তৃতীয় পুরুষ

তৃতীয় পুরুষ

সদরে গাড়ি থামার শব্দ হল। মিটার ফ্ল্যাগ তোলার ক্ষীণ একটু শব্দও শোনা গেল। বঙ্কিমের কান সজাগ ছিল বলেই, রেডিও চলা সত্ত্বেও শুনতে পেল। খাটের বাজুতে ঠেসান দিয়ে, ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে, বঙ্কিম সকালের কাগজ পড়ছিল, রেডিও-ও শুনছিল, পাশের বাড়ির শাশুড়ি বউয়ের প্রাত্যহিক প্রাতঃকালীন ঝগড়ার দিকেও কান রেখেছিল। এখন গাড়ি থামার শব্দ এবং মিটার ফ্ল্যাগ তোলার ক্লিং শব্দটাও শুনল। বঙ্কিম একসঙ্গে অনেক দিকে মনোযোগ দিয়ে দিতে পারে বলেই, তার জীবনে বোধহয় কিছু হল না। বহুমুখী মন নিয়ে বঙ্কিমের কেরিয়ারের বারোটা বেজে গেল। বঙ্কিমের মেকার্সদের অন্তত সেই রকমই ধারণা।

ক্লিং শব্দটা হতেই বঙ্কিম চট করে উঠে রেডিওটা বন্ধ করে দিল। হাত দিয়ে মাথার চুল খানিক এলোমেলো করে নিল। খাটের মাথা থেকে একটা চাদর নিয়ে গায়ে জড়াল। এখন এই রকম একটা অসুস্থতার মেক-আপ নিয়ে তাকে প্রতিমার সামনে দাঁড়াতে হবে। তাতেও শেষ রঙ্গে হবে কি না সন্দেহ। বঙ্কিমের বউ প্রতিমা ফিরে আসছে নার্সিংহোম থেকে, তাদের জয়েন্ট ভেন্‌চার, প্রথম সন্তান কোলে নিয়ে। ফিরিয়ে আনছে বঙ্কিমের পিসতুতো বোন। বিয়ের বছর না ঘুরতেই, বঙ্কিম প্রাউড ফাদার।

বঙ্কিম কিন্তু জানে, সে মোটেই প্রাউড নয়, বরং কাওয়ার্ড। সে নিজেকে কোনও দিনই ফাদার বঙ্কিম বলে ভাবতে পারেনি। তার ধারণা, ফাদার হবার যোগ্যতা একমাত্র তার ফাদারেরই আছে। তিন কি বড় জোর চার বছর বয়সে মা মারা যাবার পর তার জীবন একেবারে কানায় কানায় পিতৃময়। তার মন, ভাব, ভাবনার আকাশ আচ্ছন্ন করে পিতা পরমেশ্বর। শৈশবে পিতৃভক্তির আতিশয্যে বঙ্কিম সুর করে সকাল সন্ধে পিতৃশ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ করত—পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম। বঙ্কিমের এক জ্যাঠাইমা যাঁর ঠোঁটকাটা, কটুভাষী, কাণ্ডজ্ঞানহীন বলে পরিচয় আছে, তিনি একদিন বঙ্কিমের ভুল ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এ কী রে? এ তো মাথা ন্যাড়া করে, ঘাটে বসে, পিণ্ডোৎসর্গের সময় পড়তে হয়।’ বঙ্কিম সত্য মিথ্যে জানার জন্য পিতা পরমেশ্বরকে প্রশ্ন করেছিল। ভয়ও ছিল, শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়ে জীবিত পিতার পরলোকের পথ প্রশস্ত করে ফেলছে না তো! তিনি বলেছিলেন, ‘ও সব সংশয়বাদীদের কথা। ভক্তিমার্গে এসব বাধা ইগনোর করবে। পিতা আর পরমপিতার শুধু তিনটি শব্দের তফাৎ—প র আর ম। পিতাকে যে সন্তান পরম পিতা করে নিতে পারে তার আর মার নেই। পিতার জন্মও নেই মৃত্যুও নেই। নে সেই গানটা গা। তোর দাদুর সেই গানটা।’ বঙ্কিম সংশয়মুক্ত মনে, সিঙ্গল রিডের হারমোনিয়াম বাজিয়ে, চাঁছাছোলা গলায় গেয়েছিল, সুখে ডালে বসি ডাকিছো পাখি রে, ডাকিছো কি সেই পরমপিতারে।

চোখ বুজিয়ে বঙ্কিম বহুবার মাকে দেখবার চেষ্টা করছে। পারেনি। দেবেদেবীর মূর্তিও আসতে চায় না। চোখ বুজলেই পিতা পরমেশ্বর—সিনিক্যাল মুখ, পাতলা নাক, ডগাটা অল্প একটু বেঁকে কমার মতো পাতলা ঠোঁটের ওপর ঝুঁকে পড়ে গজাল গোঁফ জোড়াকে যেন জিজ্ঞেস করছে—কী হে ভায়া, ঠিকঠাক আছ তো! মাথার সামনে খেলার মাঠের মতো একটি মসৃণ টাক। তীক্ষ্ণ দুটি চোখ, লিভারের গ্যাঁড়াকলে প্রায়ই হলুদ বর্ণ। সোনালি ফ্রেমের শৌখিন চশমা। একেবারে স্ট্রেট ইরেকট্‌ মেরুদণ্ড। সামনে লুটানো কোঁচা। ফাইন ধুতি। কালো ঝকঝকে জুতোর ওপর রাস্তার মিহি ধুলো। সাদা টেনিস শার্ট। ক্রিম কালারের কোট। গটগট করে মিলিটারিদের মতো হাঁটা। জুতোর গোড়ালির শব্দ কী! খট্‌খট্‌। নির্মূল করে কামানো দাড়ি। সদা গম্ভীর মুখ। সে মুখে মেয়েলি মুচকি হাসি বঙ্কিম কখনও দেখেনি। বছরে একবার বিজয়ার দিন একটু সিদ্ধি খেয়ে পরমেশ্বর যখন হাসতেন, বঙ্কিম সে হাসির নাম রেখেছিল—একতলা-দোতলা। হাসির রোল লাফাতে লাফাতে ধাপে ধাপে উপরে উঠে যেত, আবার নেমে আসত ধাপে ধাপে। স্বরযন্ত্রের স্বচ্ছন্দ বিহার। পাড়ায় আর একজন মাত্র মানুষের এই রকম হাসি ছিল। তাঁর নাম ছিল সন্তোষদা। বাড়ির পাশেই পান বিড়ির দোকানের মালিক। তাঁর হাসির অবশ্য একটা ডিফেক্‌ট ছিল। পরমেশ্বরের হাইটে উঠত ঠিকই, তবে ওই খোল ফাটা তুবড়ির মতো। শেষ ধাপে উঠেই হাসি হয়ে যেত ব্রঙ্কাইটিসের কাশি। সন্তোষদা কাশতে কাশতে শেষকালে বুকটা চেপে ধরে, ‘ওরে বাবারে, ওরে বাবারে’ বলে আর্তনাদ করে উঠতেন। সন্তোষদা দিনে শখানেক বার হাসতেন। তখন বাংলাদেশে হাসির কাল চলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টাকা হাওয়ায় উড়ছে। পরমেশ্বর হাসতেন বছরে একবার। সেই কারণে একটায় ছিল নাদ, অন্যটায় আর্তনাদ।

বঙ্কিমের মনে যে ফাদার বা ফিগার ফাদার ছিল, তা পরমেশ্বরের আদলে ঢালা। ঠুম্‌রি নয়, একেবারে ধ্রুপদ। বঙ্কিম নিজে একেবারে উল্টো। পরমেশ্বর তাকে ইনটারনাল সান করে গড়ে তুলেছিলেন। তার ভেতর থেকে পিতৃনির্যাসের শেষ বিন্দুটুকু বের করে নিয়ে বঙ্কিমকে এমন কায়দায় মানুষ করেছিলেন, মেয়েছেলে দেখলেই যেন গো-বৎসের মতো হাম্মা, মা, মা করে ওঠে। বঙ্কিম নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল—ফাদার হবার কোনও কোয়ালিটিই তার মধ্যে নেই। সারা পৃথিবীতে বাবাদের যদি কোনও স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশান তৈরি করে কোয়ালিটি মার্ক দেবার প্রথা থাকত, তাহলে সেই স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হত পরমেশ্বরকে দেখে। পরমেশ্বর চিরকালের ফাদার, বঙ্কিম চিরকালের সন্তান। বঙ্কিমের ভাব সন্তানভাব। তার ভেতরটা কেবলই বাবা বাবা করছে। কিন্তু বিধির বিধানে, সেই বঙ্কিম আজ ফাদার। পরমেশ্বরের সমর্থন ছাড়াই এই অশনিসম্পাত। সে নিজে এতকাল বাবা, বাবা করেছে, এইবার তাকে বাবা বাবা করবার এতটুকু একটা যন্ত্র তৈরি হয়েছে।

প্রতিমা বুকের কাছে এতটুকু একটা তোয়ালের পার্সেল ধরে, ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। বঙ্কিম লাজুক লাজুক মুখে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দেখলে মনে হবে, বঙ্কিমই যেন মাদার। আর প্রতিমা যেভাবে উঠে আসছে মনে হচ্ছে সেই যেন ফাদার। যেন পরমেশ্বর বাজার করে ফিরছেন, বগলে একটা এক পাউন্ড রুটি। বঙ্কিম চোরের মতো এদিক ওদিক একবার তাকিয়ে দেখল। যেন কত বড় একটা অপরাধ করে ফেলেছে! দুজন থেকে তিনজন হয়েছে। প্রতিমার গর্ভসঞ্চারের ব্যাপারটা যখন কিছুতেই আর চেপে রাখা গেল না, সারা শরীরে এবং ব্যবহারে মায়ের দয়ার মতোই শনৈঃ প্রকাশিত হল, তখন পরমেশ্বর ছেলেকে বলেছিলেন—মাল্টিপ্লিকেশন ইজ এ রুল বাট ডোন্ট মেক ইট এ ন্যাচারাল প্র্যাকটিস। সেই সারমন শোনার পর থেকেই বঙ্কিমের লজ্জা ও অপরাধ বোধটা আরও বেড়ে গেছে।

আর তিনটে ধাপ ভাঙলেই প্রতিমা দোতলায় উঠে আসবে। বঙ্কিম সারা মুখে একটা নির্বোধের হাসি ছড়িয়ে, লম্বা তর্জনীটা একটা হুকের মতো সামনে বাড়িয়ে, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল—‘এইটা, এইটা’। প্রতিমা কোনও উত্তর দিল না। শুধু একটু থেমে কটমট করে তাকাল। বঙ্কিম ভয়ে ভয়ে বলল—‘একটু হাত দেব’? স্পর্শ করার জন্য আঙুলের হুকটা একবার বাড়িয়েও ছিল। তোয়ালের মোড়কটা বুকের কাছে আড়াল করে, প্রতিমা বলল—‘না’। প্রতিমার স্বাভাবিক গলাই লাউডস্পীকারের মতো। ‘না’টা একটু জোরেই বলেছিল। সারা বাড়িটা যেন শিউরে উঠল। বঙ্কিম তাড়াতাড়ি একপাশে সরে দাঁড়াল। প্রতিমা গট গট করে নিজেদের ঘরে গিয়ে ঢুকল। প্রতিমার কাঁধের পাশে হলদে কাপড়ের একটা সাইড ব্যাগ ঝুলছে। সাইড ব্যাগে কী আছে, কে জানে! আসল বস্তুটা ব্যাগে নেই তো।

বঙ্কিম জানে প্রতিমার পক্ষে সবই সম্ভব। একবার একটা দুধ চোর হুলোকে বাজারের ব্যাগে ভরে মাইলখানেক দূরে ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। যদিও বেড়ালটা প্রতিমা ফেরার আগেই ফিরে এসে আবার ঘরে যথাস্থানে গ্যাঁট হয়ে বসেছিল। এই সিঁড়িতেই একবার রাতে একটা ছিচকে চোরের হাত থেকে নতুন তোয়ালে, গেঞ্জি, আরও কী কী সব কেড়ে নিয়ে, চোয়ালে একটা আন্ডারকাট ঝেড়েছিল। চোরটা শেষ ধাপে ছিটকে পড়েছিল—মা, এমন ঘুষি থানার বড় দারোগার হাত থেকেও খালাস হবে না। ঘুষির প্রশংসায় খুশি হয়ে প্রতিমা চোরকে নতুন গেঞ্জিটা উপহার দিয়েছিল। পরমেশ্বর অবশ্য বলেছিলেন, বাইরের লোকের সামনে ঘোমটা দিয়ে বেরুলে শালীনতা বজায় থাকে। প্রতিমা বলেছিল, এর পর চোরে আপনার তোয়ালে কি জুতো চুরি করতে এলে ঘোমটা দিয়েই ঘুষি চালাব। এই প্রতিমাই পরমেশ্বরের হার্ট এটাকের সময়, পাড়ার এক জুনিয়ার ডাক্তারকে সাইকেলের পেছনে বসিয়ে পড়ি কি মরি করে নিয়ে এসেছিল। বঙ্কিম তখন অফিসে। পরমেশ্বর সুস্থ হতে হতে বলেছিলেন, বউমার জন্য এ যাত্রা বেঁচে গেলুম। সুস্থ হয়ে বলেছিলেন—হি-ওম্যান। গোঁফ থাকলে ওই বঙ্কিমের স্বামী হত। প্রতিমা সব পারে, কেবল মেয়েছেলে হতে পারে না।

বঙ্কিম পায়ে পায়ে ঘরে এসে ঢুকল। প্রতিমা ইতিমধ্যে খাটে পা মুড়ে বসেছে। কোলের ওপর তোয়ালেতে এতটুকু একটা লাল মতো মানুষ। মানুষের বাচ্চা যে এত জঘন্য দেখতে হয় বঙ্কিমের ধারণাই ছিল না। মাথায় কয়েক গুচ্ছ ললাম। ওকে চুল বলা যায় না। মুখটা অনেকটা আলুপোড়ার মতো। গায়ের চামড়া যেন রোস্টেড রাঙাআলু। পেটে একটা কাপড়ের পট্টি। ওই জায়গাটাতেই ছিল প্রতিমার সঙ্গে নাড়ির যোগ। জীবনের ভাইটাল সাপ্লাই লাইন। কোথায় দুধের টিনের গায়ে আঁকা সেই একমাথা কোঁকড়া চুল, নীল আকাশের মতো চোখ বাচ্চা! একটু আগের স্পর্শ করার ইচ্ছেটা তার আর নেই। প্রতিমাকে কত সুন্দর দেখতে। এক মাস নার্সিংহোমের যত্নে থেকে, রং যেন ফেটে পড়ছে। মুখের চামড়া একেবারে টান তেলা তেলা। চোখ দুটো মনে হচ্ছে অয়েলিং ক্লিনিং করে নতুন ফিট করা হয়েছে। মণি দুটো ঝকঝকে কালো। সেই প্রতিমার জঠর থেকে এইরকম একটা আগলি জিনিস বেরুল। নিজের সৃজনী শক্তির ওপর বঙ্কিমের ঘেন্না ধরে গেল।

বঙ্কিম রাস্তার ধারের জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। মানুষের বাচ্চা সে একটু বড় অবস্থায় দেখেছে। ফ্রেশ ফ্রম এবডোমেন, সে দেখেনি। পাশের বাড়ির গরুর বাচ্চা সে ডেলিভারি হতে দেখেছে। মার পেট থেকে পড়েই খোলা মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়ল। চারটে পা তখনও ছোটায় অভ্যস্ত নয়। ধড়াস ধড়াস করে বার কতক আছাড় খেল। তবু পৃথিবীর মাটিতে পা রাখবার কী আনন্দ। ধবধবে সাদা রং। বড় বড় নতুন চোখ। বঙ্কিম ভাবে বিভোর হয়ে মনে মনে বলেছিল—ও ক্রিয়েটার! কী সুন্দর, কী সুন্দর! মানুষের বাচ্চা গরুর মতো হবে সে এক্সপেট করে না, ডিজায়ারেবলও নয়। তাহলেও এই কী একটা স্যাম্পল! সে ছাগলের বাচ্চা, খরগোসের বাচ্চা, কুকুরের একসঙ্গে আটটা বাচ্চা, বেড়ালের বাচ্চা, মুরগির একগাদা বলের মতো বাচ্চা দেখেছে। একমাত্র পাখির বাচ্চা ছাড়া এত কুৎসিত প্রোডাকশন সে আর দেখেনি।

বঙ্কিম জানালার পাশ থেকে সরে এসে, খাটের আর একদিকে বসে একটু উসখুস করে জিজ্ঞেস করল, ‘এই রকমই হয় বুঝি? প্রতিমা এতক্ষণ একটাও কথা বলেনি। রাগে জ্বলে যাচ্ছিল। পুরো একটা মাসের বারুদ, এক কথায় ভিসুভিয়াসের মতো ফেটে পড়ল—হ্যাঁ এইরকমই হয়। স্বার্থপর, চোর, জোচ্চোর, ধাপ্পাবাজ, চিটিংবাজদের ছেলে এইরকমই হয়। কথা বলতে লজ্জা করছে না। এ ছেলে তোমার নয়।’ ভাগ্যিস বুদ্ধি করে বঙ্কিম ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল। এ সব ডায়ালগ পিতা পরমেশ্বরের কানে গেলে রক্ষে নেই। একেই তিনি সেদিন বলেছিলেন—আমার ছেলেটা সেন্টলি ইনোসেন্ট ছিল। পাল্লায় পড়ে পেকে গেল। কথা হচ্ছিল বোনের সঙ্গে। বঙ্কিম ওভার হিয়ার করেছিল। ‘জেনে রাখবি, ভাল যখন খারাপ হয় তখন খারাপকেও সে ছাড়িয়ে যায়।’ পরমেশ্বরের সঙ্গে প্রথম থেকেই প্রতিমার সম্পর্ক খুবই খারাপ। দর্শনেই আল্যার্জি। বিয়েটা নেহাত গোলেতালে হয়ে গেছে। পরমেশ্বরের বন্ধু অক্ষয়বাবু আবার হাত দেখেন। বঙ্কিমের মনে আছে, বেশ কিছুকাল আগে পরমেশ্বর বলেছিলেন—দেখ তো অক্ষয় এর হাতটা একবার। একমাত্র ছেলে। সংসারে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বঙ্কিম তখন মা বলতে মূর্ছা যায়।

অক্ষয়বাবু হাত দেখে হাসতে হাসতে বলেছিলেন—চন্দ্র ইজ ভেরি গুড। উচ্চ চিন্তার কারক। বৃহস্পতি ভেরি স্ট্রং। সেভ করবে। বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে শেষ জীবন পর্যন্ত। তবে তবে। বার কতক তবে তবে করে বললেন—সন্ন্যাসী। নো চানস। শুক্রটা ফেরোসাস হয়ে আছে। বাঘের মতো। বরং একটু সাবধানে থাকা উচিত। আচোট কাগজ, চোট করে দিতে পারে। ওয়ান ড্রপ অফ ইঙ্ক, ফিনিশ। সাদা আর সাদা থাকবে না বাবাজীবন, স্পটেড, কলঙ্কিত।

পরমেশ্বর মুখে এই শাস্ত্রটিকে ‘ফেক’ বলতেন। বলতেন বোগাস। কিন্তু যেহেতু অক্ষয়বাবু একটা খারাপ সম্ভাবনার কথা বলেছেন, পরমেশ্বর সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে ধ্রুব সত্য বলে ধরে নিলেন। পরমেশ্বর ভাল দেখতে পান না, দেখতে পারেন না, ভালতে তাঁর বিশ্বাসও নেই। অক্ষয়বাবু ভাল কিছু বললে জ্যোতিষশাস্ত্র বাজে হয়ে যেত। খারাপ বলে পরমেশ্বরের বিশ্বাসে শাস্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। আর বঙ্কিমও সেই শাস্ত্র নির্দিষ্ট পথেই আচোট কাগজে চোট খেল। প্রতিমাই সেই কালির আঁচড় ধরেই মেরে দিয়েছে। খানায় ফেলে দিয়েছে।

বঙ্কিম-রূপ-দুর্গকে দখলে রাখার অনেক চেষ্টা করেছিলেন পরমেশ্বর। পারেননি। প্রতিমার কাছে সেই দুর্গের পতন হয়েছে। মেবারের রানা মোগলাই বাহিনীর ধাক্কায় পরাজিত। পরমেশ্বরের প্রতিরোধ চুরমার। অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে ছেলের নোটবুকে শ্লোক লিখে দিয়েছিলেন—স্ত্রীয়ঃ সমস্তা সকলা জগৎসু। চাবাক না অন্য কোনও একটা মুনির মেয়েছেলে সম্পর্কে একটা ড্যামেজিং কোটেশানও ছেলেকে শিখিয়েছিলেন। সবটা বঙ্কিমের মনে নেই। একটু যা মনে আছে তা হল—মূত্র, পুরীষ ভাবিতে। অর্থাৎ বর্তমানে একটা মাংসের দলা নিয়ে যে প্রতিমা খাটে বসে আছে, আইবুড়ো বেলায় তার বাইরের রূপ দেখে—ডোন্ট গেট চামর্ড। তত্ত্বদর্শী মুনি বলছেন—বন্ধু, সি ইজ নাথিং বাট, কিছু মল, কিছু মূত্র, কিছু কফ, কিছু পিত্ত। এত করেও ছেলে বাঁচল না। লাইফ সেভিং কিট নিয়েই বঙ্কিম ভুড় ভুড় করে জলে ডুবে গেল। হিতোপদেশের গল্পে আছে নিমজ্জমানকে উদ্ধার না করে তীরে দাঁড়িয়ে উপদেশ ছুঁড়ে দিতে হয়। পরমেশ্বর উপদেশের মধ্যে একটি উপদেশই ছেলেকে দিলেন—গোয়িং দি ফ্যামিলিওয়ে, সব সময় মনে রাখবে, রেট অফ মাল্টিপ্লিকেশন ইজ ডাইরেকটলি প্রোপোরশনাল টু রেট অফ একসপেনডিচার। এই একটি কথা বলেই পরাজিত পরমেশ্বর, পুত্র আর দুচোখে দেখতে পারি না—পুত্রবধূর সংসারে, নিজের চারপাশে একটা ম্যাজিনো লাইন দাঁড় করিয়ে দিলেন। বঙ্কিম যদি হিটলার হত তাহলে হয়তো ব্লিৎসক্রিগ করে উড়িয়ে দিতে পারত। সে নেহাতই জরু কা গোলাম।

বঙ্কিম বিছানায় হাতের চেটো দুটো ইকির মিকির চামকিকির খেলার ধরনে পেতে, মিনমিনে গলায় বউকে বলল—চেঁচাচ্ছ কেন? পাড়ার লোককে আমাদের প্রাইভেট কথা শুনিয়ে কোনও লাভ আছে? বঙ্কিমের আবেদনে কোনও লাভ হল না। প্রতিমার স্বাভাবিক গলাই ‘জি’শার্পে বাঁধা, তার উপরে উত্তেজিত। বঙ্কিম একটু কল্পনাপ্রবণ, নরম প্রকৃতির লোক। হৃদয়টি শ্রীচৈতন্যের, শরীরটাই যা কেবল অকেজো বঙ্কিমের। ছেলে কোলে প্রতিমাকে যিশু কোলে মাতা মেরি ভেবে এই প্রচণ্ড মুখরা অবস্থাতেও ভালবাসা যায় কি না, বঙ্কিম চেষ্টা করে দেখল। প্রতিমা ঝাঁঝিয়ে উঠল। চেঁচাব না মানে? আমি ঢাক পেটাব। তোমরা বাপ-ব্যাটা মানুষ না অমানুষ? মেরি-মাতাকে চিন্তায় আনা গেল না। বঙ্কিম ‘বাপ’ শব্দটাকে সহ্য করতে পারে না। বাবা বলতে দোষটা কী? সেও এবার শ্বশুরমশাইকে সসুর বলবে, শাশুড়িকে সাউড়ি। বঙ্কিম মৃদু প্রতিবাদ করল। স্ত্রীকে প্রয়োজনে শাসন করা যায়, কিন্তু যে স্ত্রী সদ্য মা হয়েছে তাকে এখনি কী করে কড়া কথা বলে! সহজ ডেলিভারি নয়, সিজারিয়ান। অনেক স্টিচ পড়েছে, এখনও পুরো শুকোয়নি। স্টিচটা কোথায়! স্টিচ কেমন! বঙ্কিমের জানার কৌতুহল ভীষণ। প্রতিমা নিজের বউ হয়েও এমন বিহেভ করছে, যেন পরস্ত্রী! বঙ্কিম বলল—ব্যাপরটা তোমার সঙ্গে আমার, এর মধ্যে বাপ বাপ করে সেই এলুফ বৃদ্ধকে টানছ কেন? প্রতিমা কোনও যুক্তিই মানে না, ঘোড়ার ডিম! সে সেই একই ভল্যুমে বলল—টানবে না মানে? এইবার গলায় ছাতার বাঁট লাগিয়ে দুটোকেই টানব। লজ্জা করে না, বাপ-ব্যাটায় পরামর্শ করে খরচের ভয়ে ভুঁড়িটা একটু বড় হতেই…। বঙ্কিম সামলে দিল—মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। বাপ তবু সহ্য করা যায়, ভুঁড়ি শব্দটা দেখতেও যেমন শুনতেও তেমনি আগলি। প্রতিমা বলল, রাখো তোমার আগলি, আগলির নিকুচি করেছে। আমার ইচ্ছে করছে, দাঁত কিড়মিড় করে প্রতিমা বলল, তোমার কাপড় খুলে…। আর নয়। বঙ্কিম কানে আঙুল দিল। প্রতিমা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল বাইরের দিকে। বঙ্কিম বলল, ‘তোমার পেটে ওয়ার্মস হয়েছে, যেরকম দাঁত কিড়মিড় করছ, নাক খুঁটতে ইচ্ছে করে? এক ডোজ ‘সিনা’ দিতে পারলে ভাল হত।’

ওয়ার্মস যেটা হয়েছিল সেটা এখন কোলে। সিনা খেয়ে তোমার ওয়ার্মস মারো। রোগটা ভীষণ ছোঁয়াচে।

বঙ্কিম আর বসতে পারল না। দাঁড়িয়ে পড়ল। অসম্ভব। সে যদি হিপনোটিজম জানত! এ-মেয়েকে বশে আনার ক্ষমতা রাখে একমাত্র সার্কাসের রিং মাস্টার। পরমেশ্বর ঠিকই বলেছিলেন—যেসব মহিলার গড়ন ডেয়ো পিঁপড়ের মতো হয়, দেখতে ভাল হলে কী হবে, স্বভাবে তারা প্রতিমার মতো হয়। গুরুজন-বাক্য শোনেনি, তখন তো প্রেম-যমুনায় ঢেউ গুনেছে, এখন তো ম্যাও সামলাতেই হবে। অবশ্যই এ তরফের কিছু ল্যাপসেস আছে। তা বলে বাড়িতে ঢুকেই এইভাবে তাদের পিণ্ডি চটকানোর কোনও মানে হয়! এটা কী ভদ্রলোকের মেয়ের পক্ষে শোভন! বঙ্কিমের কী দোষ! সে তো হেল্পলেস হাবি। সংসারের কন্ট্রোল গিয়ার তো পরমেশ্বরের হাতে। বঙ্কিম যা রোজগার করে, ডিউটিফুল ছেলের মতো মাসে মাসে তুলে দেয় পরমেশ্বরের হাতে। সংসার নামক স্টেজকোচের সঙ্গে সেই কেবল টিকিট ধারী যাত্রী, প্রতিমা তার লাগেজ। গাড়ির গায়ে যাত্রীদের জন্য, পরমেশ্বরের ওয়ার্নিং, মাল নিজ দায়িত্বে রাখুন। মাল এবং মালের জন্য ড্রাইভার কাম কনডাকটার পরমেশ্বরের কোনও রেসপনসিবিলিটি নেই। বঙ্কিম নিজের দায়িত্বে ফাদার।

পরমেশ্বর হিসেবী মানুষ। তাঁর নানা হিসেব। অসংখ্য খামে অসংখ্য ফান্ড। খামগুলোর রং গোলাপী। কারণ বঙ্কিমের ফুলশয্যার তত্ত্বে শ্বশুরমশাই মেয়েকে চিঠি লেখার জন্য যে রাইটিং সেট দিয়েছিলেন তার মধ্যে এই খামগুলো ছিল। বিয়ের পর আর প্রেম থাকে না। গোলাপী খাম ইউসলেস। পরমেশ্বরের কাজে লেগে গেছে। কোনও খাম ‘এডুকেশন ফান্ড’, কোনও খাম ‘ফেস্টিভ্যাল ফান্ড’, একটা ‘অকেসনাল বুক পারচেজ ফান্ড’, এইভাবে ‘ট্রিটমেন্ট ফান্ড’, ‘লুচি ফান্ড’, ‘অ্যামিউজমেন্ট ফান্ড।’ সবচেয়ে বড় ফান্ড, যেটা খামে ধরে না, সেটা হল—’হাউস বিলডিং ফান্ড’। মাসে মাসে থোকা টাকা ব্যাঙ্কে জমা পড়ছে—সবার আগে বাসস্থান। পরমেশ্বর বলেন, সব কিছু কার্টেল করে আগে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই। বেশ কষ্টেই সংসার চলে। প্রতিমা জানে, কতদিন রাতে কুমড়োর ঘ্যাঁট আর রুটি খেয়ে, দুজনে পাশাপাশি শুয়ে, মুখে বড় এলাচের দানা ফেলে মাঝ রাত অবধি গজগজ করেছে, দধীচির হাড় দিয়ে বাড়ি তৈরি হবে অবশেষে, সেই বাড়ি হবে আমাদের সমাধি, তোমার আমার প্রেমের তাজমহল। সেই খাম ফান্ড বা ফান্ডখামে প্রেগনানসির কোনও প্রভিসন ছিল না। পরমেশ্বরের হিসেবে—বঙ্কিমের একসপেকটেড ফার্স্ট ইস্যু—পাঁচ বছর পরে। বঙ্কিম যদি স্লিপ করে, বঙ্কিমের বাবা কী করবেন? পুরোটাই এখন বঙ্কিমের দায়িত্ব।

ফাস্ট ইস্যু, রিসক অনেক, এ বাড়িতে দেখাশোনা করার দ্বিতীয় কোনও মহিলা নেই, এইসব যুক্তিপূর্ণ কথা বলে প্রতিমাকে বাপের বাড়ি পাচার করা হয়েছিল। তাতে অপরাধটা কী হয়েছে! বেশির ভাগ মেয়েই তো প্রথম মা হবার সময় বাপের বাড়িতেই হয়। বঙ্কিম বলল—ঠিক আছে, আমি পার্টটাইম করে, যা খরচ হয়েছে হিসেব করে তোমার বাপকে ইনস্টলমেন্টে শোধ করে দেব, দরকার হলে ইন্টারেস্টও দেব। বঙ্কিম ইচ্ছে করেই বাপ বলল। বাপে বাপে কাটাকাটি।

‘তোমার টাকায় তারা…’

তারা যা করে দেন, অন্তত, প্রতিমা যা বললে বঙ্কিম উচ্চারণ করতে পারবে না।

‘টাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল মন। সেই ছ’মাসে আমি গেছি তোমাদেরই বাড়ি থেকে কেউ একবার দেখতে গেল না। আড়াই টাকা দামের গোটাকতক চাটনি আপেল হাতে করে অন্তত একজনও কেউ একদিন যেতে পারত। তোমার কথা ছেড়েই দিচ্ছি। তুমি তো একটা মেষ! বাইবেলের হোলি ল্যাম্ব।

বঙ্কিম দমে না গিয়ে নিজেদের ডিফেনসে বলল—আর কে আছে যে যাবে? যেতে হলে বাবাকেই যেতে হয়। তিনি এসব পছন্দ করেন না।

কী পছন্দ করেন না?

বঙ্কিম বলল—মানুষের বাচ্চা হওয়া। আমি জন্মাবার পরই মা মারা গেলেন তো, সেই থেকে বাবার বাচ্চাতঙ্ক। তাছাড়া আর একটা মারাত্মক ব্যাপার আছে। ওই হিজড়ে।

হিজড়ে মানে?

একদল হিজড়ে আসে না, বিশ্রীভাবে হাততালি দিতে দিতে, কার হল গো, আর হল, খোঁকা হল না খুঁকি হল। বঙ্কিম সুর করে বলল। এনিহাউ ওটাকে স্টপ করতে হবে।

প্রতিমা অবাক হয়ে বলল, ‘বাব্বা, একখানা বাড়ি বটে। পাগলের বংশ বলব, না শয়তানের বংশ! এমন জানলে গর্ভপাত করিয়ে আসতুম।’

পাগল কিংবা শয়তান দুটো বিশেষণই বঙ্কিমের পছন্দ হল না। হজম করা ছাড়া উপায় নেই।

প্রতিমার আর এক প্রস্থ আক্রমণ—‘তোমার কী হয়েছিল শুনি? মাসখানেক না হয় অসুখে ভুগেছ। তারপর? একবার নার্সিংহোমে যেতে কী হয়েছিল? মজা মারবার সময় মেরেছিলে, তারপর যে মরছে সে মরছে, তাই না? স্বার্থপর, খলিফা।’

বঙ্কিম বলল, ‘ছি ছি, সে কী কথা? আসলে লজ্জা করছিল। সবাই আঙুল দেখিয়ে বলবে, ওই দেখ, এই ছেলেটার বাবা। বিচ্ছিরি ব্যাপার। যা করে ফেলেছি, ফেলেছি। আমাদের মধ্যেই থাক। লোক জানাজানি করে লাভ কী?’ বঙ্কিম এমনভাবে বলল, যেন কত অপরাধ করে ফেলেছে! কুমারী বা বিধবার সন্তান হয়েছে!

বঙ্কিমের বাচ্চা এই সময় ওঁয়া ওঁয়া করে কেঁদে উঠল। ‘ওমা কাঁদে যে! থামাও থামাও, বাবা কী মনে করবেন?’

‘তোমার বাবাও একদিন কেঁদেছিলেন। সব বাবাই কেঁদেছিল। যাও, বাইরে যাও, আমি একে খাওয়াব।’

‘কী খাওয়াবে?’

‘আদিখ্যেতা। শিগগির পরিষ্কার একটা বাটিতে একটু গরম জল করে আনো।’

এতদিন পিতাপুত্রে রান্না করে খাওয়াদাওয়া করছিল। মাঝেমধ্যে পরমেশ্বরের বোন এসে সাহায্য করছিলেন। এই তিন চার মাস বঙ্কিম তার ব্যাচেলার লাইফ ফিরে পেয়েছিল। পরমেশ্বরও বেশ খুশি খুশি ছিলেন, যেন হারানো ছেলে ফিরে পেয়েছেন। দিনের মধ্যে এক আধবার বঙ্কিম হাসতেও দেখেছে। আজ আবার অন্য পরিস্থিতি। বঙ্কিম রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, পরমেশ্বর গম্ভীর মুখে উনুনে চায়ের কেটলি চাপিয়ে উবু হয়ে দু’হাতে মাথা ধরে বসে আছেন। বঙ্কিম একটু লজ্জা পেল। চা-টা তারই করা উচিত। আমতা আমতা করে বলল, ‘সরুন, আমি করছি।’ জল প্রায় ফুটে এসেছে, সোঁ সোঁ করছে। পরমেশ্বর একটা হাত কপাল থেকে সরিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। হাতটাকে আবার যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন—‘আমিই করছি, তুমি এখন আদারওয়াইজ এনগেজড। তোমার সময় কোথা?’ তবু বঙ্কিম চামচের পেছন দিয়ে চায়ের কৌটোর ঢাকনা খোলায় ব্যস্ত হল। খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল—ক’ কাপ জল আছে? পরমেশ্বর সেইভাবেই বসে থেকে বললেন—‘তিন কাপ। এক কাপ বেশি নিয়েছি।’ বঙ্কিম বুঝল। পরমেশ্বর প্রতিমারও জল নিয়েছেন। বঙ্কিম বলল—‘আপনি ঘরে যান, আমি চা দিয়ে আসছি।’ পরমেশ্বরকে রান্না ঘর থেকে সরাতে না পারলে বঙ্কিম তার ছেলের জন্য গরম জল বসাতে পারছে না। একেই প্রতিমা তেমন কাজের নয়, গোছানো নয় বলে প্রথম থেকেই পরমেশ্বরের অফুরন্ত অভিযোগ। এখন বঙ্কিমকে বউয়ের ফরমাইশ খাটতে দেখলে কী বলে বসবেন কে জানে! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে পরমেশ্বর উঠে দাঁড়ালেন। উঠতে বেশ কষ্ট হল। ইদানীং কোমরে বাত আশ্রয় করেছে। যেতে যেতে বলে গেলেন—‘কড়ায় চিঁড়ে ভেজে রেখেছি। চায়ের আগে দিও। ও কতদূর কী জানে জানি না, তবে তোমার কিছু জানা উচিত, এই সময় চিঁড়ে ভাজা, ঘিয়ে রসুন ভাজা, সাবু—এইসব খাওয়া উচিত।’

জলে চা ভিজছে। পরমেশ্বর যে পিড়েটায় বসেছিলেন সেই পিঁড়েতে এখন বঙ্কিম। তারও মাথায় হাত। দিনটা আনন্দের না দুঃখের বোঝা দায়। বঙ্কিম তার মায়ের অভাব এতদিনে ভাল করে বুঝল। সেদিনও বুঝেছিল, বুঝেছিল ফুলশয্যার দিন সকালে, যেদিন পরমেশ্বর তাদের ঘরে নতুন খাট ফিট করে ছেলের ফুলশয্যার শয্যা তৈরি করে দিচ্ছিলেন। রজনীগন্ধার মালা ঝুলিয়ে দিচ্ছিলেন চার দিকে। বঙ্কিম সেদিন অসম্ভব লজ্জা পেয়েছিল। সে কেবলই ভাবছিল, কয়েক ঘণ্টা পরেই এই খাটে একটা মেয়ের সঙ্গে সে শোবে, শুধু শোবে না, নিজেদের আইবুড়ো অবস্থার উপর রঙিন মশারি ঝুলিয়ে দেবে, অন্ধকার মাঝরাতে ঘরের হাওয়ায় পরীর মতো ডানা মেলে ফুলের গন্ধ উড়বে। এখন পরমেশ্বর অন্য ঘরে। নিদ্রাহীনতার রুগি। নির্জন বিছানায় স্মৃতি সঙ্গী করে ভোরের অপেক্ষায় জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকবেন।

বঙ্কিম স্টেনলেস স্টিলের বাটিটাকে অন্তত দশবার ধুলো। পৃথিবীতে সদ্য আগত অতিথি উষ্ণ জল খাবে। জল খাবে, কি অন্য কিছু খাওয়াবে প্রতিমাই জানে। অত্যন্ত সতর্ক হতে হবে, কোনওরকম জীবাণু যদি একবার ঢোকে, কতরকম কী হতে পারে—পোলিও, ডিপথেরিয়া, জিআর্ডিয়া, ব্যাসিলাই ডিসেন্ট্রি। পরমেশ্বরের হোমিওপ্যাথি বই পড়ে ভয়ঙ্কর ব্যাধির জগতের অনেক তথ্য বঙ্কিমের নখদর্পণে। প্রতিমার আবার চোরা অম্বল নেই তো! চেক করতে হবে। ভাবনার শেষ নেই। শিশুমৃত্যুর হার এদেশে এখনও খুব বেশি। তাছাড়া এ ফ্যামিলির ফার্স্ট ইসু বাঁচে না। রেকর্ড আছে। পরমেশ্বরের প্রথম কন্যা সন্তান দু মাস না তিন মাসের হয়ে পটল তুলেছিল। বেঁচে থাকলে বঙ্কিমের একটা দিদি থাকত। বঙ্কিমের জ্যাঠামশায়েরও সেই একই ব্যাপার।

দুর্ভাবনা আর গরম জল নিয়ে বঙ্কিম ঘরে ঢুকতেই প্রতিমা তাড়াতাড়ি বঙ্কিমের দিকে পিছন ফিরে বসল। ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছে। বঙ্কিমের একটু হিংসের মতো হল। মনে মনে বলল স্যাক্রিফাইস করতে হবে। বিছানার উপর একটা ময়লা এক টাকার নোট অবহেলায় পড়ে আছে। বঙ্কিম জিজ্ঞেস করল—‘এটা কী?’ ‘তোমার ছেলের মুখ দেখে গেল।’ ‘এর মধ্যে আবার কে মুখ দেখে গেল?’ প্রতিমা খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল—‘বামুনদি।’ এই বামুনদি, এক সময়, বঙ্কিমদের যখন বোলবোলা ছিল, তখন রান্নার কাজ করত। বুকে পিঠে করে বঙ্কিমকে মানুষ করেছে। এখন অন্য বাড়িতে কাজ করলেও, পুরনো মনিব বাড়ির মায়া কাটাতে পারেনি। বঙ্কিম টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে তুলে রাখল।

গরম জলের বাটিটা নিয়ে প্রতিমা বলল, ‘ঝিনুক?’ সর্বনাশ, ঝিনুক কোথায় পাবে বঙ্কিম! মুখটা কাঁচুমাচু করে ভৃত্যের মতো দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমা বলল ‘নিকালো’। এমনভাবে বলল, যেন চোরকে চোরাই মাল বের করতে বলছে জাঁদরেল দারোগা। ‘ঝিনুক তো নেই।’ ‘কেন নেই? তোমাদের হিসেব, এই হিসেবটা নেই কেন?’ বঙ্কিম বলল, ‘চামচে দিয়ে আপাতত ম্যানেজ করা যায় না!’ প্রতিমা ঝোলাটা দেখিয়ে বলল, ‘বের করো। জানতুম আমি তোমাদের মুরোদ কত!’ ঝুলি থেকে ঝিনুক বেরল। ‘কিনলে?’ প্রতিমা বলল, ‘কিনব কেন? বাপের বাড়ি থেকে বাগিয়েছি। এই ঝিনুকে আমি দুধ খেতুম।’ বঙ্কিম অবাক হয়ে ঝিনুকটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। মার ঝিনুকে ছেলে দুধ খাবে। কী আশ্চর্য! দেখা শেষ করে বঙ্কিম বলল, ‘দাঁড়াও ধুয়ে আনি।’ প্রতিমা বলল, ‘ভ্যাগ, ধোবার কী আছে? পরিষ্কারই তো আছে।’ ‘অ্যাপারেন্টলি পরিষ্কার, মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেললে অসংখ্য জীবাণু জড়িয়ে আছে। বয়েল করে স্টেরিলাইজ করে আনি। তুমিও হাত ডিসইনফেকটান্ট দিয়ে ভাল করে ধোও।’ প্রতিমা অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, ‘অত সব পারব না।’

ঝিনুক ফোটাতে ফোটাতে বঙ্কিম খুব ঘাবড়ে গেল। বউ দেখছি ব্যাকট্রোলজির এ-বি-সি জানে না। ফুলস ট্রি হোয়ার এঞ্জেলস ফিয়ার। ওঃ, বাড়িতে গিন্নিবান্নি কেউ নেই! কোর্ট থেকে কোনও হুলিয়া বের করা যায় কি? ডিসওবিডিয়েন্ট মাদার ছেলেটাকে দেখছি মেরেই ফেলবে। মা বেঁচে থাকলে যা হয় একটা কিছু করা যেত। বঙ্কিমের মঙ্গলের জন্য বঙ্কিমের মা পাঁচু ঠাকুরের দোর ধরেছিলেন। পাঁচু ঠাকুর আবার কোন দেবতা! দোর ধরাটা কী? কে বলে দেবে বঙ্কিমকে!

খাটে বসে প্রতিমা পা নাচিয়ে নাচিয়ে চিঁড়ে ভাজা চিবোচ্ছে। চিঁড়ের মুচমুচ শব্দের সঙ্গে খাটের জয়েন্টের কিঁচকিঁচ শব্দ। চায়ের কাপ থেকে রোদের গায়ে ফিকে ধোঁয়া উঠছে। ঘরে একটা বেশ সুখ-সুখ ভাব। শিশু-শিশু গন্ধ। বঙ্কিম বলল, ‘দোর ধরতে জানো?’ প্রতিমা একটু হাই তুলে বলল, ‘সে আবার কী? দোর মানে দরজা। কার দরজা?’

‘পাঁচু ঠাকুরের দরজা।’ বঙ্কিম ব্যাপারটাকে একটু ব্যাখা করল। প্রতিমা বলল, ‘অসুখটা তো মেয়েদের হয়, তোমার হল কী করে?’

‘কী অসুখ!’

‘আঁতুড়ে বাই। পূয়ের পেরাল ইনস্যানিটি বইটা পড়ে দেখো—প্রসবের পর বা পূর্বে বলক্ষয় প্রভৃতি কারণে কোনও কোনও রমণী উন্মাদহঠাৎ তার একটু কেরামতি করার ইচ্ছে হল। রোগাক্রান্ত হইয়া থাকে। ওষুধটাও দেখে নাও—হায়োসায়েমাস ৩, ট্রামোনিয়াম ৩, ক্যানাবিস ইন্ডিকা ৬, লক্ষ্মণ মিলিয়ে তোমার বাবার বাক্স থেকে এক ডোজ খেয়ে নাও।’

‘তুমিও পড়েছ?’

‘পড়ব না? আমার বাবারও ওই বই একটা আছে।’

বঙ্কিমের আর কথা বলার সময় নেই। প্রসূতি পরিচর্যা, পরমেশ্বরের চর্যা সব একসঙ্গে ঘাড়ে পড়েছে। এখুনি এক বালতি গরম জল চাই। প্রতিমার স্নান। দুপুরের খাওয়া। পরমেশ্বরের তৃতীয় পক্ষের চা। বইয়ে লেখা আছে, প্রথম সপ্তাহে ডাল বা কোনও গুরুপাক তরকারি খাওয়া সঙ্গত নয়। তাহলে মাছের ঝোলই বোধহয় বিধেয়।

বাথরুমে গরম জল দিয়ে বঙ্কিম যখন ঘরে এল, প্রতিমা তখন ঘুমন্ত ছেলেকে ঘাঁটু ঘাঁটু করে আদর করছে। ‘ব্যাটা ভীষণ শয়তান। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোবে, রাত্তিরে চিল-চেঁচান চেঁচাবে।’ বঙ্কিমকে দেখে বলল, ‘রাতে তোমার ভার। তুমি সামলাবে। আমি পড়ে পড়ে ঘুমোব।’ বঙ্কিম বলল, ‘তাহলে ঈশ্বরের কাছে দুটো জিনিস এখুনি বর হিসেবে চেয়ে নিতে হয়, সারা রাত চুষবে কী?’

গরম জল দিয়েই সমস্যা মিটল না। প্রতিমার পরবর্তী ফরমাশ, পিঠে একটু সাবান আর স্পঞ্জ ঘষে ময়লা তুলে দিতে হবে। প্রস্তাবটা লোভনীয়। প্লেজেন্ট জব। কিন্তু দুজনে বাথরুমে ঢুকলে, পরমেশ্বর যদি জানতে পারেন—জয় মা, জয় মা বলে চিৎকার করে বুঝিয়ে দেবেন, পৃথিবীতে অনাচারের বর্গক্ষেত্র ক্রমশই বড় হচ্ছে, যা কিছু ভরসা তুমি মা।

দুজনে চোরের মতো পা টিপে টিপে বাথরুমে ঢুকল। প্রতিমার তেলা পিঠে জল ঢেলে সবে সাবানের ফেনা করেছে, বন্ধ দরজা ভেদ করে একটা ক্ষীণ ওঁয়া ওঁয়া শব্দ কানে এল। বঙ্কিমের অভিলাষ পূর্ণ হল না। অনেকদিন পরে একটু স্ত্রীসঙ্গ, একটু আদর আনন্দ। স্পঞ্জটা হাত থেকে নিয়ে প্রতিমা বলল, ‘আস্তে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটুটা নাচিয়ে নাচিয়ে সুর করে আয় রে আয় রে করো, ঘুমিয়ে পড়বে। ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে তুলবে, আবার ঘাড় মটকে দিও না। ব্রহ্মতালু এখনও তপতপে, ওখানে খোঁচাখুঁচি করো না।’

বঙ্কিম বাথরুম থেকে বেরিয়েই পরমেশ্বরের সামনে পড়ে গেল। প্ল্যাস্টিকের মগ হাতে দাড়ি কামাবার জল নিতে আসছিলেন। বঙ্কিমের মুখটা শুকিয়ে গেল। তবু স্ক্রুয়িং আপ কারেজ, আমতা আমতা করে বলল, ‘একটু এনগেজড আছে, দিন আমি গরম জল রান্নাঘর থেকে এনে দিচ্ছি।’ পরমেশ্বর গম্ভীর মুখে বললেন, ‘আমিই পারব।’

তৃতীয়বারের চা দিতে গিয়ে বঙ্কিম দেখল, পরমেশ্বর হাতের তালুতে দাড়ি কামাবার বুরুশের জল ঝাড়ছেন, মনোযোগ দিয়ে। মুখ যেন আষাঢ়ের মেঘ। টেবিলের রং-চটা প্ল্যাস্টিক কভারের এক পাশে কাপ নামিয়ে রেখে বঙ্কিম বলল, ‘চা’। একটি ডিশে সকালের পুজোর দুটো প্রসাদী বাতাসা, আঢাকা পিঁপড়ের ভোগ হয়ে পড়ে আছে। বঙ্কিম জানে, একটা তার, অন্যটা তৃতীয় পক্ষের। ফুঁ দিয়ে পিঁপড়ে উড়িয়ে বাতাসা দুটো হাতে নিয়ে বঙ্কিম বেরিয়ে যাচ্ছিল, পরমেশ্বর জানালার ফ্রেমের পেরেকে সুতো বেঁধে বুরুশটা ঝোলাতে ঝোলাতে বললেন—‘তোমাদের অফিসে মেটারনিটি লিভের ব্যবস্থা আছে?’ বঙ্কিম বলল—‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আছে।’

‘তাহলে নিয়ে নাও।’

বঙ্কিম অবাক। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘সে তো মেয়েদের!’

পরমেশ্বর বললেন, ‘স্পেশাল কেস করো। দেখো গ্রান্ট করে কি না! প্রয়োজন হবে। শিশুপালন তো তোমাকেই করতে হবে। কে ওর দায়িত্ব নেবে! বুড়ো বয়সে আমার পক্ষেও সম্ভব নয়। ওর মা তো ফেলে সরে পড়বে। বেড়ালের স্বভাব। ফেলাইন হ্যাবিট। শী ইজ নট মাদারলি টাইপ।’

বঙ্কিম ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে এল। মনে মনে বলল, খেল শুরু। ছ’ মাস ফ্রন্টিয়ারে সিজফায়ার ছিল। নাও শালা, হোস্টিলিটি বিগিনস।

পরমেশ্বর নমো-নমো খাওয়া শেষ করে কাগজ পড়ছেন। প্রতিমা খেতে বসেছে। বঙ্কিম হাত নেড়ে নেড়ে ছেলের মুখের মাছি তাড়াচ্ছে। হঠাৎ তার একট কেরামতি করার ইচ্ছে হল। অধীত বিদ্যা একবার যাচাই করে দেখলে মন্দ কী! বইয়ে পড়েছে, নাভিতে রেড়ির তেলের প্রদীপের সেঁক দিলে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। বুড়ো আঙুলটা শিখায় গরম করে আলতো করে চেপে ধরো। প্রদীপ পায় কোথায়! কিন্তু লাইটার আছে। ছেলের পেটের পটিটা খুলে ফেলল। লাইটারে বুড়ো আঙুল তাতিয়ে আলতো করে চেপে ধরল। প্রথমবারে কিছু হল না, দ্বিতীয়বার দিতেই ছেলে ককিয়ে কেঁদে উঠল। প্রতিমা এঁটো হাতে ধড়মড় করে ছুটে এল, যেভাবে মুরগির মা ছুটে আসে।

‘কী করছ, কী? ও কী, ওটা খুলেছ কেন?’

বঙ্কিম অপরাধীর মতো মুখ করে বলল—‘নশো সাতচল্লিশ পাতা।’

‘তার মানে?’

‘নাভিতে প্রদীপের সেঁক দেবার কথা আছে। প্রদীপের অভাবে লাইটার।’

প্রতিমা ছোঁ মেরে লাইটারটা কেড়ে নিয়ে জানালা গলিয়ে রাস্তায় ফেলে দিল। রাগে মুখ থমথমে, ‘বুঝেছি, ছেলে সহ্য হচ্ছে না, যতক্ষণ না শেষ করতে পারছ ততক্ষণ শান্তি নেই!’ বাঁ হাতে ছেলেকে বুকে তুলে নিল। বঙ্কিম মনে মনে বলল, ভুল ভুল, পরমেশ্বরের অ্যাসেসমেন্ট ভুল। কে বলে, শী ইজ নট এ মাদারলি টাইপ। শুনিয়ে শুনিয়ে বাথরুমে গান গাইলে কী হবে, মা হওয়া কী মুখের কথা! বঙ্কিমও এবার প্রতিমার পক্ষ নিয়ে গাইবে—মা যদি নিদয়া হয়, তাহলে কী প্রাণ রহিত? বঙ্কিম লাইটার উদ্ধারের জন্য রাস্তায় দৌড়ল, রাস্তায় নেই, আটকে আছে কার্নিসে।

প্রতিমা এমনিই একটু ফাঁকিবাজ টাইপের। সংসারে সে বউ হতে চায়, ঝি নয়। অথচ বাঙালি কনজারভেটিভ পরিবারে হাম ভি মিলিটারি, তোম ভি মিলিটারি গোছের বউ কেউ চায় না। বউ হবে ডিগনিফায়েড মেড-সারভেন্ট। মুখ বুজে হুকুম তালিম করবে—পানি লাও, চা বানাও, চিৎ হও, উপুড় হও, ত্রিভঙ্গমুরারি হও। বদলে, বছরে চারখানা শাড়ি, আঁচলে এক গোছা চাবি, চার বেলা আহার, সপ্তাহে একটা সিনেমা, দশ কি বারো বছরে তিন থেকে চারবার প্রজনন। ব্যতিক্রম হলেই তুমি শালা জাঁহাবাজ মহিলা। প্রতিমা ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ে গেছে। তাকে ‘ইয়েস ওম্যান’ বলা চলে না। অতএব তিনি এখন তোফা ঘুমোবেন। আর বঙ্কিমচন্দ্র ব্যস্ত হবে সরষের বালিশ তৈরিতে। বঙ্কিমের পিসিমা কথায় কথায় বলেছিলেন, সরষের বালিশে শোয়ালে মাথাটি নিটোল গোল হবে, একেবারে পাকা বেলের মতো। বঙ্কিমের সেই কেতাব আবার বলছে, ভূমিষ্ঠ হইবার পর হইতে একুশ দিন পর্যন্ত শিশুকে চিৎভাবে শয়ন না করাইয়া ডান বা বাম পার্শ্বে শয়ন করানো ভাল। সারা মাসের রান্নার সরষে বালিশের খোলে ভরে যে জিনিস তৈরি হল তাকে বালিশ না বলে সরষের কাঁথা বলাই ভাল।

ঘুমন্ত শিশুর মাথার তলায় সেই বল বেয়ারিং বালিশ ঢোকাতে গিয়ে দুটো মারাত্মক ত্রুটি আবিষ্কার করল। প্রথমত চিৎ, দ্বিতীয়ত হাঁ করে নিশ্বাস নিচ্ছে। বঙ্কিমের বই বলছে, সব সময় নজর রাখো। হাঁ হয়েছে কী বুজিয়ে দাও। ম্যাক কঙ্কি সাহেব পই পই করে বলেছেন, ওই হাঁ পথে যত রোগজীবাণু শিশুর শরীরে ঢুকবে, প্রথম অসুখই টি বি। ইস, দিনের বেলায় না-হয় ঘুরতে ফিরতে একবার করে এসে বুজিয়ে দেওয়া গেল, রাতের বেলায় টর্চ লাইট জ্বেলে কে পাহারা দেবে। মা আর ছেলে দুজনেই হাঁ। বঙ্কিম প্রথম ছেলেরটা বোজাল। বউয়েরটা বোজাতে একটু বেগ পেল। টেম্পার করা ঠোঁট। যেই বোজায়, সঙ্গে সঙ্গে প্যাট করে খুলে যায়। বোজা, খোলা, খোলা, বোজা করতে করতে প্রতিমার ঘুম ভেঙে গেল। বঙ্কিম অপ্রস্তুতের হাসি হেসে বলল—‘হাঁ করে ঘুমনো চলবে না। জীবাণু ঢুকে যাবে।’ প্রতিমা বিশাল একটা হাই তুলে বললে—‘আদেখলের আংটি হল, দেখতে দেখতে প্রাণটা গেল। নাও, একটা ফর্দ করো—দুধ এক টিন বড়, গ্রাইপ ওয়াটার একটা, রবার ক্লথ দু’ মিটার, গোল মশারি, তোয়ালে এক ডজন।’

বঙ্কিমের মুখ শুকিয়ে গেল—টাকা? ব্যাঙ্কার তো পরমেশ্বর। বঙ্কিম জিজ্ঞেস করল, ‘এখনই দুধ কেন? এখন তো তোমার দুধই যথেষ্ট।’ প্রতিমা বলল, ‘যথেষ্ট নয় বলেই তো বলা হচ্ছে।’ কিন্তু এখনই টিনের দুধ! বই বলছে, মায়ের দুধের একমাত্র বিকল্প গাধার দুধ। পাশেই ধোপা আছে, গাধাও আছে, গাধী তো নেই। চারিদিকে এত গাধা। গাধীরা কোথায় থাকে? গাধারা কোথায় জন্মায়! বুঝেছি সব শালা খচ্চর, আসলে কেউ পিওর গাধা নয়। দুধ নিয়ে মহা চিন্তা হল তো। প্রতিমা জিজ্ঞেস করল—‘খাটালে গিয়ে রাম খেলোয়ানকে জিজ্ঞেস করে আসব, ওরা কী করে গরুর দুধ বাড়ায়?’ প্রতিমা বলল, ‘আমি জানি, ফুকো দেয়, আর রোজ পাঁচ সের ভেলি বিচিলির সঙ্গে খাওয়ায়। দুধ না কিনে যাও ফুকোর ডাক্তার ডেকে আনো।’

বিকেলের চা পর্বের ওপর সন্ধ্যা নামল। বহুকালের প্রথা, ঠাকুরঘরে প্রদীপ দেখিয়ে শাঁখ বাজানো। প্রতিমা কোনও কালেই করেনি। এখন তো সাত খুন মাপ। আঁতুড়ে পক্ষাঘাত। পরমেশ্বরই করেন। মেয়েদের হাতে শেষ সন্ধ্যার প্রদীপ পড়েছিল তিরিশ বছর আগে। বঙ্কিম শাখের আওয়াজ শুনল। পরমেশ্বর বাজাচ্ছেন। পরমেশ্বরের এই শাঁখ সন্ধ্যায় মাঙ্গলিক নয়, প্রতিমার অক্ষমতার পেছনে শিঙে ফোঁকা। প্রথম ফুঁ—অপদার্থ। দ্বিতীয় ফুঁ—ম্লেচ্ছ স্বভাব। তৃতীয় ফুঁ—দেখব, দেখব, কতদিন এই ভেড়া-স্বামীর পদসেবা পাস হতভাগী। সন্ধে উৎরে অন্ধকার বেশ ঘন হল। পরমেশ্বর খবরের কাগজে মুড়ি ঢেলে তেল মেখে খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে এক-আধটা বাদামভাজা, একটা করে গোলমরিচের দানা। কুড়িটা বাদাম, পাঁচটা মরিচ হল ভোজ। বঙ্কিম পায়ে পায়ে ঘরে ঢুকল। পরমেশ্বর আড়চোখে দেখে শুকনো গলায় বললেন—’আয়।’

গলার স্বরে আর বেশিদূর কথা এগোক এমন কোনও ইঙ্গিত নেই। তবু বঙ্কিমকে বলতে হবে—দুধের কথা, রবার ক্লথের কথা, তোয়ালের কথা। বঙ্কিম আমতা আমতা করে বলল—‘ওটাকে একবার দেখলেন না!’ ওটা শব্দটা এমনভাবে উচ্চারণ করল যেন নিউটার জেন্ডার। একটা কীটপতঙ্গ বিশেষ। পিতৃত্বের অহঙ্কারকে বাথটবের ঠাণ্ডা জলে চুবিয়ে মার। পরমেশ্বর ইস্‌স্‌ করে একটা শব্দ করলেন—মরিচের ঝাল হতে পারে, বা ভেতরে জমে থাকা বিষাক্ত হাওয়ার। আউটলেটও হতে পারে। নির্বিকার মুখে বললেন—‘দেখার সময় এলেই দেখব। আমার সব কিছু একটা নিয়ম আছে।’ নিয়মের লাটাকলে পরমেশ্বর বাঁধা। বঙ্কিম প্রস্তুত হল পরের প্রসঙ্গের জন্য। মোস্ট ডেলিকেট ইস্যু টাকা। একটা ঢোঁক গিলে বলল—‘কিছু টাকার প্রয়োজন ছিল, কয়েকটা জিনিস, এই যেমন…।’ পরমেশ্বর একটা মরিচ মুখে ফেলতে যাচ্ছিলেন, ফেলা হল না, দু’ আঙুলে ধরে রেখে বললেন, ‘আই অ্যাম সরি বঙ্কিম, আমার হাত এখন একেবারে খালি। ধারধোর করে জোগাড়ের চেষ্টা করতে হবে।’ তার মানে তুমি ধার-টার করে ম্যানেজ করো। পরমেশ্বর আর একটু যোগ করলেন—‘আমি তো প্রিপেয়ারড হবার কোনও চান্‌সই পেুলম না। সব কিছুর একটা প্রিপারেশন চাই। তুমি প্রিপেয়ারড না হয়ে পরীক্ষা দিয়ে ফেল করলে, প্রিপেয়ারড না হয়ে ফাদার হলে, পভার্টি ডেকে আনলে।’ বঙ্কিমকে বেশ মোলায়েম করে কড়কে দিলেন। বাছাধন এইবার বোঝে, বাপ হয়ে বাপ বাপ করো।

সব শুনে প্রতিমা বলল, ‘এইবার লোকের বাড়ি ঝি-গিরি করতে বেরুই, ওইটাই আর বাকি থাকে কেন। বড়ি-খোঁপা করে, মুখে দোক্তাপান ঠুসে বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে বেড়াই।’ বঙ্কিম বলল, ‘কাল থেকেই চেষ্টা করি, মারোয়াড়ির গদিতে পার্ট টাইম। না জোটে ফুটপাথে গামছা বিক্রি। মধ্যবিত্তের আবার মানসম্মান! ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে তো। আপাতত ঘড়িটা বেচে যা লাগে কিনে আনি।’ প্রতিমা বলল-‘মাইরি আর কী! ঘড়িটা আমার বাবার দেওয়া। বেচতে হয় তোমার বাপের ট্যাঁকঘড়িটা বেচো গে যাও।’

শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাউকেই কিছু করতে হল না। সাত দিনের দিন পরমেশ্বর বঙ্কিমের মার একটা মপচেন বঙ্কিমের ছেলের গলায় পরিয়ে দিলেন। স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র পরেছেন। কপালে চন্দনের টিপ। রুম চোখে কোমল দৃষ্টি। দু’হাতের উপর শিশুকে শুইয়ে বঙ্কিমের ঠাকুদার ছবির সামনে চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে বললেন—‘এসেছেন, তিনি এসেছেন।’

সেই শিশু পরমেশ্বরের হাতে বড় হতে হতে এখন বারো বছরের দুর্দান্ত কিশোর। পরমেশ্বর বাহাত্তর বছরের সাত্ত্বিক বৃদ্ধ। বঙ্কিমের চুল পেকেছে। ছুটির দিন প্রতিমা পাকা চুল তুলে দেয়। তা না হলে কুটকুট করে। অস্থির করে মারে। বিল্ডিং ফান্ডের টাকায় নতুন বাড়ি হয়েছে। দোতলার ঘরে দাদু আর নাতি হইহই করে ক্যারাম খেলে। বৃদ্ধ নাতিকে বলেন, ‘তোমার বাবার অনেক গুণ ছিল। মহাপুরুষ হতে হতে একটুর জন্য পুরুষ হয়ে গেছে।’ নাতি বলে, ‘রেগে গেলে বাবাকে মহাপুরুষের মতো দেখায়।’ পরমেশ্বর হাসতে হাসতে বলেন, ‘ইয়েস, ঠিক বলছ। রাগ হল পুরুষের অলঙ্কার। তোমার যা ইন্টেলিজেন্স আর অবজার্ভেশন, মরে যদি না যাও তুমি মহাপুরুষ হবে। দেখি রবিরেখাটা একবার।’ রোজ একবার করে নাতির রবিরেখা দেখেন। নাতি তখন দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে আবদারের গলায় বলে, ‘দাদি আর একটা, আর একটা দাদি।’

পরমেশ্বর তাঁর সামান্য পেনশনের টাকায় এই হনুমানের জন্য ফল-পাকড় কলা স্টোর করে রাখেন। যেমন রাখতেন মা-মরা বঙ্কিমের জন্য আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে। নাতি এখন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের শয্যাসঙ্গী। নিদ্রাহীন বৃদ্ধ মাঝরাতে ঘরময় পায়চারি করেন। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় অন্ধকার দুলে ওঠে। স্ত্রীর ছবির সামনে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আর পাঁচটা বছর আমাকে সময় দাও। আমার শেষ যুদ্ধটা করে যাই। তুমি তো জানো, আমি সহজে কখনও হারি না। জাস্ট ফাইভ ইয়ারস, মাই জব উইল বি ডান। আমার বড্ড ভরসা এই ছেলেটা। তোমারও তো নাতি গো। বেঁচে থাকলে, কী বলো?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *