দূর প্রাচ্যে জাপানের ভূমিকা
প্রায়ই আমরা দৈনিক সংবাদপত্র খুলে চীন ও জাপানের মধ্যে সংঘর্ষের খবর পড়ি। অতদূরে যা ঘটছে তাতে ভারতে আমাদের আগ্রহ থাকার কথা নয় ভেবে অনেকে সেই খবরগুলি পড়েন না। অন্যেরা নিয়ম-মাফিক সেসব খবর পড়েন। কিন্তু যেসব ঘটনার বিবরণ প্রকাশিত হয় তাদের তাৎপর্য আমাদের মধ্যে ক’জন বুঝতে পারেন জানি না।
যে দ্বীপগুলি জাপানীদের স্বদেশভূমি সেগুলি জনাকীর্ণ। সেগুলিকে প্রায় ৭ কোটি অধিবাসীর ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হয়। তার ফলে অত্যধিক জনসংখ্যা এবং জমির ওপরে খুব বেশি চাপ পড়েছে। সেখানেই কষ্টের শেষ নয়। জাপানীদের প্রজননশীলতা খুব বেশি এবং লাফে লাফে তাদের জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে। চীনে প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা ১০০ জন আর জাপানে তা ৩১৩ জন। এ ছাড়া, জাপানের জন্মহার ব্রিটেনের তুলনায় দু’গুণ। সেজন্যে জাপান তার সন্তানদের বসবাসের জন্যে আরও স্থান চায়, ক্রমবর্ধমান শিল্পের জন্যে চায় আরও বেশি কাঁচামাল এবং উৎপন্ন পণ্যের জন্যে আরও বেশি বাজার। কেউ তাকে এই তিনটি উপহার দেবে না, সেজন্যে বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেওয়া। জাপানের পক্ষে আর একটি সমাধান হল জন্মনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনসংখ্যা সীমিত করা এবং নিজের সংস্থান অনুসারে দিনযাপন করা কিন্তু স্পষ্টতই এই সমাধান তার পছন্দ নয়। সংক্ষেপে এই হল জাপানের সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের কারণ।
চীন, রাশিয়া, ব্রিটিশ বা আমেরিকার প্রতিরোধের মধ্যেই জাপানী সম্প্রসারণ একমাত্র ঘটতে পারে। সে যদি এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে সম্প্রসারণ চায় তাহলে সে চীন বা রাশিয়ার ক্রোধ সঞ্চার করতে বাধ্য। সে যদি দক্ষিণে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার দিকে সম্প্রসারণ চায় তবে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে সংঘর্ষে আসতে বাধ্য। যতটা বিচার করা যেতে পারে তাতে মনে হয় জাপান, তাঁর Japan Must Fight England’ গ্রন্থে বর্ণিত লেঃ কমান্ডার ইসিমারুর আবেদন সত্ত্বেও, প্রথমোক্ত পথ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে জাপানের উচিত চীন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসা এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে শক্তি সমাবেশ করা। এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে যে অঞ্চলের ওপর জাপান নজর দিতে পারে তা হয় রাশিয়া কিংবা চীনের অধীনে। রাশিয়াকে আক্রমণ করা জাপানের মূঢ়তা হবে কেননা সোভিয়েট শাসনে রাশিয়া এক সম্পূর্ণ পুনর্জীবিত দেশ। এছাড়া ইউরোপে এবং দূর প্রাচ্যে তার একটি প্রথম শ্রেণীর সৈন্যবাহিনী রয়েছে।
নিজের সামাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করার জন্যে জাপানের সামনে একটিমাত্র বিকল্প ছিল। তা হল চীনের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে আত্মসম্প্রসারণ করা। কিন্তু যদিও সে চীনের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে সম্প্রসারণ করতে পারে, সেই সম্প্রসারণ ঘটতে পারে রাশিয়ার তীব্র বাধার মধ্যে। এর কারণ নীচে ব্যাখ্যা করা হবে। এ ব্যাপারে ব্রিটেন যতটা জড়িত তাতে সে এশিয়া মহাদেশে জাপানের শক্তি বৃদ্ধি যতই অপছন্দ করুক, সে এই উৎপাতও সহ্য করবে কারণ সে ভালভাবে জানে যে এর একমাত্র বিকল্প হল জাপানের দক্ষিণ দিকে সম্প্রসারণ এবং তার ফলে জাপানের সঙ্গে তার সরাসরি এবং অনিবার্য সংঘাত। আর বর্তমান অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দূর প্রাচ্যে ব্রিটেনের স্বার্থরক্ষার জন্যে নিশ্চয়ই জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না।
এশিয়ার একটি দেশ বলে এবং একটি বিরাট মহাদেশের মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি থাকায় নিজের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজনে জাপানের পক্ষে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডের দিকে নজর দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। সেখানে সে দেখতে পেল এক বিশাল দেশ—পূর্বের স্বর্গীয় সাম্রাজ্য (Celestial Empire) বর্তমানের চীনা প্রজাতন্ত্র-যা খুব অব্যবস্থায় পরিচালিত এবং ঐক্যবদ্ধ নয় এবং যার প্রাকৃতিক সম্পদ এত বেশি যে তার নিজের পক্ষে সে সবের উন্নয়ন সম্ভব নয়। চীনের বিশালত্ব, সমৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা হল জাপানকে প্রলুব্ধ করার সর্বপ্রধান কারণ।
এই দুটি এশীয় দেশের মধ্যে সংঘর্ষ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে তা শুরু হয়েছিল। সে সময় আধুনিক পদ্ধতির সহায়তায় জাপান নিজের রাষ্ট্রকে আধুনিক করে গড়ে তুলেছিল এবং যুদ্ধের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তার ছিল। সে দেখেছিল যে বড় বড় সব ইউরোপীয় শক্তি চীনকে শোষণ করতে এবং চীনের ক্ষতি করে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে আরম্ভ করেছে। তাহলে চীনের পার্শ্ববর্তী এশীয় শক্তি জাপান সেই একই কাজ কেন করবে না এবং প্রাচ্যের সম্পদ শোষণ থেকে পশ্চিমী শক্তিগুলিকে কেন দূরে সরিয়ে রাখবে না? এই সাম্রাজ্যবাদী যুক্তির দোহাই দিয়ে জাপান তার সম্প্রসারণের দৌড় শুরু করেছিল।
গত চল্লিশ বছরের মধ্যে চীনা সরকারের নিকট থেকে সুবিধা আদায় করার একটি সুযোগও জাপান হারায়নি এবং এই সময়ের মধ্যে সে ধীরে ধীরে অথচ স্থিরভাবে পশ্চিমী শোষণকারী শক্তিগুলির প্রভাব হ্রাস করে চলেছে। তার সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল রাশিয়া, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানী। ১৯০৪-০৫ সালের রুশ-জাপান যুদ্ধে সে জারের সাম্রাজ্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় সে চীনের মানচিত্র থেকে জার্মানীকে মুছে ফেলতে পেরেছিল। কিন্তু ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলা সে করতে পারেনি। আর এর মাঝে যে রাশিয়া একবার পরাজিত হয়েছিল সে নতুন অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হয়ে এবং বিশেষভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে সোভিয়েট রাষ্ট্ররূপে দৃশ্যপটে ফিরে এসেছিল।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে চীন বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিল। ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানী প্রভৃতি ইউরোপীয় শক্তিগুলি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং হংকং, সাংহাই ইত্যাদি ‘চুক্তিবদ্ধ বন্দর’ (treaty-parts’) লাভ করেছিল। কার্যত এর অর্থ হল চীনা ভূখণ্ড দখল। গত শতাব্দী শেষ হওয়ার ঠিক আগে জাপান রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল এবং পশ্চিমী কৌশলমতোই জাপান চীনের সঙ্গে আচরণ করেছিল।
চীনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত ফরমোসা দ্বীপ জাপান ১৯০৪-০৫ সালের যুদ্ধে দখল করেছিল। প্রায়ই একই সময়ে জাপান কোয়াংটুং রেলওয়ে এবং মাঞ্চুরিয়ার মধ্য দিয়ে চলাচলকারী চীনা পূর্ব রেলওয়ের দক্ষিণ অংশ নিজের দখলে নিয়ে আসে। এভাবে দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়াকে জাপানের প্রভাবাধীনে আনা হয়। চীনের পূর্বতন অঞ্চল কোরিয়াকে জাপান ১৯১০ সালে জোর করে নিজের রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে। লক্ষ্য করার বিষয় ১৮৯৪ সালে জাপান যখন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তখন সে কোরিয়াকে স্বাধীন করে দেবে বলেছিল। বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীর বিরুদ্ধে জাপান যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং অবিলম্বে সানটুং উপদ্বীপে সিংটাও (Tsingtao) ও অন্যান্য জার্মান-অধিকৃত ভূখণ্ড দখল করতে অগ্রসর হয়। ১৯১৫ সালে যখন সে দেখল যে সমস্ত পশ্চিমী শক্তি যুদ্ধে একেবারে মত্ত হয়ে আছে তখন জাপান চীনের কাছে একুশ-দফা দাবি পেশ করে কয়েকটি সুবিধা জোর করে আদায় করেছিল। যুদ্ধের পর জাপান লুটের ভাগ হিসেবে পূর্বতন জার্মান প্রশান্তমহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের শাসন কর্তৃত্ব লাভ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে সমুদ্রপথে সরাসরি যাতায়াতের পথে থাকায় এই দ্বীপপুঞ্জের সামরিক গুরুত্ব রয়েছে।
এরপর কিছুকালের জন্যে জাপানী সম্প্রসারণে মন্দাভাব দেখা দেয় কারণ দখল-করা অঞ্চলগুলিতে নিজের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে জাপানের সময় দরকার ছিল। সম্প্রসারণের প্রচেষ্টা আবার উৎসাহের সঙ্গে শুরু হয় ১৯৩১ সালে যখন জাপান মাঞ্চুকুও (মাঞ্চুরিয়া) দখল করে এবং ১৮৯৫ সালে যেমন কোরিয়ায় হয়েছিল ঠিক সেইভাবে পূর্বতন চীনা ভূখণ্ড মাঞ্চকুওতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪১ সাল থেকে একটানা বর্তমান সম্প্রসারণের মূলে আছে এখন বিখ্যাত, বরং কিছুটা কুখ্যাত ১৯২৮ সালের তানাকা স্মারকলিপি (Tanaka Memorandum), যাতে এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে জাপানের ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছিল। সংক্ষেপে ইতিহাসের এই ঘটনাবলী পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হবে যে, আমাদের এই গ্রহে নিজের জন্যে স্থান সংগ্রহে জাপানকে নিজের সঙ্কল্প থেকে বিচ্যুত করা যাবে না। বাইরের পরিস্থিতি এই উদ্ধত অভিযান বন্ধ করতে পারবে না বললেই হয়। বরং তা এই সম্প্রসারণের পথ এবং গতি নির্ণয় করতে পারে।
জাপানের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ১৯৩১ সাল থেকে অনুসৃত জাপানের সামরিক আগ্রাসী নীতি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করবে। যখন তার জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে এবং তার এখনকার ভূখণ্ড বর্তমানের এই জনসংখ্যার স্থান সঙ্কুলানের পক্ষে অল্প পরিসর তখন জাপানের যে নূতন ভূখণ্ড প্রয়োজন সে কথা সহজে বোঝা যায়। তার শিল্পব্যবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায় যে তার সমস্ত প্রয়োজনীয় কাঁচামাল যেমন, তুলা, পশম, কাগজের মণ্ড, লোহা, তেল ইত্যাদি বহু দূর থেকে আমদানি করতে হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্যে ভূখণ্ডের প্রয়োজনের মতো শিল্পব্যবস্থার সম্প্রসারণেরও প্রয়োজন দেখা দেয়। সুতরাং তার বিরাট জনসংখ্যার ভরণপোষণের জন্যে জাপানের প্রয়োজন নির্বিঘ্ন ও নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহ। আবার শিল্প সম্প্রসারণের জন্যে প্রয়োজন নতুন নতুন বাজারের।
এখন এইসব প্রয়োজন কীভাবে মেটানো যেতে পারে? চীন কী উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে নিজের ভূখণ্ড স্বইচ্ছায় জাপানকে ছেড়ে দেবে? সে কী তার কাঁচামালের বিশাল সম্পদ এবং তার বিস্তৃত বাজার জাপানকে কাজে লাগাতে দেবে? নিশ্চয়ই না। জাতীয় স্বার্থ এবং আত্মসম্মান দুই-ই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। তা ছাড়া, ইউরোপীয় শক্তিগুলি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বেচ্ছায় জাপানকে চীনের সম্পদ ও বাজারের একচেটিয়া অধিকার দেবে না। চীনের ব্যাপারে তারা শেষপর্যন্ত ‘মুক্ত দ্বার’ (Open Door) নীতিতে আঁকড়ে থাকবে। যার অর্থ হল, সমস্ত শক্তিকে চীনের সম্পদ লুট করার অধিকার দেওয়া। কাজেই জাপানকে জোর করে চীনের ভূখণ্ড দখল করতে হবে। এই কাজ সে পর্যায়ক্রমে করছে, একবার এক কামড় দেয় এবং তা হজম করার জন্যে সময় নেয়। প্রতিটি আক্রমণের আগে কোন-না-কোনও সীমান্ত-সংঘর্ষ হয় এবং জাপানী আগ্রাসনের ছুতো হিসাবে এই সীমান্ত সংঘর্ষগুলিকে সযত্নে ঘটানো হয়ে থাকে। কৌশল সেই একই, তা সে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত বা আবিসিনিয়ার ওয়ালওয়াল কিংবা দূর প্রাচ্যে মাঞ্চুরিয়া যেখানেই লক্ষ্য করে দেখা যাক।
দূর প্রাচ্যে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী প্রয়োজন ও দাবি কেবলমাত্র মিটতে পারে যদি সে শ্বেতকায় জাতিগুলিকে বাদ দিয়ে এবং কার্যত ‘মুক্ত দ্বার’ নীতি বাতিল করে চীনের ওপর রাজনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করতে পারে। বারে বারে তার রাজনীতিবিদগণ বহুভাবে এই কথাই বলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের মুখপাত্রগণ প্রায়ই বলে থাকেন যে, দূর প্রাচ্যে তার বিশেষ স্বার্থ আছে এবং এই স্বার্থের সঙ্গে অন্য কোনও পশ্চিমী শক্তির স্বার্থের তুলনা করা যায় না, অথাৎ দূর প্রাচ্যে তদারকি করার ও সে অঞ্চলে শান্তি রক্ষার যে ব্রত জাপান গ্রহণ করেছে ইত্যাদি। সন্দেহ নেই, নিছক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছাড়াও একটি সাম্রাজ্য স্থাপনের আকাঙক্ষায় জাপানীরা উদ্দীপিত এবং তারা অপরাজিত—এই চেতনা তাদের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রসঙ্গত, বিদেশে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হলে জাপানী সমাজের ফ্যাসিস্টপন্থীদের ক্ষমতা বাড়বে।
চীন যদি কোনও প্রকারে জাপানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভুত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতা মেনে নেয়, তাহলে অবিলম্বে চীন-জাপান বিরোধের অবসান হতে পারে। জাপানের অগ্রণী কূটনীতিবিদ হিরোটা গত তিন বছর ধরে এর জন্যে চেষ্টা করে আসছেন। তাঁর বক্তৃতাগুলিতে তিনি বারে বারে চীন-জাপান সহযোগিতার জন্যে আবেদন করেছেন এবং এই বক্তৃতাগুলি বাহ্যত খুবই সৌহার্দ্যসূচক। এখন প্রশ্ন হল, এই সহযোগিতার লক্ষ্য কি? নিঃসন্দেহ তা হল জাপানের সমৃদ্ধি এবং কার্যত চীনের দাসত্ব। কিন্তু এই নগ্ন সত্য তো আর চিৎকার করে বলা যায় না—তাই স্লোগান ওঠে “কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা”। এই স্লোগানে শুধু জাপানের উদ্দেশ্যই চাপা থাকে না, এ জাপান, চীন কিংবা অন্যত্র সকল সমাজতন্ত্রবিরোধী শক্তিকে খুশিও করে। এভাবে ১৯৩৭ সালের ৭ আগস্ট ভারতীয় সংবাদগুলিতে হিরোটার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিম্নোক্ত বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল:
চীনের কাছে জাপানের অনুরোধগুলির মধ্যে একটি বড় দফা হল কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা—এই কথা জাতীয় পরিষদে (House of Representatives) ঘোষণা করে এম. হিরোটা বলেন যে, যদি চীনের বিপ্লবপন্থীদের, বিশেষ করে কমিউনিস্টদের, নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে তাঁর বিশ্বাস চীন-জাপান সহযোগিতা সম্ভব হবে। তিনি একথাও বলেন যে জাপান সরকার সরাসরি উত্তর চীনের ঘটনার মীমাংসা এবং সেই সঙ্গে চীন-জাপান সম্পর্কের মৌলিক পুনর্বিন্যাস করতে চান।
কয়েকবছর আগে প্রথমবার জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে হিরোটা একই ধরনের বিবৃতি একই রকম ভাষায় বারবার দিয়েছেন।
যদি এতে শান্তি আসেও তাহলে কী চীন এই দাবি মেনে নিতে পারে? আমার নিজের মত এই যে নানকিং কেন্দ্রীয় সরকারের ডিরেক্টার মার্শল চিয়াং কাইশেক একা হলে হয়তো এটা মেনে নিতেন। মনে মনে তিনি প্রচণ্ড কমিউনিস্ট-বিরোধী। ১৯২৭ সালে কুওমিনটাও দলে (Chinese National Party) ভাঙনের পরে তাঁর একাধিপত্য স্থাপনের পর থেকে তিনি চীনা কমিউনিস্ট ও তাঁদের মিত্রদের উৎখাত করতে চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু মাশাল চিয়াং দু’টি মহল থেকে অবিরাম বাধা পেয়েছেন। চীনা সোভিয়েট রাষ্ট্র নামে পরিচিত চীনের পশ্চিমদিকের প্রদেশগুলি কার্যত নানকিং-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকায় জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে এবং এ বিষয়ে তারা চীনা জনগণের মনোভাব বিশ্বস্তভাবে প্রতিধ্বনিত করেছে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমী শক্তিগুলি, চীনে যাদের বিশাল স্বার্থ রয়েছে এবং যারা প্রাচ্য জাতিদের কাছে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে চায় তারা তাদের বৈদেশিক লগ্নী বিপন্ন করে তুলতে, যেমন ল্যাটিন আমেরিকায় (মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা) ঘটেছিল, সহজে নিজেদের প্ররোচিত করতে পারে না। চীনে ব্রিটিশ লগ্নী সম্বন্ধে ১৯৩৭ সালের ১৯ আগস্ট তারিখের ‘লণ্ডন টাইমস’-এ প্রকাশিত সংবাদের নিম্নোদ্ধৃত অংশটি আলোকপাত করবে:
চীনে সরাসরি ব্রিটিশ লগ্নীর মূল্য প্রায় ২৫ কোটি পাউন্ড। এর মধ্যে ব্যবসায়ে লগ্নী করা আছে ২০ কোটি পাউন্ড এবং সরকারের কাছে দায়বদ্ধ ৫ কোটি পাউন্ড। মোর্ট অর্থের প্রায় ১৮ কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ করা আছে সাংহাইতে এবং এই ১৮ কোটি পাউন্ডের একটি বড় অংশ নিয়োজিত আছে সুচো ক্রিকের (Soochow Creek) উত্তর দিকে সেটেলমেন্ট জেলায়। এই জেলার উপরেই এখন সবচেয়ে বেশি গোলাগুলি ও বোমাবর্ষণ হচ্ছে। এইখানেই অধিকাংশ সরকারী জনকল্যাণমূলক দপ্তর, ব’রখানা এবং অধিকাংশ বড় বড় সওদাগরী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
‘টাইমস’ পত্রিকার লেখক হতাশার সঙ্গে একথাও বলেছেন যে, আগে এই জেলায় ব্রিটিশ সুপারিন্টেন্ডেন্টের অধীনে পুলিশ ছিল, এখন থানাগুলি থেকে লোক সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং সেগুলি দখল করেছে জাপানীরা। এর ফলে শ্বেতকায় জাতিরা বুঝতে পেরেছেন যে চীনে জাপানীদের প্রভুত্বের অর্থ শুধু চীনেরই দাসত্ব নয়, দূর প্রাচ্য থেকে তাদেরও বিতাড়ন। যেহেতু একটি দেশের ভূগোল অনেক সময় সামাজিক কৌশল স্থির করে থাকে, সেজন্যে চীনের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা দরকার।
চীনে যোগাযোগ রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পথ হল তার তিনটি নদী: উত্তর হোয়াং-হে (পীত নদী), মধ্যভাগে ইয়াংসি এবং দক্ষিণে সি-কিয়াং। সি-কিয়াং-এর প্রবেশপথ নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিটিশ বন্দর হংকং, ইয়াংসি-র সাংহাই। সাংহাই বিদেশীরা, প্রধানত ব্রিটেন ও আমেরিকা, যৌথভাবে দখল করে আছে। হোয়াং-হো-র প্রবেশপথে প্রভুত্ব করে জাপানীরা। এরা প্রথমে কোয়িরায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল এবং এখন বসেছে মাঞ্চুরিয়াতেও (মাঞ্চকুও)। চীনে প্রবেশ করার একটিমাত্র কার্যকর স্থলপথ এসেছে উত্তর দিক থেকে। এই পথ দিয়ে মঙ্গোল ও মাঞ্চুরা খাস চীনে প্রবেশ করেছিল। এবং বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলিতে রাশিয়া ও চীন উভয়েরই দৃষ্টি ছিল এই পথের ওপর। ১৯৩১ সাল থেকে জাপান এই পথটি এবং এর সন্নিহিত এলাকা দখল করার দিকে লক্ষ্য রেখেছে এবং ১৯৩৭ সালের জুলাই মাস থেকে এ অঞ্চলে যুদ্ধ চলছে। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত যে এক উচ্চপর্বতমালা প্রজাতন্ত্রের পশ্চিমাঞ্চল (অথাৎ সিংকিয়াং বা চীনা তুর্কীস্তান) থেকে খাস চীনকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এর ফলে উত্তর দিকের স্থলপথ দিয়ে খাস চীনে প্রবেশ করা যায় এবং আমরা দেখতে পাই যে, ঐতিহাসিক কারণে যে শক্তি মাঞ্চুরিয়া নিয়ন্ত্রণ করেছে সেই শক্তিরই সর্বদা চীনে প্রভুত্ব করার মতো ক্ষমতা রয়েছে।
১৯৩১ সাল থেকে দূর প্রাচ্যে যেসব ঘটনা ঘটছে সেগুলি ঠিকমত বুঝতে হলে মোটামুটিভাবে জাপানের সমর-কৌশল বোঝা দরকার। শান্তিপূর্ণ অনুপ্রবেশের মাধ্যমে চীনে নিজের প্রভুত্ব স্থাপন করা সম্ভব ছিল না বলে জাপান চীনকে যুদ্ধে পরাজিত করে প্রভুত্ব স্থাপন কিংবা অন্তত তার ওপর সামরিক চাপ সৃষ্টির একটা পরিকল্পনা করেছিল। এই লক্ষ্য পূরণের জন্যে জাপানী সমর-কৌশল দু’ভাবে কাজ করেছিল। প্রথমত, চীনের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা এবং দ্বিতীয়ত, অন্য কোনও শক্তির পক্ষে চীনকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসা অসম্ভব করে তোলা। মাঞ্চুকুও, মঙ্গোলিয়া এবং খাস চীনের উত্তরভাগ-সহ প্রজাতন্ত্রের সমগ্র উত্তর অঞ্চলটি যদি জাপান দখল করতে পারত তাহলেই একমাত্র তার উদ্দেশ্য সফল হত। এই অঞ্চলগুলি একত্রে খাস চীনকে (হোয়াং-হো, ইয়াংসি ও সি-কিয়াং নদীর উপত্যকা) রুশ সাইবেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে। মানচিত্র লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে জাপান যদি এই এলাকার ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে পারে তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে সে বহির্মঙ্গোলিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে বৈকাল হ্রদের কাছে ট্রান্স-সাইবেরীয় রেলপথ বিচ্ছিন্ন করতে পারে। আর রাশিয়াকে যদি সফলভাবে বিচ্ছিন্ন করা যায় তাহলে বিপদের সময় চীনের সাহায্যে আর কোনও শক্তি এগিয়ে আসবে না। ১৯৩১ সালের পর থেকে জাপান কীভাবে এই অঞ্চল দখল করার চেষ্টা করে আসছে এবার আমরা তা দেখব।
প্রথমেই এটা লক্ষ্য করা দরকার যে জাপান কখনই তার মনোভাব স্পষ্ট করে বলেনি। যখন সে সম্প্রসারণে ব্যস্ত থাকবে তখন যাতে অন্য কোনও শক্তি তাকে আক্রমণ না করে এমনই সতর্কতার সঙ্গে সে অন্যদেশ আক্রমণ করেছে। এ ছাড়া চীনাভূমি দখলের জন্যে সে সর্বদা কোন-না-কোনও ‘ঘটনা’ ঘটেছে এমন ধুয়া তুলেছে। প্রথম ‘ঘটনা’ ঘটেছিল ১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর যখন জাপানের রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর লেফটেনান্ট কাওয়ামোতো (Kawamoto) দক্ষিণ মাঞ্চুরিয়া রেলপথ সামরিক প্রয়োজনে পরিদর্শন করছিলেন। এর ফলে পরের দিন মুকডেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে সমগ্র মাঞ্চুরিয়া দখল করা হয়েছিল। সেই সময় সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা চলেছে এবং রাশিয়া দ্রুতবেগে তার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা রূপায়ণে ব্যস্ত ছিল। এজন্যে জাপান নিশ্চিত ছিল যে, তার আক্রমণাত্মক কাজে কোনও কার্যকর বাধা আসবে না। লীগ অব নেশনস কর্তৃক প্রেরিত লিটন কমিশন জাপানের বিরুদ্ধে রিপোর্ট দিয়েছিল এবং সেই অনুসারে জাপানের মাঞ্চুরিয়া দখলকে লীগ এ্যাসেম্বলিতে নিন্দা করা হয়। কিন্তু জাপান লীগকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে সভা ছেড়ে চলে যায়। এর পরে ১৯৩৩ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন মাঞ্চুকুওর কাছে চীনা পূর্ব রেলপথ বিক্রি করেছিল এবং ১৯৩৪ সালে রুশ-মাঞ্চকুও জলপথ চুক্তি (Waterways Agreement) সম্পাদিত হয়েছিল। মাঞ্চকুওকে যদিও অন্য শক্তিরা। আইনমত স্বীকৃতি দেয়নি কিন্তু তাদের অধিকাংশই কার্যত তাকে স্বীকার করে নিয়েছিল।
মাঞ্চুকুও এক বিশাল ভূখণ্ড, উপনিবেশ স্থাপনের প্রভূত সুযোগ সেখান রয়েছে। এখানকার আবহাওয়া দুঃসহ হলেও কয়লা-সহ কতকগুলি কাঁচামালে এ অঞ্চল সমৃদ্ধ। অধিকন্তু সোভিয়েট রাশিয়ার সঙ্গে কখনও যুদ্ধ বাধলে জাপানের পক্ষে অগ্রবর্তী-ঘাঁটি হিসাবে এটি বিশেষভাবে উপযোগী। অনেকে মনে করেছিলেন মাঞ্চুকুওর উন্নতি ঘটাতে জাপানের কয়েক বছর লেগে যাবে এবং সেই অবসরে দূর প্রাচ্যে শান্তি বজায় থাকবে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রতিপন্ন হয়েছিল। অর্থনৈতিক এবং সমর-কৌশলের কারণে মাঞ্চুকুওর পক্ষে একা টিকে থাকা সম্ভব নয়। জাপান যে পরিমাণ কাঁচামাল চায় তার একাংশ মাত্র সেখানে পাওয়া যায় এবং মাঞ্চুকুওর বাজার জাপানের পক্ষে যথেষ্ট বড় হয়। এছাড়া বিরোধী শক্তিগুলির রাজ্য চারদিকে ঘিরে থাকায় সমর-কৌশলের দিক থেকে মাঞ্চকুও খুব দুর্বল। সুতরাং তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো এবং নতুন রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে জাপানকে তার আগ্রাসন অব্যাহত রাখতে হয়েছিল।
১৯৩২ সালে সাংহাইতে আর একটি ‘ঘটনা’ ঘটানো হয় এবং চীন ও জাপানের মধ্যে সাংহাই যুদ্ধ শুরু হয়। এর ফল হয়েছিল এই যে চীন সাংহাই-এর কাছাকাছি কিছু এলাকায় নিরস্ত্রীকরণ করতে এবং অপর কয়েকটি জাপানী শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। সাংহাই-এর সামরিক গুরুত্ব ১৯৩২ সালে ততটা স্পষ্ট ছিল না, কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ (১৯৩৭) তা স্পষ্ট করে তুলেছে।
১৯৩৩ সালের মধ্যে পুতুল সম্রাট পু ই-র (Pu Yi) মাঞ্চকুওতে শাসন প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়। তার সীমান্ত আরও সম্প্রসারিত করার জন্যে জাপান প্রস্তুত হয়েছিল। মাঞ্চুকুওর সীমান্তের বাইরে উত্তর চীনে যুদ্ধ হয়েছিল। জাপানী সৈন্যদল জেহল (Jehol) এবং চাহারের (Chahar) একাংশ দখল করেছিল এবং পিকিং-এর (বর্তমানে পেপিং নামে অভিহিত) প্রবেশদ্বার পর্যন্ত গিয়েছিল। যুদ্ধে পরাজিত চীনাদের অবশ্যম্ভাবী ফল মেনে নিতে হয়েছিল। তারা দেখল যে তাদের দেশের একাংশ জাপানের দখলে চলে গেল। ১৯৩৩ সালে টাংকু সন্ধিতে (Tangku Truce) যুদ্ধের অবসান হয়।
১৯৩৪ সালে তুলনামূলকভাবে বিশেষ কিছু না ঘটলেও ১৯৩৫ সালে আবার বিরোধ দেখা দেয়। জাপানের ক্ষেত্রে সর্বদাই যা ঘটে এবারেও নতুন আক্রমণের। আগে একদফা আপসমূলক বক্তৃতা এবং পররাষ্ট্রনীতিতে নরমপন্থার কথা বলা হল। ১৯৩৫ সালের ২৩ জানুয়ারি এক ভাষণে হিরোটা অনাক্রমণ নীতির কথা এবং চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার উদ্দেশ্যে ‘সৎ প্রতিবেশী’-সুলভ নীতি অবলম্বনের কথা বলেন। এবার জাপানীরা ‘উত্তর চীনের স্বায়ত্তশাসনের’ (স্বায়ত্তশাসিত মাঞ্চুকুওর মতো) স্লোগান দিয়েছিল এবং নানকিং-এর (চীনের নূতন রাজধানী) কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হয়েছিল তাঁরা যেন উত্তর চীনে জাপানের কাজকর্মে ও আলোচনায় বাধা সৃষ্টি না করেন। কিন্তু নানকিং জাপানকে সম্পূর্ণভাবে বাধিত করেনি এবং উত্তর চীনের জনগণও ১৯৩১ সালে মাঞ্চুরিয়ারা যেমন করেছিল সেইরকম অন্ধ হয়ে জাপানী ফাঁদে পা দেয়নি। ফলে জাপানের পরিকল্পনার সফল হয়নি। এ সত্ত্বেও বিরোধ শেষপর্যন্ত মিটলে দেখা গেল যে চীনকে কার্যত নিজের ভূখণ্ডের আর একটি অংশ হারাতে হয়েছে।
১৯৩৩ সালে জেহল ও চাহারের একাংশ মাঞ্চুকুওর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এখন হোপেই প্রদেশে একটি নিরস্ত্রীকৃত এলাকা গঠন করা হয়েছিল এবং এর রাজধানী হয়েছিল পেপিং-এর বারো মাইল পূর্বে টাংচোতে। এর নামকরণ করা হয় পূর্ব হোপেই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। এই অঞ্চলের দায়িত্ব ছিল Yin-Ju-Keng নামে একজন চীনা দলত্যাগীর ওপর এবং এ অঞ্চলের প্রভুত্ব ছিল জাপানীদের। (পরে চীনা শুল্কবিভাগকে ফাঁকি দেবার উদ্দেশ্যে সম্ভবত জাপানীদের প্রশ্রয়ে এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চোরাচালান চলত।) এ ছাড়া হোপেইর বাকি অংশ (যার মধ্যে পেপিং ও টিয়েনসিন পড়ে) এবং চাহারের একাংশ নিয়ে একত্রে একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছিল। এটি ছিল নানকিং-এর বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী নেতা General Sung Cheh Yuan-এর নেতৃত্বে পরিচালিত Hopei-Chahar Political Council-এর অধীনে। এই Council প্রকাশ্যে জাপানের বিরোধিতা করতে ভয় পেলেও নানকিং-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টোকিওতে একটি সামরিক বিদ্রোহ হয়েছিল এবং কিছু সময়ের জন্যে জাপান নিজের দেশে একেবারে ব্যস্ত ছিল। তা সত্ত্বেও তারা একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিল না। আন্তজাতিক ক্ষেত্রে নিজের অবস্থা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য জাপান জার্মানীর সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল—German-Japanese Anti-Commintern Pact। বছরের শেষ দিকে, ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে পেপিং-পাওটাও রেলপথ ধরে অন্তর্মঙ্গোলিয়ায় (Inner Mongolia) অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু নানকিং-এর সৈন্যদের সহায়তায় জেনারেল Fu Tso I সুইয়ান (Suiyan) প্রদেশে জাপানের মঙ্গোল-মাঞ্চুকুও ভাড়াটে সৈন্যবাহিনীর অগ্রগতি প্রতিহত করেছিলেন।
ইতিহাসের যে কোনও ছাত্রের কাছে এটা পরিষ্কার হওয়া উচিত যে ১৯৩১ সালের পর থেকে জাপান শুধু দূর প্রাচ্যেই নয় বিশ্বরাজনীতিতেও ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেকে জাহির করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেকে শক্তিশালী মনে না করলে সে কখনও চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ করতে সাহস করত না। মাঞ্চুরিয়া দখলের পর জাপানের লীগ অব নেশনস ত্যাগের উল্লেখ আমরা আগেই করেছি। এর পূর্বে সে Anglo-Japanese Alliance-কে বাতিল হতে যেতে দিয়েছিল সম্ভবত এই কারণে যে সে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যখন এ চুক্তি বাদ দিয়েই সে চলতে পারে।
ওয়াশিংটনের নৌ-চুক্তিতে ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে যুদ্ধজাহাজ ইত্যাদি রাখার ব্যাপারে ৫: ৫: ৩ এই আনুপাতিক হারে জাপান রাজী হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে এই চুক্তির মেয়াদ যখন শেষ হয় তখন জাপান সমতার দাবি তুলেছিল। কিন্তু লণ্ডন সম্মেলনে অন্যান্য শক্তিগুলি এই দাবি মানতে অস্বীকার করায় জাপান ঘৃণার সঙ্গে সম্মেলন ছেড়ে চলে যায়। যখন ব্রিটেন বিশ্বের বাজার সম্বন্ধে জাপানের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক বোঝাপড়া করার চেষ্টা করছিল তখন জাপান-ব্রিটেন কর্তৃক সরাসরি নিয়ন্ত্রিত বাজারগুলি ছাড়া অন্য কোনও বাজার নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করে এবং এই দুই শক্তির মধ্যে অনুষ্ঠিত ১৯৩৫ সালের লন্ডন সম্মেলন ভেঙ্গে যায়। এইসব ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট হবে যে ১৯৩৭ সাল আরম্ভ হলে জাপান নৈতিক এবং আন্তজাতিক দিক থেকে দূর প্রাচ্যে এক বড়-ধরনের সংঘর্ষের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল।
সময় সময় সবচেয়ে ওয়াকিবহাল মানুষেরও বিভ্রান্তি ঘটে। ১৯৩৭ সালের মার্চ ও জুলাই মাসের মধ্যে জাপান সারা জগতকে এই বিশ্বাসে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল যে, সে এক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলেছে এবং তার ফলে চীনের বিরুদ্ধে নতুন কোনও সামরিক অভিযান শুরু করার ক্ষমতা তার নেই। কয়েকটি মার্কিন সাময়িক পত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয় যে, যখন পৃথিবীর বাকি অংশে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটছে তখন জাপানের অবস্থা ছিল বিপরীত। এই পুনরুজ্জীবনের ফলে কাঁচামালের দাম খুব বেড়ে গিয়েছিল। জাপানকে এগুলি উচ্চ মূল্যে কিনতে হয় এবং তার ফলে উৎপাদনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তার পক্ষে কার্যত বিশ্বের বাজারে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। (ভারতে বর্তমানে জাপানী বস্ত্রের অস্বাভাবিক রকমের কম দাম এই বিবরণ যে মিথ্যা তা প্রমাণ করে।) মার্কিন সাংবাদিকগণ কষ্ট স্বীকার করে এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, এই অর্থনৈতিক সঙ্কটের জন্যে জাপান চীনের ব্যাপারে ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং সেজন্যে তার উদ্দেশ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। এই একই কারণে এ যুক্তিও দেখানো হয়েছিল যে জাপানে উগ্র যুদ্ধবাজেরা সাময়িকভাবে সমর্থন হারিয়েছিল এবং মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদগণের প্রভাব বাড়ছিল।
এখন দেখা যায় যে, জাপানের এই নরমপন্থা তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ঢাকবার আবরণমাত্র ছিল। উদ্দেশ্য ছিল নিজের শত্রুদের নিরাপত্তাবোধে ঘুম পাড়িয়ে রাখা। সুস্পষ্ট কারণে জাপান চীন আক্রমণের জন্যে এই বিশেষ মুহূর্তটি বেছে নিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেন কিংবা রাশিয়া তখনও জাপানকে যুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত ছিল না। তারা সকলে তীব্রগতিতে প্রস্তুত হচ্ছিল এবং অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করছিল। এবং দুই কিংবা তিন বছর পরে জাপানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। সুতরাং জাপানের তখন ‘হয় এখন কিংবা কখনই নয়’ অবস্থা, এবং সেজন্যেই সে আঘাত হেনেছিল। সংযত কথা এবং নরমপন্থায় কাজ করার ফাঁকে সে সযত্নে এই আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছিল। যখন সকলের মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে জাপান শাস্তির কথা চিন্তা করছে, তখনই সে আক্রমণ শুরু করেছিল। ১৯৩৭ সালের ২৪ এপ্রিল নিউইয়র্কের সুপরিচিত সাময়িক পত্রিকা ‘দি নেশন’ লিখেছিল: “১৯৩১ সালের পর থেকে এখন দূর প্রাচ্যে শান্তির সম্ভাবনা পূর্বের যে-কোনও সময়ের তুলনায় বেশি।” ২৬ জুন এই একই পত্রিকা লিখেছিল যে চীনের বিরুদ্ধে জাপানের আক্রমণে এখন ভাটা চলেছে। কিন্তু লেখক তখন জানতে পারেননি যে এটা ছিল ঝড়ের পূর্বের শান্ত অবস্থা মাত্র।
জাপানের আর-একটি আক্রমণের প্রস্তুতি ছাড়াও অন্য কয়েকটি বিষয় দূর প্রাচ্যের সঙ্কট বাড়িয়েছিল। সিয়ানের আকস্মিক বিদ্রোহ ও ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্শাল চিয়াং কাইশেকের অপহরণ চীনের ‘যুক্তফ্রন্ট” নীতির পথ প্রশস্ত করেছিল। এ বিষয়ে সন্দেহ করার তেমন কারণ নেই যে চিয়াংকে যাঁরা বন্দী করেছিলেন তাঁরা তাঁকে মুক্তি দেবার পূর্বে, জাপানের বিরুদ্ধে সাধারণ প্রতিরোধের ভিত্তিতে চীনা সোভিয়েট (Chinese Soviets) ও নানকিং সরকারের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল। এই বোঝাপড়ার অর্থ হল সাম্প্রতিক ইতিহাসে এই প্রথম চীনের ঐক্যসাধন। চীনা সোভিয়েটগুলিকে কমিউনিজম ও বিভেদবাদ (Separatism) ছাড়তে হবে এবং নানকিং-এর নির্দেশ মানতে হবে। জাপানী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ চীনের নেতৃত্বে দেবেন চিয়াং এবং কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ, চৌ-এন-লাই এবং চিয়াং-এর নিজের পুত্র তাঁর পন্থা অনুসরণ করবেন। জাপান একথা জানতে পেরেছিল এবং ঐক্যবদ্ধ চীন সংহতিসাধনের পথে আরও অগ্রসর হওয়ার পূর্বে তাকে আক্রমণ করেছিল।
সময়টা জাপানের পক্ষে বহুদিক থেকে সুবিধাজনক। পূর্বেই বলেছি যে পুনরায় ব্রিটিশ, রুশ এবং মার্কিন যুদ্ধ-আয়োজন দ্রুতবেগে চলেছে। তাদের কেউই এখন যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়নি। সিঙ্গাপুরে ঘাঁটি সম্পূর্ণ করতে ব্রিটেনের এখনও সময় লাগবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র The Neutrality Act গ্রহণ করায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, সে প্রতিটি আন্তর্জাতিক বিরোধের বাইরে থাকতে চায়। ফ্যাসিস্টদের রিপোর্ট অনুসারে রাশিয়ার সৈন্যবাহিনীতে দারুণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সে যাই হোক, বারো মাস পূর্বে তাকে যেমন ভয়ঙ্কর মনে হয়েছিল এখন আর সেরকম নয়। সোভিয়েট-মাঞ্চুকুও সীমান্ত-সংঘর্ষের পর ১৯৩৭ সালের ৪ জুলাই বিতর্কিত দ্বীপগুলি থেকে সোভিয়েট সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এই দ্বীপগুলি ১৮৬০ সালের চীনের সঙ্গে চুক্তির ফলে রাশিয়ার দখলে ছিল। এ থেকে আরও প্রমাণ পাওয়া যায় যে সোভিয়েট সরকার যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত নয়।
আমুর নদী থেকে সোভিয়েট সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের তিন দিন পরে পেপিং-এর নিকটে আর একটি ‘ঘটনা’ সাজানো হয়েছিল এবং ১৯৩৭ সালের ৮ জুলাই উত্তর চীনের ওপর পুনরায় আক্রমণ শুরু হয়।
প্রবাদ আছে, মানুষ বিপদ ঘটবার পর আরও বিজ্ঞ হয়ে ওঠে। এখন ওয়াকিবহাল সাংবাদিকরা বলছেন যে কিছুকাল ধরে জাপান যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। মাঞ্চুকুও দখল করে সে সন্তুষ্ট নয়। জাপান থেকে আসা বসবাসকারী লোকেদের কাছে দেশটি ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা। জাপানের শিল্পের জন্যে প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অল্প অংশ মাত্র এখানে পাওয়া যায়। সন্দেহ নেই, এর ফলে জাপানের বাণিজ্য কিছুটা বেড়েছে কিন্তু সেই লাভ প্রশাসনের ব্যয় এবং জাপানের বাজারে মাঞ্চুরিয়ার পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ক্ষতির দরুন অর্থহীন হয়ে পড়েছে। অপর পক্ষে, অর্থনৈতিক দিক থেকে উত্তর চীনে (অথাৎ, সানটুং, হোপেই, চাহার, সানসি ও সুইয়ান প্রদেশগুলিতে) মাঞ্চুকুওর চেয়ে অনেক কিছু বেশি পাওয়া যেতে পারে। চাহার সানসিতে কয়লা পাওয়া যায়। এবং দক্ষিণ হোপেই ও সানসিতেও আবার ভালজাতের কয়লাও পাওয়া যায়। তা ছাড়া এই পাঁচটি প্রদেশের নানা জায়গায় টিন, তামা, সোনা এবং তেল পাওয়া যায়। জাপানে এখন প্রতি বছর ৪০ কোটি ইয়েন মূল্যের যে তুলো ভারত ও আমেরিকা থেকে আমদানি করা হয় সেই তুলো চাষের পক্ষে পীত নদীর (হোয়াং-হো) উপত্যকা উপযোগী। আর জাপান থেকে আগত মানুষের বসবাস ও পশুপালনের পক্ষে এই জায়গায় আবহাওয়া মাঞ্চুকুওর চেয়ে বেশি অনুকূল।
কিছুকাল আগে জাপান এই অঞ্চলটি শোষণের পরিকল্পনা করেছিল। যতদিন অঞ্চলটি চীনের অধীনে ছিল ততদিন জাপানী পুঁজিপতিরা এখানে অর্থ বিনিয়োগ করতে রাজি হয়নি। এখন সামরিক শক্তি পুঁজিপতিদের সহায়তা করতে থাকে।
বর্তমান আগ্রাসনের পিছনে অর্থনৈতিক প্রয়োজন ছাড়াও মনস্তাত্ত্বিক কারণ ছিল। মার্কিন সাংবাদিকগণ যখন এ বছরের প্রথম দিকে জাপানের অর্থনৈতিক সঙ্কট সম্বন্ধে লিখেছিলেন তখন তাঁরা আংশিকভাবে সত্যি কথা বললেও তাঁদের সিদ্ধান্তগুলি ছিল ভুল। তাঁরা যা লিখেছিলেন তার বিপরীতই ঘটেছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ চাপা দেবার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক অসুবিধাগুলি ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ সরকারকে বিদেশে যুদ্ধ আরম্ভ করতে প্ররোচনা দিতে পারে। (অদূর ভবিষ্যতে একই সঙ্কট জার্মানীতেও দেখা দিতে পারে।) জাপানের প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, সম্প্রতিকালে বাণিজ্যের লেনদেনে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় যেসব অর্থনৈতিক অসুবিধার মধ্যে জাপানকে পড়তে হয়েছিল সেগুলিই প্রয়োজনীয় যুদ্ধ-মনোভাবকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল।
এ ছাড়া ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে জাপানীদের পরিচালিত সুইয়ানের (উত্তর চীনের একটি প্রদেশ) বিপক্ষে অভিযানের ব্যর্থতার পর থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে যদি সমগ্র উত্তর চীন দখল করা যায় তবেই শুধু অন্তর্মঙ্গোলিয়ার সমর-কৌশলের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলি দখল করা সম্ভব। চাহার এবং বিশেষ করে সুইয়ান নিয়ন্ত্রণ না করে মাঞ্চুকুওর দিক থেকে অন্তর্মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশ করা অসম্ভব।
অর্থনৈতিক দিক থেকে মূল্যহীন ঊষর দেশ অন্তর্মঙ্গোলিয়া সম্বন্ধে জাপান এত আগ্রহী কেন? কারণটা অর্থনৈতিক নয়, সমর-কৌশলগত। আগেই বলা হয়েছে যে মাঞ্চুকুও, উত্তর চীন ও মঙ্গোলিয়া নিয়ে গঠিত একটি ঘনবিন্যস্ত ভূখণ্ড লাভ করাই জাপানের লক্ষ্য। এর মাঝে আবার সোভিয়েট রাশিয়া চুপ করে বসে ছিল না। চীনা প্রজাতন্ত্রের দু’টি বড় প্রদেশ সিংকিয়াং (বা চীনা তুর্কীস্তান) ও বহির্মঙ্গোলিয়া (সোভিয়েট রাশিয়ার সংলগ্ন মঙ্গোলিয়ার উপরের অংশ) সোভিয়েট প্রভাবের আওতায় চলে গিয়েছে। জাপানের কাছে সিংকিয়াং-এর বিশেষ সামরিক গুরুত্ব নেই (ভারতের সন্নিহিত অঞ্চল বলে সোভিয়েট রাশিয়ার কাছে এর গুরুত্ব আছে।) কিন্তু জাপানের কাছে বহির্মঙ্গোলিয়ার গুরুত্ব আছে। বহির্মঙ্গোলিয়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকায় সোভিয়েট রাশিয়া সহজে উত্তর চীনে প্রবেশ করতে পারে। এ বন্ধ করার এবং খাস চীন থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার একমাত্র উপায় হল অন্তর্মঙ্গোলিয়া (মঙ্গোলিয়ার দক্ষিণাংশে) ও উত্তর চীন দখল করা এবং তারপরে পশ্চিম থেকে পূর্বে একটি ঘনবিন্যস্ত করিডর তৈরি করা যাতে খাস চীন থেকে রুশ সাইবেরিয়া ও বহির্মঙ্গোলিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা যায়। এই অঞ্চলটি দখল করা এখন জাপানের লক্ষ্য। একবার একাজে সফল হলে তার পরবর্তী চেষ্টা হবে এই নবঅর্জিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে একটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ তৈরি করা। সে যদি সেখানে নিজের অবস্থা সুদৃঢ় করতে পারে, তখন সে বহির্মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশের কথা চিন্তা করবে। তখন কী হবে সে সম্বন্ধে এখন ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। বর্তমানে বহির্মঙ্গোলিয়া রুশ প্রভাবের অধীন এবং সোভিয়েট সরকার স্পষ্টভাবে একথা ঘোষণা করেছেন যে, জাপানের পক্ষে এই এলাকায় প্রবেশের কোনও চেষ্টা যুদ্ধের শামিল বলে গণ্য করা হবে।
কিন্তু ভবিষ্যতে কোনও এক সময় নিজের প্রভুত্বের অধীনে মঙ্গোলদের ঐক্যবদ্ধ করার আশা জাপান ত্যাগ করেনি। এজন্যে জাপানী দালালেরা প্রায়ই বলে থাকেন যে সমগ্র মঙ্গোলের উপযুক্ত রাজনৈতিক আদর্শ হল ‘মেংকুকুও’। এই পরিকল্পনা যদি কখনও সফল হয় তাহলে তা মাঞ্চুকুওর অনুরূপ ব্যাপার হবে। মঙ্গোলিয়ারা গিবার্টিও ধাঁচের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার-সহ নিজেদের একটি রাষ্ট্র গড়তে পারবে ঠিকই কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা থাকবে জাপানের নিয়ন্ত্রণে। দূর প্রাচ্যে পঞ্চাশ লক্ষ মঙ্গোল অধিবাসী আছে। কুড়ি লক্ষ মঙ্গোল মাঞ্চুকুওর সিংগান প্রদেশে বাস করে। বহির্মঙ্গোলিয়ায় বাস করে দশ লক্ষের মতো। এ অঞ্চলটি আয়তনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক কিন্তু প্রধানত মরুভূমি। আর দশ লক্ষ বাস করে অন্তর্মঙ্গোলিয়ায় এবং প্রায় দশ লক্ষের মতো ছড়িয়ে আছে সিংকিয়াং (চীনা তুর্কীস্তান), তিব্বত ও সোভিয়েট রাশিয়ায় (বুরিয়ট প্রজাতন্ত্র)। ভবিষ্যৎ ‘মেংকুকুও’ মঙ্গোল রাষ্ট্রের একটি কাঠামো, মঙ্গোলীয় রাজনৈতিক পরিষদ-সহ, ইতিমধ্যেই গঠিত হয়েছে। মঙ্গোল নেতাদের মধ্যে যারা জাপানের প্রভাবের অধীনে তাঁরা হলেন লি শাউসিন ও রাজকুমার তে (Teh)। ‘স্বশাসিত’ মেংকুকুও জাপানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলেও তার আশু লক্ষ্য হল স্বশাসিত উত্তর চীন।
মাঞ্চুকুও দখলের পর থেকে উত্তর চীনে জাপানের প্রভাব ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। এর ফলে তাদের আশা হয় যে, কোনও রকম বড় সংঘর্ষ ছাড়া পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত উত্তর চীনে একটি সাক্ষিগোপাল রাষ্ট্র গঠিত হবে। সম্প্রতি ক্যান্টন প্রদেশ নানকিং-এর এক্তিয়ারে চলে যাওয়া এবং তারপরেই গত ডিসেম্বর মাসে মার্শাল চিয়াং-এর সঙ্গে চীনা কমিউনিস্টদের যে বোঝাপড়া হয়েছে বলে প্রকাশ তা জাপানের সকল আশা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। দীর্ঘকালের পর একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ চীন পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করছিল এবং সেই চীন বিনা যুদ্ধে তার উত্তর দিকের প্রদেশগুলি ছেড়ে দেবে না।
১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসের পর থেকে নানকিং উত্তর চীনের সরকারি কর্মচারীদের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তার করতে শুরু করে। পূর্ব হোপেইর মধ্য দিয়ে জাপানীদের আশ্রয়ে যে চোরাচালান চলত তাতে নানকিং বাধা দিয়েছিল। সে সাহস করে বিনা সম্মতিতে জাপানের প্রতিষ্ঠিত টিয়েনসিন-টোকিও এয়ারলাইনের বিমান চলাচল স্থগিত রাখার আদেশ দিয়েছিল। উত্তর চাহারে জাপানী প্রভুত্বের বিরুদ্ধে মাঞ্চুকুও ও মঙ্গোলিয়ার সৈন্যদের একটি ছোটখাট বিদ্রোহ হয়েছিল। এইভাবে জাপান-বিরোধী ঘটনা ক্রমেই বেশিমাত্রায় ঘটছিল এবং জাপানের দাবিমতো একেবারে নতিস্বীকার করে সেগুলির মীমাংসা করা হয়নি। সর্বোপরি, রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল যে নানকিং ও চীনা কমিউনিস্টদের মধ্যে বোঝাপড়ার ফলে ৯০,০০০ অভিজ্ঞ কমিউনিস্ট সৈন্যকে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োগ করা হবে।
১৯৩৭ সালের ৩ জুলাই জাপানের রাষ্ট্রদূত Shigeru Kawagoe নানকিং-এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। জাপান তার দাবি হ্রাস করে প্রস্তাব করেছিল যে যদি নানকিং মাঞ্চুকুওকে আইনসম্মত স্বীকৃতি দেয় এবং জাপানের সঙ্গে ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা’ করতে রাজি হয় তাহলে সে উত্তর চীনের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তুলে নেবে। জানা যায়, নানকিং এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। বরং উল্টে এমন প্রস্তাব করেছিল যা জাপানের দাবির তুলনায় অনেক কম। এক নতুন চীন যে জন্মলাভ করেছে এবং সে যে শীঘ্রই উত্তরের প্রদেশগুলির উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব করবে, এ বিষয়ে আর কোনও প্রমাণের দরকার ছিল না। সুতরাং জাপান আর দেরি না করে আঘাত হেনেছিল এবং পেপিং-এর (পিকিং) প্রায় ১৮ মাইল পশ্চিমে লুকৌচাইওতে (Lukouchaio) একটি ‘ঘটনা’ সাজিয়েছিল যাতে রাত-পাহারায় নিযুক্ত জাপানী সৈন্যদের সঙ্গে এই অঞ্চলে অবস্থিত ২৯ নং চীনা বাহিনীর ইউনিটের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল।
আইনের দিক থেকে এই ঘটনাটি দেখলে এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ থাকে না যে জাপানীরাই অন্যায় করেছিল। যদিও ১৯০১ সালের বক্সার চুক্তি অনুসারে পেপিং দূতাবাস এলাকায় এবং পেপিং-টিয়েনসিন রেলপথের কয়েকটি স্থানে সৈন্য রাখার অধিকার তাদের ছিল, তারা কিন্তু নির্দিষ্ট এলাকাগুলির বাইরেও সৈন্য পাঠাত এবং চুক্তি অনুসারে সমুদ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার চেয়ে বরং তাতে বাধা সৃষ্টি করত। যা হোক, এই সংঘর্ষের অল্প পরেই জাপান সরকার নিম্নলিখিত দাবিগুলি পেশ করেছিল:
১. পেপিং-এর পশ্চিম থেকে ২৯ নং সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার।
২. সংঘর্ষের জন্য দায়ী চীনাদের শাস্তিবিধান।
৩. উত্তর চীনে সব রকম জাপ-বিরোধী কাজের যথোচিত নিয়ন্ত্রণ এবং
৪. কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগুলি প্রয়োগ করা।
জানা যায় যে ১৯ জুলাই Hopei-Chahar Political Council এই দাবিগুলি মেনে নিয়েছিল এবং সমাধানের শর্তগুলি ২৩ জুলাই টোকিওতে প্রকাশিত হয়েছিল। চীনারা আশা করেছিল যে চীনা ও জাপানী সৈন্যবাহিনী উভয়েই সংশ্লিষ্ট এলাকা থেকে সরে যাবে এবং খুব সম্ভব নানকিং অনিচ্ছাসত্ত্বেও এই সমাধান অনুমোদন করবে। কিন্তু যখন জাপানী সৈন্যবাহিনী ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেল না তখন চীনা সৈন্যদলের অধস্তন অফিসার ও সাধারণ সৈন্যরা ওই এলাকা ছাড়তে অস্বীকার করে। জাপানী কম্যান্ডাররা ২৬ জুলাই এই মর্মে চরমপত্র দিলেন যে, ২৮ জুলাই মধ্যাহ্নের মধ্যে চীনা সৈন্যদের অবশ্যই প্রত্যাহার করে নিতে হবে। তারা যেতে অস্বীকার করে এবং তখন জাপানীরা তাদের বলপূর্বক উৎখাত করতে অগ্রসর হয়। এভাবে যুদ্ধ আরম্ভ হল।
যদিও নানকিং-এর ডিরেক্টার মাশাল চিয়াং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নন, তবু তিনি জাপানের বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং মনে হয় না বিনা যুদ্ধে তিনি আত্মসমর্পণ করবেন।
জাপানীরা সুদীর্ঘ সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে এবং জাপানের ডায়েট (Diet) ইতিমধ্যে এই অভিযানের জন্যে প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করেছে। জানা গিয়েছে যে ১৯৩৮ সালের জানুয়ারি মাসের শেষপর্যন্ত ওই যুদ্ধ চালাবার জন্যে জাপান ১১,৭৬,৫০,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত ব্যয় করবে।
দূর প্রাচ্যে যুদ্ধের সাম্প্রতিকতম অবস্থা হল, যুদ্ধ সাংহাই অঞ্চল পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। সাংহাই-এর নিকটে Hungjao বিমানঘাঁটিতে ৯ আগস্ট একটি নতুন ‘ঘটনা’ ঘটেছিল। জাপানী নৌবাহিনীর দু’জন অফিসার বিমানঘাঁটিতে প্রবেশ করতে চেষ্টা করলে তাঁদিকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এরপরে জাপানী নৌবাহিনী এই গুলি চালানোর প্রতিশোধ নেবার জন্যে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। জাপানী এ্যাডমিরাল দাবি করেছিলেন যে, সাংহাই থেকে অন্তত ৩০ মাইল দূরে চীনা সৈন্যকে সরিয়ে নিতে হবে এবং এ-অঞ্চলে যেসব প্রতিরোধ ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলি অবিলম্বে ভেঙ্গে ফেলতে হবে। এই দাবির উত্তরে চীনের পক্ষ থেকে স্থানীয় সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধি করতে নানকিং থেকে ৮৮ নং ডিভিসনকে সাংহাই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল। জাপানীরা একে ১৯৩২ সালের চুক্তির নির্লজ্জ লঙ্ঘন বলে মনে করেছিল কিন্তু চীনারা প্রত্যুত্তরে বলেছিল যে জাপানীরা নিজেরাই তো চীনা ভূখণ্ডে সৈন্য সমাবেশ করে এবং ঘটনাস্থলে এক বিরাট নৌবহর এনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে চীনকে সেই চুক্তির শর্ত মানার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে।
এভাবে পেপিং এবং সাংহাই এই দুই রণাঙ্গনে যুদ্ধ চলছে। এ প্রসঙ্গে একটি মূল প্রশ্ন এই যে, কোন্ পক্ষ সাংহাই-এর রণাঙ্গনে যুদ্ধ সম্প্রসারণ করতে চেয়েছিল? খুব সম্ভবত জাপানীরা।
নানকিং-এর সৈন্যবাহিনীর হোপেই প্রদেশে প্রবেশ করার পর স্থলভূমিতে আটকা পড়ে গিয়ে জাপান সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল। মার্শাল চিয়াং পেপিং-এর (জাপানের অধিকারভুক্ত) চারদিকে যে-রকম সুপরিকল্পিতভাবে অৰ্ধবৃত্তাকারে সৈন্য সাজিয়েছেন তা রণকৌশলের দিক থেকে খুব সাহসী এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সরকারি বাহিনীর বাম প্রান্ত রয়েছে প্রসিদ্ধ গিরিপথ ন্যাংকাউতে যেখানে পেপিং-পাওতাও রেলপথ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে চলে গেছে। এই অর্ধবৃত্তের কেন্দ্র হল হ্যাংকাউ রেলপথে পেপিং-এর ১০০ মাইল দক্ষিণে পাওটিংফু। জাপানের অধিকারভুক্ত টিয়েনসিনের ৩০ মাইলের মধ্যে দক্ষিণ প্রান্ত প্রসারিত। এই অর্ধবৃত্তকে—‘হিন্ডেনবার্গ’ লাইনকে—ভেঙ্গে ফেলা খুবই কঠিন কাজ। সেজন্যে চীনা প্রতিরোধ দুর্বল করার উদ্দেশ্যে সমর-কৌশলের দিক থেকে সাংহাই আক্রমণের সিদ্ধান্ত করা হয়েছে।
চীনের হৃদয় বলে যদি কিছু থাকে তবে তা হল ইয়াং-সি-র মোহনায় অবস্থিত অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বিদেশী-নিয়ন্ত্রিত শিল্প বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্রকে অবিন্যস্ত করে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে বিপন্ন, জাতীয় চেতনাকে দুর্বল এবং চীনা বুর্জোয়াদের সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্যে জাপান চীনের এই হৃদয়কে আক্রমণ করেছে।
সাংহাই কার্যত এখন জাপানী নৌবাহিনীর আয়ত্তে এবং এই সমৃদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান শহরের ওপর আক্রমণ স্পষ্টতই যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার উপায় মাত্র। যুদ্ধের ফলে বাণিজ্য কী পরিমাণে বিপর্যস্ত হবে এবং বাস্তবে ক্ষতি কতটা হবে তার ওপর কিন্তু এই আক্রমণের কার্যকারিতা নির্ভর করবে।
যুদ্ধ বেশ কিছুকাল ধরে চলবে। একজন বিশিষ্ট সমরবিশারদ বলেছেন যে, জাপান চেষ্টা করবে “অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে কেটে ফেলার উদ্দেশ্যে চীনের হৃদয়কে অবশ করে ফেলতে। সেজন্যে সাংহাই-এর যুদ্ধের ফলে চীন হয় উঠে দাঁড়াবে কিংবা পড়ে যাবে।” চীন কী এই রক্তস্নানের পর বেঁচে থাকতে পারবে? অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের জন্যে ক্যান্টন যদি উন্মুক্ত থাকে এবং সাংহাই-এর যুদ্ধের দরুন যদি গুরুতর রকমের ক্ষতি না হয়, তবে চীন হয়তো দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে জাপানের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব বিপন্ন করে তুলতে পারে। এ রকম মনে করার বিপরীত দিকটি হল এই যে, জাপানের নৌবাহিনী চীনের বন্দরগুলি অবরোধ করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া জাপানের জনগণের মধ্যে একটা যুদ্ধ-উন্মাদনা দেখা দিয়েছে। এই দ্বীপ-সাম্রাজ্যে সামরিক বাহিনী ও অসামরিক জনগণের লক্ষ্যের মধ্যে কোনও পার্থক্য মনে হয় নেই।
১৯৩১ সালে যেমন করেছিল সে রকম আবেদন চীন আবার লীগ অব নেশনসের কাছে করেছে। কিন্তু এ রকম এক জরুরি অবস্থায় এই মৃতপ্রায় লীগের মূল্য কতটুকু? বিশ্বের জনমত অবশ্য চীনের পক্ষে কিন্তু মেসিনগানের বিরুদ্ধে বিশ্বের জনমতের মূল্য তো বেশি নয়। চীনের ভবিষ্যৎ বাস্তবিকই অন্ধকারাচ্ছন্ন। সময় চীনের অনুকূল, এ রকম একটা শান্ত ধারণা এখন আর ঠিক নয়। আজ চীন সময়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে। ঈশ্বর করুন সে যেন সফল হয়।
নিজের জন্যে এবং এশিয়ার জন্যে জাপান অনেক বড় বড় কাজ করেছে। এই শতাব্দীর শুরুতে তার পুনর্জাগরণ আমাদের মহাদেশের সর্বত্র শিহরণ জাগিয়েছিল। জাপান দূর প্রাচ্যে শ্বেতকায়দের মর্যাদা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে এবং শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পাশ্চাত্যের সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এশীয় জাতি হিসেবে নিজের মর্যাদা সম্বন্ধে সে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং তা যুক্তিসঙ্গতও বটে। দূর প্রাচ্য থেকে পশ্চিমী শক্তিগুলিকে বিতাড়ন করতে সে কৃতসঙ্কল্প। কিন্তু সাম্রাজ্য না গড়ে, চীনা প্রজাতন্ত্রকে খণ্ডবিখণ্ড না করে, আর একটি গর্বিত, সংস্কৃতিবান ও প্রাচীন জাতিকে অপমানিত না করে এই সব-কিছু করা কি সম্ভব ছিল না? না, যে প্রশংসা জাপানের পাওয়া উচিত তাকে যে সে রকম প্রশংসা করা সত্ত্বেও চীনের এই দুর্দিনে আমরা সর্বান্তকরণে চীনের পাশে দাঁড়াতে চাই। চীনকে বেঁচে থাকতে হবে—তার নিজের জন্যে এবং মনুষ্যজাতির জন্যে। অতীতে অনেক সময় তার জীবনে যেমন ঘটেছে তেমনি এই বিরোধের ভস্মস্তূপ থেকে ফিনিক্সের মতো চীন আবার জেগে উঠবে।
আমরা যেন দূর প্রাচ্যের এই বিরোধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি। একটি নবযুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে ভারত প্রত্যেক দিকে জাতীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের সঙ্কল্প গ্রহণ করুক। তবে তা যেন সে অন্য জাতির স্বার্থহানি করে এবং আগ্রাসন এবং সাম্রাজ্যবাদের রক্ত-ঝরা পথে না করে।
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭
Modern Review, অক্টোবর ১৯৩৭ সংখ্যায় প্রকাশিত। সুভাষচন্দ্র বসুর Through Congress Eyes (কিতাবিস্তান, এলাহাবাদ এবং লন্ডন, ১৯৩৮) গ্রন্থে পুনর্মুদ্রিত।