বর্মায় বন্দীজীবন*
দিলীপকুমার রায়কে লিখিত
মান্দালয় জেল
মে, ১৯২৫
প্রিয় দিলীপ,
তোমার ২৪/৩/২৫ তারিখের চিঠি পেয়ে আনন্দিত হয়েছি। তুমি আশঙ্কা করেছিলে যে, মাঝে মাঝে যেমন ঘটে এবারও বুঝি তেমনি চিঠিখানাকে “double distillation”-এর ভিতর দিয়ে আসতে হবে কিন্তু এবার তা হয়নি সেজন্য খুবই খুশী হয়েছি।
তোমার চিঠি হৃদয়তন্ত্রীকে এমনই কোমলভাবে স্পর্শ করে চিন্তা ও অনুভূতিকে অনুপ্রাণিত করেছে যে, আমার পক্ষে এর উত্তর দেওয়া সুকঠিন, এ চিঠিখানিকে যে আবার “censor”-এর হাত অতিক্রম ক’রে যেতে হবে সেও আর এক অসুবিধা; কেন না, এটা কেউ চায় না যে তার অন্তরের গভীরতম প্রবাহগুলি দিনের উন্মুক্ত আলোতে প্রকাশ হয়ে পড়ুক। তাই এই পাথরের প্রাচীর ও লৌহদ্বারের অন্তরালে বসে আজ যা ভাবছি ও যা অনুভব করছি, তার অনেকখানিই কোন এক ভবিষ্যৎ কাল পর্যন্ত অকথিতই রাখতে হবে।
আমাদের মধ্যে এতগুলি লোক যে অকারণে বা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে জেলে আছি সেই চিন্তা তোমার প্রবৃত্তি ও মার্জিত রুচিতে আঘাত করবে এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনাগুলি যখন মেনে চলতেই হচ্ছে তখন সমস্ত ব্যাপারটাকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়েও দেখা যেতে পারে। একথা আমি বলতে পারি না যে, জেলে থাকাটাই আমি পছন্দ করি—কেননা, সেটি নিছক ভণ্ডামি হয়ে পড়ে। আমি বরং আরও বলি যে, কোন ভদ্র বা সুশিক্ষিত ব্যক্তি কারাবাস পছন্দ করতেই পারে না। জেলখানার সমস্ত আবহাওয়াটা মানুষকে যেন বিকৃত ও অমানুষ করে তোলারই উপযোগী এবং আমার বিশ্বাস এ-কথাটা সকল জেলের পক্ষেই খাটে। আমার মনে হয়, অপরাধীদের অধিকাংশেরই কারাবাস কালে নৈতিক উন্নতি হয় না, বরং তারা যেন আরো হীন হয়ে পড়ে। এ-কথা আমাকে বলতেই হবে যে এতদিন জেলে বাস করার পর কারা-শাসনের একটা আমূল সংস্কারের একান্ত প্রয়োজনের দিকে আমার চোখ খুলে গেছে এবং ভবিষ্যতে কারাসংস্কার আমার একটা কর্তব্য হবে। ভারতীয় কারা-শাসন প্রণালী একটা খারাপ (অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রণালীর) আদর্শের অনুসরণ মাত্র ঠিক যেমন কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটা খারাপ, অর্থাৎ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শের অনুকরণ। কারা-সংস্কার বিষয়ে আমাদের বরং আমেরিকার ইউনাইটেড স্টেটস্-এর মত উন্নত দেশগুলির ব্যবস্থাই অনুসরণ করা উচিত।
এই ব্যবস্থার যেটি সব চেয়ে প্রয়োজন সে হচ্ছে একটা নূতন প্রাণ বা যদি বল, একটা নূতন মনোভাব এবং অপরাধীদের প্রতি একটা সহানুভূতি। অপরাধীদের প্রবৃত্তিগুলিকে মানসিক ব্যাধি বলেই ধরতে হবে এবং সেই ভাবেই তাদের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রতিষেধমূলক দণ্ডবিধি—যেটা কারা-শাসন-বিধির ভিতরের কথা বলে ধরা যেতে পারে—তাকে এখন সংস্কারমূলক নূতন দণ্ডবিধির জন্যে পথ ছেড়ে দিতে হবে। আমার মনে হয় না, আমি যদি স্বয়ং কারাবাস না করতাম তা’ হলে একজন কারাবাসী বা অপরাধীকে ঠিক সহানুভূতির চোখে দেখতে পারতাম। এবং এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ যে আমাদের দেশের আর্টিষ্ট বা সাহিত্যিকগণের যদি কিছু কিছু কারাজীবনের অভিজ্ঞতা থাকত তাহলে আমাদের শিল্প সাহিত্য অনেকাংশে সমৃদ্ধ হতো। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যে তার জেলের অভিজ্ঞতার নিকট কতখানি ঋণী সে কথা বোধ হয় ভেবে দেখা হয় না।
আমি যখন ধীরভাবে চিন্তা করি তখন আমার নিঃসংশয় ধারণা জন্মে যে, আমাদের সমস্ত দুঃখ কষ্টের অন্তরে একটা মহত্তর উদ্দেশ্য কাজ করছে। যদি আমাদের জীবনের সকল মুহূর্ত ব্যাপে এই ধারণাটা প্রসারিত হয়ে থাকত তা হলে দুঃখে কষ্টে আর কোন যন্ত্রণা থাকত না এবং তাইতেই ত আত্মা ও দেহের মধ্যে অবিরাম দ্বন্দ্ব চলেছে।
সাধারণতঃ একটা দার্শনিক ভাব বন্দীদশায় মানুষের অন্তরে শক্তি সঞ্চার করে। আমিও সেইখানেই আমার দাঁড়াবার ঠাঁই করে নিয়েছি এবং দর্শন বিষয়ে যতটুকু পড়াশুনা করা গেছে সেটুকু এবং জীবন সম্বন্ধে আমার যে ধারণা আছে তাও আমার বেশ কাজে লেগেছে। মানুষ যদি তার নিজের অন্তরে ভেবে দেখার মত যথেষ্ট বিষয় খুঁজে পায়, বন্দী হ’লেও তার কষ্ট নেই, অবশ্য যদি তার স্বাস্থ্য অটুট থাকে, কিন্তু আমাদের কষ্ট ত শুধু আধ্যাত্মিক নয়—সে যে শরীরেরও কষ্ট এবং প্রস্তুত থাকলেও, দেহ যে সময় সময় দুর্বল হয়ে পড়ে।
লোমান্য তিলক কারাবাস-কালে গীতার সমালোচনা লেখেন। এবং আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, মনের দিক দিয়ে তিনি সুখে দিন কাটিয়েছিলেন। কিন্তু এ-বিষয়েও আমার নিশ্চিত ধারণা যে, মান্দালয় জেলে ছ’ বছর বন্দী হয়ে থাকাটাই তাঁর অকাল-মৃত্যুর কারণ।
একথা আমাকে বলতেই হবে যে, জেলের মধ্যে যে নির্জনতায় মানুষকে বাধ্য হয়ে দিন কাটাতে হয় সেই নির্জনতাই তাকে জীবনের চরম সমস্যাগুলি তলিয়ে বুঝবার সুযোগ দেয়। আমার নিজের সম্বন্ধে একথা বলতে পারি যে, আমার ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত জীবনের অনেক জটিল প্রশ্নই বছরখানেক আগের চেয়ে এখন যেন অনেকটা সমাধানের দিকে পৌঁছচ্ছে। যে সমস্ত মতামত এক সময়ে নিতান্ত ক্ষীণভাবে চিন্তা বা প্রকাশ করা যেত, আজ যেন সেগুলো স্পষ্ট পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অন্য কারণে না হ’লেও শুধু এই জন্যই আমার মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে, অনেকখানি লাভবান হতে পারব।
আমার কারাবাস ব্যাপারটিকে তুমি একটা ‘Martyrdom’ ব’লে অভিহিত করেছ। অবশ্য ও-কথাটা তোমার গভীর অনুভূতির ও প্রাণের মহত্ত্বেরই পরিচায়ক। কিন্তু আমার সামান্য কিছু ‘humour’ ও ‘Proportion’-এর জ্ঞান আছে, (অন্তত আশা করি যে আছে) তাই নিজেকে ‘Martyr’ বলে মনে করবার মত স্পর্ধা আমার নেই। স্পর্ধা বা আত্মম্ভরিতা জিনিষটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে চাই, অবশ্য সে বিষয়ে কতখানি সফল হয়েছি, শুধু আমার বন্ধুরাই বলতে পারেন। তাই ‘Martyrdom’ জিনিষটা আমার কাছে বড়জোর একটা আদর্শই হ’তে পারে।
আমার বিশ্বাস বেশীদিনের মেয়াদীর পক্ষে সব চেয়ে বড় বিপদ এই যে, আপনার অজ্ঞাতসারে তাকে অকালবার্ধক্য এসে চেপে ধরে সুতরাং এ-দিকে তার বিশেষ সতর্ক থাকাই উচিত। তুমি ধারণাই করতে পারবে না, কেমন করে মানুষ দীর্ঘকাল কারাবাসের ফলে ধীরে ধীরে দেহে ও মনে অকালবৃদ্ধ হয়ে যেতে থাকে, অবশ্য অনেকগুলি কারণই এর জন্য দায়ী—যথা, খারাপ খাদ্য, ব্যায়াম বা স্ফূর্তির অভাব, সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন থাকা একটা অধীনতার শৃঙ্খলভার, বন্ধুজনের অভাব, এবং সঙ্গীতের অভাব যাহা সর্বশেষে উল্লিখিত হ’লেও একটা মস্ত অভাব। কতকগুলি অভাব আছে যা মানুষ ভিতর থেকে পূর্ণ করে তুলতে পারে, কিন্তু আবার কতকগুলি আছে যেগুলি বাইরের বিষয় দিয়ে পূর্ণ করতে হয়। এই সব বাইরের বিষয় থেকে বঞ্চিত হওয়াটা অকাল-বার্ধক্যের জন্য কম দায়ী নয়। আলিপুর জেলে ইউরোপীয় বন্দীদের জন্য সঙ্গীতের সাপ্তাহিক বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু আমাদের নেই। পিকনিক, বিশ্রম্ভালাপ, সঙ্গীত-চর্চা, সাধারণ বক্তৃতা, খোলা জায়গায় খেলাধূলা করা, মনোমত কাব্য-সাহিত্যের চর্চা—এ সমস্ত বিষয় আমাদের জীবনকে এতখানি সরস ও সমৃদ্ধ করে তোলে যে আমরা সচরাচর তা বুঝতে পারি না এবং যখন আমাদিগকে জোর ক’রে বন্দী ক’রে রাখা হয় তখনই তাদের মূল্য বুঝতে পারা যায়। যতদিন জেলের মধ্যে বেশ স্বাস্থ্যকর ও সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার বন্দোবস্ত হয়, ততদিন কয়েদীর সংস্কার হওয়া অসম্ভব এবং ততদিন জেলগুলি আজকালকার মত নৈতিক উন্নতির পথে অগ্রসর না হয়ে অবনতির কেন্দ্র থাকবে।
এ কথা আমার লিখতে ভোলা উচিত নয় যে, আপনার নিজের লোকের, বন্ধুবান্ধবের এবং সর্বসাধারণের সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা মানুষকে জেলের মধ্যেও অনেকখানি সুখ দিতে পারে। এই দিকের প্রভাবটা নিতান্ত অজ্ঞাতসারে ও সুক্ষ্মভাবে কাজ করলেও নিজের মনটাকে আমি বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই যে, এই ভাব কিছুতেই কম বাস্তব নয়। সাধারণ ও রাজনৈতিক অপরাধীদের অদৃষ্টের পার্থক্যের এটা একটা নিশ্চিত কারণ। যে রাজনৈতিক অপরাধী, সে জানে মুক্তি পেলে সমাজ তাকে বরণ করে নেবে, কিন্তু সাধারণ অপরাধীদের তেমন কোন সান্ত্বনা নেই। সে বোধ হয় তার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও কোনও সহানুভূতিই আশা করতে পারে না এবং সেই জন্যই সাধারণের কাছে মুখ দেখাতে সে লজ্জা পায়। আমাদের Yard-এ যে সমস্ত কয়েদীর কাজ করতে হয় তাদের কেউ কেউ আমাকে বলে যে, তাদের নিজের লোকেরা জানেই না যে সে জেলে বন্দী। লজ্জায় তারা বাড়িতে কোনও সংবাদও দেয়নি। এ ব্যাপারটা আমার কাছে নিতান্ত অসন্তোষজনক বলে মনে হয়। সভ্য সমাজ অপরাধীদের প্রতি আরও সহানুভূতি কেন দেখাবে না?
আমার জেলের অভিজ্ঞতা বা তার থেকে যে সমস্ত চিন্তা মনে আসে সে সম্বন্ধে পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি কিন্তু একটা চিঠির ত শেষ আছে। আমার বেশি উদ্যম ও শক্তি থাকলে একখানা বই লিখে ফেলার চেষ্টা করতাম কিন্তু সে চেষ্টার উপযুক্ত সামর্থ্যও আমার নেই।
আমার জেলের কষ্ট দৈহিক অপেক্ষা মানসিক বলে মনে করার আমি পক্ষপাতী। যেখানে অত্যাচার ও অপমানের আঘাত যথাসম্ভব কম আসে, সেখানে বন্দী জীবনটা তত যন্ত্রণাদায়ক হয় না, এই সমস্ত সূক্ষ্ম ধরনের আঘাত উপর থেকেই আসে, জেলের কর্তাদের এ বিষয় কিছু হাত থাকে না। আমার অন্ততঃ এই রকমই অভিজ্ঞতা। এই যে সব আঘাত বা উৎপীড়ন—এগুলো আঘাতকারীর প্রতি মানুষের মনকে আরও বিরূপ করে দেয় এবং সেই দিক দিয়ে দেখলে মনে হয় এগুলোর উদ্দেশ্য ব্যর্থ। কিন্তু পাছে আমরা আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব ভুলে যাই এবং নিজেদের অন্তরের মধ্যে একটা আনন্দধাম গড়ে তুলি তাই এই সব আঘাত আমাদের উপর বর্ষণ করে আমাদের স্বপ্নবিষ্ট আত্মাকে জাগিয়ে বলে দেয় যে, মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা কি কঠোর ও নিরানন্দময়। তুমি বলেছ যে, মানুষের অশ্রু দিনের পর দিন কেমন করে সমস্ত পৃথিবীর মাটিকে একেবারে তলা পর্যন্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে—এই দৃশ্য তোমাকে প্রতিদিন গম্ভীর ও বিষগ্ন করে তুলেছে। কিন্তু এই অশ্রু সবটুকুই দুঃখের অশ্রু নয়। তার মধ্যে করুণা ও প্রেমবিন্দুও আছে। সমৃদ্ধতর ও প্রশস্ততর আনন্দস্রোতে পৌঁছবার সম্ভাবনা থাকলে কি তুমি দুঃখ কষ্টের ছোটখাট অগভীর ঢেউগুলি পার হয়ে যেতে অরাজী হতে? আমি নিজে ত দুঃখবাদ বা নিরুৎসাহের কোন কারণ দেখি না বরং আমার মনে হয় দুঃখ-যন্ত্রণা উন্নততর কর্ম ও উচ্চতর সফলতার অনুপ্রেরণা এনে দেবে। তুমি কি মনে কর, বিনা দুঃখ-কষ্টে যা লাভ করা যায় তার কোন মূল্য আছে?
তুমি কিছুদিন আগে যে সব বই পাঠিয়েছিলে তার সবগুলিই পেয়েছি। সেগুলি এখন ফিরে পাঠাতে পারব না, কারণ তাদের অনেক পাঠক জুটেছে। তোমার পছন্দ যে রকম সুন্দর তাতে এ কথা বলা অনাবশ্যক যে, আরও বই সাদরে গৃহীত হবে।
ইতি—
মান্দালয় জেল
২৫/৬/২৫
প্রিয় দিলীপ,
আমার শেষ চিঠির পরে তোমার কাছ থেকে সর্বসমেত তিনখানি চিঠি পেয়েছি। চিঠিগুলির তারিখ—৬ই মে, ১৫ই মে ও ১৫ই জুন।
তোমার প্রেরিত বইয়ের শেষ পার্শেলটা পেয়েছি। টুর্গেনিভের ‘Smoke’ বইটা পাইনি। আফিসে পার্শেলটি খোলা হয়েছিল, সুতরাং সুপারিন্টেন্ডেন্টকে এ বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছি। দরকার হলে কলকাতায় C.I.D, অফিসে তিনি খোঁজ করবেন, তুমিও D.I.G., C.I.D.-কে লিখে এ-বিষয়ে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পার।
Bertrand Russell-এর “Prospects of Industrial Civilisation”-খানি বহরমপুর জেলে কয়েকজন কয়েদীর কাছে আছে। আমাদের যখন স্থানান্তরিত করা হয়, তখন অনেকেই সেই বইখানি কাছে রাখবার আগ্রহ প্রকাশ করেন, আর বাস্তবিক একজন তখনও বইটা পড়ছিল। বইখানা তোমার দরকার হবে সে কথা না জেনে সেখানে রেখে এসেছিলাম। রাসেলের বইগুলির আদর এত বেশী যে, একখানা পেলে কেউ শীঘ্র ছাড়তে চায় না। বহরমপুর জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে আজ লিখলাম তিনি যেন তোমার কাছে বইখানা পাঠিয়ে দেন। তুমি তাঁকে লিখতে পার, তাতে কাজটা তাগাদা হবে। তোমার এত দরকারের সময় বইটা আটকে রাখবার জন্য দায়ী বলে বিশেষ দুঃখিত, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছ এত অসুবিধার কথা আগে আমি ভেবে উঠতে পারিনি। “Free thought and official propaganda” ত আমার কাছে নেই—এ বইটা তুমি আমাকে পাঠাও নি?
বই বেছে দেওয়ার জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমরা সকলে আশা করি, তুমি যে কাজ আরম্ভ করেছ ভগবানের ইচ্ছায় তা ভালভাবেই চলবে। তোমার লেখাগুলি যে আমি সসম্মানে পাঠ করব সে কথা বিশেষ করে বলবার বোধ হয় প্রয়োজন নেই। বই প্রকাশ করবার সময় প্রচ্ছদপটের দিকে নজর রেখো। এইমাত্র একখানা হালের “বঙ্গবাণী”তে রবীন্দ্রনাথের উপর তোমার লেখা একটা প্রবন্ধ দেখলাম, আমি এখনও সেটা পড়িনি কিন্তু বিষয়টা চিত্তাকর্ষক বলেই বোধ হল।
তুমি জান আজকের দিনে কিসে আমার মন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। আমার বিশ্বাস আমাদের সকলেরই একই চিন্তা—সে হচ্ছে মহাত্মা দেশবন্ধুর দেহত্যাগ। কাগজে যখন এই দারুণ সংবাদ দেখি তখন এ দুটো চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি, কিন্তু হায়! সংবাদটা নিতান্তই নির্মম সত্য। আমরা সমগ্র জাতিটাই যেন নিতান্ত হতভাগ্য বলে মনে হচ্ছে।
যে সব চিন্তা আমার অন্তরকে তোলপাড় করছে সে সব চিন্তাগুলি বাইরে প্রকাশ করে মনকে লাঘব করতে চাইলেও আমায় কষ্টের সহিত সংযত হতে হবে। যে সব চিন্তা আজ মনে উদয় হচ্ছে সেগুলি এত পবিত্র, এত মূল্যবান যে অচেনা লোকদের কাছে তা প্রকাশ করা যায় না censor-দের ত অচেনা অজানা মনে না করে পারি না। আমি শুধু এই কথাটা বলতে চাই যে সমগ্র দেশের ক্ষতি যদি অপূরণীয়ই হয়ে থাকে, বাঙ্গলার যুবকদের পক্ষে এ একটা সব চেয়ে বড় সর্বনাশ—সত্যই এটা আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
আজকের দিনে এত বিচলিত ও শোকাচ্ছন্ন হয়েছি এবং সেই সঙ্গে মনোজগতে সেই স্বর্গীয় মহাত্মার এত কাছাকাছি নিজেকে অনুভব করছি যে, তাঁর গুণাবলী বিশ্লেষণ করে তাঁর সম্বন্ধে কিছু লেখা মোটেই সম্ভব নয়। আমি তাঁর অত্যন্ত কাছে থেকে নিতান্ত অসতর্ক মুহূর্তগুলিতে তাঁর যে ছবি দেখেছিলাম সময় এলে জগতের সামনে তার কথঞ্চিৎ আভাস দিতে পারব আশা করি। তাঁর সম্বন্ধে আমার মত যাঁরা অনেক কথাই জানেন, তাঁরা পারলেও আজ কিছু বলতে সাহস করছেন না, আশঙ্কা হয়, তাঁর মহত্ত্বের সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে না পেরে পাছে তাঁকে ছোট করে ফেলেন।
তুমি যখন ফলতঃ এই কথাটাই বল যে, দুঃখ কষ্ট নয়, তখন আমি তোমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। জীবনে অবশ্য এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে—এই যেমন এখন একটা আমাদের উপর এসে পড়েছে—সেগুলিকে আমি সানন্দে বরণ করে নিতে পারি না। আমি এত বড় তত্ত্বজ্ঞানী বা এত বড় ভণ্ড নই যে, বলব আমি সকল প্রকার দুঃখ-কষ্টই আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও ভেবে দেখতে হয় যে, কতকগুলি এমন হতভাগ্যও আছে—হয়ত তারা সত্য সত্যই ভাগ্যবান—যারা সকল রকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করবার জন্যই যেন নির্দিষ্ট আছে। বেশী কম যাই হোক, যদি কাউকে পাত্ৰভরে দুঃখ পান করতে হয় তাহলে নিজেকে সম্পৰ্ণরূপে বিলিয়ে দিয়ে পান করা ভাল। এমনি একটা আত্মনিবেদন বা আত্মসমর্পণের ভাব চীনের প্রাচীরের মত অদৃষ্টের সমস্ত আঘাত একেবারে ব্যর্থ ক’রে দিতে নাও পারে। কিন্তু এতে নিশ্চয়ই আমাদের স্বাভাবিক সহিষ্ণুতার শক্তি অনেকখানি বাড়িয়ে তোলে। Bertrand Russell যখন বলছেন যে, জীবনে এমন সমস্ত ট্রাজেডি আছে যার হাত থেকে মানুষ নিষ্কৃতিই পেতে চায়, তখন ত তিনি খাঁটি সংসারী লোকের অভিমতই প্রকাশ করেছেন এবং আমার বিশ্বাস যে কেবল নিষ্কলঙ্ক সাধু ব্যক্তি অথবা সাধুত্বের ভান করে যে ভণ্ড, সে-ই এ কথার প্রতিবাদ করবে।
যারা ভাবুক বা তত্ত্বজ্ঞানী নয় তাদের যন্ত্রণাটা সম্পূর্ণ নিরবচ্ছিন্ন মনে করাটা হয়ত তোমার ঠিক হচ্ছে না। তত্ত্বজ্ঞানহীনদের (abstract point of view থেকে আমি তাদের তত্ত্বজ্ঞানহীনই বলি) নিজেদেরও একটা idealism আছে। তারা যাকে পূজার সামগ্রী মনে করে শ্রদ্ধা করে ও ভালবাসে নানা প্রকার দুঃখ যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় সেই ভালবাসার উৎস হতেই তারা সাহস ও ভরসা পায়। এখানে আমার সঙ্গে যারা কারাযন্ত্রণা ভোগ করছে, তাদের মধ্যে এমন অনেক আছে যারা ভাবুক বা দার্শনিক নয়, তবুও তারা শান্তভাবে যন্ত্রণা ভোগ করে এবং বীরের মত সহ্য করে। Technical অর্থে তারা দার্শনিক না হতে পারে, কিন্তু তাদের আমি সম্পূর্ণরূপে ভাব-বিবর্জিত মনে করতে পারি না। সম্ভবতঃ জগতের সর্বত্র যারা কর্মী তাদের সম্বন্ধে সাধারণতঃ একথা খাটে।
সাধারণের মনে একটা ধারণা আছে যে, অপরাধীদের যখন ফাঁসিকাঠে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তাদের একটা স্নায়বিক দৌর্বল্য আসে এবং যারা কোন মহৎ উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য প্রাণ দেয় তারাই শুধু বীরের মত মরতে পারে। এ ধারণাটা ঠিক নয়। এ সম্বন্ধে আমি কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ অপরাধীরা সাহসের সহিত প্রাণ দেয়, এবং ফাঁসির দড়ি তাদের গলায় বসাবার আগে ভগবানের পায়েই আত্মনিবেদন করে। একেবারে ভেঙ্গে মুষড়ে পড়তে বড় একটা দেখা যায় না। একবার এক কারাধ্যক্ষ আমাকে বলেছিলেন যে একজন ফাঁসির কয়েদী তাঁর কাছে স্বীকার করেছিল যে, সে একজনকে হত্যা করেছিল। সে তার কাজের জন্যে অনুতপ্ত কি না জিজ্ঞাসা করায় সে বলেছিল যে, তার মোটেই অনুতাপ হয়নি, কারণ হত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার ন্যায্য অনুযোগ ছিল। তারপর সে বীরদর্পে ফাঁসিকাঠে উঠেছিল এবং প্রাণ দিয়েছিল, কিন্তু একটি পেশীর সঙ্কোচনও তার বুঝতে পারা যায় নি।
অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব আলোচনা করে আমার চোখ ফুটে গেছে। আমার মনে হয়, মোটের উপর তাদের প্রতি যথেষ্ট অবিচার করা হয়। সেবারে অর্থাৎ ১৯২২ সালে যখন আমি জেলে ছিলাম, তখন একটা কয়েদী আমাদের Yard-এ ভৃত্যের কাজ করত। সে সময়ে আমি মহাপ্রাণ দেশবন্ধুর সহিত এক কারাপ্রাঙ্গণে একই ঘরে বাস করতাম। দেশবন্ধুর প্রাণটা ছিল খুবই কোমল, তাই সহজেই এই কয়েদীর দিকে তিনি কেমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। সে একটা পুরানো পাপী, আটবার তার সাজা হয়। কিন্তু সেও কেমন নিজের অজ্ঞাতসারেই দেশবন্ধুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং আশ্চর্য রকমের শক্তির পরিচয় দেয়। কারামুক্তির সময় দেশবন্ধু তাকে বলেছিলেন যে, জেল থেকে মুক্তি পেলে সে যেন বরাবর তাঁর কাছে যায় আর তার পুরানো সহকারীদের ছায়া না মাড়ায়। কয়েদীটি রাজী হয়েছিল ও কথামত কাজও করেছিল। তুমি শুনলে আশ্চর্য হবে যে, যে ব্যক্তি এক সময়ে পুরানো দাগী ছিল, সে এখন উপরোক্ত ঘটনার পর থেকে তাঁর বাড়িতে বাস করছে এবং মাঝে মাঝে অভদ্র মেজাজ তার দেখা দিলেও সে যে এখন শুধু অন্য মানুষ তাহা নয়, অধিকন্তু বেশ সরল ভাবেই জীবন কাটাচ্ছে এবং আজ এই ক্ষতি যাদের সবচেয়ে বেশী বেজেছে তাদের মধ্যে সেও একজন! অনেকে বলেন যে, মানুষের জীবনের ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ ঘটনা দিয়ে তার মহত্ত্বের বিচার করা উচিত—একথা যদি সত্য হয় তবে তাঁর দেশের কাজের দিকটা বাদ দিলেও স্বর্গীয় দেশবন্ধু একজন মহাপুরুষ ছিলেন।
আমি আমার আসল বক্তব্য থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি, এবং এখন আমার থামা উচিত। তোমার চিঠির জবাব লেখা এখনও শেষ করতে পারলাম না, কিন্তু আজকের ডাক ধরতে গেলে আমাকে এইখানেই শেষ করতে হয়। আমি জানি তুমি আমার খবর পাবার জন্যে উদ্বিগ্ন থাকবে, সুতরাং আজকের ডাক ধরতেই হবে। পরের পত্রে আরও খবর লিখব।
ইতি—
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লিখিত
মান্দালয় জেল।
১২/৮/২৫
শ্রদ্ধাস্পদেষু—
‘মাসিক বসুমতী’তে আপনার “স্মৃতিকথা” তিনবার পড়লুম—বড় সুন্দর লাগল। মনুষ্য-চরিত্রে আপনার গভীর অন্তর্দৃষ্টি; দেশবন্ধুর সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় ও আত্মীয়তা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার অপূর্ব বিশ্লেষণ ক’রে রস ও সত্য উদ্ধার করবার ক্ষমতা—এই উপকরণের দ্বারাই আপনি এত সুন্দর জিনিষ সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
যাহারা তাঁর অন্তরঙ্গ ছিল তাদের মনের মধ্যে কতকগুলি গোপন ব্যথা রয়ে গেল। আপনি সে গোপন ব্যথার মধ্যে কয়েকটির উল্লেখ করে শুধু যে সত্য প্রকাশ করবার সহায়তা করেছেন তা’ নয়—আপনি আমাদের মনের বোঝাটাও হাল্কা করেছেন। বাস্তবিক “পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে মুক্তি-সংগ্রামে বিদেশীয়দের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গেই মানুষকে লড়াই করতে হয় বেশী” এই উক্তির নিষ্ঠুর সত্যতা—তাঁর অনুগ্রহ, কর্মীরা হাড়ে হাড়ে বুঝেছে, এবং এখনও বুঝছে।
আপনার সমস্ত লেখার মধ্যে এই কথাগুলি আমার সবচেয়ে ভাল লাগল—“একান্ত প্রিয়, একান্ত আপনার জনের জন্য মানুষের বুকের মধ্যে যেমন জ্বালা করিতে থাকে এ সেই। আজ আমরা যাহারা তাঁহার আশেপাশে ছিলাম, আমাদের ভয়ানক দুঃখ জানাইবার ভাষাও নাই, পরের কাছে জানাইতে ভালোও লাগে না।” বাস্তবিক, হৃদয়ের নিগূঢ় কথা পরের কাছে কি সহজে বলা যায়? তারা উপহাস করলে হয় তো সে উপহাস সহ্য করা যায়। কিন্তু তারা যদি রসবোধ না করতে পারে তা হলে অসহ্য বোধ হয়, মনে হয়, “অরসিকেষু রসনিবেদনং শিরসি মা লিখ।” আমাদের অন্তরের কথা, অন্তরঙ্গ ভিন্ন আর কে বুঝতে পারে?
আর একটি কথা আপনি লিখেছেন—যা আমার খুব ভাল লেগেছে। …“আমরা করিতাম দেশবন্ধুর কাজ।” প্রকৃতপক্ষে আমি এমন অনেককে জানি যারা তাঁর মতে বিশ্বাস করতেন না—কিন্তু বোধ হয় তাঁর বিশাল হৃদয়ের মোহনীয় আকর্ষণে তাঁর জন্য তাঁরা কাজ না করেও পারতেন না। আর তিনিও মতনির্বিশেষে সকলকে ভালবাসতে পারতেন। সমাজের প্রচলিত মাপকাঠি দিয়ে আমি তাঁকে মনুষ্য-চরিত্র বিচার করতে দেখিনি। মানুষের ভালমন্দ স্বীকার করে নিয়েই যে তাকে ভালবাসা উচিত—এই কথায় তিনি বিশ্বাস করতেন এবং এই বিশ্বাসের উপর তাঁর জীবনের ভিত্তি।
অনেকে মনে করে যে, আমরা অন্ধের মত তাঁকে অনুসরণ করতুম। কিন্তু তাঁর চেলাদের সঙ্গে ছিল তাঁর সবচেয়ে ঝগড়া। নিজের কথা বলিতে পারি যে, অসংখ্য বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া হত। কিন্তু আমি জানতুম যে যত ঝগড়া করি না কেন—আমার ভক্তি ও নিষ্ঠা অটুট যে, যত ঝড়-ঝঞা আসুক না কেন—তিনি আমাকে পাবেন তাঁর পদতলে। আমাদের সকল ঝগড়ার মিটমাট হ’তো মা’র (বাসন্তী দেবীর) মধ্যস্থতায়। কিন্তু হায় “রাগ করিবার, অভিমান করিবার জায়গাও ঘুচে গেছে।”
আপনি এক জায়গায় লিখেছেন—“লোক নাই, অর্থ নাই, হাতে একখানা কাগজ নাই, অতি ছোট যাহারা তাহারাও গালিগালাজ না করিয়া কথা কহে না, দেশবন্ধুর সে কি অবস্থা!” সেদিনকার কথা এখনও আমার মনে স্পষ্ট অঙ্কিত আছে। আমরা যখন গয়া কংগ্রেসের পর কলিকাতায় ফিরি—তখন নানাপ্রকার অসত্যে এবং অর্ধ সত্যে বাঙ্গলার সব খবর কাগজ ভরপুর। আমাদের স্বপক্ষে ত কথা বলেই নাই—এমন কি আমাদের বক্তব্যটিও তাদের কাগজে স্থান দিতে চায় নাই। তখন স্বরাজ্য ভাণ্ডার প্রায় নিঃশেষ। যখন অর্থের খুব প্রয়োজন তখন অর্থ পাওয়া যায় না। যে বাড়ীতে এক সময়ে তোক ধরত না, সেখানে কি বন্ধু, কি শত্ৰু—কাহারও চরণধূলি আর পড়ে না। কাজেই আমরা কয়েকটি প্রাণী মিলে আসর জমাতুম। পরে যখন সেই বাড়ীর পূর্ব গৌরব ঘুরে এল—বাহিরের লোক এবং পদপ্রার্থীরা যখন এসে আবার সভাস্থল দখল করল—তখন আমরা কাজের কথাও বলবার সময় পাই না। কত পরিশ্রমের ফলে, কি রকম হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম ক’রে ভাণ্ডারে অর্থসঞ্চয় হ’ল, নিজেদের খবর কাগজ প্রকাশিত হ’ল এবং জনমত অনুকূল দিকে ফেরান হ’ল তা বাহিরের লোক জানে না—বোধ হয় কোনও দিন জানবেও না। কিন্তু এই যজ্ঞের যিনি ছিলেন হোতা, ঋত্বিক, প্রধান পুরোহিত, যজ্ঞের পূর্ণ সমাপ্তির আগেই তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন! ভিতরের আগুন এবং বাহিরের কর্মভার—এই দুয়ের চাপ তাঁর পার্থিব দেহ আর সহ্য করতে পারল না।
অনেকে মনে করেন যে, তাঁর স্বদেশ সেবাব্রতের উদ্দেশ্য ছিল দেশমাতৃকার চরণে নিজের সর্বস্ব উৎসর্গ করা। কিন্তু আমি জানি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এর চেয়েও মহত্তর। তিনি তাঁর পরিবারকেও দেশমাতৃকার চরণে উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। এবং অনেকটা সফলও হয়েছিলেন। ১৯২১ খৃঃ ধরপাকড়ের সময়ে স্থির সঙ্কল্প করেছিলেন যে একে একে তাঁর পরিবারের প্রত্যেককে কারাগৃহে পাঠাবেন এবং সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আসবেন। নিজের ছেলেকে জেলে না পাঠালে পরের ছেলেকে তিনি পাঠাতে পারবেন না—এ রকম বিবেচনা তাঁর আদর্শের দিক থেকে খুব নিম্নস্তরের বলে আমার মনে হয়। আমরা জানতুম যে, তিনি শীঘ্রই ধরা পড়বেন, তাই আমরা বলেছিলাম যে তাঁর গ্রেপ্তারের পূর্বে তাঁর পুত্রের যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নাই এবং একজন পুরুষ বর্তমান থাকতে আমরা কোনও মহিলাকে যেতে দিব না। অনেকক্ষণ ধরে তর্ক-বিতর্ক চলে, কোনও সিদ্ধান্ত হয় না—আমরা কোনও মতে তাঁর কথা স্বীকার করতে পারিনি। শেষে তিনি বলেন, “এটা আমার আদেশ—পালন করতে হবে।” তারপর প্রতিবাদ জানিয়ে আমরা সে আদেশ শিরোধার্য করলুম।
তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা বিবাহিতা—তাঁর উপর তাঁর অধিকার বা দাবী নাই, সেইজন্য তাঁকে পাঠাতে পারলেন না। কনিষ্ঠা কন্যা তখন বাগ্দত্তা—তাঁকে পাঠান উচিত কিনা—সে বিষয়ে ভীষণ তর্ক হ’ল, তিনি পাঠাতে চান—কন্যারও যাবার অত্যন্ত ইচ্ছা, কিন্তু অন্যান্য সকলের মত—তাঁকে পাঠান উচিত নয়। কারণ একেই তিনি অসুস্থ, তারপর আবার বাগ্দত্তা—শীঘ্রই বিবাহ হবার কথা। এ ক্ষেত্রে দেশবন্ধু সাধারণের মত স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। শেষে সিদ্ধান্ত হল সর্ব প্রথমে ভোম্বল যাবে—তারপর বাসন্তী দেবী ও উর্মিলা দেবী যাবেন—এবং তাঁর ডাক যে মুহূর্তে আসবে তখনই যাবার জন্য তিনি প্রস্তুত থাকবেন।
বাহিরের ঘটনা সকলেই জানে। কিন্তু এই ঘটনার মূলে—লোকচক্ষুর অন্তরালে যে ভাব, যে আদর্শ, যে প্রেরণা নিহিত রয়েছে—তার সন্ধান কয়জন রাখে? তাঁর সাধনা শুধু নিজেকে নয়—তাঁর সাধনা তাঁর সমস্ত পরিবারকে নিয়ে। আমার মনে হয় যে, মহাপুরুষের মহত্ত্ব বড় বড় ঘটনার চেয়ে ছোট ছোট ঘটনার ভিতর দিয়েই বেশী ফুটে উঠে। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের ‘বসুমতী’তে আমি দেশবন্ধুর সহকর্মী ও অনুগত কর্মীদের লেখা সযত্নে পড়লুম। অধিকাংশ লেখাই ভাসা ভাসা রকমের এবং কতকগুলো বাঁধা শব্দের পুনরুক্তিতেই পরিপূর্ণ, কেবল আপনি একা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার বিশ্লেষণের দ্বারা দেশবন্ধুর চরিত্র অঙ্কিত করবার চেষ্টা করেছেন। তাই আপনার লেখা পড়ে যে কতদূর তৃপ্তি হ’ল তা বলিতে পারি না। …দেশবন্ধুর শিষ্য ও সহকর্মীদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করেছিলাম। তাঁরা বোধহয় কিছু না লিখলেই ভাল করতেন।
সময়ে সময়ে আমি মনে না করে পারি না যে, দেশবন্ধুর অকালমৃত্যু ও দেহত্যাগের জন্য তাঁর দেশবাসীরা ও তাঁর অনুচরবর্গও কতকটা দায়ী। তাঁরা যদি তাঁর কাজের বোঝা কতকটা লাঘব করতেন, তাহলে বোধ হয় তাঁকে এতটা পরিশ্রম করে আয়ু শেষ করতে হত না। কিন্তু আমাদের এমনই অভ্যাস যে, যাঁকে একবার নেতৃপদে বরণ করি, তার উপর এত ভার চাপাই ও তাঁর কাছে এত বেশী দাবী করি যে কোনও মানুষের পক্ষে এত ভার বহন বা এত আশা পূরণ করা সম্ভব নয়। রাজনীতি-সংক্রান্ত সব রকম দায়িত্বের বকল্মা নেতার হাতে তুলে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে ব’সে থাকতে চাই।
যাক—কি বলতে আরম্ভ করে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা—শুধু আমরা কেন—এখানে সকলের অনুরোধ ও ইচ্ছা আপনি ‘স্মৃতিকথা’র মত দেশবন্ধু সম্বন্ধে আরও কয়েকটি প্রবন্ধ বা কাহিনী লিখুন। আপনার ভাণ্ডার এত শীঘ্র শূন্য হতে পারে না, অতএব লেখার জন্য উপাদানের অভাব হবে বলে আমি আশঙ্কা করি না। আর আপনি যদি লেখেন, তবে সুদূর মান্দালয় জেলে বসে কয়েকজন বাঙ্গালী রাজবন্দী যে অত্যন্ত আগ্রহের সহিত সে রচনা পাঠ ও উপভোগ করবে কোন সন্দেহ নাই।
আমি বোধ হয় খুব বেশী দিন এখানে থাকব না। কিন্তু খালাস হবার তেমন আকাঙ্ক্ষা এখন আর নাই। বাহিরে গেলেই যে শ্মশানের শূন্যতা আমাকে ঘিরে বসবে—তার কল্পনা করলেই যেন হৃদয়টা সঙ্কুচিত হ’য়ে পড়ে। এখানে সুখে দুঃখে স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্যে দিনগুলি এক রকম কেটে যাচ্ছে। পিঞ্জরের গরাদের গায়ে আঘাত ক’রে যে জ্বালা বোধ হয়—সে জ্বালার মধ্যেও যে সুখ পাওয়া যায় না—তা আমি বলতে পারি না। যাঁকে ভালবাসি—যাঁকে অন্তরের সহিত ভালবাসার ফলে আমি আজ এখানে—তাঁকে বাস্তবিক ভালবাসি—এই অনুভূতিটা সেই জ্বালার মধ্যেই পাওয়া যায়। তাই বোধ হয়, বদ্ধ দুয়ারের গরাদের গায়ে আছাড় খেয়ে হৃদয়টা ক্ষতবিক্ষত হলেও—তার মধ্যে একটা সুখ, একটা শান্তি—একটা তৃপ্তি পাওয়া যায়। বাহিরের হতাশা, বাহিরের শূন্যতা এবং বাহিরের দায়িত্ব—এখন আর মন যেন চায় না।
এখানে না এলে বোধ হয় বুঝতুম না সোনার বাঙ্গলাকে কত ভালবাসি। আমার সময়ে সময়ে মনে হয়, বোধ হয় রবিবাবু কারারুদ্ধ অবস্থা কল্পনা করে লিখেছিলেন—
“সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস।
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশী।”
যখন ক্ষণেকের তরে বাঙ্গলার বিচিত্ররূপ মানস-চক্ষের সম্মুখে ভেসে উঠে—তখন মনে হয় এই অনুভূতির জন্য অন্ততঃ এত কষ্ট করে মান্দালয় আসা সার্থক হয়েছে। কে আগে জানত—বাঙ্গলার মাটি, বাঙ্গলার জল—বাঙ্গলার আকাশ, বাঙ্গলার বাতাস—এত মাধুরী আপনার মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে।
কেন এ পত্র লিখে ফেল্লুম জানি না। আপনাকে পত্র দিব এ কথা আগে কখনও মনে আসেনি। তবে আপনার লেখা পড়ে কতকগুলো কথা মনে আসাতে লিপিবদ্ধ করলুম। যখন লিখে ফেলেছি—তখন পাঠিয়ে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আপনি আমাদের সকলের প্রণাম গ্রহণ করিবেন। পত্রের উত্তর ইচ্ছা হয় দেবেন। তবে উত্তর দাবী করবার মত ভরসা রাখি না, যদি উত্তর দেন এই আশায় ঠিকানা দিলুম—
C/o D.I.G., I.B., C.I.D
13, Elysium Row
Calcutta
বিভাবতী বসুকে লিখিত
শ্রীশ্রীদুর্গা সহায়
মান্দালয় জেল
১১/৯/২৫
পূজনীয়া মেজবৌদিদি,
আপনার চিঠি পেয়ে যারপরনাই আনন্দিত হয়েছি। আমার চিঠি পড়ে আপনারা যে রস উপভোগ করেছেন তা জেনে সুখী হয়েছি—কারণ মধ্যে মধ্যে আশঙ্কা হয় যে হয়তো জেলে থাকতে থাকতে জীবনের সব রস শুকিয়ে যাবে। শাস্ত্রে বলে “রসো বৈ সঃ” —অথাৎ ভগবান নাকি রসময়। সুতরাং রস যে লোক হারিয়েছে—সে যে জীবনের সারবস্তু—আনন্দ—হারিয়েছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই—তার জীবন তখন ব্যর্থ, নিরানন্দ ও দুঃখময়। আমার চিঠি পড়ে আপনারা যদি আনন্দ পান, তাহলে বুঝতে পারব যে আমি আনন্দ দিবার ক্ষমতা এখনও হারাই নাই। পৃথিবীর বড় বড় লোকেরা—যেমন দেশবন্ধু, রবি ঠাকুর ইত্যাদি—অনেক বয়স পর্যন্ত এমন কি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত—আনন্দ ও স্ফূর্তি হারান নাই। সে আদর্শ আমাদের পক্ষে অনুকরণীয়।
যাক্—বক্তৃতা রেখে এখন গল্প করি। এখানে এমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে যা শুনলে আপনারা মনে করবেন বুঝি নাটক অথবা উপন্যাসের কথা বলছি। আমাদের মলয় হঠাৎ খালাস পেয়ে বাড়ী চলে গেছে। তার সাত বৎসর মেয়াদ হয়েছিল এবং প্রায় সাড়ে তিন বৎসর মেয়াদ সে ভোগ করেছিল। গভর্নমেন্টের নূতন নিয়ম অনুসারে যাদের বেশী মেয়াদ হয়, তাদের মেয়াদের অর্ধেকটা…ভোগ হয়ে গেলে, তারা খালাস পেতে পারে। সে নিয়মানুসারে হঠাৎ একদিন খবর এলো যে মলয় কালই খালাস পাবে। যার তিন বৎসর মেয়াদ বাকী আছে, সে যদি হঠাৎ খবর পায় কালই খালাস পাবে, তবে তার মনের অবস্থা কি রকম হবে—তা হয়তো কল্পনা করতে পারেন। বহুদিন যাদের দেখে নাই, বহুদিন যাদের খবর পায় নাই, বহুকাল যাদের দেখা পাবার আশা ছিল না—হঠাৎ তাদের সব কথা সব স্মৃতি যখন মনের মধ্যে ভেসে ওঠে তখন বোধ হয় মানুষের মন আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়ে। আমরা মনে করেছিলাম যে হঠাৎ খালাসের খবর পেয়ে আনন্দে নৃত্য করবে—কিন্তু তা যখন করলে না তখন বুঝতে পারলাম যে অত্যন্ত আনন্দের চাপে সে একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। মনের অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলছে “কাউন্ড্রে কাউন্ড্রে” অথাৎ “ভাল ভাল”।
তার খালাসের পূর্বদিনে তাকে কাছে বসিয়ে তার বাড়ীর সব খবর জিজ্ঞাসা করলাম। শুনলাম তার দুইটি স্ত্রী, এবং দুইটি মেয়ে ও তিনটি ছেলে। এক স্ত্রীর কোন সন্তান হয় না। বহুকাল, অর্থাৎ প্রায় চারি বৎসর, এদের সম্বন্ধে কোনও খবর পায় নাই। তাই খালাসের সময়ে তাদের মঙ্গল সম্বন্ধে অমঙ্গল চিন্তা করে মনটা আকুল হয়েছে। তারা সকলে বেঁচে আছে কিনা—তারা কেমন আছে এই সব চিন্তা এতদিন এক রকম চাপা ছিল। কিন্তু খালাসের সময়ে এই কথা মনে আসাতে একদিকে আনন্দ হচ্ছে এবং অপর দিকে নানা প্রকার চিন্তা মনের মধ্যে দেখা দিচ্ছে। এই কারণে ও খালাসের খবর পেয়েও বেশী আনন্দ করতে পারে নাই।
তারপর তার বাড়ীর অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করে শুনলাম যে সে গ্রাম্য জমিদার কি রাজা। পূর্বে তারা একেবারে স্বাধীন ছিল এবং স্বাধীনতার জন্য বর্মীদের রাজাদের সহিত লড়াই করেছিল। তারপর ইংরাজের অধীনে তারা গিয়ে পড়ে। মধ্যে প্রায় সাত বৎসর পূর্বে, খাজনা বন্ধ করাতে ইংরাজের সহিত লড়াই হয়। সেই লড়াইতে উভয় পক্ষের অনেক লোক মরে। শেষে হার মেনে সে পলায়ন করে। প্রায় তিন বৎসর লুকিয়ে থাকবার পর তার বৈমাত্রেয় ভাই তাকে এবং তার ভাইকে ধরিয়ে দেয়। তার ভাইয়ের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় এবং তার অর্থাৎ মলয়ের সাত বৎসর মেয়াদ হয়।
তারপর মলয় তার শরীরের অনেকগুলি ক্ষতচিহ্ন দেখাইল, সে সবগুলি যুদ্ধের সময়ে আঘাতের চিহ্ন। তারপর আমরা বর্মাদেশের ইতিহাস শুনে দেখলাম যে তার কথা সত্য বটে। তার খালাসের পরও সেই দেশের অন্যান্য কয়েদীদের জিজ্ঞাসা করে জেনেছি যে মলয়ের কথা এক বর্ণও মিথ্যা নয়।
একজন গ্রাম্য রাজাকে আমরা মেথর করে রেখেছি একথা শুনে আমরা লজ্জায় মাথা হেঁট করলাম। শেষে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কেন মেথরের কাজ করতে স্বীকার করল। অত্যন্ত দুঃখের সহিত সে বললে—“কি করব—জেলের হুকুম! এখানে কি আর মানুষ আছি—এখানে কুকুর হয়ে গেছি। আবার বাহিরে গেলে তখন মানুষ হব।”
তার করুণ কাহিনী শুনে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম—ভবিষ্যতে সে কি করবে। অনেক চিন্তা করে বললে, —“এখনও কিছু স্থির করতে পারি নাই। আমার বৈমাত্রেয় ভাই আবার শত্রুতা আচরণ করবে কিনা জানি না—কারণ আমার অবর্তমানে সে-ই জমিদারী ভোগ করছিল। ভয় হয়—হয়তো আমার কপালে এখনও অনেক দুঃখ আছে।”
যাবার সময়ে আমরা জিজ্ঞাসা করলাম—বাড়ীতে গিয়ে আমাদের কথা ভুলে যাবে কিনা। তখন গদগদ কণ্ঠে বল্লে—“বেঁচে থাকতে আপনাদের স্নেহের কথা ভুলব না—এবং আমার ছেলে ও নাতিদের কাছে আপনাদের গল্প করব।”।
এখন আপনারা বলুন তো যে এ ঘটনা সত্য বলে মনে হয়, না উপন্যাসের গল্প বলে মনে হয়? ইংরাজীতে একটা প্রবাদ আছে যে সত্য ঘটনা অনেক সময়ে গল্পের চেয়েও অলৌকিক বলে বোধ হয়। এও তাই।
বর্মা ভাষা ভালো রকম শিখতে পারি নাই—তবে সাধারণ কথাবার্তা চালাবার মত কিছু কিছু শিখেছি। বর্মীদের মধ্যেও কেহ কেহ ইংরাজী বা হিন্দুস্থানী জানে, তাদের সাহায্য নিয়ে বর্মা কথা আমরা বুঝে থাকি। মোটের উপর একটু অসুবিধা হলেও আমরা কোন রকমে কাজ চালিয়ে নি।
টেনিস কোর্টের দরুন আমরা কতকটা ব্যায়াম করতে পারি। তা না হলে বোধ হয় বাতগ্রস্ত হয়ে বাড়ী ফিরতুম। এমনি তো বাতের লক্ষণ দেখা দিয়েছে বলে বোধ হয়। পূর্বে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতে পেতাম। ব্যাডমিন্টন আমি চিরকাল মেয়েদের খেলা বলে মনে করতাম এবং সেইজন্য কখনও খেলি নাই। জেলে এসে সব উল্টে যায়—তাই আবার শৈশব ফিরে আসে এবং আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতে আরম্ভ করি। প্রথমে যে একটু লজ্জা হত না তা বলতে পারি না। তবে শাস্ত্রে বলে যে মধু না পাওয়া গেলে গুড় ব্যবহার করা উচিত। তাই অন্য খেলার অভাবে ব্যাডমিন্টন খেলা খেলে আশ মেটাতে হত। আমাদের সব সময়ে জেলখানার মধ্যে আর একটা ক্ষুদ্র জেলে বাস করতে হয়—আমাদের ওয়ার্ডের (ward) বাহিরে আর কাহারও সহিত মিশিবার উপায় নাই। অধিকাংশ জেলে আমাদের কপালে এরূপ ward (ওয়ার্ড) জুটতো—যে কোন রকমে ব্যাডমিন্টন খেলার মত জায়গা করে নেওয়া যায়। এখানে একটু জায়গা বেশী থাকাতে টেনিস খেলা সম্ভব হয়েছে। তাতেও মুস্কিল এই যে বলগুলি প্রায় দেয়াল পার হয়ে বাইরে গিয়ে পড়ে। আর যেগুলি বাইরে যায় না সেগুলি দেওয়ালের গায়ে আঘাত খেয়ে আবার কোর্টের মধ্যে এসে পড়ে। তবুও—“নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।”
পুখুরের জল বাড়বার উপায় নাই। কারণ বাড়লেই উপছে নর্মদা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর মধ্যে মধ্যে পুখুর খালি করে নূতন জল ভরতে হয়। বস্তুতঃ চৌবাচ্চা না বলে পুখুর বলবার কোনও কারণ নাই। তবে বলে মনকে বোঝান যায় যে পুখুরে স্নান করেছি।
এখানে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হচ্ছে। আশা করি এখানেই মায়ের পূজা করতে পারব। তবে খরচ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সহিত ঝগড়া চলছে, দেখা যাক কি হয়। পূজার কাপড় এখানে পাঠাতে যেন ভুল না হয়—বিজয়া দশমী যখন এখানেই কাটবে।
আমাদের হোটেলে সবই পাওয়া যায়। সেদিন ম্যানেজারবাবু আমাদের গরম গরম জিলিপী খাওয়ালেন—আর আমরাও দুহাত তুলে আশীর্বাদ করলাম তিনি যেন চিরকাল জেলেই থাকেন। তার পূর্বে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন যদিও গোল্লা রসে ভাসছিল তবুও ভিতরে রস ছিল না এবং ছুঁড়ে মারলে রগ ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আমরা সেই লৌহবৎ রসগোল্লা, নিশ্চিন্তমনে গলাধঃকরণ করে কৃতজ্ঞ চিত্তে ম্যানেজারবাবুর দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলাম।
আমরা যখন বাঙ্গালী তখন বাঙ্গালী রকমের রান্না নিশ্চয় হয়। ম্যানেজারবাবু স্থির করেছেন যে জগতে একমাত্র পেঁপেই সত্য—তাই ঝোলে, ঝালে, অম্বলে, তরকারীতে, ডালনায়—সর্বত্র পেঁপে পাওয়া যায়। আর যেহেতু আমাদের ম্যানেজারবাবু half-doctor অথাৎ আধা-ডাক্তার—তিনি তাই সিদ্ধান্ত করেছেন যে বেশী পরিমাণে পেঁপে ভক্ষণ করলে পেটের অবস্থা ভাল থাকবে। চলতি কথায় বলে—“খাওয়ার মধ্যে থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়।” এখানে থোড়ও পাই না আর বড়িও পাই না। তাই বলতে ইচ্ছা করে নিরামিষ রান্নার মধ্যে পেঁপে, বেগুন, শাক, পেঁপে। ভাগ্যিস পাঁঠা ও মুরগীটা খাওয়ার অভ্যাস ছিল তাই ম্যানেজারের গুণগান করতে পারছি—তা না হলে কি হোত বলা শক্ত।
এটা কিন্তু না বললে অকৃতজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া হবে যে এর মধ্যে ম্যানেজারবাবু, অনেক অনুরোধের ফলে ধোঁকার ডাল্না, ছানার কালিয়া ও ছানার পোলাও খাইয়েছেন। অতএব তাঁর জয় হক। দুর্মুখেরাও যেন তাঁহার নিন্দা কখনও না করে!
বাগানের খবর জিজ্ঞাসা করেছেন। এখানে বাগানের অবস্থা শোচনীয়। ফুলের বীচি লাগান হয়েছিল, পিঁপড়ে ও পোকার উপদ্রবে বেশী গাছ গজায় নি। যে কয়টি হয়েছিল মুরগী কয়টা মিলে সেগুলি ধ্বংস করেছে। ফলে, গাছের মধ্যে এখন দাঁড়িয়েছে সূর্যমুখী এবং ঐ জাতীয় দুই এক রকম গাছ। রজনীগন্ধা গাছ কয়েকটি আছে কিন্তু গন্ধ নাই বলিলে অত্যুক্তি হয় না। গন্ধ ও গানের অভাব সময় সময় বোধ করি। কিন্তু উপায় কি?
এ মুলুকে ভাল চা পাওয়া যায় না—তাই কলিকাতা থেকে ভাল চা আনবার জন্য দোকানে আমরা ফরমাস দিয়েছি। এখানকার লিপ্টন ও ব্রকবন্ড চা অখাদ্য এবং উভয়ই বিলাতী। আমি গত চিঠিতে খলের কথা লিখেছিলাম। একটা ভাল খল কবিরাজী ওষুধ খাবার জন্য। এবং খুড়োকে বলবেন ভালো চায়ের দোকানের ঠিকানা আমাকে জানাতে। আমরা দার্জিলিঙের অরেঞ্জ পিকো (Orange Pekoe) চা খাই। এখানকার দোকানে ফরমাস দিয়ে আমরা কলকাতার সেই দোকান থেকে চা আনাবো।
সবচেয়ে সুন্দর এখানকার ইলিশ মাছ। দেখতে ঠিক গঙ্গার ইলিশ। কিন্তু গঙ্গার অথবা বাঙ্গলার ইলিশের মত একটুও স্বাদ নাই। খাবার সময় বলতে পারা যায় না কি মাছ। মাছের মধ্যে রুই ভিন্ন ভাল মাছ পাওয়া যায় না। চিংড়ি মাছ পাওয়া যায় বটে—কিন্তু আগুন দর।
আশা করি ওখানকার সব কুশল। কঞ্চি মামা এখন কোথায়? প্রাক্টিশ কেমন হচ্ছে? মেজদাদাকে বলবেন যে টাকার কথা যা লিখেছিলাম তা যেন পাঠান। আপনারা কি এবার দেশে যাবেন পূজার সময়? আমার Financial Secretary-র খবর কি? তিনি এখন বোধ হয় কটকে? অরুণার ও গোরার বিবাহ কি স্থির হল? বড়দিদিরা কেমন আছেন? শরীর কেমন?
কাপড় জামা ইত্যাদি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেছেন। আপনারা কি জানেন না যে আমরা সম্রাটের অতিথি? আমাদের কি কোন অভাব থাকতে পারে? আমাদের অভাব মানে যে সম্রাটের নিন্দা। আর তাও কি হতে পারে?
আমার শরীরের কথা জিজ্ঞাসা করেছেন। সুখে দুঃখে দিনগুলি একরকম কেটে যাচ্ছে। গরমের সময় বেশ অসুবিধা হয়েছিল আর স্বাস্থ্যও খারাপ হয়েছিল। বদলী হবার জন্য যে দরখাস্ত করি সে দরখাস্ত নামঞ্জুর হয়। কর্তৃপক্ষেরা বোধ হয় মনে করেন যে আমি নিতান্ত অকৃতজ্ঞ; সরকার এত কষ্ট করে আমার খোরাক পোষাক বিনা খরচে যোগাচ্ছেন—আর আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে বদলী হবার জন্য ব্যস্ত। যাক্ এখন আর বদলী হবার আকাঙ্ক্ষা রাখি না। গরমটা কমেছে; শরীরটা তাই পূর্বাপেক্ষা একটু ভাল আছে। যদি হজমের গোলমাল না বাড়ে, তবে শীতকালটা ভাল থাকব বলে ভরসা করি। এখান থেকে বর্মারাজার প্রাসাদ দেখতে পাওয়া যায়—এবং তাঁরই কেল্লার মধ্যে যে জেলখানা সেই জেলখানার মধ্যে আমরা বাস করি। পূর্ব গৌরবের কথা প্রায় মনে হয় এবং বর্তমান অবস্থার কথা চিন্তা করলে যে চোখে জল আসে না তা বলতে পারি না। ভারত কি ছিল—আর কি হয়েছে।
এখানে এসে অনেক শিখেছি এবং সে হিসেবে অনেক লাভও হয়েছে। ভগবান যা করেন—মঙ্গলের জন্য করেন। দেশকে কত ভালবাসি তা বোধ হয় এখানে এসে ভালরকম বুঝতে পেরেছি।
আপনারা সকলে আমার প্রণাম জানবেন।
ইতি—
শ্রীসুভাষ
দিলীপকুমার রায়কে লিখিত
কেয়ার অব ডি আই জি,
আই বি, সি আই ডি, বেঙ্গল
১৩, এলিসিয়াম রো
কলিকাতা
মান্দালয় জেল
১১/৯/২৫
প্রিয়বরেষু,
দিলীপ,
আমার পূর্বেকার পত্র শেষ হয়নি। পরের সপ্তাহে তোমাকে আর একটি পত্র পাঠাব ভেবে রেখেছিলাম কিন্তু ইতিমধ্যে যে দারুণ বিপদ ঘটে গেল তা আমাদের সকলকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছে। হয়তো আমার মত সকলেই আজ একটা অনিশ্চিত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে তবু ব্যক্তিগতভাবে এ ক্ষতি আমার পক্ষে অপূরণীয়; তাছাড়া এই বিপদের দিনে আমি জেলে পড়ে আছি—এই চিন্তা আমার মনকে আরও বেশী শোকাচ্ছন্ন করে তুলেছে।
কালের আবর্তনে ব্যক্তিগত ক্ষতির প্রশ্নটা হয়তো মুছে যাবে কিন্তু দেশের যে ক্ষতি হল তা তাঁর দেশবাসী যতই দিন যাবে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকবে। বাস্তবিক তাঁর প্রতিভা ও কর্মধারা এমনই বহুবিস্তৃত ছিল যে সর্বশ্রেণীর মানুষ এই নিদারুণ আঘাতে বিচলিত বোধ করেছে। কখনও কখনও আমি তাঁর সমালোচনা করে বলেছি যে, অনেক কাজের মধ্যে কেন তিনি নিজেকে এভাবে জড়িয়ে ফেলছেন। কিন্তু সৃজনশীল প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে, কোনও যুক্তিতর্কের সীমার বন্ধনে তা আবদ্ধ হতে চায় না। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় অখণ্ড জীবনের উপলব্ধি ছিল বলেই তিনি জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রে পুনর্গঠনের প্রেরণা লাভ করেছিলেন।
তোমাদের অন্তত একটা সুযোগ ছিল তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবার; এবং তাঁর স্মৃতিরক্ষার কর্মপ্রয়াসের মধ্যেও কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পার। কিন্তু এই বিপদের দিনে সুদূর মান্দালয়ে কারাবাসের মুহূর্তগুলিতে এই দুঃসংবাদ আমাদের কয়েকজনকে এমনই আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে আমরা নিতান্ত অসহায় বোধ করছি—বোধহয় ঈশ্বরের ইচ্ছাই এরূপ। তবু আমি অতি মাত্রায় আশাবাদী বলে নিজেকে কিছুটা সংযত রাখতে পেরেছি। মনের গভীরে যখন অসংখ্য চিন্তা তোলপাড় করতে থাকে তখন তাকে ভাষায় প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়; তাই এ প্রসঙ্গ ত্যাগ করে এখন অন্য প্রসঙ্গ শুরু করছি।
তোমার বই প্রকাশ হতে আর কত দেরি? এখনও কি প্রেসেই আছে? কবে নাগাদ বেরোবে আশা করছ? ভারতীয় সঙ্গীতে পুনরায় প্রাণ সঞ্চার ও তার প্রচারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ইংরাজীতে (অন্য প্রদেশের লোকদের সুবিধা হয় তাহলে) কেন বই লেখ না একটা?
কিছুদিন পূর্বে রুদ্রকে তার শোকে সমবেদনা জানিয়ে এক পত্র দিয়েছিলাম। তার কোনও উত্তর পাইনি। তুমি কোনও পত্র পেয়েছ কি?
তোমার মহান পিতার রচনাবলীর একটা সম্পূর্ণ সেট পাঠাতে পারবে কি? আমরা আবার ঐ বইগুলো পড়ে ফেলতে চাই। যদি সম্ভব হয় তাহলে এখানকার জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্টের নামে তা সরাসরি পাঠাতে পার। ঐ বইগুলোর কথা লিখে সঙ্গে একখানি পত্রও (বইগুলোর নাম সহ) পাঠাবে। আমাদের সব পত্র কলিকাতার অফিসে পরীক্ষা করে দেখা হয় কিন্তু এখানকার জেলের সুপারিন্টেডেন্ট বইগুলো পরীক্ষা করে দেখেন। সুতরাং বই-টই সব তাঁর নামে পাঠানোই ভাল, এতে অনেকখানি সময় বেঁচে যাবে। ভাল কথা, টুর্গেনিভের ‘Smoke’ বইটি পাওয়া গিয়েছে কি? কলিকাতার সি আই ডি বিভাগ আমাকে জানিয়েছে যে, এরকম কোনও বই তাদের কাছে পাঠানো হয়নি। বইটি সত্যই হারিয়ে গিয়ে থাকলে দুঃখের ব্যাপার হবে।
যদিও এখানকার আবহাওয়া আমাকে খুশী করতে পারেনি তবু অনেকটা যেন আরাম বোধ হচ্ছে। যে সব জটিল প্রশ্নের উত্তর এতদিন খুঁজে পাইনি সেগুলোরও সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আমাদের জীবনের নানা সমস্যার সমাধানের জন্য যে নিরাসক্ত মনোভাব গড়ে তোলা প্রয়োজন, এই নির্জনতা ও প্রবাসজীবনের ফলে তা আমি পেয়েছি, এজন্য কৃতজ্ঞ বোধ না করে পারছি না। যদি আমার শরীর সুস্থ থাকত তাহলে যে নির্বাসন আমাকে বাধ্য হয়ে ভোগ করতে হচ্ছে তার দ্বারা আরও অনেক কিছু লাভ হত। তবে যে রকম বোঝা যাচ্ছে তাতে মনে হয় আমাকে দীর্ঘকাল এখন এখানেই থাকতে হবে।
নানা দিক থেকে বর্মা এক আশ্চর্য দেশ; এবং এখানকার জীবন ও সংস্কৃতি পর্যালোচনের ফলে অনেক নৃতন অভিজ্ঞতাও লাভ করেছি। কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি এদের আছে—তবু আমার মনে হয়—বর্মীরা চীনাদের মতই সামাজিক দিক থেকে অনেক অগ্রসর। তবে যেটা এদের একান্ত অভাব তা হল কর্মশক্তির প্রেরণা, Bergson যাকে বলতেন ‘elan vital’—অর্থাৎ সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে প্রগতির পথে ছুটে চলার যে প্রচণ্ড আবেগ তা এদের নেই। এখানকার সমাজে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ ঘটেছে, শুধু তাই নয় ইউরোপের যে কোনও দেশ অপেক্ষা এখানে স্ত্রী-স্বাধীনতাও অনেক বেশী। কিন্তু হায়! প্রকৃতির বৈচিত্র্যহীনতাই বোধ হয় সব উৎসাহ কেড়ে নিয়েছে এদের। সুদূর অতীত কাল থেকে বিরলবসতি এই দেশে প্রচুর শস্য জন্মানোর ফলে এদের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে পড়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল দেহ ও মনের দিক থেকে এরা সবাই অলস হয়ে উঠেছে। এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে, যদি এরা কোনও দিন কর্মশক্তির প্রেরণা খুঁজে পায় তাহলে সমৃদ্ধির পথে এরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারবে।
তুমি বোধহয় জান বর্মাতে স্ত্রী ও পুরুষ মিলিয়ে শিক্ষিতের শতকরা হার ভারতবর্ষের যে কোনও প্রদেশের চেয়ে অনেক বেশী। ধর্মীয় সেবা-প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় প্রথায় আশ্চর্য অল্প খরচে যে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে তার ফলেই সম্ভব হয়েছে এটা। বর্মাতে আজও প্রত্যেক ছেলেকে কয়েক বছর না হলেও অন্ততঃ কয়েক মাস ব্রহ্মচর্য পালন করে গুরুর কাছে পাঠ নিতে হয়। এ প্রথার শুধু যে একটা শিক্ষাগত ও নৈতিক মূল্য আছে তা নয়, এর আর একটা দিকও আছে—ধনীদরিদ্রনির্বিশেষে সবাই একসঙ্গে মানুষ হবার সুযোগ পায়। সারা দেশ জুড়েই এই অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা চালু আছে।
তোমার পূর্বেকার পত্রে তুমি এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলে যে যারা দার্শনিক নয় তারা কারাজীবনের মধ্যে শুধু যন্ত্রণাই খুঁজে পায়। এটা পুরোপুরি সত্য নয়। এমন অনেক লোক আছে যারা দার্শনিক নয় কিন্তু কোনও না কোনও আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত। গত মহাযুদ্ধের সময় বহু লোক দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে নানা প্রকার দুঃখ-লাঞ্ছনা ভোগ করেছে, তারা কেউ দার্শনিক ছিল না। যতক্ষণ আদর্শের প্রেরণা থাকে, আমার বিশ্বাস যে-কোনও লোক সেরকম সাহস অবলম্বন করে আনন্দের সঙ্গে দুঃখকে বরণ করে নিতে পারে। এবথাও ঠিক যে, দার্শনিকের পক্ষে এ সব দুঃখ-যন্ত্রণার দ্বারা আত্মিক উন্নতি ঘটানো সম্ভব; এবং একে মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের কাজেও লাগাতে পারে সে। সুতরাং একথা কি ঠিক নয় যে, আমাদের মধ্যে দার্শনিকতার বোধ এখনও জন্মায়নি, আর সে বোধকে জাগ্রত করতে হলে এই যন্ত্রণানুভূতির প্রয়োজন আছে?
আজ এখানেই শেষ করছি। আশা করি শীঘ্রই তুমি আমার পত্রের উত্তর দেবে। প্রীতি ও শুভেচ্ছা নেবে। বন্ধুবান্ধবদেরও আমার প্রীতি-সম্ভাষণ জানাবে।
শ্ৰীযুক্ত ডি. কে. রায়
৩৪ থিয়েটার রোড
কলিকাতা
ইতি
তোমার চিরসুহৃদ
সুভাষ
শরৎচন্দ্র বসুকে লিখিত
মান্দালয়
১৭. ৩. ২৬
পরম পূজনীয় মেজদাদা,
দিন দুয়েক আগে খুব অভিনব নয়, অথচ একটি মজার অভিজ্ঞতা আমাদের হল। সূর্য অস্ত গেছে এবং সন্ধ্যার ছায়া এসে নেমেছে আমাদের ওপর। কিন্তু সন্ধ্যার আঁধারের চেয়েও অন্ধকার, মান্দালয়ের গ্রীষ্মে সুপরিচিত ধুলোর ঝড় আব্ছা সুদূর দিগন্ত থেকে উঠে এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল। পর্দা ফেলে দেওয়ার আগেই, চলমান ধুলোর আচ্ছাদন আমাদের সম্পূর্ণভাবে আবৃত করে ফেলল। অতি কষ্টে পর্দা যদি বা নামানো গেল, তবু ঝড়ের তীব্র গতিবেগে সে পর্দা হাওয়ায় ভেসে সমস্ত আবহাওয়াকে গীতময় করে তুলল। পুরু আচ্ছাদনের মত ধুলো ঘরময় ছড়িয়ে রইল, এমন কি ঘরের সুদূরতম কোণ-ও বাদ রইল না। বাতাস বয়েই চলল, ছাদের টালিগুলোও শুরু করল উড়তে। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ঢেউয়ে দোলায়মান জাহাজের মত কাঠের কাঠামোটিতেও শোনা গেল গম্ভীর কর্কশ শব্দ। কাগজপত্র উড়তে লাগল, লণ্ঠনের আলো হয়ে এল নিবু নিবু, বিভিন্ন জিনিসপত্রের যেন গজিয়ে উঠল ডানা। স্বর্গের রোষ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হল না, করুণার বারিবিন্দু বর্ষিত হল উপর থেকে। দার্শনিকেরা বলেন, ঈশ্বরের করুণা গভীর অন্ধকারেও দীপ্যমান। সুতরাং, এটাই ত শোভন যে এই কৃপাবিন্দু অন্ধকারেই ঝরবে। পরিবেশের ঐকতান সম্পূর্ণ করতে বৈদ্যুতিক আলো যথাসময় গেল নিবে, মিল্টন-এর “Cimmerian darkness”-এ আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেললাম। বিদ্যুতের ভয়ঙ্কর ঝিলিক্ অন্ধকারকে করে তুলল দৃশ্যমান (আমি আবার মিল্টন-এর অনুগামী কারণ শেক্সপীয়রের অপরূপ চন্দ্রলোকের বর্ণনা যতখানি সুমিষ্ট, সন্ত মিল্টনের অন্ধকারের বর্ণনা কি ততখানিই সুদক্ষ নয়?) আর অনুরাগী ভক্তের চোখে প্রকাশিত হল তমসার রাণী মা কালীর হাসির ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য। (চিন্ময় মুখমণ্ডলে শোভে অট্ট অট্ট হাসি)
ধুলোর দৌরাত্ম পরাভূত হল, আমরা ও আমাদের দীন সম্বল হয়ে উঠলাম বৃষ্টি ও বাতাসের খেলার সামগ্রী। ইস্কুলে এইরকম একটি বৃষ্টির বর্ণনা পড়েছিলাম:
“Pitter, patter, pit pat,
Down the window-pane” etc.
কিন্তু শার্সি ছিল না জানালায় আর খুঁটির বেষ্টনীর উপস্থিতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে টুপ্ টুপ্ করে বৃষ্টি পড়তে লাগল আমাদের উপর, জামাকাপড় গেল ভিজে। হাওয়ার গতি হঠাৎ অন্য মোড় নিয়ে বইতে লাগল উত্তর দিক থেকে, যেদিকে আচ্ছাদনের চিহ্নটুকুও ছিল না। বৃষ্টির জলে স্নাত, হাড়-কাঁপানো হিমেল হাওয়ায় কাতর আমরা গুটিকতক প্রাণী জায়গা ছেড়ে নড়বার সাহস করলাম না, পাছে টেবিলে বা চৌকীতে হোঁচট খাই বা একের অন্যের মাথায় ঠোকাঠুকি লাগে। এর মধ্যেও উদ্দীপনা বজায় রেখে আমাদের গলা ছেড়ে গান গাওয়া এই প্রচণ্ড তাণ্ডবে হাস্যরসের সঞ্চার করল। যতক্ষণ না বাতি আবার জ্বলে উঠল, হাওয়ার গতি গেল মন্থর হয়ে, ততক্ষণ নিচ্ছিদ্র অন্ধকার ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব চলল। তারপর, আমরা কি দেখলাম? দেখলাম, বইপত্র গেছে ভিজে, জামাকাপড় থেকে টুপ্ টুপ্ করে জল ঝরছে, আর বিছানাপত্র একেবারে স্যাঁৎস্যাঁতে। আর সর্বোপরি যা দেখলাম তা হল, ঘরের মধ্যিখান দিয়ে বয়ে যাওয়া এক শীর্ণ নদীর ধারা। আমাদের একঘেয়ে জীবনে কিছুটা বৈচিত্র্য আনার উদ্দেশ্যে, বিধাতা আমাদের কিছু অভিনব কাজ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। পুরো ঘন্টা দুই ধরে আমরা ঘরের মেঝেতে জমে থাকা জল পরিষ্কার করতে এবং বই ও আসবাবপত্র মুছে ফেলতে ব্যস্ত রইলাম। রাত্রির স্নানে সতেজ হয়ে বইপত্র ও জামাকাপড়ের ত দিব্যি ঘুম হল, কিন্তু আমাদের? প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেয়াল ও পার্থিব সর্ববিধ দুর্ঘটনার জন্য দোষী সাব্যস্ত করার মত অবশ্য একজন ছিলেন—তিনি চীফ্ জেলার। রাত্রি দশটায় পাঠানো হল জরুরি দাবি—শুকনো কম্বল ও বিছানার চাদর পাঠানো হোক্। প্রচণ্ড ঝড়-ঝঞ্ঝায় ইতিমধ্যেই কাবু হয়ে থাকা এই মাননীয় ব্যক্তিটি যেন আমাদের দাবি শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। জেলে তৈরি একদম নতুন কম্বল পাঠাননা তিনি যুক্তিযুক্ত মনে করলেন না, তাই তাঁর নিজের উদ্বৃত্ত থেকে আমাদের জন্য মোটামুটি ভাল কম্বল ও বিছানার চাদর পাঠানো হল। এই গভীর রাত্রে এ ধরনের উষ্ণ সহানুভূতি যে খুবই সাদরে গৃহীত হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। ঈশ্বরের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে আমরা দ্বাররক্ষীর হাতে আত্মসমর্পণ করলাম। ঘড়িতে তখন বাজে এগারোটা।
হয়ত আমার এখানেই থামা উচিত, নয়ত কবিত্ব করে ফেলব।
আপনার স্নেহের
সুভাষ
দিলীপকুমার রায়কে লিখিত
মান্দালয় জেল
৯/১০/২৫
একথা কিছুতেই মনে করো না যে, আমার দৃষ্টি নিতান্তই সঙ্কীর্ণ। “Greatest good of the greatest number”-এতে আমি যথার্থই বিশ্বাস করি, কিন্তু সে “good” আমার কাছে সম্পূর্ণ বস্তুগত নয়। অর্থনীতি বলে, মানুষের সকল কাজ হয় “productive” নয় “unproductive”; তবে কোন্ কাজ যে “productive,” তা নিয়ে অনেক বাক্বিতণ্ডা হয়ে থাকে। আমি কিন্তু কারুকলা বা সে সংক্রান্ত কোন প্রচেষ্টাকে “unproductive” মনে করিনে, আর দার্শনিক চিন্তা বা তত্ত্ব-জিজ্ঞাসাকে নিষ্ফল বলে অবজ্ঞা করিনে। আমি নিজে একজন আর্টিস্ট না হতে পারি—আর সত্যি বলতে কি আমি জানি যে তা নই—কিন্তু সে জন্যে দোষী প্রকৃতি বা ভগবান যাই বল, আমি নই। অবশ্য যদি বল যে আর জন্মের কর্মফল এ জন্মে ভোগ করছি, তাহলে আমি নাচার। সে যাই হক এ জন্মে যে আর্টিস্ট হ’লুম না তার কারণ, হতে পারলুম না, আর আমার বিশ্বাস শিল্পী জন্মায়, তৈরী করা যায় না, এ কথা অনেকটা সত্য। কিন্তু নিজে আর্টিস্ট না হলেই যে আর্ট উপভোগ করা যায় না, এমন কোন কথা নেই, আর কোনও কলার সমঝদার হ’তে গেলে তাতে নিজের যেটুকু পরিমাণ দখল থাকা দরকার, আমার মনে হয় তা প্রত্যেক শিক্ষিত ব্যক্তির পক্ষেই সুলভ।
দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ ক’রে এ আক্ষেপ করো না যে, সঙ্গীত নিয়ে তুমি সময়টা হেলায় কাটিয়ে দিচ্ছ, যখন শেক্সপীয়রের কথায় বলতে গেলে “the time is out of joint.”
বন্ধু, সারা দেশকে সঙ্গীতের বন্যায় প্লাবিত করে দাও, আর যে সহজ আনন্দ আমরা প্রায় হারিয়ে বসেছি, তা আবার জীবনে ফিরিয়ে আনো। যার হৃদয়ে আনন্দ নেই, সঙ্গীতে যার চিত্ত সাড়া দেয় না, তার পক্ষে জগতে বৃহৎ কি মহৎ কিছু সম্পাদন করা কি কখনও সম্ভব? কার্লাইল বলতেন, সঙ্গীত যার প্রাণে নেই, সে করতে পারে না হেন দুষ্কার্য নেই। এ কথা সত্যি হোক বা না হোক, আমার মনে হয় যার প্রাণে সঙ্গীতের কোন সাড়া নেই, সে চিন্তায় বা কার্যে কখনও মহৎ হতে পারে না। আমাদের প্রত্যেক রক্তকণিকায় আনন্দের অনুভূতি সঞ্চারিত হোক এই আমরা চাই, কারণ আনন্দের পূর্ণতাতেই আমরা সৃষ্টি করতে পারি। আর সঙ্গীতের মত আনন্দ আর কিসে দিতে পারে।
কিন্তু আর্ট ও তজ্জনিত আনন্দকে দরিদ্রতমের পক্ষেও সহজলভ্য করতে হবে। সঙ্গীতে বিশেষজ্ঞতার চেষ্টা অবশ্য ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে চলবে, আর সে রকম চর্চা হওয়াও উচিত; কিন্তু সঙ্গীতকে সর্বসাধারণের উপযোগী করে তুলতে হবে। বিশিষ্ট সাধনার অভাবে আর্টের উচ্চ আদর্শ যেমন ক্ষুন্ন হয়, তেমনি জনসাধারণের কাছে সুগম না হলেও আর্ট এবং জীবনে বিচ্ছেদ ঘটে, আর তাতে আর্ট নির্জীব ও খর্বই হয়ে যায়। আমার মনে হয় লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের (Folk music and dancing) ভিতর দিয়েই আর্ট জীবনের সঙ্গে যোগ রাখে। ভারতবর্ষে জীবন ও আর্টের মধ্যে এই যোগটি পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রায় ছিন্ন করে ফেলেছে, অথচ তার স্থানে নূতন কোন যোগসূত্র যে আমরা পেয়েছি, তাও নয়। আমাদের যাত্রা, কথকতা, কীর্তন প্রভৃতি যেন কোন অতীত যুগের স্মৃতিচিহ্ন মাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতঃ যদি আমাদের গুণী শিল্পীরা অচিরে আর্টকে পুনরায় জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত না করতে পারেন, তা হ’লে আমাদের চিত্তের যে কি দৈন্যদশা ঘটবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। তোমার হয়ত মনে আছে তোমাকে আমি একবার বলেছিলাম যে, মালদার ‘গম্ভীরা’ গানের সৌন্দর্যে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাতে সঙ্গীত ও নৃত্য উভয়ই ছিল। বাঙ্গলার অন্যত্র ওরূপ জিনিষ কোথাও আছে ব’লেও আমি জানিনে, আর মালদাতেও ওর মৃত্যু শীঘ্রই অবশ্যম্ভাবী, যদি নতুন ক’রে প্রাণশক্তি ওতে সঞ্চারিত করবার চেষ্টা না হয়, আর বাঙ্গালার অন্যান্য স্থানেও ওর প্রচলন না হয়। বাঙ্গলা দেশে লোকসঙ্গীতের উন্নতিকল্পে মালদায় তোমার শীঘ্র যাওয়া উচিত। গম্ভীরার মধ্যে জটিল বা বিশাল বা মহৎ কিছুই নেই—তার গুণই এই যে, সহজ সাদাসিধে। আমাদের নিজস্ব Folk music ও Folk dancing একমাত্র এই মালদাতেই বেঁচে আছে, আর সেই হিসাবেই গম্ভীরার যা মূল্য। সুতরাং যাঁরা ও প্রকার সঙ্গীত ও নৃত্য পুনর্জীবিত করতে চান, তাঁদের মালদা থেকে কাজ আরম্ভ করাই সুবিধা।
লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের দিক থেকে বর্মা এক আশ্চর্য দেশ। খাঁটি দিশি নাচ ও গান এখনও পুরোদমে এখানে চলেছে, আর সুদূর পল্লীতে পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ লোককে আমোদ-আহ্লাদের খোরাক যোগাচ্ছে। ভারতীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি অনুশীলন করার পর তুমি যদি ব্রহ্মদেশের সঙ্গীতের চর্চা কর ত মন্দ হয় না। সে সঙ্গীত হয়ত তত সূক্ষ্ম বা উন্নত নয়, কিন্তু দরিদ্র ও অশিক্ষিতকেও প্রচুর আনন্দ দান করবার যে ক্ষমতা তার আছে, আপাততঃ আমি তাতেই আকৃষ্ট হয়েছি। শুনি নাকি এখানকার নাচও বড় সুন্দর। বর্ষায় জাতিভেদ না থাকাতে এখানকার শিল্পকলার চর্চা কোন শ্রেণী-বিশেষের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নয়। ফলে বর্মার আর্ট চারিদিকে ব্যাপ্ত হয়ে পড়েছে। বোধহয় এই কারণে, আর লোকসঙ্গীত ও নৃত্যের প্রচলন থাকার দরুন, ব্রহ্মদেশে ভারতবর্ষের চেয়ে জনসাধারণের মধ্যে সৌন্দর্যজ্ঞান অনেক বেশী পরিণতি লাভ করেছে। দেখা হলে এ বিষয়ে আরো কথা হবে।
দেশবন্ধুর সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আমি একমত। আমিও সম্পূর্ণ মানি যে, অনেক সময়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের বৃহৎ ক্ষেত্রের চেয়ে জীবনের ছোটখাটো ঘটনায় মানুষের মহত্ত্ব ঢের বেশী প্রকাশ পায়। দেশবন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হয়েছিলাম বলেই তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধাভক্তি, ভালবাসা জন্মেছিল—দেশনেতারূপে তাঁর অনুগামী ছিলাম বলে নয়। তাঁর বেশীর ভাগ ভক্তেরও ঠিক আমার মতই হয়েছিল। বস্তুতঃ তাঁর সহকর্মী ও অনুচর ছাড়া তাঁর অন্য কোন পরিজন ছিল না বললেই হয়। আমি তাঁর সঙ্গে জেলে আটমাস একসঙ্গে ছিলাম—দু’মাস পাশাপাশি ঘরে, আর ছ’মাস একই ঘরে। এইরূপে তাঁকে সম্পূর্ণ ঘনিষ্ঠভাবে জানবার সুযোগ পেয়েছিলাম, —তাই ত তাঁর পদতলে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
তুমি শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে যা লিখেছ, তার সবটা না হ’লেও বেশীর ভাগই আমি মানি। তিনি ধ্যানী—আর আমার মনে হয়, বিবেকানন্দের চেয়েও গভীর, যদিও বিবেকানন্দের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রগাঢ়। আমিও তোমার কথায় সায় দিই যে, “নীরব ভাবনা, কর্মবিহীন বিজন সাধনা” সময়ে সময়ে দরকার হয়, এমন কি দীর্ঘকালের জন্যেও। কিন্তু আশঙ্কা এই যে, সমাজের বা দেশের জীবনস্রোত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলে মানুষের কর্মের দিকটা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, আর তার প্রতিভার একপেশে বিকাশের ফলে সে সমাজবিচ্ছিন্ন অতিমানুষের মতন কিছু একটা হয়ে উঠতে পারে। অসাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন দু’চার জন প্রকৃত সাধকের কথা অবশ্য আলাদা, কিন্তু বেশীর ভাগ লোকের কর্ম বা লোকহিতই সাধনার একটা প্রধান অঙ্গ। নানা কারণে আমাদের জাতির কর্মের দিকটা শূন্য হয়ে এসেছে, তাই এখন আমাদের দরকার রজোগুণের “double dose”। সাধক বা তাদের শিষ্যদের মধ্যে অতিরিক্ত চিন্তার ফলে ইচ্ছাশক্তি অসাড় যদি না হয়ে যায়, তা হলে নির্জনে ধ্যান যতদিনের জন্যে তারা করে করুক, আমি তাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যাব না। কিন্তু আমরা যেন “sicklid o’er with the pale cast of thought” না হয়ে পড়ি। সাধক নিজে হয়ত নিস্তেজকারী সকল প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারে,—কিন্তু তার চেলারা? গুরুর সাধনপদ্ধতি কি সজ্ঞানে না তোক অজ্ঞানে তাদের কোন অনিষ্ট করবে না?
আমি এ কথা সম্পূর্ণ মানি যে, প্রত্যেকেরই নিজের ক্ষমতার পূর্ণ বিকাশ করবার চেষ্টা করতে হবে। নিজের মধ্যে যা সর্বোৎকৃষ্ট, তার দানই হচ্ছে প্রকৃত সেবা। আমাদের অন্তরপ্রকৃতি, আমাদের স্বধর্ম যখন সার্থকতা লাভ করে, তখনই আমরা যথার্থ সেবার অধিকারী হই। এমার্সনের কথায় বলতে গেলে, নিজের ভিতর থেকেই আমাদের গড়ে উঠতে হবে; তাতে আমরা সকলেই যে এক পথের পথিক হব এমন কোন কথা নেই, যদিও একই আদর্শ হয়ত আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। শিল্পীর সাধনা কর্মযোগীর সাধনা থেকে ভিন্ন, তপস্বীর যে সাধনা বিদ্যার্থীর সে সাধনা নয়, কিন্তু আমার মনে হয় এ সকলের আদর্শ প্রায় একই। গোলাকার ব্যক্তিকে চতুষ্কোণ গর্তের মধ্যে পুরতে আর যেই চাক না কেন, আমি কখনই চাইনে। নিজের প্রতি সত্য হ’লে বিশ্বমানবের প্রতি কেউ অসত্য হতে পারে না। তাই আত্মোন্নতি ও আত্মবিকাশের পথ নিজের প্রকৃতিই দেখিয়ে দেবে। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি নিজের শক্তি ও প্রকৃতি অনুসারে নিজেকে সার্থক করে তুলতে পারে, তাহ’লে অচিরেই সমগ্র জাতির নব-জীবন দেখা দেয়। সাধনার অবস্থায় হয়ত মানুষকে এমন ভাবে জীবন যাপন করতে হয়, যাতে তাকে বাইরে থেকে স্বার্থপর বা আত্মসর্বস্ব মনে হতে পারে। কিন্তু সে অবস্থাতে মানুষ বিবেকবুদ্ধির দ্বারা চালিত হবে, বাইরের লোকের মতামতের দ্বারা নয়। সাধনার ফল যখন প্রকাশিত হবে, তখনই লোকে স্থায়ী বিচার করবে, সুতরাং আত্মবিকাশের সত্য পথ যদি অবলম্বন করা হয়ে থাকে, তা হলে লোকমত উপেক্ষা করা যেতে পারে। অতএব দেখা যাচ্ছে যে তোমার সঙ্গে আমার মতের যে বিশেষ পার্থক্য আছে, তা নয়। ইতি—
তোমার স্নেহবদ্ধ—সুভাষ
* বর্মার বন্দীশালা থেকে লেখা মেজদাদা শরৎচন্দ্র বসু, মেজবৌদিদি বিভাবতী বসু, বন্ধু দিলীপকুমার রায় ও ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠির সংকলন।