তিন ছটাক

তিন ছটাক

হাওড়া স্টেশন থেকে বর্ধমান লোক্যালে উঠলুম। ব্যান্ডেলে এসে দাঁড়িয়ে গেল। যাচ্ছে না। আধঘন্টা, একঘন্টা। কী ব্যামোয় ধরল। লাইনে অবরোধ। কাল রাতে কোনও এক পার্টির নেতাকে কিনা করেছে। প্রতিবাদে রেল রোকো।

ট্রেনের আসনে যারা বসেছিলেন, তাঁরা বসেই রইলেন। উঠলেই জায়গা দখল হয়ে যাবে। যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা ওঠা-নামা করতে লাগলেন। আমি বসেছিলুম, বসেই রইলুম। এক প্যাকেট বাদাম, দুটো চাঁপা কলা, একভাঁড় চা খেলুম। সময় যাচ্ছে, পেট ফুলছে। তিনটে তিন পার্টির মাল পেটে ঢুকে অ্যাসেম্‌ব্লি ভাঙার চেষ্টা করছে। কামরা কখনও ফাঁকা হচ্ছে, কখনও ভরে যাচ্ছে। পাখার জায়গায় পাখা নেই, গোল একটা গর্ত। আমাদের অসীম ধৈর্য, আমরা বসে আছি।

খবর এল। ট্রেন ছাড়বে। বর্ধমান লোক্যাল, ব্যান্ডেল লোক্যাল হয়ে হাওড়ায় ফিরবে।

ফিরে এলুম হাওড়ায়। আমার বাড়ি হাবড়ায়। বর্ধমান যাওয়া হল না। শিয়ালদায় গিয়ে বনগাঁ লোক্যাল ধরব।

বাইরের টারমিনাসে গিয়ে বাস ধরলুম। মহাত্মা গান্ধী রোডে আটকে গেল। সারা কলকাতায় গোটা সাতেক মিছিল বেরিয়েছে বিভিন্ন দাবি ও প্রতিবাদে। রাগী রাগী মানুষ হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে চলেছে, এদিক থেকে ওদিকে, ওদিক থেকে এদিকে।

বাসের আসনে যাঁরা বসেছিলেন তাঁরা ঘুমিয়ে পড়লেন, যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা ঢুলতে লাগলেন। বাস চলছে না, তবু মানুষ গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে উঠছে। আজ না চলুক কাল তো চলবে। আমি দাঁড়িয়েছিলুম, দুমড়ে মুচড়ে গুঁতোতে গুঁতোতে নেমে পড়লুম। তিন চার জনের পা মাড়ালুম, একজনের মাথার চাঁদোয়ায় কনুই ঠুকে দিলুম।

ব্যাপারটা এতই পারস্পরিক কেউ কিছু বলল না। গিভ অ্যান্ড টেক। মানুষ এত বেড়ে গেছে মারামারি হবেই। আজ আমি মারব, কাল তুমি মারবে। হাঁটতে লাগলুম। হাঁটছি তো হাঁটছিই। কিছুই মনে হচ্ছে না, কোনও ক্ষোভ, কোনও ক্রোধ নেই। মাথা যেন মাটির ঢেলা। কোনও ব্যাপারই খোপড়িতে ঢোকে না। বলা আছে শিয়ালদা, চলেছি শিয়ালদা। কী আছে চারপাশে, কী হচ্ছে চারপাশে কিছুই দেখছি না। স্পিলবার্গের রোবটের মতো হাঁটছি।

গলদঘর্ম হয়ে শিয়ালদায়। আড়াই হাজার লোক বাইরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে দরজা বন্ধ করে মোকাবিলা হচ্ছে। গুলি, ইট একসঙ্গে চলছে। সৃষ্টির আজ শেষ দিন। আধখানা নামিয়ে দিয়েছে। বনগাঁ লোক্যাল বনে চলে গেছে। স্বাভাবিক অবস্থা আজ হোক কাল হোক ফিরবে।

আচ্ছা হাবড়া থাক, বরানগর যাওয়ার চেষ্টা করি। মামার বাড়ি। অনেকদিন আদর খাওয়া হয়নি। বাস চলেছে ছ্যাকরা গাড়ির মতো। টালায় এসে স্ট্যান্ড স্টিল। নেমে যেতে পারেন। এবেলা এই পর্যন্ত। সেদিন পাড়ার এক গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে ক্লাবের ছেলেরা প্রতিবাদ করেছিল। সেই প্রতিবাদে চিঁড়িয়ার মোড়ে পথসভা হচ্ছে। এদিকে ওদিকে বাড়ির পেছনে গাড়ি। তিনটে অ্যাম্বুলেনসে তিনটে এমারজেন্সি, একটা হার্ট, একটা ডেলিভারি, একটা আন্ত্রিক। সাদা অ্যামবাসাডারে লাল আলো গুলগুল করে ঘুরছে। পেছনের আসনে ভারী চেহারার মন্ত্রী মন দিয়ে লেখাপড়া করছেন। লাল মারুতির পেছনের সিটে গাবলু মার্কা বাচ্চা ললিপপ চুষছে। সাদা কন্টেসায় ‘টাইম ইজ মানি’-ব্যবসায়ী সাফারি পরে ক্যালকুলেটারে কুট কুট করে অঙ্ক কষছেন, কোলের ওপর ডায়েরি।

বরানগরে মামার বাড়ি। চিলি চিকেন, ফ্রায়েড রাইস। প্রচুর খিদে, তাহলে হাঁটি। রাস্তার দু পাশে রাস্তার কাঁচা মাল, ঢিপি, গুটলে, তরল পদার্থ। মাঝখানে এক জায়গায় রাস্তার পেট ফেটে গেছে। পলতার জল গলগল।

নির্বিকার। কিছুই মনে হচ্ছে না। কী হওয়া উচিত ছিল, কী হয়েছে। কেন হয়নি, কেন হবে না। যান্ত্রিক মানুষ। দুটো ঠ্যাং। কোমরের দু’পাশে দুটো কবজা, হিঞ্জ। বুকে একটা টুলুপাম্প। তিন বালতি রক্ত, একতলা থেকে তিনতলায় তুলছে। প্লাম্বার পাইপলাইন করে রেখেছে। ইঞ্জিন চলছে। সেই জোরে দুটো ঠ্যাং ডিভাইডারের মতো রাস্তা ডিভাইড করছে। কান শুনছে, কথা নয়, তালগোল পাকানো শব্দ। চোখ দেখছে ‘আউট অফ ফোকাস’ দৃশ্য।

সিঁথির মোড়ের সায়েবি দোকানে একটা ফ্যালফ্যালে আইসক্রিম খেয়ে ফেলেছি, ভ্যালভ্যালে চোখে। সেই সময়টায় মনে হচ্ছিল ‘নটি বয়’। এ দেশে দুর্গাপুজো হয়। সামনের মাঠে সার্কাসও হয়। অটো আর রিকশায় জট পাকিয়ে আছে। নিঃশঙ্ক মানুষ মোড়ের মাথায় রাস্তাজুড়ে পেঙ্গুইন পাখি। খুব ভ্যাঁক ভ্যাঁক করলে একটু হেলতে পারে।

১৯৪৭ সাল, ভারত স্বাধীন হল। স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ। হ্যাঁচড়াতে পারে, ছ্যাঁচড়াতে পারে, মারতে পারে, মরতে পারে, পোড়াতে পারে, পুড়তে পারে জয় হিন্দ।

মামার বাড়ির সামনে এক ছটাক জমি আছে। দরজায় একটা কলিংবেল আছে। টেপা মাত্রই হিন্দি গান। দরজা খুলল না। আবার টিপলুম। অন্য একটা গান। এইবার অসীম বিরক্তি ভরা মুখ নিয়ে একজন মহিলা দরজা খুললেন। মাস তিনেক আগে যখন একবার এসেছিলুম, তখন একে দেখিনি। মনে হয় নতুন কাজে লেগেছে। বয়েস বেশি নয়। খ্যানখেনে গলায় বলল, ‘এখন বাড়িতে কেউ নেই।’

আমি একটু রসিকতা করার জন্য বললুম, ‘কেউ নেই বলাটা উচিত হল না, দিনকাল খারাপ। রিভলভার নিয়ে ঠেলে ঢুকে পড়লে একা সামলাতে পারবে? কাঁচা কাজ করলে।’

‘একবার ঢোকার চেষ্টা করে দেখো না। কালো মতো এত বড় একটা কুকুর আছে। ডাঁটা চিবিয়ে নেবে।’

‘আরে আমি তোমার বাবুর ভাগনে। আমাকে তুমি দেখোনি তাই।’

‘সে তুমি ভাগনেই হও আর ভাসুর পো-ই হও। ওদের অবত্তমানে বাড়িতে ঢোকার উপায় নাই। আমার ওপর যেমন হুকুম, আমি তার কী করব!’

‘আমাকে কি তোমার বদলোক মনে হচ্ছে!’

পাল্টা প্রশ্ন, ‘আমাকে কি তোমার বদ মেয়েমানুষ মনে হচ্ছে!’

‘না, একেবারেই না।’

‘এরা আগেই আমার নাম থানায় লিখিয়ে রেখেছে। একটা ছবি তুলিয়ে রেখেছে। কুকুর দিয়ে শুঁকিয়েছে। পেটের জন্য মানুষের কী হেনস্থা। আমাদের লাইনে চোর ডাকাত ঢুকে পড়েছে। তোমাদের লাইনেও। কী করা যাবে! এই যে তুমি বলছ ভাগনে, আমি বিশ্বাস করছি না। তোমার চোখের চাউনি ভাল নয়।’

‘সে তো তোমার চোখের চাউনিও ভাল নয়!’

‘সে তো তোমাকে দেখে আমাকে এইভাবেই চাইতে হচ্ছে। তা না হলে আমার আসল দিষ্টি হেমা মালিনীর মতো।’

‘বেশ হয়েছে এখন অতিথিকে এক গেলাস জল খাওয়াও।’

‘অয়। ওইটি হবে না বাপু। বাবু আমাকে শিকিয়ে দিয়েছে, ওরা জল খাওয়ার বায়না করে ঢুকে ঘোল খাইয়ে দিয়ে চলে যায়। তেমন ভাল তেষ্টা পেয়ে থাকলে দোকানে গিয়ে বোতলের জল খেয়ে নাও।’

‘বাবুরা গেছে কোথায়?’

‘জানলেও বলব না।’

নাকের ওপর দ্রাম করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। চিলি চিকেন, চাওমিন, সব ভেতরে। সেই অ্যালসেসিয়ানটার বিখ্যাত হুঙ্কার। মামা পার্টির লোক। আর কিছুক্ষণ ধানায় পানায় করলেই জনা কুড়ি এসে, বাবুকে বানিয়ে দেবে।

গঙ্গা পেরলেই বেলুড়। বেলুড় ঘাট থেকে স্টেশন কমসে কম তিন মাইল। মারো পয়দাল। এতক্ষণে অবরোধ খুলে গেছে। একালের ম্যালেরিয়াও এক দাগে সারে। পাঁচ মিনিটের লেকচারে রেলের কনস্টিপেশান কেটে যাবে। বর্ধমান যদি যায় তো যেতেই হবে। দিদির ছোট ননদের মেয়ের অন্নপ্রাশন। পয়সা আছে, খাওয়াবে ভাল।

স্টেশনে এসে জানা গেল, মেন নয়, কর্ড দিয়ে থেকে থেকে ট্রেন যাচ্ছে। তা যাক, গেলেই হল। আজকাল তো বাইপাসের যুগ। অল্প কোস্তাকুস্তির পর ট্রেনে জায়গা পেলুম। ফিটফাট বাবুরা সব বসে আছেন। মনে হয় ম্যারেজ পার্টি। একজনের হাতে আড়বাঁশির মতো কি একটা রয়েছে। বিয়ে বাড়ি তো, গান বাজনা হবে।

ট্রেন চলছে, বেশ ভালই যাচ্ছে। হঠাৎ সেই বাবুরা সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। একজন একটা ব্রিফকেস খুলে শক্ত শক্ত গোটাকতক কী জিনিস, এর ওর হাতে ধরিয়ে দিল। আর একজন একটা বড় মাপের ব্যাগ খুলে, মুখটা ফাঁক করে খালি আসনের ওপর রাখল। সবই খুব নিখুঁতভাবে হচ্ছে। তবে কী হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।

সবচেয়ে লম্বা ছেলেটি মিষ্টি গলায় বলল, ‘বন্ধুগণ, এইবার আমাদের কলেকশন হবে। যার যা মালকড়ি আছে, যাকে বলে যথাসর্বস্ব, সব এই ব্যাগে ফেলুন। জোলাপ খেলে যেমন খোলসা হয়, ঠিক সেইভাবে খোলসা হয়ে যান, নয় তো আমাদের ভুস দিতে হবে। ভদ্রলোকের ছেলে আপনারা, সেটা কী ভাল দেখাবে।’

যার হাতে বাঁশি ছিল, সে বাঁশি বাজাচ্ছে, আর একজন খঞ্জনি, তারস্বরে নাম সঙ্কীর্তন, প্রেম তা নিতাই বলে, হরে কৃষ্ণ হরে রাম, গৌর হরি হরি বোল।

আমি হঠাৎ বলে ফেলেছি, ‘রিভলভার।’

থুঁথনিতে আঙুল রেখে দলের একজন বলল, ‘এ শালা কোরা মাল!’

সঙ্গে সঙ্গে নেতা তাকে এক ধমক মেরে বলল, ‘কাস্টমারের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বল। আপনার কাছে যা আছে সব ওই ব্যাগে অঞ্জলি দিন। দুনিয়ায় কর্মফল ছাড়া নিজের বলে কিছুই নেই বাবা। হাতঘড়িটা দেখ তো! সত্তর টাকার কোয়ার্জ হলে ছেড়ে দে।’

সহকারী দেখে বলল, ‘এক নম্বর মাল।’

‘খুলে নে। জামাটা দেখ, বেশ চেকনাই দিচ্ছে।’

দেখেশুনে সহকারী বলল, ‘এইটটি টোয়েন্টি। কালারের ভেতরটা দেখে মনে হচ্ছে, মাল আজই চড়িয়েছে।’

‘খুলে নে, খুলে নে, মোহমুক্ত কর। প্যান্টটাও নতুন। নামিয়ে দে।’

‘প্রভু, গেঞ্জিটাও সরেস। মেকারি মাল।’

উতরে নে।’

করুণ গলায় আবেদন জানালুম, ‘প্রভু, আমি যে নেমন্তন্ন বাড়ি যাচ্ছি। সব খুলে নিলে যাই কী করে। টাকাপয়সা যা ছিল সবই তো দিয়েছি। প্রেজেন্টেশানের আংটিটাও দিয়ে দিয়েছি।’

‘কথা বাড়িও না খোকা, তা হলে বার্থডে স্যুটটাও খুলে নেব।’

নেতা বলল, ‘আমরা আমাদের কাস্টমারদের ফ্রি কৌপীনও সাপ্লাই করি। তলাটা কী একেবারে উদোম, কথা বলছে, আর রিভলভারটাকে মাঝে মাঝে ডিগবাজি খাওয়াচ্ছে। চোখ বুজিয়ে ট্রাউজারটা খুলে ফেললুম।’

চেলা সেটাকে পাট করতে করতে বলল, ‘এই তো তলায় একটা চিরকুট তো রয়েছে। গলায় আবার ওটা কী ঝুলছে!’

নেতা বলল, ‘ওল্ড স্টকের মাল। ওকে বলে পইতে। কদাচিৎ ব্রাহ্মণদের গলায় দোল খায়। থেকে থেকে ধোপার বাড়ি চলে যায়। পইতে যখন রয়েছে ঘুনসিতে, সোনার মাদুলি থাকতে পারে। চেক কর।’

চোখ বুজিয়ে বুজিয়েই বললুম, ‘বিশ্বাস করুন। আমার ঘুনসিই নেই তো কবজ, মাদুলি।’

নেতা বলল, ছেড়ে দে। প্যানপ্যানানি শুনলে মাথা গরম হয়ে যায়।’

কম্পার্টমেন্টের ওপাশে ফটাস করে একটা শব্দ হল। চমকে চোখ মেলতেই, নেতা বলল, ও কিছু নয়, ধানায়পানায় করছিল, রিভলভারের কুঁদো দিয়ে মাথাটাকে ওপেন করে দেওয়া হল।’

চেলা বলল, ‘প্রভু! এ মালের সব খালাশ করে নিয়েছি। চশমাটা কী করব। ফ্রেমটা দামি।’

‘দামি তো, খুলে নে। জিজ্ঞেস করছিস কেন?’

আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘ভাই, চশমাটা নিলে একেবারে অন্ধ হয়ে যাব।’

চেলা এক চিলতে উপদেশ ঝেড়ে দিল, ‘যে দেশে এত বেকার, সে দেশে সোনার চশমা পরে রেলা মারা কেন চাঁদু! নাও কাঁচ দুটো খুলে দিচ্ছি, লোহার ফ্রেমে ফিট করে নিও।’

‘আপনি খুলতে পারবেন না, ভেঙে ফেলবেন।’

‘ক্যা বলেছে। আমাদের টিমে টেকনোলজির অভাব নেই। ট্রেনের পাখা থেকে, মানুষের দাঁত সব আমরা খুলতে পারি। মেটাল ডিটেক্টার দিয়ে দাঁতে মেটাল ফিল করা আছে কি না দেখে, সাঁড়াশি দিয়ে উপড়ে আনি। তুলো ফ্রি।’

নেতা বলল, ‘হারি আপ।’

চেলা বলল, ‘শরীরে একটা চিরকুট ছাড়া আর কিছু নেই। বেশ ভ্যালুয়েবল মাল মাইরি। কলা গাছের মতো। থোড় খাও, মোচা খাও, কলা খাও। শরীরে ফালতু মাল একটাও ছিল না।’

নেতা বলল, ‘তোর তো শুধু উচুর দিকে নজর, তাই দেখতে পেলি না। পায়ের দিকে তাকা, বিনীত হ! পায়ে যে পাঁচশো টাকা পড়ে আছে রে! কী জুতো পরে আছে দেখেছিস।’

ব্যাগ ভরে উপচে পড়ছে। আমাকে আর একবার সার্টিফিকেট দিল, ‘সলিড মাল, তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত।’ নেতা বলল, ‘আপনারা সকলে সুখে থাকুন।’

চেন টেনে ফাঁকা মাঠে নেমে গেল। এতক্ষণ কারও মুখে কোনও কথা ছিল না। নেমে যেতেই আমার পাশের ভদ্রলোক চিৎকার করে উঠলেন, ‘আপনাদের মশাই রেজিস্ট করা উচিত ছিল।’ ওপাশ থেকে একজন বললেন, ‘ওদের মশাই লাইসেন্স আছে, বখেরা ফিফটি ফিফটি।’

পাশের ভদ্রলোক ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ‘ওরা জানে না আমি কে! পি ডবলু ডি-র অফিসার।’

ওপাশ থেকে জবাব এল, তাহলে ওদের সঙ্গেই নেমে গেলেন না কেন! একই গোত্রের তো।’

‘হোয়াট ডু ইউ মিন।’

‘পশ্চিমবাংলার রাস্তাঘাট! ওয়ার্ড ব্যাঙ্কের টাকা যাচ্ছে কোথায়!’

‘আমি পি ভি নরসিমা রাওকে লিখব।’

‘হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে যায়। আপনি সুপ্রিম থেকে হাই। পি ডবলু ডি!’

ভদ্রলোক চাপা গলায় বললেন, ‘ফালতু, সব কাওয়ার্ডের দল, সিন কমপুপ।’

স্টেশনের নাম কামারকুণ্ডু। বিরাট একটা দল সেখানে জটলা করছে। হাফ প্যান্ট, স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে তোয়ালে, অথবা গামছা। কাঁধে বাঁক। ট্রেন থেকে আরও একদল নেমে এল ওই ইউনিফর্মেই। দলে বেশ কিছু কমবয়সী মেয়েও আছে। সবাই মিলে জিগির দিল, ‘জয়বাবা তারকনাথ। ভোলে বাবা—পার করেগা।

এই গ্রুপটায় আমি বেশ ফিট করে গেলুম।

একজন বলল, ‘দাদা, সব খুলে ফেলেছেন। এই না হলে ভক্ত! আমরা পারিনি দাদা। হাফ প্যান্ট, হাফ ভক্ত।’

চোখে চশমা নেই। সব ঝাপসা দেখছি। দোনো আঁখিমেই ফোর পয়েন্ট ফাইভ মাইনাস।

চোখের ডাক্তারের কায়দায় দু হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী দিয়ে ফ্রেম ছাড়া লেনস দুটো চোখের সামনে ধরে পরিবেশটাকে পরিষ্কার দেখার চেষ্টা করলুম। অগণিত, উদ্বেলিত, উত্তেজিত শিবভক্তের দল তার মাঝে আমি এক তিন পোয়া বা বারো আনা ভক্ত। এক সের, এক টাকা ভক্ত হতে পারিনি, কারণ এক ছটাক জাঙ্গিয়াটা এখনও নিম্নাঙ্গে সেঁটে আছে। এই প্রথম উপলব্ধি করলুম, অঙ্গে কিছু না থাকার গৌরব। সাহস করে সব খুলতে পারেন বলেই, সুন্দরীরা বিশ্বসুন্দরী।

চোখের সামনে লেনস ধরে সেই হাফ ভক্তকে ধর্মগুরুর মতো বিভোরভাবে বললুম, ‘ভাই বাবার কৃপায় তিন ছটাক হতে পেরেছি। এক ছটাক ভোগ এখনও লেগে আছে। বলো, বলো, ভোলেবাবা পার করে গা, ভোল বোম্, তারক বোম্। দুটোই ফাটে, বম বম্ব।’

সেই দলে মিশে নাচতে নাচতে শ্রাবণের ভক্ত স্রোতে সোজা তারকেশ্বরের দিকে এগোচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গীত:

একটুখানি আছে বাকি

এই একটু গেলে আরও বাঁচি,

টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার

হাউ আই ওয়ান্ডার

হোয়াট ইউ আর

ভোল বোম্ তারক বোম্

নাচে ভোলা ববম বোম্।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *