আমার জীবন দর্শন
১৯১৭ সালে একজন জেসুইট পাদ্রীর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। সাধারণত সব বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আলোচনা হত। ইগনাটিয়াস লয়ালা জেসুইটদের যে সঙঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার মধ্যে আমি তখন অনেক কিছু খুঁজে পেয়েছিলাম যা আমার ভাল লেগেছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, তাঁদের দারিদ্র, সত্য ও আনুগত্যের১ তিনটি ব্রতের কথা বলা যায়। জেসুইটদের অনেকে যেমন হতেন, এই পাদ্রীটি সেরকম নিজের মতে অন্ধবিশ্বাসী ছিলেন না এবং হিন্দু দর্শনে তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। আমাদের আলোচনাগুলিতে তিনি স্বভাবতই খ্রিস্টধর্মের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতেন, আর আমার প্রধান যুক্তি ছিল শঙ্করাচার্যকৃত বেদান্তভাষ্য। অবশ্য শঙ্করের মায়াবাদের২ নিগূঢ় তাৎপর্য যে সবই আমি উপলব্ধি করেছিলাম এমন নয়, তবে তার মূল সূত্রগুলি আমি ধরতে পেরেছিলাম—কিংবা ধরতে পেরেছি অন্তত এরূপ একটা ধারণা আমার ছিল। একদিন জেসুইট পাদ্রীটি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘স্বীকার করি যে, যুক্তির দিক থেকে শঙ্করের মত সর্বাপেক্ষা গভীর—কিন্তু যারা তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না তাদের কাছে আমরা তার পরের শ্রেষ্ঠ মতটিই উপস্থাপিত করি।’
এমন একটা সময় ছিল যখন আমি বিশ্বাস করতাম যে মানুষের পক্ষে চরম সত্যে পৌঁছানো অসম্ভব নয়, এবং জ্ঞানের সারকথাই হচ্ছে মায়াবাদ। আজ ওই মতকে মেনে নিতে আমি ইতস্তত করব। আমি আর ব্রহ্মবাদী নই (যদি আমার নিজের অর্থে ওই শব্দটির ব্যবহার করতে পারি), বরং আরও বেশি বাস্তববাদী। যার সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারি না, যা কাজে লাগে না, তাকে আমি প্রত্যাখ্যান করতে চাই। দীর্ঘকাল ধরে শঙ্করের মায়াবাদ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল; কিন্তু শেষপর্যন্ত বুঝলাম যে তা গ্রহণ করা আমার চলবে না, কারণ সে অনুসারে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্যে আর একটি দর্শনের দিকে আমাকে ঝুঁকতে হয়েছিল। কিন্তু সেজন্যে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট হবার মতো কোনও প্রেরণা বোধ করিনি। ভারতীয় দর্শনের কয়েকটি মত আছে—যারা এই জগৎ ও সৃষ্টিকে মায়া মনে না করে প্রকৃত সত্তা বলে মনে করে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ, সীমাবদ্ধ অদ্বৈতবাদ মতের কথা বলা যায়; ওই মত অনুসারে চরম সত্য হচ্ছে এক এবং জগৎ তারই প্রকাশ। রামকৃষ্ণেরও ওই একই মত ছিল যে এক (ঈশ্বর) ও বহু (সৃষ্টি) উভয়ই সত্য। সৃষ্টিরহস্যকে ব্যাখ্যা করে কয়েকটি মত চালু হয়েছে। কারও কারও মতে, এই ব্রহ্মাণ্ড আনন্দ অথবা স্বর্গীয় সুখের প্রকাশ। অন্যান্যদের মত এই যে, এ হল Divine Play কিংবা ‘লীলা’র অভিব্যক্তি। মানুষের ভাষায় ও কল্পনায় এই এক, ব্ৰহ্ম—ঈশ্বরকে বর্ণনা করবার কয়েকটি চেষ্টা হয়েছে। বৈষ্ণবদিগের মতো কারও কারও নিকট প্রেমই ঈশ্বর; শাক্তদের মতে তিনি শক্তি; অন্যান্য অনেকের মতে তিনি জ্ঞান; আবার অনেকে তাঁকে আনন্দ বলে মনে করেন। এ ছাড়া হিন্দু দর্শনে ‘সৎ-চিৎ-আনন্দ’ রূপে ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে পরম্পরাগত ধারণা আছে, যাকে অন্য কথায় বলা যায় ‘অস্তিত্ব-চৈতন্য (বা জ্ঞান)-আনন্দ’। যে সব দার্শনিকের চিন্তাধারা অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ তাঁরা বলেন যে, ব্ৰহ্ম অব্যক্ত বা অনির্বচনীয় (inexpressible); এবং বুদ্ধ সম্বন্ধে বলা হয় যে ব্রহ্ম বিষয়ে যখনই তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছে তখনই তিনি নীরব থেকেছেন।
আমাদের সীমাবদ্ধ বুদ্ধির সাহায্যে ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। সত্যকে আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি না; যেহেতু তা জ্ঞেয়—নিজেই নিজের মধ্যে প্রকাশমান—আমাদের নিজ নিজ দর্শনশক্তির সাহায্যে তা করতে হবে; এইসব দর্শনশক্তি—বেকনের ‘আইডোলা’ বা কান্টের ‘ফর্মস্ অফ্ দি আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ কিংবা আর যাই কিছু হোক না কেন। হিন্দু দার্শনিক খুব সম্ভবত বলবেন যে, যতক্ষণ জ্ঞাতা (Subject) ও জ্ঞেয় (Object)— এই দ্বৈতভাব থাকে ততক্ষণ সম্পূর্ণ জ্ঞান অসম্ভব। পূর্ণ জ্ঞানলাভ তখনই করা যেতে পারে যখন জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে মিশে যায়। তা মানসিক ক্ষেত্রে—সাধারণ চৈতন্যের রাজ্যে সম্ভব নয়। তা সম্ভব শুধু অধি-মানস ক্ষেত্রে—চৈতন্যের উচ্চতর স্তরে। কিন্তু এই অধি-মানস সম্বন্ধে, চৈতন্যের এই উর্ধ্বতর স্তর সম্বন্ধে হিন্দু দর্শনের ধারণা অদ্ভুত এবং পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন। প্রথমোক্তদের মতে, যৌগিক উপলব্ধি অর্থাৎ কোনও না কোনও প্রকারের স্বতঃলব্ধ জ্ঞানের সাহায্যে চৈতন্যের এই উর্ধ্বতর স্তরে পৌঁছলে তবেই শুধু পূর্ণ জ্ঞানলাভ সম্ভব। এই স্তব্ধঃলব্ধ জ্ঞানকে কোনও কোনও মহলে এখনও উপহাস করা হলেও, আঁরি বের্গস-এর সময় থেকে অবশ্য তাকে জ্ঞান লাভের উপায় হিসাবে পাশ্চাত্য দর্শনে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু অধি-মানসের অস্তিত্ব ও যোগসাধনার দ্বারা আমাদের তা হৃদয়ঙ্গম করার সম্ভাবনা পাশ্চাত্য দর্শনকে স্বীকার করতেই হবে।
যৌগিক উপলব্ধির দ্বারা ব্রহ্মকে জানা যায়, তর্কের খাতিরে আপাতত তা স্বীকার করলেও তাঁকে ভাষায় প্রকাশ করার সমস্যা থেকেই যায়। যখন আমরা তাঁকে বর্ণনা করার চেষ্টা করি তখন আমরা সাধারণ চৈতন্য-রাজ্যের মধ্যেই ঘুরে বেড়াই এবং মানুষের সাধারণ চৈতন্যের সীমাবদ্ধতার দ্বারা বাধা পাই। কাজেই পরমব্রহ্ম সম্বন্ধে সারকথা বলতে গিয়ে যে বর্ণনা দেওয়া হয় সেগুলির দ্বারা তাঁর ওপরে নরত্ব আরোপ করা হয়ে থাকে। আর যাঁর ওপর নরত্ব আরোপ করা হয় তাঁকে চরম সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়া যায় না।
এখন কথা হচ্ছে, যোগসাধনার দ্বারা কি ব্ৰহ্মকে উপলব্ধি করা যায়? অধি-মানস ক্ষেত্রে কোনও ব্যক্তির পক্ষে কি পৌঁছানো সম্ভব, যেখানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এক হয়ে মিশে যায়? আমার নিজের কথায় বলতে গেলে, এ প্রশ্নে আমার মনোভাব ছিল পুরোপুরি অজ্ঞেয়বাদী। একদিকে, বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে কোনও কিছুকে মানতে আমি প্রস্তুত নই; প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অবশ্যই অর্জন করা চাই। কিন্তু ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে এরকম অভিজ্ঞতা লাভ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অপরপক্ষে, অতীতে অনেকেই যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বলে দাবি করেন তাকে একেবারে অসার উক্তি বলে ঠিক উড়িয়ে দিতে পারি না। একে অস্বীকার করার অর্থ অনেক কিছুকেই অস্বীকার করা, যা আমি করতে প্রস্তুত নই। অতএব, যে পর্যন্ত না আমার নিজের কোনও অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ততদিন অধি-মানসের প্রশ্নটি অমীমাংসিত বলেই স্বীকার করে নিতে হবে। ইতিমধ্যে আমার ভূমিকা হবে সম্বন্ধবাদীর। এর দ্বারা আমি বলতে চাই যে, যে সত্যকে আমরা জেনেছি তা চরম সত্য নয়, বরং আপেক্ষিক। আমাদের সাধারণ মানসিক গঠন—ব্যক্তি হিসাবে আমাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য—এবং কালপ্রবাহে ওই ব্যক্তির মধ্যে যেসব পরিবর্তন ঘটে থাকে সেগুলির কাছে তা আপেক্ষিক।
ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণাগুলি আমাদের মনের কাছে আপেক্ষিক—এ একবার স্বীকার করলে দর্শন সংক্রান্ত বিতর্ক থেকে আমরা অনেকটা পরিত্রাণ পাব। এর অর্থ হবে যে, এরকমের ধারণাগুলির মধ্যে যখন মিল নেই তখন ওইগুলির সবই সমানভাবে সত্য হতে পারে—জ্ঞাতা তাঁর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের সাহায্যে বৈসাদৃশ্যটুকু বিচার করে দেখবেন। এর দ্বারা আরও বোঝাবে যে, ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে ওই একই ব্যক্তির ধারণাগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মানসিক উন্নতির ফলে বদলে যেতে পারে। কিন্তু এই ধারণাগুলির কোনওটিকেই অসার বলে মনে করবার প্রয়োজন নেই। যেমন বিবেকানন্দ বলতেন, ‘অসত্য থেকে সত্যে নয়, বরং সত্য থেকে উচ্চতর সত্যের দিকে মানুষ এগিয়ে চলেছে।’ সেজন্যে সব মতকেই সহ্য করার একটা ক্ষেত্র থাকা দরকার।
এখন প্রশ্ন এই: যে সত্য আমি জেনেছি তা আপেক্ষিক এবং চরম সত্য নয়, এটা মেনে নিলে এর প্রকৃতিটা কিরূপ? প্রথমত, এর বস্তুগত একটা অস্তিত্ব আছে এবং তা মায়া নয়। পূর্বের ধারণা থেকে নয়, বরং প্রধানত বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি। মায়াবাদের দ্বারা কোনও কাজ হয় না। যদিও দীর্ঘকাল তার সঙ্গে আমার জীবনকে মানিয়ে নেবার জন্যে ভীষণভাবে চেষ্টা করেছি, তবুও তা আমার পক্ষে উপযুক্ত নয়; অতএব তা আমাকে বাদ দিতে হবে। অপরপক্ষে, যদি এই জগৎ সত্য হয় (অবশ্য চরম সত্য নয়, একটা আপেক্ষিক অর্থে) তাহলে জীবন চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠবে এবং তার একটা অর্থ ও উদ্দেশ্য থাকবে।
দ্বিতীয়ত, এই সত্য নিশ্চল নয়, বরং গতিশীল—সতত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের কোনও লক্ষ্য আছে কি? হ্যাঁ আছে; উন্নততর একটা অস্তিত্বের দিকে তা অগ্রসর হচ্ছে। প্রকৃত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, এসব পরিবর্তনের অর্থ হল অগ্রগতি, এবং তা অর্থহীন নয়।
অধিকন্তু, আমার কাছে এই সত্যের অর্থ হল, সজ্ঞানে একটা উদ্দেশ্য সাধনে আত্মা দেশ ও কালের মধ্য দিয়ে কাজ করে চলেছে। অবশ্য যে চরম সত্য সর্বকালে বর্ণনাতীত এবং এই মুহুর্তে যা আমারও ধারণার বাইরে, এই ধারণা সে রকম নয়। সুতরাং এ একটি আপেক্ষিক সত্য এবং আমার মানসিক১ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। তা সত্ত্বেও, এই ধারণা থেকে সত্যকে জানবার আমার ঐকান্তিক প্রয়াস বোঝা যাবে এবং এই সত্যই হল আমার জীবনে গঠনের ভিত্তি।
আত্মায় আমি কেন বিশ্বাস করি? কারণ বাস্তব ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন আছে। আসলে প্রকৃতি তা চায়। জড় জগতের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় আমি দেখে থাকি; আমার নিজের জীবনে একটা ‘ক্রমবর্ধমান উদ্দেশ্য’ লক্ষ্য করি। আমার মনে হয় যে, আমি পরমাণু দ্বারা তৈরি একটা পিণ্ড মাত্র নই। এও উপলব্ধি করি যে, কতগুলি অণুর আকস্মিক একটা সংমিশ্রণের ফলে বস্তু সৃষ্টির হয়নি। এছাড়া, আর কোনও মত সত্যকে (যেরকম ভাবে আমি বুঝতে পেরেছি) এত ভাল করে বোঝাতে পারে না। সংক্ষেপে বলতে গেলে, জ্ঞান ও নীতির দিক থেকে এই মত প্রয়োজন; আমার প্রসঙ্গে যতদূর বলা যায়, তাতে তা আমার জীবনধারণের পক্ষেও বিশেষ প্রয়োজন।
এই জগৎ আত্মার প্রকাশ এবং আত্মা ঠিক যেরকম অবিনশ্বর, এই সৃষ্টির জগৎও সে রকম। সৃষ্টির কোনও সময়ই বিনাশ হয় না, হতে পারে না। এই মত বৈষ্ণবদিগের নিত্য লীলার (Eternal Play) মতের অনুরূপ। পাপ থেকে জগৎ সৃষ্ট হয়নি; কিংবা শঙ্করবাদীরা যেমন বলেন তেমনি ‘অবিদ্যা’ বা ‘অজ্ঞানতার’ ফল তা নয়। তা নিত্যশক্তির নিত্য লীলার প্রকাশ—বলতে পারেন ঈশ্বরের লীলা।
খুব সঙ্গতভাবেই আমাকে প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, কেন আমি সত্যের স্বরূপ ও অনুরূপ সমস্যাগুলি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি এবং কেন আমার নিজের অভিজ্ঞতার দ্বারা সস্তুষ্ট থাকতে পারি না। এর উত্তর খুব সহজ। যে মুহূর্তে আমরা অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করি তখনই আমাদের ‘অহং’, অর্থাৎ যে মন তা লাভ করে এবং সব অভিজ্ঞতার মূল, যা আমাদের অভিজ্ঞতার সারবস্তু—সেই ‘নাহং’-কে মেনে নিতে হবে। ‘অহং’-কে বাদ দিয়ে যে সত্য—সেই ‘নাহং’ রয়েছে এবং চোখ বন্ধ করে থাকলেও আমরা তার অস্তিত্বকে উপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের সব অভিজ্ঞতার মধ্যে এই সত্য নিহিত আছে এবং আমাদের নিকট যার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক মূল্য আছে তার অনেকখানিই ওই সম্বন্ধে আমাদের ধারণার ওপর নির্ভর করে।
না, আমরা সত্যকে উপেক্ষা করতে পারি না। তার স্বরূপ জানবার জন্যে আমাদের অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। যদিও, আগেই যেমন বলেছি, ওই জ্ঞান বড়জোর আপেক্ষিক হতে পারে এবং তাকে চরম সত্য—এই আধ্যায় ভূষিত করা যায় না। এমনকি এই আপেক্ষিক সত্য পরিবর্তনশীল হলেও, তাকে অবশ্যই আমাদের জীবনের ভিত্তি করতে হবে।
তাহলে এই যে আত্মা—যা সত্য—তাহার স্বরূপটা কি? কয়েকজন অন্ধ লোকের হাতিকে বর্ণনা করার চেষ্টা সম্বন্ধে রামকৃষ্ণের নীতিকাহিনীটি স্মরণ করা যায়। প্রত্যেকে তার যে যে অঙ্গ স্পর্শ করেছে সেইমত তার বর্ণনা করেছে, এবং ফলে একের বর্ণনার সঙ্গে অন্যের বর্ণনার অমিল ঘটেছে। আমার নিজের মত এই যে, সত্য সম্বন্ধে মতগুলির অধিকাংশই অংশত হলেও খাঁটি, এবং প্রধান প্রশ্ন হল, কোন্ মতটির মধ্যে সর্বাধিক সত্য নিহিত আছে। আমার নিকট প্রেমই সত্যের স্বরূপ। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সার হচ্ছে প্রেম এবং মানুষের জীবনের মূল নীতি। স্বীকার করি, এই মতও সম্পূর্ণ নয়, কেননা সত্যটা আসলে কি তা আজ আমার নিকট অজানা। আর মানুষের জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার দ্বারা শেষপর্যন্ত ব্ৰহ্মকে উপলব্ধি করা গেলেও, তাঁকে আমি মেনেছি, এরকম দাবি আমি করতে পারি না। তবুও, সব অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও, এই মতই আমার কাছে সর্বাধিক সত্য বলে বোধ হয় এবং এর দ্বারা প্রায় চরম সত্যে পৌঁছানো যায়।
কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, প্রেমই যে সত্যের স্বরূপ—কীভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আমার এই জ্ঞানতত্ত্ব একেবারে খাঁটি কি না সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ আছে। কিছুটা জীবনের সব দিকের যুক্তিসঙ্গত পর্যালোচনা করে এবং কিছুটা স্বতঃলব্ধ জ্ঞান ও বাস্তাব ধারণা থেকেও এই সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছেছি। আমার চারদিকে আমি প্রেমের লীলা দেখি। আমার মধ্যেও ওই একই প্রবৃত্তি অনুভব করি। আমার মনে হয় যে নিজেকে পূর্ণতা দান করবার জন্যে আমাকে ভালবাসতেই হবে এবং জীবনকে পুনর্গঠনের মূল নীতি হিসাবে প্রেম আমার পক্ষে প্রয়োজন। নানা চিন্তার ফলে আমি ওই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হয়েছি।
উপরে বলেছি যে, মানুষের জীবনের মূলমন্ত্র হচ্ছে প্রেম। জীবনে এমন অনেক কিছু আছে যা প্রেম নয়—তা দেখে কেউ এ কথার প্রতিবাদ করতে পারেন; কিন্তু এই আপাতবিরোধী সত্যের ব্যাখ্যাও সহজ। ওই ‘মূল-মন্ত্রের’ পূর্ণ প্রকার এখনও ঘটেনি; স্থান ও কালের মধ্য দিয়ে তা নিজেকে প্রকাশ করছে। যে প্রেম সত্যের মূল, সত্যের মতো সেই প্রেমও স্থিতিশীল নয়।
এখন, যে উপায়ে তার প্রকাশ ঘটছে তার প্রকৃতিটা কি? প্রথমত, তা সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কি না? দ্বিতীয়ত, এই গতির মধ্যে কোনও নিয়ম আছে কি?
এই প্রকাশ যেভাবে হয়ে থাকে তা স্বভাবতই প্রগতিমূলক। একেবারে অন্ধ বিশ্বাস থেকে একথা জোর দিয়ে বলছি না। পর্যবেক্ষণ ও প্রকৃতির পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে সর্বত্রই অগ্রগতি ঘটছে। এই অগ্রগতি অব্যাহত ধারায় না-ও হতে পারে; মধ্যে মধ্যে সাময়িকভাবে বাধার সম্মুখীন হতে পারে। তবে, মোটের উপর অর্থাৎ দীর্ঘকালের কথা বিচার করলে দেখা যায় অগ্রগতি ঘটছে। এই যুক্তিসম্মত বিচার ছাড়া স্বতঃলব্ধ অভিজ্ঞতাও এই যে, কালক্রমে আমরা সামনের দিকেই এগিয়ে চলেছি। সবশেষে হলেও গুরুত্বপূর্ণ হল, জৈবিক ও নৈতিক—এই দু’ দিক থেকেই এই অগ্রগতিতে বিশ্বাস স্থাপন করা প্রয়োজন।
সত্যকে জানা ও তা বর্ণনা করার জন্যে যেমন নানা প্রকার চেষ্টা হয়েছে, তেমনই বহু চেষ্টা হয়েছে অগ্রগতির নিয়মকে বুঝতে পারার জন্যে। এই প্রচেষ্টার কোনটিই নিষ্ফল নয়; প্রত্যেকটির মধ্যে আমরা সত্যের ইঙ্গিত পাই। খুব সম্ভবত হিন্দুদিগের সাংখ্য দর্শনে প্রকৃতিতে এই বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়া বর্ণনা করার সবচেয়ে প্রাচীন চেষ্টা হয়েছে। আধুনিক মন ওই সমাধানে সন্তুষ্ট হবে না। আরও সাম্প্রতিক কালে বিবর্তন সম্বন্ধে আমরা নানা প্রকার মত কিংবা হয়তো বর্ণনা পেয়েছি। স্পেন্সারের মতো কেউ কেউ আমাদিগকে এরূপ বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন যে সহজ থেকে জটিলতার দিকে উন্নতির মধ্যেই বিবর্তন নিহিত রয়েছে। ভন হার্টমানের মতো অন্যান্যদের দৃঢ় অভিমত ছিল এই যে এই জগৎ অন্ধ ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ—যা থেকে এরূপ সিদ্ধান্ত করা চলত যে, তার অন্তর্নিহিত ভাব খোঁজ করা বৃথা। বের্গসঁ তাঁর নিজের সৃষ্টিমূলক বিবর্তনবাদ পোষণ করতেন; এই বিবর্তনের অর্থ, প্রতি স্তরে নতুন নতুন সৃষ্টি বা অবলুপ্তি, মানুষের বুদ্ধির সাহায্যে পূর্ব থেকে যা ধারণা করা অসম্ভব। পক্ষান্তরে, হেগেলের এরূপ অন্ধ বিশ্বাস ছিল যে, কি চিন্তারাজ্যে কি বস্তু জগতে, এই বিবর্তন-ক্রিয়ার প্রকৃতিটা তর্কশাস্ত্রের ব্যাপার। একের পর এক বিরোধ ও ওইগুলির সমাধানের মধ্য দিয়ে আমরা অগ্রসর হই। প্রত্যেকটি বিষয়ের মধ্যে আছে একটা বিরোধাভাস। এই বিরোধের সমাধান হয় সমন্বয়ের দ্বারা, যা থেকে নতুন করে সৃষ্টি হয় আর একটা বিরোধের ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এইসব মতের প্রত্যেকটির মধ্যেই নিঃসন্দেহে কিছু না কিছু সত্য রয়েছে। উপরোক্ত মনীষীদের প্রত্যেকেই, যিনি যেমন উপলব্ধি করেছেন, সেইমত সত্যকে প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু হেগেলের মতই যে সত্যের প্রায় একেবারে কাছে পৌঁছেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অন্য যে কোনও মতের চেয়ে তা অধিকতর সন্তোষজনকভাবে আসল বিষয়গুলিকে ব্যাখ্যা করেছে। আবার অখণ্ড সত্য বলেও তাকে স্বীকার করা যায় না কারণ যেসব বিষয় আমাদের জানা আছে সেসবের সঙ্গে তা মেলে না। যা হোক, সত্য এত বৃহৎ যে আমাদের ক্ষুদ্র বোধশক্তির সাহায্যে তাকে সম্পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও যে মতের মধ্যে সর্বাধিক সত্য নিহিত আছে সেই মতের দ্বারাই আমাদের জীবন গড়ে তুলতে হবে। চরম সত্যকে জানা যায় না বা আমরা জানি না, সেজন্যে আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না।
অতএব, সত্য হচ্ছে আত্মা—যার সার প্রেম, তা পরস্পরবিরোধী শক্তিসমূহ ও ওইগুলি সমাধানের নিত্য লীলার মধ্য দিয়ে নিজকে ধীরে ধীরে প্রকাশ করেছে।
১ বৌদ্ধদিগের প্রার্থনার সঙ্গে এর কিছু সাদৃশ্য আছে; প্রতিদিন তাদের এই তিনটি প্রার্থনা করতে হয়—“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি; ধম্মং (Truth) শরণং গচ্ছামি; সঙ্ঘং (Order) শরণং গচ্ছামি।”
২ এই মতবাদটির তাৎপর্য সংক্ষেপে এই যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে যে পৃথিবীকে আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা মায়া। তা রজ্জুতে সর্পভ্রমের ব্যাপার; ইন্দ্রিয়গুলির প্রতিরূপ হচ্ছে সর্প।
১ এতে কোনও ভুল নেই—কারণ, এমার্সন যেমন বলেছেন, সঙ্কীর্ণ মনের দুষ্ট ভূত হচ্ছে নির্বোধের মতো সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলা। উপরন্তু, পরিবর্তন না থাকলে অগ্রগতি কিসের?
সামঞ্জস্য রখা করে চলা উপজুক্ত পরিবর্তন না থাকলে আহগ্রগতি কিসের?
অসমাপ্ত আত্মজীবনী—‘An Indian Pilgrim’ (১৯৩৭)-এর শেষ পরিচ্ছেদ।