ব্যক্তি, জাতি এবং আদর্শ
চুঁচুড়ায় হুগলি জেলা ছাত্ৰসম্মেলনে প্রদত্ত বক্তৃতা, রবিবার, ২২ জুলাই, ১৯২৯
অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মহাশয় এবং ছাত্রবৃন্দ,
আজকের এই ছাত্ৰসম্মেলনে আমাকে কেন ডেকেছেন তা আপনারাই ভাল জানেন। কিন্তু নিজের সম্পর্কে আমি বলতে পারি যে, আমি নিজেকে এখনও আপনাদের মতো ছাত্র মনে করি বলেই আজকের এই সম্মেলনে আসবার ব্যগ্রতা, বরং সাহস বলাই ঠিক, অনুভব করেছি। আমি যত্নসহকারে “জীবনের বেদ” পড়ি এবং বর্তমান মুহূর্তে আমি বাস্তব জীবনে অভিজ্ঞতার কঠিন আঘাতে মানুষ যে-জ্ঞান লাভ করে সেই জ্ঞান আহরণে নিযুক্ত।
প্রত্যেক জাতি অথবা ব্যক্তির নিজস্ব বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য অথবা আদর্শ আছে। সেই আদর্শ অনুযায়ী সে নিজের জীবনকে রূপ দেয়। যথাসম্ভব পরিপূর্ণরূপে সেই আদর্শ অর্জন করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, এবং এই আদর্শ বাদ দিলে তার জীবন সম্পূর্ণরূপে অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন আদর্শের অনুসরণ দীর্ঘকাল ধরে চলে, তেমনই জাতির ক্ষেত্রেও এই অনুসরণ চলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। এই জন্যই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা বলেন যে, আদর্শ একটি প্রাণহীন এবং গতিহীন সত্তা নয়। এর আছে গতি, চলচ্ছক্তি এবং জীবনদায়ী শক্তি।
বিগত এক শত বছর ধরে যে-আদর্শ আমাদের সমাজে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করছে আমরা সর্বদা তার একটি ঝলকও দেখতে সফল না হতে পারি, কিন্তু যিনি চিন্তাশীল এবং প্রকৃত অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী, তিনি অবশ্যই সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অন্তরালে নিয়তপ্রবাহিত অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো এই আদর্শের সাধারণ প্রবণতাটি আবিষ্কার করতে পারেন। এবং এই আদর্শই যুগভাবনার আধার। কোনও মানুষ যখন এই আদর্শ পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করে, সে সহজেই তাঁর লক্ষ্য এবং যাত্রাপথে তাঁর দিশারি খুঁজে পায়। কিন্তু যেহেতু এই উপলব্ধি সর্বদা আমাদের কাছে আসে না, আমরা প্রায়ই ভ্রান্ত আদর্শের পিছনে ছুটি এবং ভণ্ড গুরুর অনুসরণ করি। ছাত্রবৃন্দ, আপনারা যদি সত্যই কোনও উদ্দেশ্যের জন্য নিজেদের জীবনকে রূপ দিতে চান, তা হলে ভণ্ড পথপ্রদর্শক এবং ভ্রান্ত আদর্শের প্রভাব থেকে সর্বপ্রকারে নিজেদের রক্ষা করুন এবং নিজেদের জীবনের আদর্শকে নিজেরাই পাকাপাকিভাবে বেছে নিন।
যে-আদর্শ বাংলার ছাত্রসমাজকে অনুপ্রাণিত করত, ধরা যাক পনেরো বছর আগে, তা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ। সেই গৌরবজনক আদর্শের মোহময় প্রভাবে বাঙালি যুবকরা স্বার্থপরতা এবং নীচতার কলুষমুক্ত, পবিত্র এবং আধ্যাত্মিক শক্তিতে পূর্ণ এক জীবনের দিকে দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। সমাজ এবং জাতি গঠনের মূলে আছে ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এই কারণেই স্বামী বিবেকানন্দ “মানুষ গড়া” তাঁর ব্রত, এই কথার পুনরাবৃত্তিতে কখনও ক্লান্ত হননি।
আমাদের দেশে বিবেকানন্দের যুগ শুরু হওয়ার আগে রাজা রামমোহন ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। রামমোহনের যুগ থেকে পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার আকাঙক্ষা সর্বপ্রকার আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে, এবং উনবিংশ শতকের শেষ দশকে এবং বিশ শতকের প্রথম দশকে স্বামী বিবেকানন্দের হৃদয় আলোড়নকারী বাণী—“স্বাধীনতা, স্বাধীনতাই আত্মার সঙ্গীত” —স্বদেশীর হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার বিদীর্ণ করে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে এগিয়ে এল এবং সমগ্র দেশ তা আঁকড়ে ধরে প্রায় উন্মাদ হয়ে উঠল।
স্বামী বিবেকানন্দ এক দিকে তাঁর স্বদেশবাসীকে সাহসের সঙ্গে আহ্বান করেছিলেন সর্বপ্রকার শৃঙ্খল ভেঙে প্রকৃত অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে এবং অপর দিকে, তিনি সকল ধর্ম এবং সম্প্রদায়ের অপরিহার্য ঐক্যের বাণী প্রচার করে প্রকৃত জাতীয়তাবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দের মধ্যে আমরা স্বাধীনতার যে পরিপূর্ণ এবং সার্বিক ভাবমূর্তি দেখতে পাই, তাঁর সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখনও তার প্রতিফলন হয়নি। এবং অরবিন্দ যখন তাঁর ‘বন্দেমাতরম্’ পত্রিকায় লিখলেন—“আমরা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণমুক্ত পূর্ণ স্বরাজ চাই”—স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালি যুবকরা তখন অনুভব করলেন যে, অবশেষে তাঁরা তাঁদের মনের মত লোকটিকে পেয়েছেন।
এইরূপে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রেরণা লাভ করে বাঙালিরা পথের সব বাধাবিঘ্ন তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছে। এবং ১৯২১ সালে এসে আমরা মহাত্মাজির মুখ থেকে অসহযোগের বাণীর সঙ্গে আরও একটি জিনিস পেলাম : “জনগণ ব্যতীত এবং জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার ক্ষুধা জাগরিত না করা পর্যন্ত স্বরাজ আসতে পারে না।” দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের জীবনে এই ওজস্বিনী বাণী আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তাঁর লাহোর ভাষণে তিনি অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, যে-স্বরাজ তিনি চান তা মুষ্টিমেয় লোকের জন্য নয়, সকলের জন্য, জনগণের জন্য। সর্বভারতীয় শ্রমিক সম্মেলনে তিনি তাঁর দেশবাসীর সামনে “জনগণের জন্য স্বরাজ”-এর আদর্শ তুলে ধরেছিলেন।
দেশবন্ধুর জীবনে আমরা আরও একটি বাণীর উদাহরণ দেখতে পাই। সেই বাণী এই—মানুষের জীবন, জাতির এবং ব্যক্তিরও, এক অপরিবর্তনীয় সত্য। এই জীবনকে পরস্পর থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন দুই বা ততোধিক খণ্ডে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন যখন চেতনায় জাগ্রত হয়, আমরা সকল দিক থেকে এই নব জাগরণের যথেষ্ট প্রমাণ পাই এবং নব জীবনের স্পন্দন চতুর্দিকে অনুভূত হয়। পৃথিবী—এবং সেই হেতু মানুষের জীবন—বৈচিত্র্যে পূর্ণ। এই বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করলে জীবনে পরিপূর্ণতা আসে না; এই কাজ করলে আমরা নিজেদের মৃত্যু অথবা ধ্বংসের কাছেই টেনে নিয়ে যাব। এই জন্যই ব্যক্তি এবং জাতি উভয়েরই বিকাশ ঘটাতে হবে এই বৈচিত্র্যের মাধ্যমে, এই ‘বহু’-র মাধ্যমে।
আধ্যাত্মিক জগতে রামকৃষ্ণ এবং বিবেকানন্দ “এক” এবং “বহু”-র মধ্যে যে-ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, জাতির জীবনে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশবন্ধু তা-ই অর্জন করেছিলেন অথবা অন্তত, অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন। এক কথায় “সাংস্কৃতিক মৈত্রী”-তে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি ভারতের জন্য কেন্দ্রশাসিত রাষ্ট্র অপেক্ষা যুক্তরাষ্ট্র বেশি পছন্দ করতেন।
যে-সার্বিক বিকাশ এবং আত্মসিদ্ধিতে তাঁর এমন দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তা-ই বর্তমান কালের আদর্শ। আমরা যদি এই সাধনাকে ফলবতী করতে চাই, তা হলে প্রথমেই আমাদের মনে স্বাধীনতার এক অখণ্ড কল্পনাকে চাক্ষুষ করতে হবে। কোনও ব্যক্তি তাঁর আদর্শকে অখণ্ড এবং সার্বিকরূপে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে কখনও তিনি জীবনসংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার আশা করতে পারেন না। সেই কারণেই সমগ্র ভারতকে, বিশেষ করে দেশের যুবশক্তিকে, এ-কথা বলার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে যে, আমরা স্বাধীন ভারতের যে-স্বপ্ন দেখেছি সেখানে সবাই মুক্ত—সকল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত।
আজ আমি ছাত্রসমাজকে এই কথা বলতে এখানে এসেছি যে, আমরা যে-যুগে জন্মগ্রহণ করেছি তার ভাবাদর্শ হল পরিপূর্ণ এবং সার্বিক স্বাধীনতা অর্জন। আমাদের দেশবাসী স্বাধীন দেশে এবং মুক্ত পরিবেশে বাঁচতে চায় এবং বেড়ে উঠতে চায়। স্বাধীনতার ভাবাদর্শে আমাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমাদের স্বাধীনতার দাবি ‘ভুল করবার অধিকার’ ছাড়া আর কিছুই নয়। অতএব আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের পরে অরাজকতা আসবে কি আসবে না সেই দুঃস্বপ্নের কল্পনা করে আমাদের মুষড়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। চলুন, নিজেদের উপর অবিচল আস্থা রেখে অনিচ্ছুক হাত থেকে আমাদের জন্মগত অধিকারকে ছিনিয়ে আনতে আমরা এগিয়ে যাই।
আমাদের দেশে তিনটি বৃহৎ সম্প্রদায় এখনও সুপ্ত—এরা হলেন নারী, তথাকথিত অনুন্নত সম্প্রদায় এবং শ্রমিক সম্প্রদায়। চলুন, তাঁদের কাছে গিয়ে বলি : “আপনারাও মানুষ এবং মানুষের সম্পূর্ণ অধিকার আপনারা পাবেন। অতএব উঠে দাঁড়ান, জেগে উঠুন এবং জড়ের মনোভাব পরিত্যাগ করে আপনাদের বৈধ দাবি ছিনিয়ে নিন।”
বাংলার ছাত্র এবং যুবকবৃন্দ, আপনারা সবাই পূর্ণ স্বাধীনতার সমর্থক হোন। আপনারা ভবিষ্যৎ ভারতের উত্তরাধিকারী। সুতরাং সমগ্র জাতিকে পুনর্জাগরিত এবং উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা দলে দলে বাংলার সুদূর গ্রামাঞ্চলে গিয়ে সকলকে সাম্য এবং স্বাধীনতার বাণী শোনান। স্বাধীনতার যে-চিত্রটি আমি এইমাত্র আপনাদের চোখের সামনে তুলে ধরলাম, সেটি আপনারা সমগ্র দেশের সামনে তুলে ধরুন। যথোচিত উৎসাহের সঙ্গে এগিয়ে যান, আপনাদের জয় সুনিশ্চিত। আপনাদের সাধনা সুফল প্রসব করুক—ভারতবর্ষ আবার স্বাধীন হোক—এবং আপনাদের জীবন গৌরব এবং খ্যাতিতে অভিষিক্ত হোক। বন্দেমাতরম্!