আমাদের জাতির জনক
(মহাত্মা গান্ধীর উদ্দেশে রেঙ্গুন বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণ, ৬ জুলাই ১৯৪৪)
মহাত্মাজি,
আপনার স্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি হয়েছে এবং আপনি আবার দেশের জন্যে কিছু পরিমাণে কাজ করতে পারছেন বলে আমি আপনার উদ্দেশে কয়েকটি কথা নিবেদন করছি যাতে আপনি ভারতের বাইরে বসবাসকারী দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের পরিকল্পনা ও কাজের পরিচয় জানতে পারেন।
সে কথা বলার আগে আমি আপনাকে জানাতে চাই যে, ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে আপনাকে অকস্মাৎ জেল থেকে মুক্তি দেওয়ায় সারা পৃথিবী জুড়ে ভারতীয়রা গভীর উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন। ব্রিটিশ কারাগারে শ্রীমতী কস্তুরবাঈজীর শোচনীয় মৃত্যুর পর আপনার শারীরিক অবস্থার জন্যে আপনার দেশবাসীদের স্বভাবতই উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ ছিল। যা হোক, ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি হৃতস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে আপনি যেন আবার আটত্রিশ কোটি স্বদেশবাসীকে নেতৃত্ব এবং পরামর্শ দিতে পারেন।
ভারতের বাইরে বসবাসকারী আপনার দেশবাসীদের আপনার সম্বন্ধে কী মনোভাব সে বিষয়ে কিছু বলতে চাই। এ বিষয়ে যা বলব তা নির্জলা সত্য এবং সত্য ছাড়া আর কিছু নয়।
ভারতের বাইরে এবং স্বদেশেও এমন অনেক ভারতীয় আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, একমাত্র ইতিহাস-স্বীকৃত পদ্ধতিতেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব। এসব নরনারী একান্তভাবেই মনে করেন যে, কোনও আলোচনা, নৈতিক প্রভাব কিংবা অহিংস প্রতিরোধের কাছে ব্রিটিশ সরকার কখনও আত্মসমর্পণ করবে না। এ সত্ত্বেও ভারতের বাইরের ভারতীয়দের কাছে পদ্ধতিগত পার্থক্য হল পারিবারিক পার্থক্যের মতো।
১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোর কংগ্রেসে আপনি স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করার পর থেকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সমস্ত সদস্যদের সামনে একটিমাত্র লক্ষ্য রয়েছে। ভারতের বাইরের ভারতীয়রা মনে করেন যে আপনি দেশের বর্তমান জাগরণের স্রষ্টা। পৃথিবীতে সকল প্রচারের সময় তাঁরা আপনাকে সেই পদ এবং সেই পদের যোগ্য মর্যাদা দিয়ে থাকেন। পৃথিবীর জনসাধারণের কাছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আমরা সকলেই এক—আমাদের সকলের জীবনে এক লক্ষ্য, এক আকাঙ্ক্ষা, এক প্রচেষ্টা। ১৯৪১ সালে ভারত ছেড়ে আসার পর থেকে ব্রিটিশ প্রভাবমুক্ত যেসব দেশ পরিদর্শন করেছি সর্বত্রই দেখেছি আপনাকে যে রকম সর্বোচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয় সে রকম মর্যাদা গত শতাব্দীতে আর কোনও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাকে দেওয়া হয়নি।
প্রত্যেক জাতির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আছে এবং রাজনৈতিক সমস্যাগুলি সম্বন্ধে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে। কিন্তু সে সব যে-মানুষ এত ভালভাবে নিজের দেশবাসীর সেবা করেছেন এবং যিনি সারা জীবন প্রথম শ্রেণীর এক আধুনিক শক্তির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছেন, তাঁকে স্বীকৃতি জানাতে কোনও জাতির পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। বস্তুত যেসব দেশ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পূজারী বলে ভান করে থাকে তাদের চেয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-বিরোধী দেশগুলি আপনার যোগ্যতা ও কৃতিত্ব হাজারগুণ বেশি সমাদর করে থাকে। ভারতের বাইরে বসবাসকারী স্বদেশপ্রেমিক ভারতীয়রা এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রতি সহানুভূতিশীল বিদেশী মিত্ররা আপনার প্রতি যে উচ্চ শ্রদ্ধা পোষণ করেন তা আপনি সাহসের সঙ্গে ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব উত্থাপনের পর থেকে শতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ভারতে থাকার সময় ব্রিটিশ সরকার সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা থেকে, ভারতের বাইরে থাকার সময় ব্রিটেনের কর্মনীতি সম্বন্ধে যে গোপন সংবাদ সংগ্রহ করেছি তা থেকে এবং সারা পৃথিবীতে ব্রিটেনের উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় সম্বন্ধে যা দেখেছি তাতে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছে যে, ব্রিটিশ সরকার কখনই ভারতের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেবে না। এখন ব্রিটেনের একমাত্র কাজ হল যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্যে পূর্ণমাত্রায় ভারতকে শোষণ করা। এই যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটেন তার সাম্রাজ্যের এক অংশ তার শত্রুদের কাছে এবং অপর এক অংশ তার মিত্রদের কাছে হারিয়েছে। এমনকি মিত্রপক্ষ যুদ্ধে জয়লাভ করলেও ভবিষ্যতে ব্রিটেন নয়, আমেরিকাই হবে প্রধান শক্তি। অথাৎ ব্রিটেন আমেরিকার আশ্রিত শক্তিতে পরিণত হবে।
এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটেন পূর্বের চেয়ে আরও নির্মমভাবে ভারতকে শোষণ করে নিজের ক্ষতিপূরণ করবার চেষ্টা করবে। সেই উদ্দেশ্যে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে চিরদিনের মতো চূর্ণ করার জন্যে ইতিমধ্যে লন্ডনে একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে। গোপন অথচ নির্ভরযোগ্য সূত্রে এইসব পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছি বলে তা আপনার গোচরে আনা আমার কর্তব্য বলে মনে করি।
ব্রিটিশ সরকার এবং ব্রিটিশ জনগণকে স্বতন্ত্র হিসাবে দেখলে আমাদের পক্ষে মারাত্মক ভুল হবে। সন্দেহ নেই যে, আমেরিকার মতো ব্রিটেনেও আদর্শবাদীদের একটি ছোট গোষ্ঠী আছে যারা ভারতকে স্বাধীন দেখতে চায়।
এই আদর্শবাদীদের নিজের দেশের লোক পাগল বলে মনে করে এবং সংখ্যায় তাঁরা অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে দেখার মতো। ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ জনগণ এক এবং অভিন্ন বস্তু।
এই যুদ্ধে আমেরিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে পারি, ওয়াশিংটনের শাসকচক্র এখন পৃথিবীতে প্রভুত্ব করার স্বপ্ন দেখছে। শাসকচক্র এবং তার বুদ্ধিজীবী প্রবক্তারা প্রকাশ্যভাবে ‘আমেরিকান শতাব্দী’র কথা বলেন। অর্থাৎ বর্তমান শতাব্দীতে আমেরিকা পৃথিবীতে প্রভুত্ব করবে। এই শাসকচক্রের মধ্যে যাঁরা চরমপন্থী তাঁরা এমনকি ব্রিটেনকে আমেরিকার ৪৯তম রাজ্য বলে থাকেন।
যে পদ্ধতিতে ভারতের স্বাধীনতা লাভ হবে বলে আপনি সারা জীবন বলে আসছেন, সেই পদ্ধতিতে এবং বিনা রক্তপাতে যদি ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করা যেত, তাহলে স্বদেশে কিংবা বিদেশে এমন কোনও ভারতীয় নেই যিনি খুশি না হতেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যাতে আমার দৃঢ়বিশ্বাস জন্মেছে যে, যদি আমরা স্বাধীনতা পেতে চাই তাহলে আমাদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
পরিস্থিতির আনুকূল্যে যদি আমরা আমাদের নিজেদের উদ্যোগ এবং সামর্থ্যে ভারতের মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম আয়োজন করতে পারতাম তবে সেটাই হত আমাদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল পন্থা। কিন্তু মহাত্মাজি, আপনি হয়তো ভারতের অবস্থা অন্য সকলের চেয়ে বেশি ভাল জানেন। এ ব্যাপারে আমি যতটুকু জড়িত তাতে আমি ভারতে বিশ বছরের জনসেবার অভিজ্ঞতার পর এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, বিদেশে বসবাসকারী আমাদের দেশবাসীর সহায়তা এবং এক বা একাধিক বৈদেশিক শক্তির সহায়তা ছাড়া দেশে কোনও সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
বর্তমান যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত কোনও বিদেশী শক্তি, বা এমনকি বিদেশে বসবাসকারী কোনও ভারতীয়ের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ফলে ব্রিটেনের শত্রুদের কাছ থেকে সাহায্য—রাজনৈতিক এবং সামরিক দু’ রকমই—পাওয়ার সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য আশা করার আগে ভারতের স্বাধীনতার দাবি সম্বন্ধে তাদের মনোভাব কী রকম তা আমাকে জানতে হয়েছিল। ব্রিটিশ প্রচারকেরা বহু বছর ধরে পৃথিবীর মানুষকে বলে আসছেন যে অক্ষশক্তি স্বাধীনতার শত্রু, সুতরাং ভারতের স্বাধীনতারও শত্রু। এটা কি সত্য?—আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছি। ফলে, সত্য নিজে খুঁজে বার করার জন্যে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অক্ষশক্তি সাহায্য দিতে সহায়তা করতে প্রস্তুত কি না তা জানার জন্যে আমাকে ভারত ছেড়ে আসতে হয়েছে।
নিজ গৃহ এবং নিজ দেশ ত্যাগ করার বিষয়ে চূড়ান্তভাবে মনস্থির করার পূর্বে বিদেশ থেকে সাহায্য নেওয়া উচিত হবে কি না সে বিষয়ে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। কী পদ্ধতি গ্রহণ করে অন্যান্য জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে তা জানার জন্যে আমি পূর্বে সারা পৃথিবীর বিপ্লবের ইতিহাস পড়েছিলাম। কোনরকম বিদেশী সাহায্য ছাড়া একটি পদানত জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে এরকম একটি উদাহরণ আমি পাইনি। ১৯৪০ সালে আমি আবার ইতিহাস পড়ি এবং পুনরায় এই সিদ্ধান্তে আসি যে, কোনরকম বিদেশী সাহায্য ছাড়া স্বাধীনতা অর্জনের একটি উদাহরণ ইতিহাসে নেই। এরকম সাহায্য নেওয়া উচিত কি না এই নৈতিক প্রশ্ন প্রসঙ্গে আমি প্রকাশ্যে এবং ঘরোয়া পরিবেশে বলেছি যে, ঋণ হিসেবে এরকম সাহায্য সব সময়েই নেওয়া যায় এবং পরে সেই ঋণ শোধ করা যায়। অধিকন্তু, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো শক্তিশালী একটি সাম্রাজ্য যদি ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ায় তাহলে আমাদের মতো দাসত্বে আবদ্ধ এবং নিরস্ত্র জাতির পক্ষে ঋণ হিসেবে বিদেশ থেকে সাহায্য নিতে আপত্তি কোথায়?
মহাত্মাজি, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে, এই বিপজ্জনক উদ্দেশ্যে বাহির হওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে আমি দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ও মাসের পর মাস ধরে এই বিষয়টির ভালমন্দ সব দিক যত্ন সহকারে বিচার করেছি। এতদিন সাধ্যমত সামর্থ্যে দেশবাসীর সেবা করে আমার বিশ্বাসঘাতক হবার কিংবা কেউ আমাকে বিশ্বাসঘাতক বলুক এমন বলার সুযোগ তাকে দেবার কোনও বাসনা আমার নেই।
বাড়িতে থেকে এতদিন যে কাজ করেছি সে রকম কাজ করাই ছিল আমার পক্ষে সবচেয়ে সহজ। যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন কোনও ভারতীয় কারাগারে বন্দী হয়ে থাকাও ছিল আমার পক্ষে সহজ কাজ। এরকম করলে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনও ক্ষতি হত না। ভারতের একজন দেশসেবকের জীবনে যা সম্ভব সেই রকম সর্বোচ্চ সম্মান আমার দেশবাসীর কাছ থেকে আমি পেয়েছি। আমি নিজেও একনিষ্ঠ এবং অনুগত সহকর্মীদের, আমার ওপর যাঁদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে তাঁদের নিয়ে একটি দল গড়েছি।
দুঃসাহসিক অভিযানে বিদেশে গিয়ে আমি কেবল আমার নিজের জীবন এবং সমগ্র ভবিষ্যতকে বিপন্ন করিনি, তার চেয়েও বড় কথা আমার দলের ভবিষ্যতেরও বিপদ টেনে এনেছি। বাইরে থেকে সাহায্য ছাড়া আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারব এ বিষয়ে যদি আমার বিন্দুমাত্র আশা থাকত তাহলে সঙ্কটকালে আমি কখনই ভারত ত্যাগ করে যেতাম না। স্বাধীনতা লাভের জন্যে বর্তমান যুদ্ধের মতো আর একটি সুযোগ—এক সুবর্ণ সুযোগ—আমাদের জীবিতকালে পাওয়া যাবে, এরকম আশা যদি আমার থাকত তাহলে, সন্দেহ হয়, ঘর ছেড়ে বাইরে যেতাম কি না। কিন্তু দু’টি বিষয়ে আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল—প্রথমত, এরকম সুবর্ণ সুযোগ এক শতাব্দীর মধ্যে আর আসবে না। এবং দ্বিতীয়ত, বাইরে থেকে কোনও উদ্যোগ ছাড়া স্বদেশে কেবলমাত্র আমাদের নিজেদের চেষ্টায় আমরা স্বাধীনতা লাভ করতে পারব না। এ কারণেই আমি এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে সঙ্কল্প করেছিলাম।
আমার ওপর ভগবানের অসীম দয়া। এত রকমের অসুবিধা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত আমার সমস্ত পরিকল্পনা সফল হয়েছে। ভারত ছেড়ে আসার পর আমার প্রথম কাজ ছিল যেখানেই আমার দেশবাসীদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তাদের সংগঠিত করা। আমার বলতে আনন্দ হচ্ছে যে, সব জায়গাতেই দেখেছি তারা খুবই সচেতন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্যে যা কিছু করা সম্ভব তা করতে তারা আগ্রহী। তারপর আমি যেসব সরকার আমাদের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উদ্দেশ্য ছিল ভারতের প্রতি তাদের কী মনোভাব তা জানা। আমি দেখলাম যে, ব্রিটিশ প্রচার এতবছর ধরে আমাদের যে কথা বলে আসছে অবস্থা তার বিপরীত—অক্ষশক্তি এখন প্রকাশ্যে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে। আমি আরও আবিষ্কার করলাম যে, যে সাহায্য আমাদের দরকার তারা তাদের সাধ্যমত তা দেবার জন্যে প্রস্তুত।
আমি জানি আমাদের শত্রু আমার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমার দেশবাসী, যাঁরা আমাকে এত ভালভাবে জানেন তাঁরা কখনও বিভ্রান্ত হবেন না। যে মানুষ স্বদেশের আত্মসম্মান এবং মর্যাদাকে বড় করে দেখেছে এবং তা রক্ষা করতে বহু নির্যাতন ভোগ করেছে, আর যেই করুক সে কখনই কোনও বিদেশী শক্তির কাছে নতি স্বীকার করতে পারে না। উপরন্তু, বিদেশী শক্তির কাছ থেকে আমার লাভ করার মতো কিছু নেই। একজন ভারতবাসীর জীবনে যা সম্ভব সেই রকম সর্বোচ্চ সম্মান আমার দেশবাসীর কাছ থেকে আমি পেয়েছি। বিদেশী শক্তির কাছ থেকে আমার আর কী পাওনা থাকতে পারে? এইরকম মানুষই তো একটি পুতুল হয়ে দাঁড়াবে, যার নিজের কোনও মর্যাদা বা আত্মসম্মানবোধ নেই কিংবা যে অপরের অনুগ্রহে নিজের প্রতিষ্ঠা পেতে চায়।
আমার অতি বড় শত্রুরও একথা বলার সাহস হবে না যে, আমি জাতীয় মর্যাদা ও আত্মসম্মান বিক্রি করতে পারি। এমনকি আমার অতি বড় শত্রুও একথা জোর গলায় বলতে পারবে না যে, আমি আমার দেশের একজন তুচ্ছ মানুষ এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে বিদেশী সাহায্য চাই। ভারত ত্যাগ করে, যা কিছু আমার আছে সে সবের, এমনকি আমার নিজের জীবনের ঝুঁকি আমি নিয়েছি। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে যাতে আমি সাহায্য করতে পারি সেজন্যেই আমাকে এমন ঝুঁকি নিতে হয়েছে।
অক্ষশক্তি সম্পর্কে আর একটি প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে। তাদের দ্বারা আমি প্রতারিত হয়েছি এটা কী সম্ভব?
আমার বিশ্বাস, সারা পৃথিবীর মানুষ স্বীকার করবেন যে ব্রিটিশদের মধ্যেই সবচেয়ে চতুর এবং ধূর্ত রাজনীতিবিদ দেখতে পাওয়া যায়। যে মানুষ সারা জীবন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কাজ করেছে এবং লড়াই করেছে, তাকে পৃথিবীর অন্য রাজনীতিবিদরা প্রতারিত করতে পারেন না। যদি আমাকে প্রলুব্ধ করতে বা দমিয়ে রাখতে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হয়ে থাকেন, অন্য কোনও রাজনীতিবিদ সে কাজে সফল হতে পারবেন না। যদি ব্রিটিশ সরকার, যারা আমাকে দীর্ঘকাল কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন, নির্যাতন ও শারীরিক পীড়ন করেছেন, আমার মনোবল নষ্ট করতে সক্ষম না হয়ে থাকেন, তাহলে অন্য কোনও শক্তি তা করার আশা করতে পারে না।
এ ছাড়া আপনি নিজেই জানেন, আমি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি গভীরভাবে অধ্যয়ন করে আসছি। এই যুদ্ধ শুরু হবার পূর্বেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। সেজন্যে আমি এমন নবিস নই যাকে ধূর্ত এবং চালাক রাজনীতিবিদরা ঠকাতে পারেন। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, অক্ষশক্তির দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে একটি ধারণা করার আগে সেই শক্তিভুক্ত দেশগুলিতে যেসব প্রধান নেতা ও ব্যক্তি নিজ নিজ দেশের কাজকর্মের জন্য দায়ী তাঁদের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলাম।
ফলে, আমি জোর গলায় বলতে পারি যে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্তের ওপর দেশবাসী পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেন। বিদেশে বসবাসকারী আমার দেশবাসী সাক্ষ্য দেবেন যে, ভারত ছেড়ে আসার পরে, আমি কখনও এমন কিছু করিনি যাতে দেশের সম্মান, আত্মমর্যাদা বা স্বার্থ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়। বরং বিপরীতভাবে বলা হয়, আমি যা-কিছু করেছি সে সবই আমার দেশের উপকারের জন্যে, পৃথিবীতে ভারতের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যে এবং ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
মহাত্মাজি, পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে আমাদের শত্রুরা জাপানের বিরুদ্ধে এক প্রবল ও ভয়ঙ্কর প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্যে জাপান সম্বন্ধে কিছু কথা আমি বলব। বিশেষ করে এই জন্যে যে আমি এখন জাপানের সরকার, সৈন্যবাহিনী ও দেশবাসীর নিবিড় সহযোগিতায় কাজ করছি।
একসময় আমাদের শত্রুদের সঙ্গে জাপানের মিত্রতা ছিল। যতদিন ইঙ্গ-মার্কিন চুক্তি ছিল ততদিন আমি জাপানে আসিনি। দুই দেশের মধ্যে যতদিন কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল আমি জাপানে আসিনি। আমার মতে জাপান যখন তার ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, অর্থাৎ ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, তখন আমি নিজের ইচ্ছায় জাপানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
আমার অন্য অনেক দেশবাসীর মতো আমি বেশ কয়েক বছর ধরে জাপান-বিরোধী প্রচারের কাগজপত্রগুলি পড়েছি। আমার অন্য অনেক দেশবাসীর মতো আমি বুঝতে পারিনি ১৯৩৭ সালে জাপান কেন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। এবং আমার অন্য অনেক দেশবাসীর মতো ১৯৩৭ ও ১৯৩৮ সালে আমার সহানুভূতি ছিল চুংকিং-এর পক্ষে। আপনার মনে পড়বে কংগ্রেস সভাপতি রূপে আমি ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে চুংকিং-এ একটি মেডিকেল মিশন পাঠিয়েছিলাম। জাপান পরিদর্শনের পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর থেকে সাধারণভাবে পৃথিবী সম্পর্কে, বিশেষভাবে এশীয় দেশগুলি সম্পর্কে জাপানের দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। আমার স্বদেশে জনগণ একথা এখনও বুঝতে পারেন না।
এই পরিবর্তন কেবল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে নয়, জাপানের জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও। এক নতুন চেতনা, যাকে আমি বলতে পারি এশিয়া-মহাদেশীয় চেতনা, জাপানের মানুষের মনকে গ্রাস করেছে। ফিলিপাইন, বর্মা এবং ভারতের প্রতি জাপানের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির মূলে আছে চেতনার এই পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের মধ্যেই চীনের সম্পর্কে জাপানের নূতন নীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
জাপান পরিদর্শন এবং সে দেশের বর্তমান নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করার পরে আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত যে এশিয়ার প্রতি জাপানের বর্তমান নীতি ধাপ্পাবাজি নয়, এর মূলে রয়েছে তাদের আন্তরিকতা।
একটি সমগ্র জাতির এক নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম নয়। এর পূর্বে ফরাসী বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে এবং বলশেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়াতে আমরা এরকম দৃষ্টান্ত দেখেছি। ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে দ্বিতীয়বার জাপান পরিদর্শনের পর আমি ফিলিপাইন পরিদর্শন করি এবং সেখানে ফিলিপিনো নেতাদের সঙ্গে দেখা করি এবং সব কিছু নিজের চোখে দেখি। বেশ দীর্ঘকাল আমি বর্মায় ছিলাম এবং সে দেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর সেখানকার অবস্থা নিজের চোখে দেখি। এবং জাপানের এই নতুন নীতি সত্য না মিথ্যা তা দেখবার জন্যে আমি চীনে গিয়েছিলাম। জাপান এবং চীনের জাতীয় সরকারের (National Government of China) মধ্যে সর্বশেষ সম্পাদিত চুক্তির ফলে চীনের জনগণ যেসব দাবি এতদিন করেছিল কার্যত তা সবই তারা লাভ করেছিল। এই চুক্তির শর্তানুসারে জাপান এমনকি বর্তমান সংঘর্ষ শেষ হবার পর চীন থেকে তার সৈন্য সরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল।
কী জন্যে তাহলে চুংকিং-চীন লড়াই করছে? শুধুমাত্র পরের স্বার্থরক্ষার মনোভাব নিয়ে ব্রিটেন ও আমেরিকা চুংকিং-চীনকে সাহায্য করছে, একথা কী কেউ বিশ্বাস করবে? জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্যে এখন ব্রিটেন ও আমেরিকা যে সাহায্য চুংকিংকে দিচ্ছে তার বিনিময়ে তারা কী নিষ্ঠুরভাবে নিজেদের পাওনা আদায় করবে না? আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জাপানের প্রতি তাদের পূর্বের ঘৃণা এবং বিরোধিতার জন্যে চুংকিং-কে ব্রিটেন ও আমেরিকার কাছে বন্ধক রাখা হচ্ছে।
যতদিন না জাপান চীনের প্রতি তার বর্তমান নীতি কার্যকর করছে ততদিন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে চীনের পক্ষে ব্রিটিশ ও আমেরিকার সাহায্য নেওয়ার কিছু যুক্তি বা অজুহাত থাকতে পারত। কিন্তু এখন যখন চীন-জাপান সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে তখন চীনের পক্ষে জাপানের বিরুদ্ধে অর্থহীন লড়াই চালিয়ে যাবার সামান্যতম অজুহাত নেই। এতে চীনের অধিবাসীদের কোনও ভাল হবে না, নিশ্চয়ই এশিয়ার পক্ষেও ভাল হবে না।
১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে আপনি বলেছিলেন যে, যদি আপনার স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকত তাহলে আপনি চীন ও জাপানের মধ্যে একটা বোঝাপড়ার জন্যে কাজ করতেন। এই উক্তির মধ্যে বিরল রাজনৈতিক বিচক্ষণতার প্রকাশ হয়েছিল। ভারতের দাসত্বই হল চীনের সব বিশৃঙ্খলতার মূলে। যেহেতু ভারতের উপর ব্রিটিশরা প্রভুত্ব করছে সেজন্যে ইঙ্গ-আমেরিকানরা চুংকিং-কে এই বলে ধাপ্পা দিয়েছিল যে, জাপানের বিরুদ্ধে যাতে সে লড়াই চালাতে পারে সেজন্যে যথাযোগ্য সাহায্য চুংকিং-এ নিয়ে আসা হবে। মহাত্মাজি, আপনি ঠিকই ভেবেছেন যে জাপান ও চীনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের জন্যে স্বাধীন ভারত চেষ্টা করবে। আমি আরও একটু এগিয়ে বলতে পারি, যে বোকামি সে করেছে তা চুংকিং-কে ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে স্বাধীন ভারত আপনাথেকেই চুংকিং ও জাপানের মধ্যে একটি সম্মানজনক বোঝাপড়া করতে পারবে।
পূর্ব এশিয়ায় আসার এবং চীন পরিদর্শনের পর চীনের বিষয়টি আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছি। দেখেছি চুংকিং-এ বর্তমানে একনায়কত্ব-রাজ চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে নই যদি তার উদ্দেশ্য হয় ন্যায়ভাবে শাসন করা। কিন্তু চুংকিং-এ এখন যে একনায়কতন্ত্রের শাসন চলেছে তা স্পষ্টতই বিদেশী আমেরিকার প্রভাবের অধীন। কোনমতে যদি জাপানকে পরাজিত করা যায় তাহলে চীন এশিয়ার প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে, দুর্ভাগ্যক্রমে এই রকম একটা ধারণা চীনের শাসকগোষ্ঠীর মনে সৃষ্টি করে ইঙ্গ-মার্কিনরা তাদিকে ভুলপথে চালনা করতে পেরেছে। কিন্তু আসল কথা হল জাপান যদি কোনও উপায়ে পরাজিত হয় তাহলে চীন নিঃসন্দেহে আমেরিকার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের অধীনে চলে যাবে। চীনের পক্ষে এবং সারা এশিয়ার পক্ষে এ হবে এক বেদনাদায়ক ঘটনা।
জাপানকে কোনমতে পরাজিত করতে পারলে সে এশিয়ার প্রধান শক্তি হয়ে উঠবে, এই মিথ্যা আশায় প্রলুব্ধ হয়েই চুংকিং-এর শাসকগোষ্ঠী হোয়াইট হাউস এবং হোয়াইটহলের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এক অন্যায় চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। ভারতে চুংকিং সরকারের প্রচারকার্য এবং ভারতের জনগণের মনোভাবের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের সহানুভূতি আকর্ষণ করার বিষয়ে কিছু আমার জানা আছে। সত্যিই বলতে পারি, যে চুংকিং নিজেকে ওয়াল স্ট্রিট ও লোম্বার্ড স্ট্রিটের কাছে বন্ধক রেখেছে সে আর ভারতের মানুষের সহানুভূতি পাবার যোগ্য নয়, বিশেষ করে চীনের প্রতি জাপানের নতুন নীতি গ্রহণ করার পর।
মহাত্মাজি, অন্য সবার চেয়ে আপনি ভালভাবে জানেন ভারতের মানুষ নিছক প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কী ভীষণ সন্দিগ্ধ। জাপানের এই নীতি ঘোষণা যদি নিছক প্রতিশ্রুতিই হয় তাহলে আর যাকেই করুক, আমাকে জাপান প্রভাবিত করতে পারবে না। কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখেছি বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ফিলিপাইন, বর্মা এবং জাতীয় চীনের (National China) মতো দেশে জাপান কী রকম বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। জাপান তার কথা রেখেছে এবং তার ঘোষিত নীতির সঙ্গে তার কাজের পূর্ণ সঙ্গতি রয়েছে।
ভারতের প্রসঙ্গে বলতে পারি, নিজের কাজের দ্বারা জাপান তার আন্তরিকতা প্রমাণ করেছে। এক সময় লোকে বলত ভারতের সম্পর্কে জাপানের আগ্রহের পিছনে রয়েছে তার স্বার্থ। তাই যদি তার থাকত তাহলে সে কেন অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারকে স্বীকৃতি দেবে? কেন সে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ অস্থায়ী স্বাধীন ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে চাইবে? তাহলে কেন এখন আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জন্যে একজন ভারতীয় চীফ কমিশনার পোর্ট ব্লেয়ারে থাকবেন? সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি হল, তাদের স্বাধীনতা লাভের জন্যে পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ভারতীয়দের কেন জাপান নিঃশর্তভাবে সাহায্য দেবে?
পূর্ব এশিয়ার সর্বত্র ভারতীয়রা আছে, খুব কাছ থেকে জাপানকে দেখার সব রকম সুযোগ তাদের আছে। জাপানের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা সম্বন্ধে যদি তাদের মনে সন্দেহ থাকত তাহলে সারা পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়রা কেন জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতম সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করবে? একজন মানুষকে মিষ্ট কথায় ভুলিয়ে বা জোর করে আপনার মনোমত কাজ আপনি করাতে পারেন, কিন্তু কোন একজন মানুষ সারা পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী ত্রিশ লক্ষ ভারতীয়কে দিয়ে জোর করে কোনও কাজ করাতে পারে না।
নিজেরা কোনও উদ্যোগ না নিয়ে, নিজেরা পূর্ণমাত্রায় ত্যাগ স্বীকার না করে যদি পূর্ব এশিয়ার ভারতীয়রা জাপানের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করত তাহলে তাদের অন্যায় কাজ করার অপরাধে অভিযুক্ত করা যেত। কিন্তু একজন ভারতীয় হিসাবে আমি আনন্দ ও গর্বের সঙ্গে বলছি যে, পূর্ব এশিয়ায় আমার দেশবাসীরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যে মানুষকে সংগঠিত করতে এবং অর্থ এবং রসদ সংগ্রহ করতে সর্বাধিক চেষ্টা করছে।
স্বদেশে কুড়ি বছর ধরে দেশের কাজে অর্থ, রসদ এবং লোকবল সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। এই অভিজ্ঞতার দরুন আমি বর্তমানে পূর্ব এশিয়ায় আমাদের দেশবাসীরা যে ত্যাগ স্বীকার করছে তার গুরুত্ব এবং মর্যাদার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারি। তাদের এই চেষ্টা অতি মহৎ কাজ। তারা এই যে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছে এবং সর্বোচ্চমাত্রায় ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়েছে সেজন্যে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় রসদ যা আমরা নিজেরা তৈরি করতে পারি না সেগুলির জন্যে যদি জাপানের কাছে সাহায্য নিয়ে থাকে তাতে আমি আপত্তির কিছু দেখি না।
মহাত্মাজি, আমরা এখানে যে অস্থায়ী সরকার গঠন করেছি সে বিষয়ে আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই। জাপান, জার্মানী এবং আরও সাতটি মিত্রভাবাপন্ন শক্তি অস্থায়ী আজাদ হিন্দ (বা স্বাধীন ভারত) সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এর ফলে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ভারতীয়রা এক নতুন মর্যাদা, নতুন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। অস্থায়ী সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হল সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা ভারতকে ব্রিটিশের দাসত্ব থেকে মুক্ত করা। একবার আমাদের শত্রুকে ভারত থেকে বিতাড়িত করতে পারলে এবং দেশে শান্তি শৃঙ্খলা স্থাপিত হলে, অস্থায়ী সরকারের কাজ শেষ হয়ে যাবে। এর পর ভারতের জনগণ নিজেরাই স্থির করবে কোন ধরনের সরকার তারা চায় এবং কারা সেই সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করবে।
মহাত্মাজি, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারি যে, আমি এবং আমার সহকর্মীরা সবাই নিজেদের ভারতের জনগণের সেবক মনে করি। আমাদের সকল প্রচেষ্টা, যন্ত্রণাভোগ এবং ত্যাগ স্বীকারের একটিমাত্র পুরস্কারই আমরা আশা করি—আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা। আমাদের মধ্যে এমন অনেকে আছেন যারা একবার ভারত স্বাধীন হলেই রাজনীতির জগৎ থেকে অবসর গ্রহণ করবেন। বাকি লোকেরা স্বাধীন ভারতে যে কোন পদ, তা সে যতই সামান্য হোক না কেন, পেলেই তৃপ্ত হবেন। যে মনোভাব আজ আমাদের সবাইকে উদ্দীপিত করে রেখেছে তা হল ব্রিটিশের অধীনে সর্বোচ্চ পদের চেয়েও স্বাধীন ভারতে এমনকি একজন ঝাড়ুদারের পদও বেশি সম্মানজনক। আমরা জানি স্বদেশে লক্ষ লক্ষ যোগ্য স্ত্রী পুরুষ আছেন যাঁদের ওপর একবার স্বাধীনতা লাভের পর ভারতের ভাগ্য নিশ্চিন্তে সমর্পণ করা যায়।
ভারতের মাটি থেকে শেষ ব্রিটিশারকে বিতাড়ন করা পর্যন্ত কি পরিমাণ সাহায্য জাপানের কাছ থেকে আমাদের প্রয়োজন হবে তা নির্ভর করবে ভারতের বাইরে থেকে আমরা যে সহায়তা পাব তার পরিমাণের ওপর। জাপান নিজে থেকে জোর করে আমাদের ওপর সাহায্য চাপিয়ে দিতে চায় না। নিজেদের চেষ্টায় যদি ভারতের জনগণ নিজেদের স্বাধীন করতে পারে তাহলে জাপান খুশি হবে। ব্রিটেন ও আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর আমরাই জাপানের কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছি কারণ আমাদের শত্রুরা অন্য দেশের কাছ থেকে সাহায্য নেবার চেষ্টা করবে। যাই হোক, আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে, স্বদেশে আমার দেশবাসীর কাছ থেকে এত বেশি পরিমাণে সাহায্য পাব যে জাপানের কাছ থেকে অতি অল্প সাহায্যই আমাদের দরকার হবে।
কোনমতে যদি স্বদেশে আমার দেশবাসী নিজেদের চেষ্টায় নিজেদের স্বাধীন করতে পারে কিংবা ব্রিটিশ সরকার আপনার ‘ভারত ছাড়’ প্রস্তাব স্বীকার করে তা কার্যকর করে তাহলে আমাদের চেয়ে বেশি সুখী আর কেউ হবেন না। আমরা কিন্তু এই দুটি পন্থার কোনটিই সম্ভব নয় এটা ধরে নিয়েই অগ্রসর হচ্ছি এবং একটি সশস্ত্র সংগ্রাম অনিবার্য।
মহাত্মাজি, শেষ করার পূর্বে আমি আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করব। তা হল, এই যুদ্ধের চূড়ান্ত ফল কী হবে। আমি ভাল করেই জানি আমাদের শত্রুরা এমনভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যাতে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে তারা নিশ্চিত জয়লাভ করবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমার দেশবাসী এর দ্বারা প্রতারিত হবে না এবং তার ফলে ব্রিটেনের সঙ্গে কোনও আপসের কথা চিন্তা করবে না।
শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। জয় হিন্দ।