ভারতের মৌলিক সমস্যাবলী
ভারত সম্বন্ধে আপনারা যেসব সাধারণ বিষয় শুনে থাকেন বা পাঠ করেন সে সম্বন্ধে সুধীজনের এই সভায় কিছু বলতে চাই না। মনে হয় আপনাদের কাছে ভারতের মৌলিক সমস্যা সম্বন্ধে বলাই ভাল হবে। নিজে একজন দর্শনের ছাত্র হওয়ায় স্বভাবতই আমি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে বেশি আগ্রহী। আশা করি আপনারাও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, বরং কতকগুলি মৌলিক সমস্যা যা আমাদের দেশে বর্তমানে দেখা দিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে সে সম্পর্কে আজ আমার আপনাদের কাছে বলা উচিত।
বিদেশে ভ্রমণের সময় প্রায়ই লক্ষ্য করেছি যে আমার স্বদেশ সম্পর্কে বিদেশের মানুষ সাধারণত একটি ভুল এবং কখনও কখনও বা হাস্যকর ধারণা পোষণ করে। যেমন, ভারত সম্বন্ধে ইউরোপের মানুষের সাধারণ ধারণা হল এই যে, ভারতে তিনটি জিনিস দেখা যায়—সাপ, ফকির এবং মহারাজা। ব্রিটিশ প্রচারের দ্বারা যাঁরা প্রভাবিত হয়েছেন তাঁদের ধারণা ভারত এমন একটি দেশ যেখানে লোকেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে এবং সেখানে জনসাধারণের মধ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্যে ব্রিটেনের কঠোর শাসন দরকার।
ইউরোপের প্রাচ্যতত্ত্ববিদ অর্থাৎ ভারত সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের কাছে গেলে দেখা যাবে, তাঁরা ভারতকে একটি অতীন্দ্রিয়বাদী ও দার্শনিকের দেশ বলে মনে করেন, এমন এক দেশ যেখানে একদিন অতি উচ্চমানের দর্শনের উদ্ভব হয়েছিল কিন্তু আজ তা মিশর ও ব্যাবিলনের প্রাচীন সভ্যতার মতোই মৃত।
এখন প্রশ্ন হল: ভারতের বাস্তব রূপ কী? আমাদের সভ্যতা যে অতি প্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মিশর, ব্যাবিলন, ফিনিসীয় এমনকি গ্রীসের সভ্যতার মতো ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতি মৃত নয়। বর্তমান কালেও তা বেঁচে আছে। দু’ বা তিন হাজার পূর্বের আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো বর্তমান কালের ভারতীয় আমরা মূলত একই চিন্তা করি। আমাদের একই রকম অনুভূতি এবং জীবনের আদর্শ একই রকম। অর্থাৎ অতীত কাল থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রয়েছে। ইতিহাসে এটি এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয়। এখন ভারতকে বুঝতে হলে এই মূল কথাটি, অর্থাৎ অতীতের ভারত যে মৃত নয় তা জানতে হবে। অতীতের ভারত বেঁচে আছে এবং ভবিষ্যতেও বেঁচে থাকবে।
এই পটভূমি অর্থাৎ অতীত কালের পটভূমিতে আমরা যুগে যুগে আমাদের জাতীয় জীবনে পরিবর্তন দেখতে পাই। গত তিন হাজার বছর ধরে নতুন চিন্তা, কখন বা নতুন সংস্কৃতি নিয়ে বাইরে থেকে মানুষ ভারতে এসেছে। এইসব নতুন প্রভাব, ভাবধারা এবং সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ভারতের জাতীয় জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। ফলে কয়েক হাজার বছর পূর্বের মতো আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা মূলত একই রকম থাকলেও আমাদের পরিবর্তন ঘটেছে এবং সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা চলেছি। আমাদের এক অতীত পটভূমি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে আমরা এক আধুনিক পৃথিবীতে বাস করতে এবং সেই পৃথিবীর সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।
যাঁরা সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে ব্রিটিশ প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত তাঁদের ধারণা ব্রিটিশেরা অতি সহজেই ভারত জয় করেছিল এবং ব্রিটিশের দ্বারা ভারত অধিকারের পরেই আমাদের দেশ রাষ্ট্রনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই দু’টি ধারণাই সম্পূর্ণ ভুল এবং ভিত্তিহীন।
প্রথমত, ব্রিটিশ যে অতি সহজে ভারত অধিকার করেছিল একথা সত্য নয়। ভারতকে সম্পূর্ণ অধীনে আনতে ব্রিটিশের ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত একশ বছর লেগেছিল। দ্বিতীয়ত, এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল যে, ব্রিটিশের দ্বারাই ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্য সাধিত হয়েছিল। প্রকৃত তথ্য এই যে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বৌদ্ধসম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ভারত সর্বপ্রথম রাষ্ট্রনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়। বস্তুত, মহান অশোকের সময়ের ভারত বর্তমান ভারতের চেয়েও বৃহত্তর ছিল। কেবলমাত্র বর্তমান ভারতভূখণ্ড নয়, আফগানিস্তান এবং পারস্যের একাংশ অশোকের সময়কার ভারতের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অশোকের পরে ভারতকে তার জাতীয় জীবনের অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে। অবনতির যুগের পর এসেছে উন্নতি ও জাতীয় আলোড়নের যুগ। কিন্তু জাতীয় জীবনের এই উত্থান-পতনের মধ্যেও শেষপর্যন্ত আমরা আমাদের অগ্রগতির ধারাকে বজায় রাখতে পেরেছি। অশোকের পর প্রায় এক হাজার বছর পরে গুপ্তসম্রাটদের আমলে ভারত উন্নতির শিখরদেশে পৌঁছেছিল। এরপর প্রায় ন’ হাজার বছর পরে মোগল সম্রাটদের শাসনকাল পুনরায় ভারতের এক গৌরবময় যুগ। সেজন্যে একথা মনে রাখা দরকার যে, ব্রিটিশ শাসনকালেই আমরা রাষ্ট্রনৈতিক ঐক্যলাভ করেছি এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। ভারতে তাদের রাজত্বকালে ব্রিটিশরা যা করতে চেষ্টা করেছে তা হল ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, তাদের দুর্বল, নিরস্ত্র এবং কাপুরুষ করা।
এখন আমি আপনাদের কাছে একটি সমস্যার কথা বলব যা বিজ্ঞানীদের, বিশেষ করে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রদের আগ্রহ সৃষ্টি করবে। প্রশ্নটি হল: ভারতবাসীদের স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঁচার অধিকার আছে কি না। অর্থাৎ স্বাধীন জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার মতো ক্ষমতা ও জীবনীশক্তি তাদের মধ্যে এখনও আছে কি? ব্যক্তিগতভাবে আমার ধারণা, যদি কোনও জাতি তার জীবনীশক্তি, তার অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি, হারিয়ে ফেলে তবে সে জাতির বেঁচে থাকার অধিকার নেই। আর জীবনীশক্তি হারিয়েও যদি সে বেঁচে থাকে, মানবজাতির কাছে তার অস্তিত্বের কোনও গুরুত্ব বা মূল্য না থাকারই শামিল। ভারতের স্বাধীনতার জন্যে কেন আমি কৃতসঙ্কল্প এবং কেন বিশ্বাস করি যে স্বাধীন জাতি হিসাবে আমাদের এক গৌরবময় ভবিষ্যৎ আছে, তার একমাত্র কারণ আমার বিশ্বাস স্বাধীন মানুষ হিসাবে বাঁচার এবং একটি জাতি হিসাবে গড়ে ওঠার মতো জীবনীশক্তি আমাদের রয়েছে।
আমাদের যথেষ্ট জীবনীশক্তি আছে কি না এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে এখন আমাকে দু’টি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে—প্রথমত, আমাদের জাতির সৃষ্টিক্ষমতা আছে কি না এবং দ্বিতীয়ত, নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে তা সংগ্রাম করতে এবং মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত কি না। ভারতে এই দু’টি পরীক্ষা করতে হবে।
প্রথম প্রশ্নটি প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন এবং বিদেশী শাসন থেকে উদ্ভূত নানা বিধিনিষেধ এবং অসুবিধা সত্ত্বেও এই শতাব্দীতে আমরা বহু প্রমাণ দিতে পেরেছি যে, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এখনও আমাদের সৃষ্টিক্ষমতা রয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতে অনেক দার্শনিক ও চিন্তাবিদের জন্ম হয়েছে, দাসত্বের বন্ধনের মধ্যেও কবি এবং লেখক জন্মেছেন। ব্রিটিশ শাসন সত্ত্বেও শিল্পকলার পুনরুজ্জীবন ঘটেছে, শিক্ষালাভের পথে নানা বাধা সত্ত্বেও ভারতীয়রা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছেন। আমাদের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের সমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। নিজের প্রচেষ্টা এবং উদ্যমে ভারতে শিল্প-উন্নয়ন ঘটেছে। অবশেষে এমনকি খেলাধূলার ক্ষেত্রেও ভারত সম্মানলাভ করেছে। এসবই প্রমাণ করেছে যে, রাজনৈতিক দাসত্ব সত্ত্বেও ভারতের প্রাণশক্তি অটুট রয়েছে।
বৈদেশিক শাসন এবং সেই শাসনের ফলে সকল বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও আমরা যদি নিজেদের সৃষ্টিক্ষমতার এরকম বহু প্রমাণ দিয়ে থাকি তাহলে একথা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, ভারত যখন স্বাধীন হবে এবং ভারতের জনগণ শিক্ষালাভের সুযোগ পাবে তখন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বুদ্ধিমত্তা ও সৃষ্টিক্ষমতার অনেক উন্নততর প্রমাণ দিতে পারবে।
আমি এতক্ষণ জাতির প্রাণশক্তির প্রথম পরীক্ষা, সৃষ্টিক্ষমতার কথা বলেছি। এবার দ্বিতীয় পরীক্ষা, অর্থাৎ ভারতীয়রা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করতে ও মৃত্যুবরণ করতে সক্ষম কি না সে বিষয়টি বিবেচনা করব। এ বিষয়ে প্রথমেই বলতে চাই ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশের সঙ্গে শেষ যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয়রা শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ একদিনের জন্যেও বন্ধ করেনি।
দৃর্ভাগ্যবশত আমাদের পূর্বপুরুষদের নির্বুদ্ধিতার জন্যে ১৮৫৭ সালের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর, তৎকালীন নেতৃবর্গ নিরস্ত্রীকরণের কাছে আত্মসমর্পণ করে। আমাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্যে পরবর্তী কালে আমরা যেসব বাধার সম্মুখীন হয়েছি তার কারণ প্রধানত আমাদের এই নিরস্ত্রীকরণ। কিন্তু নেতাদের ভুলের জন্যে জনসাধারণকে নিরস্ত্র করা সত্ত্বেও অন্য উপায়ে তারা স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম চালিয়েছেন।
ভারতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কি কি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল তার বিবরণ দিয়ে আপনাদের অহেতুক সময় নষ্ট করব না। এইটুকু মাত্র বলব যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে বিপ্লবীরা যেসব পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন সেসব পদ্ধতিই ভারতে গ্রহণ করা হয়েছে।
এই শতাব্দীর শুরুতে, বিশেষ করে ১৯০৪ ও ১৯০৫ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপানের জয়লাভের পর, ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুন প্রেরণা লাভ করে। তারপর থেকে গত চল্লিশ বছর ধরে আমাদের বিপ্লবীরা অন্যান্য দেশের বিপ্লবীদের পন্থাগুলি গভীরভাবে লক্ষ্য করেন এবং যতগুলি সম্ভব সেগুলি প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেন। এছাড়া তাঁরা দেশের মধ্যে অস্ত্র এবং বিস্ফোরক তৈরি করতে ও স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তী এক পর্বে ভারত একটি নতুন পন্থা পরীক্ষা করে—তা হল আইন অমান্য বা অহিংস প্রতিরোধ। এর শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা হলেন মহাত্মা গান্ধী। ব্যক্তিগতভাবে আমি যদিও বিশ্বাস করি যে, এই উপায়ে আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা আসবে না, তবুও এই আন্দোলন যে ভারতবাসীদের মধ্যে নবজাগরণ ও ঐক্য আনতে খুব সাহায্য করেছে এবং বিদেশী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন বাঁচিয়ে রেখেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সেজন্যে আমি বলতে চাই যে, বিদেশী শাসনের ফলে উদ্ভূত সমস্ত বাধা সত্ত্বেও একটি জাতি যে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারে এবং তা প্রয়োগ করে প্রভূত সাফল্য অর্জন করতে পারে, এতেই প্রমাণ হয় যে, সে জাতির প্রাণশক্তি রয়েছে। এতে বুঝতে পারা যায় যে, সেই জাতি দাসত্বকে একটি স্থির নিশ্চিত ঘটনা বলে মেনে নেয়নি, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে নতুন পন্থা উদ্ভাবন করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
একজন বিপ্লবী হিসাবে আমি অন্যান্য দেশের বিপ্লব আন্দোলনের বিষয়ে গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি এবং কোনও রকম অত্যুক্তি না করে বলতে পারি যে, ১৮৫৭ সালের পর থেকে আমরা বিপ্লব আন্দোলনের সব রকম সম্ভাব্য পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। অবশ্য একটিমাত্র পদ্ধতি গ্রহণ করা এখনও বাকি আছে, সেটি হল একটি প্রকৃত আধুনিক জাতীয় সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা।
সে কাজ এতদিন করা হয়নি কারণ ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ও ব্রিটিশ পুলিশের নজরের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরে তা করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যে মুহূর্তে এই যুদ্ধ ভারতের বাইরে একটি আধুনিক ভারতীয় জাতীয় সৈন্যবাহিনী সংগঠন করার সুযোগ ভারতীয়দের কাছে এনে দিল সেই মুহূর্তে তাঁরা তা গ্রহণ করেন। সেই প্রচেষ্টার ফলে এবং জাপান সরকার ও জাপানের সশস্ত্র সৈন্যবাহিনীর সাহায্যে তাঁরা এই সৈন্যবাহিনী সংগঠন করতে সক্ষম হয়েছেন।
সেজন্যে আমি বলতে চাই যে, ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের বিপ্লব আন্দোলনের সময় বরাবর আমরা যথেষ্ট উদ্যোগ, সৃজনশীল ক্ষমতা এবং প্রাণশক্তি দেখিয়েছি এবং প্রচণ্ড ত্যাগ স্বীকার করেছি। এখন আমরা আশা করি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে এবং এই যুদ্ধ আমাদের যে সুযোগ এনে দিয়েছে তার ফলে শেষপর্যন্ত আমরা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে এবং ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব।
ভারতীয়দের প্রাণশক্তি এবং স্বাধীন জাতি হিসাবে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার সম্পর্কে প্রশ্নটির উত্তর দেওয়ার পর আমি এখন বর্তমান ভারতের সামাজিক অবস্থা বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। বর্তমান ভারতকে বুঝতে হলে আপনাদের তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথম বিষয় হল, ভারতের প্রাচীন পটভূমিকা অর্থাৎ ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও সভ্যতা—যে বিষয়ে ভারতীয়রা আজ সচেতন এবং যার জন্যে তাঁরা গর্ববোধ করেন। দ্বিতীয় বিষয় হল, ব্রিটিশের দ্বারা চূড়ান্তভাবে পরাভূত হবার পর আমাদের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। তৃতীয় বিষয় হল, দেশের বাইরে থেকে আসা কতগুলি প্রভাব।
এই প্রাচীন ঐতিহ্য, ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন জাতীয় সংগ্রাম এবং বৈদেশিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া—এই তিনটি বিষয় মিলিত হয়ে বর্তমান ভারত।
যেসব বৈদেশিক প্রভাব ভারতে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে এবং ভারতের বর্তমান অবস্থার জন্যে অল্প পরিমাণে দায়ী সে সম্পর্কে কিছুটা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব। এইসব বৈদেশিক প্রভাবের মধ্যে প্রথম বিষয়টি হল পাশ্চাত্য জগতের চিন্তা যা অভিব্যক্ত হয়েছিল উদারনৈতিক চিন্তা, গঠনতান্ত্রিক চিন্তা এবং গণতন্ত্র-এ। বলতে গেলে ১৮৫৭ সালের পর থেকে আধুনিক উদারনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তা খুব বেশি পরিমাণে ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত করেছে।
বর্তমান শতাব্দীর শুরু থেকে একটি নতুন বিষয় সক্রিয় হয়। ১৯০৪-০৫ সালে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাপানের জয়লাভের পর একটি নতুন আন্দোলন—কেবলমাত্র জাপানের নয় সেই সঙ্গে অন্যান্য এশীয় দেশের পুনর্জাগরণ ভারতীয়দের নজরে আসে। তারপর থেকে এশিয়ার পুনর্জাগরণের দিকে ভারতীয় চিন্তাবিদরা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। গত চল্লিশ বছর ধরে শুধু ভারতের অভ্যন্তরেই নয়, এশিয়ার অন্যান্য অংশে কি ঘটেছে সে কথাও আমরা ভাবছি।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে তা হল, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে বিপ্লব আন্দোলন। ভারতীয় বিপ্লবীরা মাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডির নেতৃত্বে ইতালির বিসর্জিমেন্টো (Resorgimento) আন্দোলন এবং ব্রিটিশ অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে আইরিশ জনগণের আন্দোলন অনুধাবন করেছেন। আপনারা জানেন, গত বিশ্বযুদ্ধের আগে রাশিয়ার জারের বিরুদ্ধে নিহিলিস্ট আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন হয়েছিল। সেটিও পর্যালোচনা করা হয়েছে। ভারতের নিকটে চীনে ড. সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে নবজাগরণ ভারতীয় বিপ্লবীরা গভীরভাবে এবং সাগ্রহে অনুধাবন করেছেন।
এভাবে দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের সব বিপ্লব আন্দোলনের প্রভাব সম্পর্কে ভারতীয় বিপ্লবীদের মন ছিল অত্যধিক গ্রহণশীল। গত বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ায় যখন বিদ্রোহ শুরু হয় এবং সেই বিদ্রোহের ফলে একটি নতুন সরকার—সোভিয়েট সরকার —গঠিত হয়, সেই সরকারের কাজকর্ম আমাদের দেশে গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করা হয়।
ভারতীয়রা যতটা না কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি আগ্রহী ছিল তার চেয়েও বেশি আগ্রহী ছিল সোভিয়েট রাশিয়ায় পুনর্গঠন, সে দেশের দ্রুত শিল্পায়ন এবং কীভাবে সোভিয়েট সরকার সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান করেছেন তার প্রতি। গঠনমূলক কাজে সোভিয়েট সরকারের কৃতিত্ব আমাদের দেশের জনগণ গভীর আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন। বস্তুত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আমাদের দেশের যেসব বুদ্ধিজীবীদের কমিউনিজম সম্পর্কে তেমন আগ্রহ ছিল না তাঁরাও যখন রাশিয়া পরিদর্শন করেন তখন সে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পুনর্গঠনমূলক কাজ দেখে তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। তারপর সাম্প্রতিক কালে আরও একটি প্রভাব বিদেশ থেকে ভারতে এসেছে, তা হল ইউরোপে ইতালি ও জার্মানীর নেতৃত্বে পরিচালিত ফ্যাসিজম অথবা জাতীয় সমাজবাদ আন্দোলন। এই আন্দোলনটিও আমাদের বিপ্লবীরা অনুধাবন করেছেন।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, চীন, রাশিয়া, জার্মানী প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যেসব প্রভাব ভারতে এসেছে সে বিষয়ে আপনাদের কিছু বললাম। আর একটি বিষয়ে এখন বলব তা হল, এইসব প্রভাবে আমাদের কিরকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে, এইসব বৈদেশিক প্রভাব কতটা আমরা গ্রহণ করেছি এবং কতটা বর্জন করেছি।
আমাদের ওপর বৈদেশিক প্রভাবের প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে চাই যে, আমাদের প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান রয়েছে। প্রবীণ প্রজন্মের প্রবক্তা হিসেবে আমি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর নাম উল্লেখ করব। তাঁরা বিগত যুগের প্রতিনিধি এবং তাঁদের চিন্তাভাবনা ও আমাদের বর্তমান যুগের চিন্তাভাবনার মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।
আপনারা যদি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর রচনাগুলি পড়েন তাহলে দেখবেন পাশ্চাত্যের প্রভাব সম্বন্ধে কী প্রতিক্রিয়া হবে এ নিয়ে বরাবর তাঁদের মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর সম্পর্কে বলতে পারি তিনি এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট সমাধান কখনও দেননি। পাশ্চাত্য চিন্তাধারা গ্রহণের বিষয়ে তাঁরা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তিনি দেশবাসীকে একটা সন্দেহের মধ্যে রেখেছেন। সাধারণভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বিরুদ্ধতার কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে তিনি সব সময় নিজের আদর্শমতো কাজ করেননি। এর কারণ পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনার প্রতি তাঁর গভীর বিরুদ্ধতা বা শত্রুতার অংশীদার তাঁর দেশবাসী ছিলেন না।
হিংসা বা শারীরিক বলপ্রয়োগের বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর কী মনোভাব তা আপনারা সকলে জানেন। কারুর স্বাধীনতা অর্জনের জন্যে অস্ত্রের ব্যবহার কিংবা শত্রুর রক্তপাত তিনি অনুমোদন করেন না। হিংসা বা শারীরিক বলপ্রয়োগ সম্বন্ধে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বৈদেশিক প্রভাব, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের প্রভাবের সঙ্গে নিবিড়ভাবে বিজড়িত।
আমাদের যুগের মানুষ মহাত্মা গান্ধীকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অনুসরণ করেছে কিন্তু অন্যসব প্রশ্নে তাঁর চিন্তাভাবনাকে গ্রহণ করেনি। সেজন্যে মহাত্মা গান্ধীকে বর্তমান প্রজন্মের চিন্তাভাবনার ব্যাখ্যাতা হিসাবে গ্রহণ করলে ভুল হবে।
কতকগুলি দিক থেকে গান্ধী এক জটিল চরিত্র। আমি তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিশ্লেষণ করতে চাই যাতে আপনারা তাঁকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারেন। গান্ধীর মধ্যে দু’টি দিক আছে— রাজনৈতিক নেতা গান্ধী এবং দার্শনিক গান্ধী। আমরা তাঁকে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অনুসরণ করে আসছি কিন্তু আমরা তাঁর দর্শনকে গ্রহণ করিনি।
এখন প্রশ্ন হল, কীভাবে আমরা এই দু’টি দিককে পৃথক করতে পারি। তাঁর দর্শনকে যদি আমরা গ্রহণ না করে থাকি তাহলে কেন তাঁকে অনুসরণ করছি? যদিও গান্ধীর নিজস্ব জীবনদর্শন আছে তবুও তিনি একজন বাস্তববাদী রাজনীতিবিদ এবং সেজন্যে তিনি মানুষের ওপর তাঁর দর্শনচিন্তা চাপিয়ে দেননি। এর ফলে যদিও আমরা আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁকে অনুসরণ করছি তবুও নিজেদের দর্শন অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা আমাদের আছে। যদি গান্ধী তাঁর দর্শন আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন, তাহলে আমরা তাঁকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করতাম না। কিন্তু তিনি তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে তাঁর দর্শনকে পৃথক করে রেখেছেন।
বিগত যুগের প্রতিনিধি এবং ব্যাখ্যাতা হিসাবে আমি রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর উল্লেখ করেছি। এখন তাঁদের দর্শনের তুলনামূলক আলোচনা করা যাক। কয়েকটি বিষয়ে তাঁরা একমত আবার অন্য কতকগুলি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল নেই। যেসব বিষয়ে তাঁরা একমত তার মধ্যে প্রথমটি হল, তাঁরা উভয়েই চান অস্ত্রব্যবহার না করেই জাতীয় সংগ্রাম পরিচালিত হোক। অর্থাৎ বলপ্রয়োগের প্রশ্নে তাঁদের অভিমত অভিন্ন। দেশের শিল্পায়নের প্রশ্নেও তাঁরা একমত। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী উভয়েই আধুনিক শিল্প-সভ্যতার বিরোধী। কিন্তু সংস্কৃতির বিষয়ে তাঁদের অভিমত এক নয়। চিন্তাভাবনা, শিল্পকলা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ বিদেশী প্রভাব গ্রহণে সম্মত। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা এবং পারস্পরিক আদানপ্রদান থাকা দরকার। অন্য কোনও দেশের সংস্কৃতি বা চিন্তাভাবনার প্রতি আমাদের বিরুদ্ধ বা শত্রুতার মনোভাব থাকা উচিত নয়। সংস্কৃতির বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা সমর্থন করেন কিন্তু গান্ধীর সাধারণ মনোভাব বিদেশী প্রভাবের বিপক্ষে। অবশ্য আমাদের মনে রাখতে হবে মহাত্মা গান্ধী তাঁর মতামত কোথাও খুব স্পষ্টভাবে ব্যক্তি করেননি। এই বিষয়ে আমি কেবল তাঁর সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির কথাই বলছি।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের প্রবীণ ও নবীন প্রজন্মের মৌলিক চিন্তাভাবনার মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে। এর দ্বারা কী বোঝাতে চাইছি তার ব্যাখ্যা করব। আগেই বলেছি বিদেশী প্রভাব এবং শিল্প সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের কিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত এই প্রশ্নটি আমাদের পুরনো প্রজন্মের নেতাদের মন আজীবন আলোড়িত করেছে এবং তাদের সব কাজকর্মে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। আমাদের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা নেই। তা না থাকার কারণ শুরুতেই আমরা চাই এক আধুনিক ভারত, যার ভিত্তি অবশ্যই থাকবে অতীতের ওপর। আমরা বিশ্বাস করি না যে, অস্ত্র ব্যবহার বিনা ভারত স্বাধীনতা অর্জন করবে। একবার যদি এরকম মনোভাব, অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের জন্যে অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে, গ্রহণ করা যায় তাহলে অস্ত্রশস্ত্র তৈরির জন্যে আমাদের আধুনিক শিল্পের প্রয়োজন। সেজন্যে আধুনিকীকরণের ওপরেই আমরা দাঁড়াতে চাই। শত্রুর সঙ্গে আধুনিক পদ্ধতিতে আধুনিক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে এবং এজন্যে আধুনিক শিল্প অবশ্যই চাই। পুরনো নেতৃত্বের কাছে যা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা তা আমাদের প্রথম ধাপ। আধুনিকতা, বিদেশী প্রভাব বা শিল্পায়ন সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর বর্তমান ভারতের সমস্যা নয়। সমস্যা হল বর্তমান যুগের সমস্যাগুলি কীভাবে সমাধান করা যায়।
আমি বিশ্বাস করি আধুনিক জাপান যেভাবে আমাদের পুরনো যুগকে বুঝতে পারত তার চেয়ে ভালভাবে আমাদের বর্তমান কালকে বুঝতে পারবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় একই। পুরনো সংস্কৃতি ও সভ্যতার ভিত্তির উপরে আমরা একটি আধুনিক জাতি গড়তে চাই। সেজন্যে আমাদের চাই আধুনিক শিল্প, আধুনিক সৈন্যবাহিনী এবং অন্যান্য সব জিনিস যা আধুনিক পরিবেশে আমাদের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা বজায় রাখতে দরকার।
আমাদের প্রজন্মের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে আলোচনার পর এখন কতকগুলি সমস্যার বিশদ আলোচনা করব। বর্তমানে অবশ্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কীভাবে লড়াই করে এই যুদ্ধে জয়লাভ করা যায়। কিন্তু এই সমস্যার কথা আপনারা সংবাদপত্র পাঠ করে এবং রেডিও শুনে অবগত আছেন। আমি এখন স্বাধীন ভারতের কতকগুলি সমস্যা বিচার করব। যে মুহূর্তে ভারত স্বাধীন হবে তখনই সবচেয়ে জরুরি সমস্যা হবে ভবিষ্যতে আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে একটি জাতীয় সৈন্যবাহিনী সংগঠন করা। সেজন্যে আমাদের আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী শিল্প গড়ে তুলতে হবে যাতে আত্মরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র আমরা তৈরি করতে পারি। এর অর্থ হল শিল্পায়নের জন্যে এক বিশাল পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
আত্মরক্ষার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পর পরবর্তী জরুরি সমস্যা হল দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধান। ভারত আজ পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলির অন্যতম কিন্তু ব্রিটিশ শাসনাধীনে আসার আগে আমরা দরিদ্র ছিলাম না। বস্তুত ভারতের সম্পদ ইউরোপের জাতিগুলিকে ভারতের দিকে আকৃষ্ট করেছে। কেউ একথা বলতে পারবে না যে জাতীয় ধন-সম্পদের দিক থেকে ভারত দরিদ্র। প্রাকৃতিক সম্পদে আমরা ধনী কিন্তু ব্রিটিশ এবং বিদেশী শোষণের ফলে দেশ দরিদ্র হয়েছে। সেজন্যে আমাদের দ্বিতীয় জরুরি সমস্যা হল, ভারতে কীভাবে এই লক্ষ লক্ষ বেকারকে কাজ দেওয়া যায় এবং কীভাবে ভারতীয় জনগণের ভয়াবহ দারিদ্র্য মোচন করা যায়।
স্বাধীন ভারতের তৃতীয় সমস্যা হবে শিক্ষার সমস্যা। বর্তমানে ব্রিটিশ শাসনে জনগণের শতকরা নব্বই জনই নিরক্ষর। আমাদের সমস্যা হবে যতদূর সম্ভব শীঘ্র ভারতীয় জনগণকে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা এবং সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে উচ্চতর শিক্ষার অধিকতর সুযোগ দেওয়া।
শিক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে ভারতের পক্ষে গুরুতর আর একটি সমস্যা জড়িত আছে। সেটি হল বর্ণলিপি সমস্যা। ভারতে মুখ্যত দু’ ধরনের লিপি প্রচলিত আছে। একটি সংস্কৃত (বা নাগরী) লিপি, অন্যটি আরবিক (বা পারসীক) লিপি। এতদিন পর্যন্ত সমস্ত জাতীয় কাজকর্মে এবং সভাসমিতিতে আমরা এই দু’টি লিপিই ব্যবহার করে আসছি। আরও বলি, কতকগুলি প্রদেশে কয়েক প্রকার লিপির প্রচলন আছে যেগুলি সংস্কৃত লিপিরই রূপান্তর। কিন্তু মূলত লিপি দু’ প্রকার এবং সমস্ত জাতীয় কাজে এবং সভাসমিতিতে আমাদের এই দুটি লিপিই ব্যবহার করতে হয়।
ল্যাটিন লিপির সাহায্যে এই লিপি সমস্যা সমাধানের জন্যে একটি আন্দোলন চলেছে। আমি নিজে ল্যাটিন লিপির সমর্থক। যেহেতু আমাদের আধুনিক পৃথিবীতে বাস করতে হবে সেজন্যে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হবে এবং আমরা পছন্দ করি আর নাই করি, আমাদের ল্যাটিন লিপি শিখতে হবে। সারা দেশে লেখার মাধ্যম হিসাবে আমরা যদি ল্যাটিন লিপি ব্যবহার করতে পারি তাহলে আমাদের এই সমস্যার সমাধান হবে। যা হোক, এটা আমার নিজস্ব মত এবং আমার নিকটতম বন্ধু ও সহযোগীদের মত।
স্বাধীন ভারতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা আমি উল্লেখ করেছি: জাতীয় প্রতিরক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জনগণকে শিক্ষাদান। এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান যদি করতে হয় তাহলে আমাদের কী করা উচিত? সমস্যাগুলির সমাধানের দায়িত্ব কী ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দেওয়া হবে, না রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে?
বর্তমানে ভারতের জনমত হল, এইসব জাতীয় সমস্যা, বিশেষত অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমরা যদি দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যার সমাধানের বিষয়টি ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর ছেড়ে দিই, তবে সমাধান করতে সম্ভবত কয়েক শতাব্দী লাগবে। সেজন্যে ভারতের জনমত কোনও প্রকার সমাজবাদী পন্থার পক্ষে, যে পন্থায় কোনও ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর দায়িত্ব না দিয়ে রাষ্ট্রই অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। দেশের শিল্পায়নের প্রশ্নেই হোক কিংবা কৃষির আধুনিকীকরণের প্রশ্নেই হোক, আমরা চাই রাষ্ট্র এগিয়ে এসে দায়িত্ব গ্রহণ করুক এবং অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কারমূলক কাজ করুক যাতে ভারতের মানুষ অল্প দিনেই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের জন্যে আমরা নিজস্ব ধারায় কাজ করতে চাই। আমরা স্বভাবতই অন্যান্য দেশের পরীক্ষাগুলি বিচার করে দেখব কিন্তু কার্যত ভারতীয় পন্থায় এবং ভারতের পারিপার্শ্বিক অবস্থা অনুসারে আমাদের সমাধান করতে হবে। সেজন্যে শেষপর্যন্ত যে পদ্ধতি আমরা গ্রহণ করব তা হবে ভারতীয়দের প্রয়োজনের উপযোগী এক ভারতীয় পদ্ধতি।
ভারতের জনগণের—যাদের অধিকাংশই হল দরিদ্র—স্বার্থে যদি আমরা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করি তাহলে বর্তমান কালে চীনে যে বিভ্রান্তি এবং জটিলতা আমাদের চোখে পড়ে সেই রকম অবস্থা আমরা সৃষ্টি করব। এখন চীনে আপনারা দেখছেন কুয়োমিনটাং ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এরকম ঘটার কোনও কারণ খুঁজে পাই না। যদি কুয়োমিনটাং দলের মনে চীনা জনগণের স্বার্থের কথা বিরাজ করে তাহলে বিদেশী প্রভাবের অধীন কমিউনিস্ট পার্টির মতো একটি পৃথক দলের প্রয়োজন থাকা উচিত নয়।
অভিজ্ঞতার ফলে যা শিখেছি তাতে চীন যা ভুল করেছে সে রকম ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে আমরা চাই না। আজ আমরা বাস্তবে দেখছি আমাদের যুগে যেহেতু আমাদের জাতীয় আন্দোলন জনগণের অর্থাৎ শ্রমিক ও কৃষকদের, যারা সংখ্যায় জনগণের ৯০ শতাংশেরও বেশি, স্বার্থের সঙ্গে একাত্ম হয়েছে এবং যেহেতু তাদের স্বার্থ আমাদের মনে বিরাজ করছে, সেজন্যে কমিউনিস্ট পার্টির মতো একটি পৃথক দলের অস্তিত্বের কোনও প্রয়োজন নেই। যদি ভারতের জাতীয়তাবাদীদের অন্তরে জনগণের স্বার্থ বিরাজ না করত তাহলে চীনে যা ঘটছে দেখছেন ভারতেও সেই একই ব্যাপার দেখতেন।
এবার আসি অন্য প্রশ্নে—অর্থাৎ রাষ্ট্রপদ্ধতি বা সরকার। যদি আমরা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো চাই তাহলে আমাদের রাষ্ট্রপদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যাতে সেই অর্থনৈতিক কার্যসূচী সম্ভাব্য শ্রেষ্ঠ উপায়ে রূপায়িত করা যায়। সমাজবাদের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সংস্কার করতে হলে তথাকথিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তা করা চলবে না। সেজন্যে আমাদের চাই একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি-কর্তৃত্বমূলক ধরনের একটি রাষ্ট্র।
ভারতের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা আছে এবং ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আমেরিকা প্রভৃতি অন্যান্য দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির কাজকর্মও আমরা অনুধাবন করেছি। এতে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির দ্বারা আমরা স্বাধীন ভারতের সমস্যার সমাধান করতে পারব না। সেজন্যে ভারতের আধুনিক প্রগতিশীল চিন্তাধারা একটি কর্তৃত্বমূলক রাষ্ট্র গঠনের অনুকূলে। এই রাষ্ট্র জনগণের মুখপাত্র বা জনগণের সেবক হিসাবে কাজ করবে, কোনও গোষ্ঠী বা কিছু ধনী ব্যক্তির জন্যে নয়।
স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র-কাঠামো সম্বন্ধে এই হল আমাদের ধারণা। আমরা অবশ্যই এমন এক সরকার চাই যা মানুষের সেবক রূপে কাজ করবে এবং যার হাতে স্বাধীন ভারতের শিল্প, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নতুন সংস্কার সাধন করার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে।
পরবর্তী সমস্যার কথা বলার আগে আমি আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। তা হল ধর্ম ও জাতিভেদ সম্পর্কে স্বাধীন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি। এই প্রশ্নটি প্রায়ই জিজ্ঞাসা করা হয়ে থাকে। ভারতে অনেকগুলি ধৰ্ম আছে। সেজন্যে স্বাধীন ভারতের সরকারকে সমস্ত ধর্ম সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে এবং প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পছন্দমত কোনও ধর্মমত অনুসরণ ও প্রচারের অধিকার দিতে হবে।
জাতিভেদ সম্পর্কে এখন আমাদের কোনও সমস্যা নেই কারণ জাতি বলতে পূর্বে যা প্রচলিত ছিল আজ আর তা নেই। জাতিভেদ প্রথা কী? জাতিভেদ প্রথা বলতে বোঝায় বৃত্তি বা পেশার ভিত্তিতে বিভক্ত কয়েকটি গোষ্ঠী এবং নিজ নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ।
বর্তমান ভারতে এরকম জাতিগত বৈষম্য নেই। এক বর্ণের লোক যে-কোনও বৃত্তি গ্রহণ করতে পারে। সুতরাং সেই পুরনো অর্থে জাতির অস্তিত্ব নেই। এরপর আছে বিবাহের প্রশ্ন। অতীতে নিজের বর্ণের মধ্যেই বিবাহ করার প্রথা ছিল। এখন বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বিনাবাধায় বিবাহ ঘটছে। অতএব বর্ণভেদ দ্রুত অবলুপ্ত হচ্ছে। বস্তুত জাতীয় আন্দোলনের সময় কোন ব্যক্তির কী জাত, আমরা জিজ্ঞাসা করি না। এমনকি আমাদের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীর জাত আমরা জানি না। এতেই প্রমাণ হয় যে বর্তমান প্রজন্মের মানুষ জাতিভেদ নিয়ে আদৌ ভাবে না। সেজন্যে স্বাধীন ভারতে জাতিভেদ কোনও সমস্যা হবে না।
এই প্রসঙ্গে আমি আপনাদের বলতে চাই যে, ব্রিটিশেরাই সারা পৃথিবীতে এই ধারণার সৃষ্টি করেছে যে আমরা পরস্পরের মধ্যে বিবাদ করি, বিশেষভাবে ধর্ম নিয়ে। কিন্তু ভারত সম্পর্কে তা একটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছবি। ভারতবাসীদের মধ্যে কিছু কিছু বিভেদ থাকতে পারে কিন্তু এই ধরনের বিভেদ আপনারা প্রত্যেকটি দেশেই দেখতে পাবেন। যদি আমরা বর্তমান যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে ফ্রান্স অথবা হিটলার বা তাঁর দলের ক্ষমতা দখলের পূর্বে জার্মানী ইত্যাদি পৃথিবীর তথাকথিত প্রগতিশীল দেশগুলির কথা মনে করি তাহলে দেখব সেসব দেশেও জনসাধারণের মধ্যে তীব্র বিভেদ ছিল। স্পেনেও তো এক বড় ধরনের গৃহযুদ্ধ ঘটে গেল।
কিন্তু একথা কখনও কেউ বলে না যে, যেহেতু এসব দেশে জনগণের মধ্যে বিবাদ ও বিভেদ আছে সেজন্যে তারা নিজেদের শাসন করতে যোগ্য নয়। কেবলমাত্র ভারতের ক্ষেত্রেই ব্রিটিশেরা বলে থাকে ভারতবাসীদের কিছু বিভেদ থাকায় তারা স্বাধীনতা লাভের উপযুক্ত নয়। তা ছাড়া সত্য ঘটনা হল ভারতীয় জনগণের মধ্যে যা-কিছু বিভেদ আছে তা বেশির ভাগ ব্রিটিশ সরকারের সৃষ্টি। শত শত উদাহরণ দিয়ে আপনাদের দেখানো যায় যে, সমগ্র ব্রিটিশশাসন কালে ভারতীয়দের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্যে ব্রিটিশেরা সম্ভাব্য সব রকম পদ্ধতি প্রয়োগ করেছে। ভারতীয়দের মধ্যে কৃত্রিম বিভেদসৃষ্টির এত প্রচেষ্টার পর এখন তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে বলছে যে আমরা স্বাধীন হবার উপযুক্ত নই।
আমি আরও বলতে চাই যে আপনারা সোভিয়েট ইউনিয়নের মতো একটি আধুনিক রাষ্ট্রের কথা বিচার করলে দেখবেন কত বিভিন্ন প্রকার উপাদান নিয়ে সেই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। বুঝতে পারবেন যদি এই রকম একটি উপাদান সত্ত্বেও কত বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন জাতিকে এক রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে এনে ঐক্যবদ্ধ করা যায় এবং সে দেশ একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয় তাহলে ভারত, যার অধিবাসীরা সোভিয়েট ইউনিয়নের অধিবাসীদের চেয়েও সম-প্রকৃতির, কেন একটি জাতি হিসাবে সংহত হবে না তার অবশ্যই কোনও কারণ থাকতে পারে না। বস্তুত আপনারা দেখবেন ভারতের বাইরে যেখানে কোনও ব্রিটিশ প্রভাব নেই সেখানে ভারতীয়দের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। পূর্ব এশিয়ায় ভারতের মুক্তি আন্দোলনে এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে ধর্ম, জাতি বা শ্রেণীর কোনও প্রশ্ন নেই। একমাত্র ভারতে যেখানে ব্রিটিশ প্রভাব ও অধিকার আছে সেখানেই এইসব বিভেদ লক্ষ্য করবেন।
জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে আমি আপনাদের বন্ধুভাবে সাবধান করে দিতে চাই যে ব্রিটিশ প্রচার পৃথিবীতে এমন ধারণা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করেছে যে, ভারতীয় মুসলমানেরা স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করেন না। এটা ভুল। আপনারা প্রায়ই সংবাদপত্রে মুসলিম লীগ বা হিন্দু মহাসভার মতো কোনও কোনও সংগঠনের কথা পড়ে থাকবেন। ব্রিটিশেরা এই সংগঠনগুলিকে সহায়তা করে থাকে কারণ এদের নীতি ব্রিটিশ-ঘেঁষা এবং এরা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিপক্ষে। ব্রিটিশেরা দেখাতে চেয়ে যে মুসলিম লীগই ভারতের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তা হল ব্রিটিশ প্রচার। সত্য ঘটনা এই যে, মুসলিম লীগ ও তার নেতা মিঃ জিন্না ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের এক সংখ্যালঘু অংশের প্রতিনিধি। ভারতের মুসলমানদের অধিকাংশই জাতীয়তাবাদী এবং তাঁরা অন্য যে-কোনও ব্যক্তির মতো স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করেন। জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি একজন মুসলমান এবং কংগ্রেসের অনেক সদস্য মুসলমান। এঁদের অনেকে আজ কারায় বন্দী।
এই তথ্যগুলি বাইরের জগৎ জানে না। বাইরের জগতের এই ধারণা হয়েছে যে মিঃ জিন্না সমস্ত ভারতীয় মুসলমানের প্রতিনিধি এবং তাঁরা জাতীয় আন্দোলন সমর্থন করেন না। সেজন্যে ব্রিটিশ প্রচার সম্পর্কে আমি আপনাদের সতর্ক করে দিতে চাই।
স্বাধীন ভারতে আমরা কী ধরনের অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ করতে চাই সে বিষয়ে আমি পূর্বেই আপনাদের বলেছি। এ থেকে একটি সমস্যা দেখা দিতে পারে, তা হল আমাদের রাজনৈতিক দর্শন কী। এ বিষয়ে আমার মতামত দশ বছর আগে লেখা আমার ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে বিবৃত করেছি। ভারতে আমাদের দায়িত্ব হল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত পদ্ধতিগুলির সমন্বয় করে একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একদিকে ফ্যাসিবাদ [কিংবা যাকে আপনারা জাতীয় সমাজবাদ (National Socialism)] বলতে পারেন ও অন্যদিকে কমিউনিজমের মধ্যে দ্বন্দ্বে, আমি বুঝতে পারি না কেন উভয় পদ্ধতির ভাল দিকগুলি নিয়ে দুয়ের একটি সমন্বয় গড়ে তোলা যাবে না। যে কোনও একটি পদ্ধতি মানুষের অগ্রগতির শেষ পর্যায়, কারুর পক্ষে এমন কথা বলা বোকামি। দর্শনের ছাত্র হিসাবে আপনারা স্বীকার করবেন যে, মানুষের অগ্রগতি কখনও থেমে থাকতে পারে না এবং পৃথিবীর অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। সেজন্যে ভারতে আমরা বিরোধী পদ্ধতিগুলির সমন্বয় এবং তাতে দু’টিরই ভাল দিক অন্তর্ভুক্ত করতে চেষ্টা করব।
এখন আমি ন্যাশনাল সোস্যালিজম এবং কমিউনিজমের কতকগুলি ভাল দিকের তুলনা করতে চাই। আপনারা দেখবেন উভয়ের মধ্যে কতকগুলি একই বিষয় আছে। উভয়কেই গণতন্ত্র-বিরোধী বা একনায়কতন্ত্রী বলা হয়। উভয়েই ধনতন্ত্র-বিরোধী। এরকম মিল সত্ত্বেও অন্যান্য বিষয়ে এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বর্তমান ইউরোপে ন্যাশনাল সোস্যালিজমের দিকে তাকালে আমরা কী দেখব? ন্যাশনাল সোস্যালিজম জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সাধনে এবং জনগণের অবস্থার উন্নতি বিধানে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু তা ধনতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমানের অর্থনৈতিক পদ্ধতির আমূল সংস্কার সাধন করতে সক্ষম হয়নি।
অন্যদিকে কমিউনিজমের ভিত্তিতে গঠিত সোভিয়েট পদ্ধতি বিবেচনা করা যাক। আপনারা এতে এক বিরাট সাফল্য লক্ষ্য করবেন, তা হল পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। কমিউনিজমের দুর্বলতা হল এখানে যে তা জাতীয় প্রবণতার কোনও মূল্য দেয় না। আমরা ভারতে চাই একটি প্রগতিশীল পদ্ধতি যা সমস্ত মানুষের সামাজিক প্রয়োজন মেটাবে এবং যা জাতীয় মনোভাবের ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে। অন্য কথায় তা হবে জাতীয়তাবাদ ও সমাজবাদের সমন্বয়। এখনকার জার্মানীর ন্যাশনাল সোস্যালিস্টরা এ জিনিসটি অর্জন করতে পারেনি।
কতকগুলি বিষয়ে ভারত রাশিয়াকে অনুসরণ করবে না। প্রথমত, শ্রেণী-সংগ্রাম এমন একটি জিনিস ভারতে যার কোনও প্রয়োজন নেই। যদি জনগণের মুখপাত্র হিসাবে স্বাধীন ভারতের সরকার কাজ করে তাহলে শ্রেণী-সংঘর্ষের প্রয়োজন দেখা দেবে না। জনতার সেবকরূপে রাষ্ট্রকে সংগঠিত করে আমরা আমাদের সমস্যাগুলির সমাধান করতে পারি।
আর একটি বিষয়ে সোভিয়েট রাশিয়া অত্যধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে, সেটি হল শ্রমিক সমস্যা। ভারত প্রধানত কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় কৃষকদের সমস্যা শ্রমিকশ্রেণীর সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে।
আর একটি বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ একমত হতে পারি না। তা হল মার্কসবাদে মানুষের জীবনের আর্থিক দিকটির ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমরা আর্থিক দিকের গুরুত্ব সম্পূর্ণ উপলব্ধি করি। পূর্বে তা অবহেলা করা হয়েছে কিন্তু তার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই।
আর একবার পুনরাবৃত্তি করে বলি, আমাদের রাজনৈতিক দর্শন হবে ন্যাশনাল সোস্যালিজম ও কমিউনিজমের সমন্বয়। ‘থিসিস’ ও ‘অ্যান্টিথিসিসে’র দ্বন্দ্ব উচ্চতর সমন্বয়ের মাধ্যমে মীমাংসা করতে হবে। দ্বন্দ্ববাদের সূত্র (Law of Dialectics) এরকমই বলে। যদি তা না করা হয় তাহলে মানুষের অগ্রগতি শেষ হয়ে যাবে। ভারত সেজন্যে রাষ্ট্রনৈতিক এবং সামাজিক বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে অগ্রসর হবার চেষ্টা করবে। আমার বক্তৃতার শেষ বিষয়টি এবার আমি আলোচনা করব। এটি হল আন্তর্জাতিক সংগঠন সম্বন্ধে আমাদের ধারণা। এই বিষয়ে টোকিওতে আমি কয়েকবার বলেছি। স্বাধীনতা, ন্যায় এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পূর্ব এশিয়ায় একটি নতুন সংগঠন করার জন্যে যৌথ-বিবৃতির (Joint Declaration) মাধ্যমে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা আমি পূর্ণ সমর্থন করি। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তালাভের জন্যে কতকগুলি দেশে আমি কাজ করেছি এবং এই সূত্রে লীগ অব নেশনসের কাজকর্ম সম্পর্কে জানবার সুযোগ আমার হয়েছিল। এজন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে খুব আগ্রহী।
লীগ অব নেশনসের পরীক্ষা বিফল হয়েছে; এবং তা কেন বিফল হয়েছে সে বিষয়ে অনুসন্ধান করা কাম্য এবং লাভজনক। এর উত্তর দিতে হলে আমি বলব তার বিফল হবার কারণ এই যে, সংগঠক রাষ্ট্রগুলি ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর এবং অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এই সংগঠক দেশগুলি হল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা। আমেরিকা লীগ থেকে বেরিয়ে যায়, সেজন্যে যে শক্তিগুলি লীগ পরিচালনা করে তারা হল ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। এখন এই দুই প্রধান শক্তি নিঃস্বার্থ কাজের উদাহরণ স্থাপন না করে লীগকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এবং নিজেদের উপকারের জন্যে কাজে লাগাল। স্বাধীনতা, ন্যায় এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই কেবলমাত্র একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন আমরা গড়ে তুলতে পারি। সেজন্যে পূর্ব এশিয়ায় সঠিকভাবে এবং সঠিক ভিত্তিতে কাজ আরম্ভ হয়েছে। আমাদের কাজ হল যৌথ-বিবৃতিতে সন্নিবিষ্ট নীতিগুলি কাজে রূপায়িত হচ্ছে কি না সেদিকে কেবল লক্ষ্য রাখা। যদি এই নীতিগুলি কাজে রূপায়িত করা যায় তাহলে পরীক্ষা সফল হবে। যদি তা না হয়। পুনরায় তা ব্যর্থতাই প্রমাণ করবে।
আমার বক্তৃতায় এবং সংবাদপত্রের বিবৃতিতে আপনারা অবশ্য দেখে থাকবেন যে, এই যৌথ-বিবৃতির বিষয়ে আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। এর অনেকগুলি কারণ আছে। প্রথমত, সঠিক ভিত্তিতে এবং সঠিক পথে কাজ আরম্ভ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যদি আপনারা একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তুলতে চান তাহলে কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলে কাজ আরম্ভ করতে হবে। যদি আমরা একটি অঞ্চলে তা সফল করে তুলতে পারি তাহলে সারা পৃথিবীতে ক্রমশ তা বিস্তৃতিলাভ করবে।
শূন্য থেকে হঠাৎ কোনও আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং তাকে সফল করা কঠিন। কিন্তু যদি একটি অঞ্চলে কাজ আরম্ভ করে সেখানে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক আদান-প্রদান গড়ে তোলা যায় এবং সেখানে তা সফল হয় তাহলে সেই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অন্যান্য অংশের রাষ্ট্রগুলি অনুকরণ করতে পারে। সেজন্যে একটি আঞ্চলিক সংগঠন গড়ে তোলাই হল একমাত্র উপায় যা থেকে ক্রমশ এক আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে উঠতে পারে।
তৃতীয় কারণ হল, আমি দেখেছি যে এরূপ ধারণা বা পরিকল্পনার প্রতি দেশের জনগণের, বিশেষত যুবকদের সমর্থন রয়েছে। যদি দেখতাম এই নতুন সংগঠন অল্প কয়েকজন রাজনীতিবিদ বা নেতা প্রবর্তন করেছেন এবং বাকি লোকেরা উদাসীন বা ঔৎসুক্যহীন তাহলে নিশ্চয়ই আমার পক্ষে আশাবাদী হওয়া উচিত হত না। কিন্তু যেহেতু আমি দেখেছি যে সমগ্র জাতি, এবং বিশেষ করে যুবসমাজ এ বিষয়ে অত্যন্ত আগ্রহী এবং উৎসাহী সমর্থক, সেজন্যে আমি বিশ্বাস করি নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং যুবসমাজের সহযোগিতায় তাকে সফল করে তোলা যাবে।
আমি পুনরায় বলতে চাই এই বিষয়টি এ দেশের সরকার এবং জনগণের পক্ষে বিরাট দায়িত্বপূর্ণ কাজ। আপনারা জানেন আপনাদের সরকার এই পরিকল্পনাটি প্রবর্তন করেছেন। কাজেই আপনারা হলেন প্রবর্তক রাষ্ট্র। এই পরীক্ষায় সাফল্য নির্ভর করে প্রবর্তক রাষ্ট্রের প্রদর্শিত দৃষ্টান্তের ওপর। লীগ অব নেশনসের ব্যর্থতার কারণ প্রবর্তক রাষ্ট্রগুলি ছিল স্বার্থপর এবং অদূরদর্শী। এবার যে, রাষ্ট্রগুলি একত্রিত হয়েছে তারা এবং বিশেষ করে প্রবর্তক রাষ্ট্রগুলি যদি স্বার্থপর ও অদূরদর্শী নীতি পরিহার করে এবং নৈতিক ভিত্তিতে কাজ করে তাহলে এই পরীক্ষা সফল না হবার কোনও কারণ দেখি না।
প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্র রূপে যোগ দিয়ে জাপান এই কাজে যে বিরাট দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সেই বিষয়টি আমি বিশেষ জোর দিয়ে বলতে চাই। আর আমি যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বের কথা বলি তখন যুবকদের দায়িত্বের ওপরেও গুরুত্ব দিতে চাই। আজকের যুবকেরা আগামী দিনের জাতি ও নেতা হবেন। একটি চিন্তা যুবকেরা স্বাগত এবং সমর্থন করলে একদিন তা সমগ্র জাতি সমর্থন করে। কিন্তু যে চিন্তা যুবকেরা সমর্থন করে না স্বাভাবিকভাবেই তার মৃত্যু ঘটবে। সেজন্যে একটি নতুন সংগঠন সফল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব শেষপর্যন্ত এই দেশের যুবকদের ওপরেই বর্তায়। আমি আশা করি, প্রার্থনা এবং বিশ্বাস করি যে যুবক ও ছাত্রবৃন্দ, যাঁরা জাতির ভবিষ্যৎ, তাঁরা এই নতুন সংগঠন প্রবর্তন করে জাপান যে গুরু নৈতিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে তা উপলব্ধি করবেন।
একটি জাতি এক উচ্চ নৈতিক স্তরে উঠতে পারে কি না এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও নিঃস্বার্থ হয়ে নতুন সংগঠন গড়ে তুলতে পারে কি না, এ বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। মানবজাতির প্রতি আমার প্রগাঢ় বিশ্বাস আছে। যদি একজন ব্যক্তির পক্ষে নিঃস্বার্থ হওয়া সম্ভব হয়, যদি উচ্চ নৈতিক মানে তার পক্ষে জীবনযাপন সম্ভব হয়, তাহলে সমগ্র জাতিও কেন সেই স্তরে উঠতে পারবে না তা বুঝতে পারি না। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখেছি যেখানে একটি বিপ্লব সমগ্র জাতির মনোভাব বদল করে তাকে এক উচ্চ নৈতিক স্তরে তুলে দিয়েছে। সেজন্যে সমগ্র একটি জাতি সেই স্তরে উঠতে পারে কি না সে বিষয়ে যদি কারও কোনও সন্দেহ থাকে, তাহলে আমি সেই সন্দেহের অংশীদার হতে পারি না।
পরিশেষে আমি আবার বলি, যে, বিরাট দায়িত্বভার সে গ্রহণ করেছে তার কথা প্রতিষ্ঠাতা-রাষ্ট্র যেন অনুভব করে। এই কাজটি শুধু নেতৃবৃন্দ বা রাজনীতিবিদদের নয়, এ কাজ সমগ্র জাতির বিশেষ করে যাঁরা জাতির আশা-ভরসা—সেই যুবক ও ছাত্রবৃন্দের।
টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং ছাত্রদের নিকট বক্তৃতা, নভেম্বর ১৯৪৪।