আয়ারল্যান্ডের অভিজ্ঞতা
আইরিশ ফ্রি স্টেট পরিদর্শনের অনুমতিদান, যার ফলে আমার দীর্ঘদিনের একটি আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়েছে এবং ডাবলিনে আমার প্রতি তাঁর সাদর এবং আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্যে আমি প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরার কাছে কৃতজ্ঞ। স্বৰ্গত ভি. জে. প্যাটেলের ইচ্ছা এবং আদেশ ছিল স্বদেশে ফেরার পূর্বে আমি যেন ডাবলিন পরিদর্শন করি এবং ইন্ডিয়ান-আইরিশ লীগ, যার প্রতিষ্ঠার জন্যে তিনি সাহায্য করেছিলেন, তার কাজকর্ম পুনরায় চালু করতে চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস আমার আয়ারলান্ড পরিদর্শনের ফলে সেই কাজে সুফল হয়েছে।
আয়ারল্যান্ডে থাকার সময় সে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে সত্যকার পরিচয় জানার জন্যে যতগুলি সম্ভব দল এবং ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেষ্টা করি। আমার বিশ্বাস আমি অনেক কিছু শিখেছি যা ভারতের পক্ষে উপযোগী এবং আকর্ষণীয় হবে।
পার্লামেন্টে (Dail) সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হল প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরার Fianna Fail। এদের সমর্থন করে Mr. Norton-এর নেতৃত্বে লেবার পার্টি। বিরোধী দল হল Mr. Cosgrave-এর ‘Fine Geel’ দল। Mr. Cosgrave-এর দলে অনেক ভাল বক্তা এবং তার্কিক আছেন কিন্তু সমগ্রভাবে দেশ Fianna Fail দলের সমর্থক, কারণ Mr. Cosgrave-এর দলকে ব্রিটিশ দলের পক্ষে বলে মনে করা হয় এবং পুরনো unionist-রা এই দলকে সমর্থন করে। General O’Duffy, যিনি Blue-Shirts সংগঠন করেছেন, দল ত্যাগ করায় Mr. Cosgrave-এর দল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তিনি ফ্যাসিস্ট রীতিতে National Corporate Party প্রতিষ্ঠা করেছেন। এর ফলে দেশে স্বভাবতই Fianna Fail-এর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান আইরিশ রাজনীতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল Fianna Fail ও Republican দলের মধ্যে বিরোধ। রিপাবলিকানরা অভিযোগ করে থাকে যে তাঁর প্রতিশ্রুতিমতো প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরা রিপাবলিক দলের দিকে ঝুঁকছেন না। তাঁর সরকার রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে, পঁচিশ জন রিপাবলিকানকে কারাবন্দী করা হয়েছে। সরকারের মত হল রিপাবলিকানরা বড় অসহিষ্ণু ও তারা কোনও কৌশল জানে না এবং বাস্তব অবস্থা অথাৎ দেশের মধ্যে একটি ব্রিটিশ-সমর্থক দলের উপস্থিতি সম্বন্ধে অন্ধ। আয়ারল্যান্ড বিভক্ত হওয়ায় এখনই রিপাবলিক ঘোষণা করা একেবারে অসম্ভব না হলেও বেশ কষ্টকর। Fianna Fail দলের সদস্যরা তা সমর্থন করে কিন্তু আসল ঘোষণা কতকগুলি বিষয় বা অবস্থার উপর নির্ভর করছে। মোটের উপর, সরকারি দল থেকে স্বতন্ত্র হয়ে রিপাবলিক দলের থাকাটা আমার মতে আশীর্বাদ। Fianna Fail যে কখনই তার প্রজাতন্ত্রী লক্ষ্যের কথা ভুলতে পারবে না, এটা নিশ্চিত; কারণ যদি তা করে তাহলে লোকে তাদের সমর্থন তুলে নেবে। আমি কেবল ইচ্ছা করি Fianna Fail এবং Republicans— এই দু’ দলের মধ্যে আরও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠুক, ১৯৩২ সালে প্রেসিডেন্ট ডি. ভ্যালেরার প্রথম ক্ষমতায় আসার সময় যেমন ছিল। কিন্তু জনগণ এবং মতপার্থক্য উভয়ের মধ্যে একটা বিচ্ছেদের সম্পর্ক শীঘ্রই সৃষ্টি করেছিল।
মিঃ ডি. ভ্যালেরার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করা ছাড়া আমি Fianna Fail মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করি। তাঁরা প্রত্যেকেই ভীষণ সহানুভূতিশীল ও উচ্চমনোভাবাপন্ন। তাঁদের কাছে লোকে সহজেই যেতে পারে। তাঁরা এখনও পর্যন্ত ‘মাননীয়’ পর্যায়ে পৌঁছননি। স্বাধীনতা লাভের লড়াই করার সময় তাঁদের অনেকেই পালিয়ে বেড়াতেন এবং তাঁদের দেখতে পেলে গুলি করা হত। তাঁরা এখনও পর্যন্ত নিয়মসর্বস্ব কঠোর মন্ত্রী হয়ে ওঠেননি এবং চারপাশে কোনও দপ্তরসুলভ বাতাবরণের মধ্যে তাঁরা থাকেন না। ভূমি বিভাগের মন্ত্রীর সঙ্গে আমি আলোচনা করেছিলাম কীভাবে তাঁরা বড় বড় তালুক কিনে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে জমি কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দিচ্ছেন। কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম খাদ্য সরবরাহের বিষয়ে কীভাবে তাঁরা দেশকে স্বনির্ভর করতে চেষ্টা করছেন। জেনেছিলাম যে, এখন অনেক জায়গা জুড়ে গম এবং আখের চাষ হচ্ছে এবং কৃষির উন্নতির জন্যে তাদের আর গো-পালন এবং ইংল্যান্ডের বাজারের ওপর বেশি নির্ভর করতে হয় না। ভারতে পাটচাষের ওপর বাধা আরোপের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তাঁর ওপর এই দায়িত্ব থাকলে কীভাবে তিনি ব্যাপারটি নিষ্পত্তি করতেন সেই মর্মে তিনি আমাকে মূল্যবান মতামত জানিয়েছিলেন। শিল্পমন্ত্রীর সঙ্গে আমি সরকারের শিল্পনীতি বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। তিনি ব্যাখ্যা করে জানিয়েছিলেন তাঁরা কেবল কৃষিতে নয়, শিল্পেও স্বনির্ভর হতে চাইছেন। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটবে এবং ভবিষ্যতে যদি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাতে তাদের অল্পই ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকবে। নতুন কলকারখানা গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে অল্প কয়েক বছরের মধ্যে প্রভূত কাজ করা হয়েছে। শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে সরকার যা করেছেন এবং করে চলেছেন তা প্রশংসনীয় বোধ হলেও আমার মনে হয় শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্যে সরকারের তরফে আরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। মোটের উপর আমি দেখেছি Fianna Fail মন্ত্রিবর্গের কাজকর্ম খুবই প্রশংসনীয় এবং তাঁদের অভিজ্ঞতা, ভারতে রাষ্ট্রের মাধ্যমে যখন জাতিগঠনের কাজ শুরু হবে তখন আমাদের উপকারে লাগবে।
আয়ারল্যান্ডে অনেক কিছু শেখার আছে এবং অল্পদিনই সেখানে ছিলাম। অবাক হয়ে ভাবি, আমার দেশবাসী যারা ইংল্যান্ডে বছরের পর বছর আছেন তাঁদের মধ্যে অতি অল্পজনই ঘরের পাশে আয়ারল্যান্ডে গিয়েছেন। ইংল্যান্ডের চেয়ে আয়ারল্যান্ড এক সম্পূর্ণ ভিন্ন দেশ।
আমি দেখে বেশ বিস্মিত হয়েছি যে বিভিন্ন দলের নিজেদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও সমস্ত আইরিশ দল একইভাবে ভারত এবং ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতিশীল। যখন সেখানে ছিলাম ভারতের হয়ে কিছু প্রচার করে আমি খুশি। কয়েকটি সংবর্ধনা এবং সাধারণ সভায় ভারতের বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে আমাকে বক্তৃতা দিতে বলা হয়েছিল। নিজেদের দেশের বাইরে আইরিশেরা দুটি দেশের বিষয়ে বেশি আগ্রহী—ভারত ও মিশর।
৩০ মার্চ ১৯৩৬
সোমবার ৩০ মার্চ ১৯৩৬ Lausanne-তে আয়ারল্যান্ড সম্পর্কে সুভাষচন্দ্রের বিবৃতি।