বাঙ্গলার সাধনা
(শ্রীযুক্তা বাসন্তী দেবীকে লিখিত)
কেলসাল লজ
শিলং
১৭/৭/২৭
পরম পূজনীয়া মা,
আপনার ১০ জুলাই-র পত্র ১৩ই তারিখে আমি পেয়েছি। আমার কথা মত আপনাকে পত্র দিই নাই—আমারই দোষ—সুতরাং আমি ক্ষমার পাত্র। মানুষ কোনও সম্বন্ধ স্বীকার করে নিলে তার সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি কর্তব্য তার ঘাড়ে এসে পড়ে—এবং সেগুলি সম্পাদন না করলে তার পক্ষে অন্যায় হয়। অতএব আমার যে ত্রুটি হয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই।
আপনি যে প্রায়ই বলে থাকেন এবং লিখেও থাকেন—“এ সংসারে আমার সাহচর্য আর কাহাকেও আনন্দ দান করিতে পারিবে না” —এ কথা মোটেই সত্য নয়। আপনি কি জানেন না—বাঙ্গলার তরুণ যুবকেরা (আর সকলের কথা না হয় তর্কের খাতিরে বাদ দিলাম) আজও আপনাকে কি চোখে দেখে? আপনি যদি তাদের একেবারে “পর” বলে ভাবেন—তবে কি তাহাদের প্রতি অবিচার করা হয় না? তারা কি তাদের হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য আপনার চরণে ঢেলে দেয়নি? তারা কত আশা করেছিল যে দেশবন্ধু যখন ইহলোক ত্যাগ করে গেলেন তখন আপনি এগিয়ে এসে তাদের নেতৃত্বভার গ্রহণ করবেন। সে আশা যখন পূর্ণ হল না তখন তাহাদের হৃদয়ের অপরিসীম ব্যথা ও হতাশা রাখবার কি আর স্থান ছিল? দেশবন্ধু জীবদ্দশায় বলতেন যে আপনি তাঁহার জীবদ্দশায় জনহিতকর কাজে প্রকাশ্যভাবে সংশ্লিষ্ট না হলেও তাঁহার অনুপস্থিতিতে আপনি তাঁর পরিত্যক্ত স্থান পূরণ করবেন।
আপনি হয়তো বলবেন যে হিন্দু মহিলার কাজ পরিবারের মধ্যে, পর্দার আড়ালে—public platform-এ নয়। আমি মা’র কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিবার ধৃষ্টতা রাখি না ; কিন্তু আমার মনে হয় যে আজ আমাদের দেশের ও সমাজের সহজ অবস্থা নয়। আজ যে আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে—মা। ঘরে আগুন লাগে যখন—তখন যিনি পদানশীন তাঁকেও সাহস করে রাস্তায় এসে দাঁড়াতে হয়। সন্তানকে বাঁচাবার জন্য—আগুনের হাত থেকে মূল্যবান সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য—তাঁকেও পুরুষ-বিক্রমে পরিশ্রম করতে হয়। তাতে কি তাঁর মর্যাদার বা grace-এর হানি হয়?
বাঙ্গলার সাধনা প্রধানতঃ মাতৃমূর্তির ভিতর দিয়ে প্রকট হয়েছে। কি ভগবান কি স্বদেশ—আমাদের আরাধ্য যা কিছু—আমরা তাহা মাতৃমূর্তিরূপে কল্পনা করেছি। কিন্তু হায়! বাঙ্গলার পুরুষেরা আজ এত নির্বীর্য ও কাপুরুষ হয়ে পড়েছে যে বাঙ্গলা দেশের জেলায় জেলায় স্ত্রীলোকদের উপর যে অত্যাচার চলেছে তা প্রতিরোধ করতে অক্ষম। সে দিন (কয়েক মাস হ’ল) “সঞ্জীবনীতে” লিখেছিল—“আপনার মান রাখিতে জননী, আপনি কৃপাণ ধর গো।” কথাগুলি আমার প্রাণে বড় লাগল। আজ বাস্তবিক দেশের অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাই ; শুধু তাই নয়—বোধ হয় সন্তানের মান রাখতেও জননীকে অগ্রসর হতে হবে—দেশ এমই হতশ্রী ও হীনবীর্য হয়ে পড়েছে।
আমার সময়ে সময়ে মনে হয় যে আপনি যদি বাহিরের পাঁচরকম জনহিতকর কাজে মন দিতে পারতেন—তা হ’লে বোধ হয় ভিতরের জ্বালাটা কিয়ৎপরিমাণেও কমত। পারিবারিক জীবনের সুখ-দুঃখের দ্বারা কি আমাদের জীবনটা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত? আপনি ছিলেন রাজরাজেশ্বরী—আজ আপনি পার্থিব দৃষ্টিতে রিক্তহস্তা। এ কথা যে ভাবে—তারই হৃদয়ে তীব্র জ্বালা না হয়ে পারে না। কিন্তু আমাদের সান্ত্বনা এই যে, ভারতের নরনারী অনাদিকাল হ’তে রাজার ঐশ্বর্য অপেক্ষা সন্ন্যাসের গৌরবকে অধিকতর শ্লাঘ্য, শ্রেয় ও পূজ্য বলে মনে করে আসছে। সন্ন্যাসের গৌরবময় প্রভাবে আপনার দেশবাসীর হৃদয়ে আপনার স্থান যে কত উঁচুতে উঠেছে তা বোধ হয় আপনি জানেনও না। জানি না এসব কথা বলা আমার পক্ষে চাপল্য হ’ল কি না কিন্তু আমার Justification শুধু এই যে, যে তীব্র জ্বালা আপনাকে নিরন্তর দগ্ধ করছে তাহা অতি সামান্যভাবেও আমাকে সময়ে সময়ে পীড়া দেয়—এবং একথা বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে বাঙ্গলার অসংখ্য যুবককে পীড়া দেয়।
পূর্ব পত্রে আপনি লিখেছিলেন—“অভিশপ্ত জীবনের সব কাজই শেষ হইয়া গিয়াছে, এখন শুধু শেষ প্রতীক্ষায় নীরবে বসিয়া থাকা ছাড়া আর কিছু খুঁজিয়া পাই না। জানি না কত যুগ-যুগান্তরে আমার অভীষ্ট মিলিবে।”
আমার আশঙ্কা হয় যে অত্যধিক brooding-এর ফলে আপনি সময়ে সময়ে ভুলে যান যে দেশের বুকে—এবং আমাদের বুকে আপনার আসন কোথায়। তা যদি বিস্মৃত না হতেন তবে নিজের জীবনকে ভীষণ পারিবারিক দুঘর্টনা সত্ত্বেও “অভিশপ্ত’ বলতে পারতেন না। ভগবানের নিকট যিনি প্রিয় তাঁর উপরেই বারে বারে দুঃখ ও বিপদ বর্ষিত হয়—এ কথা কি একেবারে মিথ্যা? আর, মানুষের হৃদয় যত বড় হয় তার দুঃখও তত বেশী জোটে—একথাও কি একেবারে মিথ্যা? আমাদের আশা ও আকাঙক্ষা আপনি পূরণ করুন—আপনার আসন চিরকাল দেশের বুকে অটুট থাকবে। যে ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালবাসা আপনার চরণে দেশের লোক ঢেলে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং দিবে—তার দশমাংশও কি কোনও তথাকথিত ভাগ্যবান লোক পেতে পারেন? কত আশা-আকাঙক্ষা বুকে করে নিয়ে দেশবন্ধু আমাদের ফেলে চলে গেলেন। তাঁর সেই সব স্বপ্নই সর্বশ্রেষ্ঠ Legacy। যে Legacy আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনিও পেয়েছেন। সুতরাং আপনি কি বাস্তবিকই অন্তরের সহিত বলিতে পারেন—আপনার কাজ শেষ হয়েছে এবং যাবার সময় হয়েছে? বললে ধৃষ্টতা হয় কিন্তু তবুও বলিতে ইচ্ছা হচ্ছে যে আপনার যিনি ইষ্ট তিনি কখনও এ বিষয়ে আপনার কথা সমর্থন করবেন না—বরং আমার কথাই সমর্থন করবেন।
আপনি লিখেছেন—“জড় প্রকৃতির সাথে এখানেই আমার অন্তর-প্রকৃতির যথার্থ মিলন। এই ঘন ঘোর অন্ধকার আমার বেশ লাগে।” আপনার হয়তো সব সময়েই অন্ধকার আজকাল ভাল লাগতে পারে—কিন্তু সকলেরই অন্ততঃ মধ্যে মধ্যে অন্ধকার ভাল লাগে। অন্ধকারকে ভালবাসলে তার বুকে যে আলো লুকান আছে—তাকে কি ভালবাসতে নাই? সে বেচারীর অপরাধ কি? সে তো সকলকে সুখী করতে চায়, আলো ও আনন্দ দিতে চায়।
আপনি হয়তো কোনও বন্ধনের মধ্যে আসতে চান না—সে বন্ধন কাজেরই হউক বা মানুষেরই হউক। কিন্তু আমাদের তো কোন উপায় নাই। যে দিন “মা” বলেছি সে দিনই সম্বন্ধ স্বীকার করে নিয়েছি। এ সম্বন্ধ তো অন্ততঃ ইহজীবনে ছিন্ন হবার নয়। সংসারের প্রাচীর আছে—বাধা আছে—লোকাচার আছে—কিন্তু এ সব সত্ত্বেও অন্তরের সম্বন্ধ তো মিথ্যা হতে পারে না।
মানুষ জীবনে এমন একটি স্থান চায় যেখানে তর্ক থাকবে না—বিচার থাকবে না—বুদ্ধি-বিবেচনা থাকবে না—থাকবে শুধু Blind Worship। তাই বুঝি “মা”-র সৃষ্টি। ভগবান করুন যেন আমি চিরকাল এই ভাব নিয়ে মাতৃপূজা করে যেতে পারি।
…ইতি—
আপনাদের সেবক
সুভাষ
Kelsall Lodge
Shillong
৩০/৭/২৭
পরমপূজনীয় মা,
শ্রীচরণেষু,
পূর্বপত্রে আমি ধৃষ্টতাবশতঃ আপনার কর্তব্য সম্বন্ধে আপনাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম। আপনি আমার সে চাপল্য স্নেহগুণে ক্ষমা করিয়াছেন। ধৃষ্টতা আমার অনেক আছে—তাহা না হইলে অসাধ্য সাধনের আকাঙক্ষা আমরা কোথা হইতে পাইব? আমরা যে লক্ষ্মীছাড়ার দল!
আমরা যে মা-র মুখপানে এখনও তাকাইয়া আছি, এটা আমদের আত্মবিশ্বাসের অভাবের দরুন নয়। আত্মবিশ্বাস আমাদের যথেষ্ট আছে—বোধ হয় একটু বেশীই আছে। তবুও আমরা মা-কে চাই কেন? তার কারণ এই যে মা-কে বাদ দিয়া কোনও পূজাই হয় না। আমাদের সমাজের ইতিহাসে যখনই বিপদ আপদ জুটিয়াছে তখনই মা-র আবাহন আমরা করিয়াছি। আমাদের অন্তরে সর্বশ্রেষ্ঠ যাহা কিছু পাইয়াছি তাহা লইয়াই মাতৃমূর্তি রচনা করিয়াছি। ‘বন্দেমাতরম্’ গান লইয়া আমাদের জাতীয় অভিযান সুরু হইয়াছে। তাই আজ এমনভাবে মা-কে ডাকিতেছি—কিন্তু পাষাণীর হৃদয় কি গলিবে না?
সন্তান বলিয়া যখন নিজের কাছে নিজের পরিচয় দিতেছি তখন যেন আমার দ্বারা মা-এর নাম কলঙ্কিত না হয় সেই আশীর্বাদই করুন। মা-এর উপযুক্ত সন্তান হইব—এত বড় স্পর্ধা আমার নাই।
যে কন্টকময় পথে চলিয়াছি শেষ পর্যন্ত যেন এমনই ভাবে চলিয়া যাইতে পারি—সেই আশীর্বাদ করুন। সন্ন্যাসের শূন্যতার মধ্যে যেন জীবন শুকাইয়া না যায় ; এই শূন্যতার মধ্যে যে অমৃত লুক্কায়িত আছে তার সংস্পর্শে যেন জীবনটা মঙ্গলের দিকে ফুটিয়া উঠে—সেই আশীর্বাদ চাই। আপনার আশীবাদের মূল্য আমার কাছে কত—তাহা কি বলিতে হইবে?
একদিকে আমার ধৃষ্টতার যেমন অবধি নাই, অপর দিকে নিজের অযোগ্যতার চিন্তা আমাকে নিরন্তর দগ্ধ করে। এই conflict-টা কাল্পনিক নয়—বাস্তব সত্য। ভগবানের নিকট সর্বদা প্রার্থনা করি “তোমার পতাকা যারে দাও, তারে বহিবারে দাও শকতি।” তবুও সময়ে ২ আশঙ্কা হয়, ভয় হয়—বুঝি, দেশ যা চায় তাহা দিতে পারিব না। বুঝি, বামন হইয়া চন্দ্রমা স্পর্শের চেষ্টায় মাঝ গঙ্গায় ভরাডুবি হইয়া মরিব। মা, তুমি কি আমায় অভয় বাণী শুনাবে?
আর একটা কথা বলিব—অনেক দিন বলিব বলিব করিয়া বলিতে পারি নাই। সন্তানের একটা কর্তব্য আছে—একটা অধিকার আছে। সেবার অধিকারে কি চিরকাল বঞ্চিত হইব? চিরকাল কি ‘পর’ হইয়া থাকিব? এই অসীম বিশ্বের মধ্যে মানুষের গড়া ক্ষুদ্র সংসারটাই কি সব চেয়ে বড় সত্য?
আপনার দিবার অনেক কিছু আছে—দেশ এখনও তার জন্য প্রতীক্ষা করিতেছে। এটা আমার মনগড়া কথা নয়—দেশের প্রাণের কথা। তবে আপনার দেয় আপনি দিবেন কি না—তার মীমাংসা আপনার হাতে। দেশ যা আশা করিতেছে তাহা যদি না পায় তবে দেশেরই দুর্ভাগ্য—এছাড়া আর কি বলিব।
আপনি লিখেছেন—“নবীনের প্রবীণের চিন্তাসূত্র কর্মধারা এক নয়।” একথা সত্য কিন্তু তথাকথিত নবীনদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ পাওয়া যায়—এবং তথাকথিত বৃদ্ধদের মধ্যে অনেক তরুণ পাওয়া যায়। তরুণেরা যদি আপনাকে তাদেরই একজন মনে করে—যদি তাদের নেত্রীত্বের ভার আপনাকে দেয়, তবে তাতে আপনার আপত্তির কারণ কি আছে?
আমি কলিকাতায় আপনাকে যে প্রশ্ন করিয়াছিলাম—তার মীমাংসা হইয়া গিয়াছে? তার মীমাংসা এই—যে আপনি যদি আমাদের নেত্রীত্বের ভার গ্রহণ না করেন তবে বাঙ্গলাদেশে এমন কেহ এখন নাই যাঁকে আমরা অন্তরের সহিত নেতা বা নেত্রী বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি। কোনও সভার সভাপতির কাজ চালাইবার জন্য কাহাকেও বরণ করিলে তাঁহাকে নেতা বলিয়া স্বীকার করা হয় না। তেমন নেতা বাঙ্গলাদেশে অনেকে আছেন—কিন্তু প্রকৃত নেতা—যাঁর কাছে হৃদয় সহজেই ভক্তিতে আনত হইয়া পড়ে—আজ বাঙ্গলাদেশে বিরল। যদি আপনাকে আমরা না পাই তবে এই লক্ষ্মীছাড়ার দলকেই আত্মপ্রতিষ্ঠার রাস্তায় চলতে হবে। আপনার আশীর্বাদ আমাদের নিকট অমূল্য সম্পদ সন্দেহ নাই কিন্তু আমরা তদপেক্ষা বেশী কিছু চাই।
আমরা এখানে একপ্রকার ভাল আছি। আমার বোনের শরীর পূর্বাপেক্ষা ভাল। মা একরকম ভালই আছেন। আমার শরীর ক্রমশঃ সুস্থ হইতেছে—তবে weight তেমন বাড়িতেছে না। অবশ্য আমি ওজন বাড়াটা চাই না—কিন্তু ডাক্তারদের তার উপর খুব ঝোঁক। প্রত্যহ বৈকালের দিকে বেড়াতে যাই—এবং হাঁটাও হয়।
শ্রীযুক্তা অপর্ণা দেবীর শরীর খুব খারাপ দেখেছিলাম। তিনি এখন কেমন আছেন? মিনু-রা ভাল আছে তো? অন্যান্য সকলের কুশল সংবাদ দিবেন। জাস্টিস্ দাশ কেমন আছেন?
আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিবেন। ইতি—
আপনাদের সেবক
সুভাষ
পুনঃ—সেদিন মার কাছে শুনিলাম আপনি স্বপ্নে একটা ঔষধ পেয়েছিলেন—আমার অসুখের জন্য—অথচ আপনি আমাকে সে ঔষধ দেন নাই বা সে সম্বন্ধে কিছু বলেন নাই। শুনে আমার খুব রাগ হয়েছে। চিরকাল কি পর করে রাখবেন? আপনি জানেন যে যে কোনও ঔষধ আপনি দিলে আমি সাগ্রহে এবং ভক্তির সহিত তাহা গ্রহণ করতাম।