লাস্ট টার্মিনাস

লাস্ট টার্মিনাস

পেছনের দরজার বাঁপাশ থেকে লম্বা আসন সামনের দরজার ডানপাশ পর্যন্ত চলে গেছে। হাফ লেডিজ, হাফ জেন্টস। এই রকম স্টেটবাস শহরে অনেক আছে। বিকেল। অফিস ভাঙা বাবুদের ভিড়। সবাই বিপ্লবী। হৃদয়ে তাল মারছে শ্লোগান—লড়াই লড়াই লললড়াই। একখানা ছাগুলে গোঁত্তা, তারপর টরপেডো। তারপরে নিতম্ব ঘূর্ণন। ধুমধাড়াক্কা হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে খুঁজে পেলুম। পেরেছি নিজেকে বসাতে পেরেছি। দু’ধরনের বসা আছে, দুটোর জন্যই আমরা ব্যাকুল। নিজেকে যেভাবেই হোক বাসে বসাব, আর নিজে মরে পরিবারকে পথে বসাব।

এদিক সেদিক অল্প স্বল্প কেটে ছড়ে গেছে। ও যাবেই। বাস তো আর ভেলভেট দিয়ে মোড়া যাবে না। আজও বসেছি এইটাই এক মহাসাফল্য। আমার বাঁদিক থেকেই মহিলা মহলের শুরু। একটি মেয়ে বসে আছে। মহিলা বা রমণী নয়, ভারী সুন্দরী একটি মেয়ে। আড়চোখে এক লহমার তাকানো। ওর বেশি—অভদ্রতা। ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে নেই। মনে মনে তাকাও। অ্যায়সা চাপ এপাশ থেকে ওপাশ থেকে, মেয়েটির কাঁধে আমার কাঁধে ঠেকে গেছে। ওপর বাহুতে ঠেকে গেছে ওপর বাহু। বাসে এমন হয়। কিছু মনে করতে নেই। কত বয়েস! কুড়ি হতে পারে, পঁচিশ হতে পারে, না, তিরিশ কখনওই নয়। তিরিশে শীত আসে। এ বসন্ত।

বাস গাদাই হচ্ছে। শয়ে শয়ে লাশ। খ্যাঁও ম্যাঁও। কথার টেনিস। নুড়ি পাথর। সামনেটা হয়ে গেল দুর্ভেদ্য চাইনিজ ওয়াল। আমার বাঁপাশে বসন্ত, ডানপাশে একটা পিপে। নাক দিয়ে ভসভস হাওয়া ছাড়ছেন। লাংস নয় তো হারমোনিয়ামের বেলো। মাঝে মাঝে গ্রাউন্ড ফ্লোর থার্ডফ্লোর ঢেঁকুর। বুঝেছি, পার্টির পয়সায় বিরিয়ানি হয়েছে।

সুইচ অফ করে দিলুম। বাসযাত্রী ট্রেনযাত্রীদের তাই করতে হয়। দেহ থেকে নিজেকে তুলে নিতে হয়। কলকাতার বাস নামক মর্গে লাশটা আছে, মন চলে গেছে লাস ভেগাসে। মনকে অতদূরে পাঠাতে হল না। বাঁদিকে ঠেলে দিলুম। কাঁধ থেকে ওপর বাহু। কোমল, শীতল, অনুকম্পার মতো। চোখ বুজিয়ে ফেললুম। রোজ যা করি। সহযাত্রীদের দেখতে চাই না। ধূর্ত মুখ, বোকা মুখ, সন্দেহবাদী মুখ, নিরীহ মুখ, বড় দাঁত, ভাঙা দাঁত, মরা চোখ, উগ্র চোখ। চোখ বোজা মাত্র সব অদৃশ্য। মাংসের পাঁচিল, ফারনেসের উত্তাপ, শব্দের ককটেল, ভ্যাপসা গন্ধ। অমৃতের পুত্ররা দলা পাকিয়ে চলেছে।

ইঞ্জিনের আর্তনাদ শোনা গেল। সামনের আর পেছনের কন্ডাকটর একই সঙ্গে বাসের লোহার চাদরে গোটা দুই চাপড় আর কয়েকবার ঘন্টা টেনে যাত্রা শুরু করলেন। দুপাশের ফুটবোর্ডে পাকাফলের মতো মানুষ নয় ভোটার ঝুলছে। ডান বাঁ সব কদমা হয়ে গেছে। পায়ে পায়ে কাঁচি চলছে।

টার্মিনাস চক্কর মেরে বাস রাস্তায় গিয়ে পড়ল। একটু যায় একটু থামে। কখনও গাড্ডায় কখনও সমতলে। গেল গেল, সামাল সামাল। দণ্ডায়মান পাঁচিল কখনও হেলে ফর্টিফাইভ, কখনও নাইনটি। ম্যালেরিয়া থাকলে কুলকুল ঘামে ছেড়ে গেল। অতীতের পাপ এক পোয়া কমল। নরকের কম্পিউটারে মেয়াদ মাইনাস হল। স্বর্গের ফিকসড ডিপোজিট কিছু যোগ হল।

পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ, এক, দেড়, দুই লেগে যেতে পারে। দমদম থেকে দিল্লি চলে গেল ধর্মতলা থেকে দক্ষিণেশ্বর পৌঁছল না। গাঁটের পর গাঁট। তবে বাঁ দিকের কথা ভেবে মনে হল, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হত। এই হঠাৎ পাওয়া অনুভূতি। এ তো অসভ্যতা নয় অবস্থিতি। অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এল।

যাঁরা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন তাঁরাও যদি বাসে বসতে পান তো ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন নেই। বেড়া টপকানো ভেড়া গোনারও প্রয়োজন নেই। আমার ডান পাশের বস্তাটি ঢুলতে শুরু করেছেন; কিন্তু আমার বাঁ পাশে কী হচ্ছে! শরীরের সঙ্গে সেঁটে থাকা হাতটা আরও কোমল হয়ে উঠছে। গরমে নরম হয়ে আসা আইসক্রিমের মতো। মেয়েটির দেহভার আমার শরীরের ওপর ক্রমশই বাড়ছে। মাথাটা আমার কানের কাছে চলে এসেছে। চুল সুড়সুড়ি দিচ্ছে। মিষ্টি একটা গন্ধ আসছে নাকে। আড়ে তাকালুম। ঘুমিয়ে পড়েছে, যাকে বলে ঘুমে কাদা। মাথা নামছে আমার বাঁ কাঁধের দিকে। ভয়ঙ্কর কাণ্ড। পাবলিকের সামনে। ধাক্কা মারতে পারছি না। পাশের বস্তাটাকে ইতিমধ্যে দু-একবার মেরেছি। কাজ হয়নি কিছু। মেয়েটির বেলায় যে কারণে পারছি না, তা হল ধড়মড় করে জেগে উঠে যদি বলে, অসভ্য। যদি বলে, কাঁধটা কেন এগিয়ে দিয়েছেন, বদ মতলব। তারপর গণধোলাই! দ্বিতীয় কারণ, খুব মায়া হচ্ছে। কোন অফিসে কী কাজ তা তো জানি না, হয় তো খুব খাটায়। কতই বা মাইনে দেয়। ভাল-মন্দ কী-ই বা খেতে পায়! ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে ঢুলে পড়েছে। কে-ই বা একটু স্নেহ করে, কে-ই বা ভালবাসে! দশভুজা সংসার কেবল দেহি দেহি করছে—টাকা দাও, সেবা দাও, যৌবন দাও। মেয়েটিকে আমার খুব ভালবাসতে ইচ্ছে করল। এক নজরে যা দেখেছি—অনেক চুল, ঝিনুকের মতো কপাল, সুন্দর নাক, ভুরু, চোখ। শান্ত মুখ। ভালবাসার মতোই একটি মেয়ে। একটা ছেলে একটা মেয়েকে যদি ভালবাসতেই না পারল তাহলে মাটির পৃথিবী পনপন করে ঘুরছে কেন, ফুলই বা ফুটছে কেন, নদীই বা বইছে কেন, ইত্যাদি।

মেয়েটির মাথা আমার বাঁ কাঁধে নেমে পড়েছে। শুধু পড়েইনি, বেশ জুতসইভাবে চেপে বসেছে। চুলে ভরা সুন্দর একটি মাথা। কাঠ হয়ে চোখ বুজিয়ে বসে আছি। নট নড়নচড়ন, নট কিচ্ছু। তিনটে কারণ। প্রথম কারণ, পাবলিক। পরশ্রীকাতর, পরস্ত্রীকাতর,। একজন একটু সুখে আছে দেখলেই বাগড়া দেবে। নিজে খাবে না অন্যকেও খেতে দেবে না। বললেই হল, কাঁধে মাথা পড়েছে, ঠেলে তুলে দিন। বসে বসে মজা মারছেন। খুব রস, তাই না! যেন নিজেদের চোখে বালি পড়েছে। দ্বিতীয় কারণ, দোলাদুলি করলেই ঘুম ভেঙে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা তুলে নেবে। অবশ্য এ-ও জানি, আবার ঢুল আসবে, আবার মাথা হেলবে, আবার কাঁধে আসবে। মাঝের এই বিরতিটা আমি চাইছি না। বাসে নিত্য যাওয়া-আসা করতে করতে চুল সম্পর্কে আমি যথেষ্ট গবেষণা করেছি। রাজনীতির মতো এতেও ডান, বাঁ আছে। কেউ ডাইনে হেলেন, কেউ বাঁয়ে। মেয়েটি দক্ষিণপন্থী। তৃতীয় কারণ, মেয়েরা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চালান করে দিতে একখানি। চাং করে জেগে উঠেই বলতে পারে, আপনার কাঁধ আমার মাথায় কেন? কিছুতেই বোঝাতে পারব না, মাথায় কাঁধ থাকতে পারে না, কাঁধেই মাথা থাকে। মাথাই ঢোলে, কাঁধ ঢেলে না। দেহের কনস্ট্রাকশনটাই এমন! একমাত্র ব্যতিক্রম পায়ের জুতো। সময় সময় মাথায় ওঠে, গালেও উঠতে পারে। আমার এক সহপাঠীর যেমন হয়েছিল। দোলের দিন রঙের আবেগে পাড়ার একটি মেয়েকে বলেছিল, দোয়েল, আই লাভ ইউ। বেরসিক দোয়েল দাঁড়কাকের মতো গলায় বলেছিল, তোমার মুখে জুতো। তারপর স্যান্ডেল খুলে পটাপট। সেই থেকে আমার সেই বন্ধুর নাম হয়ে গেল, স্যান্ডেল। সে এখন আমেরিকায়। এক মেকসিকান সুন্দরীকে বিয়ে করে মহাসুখে আছে।

আমি যেন যোগাসনে ধ্যানে বসে আছি, অর্ধনারীশ্বর। ডানদিকটা পুরুষ, বাঁ দিকটা রমণী। হরগৌরীর শহর সংস্করণ। শঙ্করাচার্যের হরগৌরী অষ্টকের একটি দুটি স্তবক মনে পড়ছে। আধখানা শিব আধখানা শিবানী। কস্তুরিকাচন্দনলেপনায়ৈ, শ্মশানভস্মাঙ্গবিলেপনায়, সৎকুণ্ডলায়ৈ ফণিকুণ্ডলায়। বাঁদিকে কস্তুরিকাচন্দন লিপ্ত গৌরী, ডানদিকের শরীর শ্মশানের ছাই মাখা, বাঁদিকে সুন্দর খোঁপা, ডানদিকে সাপের কুণ্ডল। কলকাতার বাসের কী বাহাদুরি ক্ষমতা! বাড়িওলা, ভাড়াটে, সিপিএম, কংগ্রেস কিছুক্ষণের জন্য হলেও হলাহলি, গলাগলি। কোলাকুলি অবস্থাতেই বলছে—বউকে বিধবা করে দেব। পাদানিতে যার পায়ের ওপর পা রেখে হাঁচোর পাঁচোর ঝোলা, তার সঙ্গেই পাঁয়তারা। বহু আগেই বাঙালির এই স্বভাব ধরা পড়েছে প্রবাদে—যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া। আমিও তো সেই বাঙালির বাঙালি।

বাস যত টার্মিনাসের দিকে এগচ্ছে ততই হালকা হচ্ছে। কাঠের মেঝে টিনের ছাত, উল্টোদিকের আসন, যাত্রী দেখা যাচ্ছে। আর তখনই আমার ভয় করছে। চলমান গণ-আদালত বিচারে নামলেই হল। মাথাটা যারই হোক, কাঁধটা তো তোমার! মানুষ না মরা পর্যন্ত কাঁধ দেওয়াটা অপসংস্কৃতির মধ্যে পড়ে। অতিশয় অপকর্ম।

অতএব আমি এমন সহজ ভাব করছি, যেন স্বামী স্ত্রী, হনিমুনে আছি। দণ্ডায়মান এক সরল মানুষ বলেই ফেললেন, আপনার স্ত্রী খুব ক্লান্ত। এই সময়টায় অমন হয়। আয়রন টায়রন খাওয়ান, সঙ্গে জিঙ্ক। লোহা আর দস্তা না খেলে ধস্তাধস্তি করবে কী করে!

এই সময়টায় মানে! প্রায় প্রবীণ মানুষটি কী বোঝাতে চাইছেন! একটু বোঝার চেষ্টা করেই মনে মনে আধ হাত জিভ কাটলুম। আমি যত না এগিয়েছি, ভদ্রলোক তার চেয়ে তিন চার বছর এগিয়ে গেছেন। একবার আড় চোখে বাঁ পাশে তাকালাম। কী গভীর, নিশ্চিন্ত নিদ্রা! হয়তো স্বপ্নও দেখছেন। রাজবাড়িতে সানাই বাজছে। বড় বড় রাজহাঁস ঘুরছে।

আমার স্টপেজ এসে গেছে। দশ মহাবিদ্যা লন্ড্রি, অবলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। আমার নামা হল না। কাঁধে যে দায়িত্ব নিয়েছি, সেই দায়িত্ব না নামাতে পারলে মুক্তি নেই। কিছু নামল, কিছু উঠল। বাস চলল। নিজের জায়গাটা ঘোঁৎ ঘোৎ করে পেছনে চলে যাচ্ছে দেখে মন ছটফট করল। তবু বসে রইলুম। খোঁটায় জড়িয়ে গেছে ঝুমকো লতা। খোঁটা কী আর সরতে পারে!

টার্মিনাস প্রায় এসে গেল। কেউ আর দাঁড়িয়ে নেই। যে-কজন বসে আছেন, বসে আছেন। সকলের মুখের ওপর দিয়েই অপরাধীর মন নিয়ে চোখ ঘোরালুম। কোনও মুখেই কোনও সন্দেহ নেই। সকলেই ধরে নিয়েছেন, আমরা স্বামী স্ত্রী। স্ত্রী ছাড়া এমন নির্ভয়ে প্রকাশ্য স্থানে পুরুষের কাঁধে মাথা ফেলে কে ঘুমোতে পারে। হিন্দু বিবাহ ব্যবস্থায় শিবের সংসার রচনার পথ করে দেয়। স্বামী স্ত্রী হরগৌরী।

এই সব ভাবতে ভাবতেই টার্মিনাস এসে গেল। সবাই দুমদাম নেমে গেলেন। তখনও ঘুম ভাঙেনি। আস্তে আলতো হাত মাথায় রেখে নাড়া দিলুম। শুনছেন, বাস শেষ হয়ে গেছে।

মাথাটা তড়াক করে কাঁধ ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। ভাগ্য ভাল কন্ডাক্টর সায়েব সব আলো নিবিয়ে দেননি। একটা আলো নাইটল্যাম্পের মতো জ্বলছিল।

হতচকিত মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, এটা কোথায়।

—লাস্ট টার্মিনাস।

—সে কী, আমি তো দু’ স্টপেজ আগে নামব।

—আপনি দু’ স্টপেজ। আর আমার যে পাঁচ স্টপেজ আগে নামার কথা। আপনার মাথা ফেলে নামতে পারিনি।

—ছি ছি। অ্যান্টি অ্যালার্জিক খেয়ে আমার এই অবস্থা! কিছু মনে করেননি তো!

—কিচ্ছু না।

দু’জনে নেমে এলুম। আর একটা বাস ধর্মতলায় যাওয়ার জন্য তৈরি। আলো, লোক, ঘন্টা, চিৎকার।

—চলুন ওইটায় উঠে পড়ি।

মেয়েটি বলল, আজ মঙ্গলবার, এতদুর যখন এসেই গেছি, দক্ষিণেশ্বরে মাকে একবার দর্শন করে যাই।

—আমাকে আপনার সঙ্গে নেবেন!

কথাটা বোমা ছোঁড়ার মতো দুম করে বলে সিঁটিয়ে রইলুম। কীভাবে ফাটে, কতটা শব্দ হয়।

সে বলল—মায়ের কাছে সবাই যেতে পারে। চলুন না।

হাঁটছি দু’জনে পাশাপাশি। প্রথমে অ্যালার্জির কথা হল। কেন অ্যালার্জি, কী অ্যালার্জি। তারপরে নিত্য যানযুদ্ধের কথা। তারপর চাকরির কথা। ক্রমশই সহজ হচ্ছি। মন্দিরের প্রবেশপথে প্রায় অন্তরঙ্গ যেন কত কালের পরিচয়। যেন ওই সুন্দর মাথাটা আমার কাঁধের জন্যেই তৈরি। ওই লম্বা লম্বা আঙুল আমার মুঠোয় ধরার জন্যেই। একজন প্রেমিকের যা যা ভাবা উচিত, আমি তাই ভাবছি। সামনে সে, একটু পেছনে আমি। তরতর করে হাঁটছে। সাহসী পদক্ষেপ। আত্মনির্ভর। ন্যাকা ন্যাকা, থ্যাসথেসে নয়। বাতাসে আঁচল উড়ছে। সার সার দোকানের আলোয় সে হাঁটছে। পৃথিবীটা বেবাক স্বপ্ন হয়ে গেল। কোথায় ডালহৌসি, কোথায় আমার নোনাধরা দেয়াল, শ্যাওলা ধরা কলতলা, কোথায় রাজপথের সংগ্রামী মিছিল, কোথায় সেই প্রবীণদের নিত্য প্যানপ্যানানি, মানুষ বাঁচবে কী করে, যা দিনকাল। ওসব চুলোয় যাক। ওমর খৈয়াম ভেতরে এসে পড়েছেন—

আজ ফাগুনের আগুন-জ্বালে/হুতাশ-বোনা শীতের বাস

পুড়িয়ে সে সব ছাই করে দাও/দাও আহুতি দুখের শ্বাস!

আয়ু-বিহগ্-খোঁজ রাখো কি/মেলিয়ে ডানা উড়ল হায়,

পেয়ালাটুকু শেষ করে নাও/এক চুমুকেই ফাগুন যায়।।

আরতি শুরু হয়ে গেছে। নাটমন্দিরে লাইন। আমার সামনে সে, পেছনে আমি। ভবতারিণী সামনে ঝলমলে মানুষের কাণ্ড দেখে জিভ কেটে হাসছেন। আমি মা দেখছি, খোঁপা দেখছি। আমি মা দেখছি, ঘাড় দেখছি। মা দেখছি, কাঁধ ঢালু চওড়া পিঠ দেখছি। আমি মা দেখছি, ব্লাউজের পেছনের হুক দেখছি। মনের এমন একটা অবস্থা হল, স্থান, কাল বোধটাই চলে গেল। মনে হতে লাগল, আমরা বহুদিন বিবাহিত। কোথাও আমাদের একটা প্রাচীন সংসার আছে, কোনও বটতলায়। বেড়া আছে, গাছ আছে, তুলসীমণ্ডপ আছে, ছাগল আছে।

বেকসুর সেই রাত। বকুলতলার ঘাটে জোয়ার ছলাৎছলাৎ নদীর ধারে, ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার আবহ শব্দে, কথাটা বলেই ফেললুম, ওই মাথাটা কাঁধে নয় বুকে চাই।

ভেবেছিলুম, ভুরু দুটো কোঁচকাবে। মুখ কঠোর হবে। ঠাস করে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবে। হল না। মোলায়েম একটা হাসি। খুব অর্থমাখানো দুটো চোখ। এক ঝলক চাঁদের আলো। সাদা পায়রার ফট ফট ডানা। অবশেষে দুর্দান্ত ঝাল সিঙাড়া, জিভ-ছ্যাঁকা চা।

ফ্যামিলি কোর্ট পারিবারিক আদালতের বিচারক চোখ তুলে বললেন—এত সুন্দর শুরুটাকে মাঝপথে এমন জগাখিচড়ি পাকিয়ে ফেললেন কী করে। কাঁধও রয়েছে, মাথাও রয়েছে, বাসও আছে। তাহলে বাঁধনটাকে হাতুড়ি মেরে দু’টুকরো করতে চাইছেন কেন? কাঁধটা মাথা থেকে সরাতে চাইছেন কেন?

—আমি যে গাড়ি কিনেছি।

অ বড়লোক হয়েছেন?

নল দিয়ে ছেঁড়া আলপিনের মতো বড়লোক শব্দটা প্যাঁক করে আঁতে এসে ফুটল। বড়লোক না হলে এত ছোটলোক হলুম কী করে! প্রেম হল মধ্যবিত্তের জুয়েল। আর ভোগ হল বড়লোকের বিড়ম্বনা। নিজের শরীরটার দিকে তাকাতে ঘেন্না করে। জল ভরা ভিস্তির মতো অশ্লীল। কামুকের চোখ। নেকড়ের থাবা। প্রেমের মতো নিঃসঙ্গ।

বিচারে বসেছেন, নামজাদা এক সাহিত্যিক। একটা সমাধানের রাস্তা তিনি খুঁজে বের করতে চাইছেন। মামলাটা ঝুলে আছে বেশ কিছুকাল। এর মধ্যে আমি অনেকটা উঠেছি। একতলার এঁদো বাড়ি ছেড়ে সাততলায় উঠেছি। আকাশের কাছাকাছি। উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিম সব খোলা। খিদিরপুরের জাহাজ, মাস্তুল খাড়া, দমদমের প্লেন নামা, গল্ফগ্রিনের টিভি মাস্তুল, সব দেখা যায়। অনেক আলো, অনেক বাতাস, ঝড় এলে সব দক্ষযজ্ঞ। আমি এখন ভাল খাই, ভাল পরি। তবে, সত্যিই উঠেছি, না পড়েছি, ঠিক বুঝতে পারি না। অন্ধকারের বাণিজ্য, অন্ধকারের টাকা। লালুদা, ভুলুদাদের রাজনৈতিক উপদ্রব। কষে বেল্ট বাঁধা, উর্দিপরা, ঘর্মাক্ত আইনের প্রভুদের নিত্য নৈবেদ্য, প্রেমহীন দেহসেবা। আমি লোকটা নষ্ট হয়ে গেছি একেবারে।

সাহিত্যিক বিচারক বলছেন, শুনতে পাচ্ছি, এই উথালপাথাল ভাবনার মধ্যেও—বুঝলেন, প্রথম বিয়েটাই বিয়ে, পরের সব তাপ্পি। কাপের হাতলটা ভেঙে গেলে সেটা আর কাপ থাকে না, হয়ে যায় গেলাস। বাইরে বড়লোক হলেও, ভেতরে একটু গরিব হওয়ার চেষ্টা করুন না। আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখেছেন?

তাকাতে পারিনি, কারণ, বিবেকটাকে কিছুতেই খুন করতে পারছি না। সে যে মনের কোন্ কন্দরে বসে আছে জানি না। যেই একা হই সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে। বৃদ্ধ পিতার মতো, বৃদ্ধা মাতার মতো। ছানি পড়া, মৃত মাছের মতো চোখ। কেবল তাকিয়ে থাকে। বলে না কিছুই। আর তখনই আমি নিজেকে নিজে বলতে থাকি, থাকবে না কিছুই। প্রোমোটারের তৈরি বাড়ির মতো হঠাৎ একদিন ভেঙে পড়বে।

মাধুরীর দিকে তাকালুম। রোগা হয়েছে। আগের সেই রঙ নেই। চুল কমে গেছে। মুখের আদল শক্ত হয়েছে। কষ্টে আছে, অভাবে আছে, আগুনে আছে। দশ বছর আগের সেই রাত ফিরে আসছে। মন্দির, আরতির শঙ্খঘন্টা, আলোছায়া, গঙ্গার জলের শব্দ, ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া। গরম সিঙাড়ার দাঁতে ধরা অংশের ফিকে ধোঁয়া, পেছন থেকে দেখা খোঁপা, কাঁধ, পিঠ, ব্লাউজের ভিকাট। একটু প্রেম, একটু কাম।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লুম। মাধুরীর হাতটা ধরে বললুম, ওঠো!

সাহিত্যিকের দিকে তাকিয়ে বললুম, লাস্ট টার্মিনাস পর্যন্তই যাব।

—খুলে যাবে না তো!

—খোলার চান্স নেই, টিল ডেথ ডু আস অ্যাপার্ট। কে কখন নেমে যাব, সেটা বলি কী করে। কার কাছে কত দূরের টিকিট, সে আমিও জানি না, ওও জানে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *