প্রেমের প্রথম ভাগ

প্রেমের প্রথম ভাগ

সর্বপ্রথমই করজোড়ে নিবেদন, এ অধম মরালিটি-ইমমরালিটি কোনওকিছুই প্রচারের জন্য এই ফরাসি হ্যান্ডবুক ফর বিগিনার্স ইন ল লিখতে বসেনি। অবশ্য স্বীকার করি, আমি প্রাচীনপন্থী কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বলে নিই– যাতে করে আমার প্রতি অবিচার না হয়– মডার্ন কবিতা, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ট্রাম-বাস পোড়ানো, পেট-কাটা ব্লাউজ ইত্যাদির বিরুদ্ধে না আছে আমার কোনও অভিযোগ, না চাই আমি দেশের জনসাধারণকে তন্মধ্যে আমি নিজেও আছি– খ্রিস্ট-বুদ্ধ রূপে দেখতে। বিশেষত ঐতিহাসিক উপন্যাস। জনসাধারণে রটে গেছে, আমি নাকি ওই বস্তুর শত্রু। এটা আমার প্রতি বেদরদ জুলুম। প্রথমত, জনপ্রিয় কোনও জিনিস, অভ্যাস বা আদর্শের শত্রু হতে আমি কিছুতেই সম্মত হইনে। দ্বিতীয়ত, ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখতে গেলে পথে যেসব খানাখন্দ পড়ে, সেগুলোর প্রতি লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি তো ওঁদের সেবা করে নিজেকে ধন্য মনে করেছি। বস্তুত আমি নিজেই একখানা লিখব বলে স্থির করেছি। তবে নিশ্চয়ই জানি অধুনা যেগুলো জনপ্রিয় তার চেয়ে আমার বই অনেক নিরেস হবে; ভরসা এই, দালদাই বাজারে বেশি বিক্রি হয়, আমারটার কাটতি সেই কারণেই হবে অধিকতর।

তবে আমার এ ফরাসি হ্যান্ডবুক লেখার সময় ইতিহাসের শরণ নেব অল্পই। যদিও আমার মনে হয়, পেট-কাটা বা টপ-লেসের নিন্দায় যখন হরিশ মুখুজ্যেরা কলরব করে ওঠেন তখন আধুনিকাঁদের উচিত একটুখানি ইতিহাসের পাতা উল্টোনো, কিংবা ইতিহাসের বাস্তব নিদর্শনভূমি মিউজিয়মে গমন। জাতকে আছে, একটি জেদি রমণী বসন্তোৎসবে যাবার সময় একটি বিশেষ রকমের দুর্লভ ফুল কামনা করে তার স্বামীকে রাজার বাগানে চুরি করতে পাঠায়। ধরা পড়ে বেচারা যখন শূলে চড়েছে তখন সে তার নিষ্ঠুর অকালমৃত্যুর জন্য রোদন করেনি। সে উচ্চকণ্ঠে শোক প্রকাশ করছিল এই বলে, আমি মরছি তার জন্য আমার দুঃখ নেই, প্রিয়ে; আমার ক্ষোভ, তুমি আমার প্রিয় পুষ্পপ্রসাধন করে যে বসন্তোৎসবে যেতে পারলে না তার জন্য।

তা হলে সপ্রমাণ হল, তথাগতের যুগেও রমণী ফ্যাশানের জন্য এমন ফুলও কামনা করতেন, যেটা শুধু রাজবাড়িতেই পাওয়া যেত, এবং সেটা জোগাড় করার দুঃসাহসিক অভিযানের ফলস্বরূপ তিনি বিধবা হতেও রাজি ছিলেন। এবং শুধু তাই নয়, সে-যুগের স্বামীসম্প্রদায় অতিশয় দার-নিষ্ঠ ছিলেন। প্রিয়ার মনোরঞ্জনাৰ্থে হেলায় প্রাণ বিসর্জন দিতেন। এই দৃষ্টান্ত কি এ-যুগের যুবক-সম্প্রদায়কে আত্মোৎসর্গের স্বর্গীয় পন্থা অবলম্বনে উদ্বুদ্ধ করবে না?

অবশ্য পাঠক বলতে পারেন এ ধরনের ঘটনা সাতিশয় বিরল।

সাতিশয় বিরলই যদি হবে তবে আমাদের কবিগুরু ওই ধরনের উদাহরণই জাতক থেকে। নেবেন কেন?

–বালক কিশোর,
উত্তীয় তাহার নাম, ব্যর্থ প্রেমে মোর
উন্মত্ত অধীর। সে আমার অনুনয়ে
 তব চুরি-অপবাদ নিজস্কন্ধে লয়ে
দিয়েছে আপন প্রাণ।

এবং যেন এ কবিতাতেই প্রোপাগান্ডা কর্ম নিঃশেষ হল না বলে কবি বৃদ্ধ বয়সে ওই বিষয় নিয়ে আরও মনোরঞ্জক, আরও চিত্তচাঞ্চল্যকর গীতি নৃত্য-নাট্য শ্যামা রচনা করলেন।

এস্থলে উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করি যে, আমার যতদূর মনে পড়ছে মূল জাতকে গল্পটি একটু অন্যরকমের। আমার স্মৃতিশক্তি হয়তো আমাকে ঠকাচ্ছে, কিন্তু আমার যেন মনে পড়ছে, উত্তীয়কে কোনওকিছু না বলেই তাকে শ্যামা নগরপালের কাছে পাঠায়। তাকে আগের থেকেই শ্যামা বলে রেখেছিল, কিংবা উত্তীয়েরই হাত দিয়ে চিঠি লিখে তাকে জানায়, পত্রবাহককে শূলে চড়াও; বজ্রসেনকে মুক্তি দাও। এবং বোধহয় ঘুষের টাকাও কিছু ছিল, আর সেটাও উত্তীয় তার আপন ভাণ্ডার থেকেই দিয়েছিল তাবৎ ঘটনার কোনওকিছুই না জেনেশুনেই। আবার মাফ চাইছি, ভুল হতে পারে, শ্যামা বোধহয় উত্তীয়কে বলে তুমি এই চিঠি ও অর্থ– সেটা শ্যামার কিংবা উত্তীয়ের নগরপালকে দিয়ে এলে আমি একান্ত তোমারই হব।

পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি শ্যামা বা পুষ্পবিলাসিনীর কার্যকলাপ সম্মতির চোখে দেখছি। আধুনিকাঁদের অধঃপাতগমনের অহেতুক অভিযোগ কানে এলে আমার এসব দৃষ্টান্ত মনে আসে, এই মাত্র।

তবে এ নিয়ে ভাববার আছে।

যে কালে মুরুব্বিরা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে দিতেন, সে সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের মুরুব্বিদের ভিতর ভালো বর পাওয়ার জন্য যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হত না তা নয়। বস্তুত যে কনের সঙ্গে লোভনীয় বরের বিয়ের কথাবার্তা এগিয়ে গেছে তার বিরুদ্ধে নাকি উড়ো চিঠি পর্যন্ত যেত তৃতীয় কন্যাপক্ষ থেকে। আশ্চর্য হবার কিছু নেই। সংগ্রামে আবার নীতি কী! এবং কিছুমাত্র নতুন তত্ত্ব নয় যে, কুরু-পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্র সংগ্রামে যে নীতি অবলম্বন করেছিলেন সে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এ যুগে, বিশেষ করে কলকাতা এবং অন্যান্য বড় শহরে অনেক মেয়েকেই বাধ্য হয়ে বরের সন্ধানে বেরুতে হয়। এবং বররাও বেরোন কন্যার সন্ধানে। ফলে বিত্তশালী, রূপবতী বা উচ্চশিক্ষিতা যার যেমন অভিরুচি কনের জন্য ছোকরাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগে যায়, এবং উল্টোটাও হয়। বোধহয় সুলেখক সুবোধ ঘোষের গল্পেই পড়েছি, তিনটি মেয়ে তিনটি ফুলের তোড়া নিয়ে পাল্লা দেয় এক শাসালো বরকে স্টেশনে সি-অফ করতে গিয়ে।

এসব বিয়ে যে দেখামাত্রই দুম্ করে স্থির হয় না সে কথা বলা বাহুল্য। কিঞ্চিৎ পূর্বরাগ, প্রেম বা প্রেমের অভিনয়ের প্রয়োজন হয়। কোনও কোনও স্থলে এটাকে কোর্টশিপও বলা হয়। আমাদের দেশে একদা গান্ধর্ব-বিবাহের প্রচলন ছিল। সে বিবাহ হত বিবাহের পূর্বেকার প্রণয়ের ভিত্তিতে।

কিন্তু এদেশে এখনও প্রণয়ের কোনও কোড় নির্মিত হয়নি, অর্থাৎ যুবক-যুবতীতে কতখানি প্রণয় হওয়ার পর ছেলে কিংবা মেয়ে আশা করতে পারে যে এবারে অন্য পক্ষ তাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত, এবং তখন যদি সে হঠাৎ তাকে ত্যাগ করে অন্য কাউকে ভালোবাসতে আরম্ভ করে তবে সমাজে তার নিন্দা হয়। ইউরোপে মোটামুটি দুটো ধাপ আছে। দু-জনাতে প্রণয় হওয়ার ফলে যদি ছেলেটা মেয়েটিকে ফরাসিতে আমি, জর্মনে ফ্রয়েভিন (গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে এটাকে ঘনিষ্ঠতর বলে ধরা হয়) বলে উল্লেখ করে তার তখনও মোটামুটি বিয়ের দায়িত্ব আসে না। এটা প্রথম ধাপ। কিন্তু ফরাসিতে ফিয়াসে– জর্মনে ওই একই শব্দ বা ফেরট ব্যবহৃত হয়– পর্যায়ে পৌঁছলে সেটাকে দ্বিতীয় ধাপ বলা হয়। এবং সে সময় যদি যুবক তাকে এনগেজমেন্ট আংটি দেয় (অর্থাৎ মেয়েটি তখন বাগদত্তা হল যদিও অর্থটা কিছু ভিন্ন) তবে সেটা বিয়ের প্রতিশ্রুতি বলেই ধরা হয়। তার পর সে বিয়ে করতে না চাইলে অনেক স্থলে মেয়েটি আদালতে প্রতিজ্ঞা বা চুক্তিভঙ্গের মোকদ্দমা করে খেসারতি চাইতে পারে। সমাজে বদনাম তো হয়ই। মহাভারতে রুক্মিণী বাগদত্তা ছিলেন বলে পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করলে শ্রীকৃষ্ণের শত্রুপক্ষ তাঁর নিন্দা করে।

এদেশে প্রণয়ের কোনও স্তরেই বোধহয় এরকম আংটি দেবার রেওয়াজ প্রচলিত হয়নি। তবে প্রণয় ঘনীভূত হওয়ার পর (কতটা ঘনীভূত এবং তার চিহ্ন কী, সেটা বলা কঠিন) যদি কোনও পক্ষ অকারণে রণে ভঙ্গ দেয়, তবে তার যে বদনাম হয় সেটা সুনিশ্চিত। ইউরোপেও যে মেয়ে অকারণে একাধিক প্রণয়ীকে পরপর ত্যাগ করে সে জিট এই বদনামটি পায়।

নিছক প্রেমের জন্য প্রেম বিয়ে করার উদ্দেশ্য কারওরই নেই– এটা বোধহয় এদেশে বিরল। ইউরোপে মোটেই বিরল নয়। ছাত্র, ছাত্রী, মেয়ে কেরানি, ছোকরা অ্যাসিসটেন্টের ভিতর এ-জাতীয় প্রেম আকছারই হয়। এ-জাতীয় প্রণয়ের ফলে যদি কোনও কুমারী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যায় তবে কোনও কোনও স্থলে সে যুবকের বিরুদ্ধে খেসারতির মোকদ্দমা আনতে পারে। আমি যতদূর জানি, বিয়ে করতে বাধ্য করাতে পারে না–তবে রাশাতে বোধ হয় সন্তানটি অন্তত পিতার নামটা আইনত পায়, অর্থাৎ জারজরূপে ঘৃণার পাত্র হয় না। ইউরোপে যদি যুবা প্রমাণ করতে পারে যে, মেয়েটার একাধিক প্রণয়ী ছিল তবে তাকে বা অন্য কাউকে কোনও খেসারত দিতে হয় না। এক বলশেভিক আমাকে বলেন, এক্ষেত্রে রাশায় সব কজনাকে খেসারতি ভাগাভাগি করে দিতে হয়।

তবে ইউরোপের মেয়েরা যুগ যুগ ধরে প্রেমের মারফতে বিয়ে করেছে বলে অনেক কিছু জানে, এবং আর পাঁচজন বিচক্ষণ বান্ধবীদের কাছ থেকে উপদেশও পায়।

এদেশের তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে আমার যোগসূত্র নেই। তবে আমার সবসময়েই মনে হয়েছে আমাদের মেয়েরা বড় অসহায়।

***

সিরিয়স প্রবন্ধ লিখব বলে আমার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। আমি প্রণয়, বিবাহ, লাভ ফর লাভ সেক্ ইত্যাদি সম্বন্ধে ফরাসিদের দু-একটি মতামত লিখতে যাচ্ছিলুম মাত্র। এ বাবদে ফরাসিদের অধিকারই যে সবচেয়ে বেশি, সেকথা বিশ্বজন মেনে নিয়েছে। লোকে বলে অবাধ অবৈধ প্রেম নাকি ওই দেশেই সবচেয়ে বেশি। আমি কিছু বলতে নারাজ, তবে একটা কথা জানি। ডিভোর্স বা লগ্নচ্ছেদ ফরাসিরা নেকনজরে দেখে না। পারিবারিক শান্তি ও শিশুদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তারা বড়ই সচেতন। স্বামী-স্ত্রী দুজনাই কিঞ্চিৎ অসংযমী হলে ফরাসি সমাজ সয়ে নেয়, কিন্তু তারা একে অন্যকে ডিভোর্স করতে চাইলে সমাজ অসন্তুষ্ট হয়।

ইউরোপের উন্নত দেশগুলো যে স্থলে গিয়ে পৌঁছেছে আমরাও একদিন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। (অবশ্য তার অর্থ এ নয় যে, আমি ইউরোপের প্রেম তথা বিবাহ পদ্ধতির নিন্দা করছি। বস্তুত বাইরের অন্য সভ্যতা অন্য ঐতিহ্যের মানুষ হয়ে আমার পক্ষে ইউরোপীয় সভ্যতা বিচার করতে যাওয়াটা খুব যুক্তিসঙ্গত নয়। যারা আমার চেয়ে বহু ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত সত্য দেখতে পান তারাই বোধহয় অনাসক্তভাবে আপন দেশ ও বিদেশ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করবার অধিকার ধরেন)। এদেশের ঐতিহ্য তাকে প্রেম বিবাহ প্রভৃতি ব্যাপারে অন্য প্যাটার্ন বানাতে শেখাবে- এই আমার বিশ্বাস।

***

যে ফরাসি যুবতী কয়েকটি তরুণীকে হাসিঠাট্টার ভিতর দিয়ে সদুপদেশ দিচ্ছিলেন তার কথাগুলো শুনে আমি আমোদ অনুভব করছিলুম। তরুণীদের ভাবভঙ্গি-কথাবার্তা থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল তারা যুবতীটিকে প্রেমের ভুবনে রীতিমতো সাকসেসফুল বা বিজয়িনী বলে মনে করছিলেন। তিনি খাচ্ছিলেন কন্যা ও চেসার, অতি ধীরে মন্থরে। অর্থাৎ সামান্য কয়েক ফোঁটা কন্যা পান করে সঙ্গে সঙ্গে অন্য গেলাস থেকে এক ঢোক জল। এই জল কন্যাককে chase করে নিয়ে যায় বলে একে বলে চেসার। যুবতীটি যে পান বাবদে শুধু সমঝদার তাই নয়, আমার মনে হল তিনি এ বাবদে পরিপূর্ণ আত্মকর্তৃত্বও বজায় রাখেন।

লম্বা হোল্ডারে সিগারেট ধরিয়ে ঊর্ধ্বপানে ধুয়োর একসারি চক্কর চালান করে বললেন, লেয়ো ব্লুমের কেতাবখানা মন দিয়ে পড়। বিবাহ সম্বন্ধে তিনি অনেক খাঁটি কথা বলেছেন। রুম একদা ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং তিনি তার বইয়ে বলেন, প্রেম, যৌনজীবন সম্বন্ধে অনভিজ্ঞ যুবক-যুবতীর বিবাহ সাধারণত তাদের জীবনে দীর্ঘকালব্যাপী দাম্পত্য সুখশান্তি দিতে পারে না। উচিত, উভয় পক্ষেরই এ-সব বিষয়ে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর বিয়ে করা। বলা বাহুল্য, এ বই প্রকাশিত হলে ইংলন্ডের অনেকেই এটাকে শকিং গর্হিত বলে নিন্দা করেছিলেন।

সুন্দরীটি ব্লুমের মূল বক্তব্য প্রাঞ্জল ভাষায় পেশ করে বললেন, দেখ, আমি নিজে বিশ্বাস করি, নারী-পুরুষ দুই যুযুধান শক্তি, একে অন্যের শত্রু

একটি তরুণী কফির ঢোক গিলতে গিয়ে মারাত্মক বিষম খেয়ে বলল, আপনি এ কী কথা বলছেন! কবি দুর্গা এখনও আপনার কথা ভুলতে পারেননি– আপনি তাকে বিদায় দেওয়ার পরও। এখনও তার মুখে ওই এক মন্ত্র : আপনার মতো প্রাণ-মন, সর্বহৃদয়, সর্বস্ব দিয়ে এরকম আত্মহারা হয়ে কেউ কখনও ভালোবাসতে পারেনি।

যুবতী স্মিত হাস্যভরা চোখে তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেচারি আঁদ্রে! তোমার এখনও অনেক-কিছু শেখবার বাকি আছে। আমি আর্টিস্ট। আমি যা-ই করি না কেন, সেটাকে পরিপূর্ণতার চরমে পৌঁছিয়ে দিয়ে করি। যখনই ভালোবেসেছি, আত্মহারা হয়েই ভালোবেসেছি। কিন্তু, ডার্লিং, ইহুদিও কি তার ব্যবসা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসে না? তাই বলে সে কি তার মুনাফার কথা ভুলে যায়। যে ব্যবসাকে সে আপন প্রিয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসে তাকে সে অকাতরে বিসর্জন দেয় না, যদি দেখে সেটা দেউলে হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

তাই বলছিলুম, পুরুষ রমণীর শত্রু। যে কোনও পুরুষ আমাকে আত্মহারা হয়ে ভালোবাসলেও একদিন সে আমাকে অকাতরে বিসর্জন দিতে পারে আমি যে রকম সিয়ো দুর্গাকে দিয়েছিলুম। অবশ্য আমি স্যাডিস্ট নই, তাই তাকে ড্রপ করার সময় যতদূর সম্ভব মোলায়েমভাবে সেটা সম্পাদন করি– তদুপরি বলা তো যায় না, কখন কাকে আবার প্রয়োজন হয়।

আরেকটি তরুণী বলল, কিন্তু দান্তে–?

মাদাম বললেন, ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি– যদিও ওঁর কাব্য আমার প্রেমপত্রে কাজে লেগেছে। ওই ধরনের মানুষ আমি দেখিনি। তবে এইটুকু বলতে পারি, যারা কারও বিরহে বা মৃত্যুতে দীর্ঘদিন ধরে আপসা-আপসি করে সেটা শুধু তাদের আত্মম্ভরিতা। নিজের কাছে স্বীকার করতে চায় না যে, এইবারে তার অন্য ব্যবসা ফাঁদা উচিত। মনস্তত্ত্বে ওদের বলা হয় ম্যাজোকিস্ট নিজেকে নিজে কষ্ট দিয়ে সুখ পায়। ওই যে রকম অনেক সর্বত্যাগী অনাহারে থেকে সুখ পান! তোমার-আমার স্বাস্থ্য আছে, ক্ষুধা আছে, আমরা নর্মে। খাদ্য যখন রয়েছে তখন উপোস করব কোন্ দুঃখে?

তবে কি একনিষ্ঠ প্রেম বলে কিছুই নেই?

কী উৎপাত! কে বলল নেই? নিশ্চয়ই আছে। যখন যাকে ভালোবাসবে তখন তার প্রতি একনিষ্ঠ হবে, আঁদ্রের ভাষায় আত্মহারা হবে। একাধিকজনের সঙ্গেও অক্লেশে একনিষ্ঠ হওয়া যায়। ওই তো আমার এক বন্ধু ছিলেন লিয়োতে। সেখানে মাঝে মাঝে উইক-এন্ড করতে যেতুম। চমৎকার কথাবার্তা বলতে জানেন। বাড়িটিও সুন্দর। প্যারিসে প্রতি বৃহস্পতিবারে আমার ফ্ল্যাটে আসতেন আরেক বন্ধু। উনি বিবাহিত। অন্য সময় সুযোগ। পেতেন না। তা ছাড়া চাকরির উন্নতির জন্য অফিসের এক বৃদ্ধ কর্তার সঙ্গে তাঁর মোটরে মাঝে মাঝে বেরুতে হত। তিনি আবার ভয়ানক ভীতু। যদি কেউ দেখে ফেলে! তাই রাত্রে মোটরে করে শহর থেকে দূরে যেতে হয় তাঁর সঙ্গে। এদের প্রত্যেককে যদি একনিষ্ঠভাবে না ভালোবাসি তবে ওই যে বললুম পুরুষ মাত্রই শত্রু– সে শত্রু ধরে ফেলবে না আমার ভারসেটাইলিটি– বহুমুখী প্রতিভা? শুনেছি, এবং বিশ্বস্তসূত্রেই, যে রসরাজ কবি, যোদ্ধা, ঔপন্যাসিক, শাসনকর্তা দাদৃজিয়ে একসঙ্গে একগণ্ডা সুন্দরীর সঙ্গে একনিষ্ঠ প্রেমের উচ্চাঙ্গ সাধনা করেছেন, তিনি একই সময়ে চারজনকে যে চার সিরিজ প্রেমপত্র লিখেছেন, তার প্রত্যেকটি অতিশয় অরিজিনাল মাধুর্যময় কবিত্বপূর্ণ কোনও সিরিজের সঙ্গে কোনও সিরিজের সাদৃশ্য নেই। প্রত্যেকটি বল্ল আপন সিরিজ পেয়ে ধন্য হয়েছেন।

তার পর আরেক তরুণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সুজান, তুমি এ লাইন ছেড়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেল। পল আর মার্সেল তোমাকে একই সময়ে ভালোবাসত; আর তুমি মাত্র দুটোকে সামলাতে পারলে না? হায়! প্যারিস কোথায় এসে পৌঁছচ্ছে? আর ডার্লিং সুজান, তুমি নাকি জানতেও না, পল্ আর মার্সেল উভয়েরই তখন আরেক প্রস্থ প্রিয়া ছিল!

স্যুজান তাজ্জব মেনে বলল, তাই নাকি। মঁ দিয়ো!

নানেৎ বলল, ডিভাইড অ্যান্ড রুল? দ্বিধা করে সিধা রাখ?

 মাদাম বললেন, ও! তা কেন? মেনাজ্ আ ত্রোয় (menage a trois = management by three) যদিও এখন ফ্রান্সে একটু আউট অব ডেট– তবু তিনজনে মিলেমিশে থাকাটা তো ট্রায়েল পেতে পারে, কিন্তু সবসময়েই মনে রাখতে হবে শান্তিভঙ্গ যেন না হয়, নো স্ক্যান্ডাল, প্লিজ! আর ডুয়েল, খুন, আত্মহত্যা এগুলো তো বর্বরতার চরম ভুল বললুম, বর্বরদের ভিতর এসব অপ্রিয় ঘটনা প্রায় কখনওই ঘটে না। এগুলো ঘটলে মনের অশান্তি খানিকটে হয় বটে, কিন্তু তার চেয়ে মারাত্মক বদনাম ছড়ায় ভবিষ্যতের বিয়ের বাজারে। অবশ্য এমন কোনও বদনাম নেই যেটা আস্তে আস্তে মুছে ফেলা যায় না। এবং কোনও কোনও স্থলে একাধিক পুরুষ আকৃষ্ট হয় ফাম্ ফাতা (fatal woman) বিপজ্জনক রমণীর প্রতি।

ইনি তাদেরই একজন কি না সেটা জানবার কৌতূহল আমার পক্ষে স্বাভাবিক।

ইতোমধ্যে তার কন্যা শেষ হয়ে গিয়েছে দেখে গুটিতিনেক তরুণী একসঙ্গে ওয়েটারকে ডাকল। যুবতী রাজ-রাজেশ্বরীর মতো বাঁ হাতখানা দিয়ে যেন বাতাসের একাংশ দু টুকরো করে অসম্মতি জানালেন, বললেন, সুইট অব ইউ, কিন্তু জানো তো আমার সোনার খনিতে এখন ডবল শিফটে কাজ চলছে। দ্বিতীয় শিফটটায় আমি অবশ্য অনেকখানি সাহায্য করি। এমনিতেই আমি একগাদা টাকার কুমিরকে চিনতুম, এখন আমার মারি (স্বামী) প্রতি রাত্রেই দু-একটি নয়া নয়া বাঘ-ভালুক শিকার করছেন আমাকে তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে।–তোমরা বরঞ্চ শ্যামপেন খাও।

তরুণীদের একাধিকজন আনমনা হয়ে ভাবল, তাদের জীবনে এ সুদিন আসবে কবে?

হঠাৎ যেন বিজয়িনীর একটি গভীর তত্ত্বকথা মনে পড়ল। গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু, যাদুরা, একটি কথা মনের ভিতর ভালো করে গেঁথে নিয়ো। ব্লুম এটা বলেননি। সর্বপ্রেমের চরম গতি যখন পতিলাভ তখন সে-পথে নামবার আগে একটি মোক্ষম তত্ত্ব ভুললে চলবে না। ব্লুম বলেছেন, প্রথম ইদিক-উদিক প্রেম এবং ফ্যাকটুস অব্ লাইফ সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর, ইংরেজিতে পুরুষের বেলা যাকে বলা হয় বুনো ভুট্টা বপন সেইটে হয়ে গেলে পর বিয়ে করবে। তা হলে একে অন্যের প্রতি সহিষ্ণুতা হবে অনেক বেশি, একে অন্যকে সাহায্য করতে পারবে অনেক বেশি দাম্পত্যজীবন তাই হবে দীর্ঘকালব্যাপী ও মধুর। ব্লুমের উদ্দেশ্য অতিশয় মহৎ এ-বিষয়ে কেউ সন্দেহ করবে না। অমি তো নিশ্চয়ই করব না, কারণ তিনি অতিশয় নীতিবাগীশ

কোরাস উঠল তাবৎ তরুণী কণ্ঠে, কী বললেন, মাদাম?

কণামাত্র বিচলিত না হয়ে মহিলাটি ধীরেসুস্থে আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে বললেন, কট্টর নীতিবাগীশ, ধর্মভীরু, আচারনিষ্ঠ এবং ছিন্নভিন্ন উদ্দেশ্যহীন ফরাসিসমাজকে নৈতিক দৃঢ়ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ব্যগ্র। তিনি ইহুদি, এবং অনেকেই যেরকম তার ইহুদি-ভ্রাতা ফ্রয়েটকে ভুল বোঝে, এর বেলাও তাই হয়েছে। আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি এবং জানি, তিনি নীতি, মরালিটিতে অতিশয় আস্থাবান। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন, প্রাচীন নীতি পরিবর্তন করে বরং বলব সেটা পরিপূর্ণভাবে কার্যকরী ও কল্যাণময়ী করে সম্পূর্ণতর করে তোলবার জন্য নবীন নীতির প্রয়োজন। তিনি সেইটে প্রবর্তন করতে চান। কিন্তু এই নবীন নীতি প্রবর্তন করতে পারি শুধু আমরা ফরাসিরাই। যেরকম আমরাই সর্বপ্রথম ফরাসিবিদ্রোহ করে সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা প্রবর্তন করি। ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি জর্মনিরও লাগবে এ নীতি গ্রহণ করতে অন্তত একশো বছর। তারা তো এখনও গণতন্ত্রটাই রপ্ত করতে পারেনি। আর যেসব দেশ ধর্ম উৎপাদন করেছে যেমন প্যালেস্টাইন, আরবদেশ, ইন্ডিয়া, এরা এ নীতি কখনও গ্রহণ করতে পারবে না, আর যদি করে তবে তাদের সর্বনাশ হবে।

আমি মনে মনে সম্পূর্ণ সায় দিলুম। এবং যোগ দিলুম, হয়তো চীন পারবে।

কিন্তু একটা প্র্যাকটিকাল উপদেশ আমি দিই। বিয়ের পূর্বের সর্ব অভিজ্ঞতা যেন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে হয়। তার প্রথম কারণ তারা প্রবীণতর, পকৃতর। তাদের কাছে শুধু প্রণয় নয়, জীবনের মূল্যবান আরও অনেক-কিছু শেখা যায়। কিন্তু খবরদার আহামুকের মতো ককখনও তাকে বলবে না, তোমার বউকে ডিভোর্স করে আমাকে বিয়ে কর। এক্সপেরিমেন্টের ইঁদুরকে আকাট মূর্খও বিয়ে করে না।

আরেকটা কারণ বললে তোমাদের তরুণ-হৃদয়ে হয়তো একটু বাজবে।

ওই বিবাহিতদেরই দু পয়সা রেস্ত থাকে। বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে আর স্রেফ হাওয়া খেয়ে খেয়ে জীবনের কোনও অভিজ্ঞতাই সঞ্চয় হয় না। সেটা হয় জনসমাজে। ক্লাব, রেস্তোরাঁ, অপূরা, জুয়োর কাসিনো, রেস্, রিভিয়েরা, সুইজারল্যান্ড ভ্রমণ, এগুলো না করলে, না চষলে কোনও এলেমই হয় না, যেটা তোমার ভবিষ্যৎ স্বামী ও দাম্পত্যজীবনে কাজে লাগবে।

আরেকটা সুবিধে, বলা তো যায় না, তিনি যদি মাত্রা সামলাতে না পেরে তোমাকে বিয়ে করতে চেয়ে বসেন, তুমি তখন অতিশয় ব্রীড়া সহকারে বলতে পারবে, আমি চাইনে যে আপনার স্ত্রীকে ডিভোর্স করে আপনি একটি পরিবার নষ্ট করুন।

এবং শেষ সুবিধে, যেদিন তুমি কেটে পড়তে চাইবে, সেদিন স্বচ্ছন্দে বলতে পারবে, আমারও তো সংসার পাততে হবে, আমারও তো সমাজের প্রটেকশন দরকার, তার পর ব্লাশ করে বলবে, আমিও তো, আমিও তো মা হতে চাই।

কী বলব পাঠক, সে যা অনবদ্য অভিনয় করলেন সেই বিবাহিতা যুবতীটি– আহা যেন ষোল বছরের তরুণীটি, ভাজা মাছটি উন্টে খেতে জানেন না। ধন্য নটরানি প্যারিস, ধন্য তোমার অভিনয়, ধন্য তোমার নব মরালিটি! সাধে কি লোক বার বার বলে, সি প্যারিস অ্যান্ড ডাই। প্যারিস দেখার পর পৃথিবীতে দেখবার মতো আর তো কিছু থাকে না।

তবে আমার অনুরোধ, অন্যান্য বহু বস্তু নির্মাণ করার সময় ফ্রান্সে আইনত যেমন ছাপ মারতে হয়, নট ফর একত্সপোর্ট–বিদেশে চালান নিষিদ্ধ, এই নব মরালিটির উপরও যেন তেমনি ছাপটি সযত্নে মারা হয়।

তবে আমি এটি আমদানি করলুম কেন? বুঝিয়ে বলি। বিদগ্ধা যুবতীটি যা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলেছিলেন আমি তার সহস্রাংশের একাংশও বলিনি। আমি শুধু সেটুকুই বলেছি, যেটুকু আপনার জানা থাকলে যদি কখনও প্যারিসের ওই নব মরালিটিটি এদেশে চোরাবাজার দিয়ে বা স্মাগড় হয়ে চলে আসে তবে যেন তৎক্ষণাৎ সেটি চিনতে পারেন।

চার্লি চ্যাপলিন এই কর্মটি করেছিলেন। অনেকেই তার মিশিয়ে ভেদু ছবি দেখেছেন। চ্যাপলিনের পূর্বেও তার সময়ে ইউরোপের কোনও কোনও দার্শনিক সাড়ম্বর প্রচার করেন, জীবনসংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেন সর্বাস্ত্র প্রয়োগ করে সর্ব প্রতিদ্বন্দ্বীকে অর দ্য কঁবা–দরকার হলে খতম করে দেয়। সেই হাস্যাস্পদ দর্শনের বেকুব চরম পরিণতি প্রমাণ করার জন্য চ্যাপলিন দেখান কীভাবে একজন লোক একটার পর একটা ধনী প্রাপ্তবয়স্কা রমণীকে বিয়ে করে তাকে সুকৌশলে খুন করে অর্থ সঞ্চয় করতে থাকে। কিন্তু খুনের কৌশলটি ছবিতে দেখাননি।

আমিও বিদগ্ধা প্যারিসিনীর আসল অস্ত্রটির রহস্য সযত্নে গোপন রেখেছি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *