নটরাজনের একলব্যত্ব

নটরাজনের একলব্যত্ব

বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পদ্মার উপর দিয়ে পুরবৈয়া বায়ু বইতে আরম্ভ করে না। সে হাওয়া আসে দিন আষ্টেক পরে। কিন্তু তখনই সাড়া পড়ে যায় বন্দরে বন্দরে মাঝি-মহল্লায়। হালের বলদ, পালের গরু বিক্রি করে তারা তখন কেনে নৌকোর পাল। পুরনো পালে জোড়াতালি দিয়ে যেখানে চলে যাওয়ার আশা, সেখানে চলে কাঁথার উঁচ আর মোটা সুতো। তার পর আসবে ঝোড়ো বেগে পুব হাওয়া। দেখ তো না দেখ, নারায়ণগঞ্জ নৌকো পৌঁছে যায় রাজশাহী। বিশ্বাস করবেন না, স্রোতের উজানে, তর তর করে।

আমিও বসে আছি হাল ধরে, পাল তুলে হাওয়া এই এল বলে। নোঙর নিইনি। এই শেষ যাত্রায় যেতে হয় এক ঝটকায়। কোথাও থামবার হুকুম নেই।

নাতি ডাবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল দাদু, তামুক খাও।

হাওয়ার আশায় বসে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ-আবেশে ভরে যায়।

নাতি বলল, দাদু, সারাজীবন ধরে পদ্মার উজান-ভাটা করলে। কত লোকের সঙ্গেই না তোমার দোস্তি হল। বাড়িতে থেকে খেত-খামার করে দোকানপাট চালালে তো অতশত লোকের সঙ্গে তোমার ভাবসাব হত না– আর বিদেশিই বা কিছু কম। কঁহা কঁহা মুলুকের রঙবেরঙের চিড়িয়া। আমারে কও, তাদের কথা।

আমি পদ্মা নদীর মাঝি নই। কিন্তু আমার জীবনধারা বয়ে গেছে পদ্মার চেয়েও দেশদেশান্তরে। কত না অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতি, কত না বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখন পাল তুলে ওপারে যাবার মুখে ভাবছি, এঁদের কারও কারও সঙ্গে আপনাদেরও পরিচয় করিয়ে দিই। কারণ এদের সম্বন্ধে অন্য কেউ যে মাথা ঘামাবে সে আশা আমার কম– প্রচলিতার্থে এঁরা দেশের কুতুবমিনার নন। অথচ আমার বিশ্বাস এঁরা যদি সত্যই এমৃবিশাস হতেন তবে আজ আমার মতো অখ্যাত জনের কাঁধে এঁদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার ভার পড়ত না, আর পড়লেও সেটা আমি গ্রহণ করতুম না। কারণ এদের আমি ভালোবেসেছিলুম এঁরা লাওৎসের চেলা বলে। তারই উপদেশমতো এঁরা জীবনের মধ্য-পথ অবলম্বন করেছিলেন। পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে, আপন প্রতিভা যতদূর সম্ভব চাপা রেখে গোপনে গোপনে তার পরিপূর্ণ বিকাশ দেবার চেষ্টা করেছেন। বাধা পড়লে পড়াই দিতেন মোক্ষম, কিন্তু সর্বক্ষণ এঁদের চরিত্রে একটা বৈরাগ্য ভাব থাকত বলে মনে মনে বলতেন, হলে হল, না হলে নেই।

কিন্তু আমাকে একটু সাবধানে, নাম-পরিচয় ঢেকে চেপে লিখতে হবে। পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছি এরা জীবন-সভাস্থলে প্রধান অতিথির আসনে বসে ফুলের মালা পরতে চাননি, তাই পাঠক সহজেই বুঝে যাবেন, কারও লেখাতেও তারা হ্যাঁমলেট, রঘুপতি হতে চান না– আমার নাতিপরিচিত লেখাতেও না।

মনে করুন তার নাম নটরাজন। তার পিতা ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মচারী, আশা করেছিলেন ছেলেও তাঁর মতো চারটে পাস দিয়ে একদিন তারই মতো বড় চাকরি করবে। অন্যায্য আশা করেননি, কারণ নটরাজন ক্লাসের পয়লা নম্বরি না হলেও প্রোমোশন পেত অক্লেশে, আর একটা বিষয়ে স্কুলের ভিতরে-বাইরে সবাইকে ছাড়িয়ে যেত অবহেলে। ছবি আঁকাতে। তার অঞ্চলে এখনও দেওয়ালে রঙিন ছবি আঁকার (মুরাল) রেওয়াজ আছে। তারই ওস্তাদ পটুয়ারা স্বীকার করতেন, নটরাজনের চতুর্দশ পুরুষে যদিও কেউ কখনও ছবি আঁকেননি– তাঁরা খানদানি, পটুয়া হতে যাবেন কোন দুঃখে– এ ছেলে যেন জন্মেছে তুলি হাতে নিয়ে। শুধু তাই না– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এদেশে যখন হরেকরকম রঙের অভাব চরমে পৌঁছেছে তখন নটরাজন দেশের কাদামাটি কাঁকর পাথর ফুলপাতা থেকে বানাতে আরম্ভ করল নানা রকমের রঙ। এটা ঠিক আর্টিস্টের কাজ নয়– এর খানিকটে কেমিস্ট্রি, বাকিটা ক্রাফটসম্যানশিপ। পটুয়ারা নটরাজনকে প্রায় কোলে তুলে নিলেন। তখন তার বয়েস বারো-তেরো।

রবিবর্মা তার অঞ্চলেরই লোক। ওঁর ছবি কিন্তু নটরাজনকে বিশেষ বিচলিত করেনি। হঠাৎ একদিন সে দেখতে পেল নন্দলালের একখানা ছবি। জঘন্য রিপ্রডাকশন রেজিস্ট্রেশন এতই টালমাটাল যে মনে হয় প্রিন্টার তিনটি বোতল টেনে তিনটে রঙ নিয়ে নেচেছে।

নটরাজন কিন্তু প্রথম ধাক্কায় স্তম্ভিত। দ্বিতীয় দর্শনে রোমাঞ্চিত। মধ্য রজনী অবধি সে ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

নটরাজন ছিল অসাধারণ পিতৃভক্ত। তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পিতা কী আশা পোষণ করেন সে তা জানত। কী করে তাকে বলে যে সে তার গুরুর সন্ধান পেয়ে গিয়েছে; সর্বস্ব ত্যাগ করে তাঁর পদপ্রান্তে তাকে যেতেই হবে। তদুপরি কোথায় মালাবার আর কোথায় শান্তিনিকেতন!

পিতাই লক্ষ করলেন তার বিষণ্ণ ভাব। পিতাপুত্রে সখ্য ছিল– দূরত্ব নয়। সব শুনে বললেন, বাধা পথে যে চলে না তার কপালে দুঃখ অনেক। কিন্তু আপন পথ খুঁজে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ আরও বেশি। তোমার ওপর আমার আশীর্বাদ রইল।

অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম যুগ। যারা গোলামি-তালিম চায় না, তারা যাবে কোথায়? বিশ্বকবি কবিগুরু যেন বিধির আদেশে ঠিক ওই শুভলগ্নেই শান্তিনিকেতনে তাদের জন্য নীড় নির্মাণ করেছিলেন– যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম্। দূর সিন্ধু, মালাবার, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, আসাম থেকে ছেলেমেয়ে আসতে লাগল– দলে দলে নয়, একটি-দুটি করে।

যারা এল তাদের মধ্যে দু-চারটি ছিল লেখাপড়ায় বিদ্যেসাগর, বাপ-মা-খ্যাদানো বিশ্ববকাটে। বিশ্বভারতীই তো বিশ্ববকাটেদের উপযুক্ত স্থান, ওই ছিল তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আসলে এরা ছিল কোনও কৌশলে স্কুল থেকে নাম কাটানোর তালে। অসহযোগের সহযোগিতায় তারা সে কর্মটি করল নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে।

বলা বাহুল্য আমি ছিলুম এই দলের।

 হিন্দি-উর্দুতে বলে পাঁচো উঙলিয়া ঘিমে আর গর্দন ডেগমে অর্থাৎ পাঁচ আঙুল ঘিয়ে আর গর্দানটাও হাঁড়ায় ঢুকিয়ে ভোজন। আমরা যে ভূমানন্দ– ভূমা, বিশ্বপ্রেম, অমৃতের পুত্র এসব কথা তখন ছিল আমাদের ডালভাত– আমাদের মধুরতর স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি, এখানে এসে দেখি সে-অমৃত উপচে পড়ছে। সে যুগে বিশ্বভারতীর প্রথম নীতি ছিল, আমি অক্ষরে অক্ষরে তুলে দিচ্ছি : The system of examination will have no place in Visvabharati, nor will there be any conferring of degrees.!!

বঙ্কিম চাটুয্যের কল্পনাশক্তি বড়ই দুর্বল। তিনি রচেছিলেন,

ছাত্রজীবন ছিল সুখের জীবন
যদি না থাকিত এগজামিনেশন।

 বিশ্বভারতী বঙ্কিমের সে স্বপ্ন মূর্তমান করেছিল।

এবং ধর্মত ন্যায্যত প্রাক্তনীতির পিঠ পিঠ আসে : যেখানে পরীক্ষা নেই সেখানে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া না-হওয়া ছাত্রের ইচ্ছাধীন। অতএব রেজিস্ট্রি নেই, রোল-কল্ নেই!

আমাদের অভাব ছিল মাত্র একটি উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট যা-ই হোক– চায়ের দোকান। তাই ছিল ঘরে ঘরে স্টোভ আর চায়ের সরঞ্জাম।

সত্যকুটিরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসে শুনছি ভিতরে স্টোভের শব্দ। কেনগরের মণি গাঙ্গুলি চা বানাচ্ছে। সামনে, গৌরপ্রাঙ্গণ পেরিয়ে, লাইব্রেরির বারান্দায় ঈষৎ প্রাণচাঞ্চল্য আরম্ভ হয়েছে। বৈতালিকের মূলগায়েন শ্রীযুক্ত অনাদি দস্তিদার (পরবর্তী যুগে খ্যাতিপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ) ও দোহারদের ফুলু রায় গান বাছাই করছেন। পূজনীয় বিধু-ক্ষিতি-হরি একটু পরেই আসবেন।

তখনকার দিনে প্রথা ছিল, যারা গত চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর এই প্রথম আশ্রমে এসেছে তারা ভোরের বৈতালিকে উপস্থিত হত। আমাদের দলটা গুঁড়ি গুডিদের তুলনায় ছিল সংখ্যালঘু। অবশ্য আমরা দম্ভভরে গুরুদেবকেই উদ্ধৃত করে বলতুম, The rose which is single need not envy the thorns which are many. কিন্তু তক্কে তক্কে থাকতুম, দল বাড়াবার জন্য।

হঠাৎ চোখ পড়ল নয়া মালের দিকে। দুর থেকে মনে হল চেহারাটা ভালোই ভালোমানুষ। জানালা দিয়ে ভিতরের গাঙ্গুলিকে বললুম, এসেছে রে। গাঙ্গুলি এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে গান ধরল,

শুনে তোমার মুখের বাণী
আসবে ছুটে বনের প্রাণী—

 অর্থাৎ বিশ্বভারতীর ডাক শুনে বনের প্রাণীরা এসে জুটেছে!

ইনিই হলেন আমাদের নটরাজন।

দুপুরবেলা খাওয়ার পর তাকে গিয়ে শুধালুম, টেনিস খেলতে জানো? বড়ই গাইয়া– মাস ছয় পূর্বে আম্মা ছিলুম, এবং বললে পেত্যয় যাবেন না, এখনও আছি– হকচকিয়ে ইয়েস ইয়েস, নো নো, ইয়েস ইয়েস বলল। র‍্যাকেট নেই? কুছ পরোয়া ভি নেই, আমারটা দোবখন। এর পর ভাব হবে না কেন?

তবে লাভ হল না। কলাভবনের ছাত্র। আমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় কম। তবে দেখলুম, বাউণ্ডুলে স্বভাব ধরে। যখন-তখন স্কেচবই নিয়ে খোয়াইডাঙার ভিতর ডুব মারে। সঁওতাল গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে গোপনে যে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় আশ্রম তখনও নিরামিষাশী– সেটা ওকে শিখিয়ে দিলুম। সে তো নিত্যি নিত্যি খোয়াই পেরিয়ে সাঁওতাল গাঁয়ে যায় তার পক্ষে ডিম জোগাড় করা সহজ।

কিন্তু ওই গোবেচারাপারা ছোঁড়াটা পেটে যে কত এলেম ধরে সেটা অন্তত আমার কাছে ধরা পড়ল অল্পদিনের ভিতর। আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে অনেকক্ষণ অবধি এদিক থেকে, ওদিক থেকে, এগিয়ে পিছিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তুলল দুটি ফটো। পরে প্রিন্ট দেখে আমার চক্ষুস্থির। এ যে, বাবা, প্রফেশনালেরও বাড়া! এবং আজ আমি হুনুরের দেবতা বিশ্বকর্মাকে সাক্ষী মেনে বলছি, পরবর্তী যুগে কি বার্লিন কি লন্ডন কেউই টেকনিক্যালি আমার এমন পারফেক্ট ছবি তুলতে পারেনি এবং স্মরণ রাখবেন, নটরাজনের না ছিল কৃত্রিম আলো বা স্টুডিয়ো।

এর পর যা দেখলুম সে আরও অবিশ্বাস্য। নটরাজনের অন্যতম গুরুর প্রথম মেয়ের বিয়ে। কোথায় গয়না গড়ানো যাবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। স্বল্পভাষী নটরাজন অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ শোনার পর বলল, আমাকে মালমশলা দিন। আমি করে দিচ্ছি। সবাই অবাক; তুমি শিখলে কোথায়? বলল, শিখিনি, দেখেছি কী করে বানাতে হয়। নন্দলাল চিরকালই অ্যাডভেঞ্চার-একত্সপেরিমেন্টের কলম্বাস দিলেন হুকুম, ঝুলে পড়।

বিশ্বকর্মাই জানেন স্যাকরার যন্ত্রপাতি কোত্থেকে সে জোগাড় করল, কী কৌশলে কাজ সমাধা করল। গয়না দেখে কে কী বলেছিলেন সেটা না বলে শুধু সবিনয় নিবেদন করি, হিন্দু বিয়েতে বরপক্ষ আকছারই সহিষ্ণুতায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসেন না– তারা পর্যন্ত পঞ্চমুখে গয়নার প্রশংসা করেছিলেন।

নটরাজনের অন্যান্য গুণ উপস্থিত আর উল্লেখ করছি না। তার পরবর্তী ঘটনা বোঝার জন্য একটি গুণকীর্তন করি। এস্তেক বর্ণপরিচয় স্পর্শ না করে শুধু কান দিয়ে সে শিখেছিল অদ্ভুত সড়গড় চলতি বাঙলা। আমাকে শুধু গোড়ার দিকে একদিন শুধিয়েছিল, বাঙলার কি কোনও স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ নেই? উচ্চারণে উচ্চারণে যে আসমান-জমিন ফারাক? কোনটা শিখি?।

শান্তিনিকেতনে তখন ছিল নিরঙ্কুশ বাঙাল রাজত্ব। পাঁচটা বাঁদরের বদলে পাস্টা বাদর হামেশাই ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে পড়ার বদলে বেড়িয়ে পরত, অবিড়াম ঝড়ঝড় বাড়ি-ধাড়ার মাঝখানে। আমি নটরাজনকে বললুম আর যা কর কর, দোহাই আল্লার, আমার উচ্চারণ নকল করিনি। আমি বাঙালস্য বাঙাল– খাজা বাঙাল। আর করিসনি শুরুদেবের। তার ভাষা, তার উচ্চারণ তাঁর মুখেই শোভা পায়। করবি তো কর তোর গুরু নন্দলালের উচ্চারণ। বাঙলায় এম.এ. পাস ধুরন্ধররাও ওরকম সরল লৈতি বাঙলা বলতে পারে না।

তার পর ঝাড়া বিশটি বছর আমাদের দুজনাতে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, চিঠি-পত্রও না। এই বিশ বৎসরের ভিতর বাঙলা দেশে থাকলে পৌষমেলায় কখনও-সখনও শান্তিনিকেতন গিয়েছি। ওর সাক্ষাৎ পাইনি। সত্যি বলতে কি, ওর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম। শুধু কেউ কখনও অচলিত গান

জগপতি হে
সংশয় তিমির মাঝে
না হেরি গতি হে

গাইলে মনে পড়ত নটরাজন ওর সুরটা বড় দরদভরা করুণ সুরে বাঁশিতে বাজাত।

১৯৪৭ সাল। স্বরাজ যখন পাকা ফলটির মতো পড়ি পড়ি করছে, ওই সময়ে আমি একদিন বাঙ্গালোরের এক রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাচ্ছি। দেখি, তিনটি প্রাণী ঢুকে এককোণে আসন নিল। একজন চীনা কিংবা জাপানি ছোট্টখাট্টো একমুঠো মেয়ে, দ্বিতীয়া সুডৌলা তরুণী–খুব সম্ভবত তামিল– এবং সঙ্গে এ কে? নটরাজন! চেহারা রত্তিভর বদলায়নি। শুধু কপালটি আরও চওড়া হয়েছে, চুলে বোধহয় অতি সামান্য একটু পাক ধরেছে। আমার চেহারা বদলে গেছে আগাপাশতলা কিন্তু আর্টিস্ট নটরাজনকে ফাঁকি দিতে হলে প্লস্টিক সার্জারি করাতে হয়, এবং চোখদুটো আই-ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়। নটরাজন আমাকে দেখামাত্র উঠে এসে আমাকে তার টেবিলে নিয়ে গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। তামিলটি লেডি ডাক্তার, বিধবা, প্র্যাকটিস করেন, এবং জাপানিটি তাঁর স্ত্রী। শুধালাম, তুমি আবার জাপান গিয়েছিলে নাকি? সেই মুখচোরা নটরাজন মুখচোরাই রয়ে গেছে। বলল, অনেক বছর কাটিয়েছি।

সেদিন আর বেশি কথাবার্তা হল না। শুধু বলল, শহরের তিন মাইল দূরে ফাঁকা জায়গায় সেরামিকের ছোটখাটো কারখানা করেছে, বাড়িও। আমাকে শনিবার দিন উইক-এন্ড করতে সেখানে নিয়ে যাবে। আমার ঠিকানাটা টুকে নিল।

এস্থলে বলে রাখা কর্তব্য বিবেচনা করি, আমি কুমোরের হাঁড়িকুড়ি থেকে আরম্ভ করে সেরামিক, পর্সেলিন, গ্লেজড পটারি, ফাইয়াস এসবের কিছুই জানিনে। শুধু এইটুকু জানি যে স্টোনওয়েয়ার পাথরের জিনিস নয়– সেটা আমরা যাকে তামচিনি বলি, মেয়েরা যেসব বোয়ামে আচার-টাচার রাখেন। এটা উল্লেখ করার প্রয়োজন হল এই কারণে যে, সেই সন্ধ্যায় এক বন্ধুকে নটরাজনের কথা তুলতে তিনি বললেন, সেরামিক বাবদে ও যা জানে না, সেটা জানার কোনও প্রয়োজন নেই। বিগেস্ট একত্সপার্ট ইন দি ইস্ট। এখানকার সরকারি সেরামিক ফ্যাক্টরির বড় কর্তা।

শনির সন্ধ্যায় নটরাজন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার বউ একটিমাত্র কথা না বলৈ যা যত্ন-আত্তি করল সেটা দেখে বুঝলুম কেন চীন-জাপানে প্রবাদ প্রচলিত আছে চীনা খাদ্য আর জাপানি স্ত্রী স্বর্গ-সুখ; চীনা স্ত্রী আর জাপানি খাদ্য– নরক ভোগ। জাপানি স্ত্রীজাতির মতো কর্মঠ, শান্ত, সেবাপরায়ণ রমণী নাকি ইহসংসারে নেই।

আহারাদির পর নটরাজনের স্ত্রী বললেন, দুই বন্ধুতে কথাবার্তা বলুন।

নানা কথা হওয়ার পর আমি বললুম, জাপানের কথা কও।

নটরাজন সে রাত্রে কিছুটা বলেছিল, পরে আরও সবিস্তার।

বলল, শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর আমার ধারণা হল যে, আর্টসের চেয়ে ক্রাফটুসেই আমার হাত খোলে বেশি।

আমি বললুম, সে আর বলতে! সেই যে, গয়না বানিয়েছিলে!

বলল, সেকথা আর তুলো না। হাত ছিল তখন বড়ড় কাঁচা। তা সে যাক্। নানা ক্রাফ্ট শিখলুম অনেক জায়গায়। শেষটায় চোখ পড়ল পর্সেলিনের দিকে। সামান্য কিছুটা শেখার পরই বুঝলুম, এ একটা মারাত্মক ব্যাপার, একটা নতুন জগৎ, এর সাধনায় আস্ত একটা জীবন কেটে যায়। মেলা কেতাবপত্র ঘেঁটে আবিষ্কার করলুম যে, যদিও চীন এই কর্মে একদা সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল, ড্রেসডেনও একদা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল, এখন কিন্তু জাপান এর রাজা।

ঘটি-বাটি বিক্রি করে চলে গেলুম জাপান।

টোকিয়ো পৌঁছনোর কয়েকদিন পরেই দেখি আমার ল্যান্ডলেডি চীনামাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার কাছ থেকে খবর পেলুম, পর্সেলিন অর্থাৎ চীনামাটির বাসনকোসন, কাপ-সসার বানানো এদেশে কুটিরশিল্পও বটে। সে কী করে হয়! যে মাটি দিয়ে পর্সেলিন তৈরি হয় তার থেকে বালু আর অন্যান্য খাদ সরাবার জন্য ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবস্থা করতে হয় অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমি এখানে, বাঙালোরে এসে করেছি, কিন্তু ঠিক ওত্রাচ্ছে না, এখানকার মাটি ভালো নয়– খরচাও বিস্তর। ল্যান্ডলেডি বলল, বাজারে রেডিমেট কাদা বিক্রি হয়। আমি ল্যান্ডলেডিকে বললুম, সে না হয় হল, কিন্তু পোড়াবে (fire করবে) যে, তার জন্যে কিলন ফারনেস্ (পাঁজা) পাবে কোথায়?

আমি বাধা দিয়ে নটরাজনকে বললুম, আমাদের কুমোররা—

বলল, হায়, হায়! ওই টেম্পারেচারে মাটির হাঁড়িকুড়ি হয়। গ্লেজড পটারির– এদেশের সব বস্তুই তাইজন্য আরও টেম্পারেচার তুলতে হয়, আর কমসে কম দু হাজার ফারেনহাইট না হলে–

আমি বললুম, থাক, থাক্। ওসব অমি বুঝব না।

বলল, হ্যাঁ, সেই ভালো। তার পর খবর নিয়ে ন্যাজেমডো অবধি ওকিবহাল হয়ে গেলাম। নিজের চাই শুধু একটা পটারস হুইলকুমোরের চাক। বাজার থেকে রেডিমেড কাদা এনে তাতে চড়িয়ে বানাবে যা খুশি। সেগুলো ভেজা থাকতে থাকতেই তার উপর আঁকবে ছবি নিজস্ব আপন অনুপ্রেরণায়, এবং একই ছবি দুসরা সেটে আবার নকল করবে না, যেরকম খাস পেন্টাররা একই ছবি দু দুবার আঁকেন না। ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠেলায় করে নিয়ে যাবে কিওলার কাছে। বহু লোকের কাছ থেকে একরাশ জমা হলে তবে সে ফায়ার করবে, নইলে খর্চায় পোষায় না। তবে মোটামুটি বলে দেয় কবে এলে তোমার মাল তৈরি পাবে। মাল খালাসির সময় দেবে তার মজুরি। তার পর তুমি তোমার মাল পর্সেলিনের দোকানে দিয়ে আসতে পারো তারা বিক্রি করে তাদের কমিশন নেবে কিংবা তুমি ঠেলা ভাড়া করে তার উপর মাল সাজিয়ে ফেরি করে বেড়াতে পারো।

আমি বললুম ব্যবস্থাটা উত্তম বলতে হবে। তার পর?

জিনিসটা যে এত সরল-সহজ করে এনেছে জাপানিরা সেটা আমি জানতুম না। সেইদিনই সবকিছু জোগাড় করে লেগে গেলুম কাজে। টেকনিকেল দুটো-একটা সামান্য জিনিস ল্যান্ড লেডির করার ধরন থেকে অনায়াসে শিখে নিলুম। আর এ ব্যাপারে তো এই আমার পয়লা হাতেখড়ি নয়। আর কাপ, পটে আঁকার মতো ছবির বিষয়বস্তু নিয়েও আমার কোনও দুর্ভাবনা ছিল না।

মাল যখন সমুচা তৈরি হল, তখন কিছুটা দিলুম দোকানে; আর ঠেলা নিয়ে ফেরি করতে কার না শখ যায়?

ভারতীয় বলে সর্বত্রই পেলুম অকৃপণ সৌজন্য ও সাহায্য। তুমি জানো কি না জানিনে, এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক ভবঘুরে জাপানি না জানি কী করে ভাসতে ভাসতে পৌঁছয় তোমাদের ঢাকা শহরে। ভাবতেই কীরকম মজা লাগে– দুনিয়ার সব জায়গা ছেড়ে ঢাকা। তবে ওই চিরসবুজের দেশ– আমারও দেখা আছে– তাকে এমনি মুগ্ধ করল যে, সে সেখানে একটা সাবানের কারখানা খুলল এবং শেষটায় একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়েও করল। বাপ-মাকে দেখাবার জন্য একবার নিয়ে গেল তার বউকে জাপানে। বুদ্ধের দেশের মেয়ে জাপানে এসেছে খবরটা দেশময় ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে। সেই অজ পাড়াগাঁ রাতারাতি হয়ে গেল জাপানের তীর্থভূমি। হাজার হাজার নরনারী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে কন্যার দর্শনাভিলাষে। ভাবো, মেয়েটার অবস্থা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে বসতে হল পদ্মাসনে, আর নতন্ত্র জাপানিদের লাইন তাকে প্রণাম করে পাদ্যঅর্থ দিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করল।

আমি বললুম মহিলাটি ঢাকায় ফিরে তাঁর জাপান-অভিজ্ঞতা বাঙলায় লেখেন, বড় সবিনয় ভাষায়। আমি পড়েছি। সে তো এলাহি ব্যাপার হয়েছিল।

হবে না? আমার আমলে আমাদের রাসবিহারীবাবু ছিলেন জাপানিদের সাক্ষাৎ দেবতা। ভারতবর্ষ থেকে জাপানে যে কেউ আসুক না কেন– এমনকি ইংরেজও তার কাগজপত্র যেত ওঁর কাছে। তিনি না বললে পত্রপাঠ আগন্তুকের জাপান ত্যাগ ছিল অনিবার্য। আর গুরুদেবের কাছ থেকে কেউ চিঠি নিয়ে এলে রাসবিহারীবাবু তাকে সমাজের সর্বোচ্চদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধের জন্মদিনে তার বাড়ি থেকে প্রসাদ বিতরণ হত– কিউ দাঁড়াত মাইল দুয়েক লম্বা। সিঙাড়া না আমাদের দেশের কী একটা খাবার জাপানিদের কাছে রোমান্টিক এবং হোলি।

আমি অবশ্য পারতপক্ষে মাতৃভূমির পরিচয় দিতুম না।

তবু বিক্রি হতে লাগল প্রচুর। তার কারণ সরল। পাত্রের গায়ে অজানা ডিজাইন, নবীন ছবি– তা সে ভালো হোক আর মন্দই হোক– সক্কলেরই চিত্ত-চাঞ্চল্য এনে দেয়। তারই ফলে আমি পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগলুম। ফেরি-টেরি আর করিনে– নিতান্ত দু মাসে ছ মাসে এক-আধ দিন রোমাসের জন্য। করে করে দু বছর কেটে গেল।

একদিন ওই ঠেলা গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে আমি জিরোচ্ছি, এমন সময় এক থুরথুরে অতিবৃদ্ধ জাপানি খানদানি সামুরাই অন্তত আমার তাই মনে হল– থমকে দাঁড়ালেন ঠেলার সামনে। কিন্তু এর মুখে দেখি তীব্র বিরক্তি। পুরু পরকলার ভিতর দিয়ে ক্ষণে তাকান আমার দিকে, ক্ষণে ঠেলার মালের দিকে। জাপানিরা অসহ্য রকমের অসম্ভব দ্র; অসন্তুষ্টি কিছুতেই প্রকাশ করতে চায় না। এর কিন্তু ধৈর্যের বাধ যেন টুটে গেল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এসব কী? এসব কী করেছ? যাও, যাও, ওস্তাদ ওসিমার কাছে। তোমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। তার পর আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন, এরকম সুরেলা গলা নিয়ে কি বিশ্রী বেসুরা গান!

আমি বাড়িতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লুম। সত্যিই তো, আমি এ দু বছরে নতুন শিখেছি কী? কাদা কী করে তৈরি করতে হয়, কিলন কী করে জ্বালাতে হয়– অন্যসব বাদ দিচ্ছি–কিছুই তো শিখিনি। দেশে ফিরলে ওগুলো আমায় করে দেবে কে? আর বাসনকোসনের শেপে, ছবিতে নিশ্চয়ই মারাত্মক ত্রুটি আছে, নইলে রাস্তার বুড়ো ওরকম খাপ্পা হল কেন?

চিন্তা করতে করতে মনে পড়ল শান্তিনিকেতন মন্দিরে গুরুদেবের একটা সারমনের কথা। সোনার পাত্রে সত্য লুকানো রয়েছে– সবাই পাত্র দেখে মুগ্ধ, ভিতরে হাত দিয়ে খোঁজে না, সত্য কোথায়। আমার হয়েছে তাই। এখানে কাঁচা পয়সা কামিয়ে আমি অবহেলা করেছি সেরামিকের নিগূঢ় তত্ত্ব।

কিন্তু আর না।

ওস্তাদ ওসিমা সম্বন্ধে খবর নিয়ে কিন্তু বিশেষ ভরসা পেলুম না। তিনি বাস করেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে, এবং গত দশ বছর ধরে কোনও শাগরেদ নিতে রাজি হননি। তবে সবাই একবাক্যে বললেন, ওরকম গুণী এখন তো কেউ নেই-ই; সেরামিকের ইতিহাসেও কমই জন্মেছেন।

যা হয় হবে কুল-কপালে। সব জিনিসপত্র বিক্রি দিয়ে, একফালি বিছানা আর একটি সুটকেস নিয়ে পৌঁছলুম সেই গায়ে, খুঁজে বের করলুম ওস্তাদের বাড়ি।

জাপানি ভাষা কিন্তু আমি বাঙলার মতো সুদু কান দিয়ে শিখিনি। প্রথম দিন থেকে রীতিমতো ব্যাকরণ অভিধান নিয়ে তোমরা যেরকম আশ্রমে শাস্ত্রীমশায়ের কাছে সংস্কৃত

আমি বললুম, থাক, থাক্।

ওস্তাদের ঘরে ঢুকে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে অতিশয় বিনয়, ততোধিক বশ্যতা প্রকাশ করে তাঁর শিষ্য হওয়ার ভিক্ষা চাইলুম।

যেন বোমা ফাটল : বেরিয়ে যাও এক্ষুণি, বেরোও এখান থেকে।

আমি ভয়ে ভয়ে এসেছিলুম সত্যি, কিন্তু এরকম পদাঘাত প্রত্যাশা করিনি।

আরম্ভ করলুম কাকুতিমিনতি, সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, আমি হত্যে দেব ইত্যাদি। আর শুধু মাটিতে মাথা ঠেকাই।

অনেকক্ষণ পর তিনি অতিশয় শান্ত সংযত কণ্ঠে বললেন, আমি কী করি না করি সেকথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করিনে। তবু তোমাকে বলছি– বিদেশি বলে। আমার কাছে লোক এসে দু-চার মাস তালিম নিয়ে পালিয়ে গিয়ে রটায় তারা আমার শিষ্য। কিছুই তারা শেখেনি– আর আমার নাম ভাঙিয়ে খায়। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আর কোনও শিষ্য নেব না।

আমি বললুম, নটরাজন, বরোদার ওস্তাদ গাওয়াইয়া ফইয়াজ খানও হুবহু ঠিক একই কারণে তাঁর জীবনের শেষের দিকে আর কোনও চেলা নিতেন না।

নটরাজন বলল, ওদের দোষ দিইনে, কিন্তু আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। আমি আমার ওস্তাদকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি ওরকম কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। তিনি অটল অচল, নির্বাক।

কী আর করি! বারান্দায় গিয়ে বসে রইলুম বিছানাটার উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি নাছোড়বান্দা, জীবনমরণ আমার পণ।

ঘণ্টাখানেক পর ওস্তাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় চলে গেলেন আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি এক লফে ঘরের ভিতর ঢুকে তার চাকরকে খুঁজে বের করে বললুম, দাদা, এখন তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি আমায় সাহায্য কর। সে আগেই শুরুর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ শুনেছিল। তাকে বখশিশের লোভও দেখালুম। তার অনুমতি নিয়ে ওস্তাদের সবকখানা ঘরে লাগালুম ঝট, ঝাড়াই-পোঁছাই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তন্ন তন্ন করে। গামলার জল পাল্টালুম, রঙতুলি গুছিয়ে রাখলুম, জামা-কিমোনো ভাঁজ করলুম, বিছানা দুরুস্ত করলুম। তার পর ফের বারান্দায়, বিছানার উপর। ওস্তাদ ঘন্টাখানেক পরে ফিরে এসে দরজার সামনে এক লহমার তরে একটু থমকে দাঁড়ালেন। কিন্তু নির্বাক। এবার চাকরকে চায়ের হুকুম দিলেন। আমি আড়াল থেকে লক্ষ করলুম। ঘন্টাখানেক পরে খেয়ে শুতে গেলেন। আমি গাঁয়ের যে একটিমাত্র খাবারের দোকান ছিল সেখানে শুটকি-ভাত খেয়ে এলুম। ওস্তাদ ঘুম থেকে উঠে চায়ের জন্য হাঁক দিতেই আমি রান্নাঘর থেকে চায়ের সরঞ্জাম এনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে চা তৈরি করে কাপ এগিয়ে দিলুম। তিনি তখন আমার দিকে পিছন ফিরিয়ে ভেজা পাত্রে ছবি আঁকছিলেন। পেয়ালা হাতে নিয়েই ঘাড় ফিরিয়ে একবার কুটি-কুটিল নয়নে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু নির্বাক। এর পর আমি রঙ গুলে দিতে লাগলুম। যাই বল, যাই কও– আমিও আটিস্ট। কখন কোন রঙের দরকার হবে আগের থেকেই বুঝতে পারি। তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি নির্বাক।

সে রাত্রে আমি বারান্দাতেই ঘুমিয়েছিলুম। কিন্তু ওই এক রাত্রিই।

ভোর থেকেই লেগে গেলুম চাকরের কাজে। তার পরের দিন। ফের পরের দিন। চাকরটা এখন আর তার ঘরেই ঢাকে না। তিনি নির্বাক।

আমি দু বেলা হোটেলে গিয়ে শুটকি-ভাত খাই, আর রাত্রে চাকরের পাশে শুই।

 বিশ্বাস করবে না, এই করে করে প্রায় একমাস গেল। তিনি নির্বাক।

 মাসখানেক পরে একরাত্রে আমি আমার ইচ্ছা, আর কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। যা দেখেছি সেইটে কাজে লাগাবার অদম্য কামনা আমার ঘুম তাড়িয়ে দিয়েছে। অতি চুপিসাড়ে ওস্তাদের পটার্স হুইলের পাশে বসে একটা জাম-বাটি তৈরি করতে লাগলুম তন্ময় হয়ে। হঠাৎ পিঠের উপর একটা বিরাশি সিক্কার কিল আর হুঙ্কার।

কোন গর্দভ তোমাকে শিখিয়েছে ওরকমধারা বাটি ধরতে? কোন মর্কট তোমাকে শিখিয়েছে ওরকম আঙুল চালাতে? প্রত্যেকটি জিনিস ভুল। যেন ইচ্ছে করে যেখানে যে ভুলটি করার সেটা মেহন্নত করে করে শিখেছ। হটো ইহাসে!

গুরু প্রথম নিজে করলেন। কী বলব ভাই, তাঁর দশটি আঙুল যেন দশটি নর্তকী। প্রত্যেকটির ফাংশান যেন ভিন্ন ভিন্ন, নাচে আপন আপন নাচ। তার পর আমাকে বসিয়ে আমার হাতে হাত ধরে শুরু করলেন গোড়ার থেকে। আর শুধু বলেন, হা আমার অদৃষ্ট, এসব গলদ মেরামত করতে করতেই তো লেগে যাবে পাঁচটি বচ্ছর!

এই আমার প্রথম পাঠ। ভোর অবধি চলেছিল।

সকালবেলা চা খেতে খেতে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভুল প্র্যাকটিস যে কী মারাত্মক হতে পারে তার কল্পনাও তোমার নেই। তোমার ঘর ঝাট দেওয়া, রঙ গোলা থেকে আমি অনুমান করেছিলাম তোমার হাত আছে, কিন্তু অসম্ভব খারাপ রেওয়াজ করে করে তার যে সর্বনাশ করে বসে আছ সেটা জানলে প্রথমদিনই পুলিশ ডেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিতুম। এখন দেখি, কী করা যায়। এ-ও আমার এক নতুন শিক্ষা! তোমাকে নেব দুই শর্তে। প্রথম, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার কাজ জনসাধারণকে দেখাতে পারবে না। দ্বিতীয়, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি শিক্ষা ক্ষান্ত দিয়ে পালাতে পারবে না।

আমি বুদ্ধের নামে শপথ করলুম।

তার পর, ভাই আরম্ভ হল আমার পিঠের উপর ব্লাদা চালানো। একই কাজ একশো বার করিয়েও তিনি তৃপ্ত হন না–আর মোস্ট এলিমেন্টারি টাস। সঙ্গীতের উপমা দিয়ে বলতে পারি, এ যেন স্রেফ সা রে গা মা পা ধা নি সা সা নি ধা পা মা গা রে সা। সা রে গা মা পা ধা নি– 

আমি বললুম, বোমা পড়ে জাপানি!

নটরাজন অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী? আমি বললুম সিলেটে গত যুদ্ধে প্রথম জাপানি বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য কবি রচেন,

সা রে গা মা পা ধা নি
 বোমা পড়ে জাপানি
 বোমার মধ্যে কালো সাপ
বিটিশে কয় বাপ রে বাপ!

নটরাজন বলল, আমার অবস্থা তখন ব্রিটিশের চেয়েও খারাপ। তারা তো পালিয়ে বেঁচেছিল, আমার যে পালাবারও উপায় নেই। তবে শুরু এখন বাঙ্ময়। চা খেতে খেতে, বেড়াতে যেতে যেতে ফাইয়াস-পর্সেলিনের গুহ্যতম তত্ত্ব বোঝাতেন, কিন্তু রেওয়াজের বেলা সেই প্রাণঘাতী সা রে গা মা।

পাক্কা দেড়টি বছর পরে পেলুম দ্বিতীয় পাঠ!

ইতোমধ্যে দেখি, এ-দেশের ব্যাপারটাই আলাদা! অনেকদিন একটানা পাত্র গড়ে তার উপর ছবি এঁকে যখন এক উঁই তৈরি হল তখন গুরু কিনে সেগুলো ঢুকিয়ে করলেন ফায়ারিং। ইতোমধ্যে পটারির সমঝদারদের কাছে নিমন্ত্রণ গেছে, অমুক দিন অমুকটার সময় তাঁর পটারির প্রদর্শনী। ঢাউস ঢাউস মোটর চড়ে, গ্রাম্যপথ সচকিত করে এলেন লক্ষপতিরা। তাঁরা চা খেলেন। সার্ভ করলুম। সবাই ভাবলেন আমি বিদেশি চাকর। একজন একটু কৌতূহল দেখিয়েছিলেন, গুরু সেটা অঙ্কুরেই বিনাশ করলেন। তার পর ওঁদের সামনেই কিলন থেকে পটারি বের করা হল। পাঁচশো থেকে আরম্ভ করে, এক এক সেট দুহাজার তিন হাজার টাকায় সব– সব বিক্রি হয়ে গেল। দেশে, বিলেতে মানুষ যেরকম ছবি, মূর্তি কিনে নিয়ে আপন কলেশন বানায়।

তার পর আস্তে আস্তে অনুমতি পেলুম পাত্রের গায়ে ছবি আঁকবার। পুরো এক বছর ধরে পাত্র গড়ি, ছবি আঁকি কিন্তু কিনে ঢোকবার অনুমতি পাইনে। ভেঙে ফেলতে হয় সব। সে কী গব্বযন্ত্রণা!

এমন সময় এল শুরুর আরেকটা প্রদর্শনী। আমি গোপনে গুরুর উঁইয়ের সঙ্গে আমার একটা কাপ এক কোণে রেখে দিলুম। ডিজাইন দিয়েছিলম পারশিয়ান। আমাদের দেশে তো সেরামিকের ঐতিহ্য নেই, আর পারশিয়ান ডিজাইন জাপানে প্রায় অজানা।

চায়ের পর কিলন খোলার সময় প্রায় একই সময়ে সকলের দৃষ্টি পড়ে গেল আমার কাপটার ওপর। আমি আশা করেছিলুম, ওটা আমি গোপনে সরিয়ে নিতে পারব। আমি তখন ছোঁ মেরে সেটা সরিয়ে করলুম পলায়ন। ওঁদের ভিতর তখন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে আমার কাপ নিয়ে নিলাম। গুরু বসবার ঘরে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে কাপটি রাখলুম। তখন তারা বুঝলেন, এটা কার কাজ। গুরু স্মিতহাস্যে ওঁদের সবকিছু বয়ান করে বললেন, শিগগিরই ওর আপন প্রদর্শনী হবে। আপনারা কে কী চান অর্ডার দিয়ে যান।

ওরা চলে গেলে আমি সব বুঝিয়ে গুরুর কাছে মাফ চাইলুম। তিনি প্রসন্ন বদনে বললেন, দু-চার মাসের ভিতর এমনিতেই হত। তোমাকে কিছু বলিনি।

আমি কাজে লেগে গেলুম। গুরু আপন কাজ বন্ধ করে দিয়ে পই পই করে তদারকি করলেন আমার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ বা অঙ্গুলিচালনা।

নিমন্ত্রণপত্র বেরুল তাঁর নামে। আমার প্রথম প্রদর্শনী। গুরু বললেন, তোমার একটা ফটো ছেপে দাও চিঠিতে।

নটরাজন বলল, দাঁড়াও, সে চিঠির একটা কপি বোধহয় বউয়ের কাছে আছে। তাঁকে স্মরণ করা হলে তিনি নিয়ে এলেন একটা অ্যালবাম্। তাতে মেলা প্রেস-কাটিংস। নটরাজনের প্রদর্শনীর রিভিউ। নিমন্ত্রণপত্রে তাজ্জব হয়ে দেখি ফটোতে নটরাজনের মাথায় খাস পাঠান পাগড়ি! আমি বললুম এ কী? বলল, ভাই, জাপানিরা ওই পাগড়িটাই চেনে। ওটা হলেই ইন্ডিয়ান!

আমি শুধালুম, তার পর?

প্রদর্শনী হল। গুরু ময়ূরটার মতো প্যাখম তুলে ঘোরাঘুরি করলেন। বেবাক্ মাল বিক্রি হয়ে গেল। কড়া কড়া টাকা পেলুম। কাগজে কাগজে রিভিউ বেরোল।

নটরাজনের স্ত্রী বললেন, তিনি জাপানের অন্যতম সেরা আর্টিস্ট বলে স্বীকৃত হলেন।

নটরাজন বলল, সেসব পরে হবে। আমার মস্তকে কিন্তু সাত দিন পরে সাক্ষাৎ বজ্রাঘাত। চাঁদের আলোতে ঝরনাতলায় চুকচুক করে সাকে খেতে খেতে গুরু বললেন, এইবারে বৎস, তোমার ছুটি। টোকিওতে গিয়ে আপন পসরা মেলো।

আমি আর্তকণ্ঠে বললুম, গুরুদেব, আমার যে কিছুই শেখা হয়নি।

গুরু বললেন, বৎস শেখার তো শেষ নেই। কিন্তু গুরুর কাছ থেকে তালিম নেবার একটা শেষ থাকে। তোমাদের স্কুল-কলেজেও তো শেষ উপাধি দিয়ে বিদায় দেয়। তখন কি আর গুরু শোনে তোমার মিনতি যে, তোমার কিছুই শেখা হয়নি? আমি যেসব হুনর পুরুষানুক্রমে পেয়েছি তার প্রত্যেকটি তোমাকে শিখিয়েছি। এবারে আরম্ভ করো সাধনা।

আমার সব অনুনয়-বিনয় ব্যর্থ হল। বললেন, মাঝে মাঝে এসো; তোমার কাজ দেখে আলোচনা করব। নির্দেশ দেব না, আলোচনা করব।

আমি পরের দিন আমার সঞ্চয়ের সব অর্থ গুরুর পদপ্রান্তে রাখলুম– গুরুদক্ষিণা। তিনি একটি কড়িও স্পর্শ করলেন না। অনেক চেষ্টা দিলুম। আবার তিনি নির্বাক! সেই প্রথমদিনের মতো।

বেশ খানিকক্ষণ কী যেন একটা ভেবে নিয়ে নটরাজন বলল, এঁর সঙ্গে কিন্তু একটা সাইড-ড্রামাও আছে।

সেটা কী?

 মুচকি হেসে বলল, তাঁর কন্যার—

মিসেস উঠে বললেন, আমি চললুম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া।

 নটরাজন বলল, তার কন্যার পাণিগ্রহণের অনুমতি চাইলুম।

 আমি বললুম, সে কী! এর তো কিছু বলনি!

বললুম তো, সে অন্য নাট্য। আরেক দিন বলব।

 গুরু কী বললেন?

দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, আমার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না যে আমার গুণী মেয়ে কোন আনাড়ির হাতে পড়ে, যে সেরামিকের রস জানে না। তোমরা দুজনাতে আমার ঘরানা বাঁচিয়ে রাখবে, সমৃদ্ধ করবে। আমার স্ত্রী সত্যি ভালো কাজ করতে পারে।

***

পরের দিন শুধালুম, দেশে ফিরে কী করলে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানতুম এদেশে অলঙ্ বাধাবিঘ্ন। কাদা-কিলুনের কথা বাদ দাও, আমার হ্যান্ডপেন্টেড অরিজিনাল জিনিস পাঁচশো-হাজার টাকা দিয়ে কিনবে কে? এদেশে তো এসব কেউ জানে না– ভাববে আমি পাগল, একটা টি-সেটের জন্য পাঁচশো টাকা চাইছি। এদেশে জাপানি ক্রোকারি আসে মেশিনে তৈরি মাস্-প্রোডাকশন্। আমার তো প্রতি মাসে অন্তত সাতশো, হাজার টাকা চাই। জাপানে প্রতি মাসে পাঁচ-সাত হাজারও কামিয়েছি।

আমি বললুম, এ কী ট্র্যাজেডি! যা শিখলে তার সাধনা করতে পেলে না?

হেসে বলল, আমি কি পয়লা না শেষ? বিদেশ থেকে উত্তম সায়ান্স শিখে এসে কত পণ্ডিত উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে এদেশে শুকিয়ে মরে! আর যারা ছবি আঁকে? তাদেরই-বা কজনের অন্ন জোটে? তাই একটা চাকরি নিয়েছি– দেখি, অবসর সময়ে যদি কিছু

আমি উৎসাহের সঙ্গে বললুম, তোমার চাকরিটা তো ভালো। তোমাদের সেরামিক ফ্যাক্টরি শুনেছি, ভারতের সর্বোত্তম। সবচেয়ে বেশি টেম্পারেচার তুলতে পারো তোমাদের কিনে।

অট্টহাস্য করে নটরাজন বলল, ইনসুলেটার! ইনসুলেটার! লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি! টেলিগ্রাফের খুঁটির মাথায় সাদা মুণ্ডুটা দেখেছ? আমরা বানাই সেই মাল। অষ্টপ্রহর তাই বানিয়েও বাজারের খাই মেটাতে পারিনে। কোম্পানির ওতেই লাভ, ওতেই মুনাফা। আর দয়া করে ভুলো না, হরেক রকম ইনসুলেটর সেরামিক পর্যায়েই পড়ে! হা-হা হা-হা, যেমন দেয়ালে যে রঙ লাগায় সে-ও পেন্টার, অবন ঠাকুরও পেন্টার।

ইনসুলেটার হে, ইনসুলেটার!!

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *