একদিন

একদিন

পরপর দাঁড়িয়ে আছে ষোলোটা সাদা অ্যাম্বাসাডার। সব কটাই ঝকঝকে নতুন, যেন এইমাত্র কারখানা থেকে বেরিয়ে এল। হাতে গরম। পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। সব বড়কর্তা। সি আর ডিসির নীচে কেউ নেই। ঝাঁক ঝাঁক ব্ল্যাক ক্যাট। প্রত্যেকের হাতে অটোমেটিক। একটু এদিক সেদিক হলেই ঝাঁজরা চালুনি বানিয়ে ছেড়ে দেবে। গোটা শরীরটাই ফুটো। আগে দুটো ফুটো দিয়ে শ্বাস নিতে, এখন গোটাটাই নাক। শয়ে শয়ে ফুটো। রাস্তার দুটো মাথাই বন্ধ। কিছুক্ষণের জন্য যান চলাচল করবে না। মুখ্যমন্ত্রী সচিবালয় থেকে বাড়ি ফিরছেন। জেড ক্যাটিগরির নিরাপত্তা ব্যবস্থা। কিছু করার নেই। চারপাশে ছারপোকার মতো টেররিস্ট। মানুষমারার সর্বাধুনিক ব্যবস্থা নিয়ে ঘুরছে। হরেক রকমের সব দাবি। সকলেই এক একটা স্বতন্ত্র স্বাধীনে রাজ্য চাইছে। কেউ কারও তাঁবে থাকবে না। সকলেরই কোমরে ভেলিগুড়ের মতো বিস্ফোরক। নাম তার আর ডি এক্স। পেছনে বোতাম ফিট করা, তলপেটে এক জোড়া ব্যাটারি, দু’গাছা লিকলিকে তার। কী, কেমন আছেন সার? ভাল আছি, তুমি কেমন আছ, বলার সময়ও মিলবে না। ব্লাম। দুজনেই স্বর্গে। কদমগাছের ডালে এক জোড়া আত্মা। সর্বাঙ্গে কদম ফুলের মতো রোমাঞ্চ। উই আর অন দি সেম ডাল ব্রাদার। দোলে দোদুল দোলে ঝুলোনা।

মেটাল ডিটেকটর দিয়ে পথঘাট দেখা হচ্ছে। প্রতিটি গাড়ির ভেতর ও তলা। পৃঙক্ষানুপুঙ্ক্ষ অনুসন্ধান। দুনিয়াকে বিশ্বাস নেই। কোথাকার কাজিয়া কোথায় চলে আসে কেউ জানে না। অমন সোনার চাঁদ ছেলেটাকে কেমন গলায় মালা দিয়ে, প্রণাম করার ভান করে ফদাফাই করে দিল। এক সেকেন্ড আগে বোঝা গিয়েছিল! কেন, এই যে হালফিল গেলেন পঞ্জাবের সি এম। সেও তো এই গাড়ি কেস! কোথায় বাড়ি যাবেন, না চলে গেলেন স্বর্গে।

পিঁক করে একটা শব্দ হল। সাবধান! টাইম বোমার টিকি। হলেও হতে পারে। না সামান্য জিনিস। একটা সেফটিপিন। বাস ধরার কোস্তাকুস্তিতে কারও বক্ষচ্যুত হয়েছে। কোথা থেকে একটা লেড়িকুকুর ব্যুহ ভেদ করে ঢুকে পড়েছে। সিকিউরিটির প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধার ভাব নেই এই সারমেয়কুলের। শেয়াল নিয়ে কী কেলেঙ্কারি! অভূতপূর্ব। এই এক কুকুর! ভোটার লিস্টে যাদের নাম আছে তাদেরই সমীহ করা হয় না আজকাল, এ ব্যাটা তো লিস্ট বহির্ভুত প্রাণী। তবে হ্যাঁ, ল্যাজে গোবরে করে দিতে ওস্তাদ। এদিকে তাড়ালে ওদিকে যায়, ওদিকে তাড়ালে এদিকে। ডগ স্কোয়াড রেডি ছিল। ক্যাঁক করে ধরে সোজা পলিথিন ব্যাগে চালান।

এই নিরুত্তেজক রুটিন ব্যাপারটায় যথেষ্ট উত্তেজনা আনার জন্য আমেরিকান কায়দায় কোডনেম দেওয়া যেতে পারে, যেমন অপারেশন ব্লু-ফক্স। রিসিভারে বিপ্‌বিপ বিপ্‌বিপ্‌ সিগন্যাল, হ্যালো হ্যালো মাইকেল, মাইকেল, ফ্রম দি কার্নিস, দে ডল ইজ রেডি ফর ডেলিভারি। প্যাকিং ইজ কমপ্লিট। মানে, তিনি অবতরণ করছেন। একা তো নয়। হিউম্যান ওয়াল দিয়ে ঘেরা। গাছের ডালে বসে টেলিস্কোপিক রাইফেল দিয়ে তাক করলেও সুবিধে হবে না। ফুটো হবে একটা ইট। বিধবা পাবেন তিন লাখ টাকা কমপেনসেসান।

এক ডজন মাথা বেরিয়ে এল। এর মধ্যে একটি মাথার মালিক সি এম। পরপর ষোলোটা গাড়ির দরজা খুলছে। বসবেন বেষী চয়েসে। তিনে বসবেন, কি পাঁচে, না সাতে, তৎক্ষণাৎ ঠিক হবে। এটাও সিকিউরিটি গেম। আগে ভাগে ঠিক করে রাখলে রক্ষীদের কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। রক্ষক ভক্ষক হতে কতক্ষণ। এ যুগে সবই সম্ভব।

সি এম ঝাঁকের মৌমাছির মতো এগচ্ছেন। চারপাশে সিকিউরিটির লোক। আধুনিক অস্ত্রধারী ব্ল্যাকক্যাটের দল। এক নম্বর গাড়ি, না। দু নম্বর, মনের সায় নেই। তিন নম্বর বাতিল। বাপ বাপ দরজা বন্ধ হচ্ছে। সি এম এগচ্ছেন। সবাই তটস্থ। জোড়া জোড়া চোখ ভূতল, উচ্চতল, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, নৈঋত, ঈশান, নজর রাখতেই ব্যস্ত। মৃত্যু গোলক যে কোনও দিক থেকেই ছুটে আসতে পারে।

সি এম আজ গুড মুডে। রাজ্যের কোথাও কোনও সমস্যা নেই। মেশিন স্মুথ চলছে। কেন্দ্র গেঁজে গেছে। হাওলা, গাওলায় রথী মহারথীরা ফ্ল্যাট। গুড টাইম। স্মুথ সেলিং। ভরাপালে সবাতাস। শিস দিতে ইচ্ছে করছে। নস্টালজিয়া আসছে।

সি এম অন্যমনস্ক ষোলোতম গাড়িটিও অতিক্রম করে, বেড়াফেড়া টপকে সোজা সামনে হেঁটে চলেছেন। প্রচণ্ড গুলতানিতে প্রহরীরা লক্ষই করল না। থাস করে বন্ধ হল শেষ গাড়ির দরজা। ইলেকট্রনিক সিগন্যাল এল বিপ্। পুরো ব্যাপারটার কন্ট্রোলে ছিল কম্পিউটার। ও কে সিগন্যাল। কনভয়ের যাত্রা শুরু হল। পাইলট কারে ওঁয়া ওঁয়া শব্দ। মাথার ওপর পাক মারছে লাল আলো। কোনও তফাত নেই, মরণাপন্ন রোগী তাম্বুলেনসে। ড্রিপ চলছে, পাখার বাতাস। সাইরেনে নবজাতকের কান্না। ছুটেছে হাসপালের দিকে। আন্ত্রিক অথবা হার্ট, অথবা ম্যালিগন্যান্ট মেলেরিয়া। মরে না যায়। সি এম বাড়ি ফিরছেন। যোলো রথের কনভয়। সেই একই কান্নার সুর সাইরেনে—ওঁয়া ওঁয়া। মৃত্যু যেন হাত না বাড়ায়। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে সিকিউরিটি আরও টাইট করা হবে। এয়ার কন্ডিশনড, অক্সিজেন ফিলড্ লোহার সিন্দুক, ভিভিআইপিদের জন্য। চারপাশে চারটে স্পিকার। ভেতরে অডিও সিস্টেম। সভায় এসে আসন গ্রহণ করলেন সিন্দুক। ফুলের মালা চাপানো হল। শুরু হল সিন্দুকের ভাষণ। বন্ধুগণ, আপনারাও ভালবাসেন, আমিও ভালবাসি। প্রেমের আলিঙ্গনে বাঁধা। শুধু টেকনিক্যাল কারণে, এই টেকনলজির যুগে, লখিন্দরের লোহার বাসরে ঢুকে আছি। মহাপ্রভুর মধ্যযুগ আর নেই। মাধাইরা তখন ইনোসেন্ট কলসির কানা ‘ছুঁড়ত। কপালে রুমাল চেপে বলা যেত, মেরেছিস কলসির কানা, তা বলে কি প্রেম দেব না। বন্ধুগণ, প্রেম আজও আছে। প্রেমের তালশাঁস ; কিন্তু অ্যাডভানস্ড মাধাইদের দাপটে এই লোহার বাসর ঘর। একালে মারলে খোল নলচে সব সেপারেট হয়ে যাবে।

যোলোখানা গাড়ি সঙ্গে যাবতীয় লটবহর বিশেষ রাস্তা ধরে তুরন্ত পৌঁছে গেল সিএম নিবাসে। সিকিউরিটির কর্মীরা একে একে দরজা খুলে ঠাস ঠাস স্যালুত ঠুকতে লাগলেন। কোনটায় খোদ মালিক আছেন কে জানে! ষোলোটা গাড়ির দরজা খোলা হল। আবোল তাবোল সবাই নেমে এলেন। সি এম নেই। সি এম মিসিং।

মাথায় হাত। এ আবার কী! নতুন ধরনের টেররিজম্। ভেতর থেকে আঁকসি দিয়ে তুলে নিয়ে গেল। জেল থেকে কয়েদি পালালে পাগলাঘণ্টি বাজানো হয়, এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত। আবার সাইরেন বাজানো হবে! জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি।

ওয়্যারলেস সক্রিয় হল। সারা ভারতে ছড়িয়ে গেল, সিক্রেট খবর সি এম ইজ মিস্টিরিয়াসলি মিসিং। রেড অ্যালার্ট জারি করে দেওয়া হল। সি, ডিসিকে বললেন, আসুন সপরিবারে রেজিগনেশান চিঠিটা লিখে ফেলা যাক। কর্তব্য কর্মে এমতো অবহেলা অভাবনীয়। রাজা ছাড়াই রথ চলে এল। ঢোলসহরত করে।

সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন পথের দুপাশে। কেলো টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। এদিকে কী হল! সি এম গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে সোজা বেড়া টপকে চলে এলেন। হাঁটতে হাঁটতে সোজা চার্চের কাছে। নিজের চোখেই দেখলেন, তাঁর কনভয় সাট সাট করে বেরিয়ে যাচ্ছে। তাঁর পাশ দিয়ে যেতে যেতে কে একজন বলে গেল, ‘কী দেখছেন! রাজা যাচ্ছেন। জনগণের দরদী সেবক।’

সি এম বললেন, কত খরচ জানেন?

—সে আর জানি না। হাতি পোষার খরচ।

একজন পোড় খাওয়া মধ্যবয়সী মহিলা রেলিং-এ লটারির টিকিট ঝুলিয়ে বিক্রি করছেন। সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই করুণ কণ্ঠে বললেন, একটা রয়াল ভুটান নিন না। কালকে ড্র। পঞ্চাশ লাখ। সি এম বুক পকেটে হাত দিলেন। সোনার কলম। টাকা কোথায়! কেরানি নাকি, যে টাকা নিয়ে বেরুবেন। কপর্দক শূন্য অবস্থা। সি এম-এর থেকে নিঃস্ব মানুষ কে আছে দেশে।

তাড়াতাড়ি সরে গেলেন।

ঝালমুড়ি বিক্রি হচ্ছে। বহুকাল খাওয়া হয়নি। জিভে জল এল। পকেটে পয়সা থাকলে সাহস করা যেত। জীবনের প্রথম দিকে পার্টি অফিসে খবরের কাগজে মুড়ি ঢেলে তরিবাদি করে মেখে সবাই মিলে খাওয়া হত। সঙ্গে দিশি পেঁয়াজি, কাঁচালঙ্কার হু হা। কোথায় গেল সেই দিন! সোনার খাঁচায় বন্দী পাখি।

পাশ দিয়ে যেতে যেতে এক ফচকে আধুনিক মন্তব্য করে গেল, জামাইবাবু জামাইষষ্ঠী সেই জষ্টি মাসে।

সচেতন হলেন। মলিন এই শহরের পক্ষে পাটভাঙা মিহি ধুতি পাঞ্জাবি বড়ই বেমানান। একালের মানুষ কী বেপরোয়া দুঃসাহসী। যাকে তাকে যাতা বলে দেয়। এইভাবে বেশিদিন ঘোরাঘুরি চলবে না।

ধাবমান বাস, মিনিবাসের দিকে তাকালেন। চলন্ত ঝুলন্ত সাকার্স। তামাটে বর্ণের শক্তপোক্ত মানুষের গুঁতোগুতি। ওর পাদানিতে স্থান করে নেওয়ার দুঃসাহস নেই। মানুষ এইভাবে দিনের পর দিন যাতায়াত করে। পপুলেশন কী হারে বেড়েছে। কোথায় গেল ফ্যামিলি প্ল্যানিং।

একটা খালি ট্যাকসি। হাত দেখালেন। চালক মুখ ভেংচে চলে গেল। যা শুনেছেন, তাই ঠিক। নম্বরটা নিলে হত। সি এমকে রিফিউজ করার ঠেলাটা একবার বুঝত।

সামনেই বিশাল একটা ঘড়ির দোকান। নানা রকমের অজস্র ঘড়ি। হাজার বারোশো, সাতশো তিনশো। সবই সময়ের ট্যাবলেট। মানুষও তো ঘড়ি! দার্শনিকতা ভাল লাগে না। মেয়েলিপনা যেন। যে ইজ নিয়ে আছেন, তাতে জীবন নিয়ে প্যানপ্যানানি নেই, ঈশ্বর নেই। দুধরনের মানুষের লাগাতার সংগ্রাম—হ্যাভস আর হাভ নটস-এর লাগাতার কোস্তাকুস্তি মারো আর মরো। তবু সময় তো রয়েছে। উলটো রেল। ভবিষ্যতের মেলট্রেন বর্তমান-স্টেশনে হল্ট করে অতীতের ইয়ার্ডের দিকে ছুটছে। মানুষ হল বর্তমান স্টেশনের স্টেশনমাস্টার। হাতে গ্রিন সিগন্যাল। কোথায় গেল শৈশব, যৌবন! খেলার মাঠ, নদীর ধার, ছাত্রজীবনের বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, পরীক্ষা, ফিফটিন মিনিটস মোর। হ্যাপি বয়, আইসক্রিম, আলকাবলি, নটি বয় শু।

পাশে এক প্রবীণ মানুষ এসে দাঁড়ালেন। আড়ে আড়ে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।

—টেলিভিশান।

—টিভিস্টার? নাটক টাটক করেন?

—কেউ কেউ সেই রকমই বলে। তা নয়, আপনি দেখেছেন নিরুদ্দেশ বিজ্ঞাপনে। কী দুঃখের কথা মশাই, আমি হারিয়ে গেছি। লস্ট ফর এভার। আমাকে কেউ খুঁজে পাচ্ছে না, আমিও কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।

ভদ্রলোক সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে একটি মন্তব্যই করলেন—পাগল! সত্যিই গরম পড়েছে।

আবার একটা ট্যাকসি। এবার দাঁড়াল। চালকের চেহারাটি বেশ ভোলেভালে।

কোথায় যাবেন?

—যেখানে যাব, সেখানেই যাবেন তো?

—জাহান্নাম ছাড়া। বেশি পাঁয়তারা না করে উঠে বসুন, মামু এক্ষুনি নম্বর নিয়ে নেবে। সি এম উঠতে উঠতে বললেন, মামুরা তাহলে কাজ করছে?

—ঘোড়ার ডিম করছে। এদিকে লরি নেই তাই আমাদের ধরে টানাটানি। রোজগার তো চাই।।

যা দিনকাল। পটলের কিলো তিরিশ, আলু ছয়। চাল বারো, ষোলো, চল্লিশ। মাছ আশি নব্বই। চিংড়ি তো পোকা, সাড়ে তিনশো, চারশো। ওই হাওলা আর গাওলারাই বাঁচবে। আমাদের দিন শেষ।

—আমাদের সরকার কেমন চলছে!

—নিজের তো সংসার আছে। বুঝতে পারছেন না! রোজ সকালে বাজার তো যান! আস্ত আস্ত নোট উড়ে যাচ্ছে, ছোট্ট একটা থলে ভরছে না।

—এবারের নির্বাচনে কী হবে!

—কেন ওইসব ফালতু কোশ্চেন করছেন। সাধারণ মানুষের কাছে নির্বাচন কোনও ফ্যাকটর নয়। যে যাবে লঙ্কায় সেই হবে রাবণ। আমার ছেলেটা এম এ বিটি করে বসে আছে তিন বছর। মাস্টারির চানস্ পাচ্ছে না। বলছে, পোস্টার লেখো, আমাদের লোক হও তবে হবে। আমাদের লোক তোমাদের লোক কী! সব লোকই তো লোক। লে হালুয়া।

—ছেলেটাকে তাহলে মানুষ করেছেন?

—অনেক কষ্টে। ড্রাইভারি লাইনে সবাই মদ খেয়ে উড়িয়ে দেয়, আমি জল ছাড়া কিছুই খাই না। আমি পরিবার বাড়াইনি। সংযম করেছি। একটাই মাত্র ছেলে। এখন মনে হচ্ছে মানুষ করে ভুল করেছি। অমানুষের জগতে মানুষকে তো না খেয়ে মরতে হবে। রাজনীতিতে পাঠালে করে খেত। এতদিনে মন্ত্রী না হোক, প্রোমোটার কি কন্ট্রাকটর হত। গাড়ি থেমে গেল। সামনে বিশাল জ্যাম।

—কী হল ভাই।

—কী আবার হল। বসে বসে ঘামুন, আর ডিজেলের গন্ধ শুকুন। এই শহরের একটাই তো ব্যামো। মিছিল। চলছে না চলবে না। এর নাম লড়াই। লড়াই লড়াই লড়াই লড়াই। মিছিলের মাথাটা গাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সি এম মুখ বাড়িয়ে নেতার মতো একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, কত বড়?

অশ্লীল গালাগালি ও উত্তর, ট্যাকসিতে বসে রিপোর্টারি হচ্ছে চাঁদু। মালাইকারি বানিয়ে দোবো। গাড়ির চালক বললেন, ঠিক হয়েছে। পার্টির লোককে কিছু জিজ্ঞেস করতে আছে! আপনার জন্য আমার গাড়িটা ভাঙচুর হয়ে যাবে।

সি এম পেছনে বসে দেখছেন, স্টিয়ারিং-এ শক্ত সমর্থ একজন প্রকৃত মেহনতী মানুষ। চওড়া পিঠ। শক্ত ঘাড়। আবার গুনগুন করে গান গাইছে, এ মণিহার আমায় নাহি সাজে। বহুকাল পরে একটা রিয়েল মানুষ দেখছেন। গায়ে ঘামের গন্ধ, মুখটা তেলতেলে, কদম ছাঁট চুল। সর্বদা যাঁরা তাকে ঘিরে থাকে, সেই ধান্দাবাজ, পানমশলা খাওয়া থলথলে, গদগদে লোকগুলোর একজন নয়। এদের জন্যই তো কিছু করার কথা ছিল! সে আর হল কই! দেশ থেকে মানুষই অদৃশ্য হয়ে গেল। কাতারে কাতারে এরা কারা! সব কিছুই রংট্র‍্যাকে চলে গেছে মিস্টার সি এম। আর তো ফেরা যাবে না।

অনেকক্ষণ পরে গাড়ি আবার চলল। জটিল যান জটলা। উদভ্রান্ত মানুষ। রংচটা নোনাধরা বিখ্যাত সেই হাসপাতাল। ডাবপটি, ফলপটি, চৈত্রের সেল, ফুটপাথ জুড়ে কালোয়ারদের লোহার কালোয়াতি।

সি এম ফিরলেন। দূর থেকে দেখছেন, তাঁর আলয়ের সামনে বিশাল জটলা। ব্যারিকেড কর্ডন। কে একজন বলছে। সি এম পালিয়েছে।

উত্তর এল, আপনাদের কত অত্যাচার আর সইবেন।

ট্যাকসির চালক বললেন, আর তো যাওয়া যাবে না সার। এ তো রেডলাইট এরিয়া। সি এম চমকালেন, ইংরেজিটা ঠিক হল না। ইওর ম্যাজেস্টি লুকস ব্লাডির মতো হয়ে গেল। যাক গে, সংশোধন করার আর সময় নেই। সবাই রেরে রেরে করে ছুটে আসছে।

ডিসি উকি মেরেই আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন, সার এসে গেছেন, সার এসে গেছেন।

সি এম কান দিলেন না। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?

—আজ্ঞে গোপাল সাধু। কোনও অপরাধ করিনি তো! গরিব মানুষ সার।

—অপরাধ! আপনার ছেলের চাকরির ব্যবস্থা আমি করব।

—না, সার। দেশের আর দশটা মানুষ থেকে তাকে আলাদা করে দেবেন না।

এইভাবে বাঁচতে বাঁচতে সে বাঁচাটা শিখে যাবে। আপনারা যেমন আছেন সেই রকমই থাকুন, আমরা যেমন আছি সেইরকমই থাকি।

আর বেশি কথা হল না। সিস্টেম সি এমকে সোনার শিকলে বেঁধে সুরম্য বৈঠকখানায় এনে শরীর ডুবে যাওয়া সোফায় বসিয়ে দিল।

সি আর ডিসি আর ডিডি আর এসি আর আর সবাই সামনে অধোবদন।

—সার আমরা এক মাস রেজিগনেশন দিচ্ছি। প্লিজ অ্যাকসেপ্ট ইট।

সি এম হাহা করে হেসে উঠলেন। এমন হাসি জীবনে আসেননি। তলপেট থেকে উঠছে। হাসতে হাসতে বললেন, আপনাদের সব ডবল তিনডবল প্রোমোশন হবে। আপনাদের কৃপায় আজ আমি রিয়েল কিছু মানুষ দেখলুম মশাই। জ্বলজ্যান্ত মানুষ। আমার অতীতটাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য ফিরে পেয়েছিলুম। রিয়েল লাইফ। আমরা কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি, কী থেকে কী হয়েছি। ভাবছি, আমিই রেজিগনেশন দেব।

ঘরসুদ্ধ সবাই হায় হায় করে উঠলেন, সার অমন কাজটি স্বার্থপরের মতো করবেন না, এত অপোগ তাহলে যাবে কোথায়!

সবাই সোজা হয়ে মিলিটারি কায়দায় ঠাস ঠাস স্যালুট বাজাতে লাগলেন। পার্টির কিছু লোক ঢেকুর তোলার কায়দায় বলতে লাগলেন, যুগ যুগ জিয়ো, যুগ যুগ জিয়ো।।

সি এম মনে মনে যোগ করলেন, জিওল মাছের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *