, আর বেশি দেরি হলে তো বরফ পড়তে আরম্ভ করবে।
শেষটায় এক বড়কর্তার কাছে ডাক পড়ল। তার প্রাসাদে উঠে দেখি, ইয়া আল্লা। তার সেই উঁচু টিলার স্ট্যান্ডের উপর খাড়া জোরদার টেলিস্কোপ। আমরা যখন অস্ট্রিচ পাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে আত্মগোপনের আত্মপ্রসাদ অনুভব করছি, ইনি তখন প্রতিদিন নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের প্রতিটি পাহাড় ওঠা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কৌতূহলী হয়ে আমাদের সম্বন্ধে সর্বসংবাদ সংগ্রহ করেছেন। বেশ রসিয়ে রসিয়ে আদ্যোপান্ত বললেন। আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল– ইস্তেক যে-জাপানি বদন অনুভূতি প্রকাশে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত ও অনিচ্ছুক সেটিও কিঞ্চিৎ বিকৃত হল।
কিন্তু বৃথাই আতঙ্ক; আমরা খামোখাই ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখছিলুম। আমাদের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। বড়কর্তা সর্বসংবাদ শুনে আমাদের অভিযানাকাঙ্ক্ষা প্রসন্নতর দৃষ্টিতে আশীর্বাদ করেছেন। কারণ, আমরা ধর্ম বা অর্থ কোনওটাই সঞ্চয় করতে যাচ্ছি না– আমরা আসলে তীর্থযাত্রী নই, আর ব্যবসায়ী তো নই-ই। তবে তখনও জানতুম না, আরেকটু হলেই অনিচ্ছায়, অন্তত আমার, মোক্ষ লাভটা হয়ে যেত।
অমি বললুম, ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ তিনটের তো জমা-খরচ হল আর কাম?
মসোজি বললেন, রাম, রাম। ওর মতো রিটান আমি কোনও মঠ, কোনও মনাস্টেরিতে দেখিনি।
তার পর বিনায়ক রাও আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ছবি এঁকে যেতে লাগলেন। কত না বনস্পতি, অজানা-অচেনা বিহঙ্গের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, আন্দোলিত উপত্যকার উপর ক্রোশের পর ক্রোশব্যাপী দোদুল্যমান ফুলের বন্যা, পার্বত্য-নদী, জলপ্রপাত, অভ্রংলেহী পর্বত, পাতালস্পর্শী অন্ধকূপ, সংকটময় গিরি-সংকট, পান্থশালা, চট্ট, পার্বত্য শ্রমণদের জিহ্বানিমণপূর্বক তৎসঙ্গে ঘন ঘন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠদ্বয় আন্দোলন দ্বারা অভিবাদন, দুর্গন্ধময় স্নেহজাতীয় পদার্থসহ চা-পানের নিমন্ত্রণসহ অতিথি সৎকার। আরও এতসব বিজাতীয় বস্তু ও কল্পনাতীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, সেগুলোর নির্ঘণ্ট মাত্র দিতে হলে প্রচুর অবকাশ ও প্রচুরতর পরিশ্রমের প্রয়োজন। য়েতি বা এমিনেবল স্নোম্যান সম্বন্ধে যেসব কাহিনী বর্ণন করেছিলেন শুধু সেগুলো শিকের হাঁড়িতে সযত্নে তুলে রেখেছি : অম্মদেশীয় সম্পাদক ও প্রকাশকদের শেষশয্যায় সেগুলো তাদের রসিয়ে রসিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের শেষ যাত্রাটি বিভীষিকাময় করে দেবার জন্যে।
বিনায়ক রাও বললেন, ক্রমে ক্রমে আমরা লক্ষ করলুম, পাহাড় থেকে নেমে আসছে সবাই, উপরের দিকে যাচ্ছে না কেউই। চটির পর চটি দেখি হয় জনমানবহীন দরজা খা-খা করছে কিংবা তালাবন্ধ– সমস্ত শীতকাল এখানে তো আর কেউ আসবে না।
আমরা চড়াইয়ের দিকে শেষ কাফেলাও মিস করেছি।
কিন্তু হাসেগাওয়ার ওই একটি মহৎ সদণ্ডণ যে, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজন না হওয়ার পূর্বে তিনি ওই নিয়ে মাথা ঘামান না।
আমরা যতই উপরের দিকে উঠছি, ততই রাস্তা এবং চট্ট জনবিরল হতে লাগল। শেষটায় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা চলার পরও কাউকে নেমে আসতে দেখি না— ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। তখন দেখি এক পরিত্যক্ত চট্টর সামনে একজন সাধু বসে আছেন। সন্ধ্যা হয়-হয়। মোক্ষম শীত পড়েছে কিন্তু সাধুজি কৌপিনসার। সর্বাঙ্গে ভস্মও মাখেননি কিংবা অন্য কোনও ব্যবস্থারও প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ দেহটির দিকে তাকালে মনে হয়, এইমাত্র প্রচুর তেল ডলাইমলাই করে স্নান সেরে উঠেছেন– গা বেয়ে যেন তখনও তেল ঝরছে। আমাদের সঙ্গে চাপাতি ও শুকনো তরকারি ছিল। সাধুজিকে তার থেকে হিস্যে দিলুম। তিনি কোনওপ্রকারের বাক্যালাপ না করে খেলেন। আমরাও কোনও প্রশ্ন শুধালুম না। পরের দিন ভোরবেলা দেখি, তিনি তখনও সেখানে ঠায় বসে। আমরা তাঁকে প্রণাম করে রাস্তায় নামবার সময় মনে হল এই যেন সর্বপ্রথম তার চোখে ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল– সে পরিবর্তনে যেন আমাদের প্রতি আশীর্বাদ রয়েছে। রাস্তায় নামার পর হাসেগাওয়া বলল, আমার দুশ্চিন্তা গেছে। আমাদের যখন উনি চড়াইয়ের পথে যেতে বারণ করলেন না, তখন মনে হচ্ছে, আমাদের যাত্রা সফল হবে।
হিমালয়ের অন্যতম এই রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। এইসব একাধিক সন্ন্যাসী সমস্ত শীতকালটা এসব জায়গায় কাটান কী করে? পাঁচ-সাত হাত বরফ এখানে তো জমেই– সেখানে না আগুন, না কোনওপ্রকারের খাদ্য। এক চট্টিওলা আমাকে পরে বলেছিল, বরফের তলায় নাকি একরকমের লতা গজায়। তারই রস নাকি এদের খাদ্য, বস্ত্র, আগুন– সব।
আর হাসেগাওয়া তুলে যাচ্ছে, একটার পর একটা ছবি। এই গিরি অভিযানে বেরুবার তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য– যত পারে, যতরকমের হয়, ফটোগ্রাফ তোলা। দাঁড়ান, আপনাকে বইখানা দেখাই।
বিনায়ক রাও নিয়ে এলেন ঢাউস এক ফটোগ্রাফের বই। মলাটের উপরকার ছবি দেখেই আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বই জাপানি। জর্মনরাও বোধহয় এরকম প্রিন্ট করতে পারে না। কে বলবে এগুলো ব্লক থেকে তৈরি! মনে হয় কন্টাক্ট প্রিন্ট!
বিনায়ক রাও বললেন, জাপানে ফিরে গিয়ে হাসেগাওয়া তার তোলা ছবির একটি প্রদর্শনী দেখান। সে-দেশের রসিক-বেরসিক সর্বসম্মতিক্রমে এই সঞ্চয়ন ফটোগ্রাফির প্রথম বিশেষ পুরস্কার পায়।
ছবি বোঝাবার জন্য এ-বইয়ে টেক্সট অত্যল্প। আমার বড় বাসনা ছিল বইখানা যেন ভারতের বাজারেও জাপানিরা ছাড়ে। কিন্তু ঠিক তখনই মার্কিন হিরোশিমার উপর এটম বোমা ফেলছে। পরবর্তীকালে আমি আবার কঁহা কঁহা মুলুকে চলে গেলুম।
এ-বইখানা আনাতে কিন্তু আমার অসুবিধা সৃষ্ট হল। বিনায়ক রাও বই আনার পর আর বর্ণনা দেন না। শুধু বলেন, এর পর আমরা এখানে এলুম বলে দেখান একটা ফটো, ফের দেখান আরেকটা অনবদ্য ছবি। কিন্তু এখন আমি সেসব ছবির সাহায্য বিনা তাদের যাত্রাপথের গাম্ভীর্য, মাধুর্য, বিস্ময়, সংকট, চিত্র-বৰ্ণন করি কী প্রকারে! পাঠক, তুমি নিরাশ হলে আমি নিরুপায়।
বিনায়ক রাও, হাসেগাওয়া তোমার ও আমার পরম সৌভাগ্য যে, ওঁরা দুজনা পথিমধ্যে একটি কাফেলা পেয়ে গেলেন এবং অবিশ্বাস্য, সেটা যাচ্ছে উপরের দিকে। এদের ভিতর আছে তীর্থযাত্রী ও অল্পবিত্ত ব্যবসায়ী। এই শেষ কাফেলা। নানা কারণে এদের বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের মনে শঙ্কা, বরফ-নামার পূর্বে এঁরা পাহাড় থেকে নামতে পারবেন কি না। তীর্থযাত্রীদের মনে কিন্তু কোনওপ্রকারের দুশ্চিন্তা নেই। এ ধরনের তীর্থদর্শনে যারা বেরোয়, তারা ঘরবাড়ির মোহ, প্রাণের মায়া সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েই সম্মুখপানে পা ফেলে। পথিমধ্যে মৃত্যু, মানসে মৃত্যু, গৃহ-প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যেখানেই মৃত্যু হোক না কেন, তারা আশ্রয় পাবেন ধূর্জটির নিবিড় জটার মাঝখানে– যে-জটা হিমালয়ের চূড়ায় সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে চিরজাজ্বল্যমান।
আর কাফেলার ওইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে মনে হয়, কী বিচিত্র দ্বন্দ্বময় পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপ এদের জীবনে। যে প্রাণরক্ষার জন্য এরা দুটি মুঠি অন্ন উপার্জন করতে এসেছে এখানে, সেই প্রাণ তারা রিস্ক করছে প্রতিদিন, প্রতি বৎসর। হুবহু সার্কাসের স্টান্ট খেলাড়িদের মতো প্রাণধারণের জন্য যারা প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে প্রতি সন্ধ্যায়!
তা সে যাক্। এ লেখাটি এখন সংক্ষিপ্ত করি। কারণ, হিমালয়ের বর্ণনাই যখন দিতে পারছিনে, তখন হিমালয় নিয়ে কাহিনী বলা শিবহীন দক্ষযজ্ঞ এবং যদ্যপি হিন্দু পুরাণের সঙ্গে পরিচয় আমার ঘনিষ্ঠ নয়, তবু এটুকু জানি, সে প্রলয়কাণ্ড ঘটেছিল এই হিমালয়েই– দক্ষালয়ে।
আমি অরসিক। হঠাৎ শুধালুম, বিনায়ক রাও! তোমরা খেতে কী?
শেষের দিকে পথে যেতে যেতে– পথ বললুম বটে কিন্তু আমি আপনারা পথ বলতে যেটা বোঝেন, সেটাকে অপমান করতে চাইনে– আমার শ্যেনদৃষ্টি থাকত কিসের ওপর জানেন? শকুনি, শকুনি– আমি তখন সাক্ষাৎ শকুনি। শকুনি যেমন নির্মল নীলাকাশে ওড়ার সময়ও তাকিয়ে থাকে নিচে ভাগাড়ের দিকে, আমিও তাকিয়ে থাকতুম নিচের দিকে। কোথাও যদি ভারবাহী য়া পশুর এক চাবড়া গোবর পেয়ে যাই। সে-ঘুঁটেতে আগুন ধরিয়ে ধুয়োর ভিতর নাড়াচাড়া করি, চেপে ধরি, দু হাত দিয়ে চড়চাপড় মেরে তৈরি করা এবড়ো-থেবড়ো রুটি– গুজরাতিতে যাকে বলে রোটলা, কাবুলি নানের চেয়েও তিন ডবল পুরু। কিন্তু সেই উঁশা রুটিই মনে হত সাক্ষাৎ অমৃত– ওলড টেস্টামেন্টের বিধিদত্ত মান্না, যার স্বাদ আজও ইহুদিকুল ভুলতে পারেনি।
বিনায়ক রাও বললেন, পঙ্গুও ঈশ্বরপ্রসাদাৎ গিরি লঙ্ন করে– এটা মানসে পৌঁছে জন্মের মতো উপলব্ধি করলুম। হাসেগাওয়ার দর্শনই ঠিক পঙ্গু বাধ্য হয়েই এগোয় অতি ধীরে-মন্থরে, তাই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় মানসসরোবরে। পঙ্গুর কাছে যা বিধিদত্ত, সুস্থ মানুষকে সেটা শিখতে হয় পরিশ্রম করে। *
[* চেকোশ্লোভাকিয়ার পাহাড়-পর্বত হিমালয়ের তুলনায় নগণ্য। সেখানে পাহাড় চড়তে গিয়ে শ্রীযুক্ত মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে অভিজ্ঞতা হয় সেটি এস্থলে তুলে দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না।
মিরেক (একজন পাহাড়-বন-বিভাগের চৌকিদারকে) শুধোল, আচ্ছা, আপনি এত আস্তে চলছেন কেন?
প্রশ্ন শুনে চৌকিদার হো হো করে খুব খানিকটা হেসে নিলেন। তার পর বললেন- শুনুন। বহু বছর, চল্লিশেরও উপর, বনের পথে, পাহাড়ে রাস্তায় নানান গতিতে হেঁটেছি। কখনও জোরে কখনও ধীরে। আপনাদের মতো আগে হাঁটতুম, আরও জোরে হাঁটতুম। লাফিয়ে ঝাফিয়ে পাহাড়ে উঠে তার পর হাঁপাতুম। হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের উপর শুয়ে জিরিয়ে নিতুম, তারপর আবার চলতুম। কাজের তাগিদে কখনও সারাদিন হাঁটতে হয়েছে, কখনও সারারাত। কিন্তু এই যে এখনকার আমার চলার গতি দেখছেন, এ হচ্ছে বহুদিনের বহু সাধনার পর আবিষ্কৃত। এ গতিতে চললে কখনও ক্লান্তি আসবে না শরীরে। যত দূর-দূরান্তরে বনান্তরে যান না কেন, যাত্রার শুরুতে যেমন শরীর তাজা তেমনিই থাকবে। চরণিক, প্রথম (বেঙ্গল) সংস্করণ, পৃ. ১১৩/১৪।]
বিনায়ক রাও ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সরোবরে স্নান করেছিলুম। আমার জীবনের মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিতর এটা আমার চিরকাল মনে থাকবে।
সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল না? পুণ্যস্নান তো বটে।
বিনায়ক রাও শিউরে উঠলেন, বাপরে বাপ! জলে দিয়েছি ঝাঁপ আর সঙ্গে সঙ্গে মেরেছি পারের দিকে লাফ। সেদিন আকাশ ছিল পরিষ্কার। দ্বিপ্রহরের সেই উগ্র রৌদ্রে আমি ঘণ্টাদুয়েক ছুটোছুটি করেছিলুম শরীরটাকে গরম করার জন্যে। ছুটেছি পাগলের মতো দু-হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পা-দুটো ছুঁড়ে ছুঁড়ে আছাড় মেরে মেরে। তার পর ক্লান্ত হয়ে থামতে বাধ্য হয়েছি। ফাঁসির লাশের মতো জিভ বেরিয়ে গিয়েছে হাঁপাতে হাঁপাতে। ফের ছুটতে হয়েছে গা গরম করার জন্য। গা আর কিছুতেই গরম হয় না। সে কী যন্ত্রণাভোগ!
আমি বললুম, শুনেছি, গত যুদ্ধে যেসব অ্যার পাইলট শীতকালে ইংলিশ-চ্যানেলের জলে পড়েছে, তাদের কেউই কুড়ি মিনিটের বেশি বাঁচেনি।
বিনায়ক রাও বললেন, লোকে বলে, অগ্নিপরীক্ষা? আমি বলি শীতের পরীক্ষা।
হ্যাঁ, আফ্রিকাবাসীরাও বলে– Heat hurts, cold kills.
বিনায়ক রাও বললেন, হাসেগাওয়া প্রাণভরে ছবি তুললেন। তার পর প্রত্যাবর্তন। অন্য পথ দিয়ে।
চলেছি তো চলেছি; তার পর এল আমাদের কঠিনতম সংকট। আমাদের একটা গিরিসংকট পেরুতে হবে। এবং এটা পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ গিরিসংকট। সমুদ্রতট থেকে বারো হাজার ফুট উঁচুতে না বাইশ হাজার আমার মনে নেই। এবং একটুখানি যাওয়ার পরই আরম্ভ হয় চড়াইয়ের পর চড়াই। ক্যারাভানের এক ব্যবসায়ী আমাকে বলেছিল, যেসব তীর্থযাত্রী মারা যায়, তাদের অধিকাংশই মরে এইখানে।
ক্রমেই বাতাসের অক্সিজেন কমে আসছিল। অতিকষ্টে আমরা ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। এমন সময় চোখে পড়ল একটা লোক অকাতরে ঘুমুচ্ছে পথের একপাশে। কাছে এসে বুঝলুম, মৃতদেহ! এবং সম্পূর্ণ অবিকৃত মৃতদেহ। এ বছরে মরেছে, না গেল বছরে বুঝতে পারলুম না। কারণ, আমি শুনেছিলুম, উপরে-নিচে বরফ থাকে বলে মড়া পচে না।
এর পর আরও কয়েকটা। আমি মাত্র একবার একজনের মুখের দিকে তাকিয়েছিলুম, আহা! সে কী শান্ত, প্রশান্ত, নিশ্চিন্ত মুখচ্ছবি। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে-পড়া শিশুর মুখেও আমি এরকম আনন্দভরা আত্মসমর্পণের ছবি দেখিনি।
ইতোমধ্যে আমার দৃষ্টি গেল অন্যদিকে। দেখি, আমাদের দলের একজন বৃদ্ধ তীর্থযাত্রী অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। কারও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। আমি জানতুম, এবং হাসেগাওয়াও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এখানে বলবান যুবা পুত্রও হাত বাড়িয়ে মাতাকে পর্যন্ত সাহায্য করতে পারে না। কারও শরীরে একবিন্দু উদ্বৃত্ত শক্তি নেই যে, সে সেটা অন্যের উপকারে লাগাবে। সামান্য দুটি কথা বলে যে সাহস দেবে সে শক্তিও তখন মানুষের থাকে না। আমার মনে হল, হালকা একটি পালক দিয়েও যদি কেউ আমাকে ঠোনা দেয় আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব।
আমি খুব ভালো করেই জানতুম, কাফেলা কারও জন্য অপেক্ষা করে না, করলে সমস্ত কাফেলা মরবে। আমাদের যে করেই হোক সন্ধ্যা নাগাদ সামনের আশ্রয়স্থলে পৌঁছুতে হবে।
এমনিতেই আমাদের প্রত্যেকেরই ছিল শম্বুকগতি। আমি সেটাও কমিয়ে দিলুম ওই বৃদ্ধকে সঙ্গ দিতে। হাসেগাওয়া বুঝতে পেরেছে। আমার দিকে রহস্যভরা নয়নে সে তাকাল। আমি ইঙ্গিতে জানালুম, সে যেন তার গতি শ্লথ না করে।
এস্থলে আমি সামান্য একটি তথ্যের উল্লেখ না করলে কর্তব্যবিচ্যুতি হবে।
বিনায়ক রাওয়ের মতো পরদুঃখকাতর মানুষ আমি এ জীবনে কমই দেখেছি, এবং একেবারেই দেখিনি পরোপকার গোপন রাখতে তাঁর মতো কৃতসংকল্পজন। প্রভু যিশুর আদেশ, তোমার বাঁ হাত যেন না জানতে পারে তোমার ডান হাত কী দান করল। এরকম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমি কোনও খ্রিস্টান অখ্রিস্টান– কাউকে দেখিনি। কাফেলার বৃদ্ধের প্রতি তাঁর দরদ গোপন রাখতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই তাই করতেন– এ সত্য আমি কুরান স্পর্শ করে বলতে রাজি আছি। কিন্তু এটা গোপন রাখলে তাঁর মূল বক্তব্য একেবারেই বিকলাঙ্গ হয়ে যেত বলে তিনি যতটা নিতান্তই না বললে নয়, সেইটুকুই বলেছিলেন।
বিনায়ক রাও সেদিনের স্মরণে একটুখানি শ্বাস ফেলে বললেন– বৃদ্ধকে আমি বলব কী– স্পষ্ট দেখতে পেলুম, সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যেন কাফেলা থেকে সে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। এই যে আমি তার তুলনায় শক্তিশালী, আমারই থেকে থেকে মনে সন্দেহ হচ্ছিল, আমিই কি পৌঁছতে পারব গন্তব্যস্থলে? তখন হৃদয়ঙ্গম করলুম, এখানে এ-সংকট থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানসিক বলের। এবং এ বৃদ্ধের সেটা যেন আর নেই। তীর্থদর্শন হয়ে যাওয়ার পর ফেরার মুখে অনেকেই সেটা হারিয়ে ফেলে– কারণ তখন তো সামনের দিকে আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, আর কোনও চরম কাম্য বস্তু নেই। ফিরে তো যেতে হবে আবার সেই সংসারে, তার দিনযাপনের প্রাণ-ধারণের গ্লানির ভিতর।
আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজে যেন সন্তরণে অক্ষম, আরেক সন্তরণে অক্ষম জনকে সাহায্য করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করছি। তবু বললুম, আরেকটুখানি পরেই উত্রাই। চলুন। এই সামান্য কটি শব্দ বলতে গিয়েই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে এল।
বুড়ো আমার দিকে তার ঘোলাটে চোখ তুলে তাকিয়ে হঠাৎ কী যেন দেখতে পেল। অতি কষ্টে ধীরে ধীরে বলল, বাবু, তোমার বোতল থেকে একটু শরাব।
বিনায়ক রাও বললেন, আমি জীবনে কখনও শরাব স্পর্শ করিনি; আমার বুকের পকেটে ছিল চ্যাপ্টা বোতলে জল।
কোনও গতিকে বললুম, জল। বুড়ো বিশ্বাস করে না। কাতর নয়নে তাকায়।
আস্তে অতি আস্তে বুড়ো এগোচ্ছে ওই শরাবের আশায়।
এইভাবে খানিকক্ষণ চলল। হঠাৎ বুঝি বুড়ো লক্ষ করেছে কাফেলা একেবারেই অন্তর্ধান করেছে। কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো বলল, জিরো। আমি শুষ্ককণ্ঠে যতখানি পারি চেঁচিয়ে বললুম, না না! আমি জানি এ জিরোনোর অর্থ কী। এই বসে পড়ার অর্থ, সে আর উঠে দাঁড়াবে না। তার মনে হবে এই তো পরমা শান্তি আরাম, আরাম। আর শেষ নিদ্রায় ঢলে পড়বে।
বুড়ো তার শেষ ক-টি কথা বলল যার অর্থ, এক ঢোক শরাব পেলে সে হয়তো সংকট পেরুতে পারবে। আমার দিকে হাত বাড়াল। আমি আর কী করি? দিলুম বোতল। সে টলতে টলতে বসে পড়ল। এ কী সর্বনাশ! তার পর বোতল মুখে দিয়ে যখন দেখল সত্যি জল, তখন আমার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
এই শরাবের আশাতেই সে এতক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে কোনও গতিকে এসেছে। এবারে শেষ আশা বিলীন হতে সে ঢলে পড়ল।
***
চলেছি তো চলেছি। কতক্ষণ চলার পর উত্রাই আরম্ভ হয়েছিল, কখন যে উপত্যকায় নেমেছি সেগুলো আমার চৈতন্যসত্তা যেন গ্রহণ করেনি।
সম্বিতে এলুম হঠাৎ বরফপাতের সঙ্গে সঙ্গে। অতি হালকা চাদরের মতো কী যেন নেমে এল। তবু সম্মুখপানে খানিকটা দেখা যায়। ঈষৎ দ্রুততর গতিতে চলতে আরম্ভ করলুম। কয়েক মিনিট পরেই বরফপাত থেমে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। তার পর সামনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আতঙ্কে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, একটুখানি বেশি আগেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বসেছি।
সামনে উপত্যকা, এবং এইমাত্র যে বরফপাত হয়ে গেল তারই কল্যাণে মুছে গেছে কাফেলার পদচিহ্ন। এবং সংকটটাকে যেন তার বীভৎসতম রূপ দেবার জন্য সামনে, ধীরে ধীরে, নেমে আসছে কুয়াশার জাল দিনের আলো ম্লান হয়ে গেছে।
তারই ভিতর দিয়ে লক্ষ করলুম, আরেকটু সামনে একটা পাথরের টিলা। সেখানে পৌঁছে আমাকে যেতে হবে হয় বাঁয়ে নয় ডাইনে। কিন্তু মনস্থির করি কী প্রকারে? বরফের উপর যে কোনও চিহ্নই নেই। তবু আমার মনে যেটুকু দিক্-বিদিক জ্ঞান ছিল সেটা পরিষ্কার বললে, যেতে হবে বাঁ দিকে।
এমন সময় হঠাৎ কুয়াশার ভিতর যেন একটু ছিদ্র হল, এবং তার ভিতর দিয়ে এক মুহূর্তের তরে, যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, দেখি একটা কুকুরের ইঞ্চিতিনেক লেজ, বো করে ডান দিকে মোড় নিল, কুকুরটাকে কিন্তু দেখতে পেলুম না।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, কুকুর! কোথাকার কুকুর? কুকুরের কথা তো এতক্ষণ কিছু বলনি!
ও। সত্যি ভুলে গিয়েছিলুম। ওই কুকুরটা থাকত একটা চট্টিতে। আমরা সে চড়িতে, বৃষ্টির জন্য আটকা পড়ে, দিন তিনেক ছিলুম। ওই সময় আমি ওটাকে সামান্য এটা-সেটা দিয়েছি। সে চট্টি ছাড়ার খানিকক্ষণ পরে দেখি, তিনি আমার পিছু নিয়েছেন। বিস্তর হাই-হুই করে পাথর ছুঁড়েও তাকে চট্টিতে ফেরত পাঠাতে পারলুম না।
আমি বললুম, এই তো সেই জায়গা যেখানে যুধিষ্ঠিরের সারমেয় তাঁকে ত্যাগ করতে চায়নি।
মসোজি বললেন, এসব কেন, কোনও কুকুরেরই লেজ কাটা উচিত নয়; তবু কে যেন বেচারির বাচ্চা বয়সে তার লেজ কেটে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেলুম সেই টুকরোটুকু, যেটুকু অবশিষ্ট ছিল। এবং সেটা মোড় নিল ডানদিকে।
আমার অভিজ্ঞতা, আমার পর্যবেক্ষণ, আমার বিচারশক্তি সব-সব আমাকে চিৎকার করে বলছিল, বাঁ দিকে বাঁ দিকে মোড় নাও আর অতি স্পষ্ট যদিও অতিশয় ক্ষণতরে আমি দেখলুম, কুকুরটার লেজ মোড় নিল ডান দিকে।
আমি নিজের বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে কুকুরটার লেজকেই বিশ্বাস করলুম বেশি।
কুকুরটাকে কিন্তু তখনকার মতো আর দেখতে পেলুম না।
ঘণ্টাটাক পরে চডিতে পৌঁছলুম। হাসেগাওয়া বললেন, আমি বুড়োর জন্য অপেক্ষা করার পর থেকেই কুকুরটা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল। শেষটায় সে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমি শুধালুম, আর বাঁ দিকে মোড় নিলে কী হত? প্রশ্নটা জিগ্যেস করেই বুঝলুম আমি একটা ইডিয়ট।
বিনায়ক হেসে বললেন, তা হলে আপনি আপনার বন্ধু বিনায়ককে আর—
আমি বললুম, ষাট ষাট।*
[* বিনায়ক রাও আমাকে তার মানস-গমন কাহিনি বহু বৎসর পূর্বে বলেছিলেন। এখন কেতাবপত্র ঘেঁটে লুপহোলগুলো যে পূর্ণ করা যেত না তা নয়, কিন্তু আমার কেমন যেন মনে হল এই খাপছাড়া খাপছাড়া অসম্পূর্ণ পাঠটাই সত্যের নিকটতর থাকবে।
শ্ৰীযুত গাঙ্গুলির পাহাড় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা একটু আগেই ফুটনোটে উল্লেখ করেছি। মোরাভিয়ার পাহাড় তেমন কিছু উঁচু নয়, কিন্তু বরফের ঝড়ে কিংবা নিছক ক্লান্তিবশত পর্যটকের মরণবরণ একই পদ্ধতিতে হয়। গাঙ্গুলিমশাই লিখেছেন :
সেবারে দুটি স্লোভাক ছেলে প্রায়েটের চুড়োয় এসে হাজির হল। তখন খুব বরফ পড়ছে। (সেখানকার) কাফিখানায় একচুল জায়গা নেই– যত রাজ্যের শি-চালক সেখানে এসে জমেছে। এই দুই স্লোভাক ছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু পেয়ালা গরম দুধ খেয়ে বেরিয়ে গেল। কোথায় যাচ্ছ জিগ্যেস করায় তারা জবাব দিল– চের্ভেনে সেডলো।
বরফ পড়লেও দিনটা মোটামুটি পরিষ্কার ছিল। কিন্তু ছেলে দুটি বেরিয়ে যাবার খানিক পরেই হঠাৎ কুয়াশা এসে চারিদিক ছেয়ে ফেলল। তার পর এই কুয়াশা কাটল না, ছেলে দুটিও ফিরে এল না। এদিকে অন্ধকার নেমে এল আর তারই সঙ্গে ঘন তুষারপাত শুরু হয়ে গেল। কাফিখানার মালিক উদ্বিগ্ন হয়ে বিদেশি ছেলে দুটিকে খোঁজবার জন্যে কয়েকজনকে পাঠালেন। তারা শি নিয়ে কোমরে টর্চ বেঁধে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে ওই ঘন তুষারপাতের মধ্যে যাবে কোথায়? যাবেই-বা কী করে? বিশেষ কিছু লাভ হল না। তারা ফিরে এল। কিন্তু ছেলে দুটি আর ফিরল না।
পরদিন সকালবেলা বরফের উপর রোদ পড়ে যখন চারিদিক ঝলমল করে উঠল, তখন দেখা গেল রাতভোর এত বরফ পড়েছে যে ছেলে দুটি যদি কোথাও মরেও পড়ে গিয়ে থাকে তাদের দেহ খুঁজে বার করবার কোনো উপায় নেই। আশপাশের যত কুটির যত গ্রাম আছে সব জায়গা থেকে যখন খবর এল যে ছেলে দুটি কোথাও পৌঁছয়নি তখন বোঝা গেল এই অঞ্চলের বরফের মধ্যে তাদের সমাধি হয়েছে।
সারা শীতকাল ছেলে দুটি তাদের অজানা সমাধির মধ্যে রইল শুয়ে। তার পর যখন প্রথম বসন্তের হাওয়ায় বরফ গলতে আরম্ভ করল তখন তাদের অবিকৃত দেহ আবিষ্কার হয় এই জঙ্গলের মধ্যে। আশেপাশে অনেকগুলি আধপোড়া দেশলাই-এর কাঠি ছড়ানো। বরফের মধ্যে পথ হারিয়ে যাওয়ার এই হচ্ছে বিপদ। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়ার মতো হলে যে ক্লান্তি আসে সে বড় ভয়ানক ক্লান্তি। দু-চারটে দেশলাই জ্বেলে কি তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়? দেহ মন চোখ সমস্ত ঘুমে জড়িয়ে আসে। হঠাৎ শীতের অনুভূতি আর থাকে না। মনে হয় বরফেরই কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ি। তখন মনে হয় জেগে থাকার চেষ্টা করার মধ্যেই যত অস্বস্তি, যত কষ্ট! ঘুমিয়ে পড়াই হচ্ছে আরাম! তার পর একবার সেই ঘুমের কোলে কেউ ঢলে পড়লে, সে ঘুম আর ভাঙে না। বরফের মধ্যে মৃত্যুকে ঠিক জীবনের অবসান বলা যায় না– এ যেন এক গভীর সুষুপ্তি।]
.