শ্রমিক ইউনিয়ন ও বেকার সমস্যা
কলকাতায় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ
৪ জুলাই ১৯৩১
বিগত আঠেরো বছরে শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের শক্তি কিংবা আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, এমন দাবি আমরা করতে পারি কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। বরং আমার মনে হয়, ওই সময়ে সে আন্দোলন পিছিয়েই পড়েছে। পিছিয়ে পড়ার কারণ অনেক, কিন্তু আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে মনে হয়, প্রধান দুটি কারণ হল প্রথমত, নাগপুরে আন্দোলনের বিভক্ত হয়ে যাওয়া, এবং দ্বিতীয়ত, আইন-অমান্য আন্দোলনের দরুন শ্রমিক-ইউনিয়ন আন্দোলনের একাগ্রতার হানি। আমাদের কমরেডদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো ভাবতে পারেন বিভক্ত হওয়ার ফলে আমাদের শক্তি কমেনি, কিন্তু আমি তা মনে করি না। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, অন্তত এখনকার মতো বিভাগের ফলে আমরা দুর্বল হয়েছি। সেই কারণে, যাঁরা আন্তরিকভাবে এই বিভাগের জন্যে দুঃখিত, আমি তাঁদের অন্যতম, এবং আমাদের মধ্যে ঐক্য যদি স্থাপিত হয়, আমি সর্বান্তঃকরণে তাতে খুশি হব। দ্বিতীয় কারণটির কথা বলতে গেলে, আমার মনে হয় আইন অমান্য আন্দোলনের আকর্ষণ যেহেতু প্রবলতর, সারা দেশের মনোযোগ শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের দিক থেকে সরে গিয়েছে। পরিস্থিতি অন্য রকম হলে আইন অমান্য আন্দোলনের দরুন শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের লাভই হত, তার শক্তি বৃদ্ধি পেত। কিন্তু এখন যা হয়েছে, শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলন তার স্বাভাবিক অগ্রগতিতে বাধা পেয়েছে।
শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের ভিতর থেকেই নানা ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। অতএব, কোন কোন প্রশ্ন নিয়ে আমাদের বিবাদ এবং বর্তমান অবস্থায় ঐক্য-স্থাপনের শ্রেষ্ঠ উপায় কী, আমি মনে করি এ-সব কথা স্পষ্ট করে বললে ভাল হয়। প্রধান বিচার্য বিষয়গুলি হল (১) বিদেশী সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, (২) জেনিভাতে প্রতিনিধি প্রেরণ, (৩) শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রস্তাব অবশ্যপালনীয় কি না।
প্রথম প্রস্তাবটির বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মত, বিদেশী কোনও সংস্থার সঙ্গে এখনই সম্পর্ক স্থাপনের দরকার নেই। ভারতের শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলন নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে পারবে। যে কোনও মহল থেকেই শিক্ষা নিতে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, এমন কি পৃথিবীর যে কোনও জায়গা থেকে সাহায্য এলে তাও গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আমস্টারডাম কিংবা মস্কোর হুকুমের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত নয়। ভারতকে উদ্ভাবন করতে হবে তার নিজস্ব পদ্ধতির, তার নিজের পরিবেশ, নিজের প্রয়োজনের মতো করে তৈরি করতে হবে নিজেকে।
জেনিভাতে প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে বলি, আমার মনে হয় এই বিষয়টিকে অনাবশ্যক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল হবে মন খোলা রাখা, এবং প্রতি বছর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। জেনিভাতে প্রতিনিধি পাঠাব কি না সে বিষয়ে আগেভাগে চিরকাল বহাল থাকবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। ব্যক্তিগতভাবে জেনিভার ওপর আমার কোনও আস্থা নেই। তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিয়ে বছর বছর সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের বন্ধুরা যদি কেউ সন্তুষ্ট হন, আমার কোনও আপত্তি নেই তাতে।
শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রস্তাবগুলি যে অমান্য করা চলে না, সে বিষয়ে বলি, শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসের অস্তিত্ব যদি বজায় রাখতে হয়, এবং তাকে যদি কাজ করতে হয়, তা হলে, আমার মনে হয়, কোনও রকম আপস চলবে না। দেশে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের জন্য যদি তাকে কাজ করতে হয়, শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসের সমস্ত প্রস্তাব কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সমস্ত ইউনিয়নকে মানতে হবে। শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসকে এক শিথিল ফেডারেশনে, কিংবা সর্ব-দলীয় সমাবেশ জাতীয় কিছু একটাতে পর্যবসিত করলে তা হবে আত্মহত্যা।
শ্রমিক ইউনিয়নের ঐক্য সম্পর্কে আমার বক্তব্য পরিষ্কার। আমি ঐক্য চাই এই কারণে যে, তা হলে আমরা একটি শক্তিশালী সংঘ গড়ে তুলতে পারব। কিন্তু আবার যদি আমরা ঝগড়াঝাঁটি করি, আলাদা হয়ে যাই, তা হলে এখন জোড়া-তাড়া দিয়ে একটা ঐক্য স্থাপন করার দরকার নেই। শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেস সর্ব-সাধারণের সম্পত্তি, সমস্ত ইউনিয়ন তাতে যোগ দিতে পারত, তাদের উপস্থিতি যাতে টের পাওয়া যায়, তা করতে পারে। তার ফলে কংগ্রেসের পদাধিকার যদি কোনও একটি দলের হাতে চলে যায়, ন্যায্যত কেউ আপত্তি করতে পারবেন না। অতএব আমি সমস্ত ইউনিয়নকে আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ করছি শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসে যোগ দিতে, ইচ্ছে করলে তার কার্যকরী সমিতি দখল করতে।
মহাত্মা গান্ধী এবং লর্ড আরউইনের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তাতে আমাদের কর্মীরা কেউ কেউ অতিশয় বিচলিত। সেই চুক্তির সমালোচনা আমি করতে চাই না, কারণ সেটা হবে পোস্টমর্টেম করার মতো কাজ। চুক্তি যা হবার হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সেটাকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারি। গত বছর আইন অমান্য আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশেষ কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু ভবিষ্যতের আন্দোলনে ইচ্ছে করলে তারা অপেক্ষাকৃত বড় অংশ গ্রহণ করতে পারে। তা করতে গেলে প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করা দরকার।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস করাচি অধিবেশনে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে, মৌলিক অধিকার প্রস্তাব নামে সেটি পরিচিত। সেই প্রস্তাব সম্বন্ধে নানা মত ব্যক্ত হয়েছে। এক দিকে, কেউ কেউ তাকে সর্বাংশে ধিক্কার দিয়েছেন, যথেষ্ট নয় বলে, অসন্তোষজনক বলে। আবার, অন্য দিকে, অন্যেরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু আমার মনে হয়, এই দুই মতই একদেশদর্শী। প্রস্তাবটি যতই অসন্তোষজনক হোক, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে চিরাচরিত ধারা থেকে স্বতন্ত্র নতুন একটি ধারার সূত্রপাতের, শ্রমিক ও কৃষকদের একটা স্বীকৃতিদানের, সমাজতন্ত্রের অভিমুখে এক সুনিশ্চিত পদক্ষেপের সাক্ষ্য দিচ্ছে প্রস্তাবটি। প্রস্তাবটিতে কী আছে না আছে, আপাতদৃষ্টিতে তার মূল্য বোঝা যাবে না, দেখতে হবে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। আমাকে যেটা আকৃষ্ট করে, সেটা প্রস্তাবের বিষয়বস্তু নয়, সেটা তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা। প্রস্তাবটির বিষয়বস্তুকে আরও ভাল করতে হবে, ভাল করে বুঝিয়ে বলতে হবে, তা হলেই সেটি সন্তোষজনক হবে। একটি কমিটি ইতিমধ্যেই সে কাজ আরম্ভ করেছে দেখে আমরা খুশি হয়েছি।
এ দেশের লোক এখন গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের এখনকার যা মনোভাব, যা মানসিকতা, তাতে আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না যে সে বৈঠক থেকে প্রকৃত কোনও ফলোদয় হবে। তা ছাড়া গোলটেবিল বৈঠকটি এমনই বস্তু যে সেখানে জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের দাবি জোর দিয়ে হাজির করা অত্যন্ত কঠিন, বৈঠকের ফলাফল ঘোষণা করা হলে তখন জনসাধারণের, তাঁরা যা উপযুক্ত মনে করবেন, তাই করবার সময় আসবে। সেই মনস্তাত্ত্বিক মুহূর্তটি এলে জনগণ যেন তাকে বৃথা যেতে না দেন।
কংগ্রেসের নাগপুর অধিবেশনে হুইটলি কমিশনকে বয়কটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে কমিশন সদ্য তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। ঠিক ন্যায়শাস্ত্র অনুযায়ী কাজ করতে গেলে সে রিপোর্ট আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করতে হয়। কিন্তু তা আমি করব না। সে রিপোর্ট ভাল হোক, মন্দ হোক, ভালো-মন্দ কিছুই না হোক, ওই রকম দলিল, জনসাধারণের সামনে যা এখন উপস্থিত, জনসাধারণ যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে, যার সমালোচনা করতে বাধ্য, তাকে অগ্রাহ্য করা উচিত নয় আমাদের।
প্রথমেই আমি বলতে চাই, কোনও একটি কমিশনের একটি রিপোর্টের মূল্য কাগজে-কলমে তাতে কি আছে তার ওপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে শেষ পর্যন্ত তার ফল কী হবে, তার ওপর। কমিশনের পিছনে যে অর্থ ব্যয় হয়েছে তা কি যুক্তিযুক্ত বলে প্রমাণিত হবে? এক, সাধারণ লোকেই সে প্রশ্ন করবে। আমরা ভারতীয়েরা এত রিপোর্ট দেখেছি যে, একমাত্র রিপোর্ট দাখিল করা ছাড়া, অন্য কোন বাস্তব সুফল আমরা কোনও কমিশনের কাছ থেকে পাব কি না সে বিষয়ে অবিশ্বাস এবং সন্দেহ আমাদের মনে থাকতে বাধ্য। এমন কি, বলতে পারি, অতীতে কোনও কোনও কমিশন সর্বাংশে লোকের নিন্দাই কুড়িয়েছে, কেন না তাদের রিপোর্টে ভাল যা ছিল তাকেও গভর্নমেন্ট কাজে পরিণত করতে পারেনি।
বর্তমান রিপোর্টে শ্রমিক-কল্যাণ কর্মসূচীর সমস্যার ওপর যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে, এবং যদিও আমি হুইটলি কমিশনকে বয়কটের পক্ষেই ভোট দিয়েছিলাম, এ কথা বলতে আমার কোনও দ্বিধা নেই, এ বিষয়ে কমিশনের সুপারিশগুলি যদি কার্যকর করা হয়, বর্তমান অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হবে। তবু আমি বলতে বাধ্য, কতকগুলি বৃহত্তর এবং বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন বিবেচনা করা হয়নি। আজকের শ্রমিক দাবি করে কাজের অধিকার। রাষ্ট্রের কর্তব্য নাগরিকের কর্মে বিনিয়োগের সুযোগের সংস্থান করা। যদি কাজের সংস্থান না করতে পারে, রাষ্ট্রকে তার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে। অর্থাৎ, শ্রমজীবী নাগরিককে নিয়োগকর্তা যখন খুশি রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবেন, তার ফলে সে না খেয়ে থাকবে, এ হতে পারে না। এ দেশের শিল্প ব্যয়-সংকোচের ফলে এক সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। নিয়োগকর্তার নানা অসুবিধার কথা আমি খেয়াল করছি না, তা নয়। তখনকার সব শ্রমিক-কর্মচারীকে কাজে বহাল রাখা এক অসম্ভব ব্যাপার তাঁদের পক্ষে, ছাঁটাই করতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সে-রকম ক্ষেত্রেও রাষ্ট্র সব দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। নিয়োগকর্তাকে বলা দরকার, যখন সুদিন ছিল, দরিদ্র শ্রমজীবীদের সাহায্যে তিনি যদি লাভের পাহাড় জমিয়ে তুলে থাকেন, আজ দুর্দিনে তাদেরকে ভাগ্যের হাতে সমর্পণ করবেন, তা চলবে না। এই ছাঁটাইয়ের সমস্যার যত দিন না সন্তোষজনক সমাধান হচ্ছে, দেশে শিল্পক্ষেত্রে শান্তি আসতে পারে না।
প্রত্যেক শ্রমিক যেমন কাজ দাবি করতে পারেন, তেমনই জীবনধারণের উপযোগী মজুরিও দাবি করতে পারেন। আজ ভারতে কারখানা-শ্রমিক কি বেঁচে থাকার মতো মজুরি পান? চটকল, কাপড়ের কল, এ-সবের দিকে তাকান। তাদের বিপুল মুনাফার কতটুকু অংশ ব্যয় করে তারা দরিদ্র নিপীড়িত শ্রমিকদের জন্যে? আমি জানি তারা বলবে, ইদানীং তারা দুরবস্থায় পড়েছে। কিন্তু সে কথা মেনে নিলেও, আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি না, অতীতে সংরক্ষিত খাতে তারা কত জমিয়েছে? এ প্রসঙ্গে ভারতীয় রেলপথের কথাও আমি ভুলব না। তারা এখন যে খুব তৎপরতার সঙ্গে ছাঁটাই করছেন, তাঁদের অবশ্যই কর্তব্য আছে সেই শ্রমিকদের প্রতি, যাঁদের সাহায্যে অতীতে তাঁরা মুনাফার অঙ্ক স্ফীত করেছেন, সংরক্ষিত খাতে টাকা জমিয়েছেন। আমাদের চা-বাগানের মালিকদের কথাও আমরা বলতে পারি। তাঁরা মুনাফা কী রকম করছেন? আর তাঁদের শ্রমিকদের প্রতি কী আচরণ করছেন? এ কথা কি ঠিক নয়, যে অন্তত কোথাও কোথাও দরিদ্র শ্রমিকদের এমন অবস্থা যে প্রাচীন দাসপ্রথার সঙ্গে তার অনেক সাদৃশ্য? শ্ৰম কমিশনার তা হলে কী সুপারিশ করেছেন, যাতে ভারতীয় শ্রমজীবী জীবনধারণের উপযোগী মজুরি পান, ভাল ব্যবহার পান? তাঁরা পাটশিল্পে ও বস্ত্রশিল্পে ন্যুনতম মজুরির কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ন্যূনতম মজুরি মানে যে জীবনধারণের উপযোগী মজুরি, সে বিষয়ে কি আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি?
হুইটলি কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশের খুঁটিনাটি নিয়ে বিচার করবার আমার দরকার নেই। শুধু তার একটি বিষয়ের কথা আমি বলতে চাই। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও ভারতে শ্রমিক ইউনিয়ন আন্দোলনের উন্নতির প্রশ্নে তার তাৎপর্য সাংঘাতিক। রিপোর্টে আছে, শ্রমিক ইউনিয়ন আইনের ২২ নং ধারার সংশোধন প্রয়োজন, যাতে কোনও রেজিস্টার্ড শ্রমিক ইউনিয়নের পদাধিকারীদের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশকে, যে শিল্পের সঙ্গে সেই ইউনিটটি সম্পৃক্ত, তাতে নিযুক্ত অথবা কর্মরত থাকতে হবে এমন ব্যবস্থা থাকে। কমিশনের জানা উচিত ছিল, ভারতে সাধারণত শ্রমিক ইউনিয়নের পদাধিকারী হিসাবে বহিরাগত, অথবা যাঁরা শ্রমিক নন, তাঁদের নির্বাচন করা হয় এই কারণে যে শ্রমিক কর্মচারী যাঁরা পদাধিকারী হিসাবে কাজ করতে রাজি হন, নানা ছুতোয় নিয়োগকারীরা তাঁদের উৎপীড়ন করে থাকেন। কাজেই, শ্রমিক-কর্মচারীরা যদি নিজেরাই পদাধিকারী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন, এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে তাঁরা নিয়োগকর্তাদের হাতে নিগৃহীত না হন। না হলে, এখনকার নিগ্রহনীতি যদি চলতে থাকে, শ্রমিক-কর্মচারীদের পক্ষে পদাধিকারী হওয়া অসম্ভব হবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, বেকারী, ছাঁটাই এবং জীবনধারণের উপযোগী মজুরির সমস্যায় ঠিকমতো হাত দেওয়া হয়নি। শ্রমিক-কর্মচারীদের দুর্দশা লাঘবের যে কর্মসূচী কমিশন রচনা করেছেন অনেকাংশে সেটি আকর্ষক কিন্তু সে কর্মসূচীকে কার্যকর কে করবে? বর্তমান গভর্নমেন্ট সুনিশ্চিতভাবে শ্রমিক-বিরোধী। তাঁদের কাছ থেকে কি কিছু আশা করা যায়? অতএব, শেষ পর্যন্ত দেখতে গেলে শ্রমিক সমস্যা হল রাজনৈতিক সমস্যা। যত দিন ভারত স্বাধীন না হচ্ছে এবং একটি সমাজতান্ত্রিক, কিংবা অন্তত গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করছে, শ্রমিকদের দুর্দশা মোচনের কর্মসূচী কার্যকর করা সম্ভব হবে না। রিপোর্টে একটি জিনিস বলতে গেলে পরিষ্কার, সব কিছুই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে গভর্নমেন্টের হাতে। সরকারি শাসনযন্ত্র শ্রমিকেরা কী করে হস্তগত করবেন, কী করে তাকে প্রভাবিত কববেন, সে কথা কিছুই নেই রিপোর্টে। কিন্তু তা যতক্ষণ না হচ্ছে, শত রিপোর্টেও শ্রমিকের প্রকৃত কোনও উপকার হবে না। নতুন সংবিধানে কমিশনের উচিত ছিল প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার সুপারিশ করা। তার ওপরে, কিংবা সেই সঙ্গে, কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যপদের একটি নির্দিষ্ট শতকরা ভাগ শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের জন্য সংরক্ষিত রাখার সুপারিশ কমিশন করতে পারতেন।
শ্রমিক ইউনিয়নের যে আন্দোলন—তার শক্তি এবং আকার অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে, অতীতে সাময়িকভাবে যতই সে অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে থাক। নানা দিক থেকে নানা রকম পরস্পর-বিরোধী চিন্তার ধারা শ্রমিক-ইউনিয়নের শ্রমজীবীদের বিভ্রান্ত করে, তাঁরা বুঝতে পারেন না কোন পথে যাবেন, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করবেন। এক দিকে আছেন দক্ষিণপন্থীরা, তাঁরা সংস্কারবাদী কর্মসূচীর পক্ষে। অন্য দিকে আমাদের কমিউনিস্ট বন্ধুরা আছেন। তাঁরা, যদি আমি তাঁদের কথা সঠিক বুঝে থাকি, মস্কোর অনুগত এবং অনুসারী। এই দুই গোষ্ঠীর কোনওটির সঙ্গে আমরা একমত হই বা না হই তাঁদের কথা আমরা বুঝতে পারি। এই দুইয়ের মাঝখানে আর একটি গোষ্ঠী আছে, যাঁরা পুরোদস্তুর সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা, কিন্তু চান ভারত তার নিজের ধরনের সমাজতন্ত্রের, তার নিজস্ব পদ্ধতির বিকাশ করুক। আমি সবিনয়ে দাবি করি, আমি শেষোক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত।
আমার নিজের মনে কোনও সন্দেহ নেই, যে ভারতের এবং বিশ্বেরও মুক্তি নির্ভর করে সমাজতন্ত্রের ওপর। অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ভারতকে গ্রহণ করতে হবে, তার দ্বারা লাভবান হতে হবে। কিন্তু নিজের অবস্থা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের পদ্ধতি তাকে গড়ে তুলতে হবে। বাস্তবক্ষেত্রে তত্ত্বের প্রয়োগ করতে গেলে ইতিহাস এবং ভূগোলকে বাদ দেওয়া চলবে না। সে চেষ্টা যে করবে, সে বিফল হবেই। অতএব ভারতকে তার নিজস্ব ধরনের সমাজতন্ত্রের বিকাশ করতে হবে। সারা দুনিয়াই যখন সমাজতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে, আমরাই বা তা করব না কেন? এমনও হতে পারে, ভারত যে ধরনের সমাজতন্ত্র বিকশিত করে তুলবে—তার মধ্যে এমন নতুন কিছু অভিনব কিছু থাকবে, সারা বিশ্ব যারা দ্বারা লাভবান হবে।