জুতো

জুতো

জুতোটা কিনতে অনেক কসরত করতে হল। জুতো কেনা আর চুল কাটা প্রায় একই ব্যাপার। অনেক পাঁয়তারা কষে তবেই চুল কাটা যায়, তবেই জুতো কেনা যায়। প্রথমত পুরনো জুতোর একটা আলাদা সোহাগ আছে, পুরনো স্ত্রীর মতোই। সেই সোহাগ ছেড়ে নতুন জুতোয় সহজে পা গলাতে ইচ্ছে করে না; টাকাটা অনেকদিন ধরেই পকেটে ঘুরছিল। রোজই ঘুরে ঘুরে বাড়ি ফিরে আসছিল। আর প্রতিদিনই সেই টাকা থেকে একটা দুটো খরচ হয়ে যাচ্ছিল। শেষে প্রায় মরিয়া হয়ে এক সন্ধ্যায় জুতোজোড়া কিনেই ফেললুম। শো-উইন্ডোর কাচে নাক ঠেকিয়ে প্রথম সব রকমের জুতো যতটা সম্ভব সময় নিয়ে পরিদর্শন করে ফেললুম। উইন্ডোর কাচটা এমন পরিষ্কার যে কাচ আছে কি নেই বুঝতে না পেরে মাথাটা কাছে আনতে গিয়ে নাকটা ধাঁই করে কাচে ঠুকে গেল। চোখ দিয়ে একটু জলও বেরুল। আশেপাশে লোক ছিল, পাছে তাঁরা ভাবেন—লোকটা গেঁয়ো ভূত, তাই নাকটা কাচেই ঠেকিয়ে রাখলাম—যেন কাচে নাক ঠেকিয়ে জুতো দেখাই আমার অনেক দিনের অভ্যাস। জুতোর পাশে যে সব টিকিট খাড়া করে রাখা ছিল তাতে দামের বহর দেখে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করল। কাচ থেকে নাকটা তুলে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলুম। পাশ দিয়ে একজন সুন্দর চেহারার মহিলা যাচ্ছিলেন। মহিলাদের দেখলেই আমার কী রকম আপনার লোক বলে মনে হয়। ভাবলাম মহিলাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করি—এত দাম দিয়ে আমার একজোড়া জুতো কেনা উচিত হবে কি না? আসলে আমি তখন আমার এই কেনার ব্যাপারে একটা জোরালো নৈতিক সমর্থন খুঁজছিলাম। ভদ্রমহিলাকে পায়ের জুতোটা দেখিয়ে বললুম—এই অবস্থা! উপরের সাজটাই আছে তলাটা নেই বললেই চলে। পায়ের তলাটাই জুতোর তলার কাজ করে। মসৃণ পিচের রাস্তায় নো-ট্রাবল, কেবল খোয়া-ওঠা রাস্তায়, পিচ-গলা রাস্তায় কিংবা বর্ষার রাস্তায় বড় কষ্ট দেয়। এখন বলুন—আমার এই সঙ্কটজনক অবস্থায় একটা জুতো কেনা উচিত নয় কী? ভাবতে ভাবতেই ভদ্রমহিলা অনেক দূরে চলে গেলেন। মহিলাদের সামান্য একটু উসকানিতে কী না করা যায়। লেডি ম্যাকবেথের কথায় এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল, যার ধাক্‌কায় আজও পর্যন্ত কলেজে কলেজে ছেলেদের প্রাণ যায়। সামান্য এক জোড়া জুতো কেনা তো কিছুই নয়। ভদ্রমহিলার শরীরের শেষ দৃশ্যমান অংশটুকু চোখের বাইরে চলে যাবার পর আবিষ্কার করলুম—সাহসের অভাব ঘটেছে! চাঙ্গা হবার জন্য কাছাকাছি একটা দোকানে গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে বসলুম। সত্যি, চায়ের কী গুণ! চা খেতে খেতেই মনের কোণে একটা মরিয়া ভাব চিনচিন করে উঠল। যা থাকে বরাতে, জুতো আজ আমি কিনবই।

সকলেরই পায়ের একটা সোজা মাপ থাকে। আমার সবই উলটো। পাঁচ-নম্বর পায়ে ঢোকে না, আবার ছ নম্বর হপ্‌ হপ্‌ করে খুলে যায়। দোকানের বিক্রেতা এক নজরে আমার পা-টা দেখে নিয়েই বললেন—পাঁচই আপনার সাইজ। কথাটা বলেই এক টিপ নস্যি নিয়ে একটা অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে টঙে উঠে গেলেন। সেখানে পর পর জুতোর বাক্স ডাঁই করা। এক সার বাক্সের উপর দিয়ে হাতের একটা আঙুল সড়াক করে উপর থেকে নীচে নামিয়ে এনে একটা বাক্স অদ্ভুত কায়দায় টেনে বের করে নেমে এলেন।

ভদ্রলোকের মইয়ের উপর ওঠা আর নামাটা যেমন গ্রেসফুল, তেমনি জুতোর বাক্সটাকে খুলে জুতো দুটোকে তলায় তলায় ঠাস্ ঠাস্ করে ঠুকে আলতোভাবে হাতের উপর ডিগবাজি খাইয়ে হাঁটু গেড়ে বসার ভঙ্গিটিও চমৎকার। শুধু এইটুকু খেলা দেখাবার জন্যই আমি কিছু টাকা দিতে প্রস্তুত ছিলাম। ভদ্রলোক আমার ডান পাটাকে জুতো পরাবার বাক্সের উপর টেনে নিয়ে, জুতোটা আঙুলের উপর লাগালেন। আমার নিজের চেষ্টায় পা ঢুকল না। ভদ্রলোক একটু ধমক দিলেন—দুর মশাই, ঘোড়া দেখলে দেখি খোঁড়া হন। আয়েস করে পা ঢোকালে ঢোকে? একটু উঠে ঢোকাবার চেষ্টা করতে হয়। ভদ্রলোকের প্রেরণায় উৎসাহিত হয়ে উঠে একটু বেশি চাপ দিতেই, জুতোর গোড়ালিটা একটু দোমড়াল মাত্র, আমার অবাধ্য পা কিন্তু সেই জুতো আর জুতোর মধ্যেকার শূন্যতার মাঝখানে বিদ্রোহীর মতো রয়ে গেল। পাছে গোড়ালি মচকে জুতো ড্যামেজ হয়ে যায় সেই ভয়ে ভদ্রলোক হাঁ হাঁ করে উঠলেন—আহা, করেন কী, করেন কী! সব কিছুই সইয়ে সইয়ে ঢাকাতে হয়। ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে জুতো পরাবার জিভ কোথা থেকে জোগাড় করে নিয়ে এলেন। জিভটাকে পায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে ভীষণ একটা কাণ্ড করলেন। পায়ে সুড়সুড়ি লাগছিল বলে আমি মাঝে মাঝে কুঁচকে যাচ্ছিলাম। তাতে ভদ্রলোক বিরক্ত হচ্ছিলেন—মেয়েছেলেকেও হার মানালেন। অবশেষে দুজনের প্রাণপণ চেষ্টায় পা ঢুকল।

—নিন, এবার হেঁটে দেখুন—

দোকানের ঢালাও দড়ির পাপোশে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে দু-কদম হেঁটে ফিরে এলুম নিজের আসনে, যেখান থেকে স্টার্ট করেছিলুম সেইখানেই। খাটো একটা জুতো পরাবার একদিকে উঁচু একদিকে গড়ানে টুলের উপর বসে হাসি-হাসি মুখে ভদ্রলোক আমাকে বিজয়ীর সম্মানে রিসিভ করলেন—

—কী! বলেছিলুম কি না! পাঁচই আপনার সাইজ?

—কিন্তু ভীষণ যে লাগছে! মরে যাবার মতো লাগছে।

—সব মনের ভুল মশাই। ও-রকম মনে হয়। বাঙালি তো মরেই আছে, তাহলে লাগে কী করে?

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম—আমি বোধহয় বেঁচে আছি তাই এত লাগছে। পায়ে পক্ষাঘাত না হলে এ জুতো পায়ে রাখে কার বাপের সাধ্যি! এ জুতো পা থেকে খুলবে তো না, কেটে বের করতে হবে!

ভদ্রলোক আমার ভয় দেখে হাঁ হয়ে গেলেন। শেষে পকেট থেকে নস্যি বের করে এক টিপ নিয়ে আমায় বললেন—নেবেন?

—নস্যি আমি নিই না।

—একেবারে এলেবেলে আপনি। শুনুন, প্রথম প্রথম সব নতুন জিনিসই একটু লাগে, পরে ঠিক হয়ে যায়। জুতো কী মশাই গোলাপের পাপড়ি, না ঘাসে ঢাকা জমি, না পারসি কার্পেট! গরুর চামড়ায় পেরেক সেঁটে পাদুকা হয়। আপনার মতো আউপাতালে লোকের তুলোর বা পশমের জুতো পরা উচিত।

আমি ভদ্রলোককে একটু শান্ত করে বলি—আহা, রাগছেন কেন? সবই জানি, কিন্তু জুতোটা তো সাইজ মতো হওয়া চাই?

—সাইজ? ভদ্রলোক যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। —বেসাইজের লোক আপনি সাইজ খুঁজছেন। কটা লোকের পায়ে মশাই জুতো ফিট করে! জুতোতেই পা ফিট করাতে হয়। ২৪ বছর ধরে জুতো বেচছি—আমাকে ফিটিং শেখাবেন না। আমার কাছে শুনে রাখুন, পরে কাজে লাগবে—জুতোতে পা ফিট করাতে হয়, চশমায় চোখ, স্ত্রীতে স্বামী।

কথা বলতে বলতেই জুতো প্যাক হয়ে গেল। জুতোটাকে অদ্ভুত কায়দায় যে-ভদ্রলোক বিল করছিলেন, তাঁর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন—বিল করুন!

আমার খুঁতখুঁতুনি তখনও গেল না—জুতোটা ঠিক ফিট করল না, ঠিক ফিট করল না।

ভদ্রলোক এবার বেশ রেগেই বললেন—আবার সেই ফিট্‌ ফিট্‌ করছেন? শুনলেন কী? জুতো কারুর ফিট করে না। জীবনে খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোকেরা কখনও সুখী হয় না। যা পাবেন তাই পরবেন, যা পাবেন তাই খাবেন।

জুতোর বাক্স বগলদাবা করে বেরিয়ে এলুম। বাপ্‌স, কী পাল্লায় পড়েছিলুম। নতুন জুতো পরেই তো আর রাস্তায় বেরুনো যায় না। জুতো পায়ে ব্রেক করতে হয়। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর জুতো জোড়া বের করে পায়ে ঢোকাতে গিয়েই হিমসিম! জুতো-পরার চামচ ছিল না। হঠাৎ মনে পড়ল শীতকালে ঠোঁটে লাগাবার জন্য একটিন পেট্রোলিয়াম জেলি ছিল তাকে তোলা। খানিকটা জেলি গোড়ালিতে লাগিয়ে একটু চাপ দিতেই পা ঢুকে গেল। পাঞ্জায় আর আঙুলে ভীষণ চাপ লাগল। পায়ের পাঁচটা আঙুল একটা আর একটার ঘাড়ে উঠে, এক সঙ্গে জড়াজড়ি করে জুতোর সামনের দিকটায় একটা অসুবিধের সৃষ্টি করল। কিন্তু জুতোটা যে বেশ ছোটখাটো মাপসই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। প্রথমে দাঁড়াতে একটু অসুবিধে হল। পায়ের প্রধান শিরার ওপর চাপ পড়ে পা টনটন করছিল। শুনেছি ব্যথা বেদনার উপলব্ধি সবই হল মনের ব্যাপার। কত লোক তো অবলীলাক্রমে কাচের উপর, আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, চড়কগাছ চেপে পিছনে লোহার হুক গেঁথে বন্‌ বন্‌ করে ঘোরে। মহামতি ভীষ্ম তো শরশয্যায় শুয়ে শুয়ে জীবনটা কাটিয়ে গেলেন। যিশুখ্রিস্ট ক্রুশে পেরেক বেঁধা হয়ে কেবল হাসি-হাসি মুখে কয়েকদিন কাটিয়ে দিলেন, আর আমি এই সামান্য যন্ত্রণা সহ্য করতে পারব না…।

স্বামীজি বলেছিলেন, ব্যথার জায়গা থেকে মনটাকে তুলে নেবার কৌশলটা আয়ত্ত করতে পারলে দৈহিক যন্ত্রণার কোনও উপলদ্ধিই থাকবে না। শোবার ঘরের মেজেতে এক-পা হাঁটি আর সেই কৌশলটা আয়ত্ত করার চেষ্টা করি। কতক্ষণ পায়চারি করেছিলুম মনে নেই, হঠাৎ দেখি নীচের ফ্ল্যাটের ছেলেটি উপরে উঠে এসেছে—বাবা বলে পাঠালেন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা হল, আমরা নীচে কেউ চোখ বুজতে পারছি না, আপনি তো আগে কখনও এমনভাবে ঘণ্টার ঘর ঘণ্টা জুতো পায়ে ঘরময় দুরমুশ করে বেড়াতেন না।

—তাই নাকি? তবে জেনে রাখো, যতক্ষণ না এক মাইল হাঁটা শেষ হচ্ছে, ততক্ষণ আমাকে হাঁটতেই হবে। তুমি জানো না—আফ্‌টার সাপার ওয়াক এ মাইল।

ছেলেটিকে বিদেয় করে—ওয়াক এ মাইলের মহড়া চলল। না দেখলেও অনুমানে বুঝলাম আমার ঘরের নীচে একটি পরিবার কেমন আতঙ্কে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা বাজল ঢং করে, পাপপাশের উপর জুতো জোড়া খুলে রেখে, বিছানায় পা তুলে বসলাম। হাতে বার্নলের টিউব। ক্ষতবিক্ষত পায়ের চিকিৎসায় মিনিট পনেরো কাটল।

আমার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলাটা, অফিসের প্রথমেই যাঁর নজরে পড়ল, তিনি হলেন বড়বাবু। বড়বাবু ইদানীং আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারেও একটু মাথা ঘামাচ্ছেন। দুর্জনে বলে— বড়বাবুর নাকি একটি বিবাহযোগ্য মেয়ে আছে। লম্বা চওড়া। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সমান। ডাকসাইটে মেয়ে। বড়বাবু বললেন—নতুন জুতো পরলে প্রথম প্রথম একটু একটু ফোসকাটোসকা হবেই বাবা। এ কী সাহেববাড়ির জুতো! আমাদের যৌবনকালে সব পরতুম। পায়ে জুতো আছে কি নেই বোঝাই যেত না। হাঁটলে একটা মোলায়েম মুচমুচ আওয়াজ হত। সেই শব্দটার অনুসরণ করে মাইলের পর মাইল হাঁটা যেত। জুতোটা কি তোমার একটু টাইট হয়েছে?

—একটু বোধহয় হয়েছে। আমার পায়ে জুতো ঠিক লাগে না। সাইজের গোলমাল আছে। পাঁচ আর ছয়ের মাঝখানে—

—ওই তো মুশকিল বাবা। সেই মধ্যবিত্তের সমস্যা। মাঝামাঝি থাকার বিপদ।

বড়বাবু একটা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। পায়ের মাপ আর জুতোর মাপের গোলমালের ঝাঁকে মধ্যবিত্তের উপমা ঢুকিয়ে বেশ একটা ইন্টেলেক্‌চুয়েল ঘুষি হাঁকিয়েছেন ভেবে কেমন একটা গদগদ ভাব মুখের চেহারায় ফুটিয়ে তুলল।

বড়বাবুর পাশে বসেন টাইপিস্ট কালীবাবু। একমাথা পাকা চুল। ঠোঁটের উপর ঝ্যাঁটা গোঁফ। চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলেন। মেয়েদের দিকে মিটিমিটি চান। কিছু টাইপ করতে দিলে মহা বিরক্তি। গল্প করতে পারলে মহা খুশি। কালীবাবু বললেন—জুতো সব সময় বড় কিনবে। বড় জুতো ছোট করা যায় সুকতলা-মুকতলা দিয়ে। কিন্তু ছোট জুতোকে বড় করা, বুঝলে কি না, ভেরি ডিফিকাল্ট।

বড়বাবু বললেন—জুতো বড়ও ভাল না, ছোটও ভাল না। ঠিক ঠিক মাপের হতে হবে। তুমি জুতোর কী বোঝ কালী। সারা জীবন তো টায়ারের চটি পায়ে দিয়েই কাটালে।

—টায়ারের চটি পায়ে দেয়া শুরু করেছি, মেয়ের বিয়ের পর, তার আগে আপনি আমার পায়ে গ্রিসিয়ান দেখেননি?

—তুমি জুতোর কথা আমাকে বলতে এসো না। এখনও রবিবার আমার বাড়িতে গেলে দেখবে, দুপুরবেলা ঘুমটুম ছেড়ে আমি বসে আছি, চারদিকে ছড়ানো কমসে কম পনেরো জোড়া জুতো। এক-একটার এক-একরকম ধাত।

—জুতো আপনিও আমাকে দেখাবেন না। আবার বাবা ছিলেন জি পি ও-র বড়বাবু। কমসে কম ষাট জোড়া জুতো ছিল বাড়িতে। বাবার তো কথায় কথায় জুতো—এক-একটার এক-এক রকম স্বাদ।

বড়বাবু ফাইলের মধ্যে থেকে ঠাসা দু’পাতার একটা ড্রাফ্‌ট বের করে কালীবাবুকে ধরিয়ে দিলেন। দুটোর মধ্যে চাই। বড়বাবুর সঙ্গে তর্ক করার শাস্তি। কালীবাবু বেজার মুখে বাক্স পেটাতে বসলেন।

—তুমি এক কাজ করে অরিন্দম। বড়বাবু একটা রাস্তা বাতলালেন—পোয়াটাক টকদই কিনে জুতোটাকে খাওয়াও।

আমি বোকার মতো প্রশ্ন করলুম—কীভাবে, ঘোল করে?

—আরে না না। একটা ন্যাকড়া দিয়ে থ্যাপ থ্যাপ করে জুতো দুটোর আষ্টেপৃষ্টে মাখিয়ে ফেলে রাখবে একদিন, দেখবে নরম তুলতুলে হয়ে গেছে।

—আরে না না, দই মাখিয়ে কী হবে? কালীবাবু টাইপ করতে করতেই বললেন। বড়বাবু একবার কটমট করে তাকালেন। কোনও কাজ হল না। কালীবাবু তখন মরিয়া। টাইপের হাত থেকে যখন নিষ্কৃতি পেলেন না, তখন বড়বাবুকে খাতির করার কী মানে। কালীবাবু বললেন—দইটা ঘোল করে খেও। জুতোটাকে জলে ভিজিয়ে লাশে চাপিয়ে রাখো একদিন। দেখবে ঠিক হয়ে গেছে।

—লাশে মানে? বেশ অবাক হলাম। লাশ মানে তো মৃতদেহ। শেষে কী জুতোর জন্য শব সাধনা করতে হবে?

আরে দূর। বড়বাবু ঠোঁট উল্টে কালীবাবুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন। কিচ্ছু জানে না। লাশ নয়, লাশ নয়। আসল শব্দটা হল লাস্ট—শু লাস্ট। জুতোর দোকানে দেখোনি, সারি সারি ঝোলে—কাঠের তৈরি পায়ের পাতার মতো দেখতে। আচ্ছা তোমার অত হাঙ্গামার দরকার কী? তুমি জুতো জোড়া আমার বাড়িতে পৌঁছে দিও। মালু এইসব ব্যাপারে এক্সপার্ট।

মালু হল বড়বাবুর সেই ম্যাগনাম মেয়ে, ভাল নাম মলিনা। রাতে বাড়ি ফিরতেই, নীচের ফ্ল্যাটের প্রতাপবাবু সিঁড়ির মুখে হাত জোড় করে বললেন—আমার স্ত্রী বড় অসুস্থ। আজ আর দয়া করে ওয়াক-এ-মাইল করবেন না। এই নিন আমি একটা হজমের জন্য এনজাইম কিনে এনেছি। একটা ক্যাপসুলেই একশো মাইল হাঁটার এফেক্ট পাবেন।

ওষুধের ফাইলটা হাতে নিয়ে উপরে উঠে এলুম। পায়ের যা অবস্থা, জুতো আর পায়ে উঠবে না। পাপোশের উপর জুতো দুপাটি নির্বোধের মতো বসে আছে। চক্‌চকে শরীরে মিহি ধুলো জমেছে। একটা ব্রাশ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে জুতো যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিলুম।

তিন চার দিন পরে পাটা একটু সুস্থ হতেই, আহাম্মকের মতো একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেললুম। সকালে চানটান করে খাওয়া-দাওয়ার পর, কী খেয়াল হল, নতুন জুতোয় একবার পা গলাবার ইচ্ছে হল। জুতো দুপাটি সহজেই পায়ে উঠে এল। আশ্চর্য। এ কী—তাহলে সকালের জুতো? বিকেলে পা গলাতে ফাটাফাটি, সকালে সো ইজি। পুজোর মুখ। হাওয়ায় শীতের কামড় লেগেছে। নতুন জুতো পায়েই সাহস করে অফিসে চলে এলুম। সাহস করে রাস্তায় পরে না বেরুলে আর কবে বেরুব। পয়সা খরচ করে কেনা, পরার জন্যই তো। অত পয়সা নেই যে কথায় কথায় জুতো কিনব।

বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ড অবধি রিকশায় আসি। সেখান থেকে বাস। অফিস পাড়ায় বাস থেকে নেমে খানিকটা হাঁটতে হয়। বাসে ওঠার সময় এক ভদ্রলোক জুতোটা মাড়িয়ে দিলেন। বিশ্রী একটা দাগ হয়ে গেল। ভদ্রলোক এর চেয়ে যদি আমার মুখে এক ঘা জুতো লাগাতেন, কিছু বলার ছিল না। বসে বসে, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলাম। ঘনঘন মুখ মুছছি। মুছতে মুছতে এক ফাঁকে নিচু হয়ে ঝট করে জুতোর ডগাটাও মুছে নিলুম। এমন কায়দায় মুছলুম, আশেপাশে কেউ বুঝতেই পারল না। মুখ মোছা আর জুতো মোছা এমন কায়দায় মিলিয়ে দিলুম, ধরার উপায় নেই। বাস থেকে নেমে অফিস, পৌনে এক মাইলের মতো দূরত্ব। প্রথমে একটু কষ্ট লাগছিল। মনের জোরে সে কষ্ট কাটিয়ে উঠলুম।

লিফ্‌ট থেকে নেমে অফিসের করিডরে যখন হাঁটছি, জুতো থেকে মৃদু মুচমুচ আওয়াজ উঠছে, আর সে কী অসাধারণ জুতোর জেল্লা। অফিসের চেয়ারে বসে যখন কাজ করি, জুতো খুলেই রাখি, পাটা বেশ ঠাণ্ডা থাকে। পায়ের তলার পাদানির উপর পা দুটোকে টান করে পাশাপাশি ফেলে রাখি। চারটে সাড়ে-চারটে নাগাদ মহা বিপদে পড়লুম। জুতোর মধ্যে কিছুতেই আর পা ঢুকতে চায় না। বড়বাবুর ঘন ঘন তলব, অথচ কিছুতেই পায়ে ঢোকাতে পারি না। শেষে খালি পায়েই দৌড়ে গেলুম। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ধুতির কোঁচা লুটোচ্ছে, গায়ে আদ্দির পাঞ্জাবি, এদিকে শুধু পা।

—এ কী ব্যাপার, অশোচ নাকি? না রাগ করে জুতো পরাই ছেড়ে দিলে। বড়বাবুর যত প্রশ্ন সব এক সঙ্গেই খালি করে দিলেন।

—আজ্ঞে না, ওসব কিছু না। সেই নতুন জুতো। সকালে বেশ সহজেই পায়ে ঢুকে গেল। কাজ করার সময় একটু খুলে বসেছিলুম। এখন শেষ বেলায় কিছুতেই আর পায়ে ঢুকছে না।

—এই দেখো, তোমার শরীর বাবা একটু রসস্থ হয়েছে। একাদশী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা করো?

—তার মানে?

—উপোসটুপোস করো?

—আজ্ঞে না।

—হুঁ, এবার থেকে করতে হবে। দুবেলা রুটি খাবে, চিনি খাওয়া কমাও, নুন খাওয়াও কম করো।

—আজ্ঞে, তাহলে বলছেন জুতোয় সহজেই পা ঢুকবে।

—হ্যাঁ গো, তোমার পা ফুলেছে। যা বললুম, তা করলে এক মাসের মধ্যে তোমার পা ফোলা কমে যাবে। পা দুটো দেখবে কেমন আমসত্ত্বর মতো পাতলা হয়ে গেছে।

—কিন্তু এখন কী হবে? জুতো হাতে বাড়ি যেতে হবে!

—তা কেন? তুমি এক কাজ করো। বড়কর্তা টুরে গেছেন, তুমি ওই ঘরে চলে যাও। ঘরে একটা ডেক চেয়ার আছে, সেইটায় শুয়ে পড়ে পা দুটো উঁচু করে জানালার উপর তুলে দাও। ঘণ্টাখানেক ওইভাবে থাকলে পা চুপসে যাবে।

বড়কর্তার কামরা গঙ্গার দিকে। ডেক চেয়ারটা একটা পার্টিশানের আড়ালে গঙ্গামুখো ঘোরানো। বড়কর্তা প্রকৃতি-প্রেমিক। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে মুখে পাইপ দিয়ে এই চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে গঙ্গা, জাহাজ, উন্মুক্ত আকাশ ইত্যাদি দেখে থাকেন।

পা দুটো উঁচু করে জানালার উপর তুলে দিয়ে আরাম করে আরাম-কেদারায় বসলুম। সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। আকাশে তখন শুকনো চাষের ক্ষেতের মতো কোদালে মেঘ জমেছে। সূর্যের আলো পড়ে সোনার মতো দেখাচ্ছে। ফুরফুরে হাওয়া আসছে। এত ভাল লাগছে। মনে হল একটা কবিতা লিখে ফেলি—মালু, তুমি আমার গোল আলু, সব সময় তুমি যেন আলুথালু। কবিতা বেশিদূর এগোলো না, এর পর কী যে হল বলতে পারব না। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আমার সেই সর্বনেশে ঘুম। যে ঘুমের জন্য মাসের মধ্যে অন্তত দশদিন আমি বাড়ির স্টপেজে, কী অফিসের স্টপেজে নামতে পারি না। টার্মিনাসে বাস লেগে যায়, আমি তখন হাঁ করে ঘাড় কাত করে ঘুমোই। যে ঘুমের জন্য আমি যশিডি স্টেশনে নামতে গিয়ে পাটনা চলে গিয়েছিলুম, আবার পাটনা থেকে ফিরতি পথে ঘুমোতে ঘুমোতে হাওড়া চলে এসেছিলুম। দুবারই ঘুমের চোটে যশিডি নামা হয়নি। যে ঘুমের জন্য ইদানীং বাসে বা ট্রামে বসার জায়গা পেলেও বসি না। ঘর অন্ধকার। যে আকাশে রোদ ঝলমল করছিল সে আকাশে ঝকঝক করছে এক ঝাঁক তারা। সর্বনাশ! রাত প্রায় সাড়ে আটটা। ঘরের দরজা টেনে দেখি, বাইরে থেকে বন্ধ। কেয়ারটেকারের লোক এসে কখন চাবি দিয়ে গেছে। পার্টিশানের পেছনে ছিলুম, দেখেওনি হয়তো। এখন উপায়। ডাকলেও সাড়া পাব না। এই সব আকাশছোঁয়া বাড়ির কে কোন তলায় আছে কে জানে? কেয়ারটেকার আছেন তেরো তলায়। দরওয়ানরা আছে পাশের একটা ছোট ব্লকে। বহু দূরে ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে দুএকজন পিঁপড়ের মতো খুদে লোক চলেছে।

ভীষণ রাগ হল নিজের উপর। সারা রাত থাক পড়ে এই ঘরে। তারপর চুরির দায়ে ধরা পড়। অনেক ভেবে ঠিক করলুম ডিরেক্ট লাইন থেকে কেয়ারটেকারকে ফোন করব। ভয় হল। যদি জিজ্ঞেস করেন, কী করতে ঢুকেছিলেন ওই ঘরে? তারপর একলা না এসে যদি পুলিশ নিয়ে আসেন। তার চেয়ে বড়বাবুকে ফোন করি। করে বলি, একটু কেয়ারটেকারকে বলে দিন, কী অবস্থার মধ্যে ঘরে আটকা পড়েছি।

অনেকক্ষণ ধরে ফোন বেজে গেল, তারপর নারীকণ্ঠে হ্যালো। কে হতে পারে? বড়বাবুর স্ত্রী অথবা মালু।

কাকে চাই? বড়বাবুকে দিন না। কে আপনি? অরিন্দম। নামটা শুনেই ভদ্রমহিলা চিৎকার দিলেন—ও মা। বুঝলুম—মালু। বড়বাবুর গলা পাওয়া গেল।

—সে কী হে। তুমি এখন অফিসে? আটকা পড়েছ। মাই গড। পায়ের খবর কী? জুতো ঢুকেছে?

জুতোর কথা বলতে খেয়াল হল। আশ্চর্য! জুতো কখন কীভাবে পায়ে চলে এসেছে খেয়াল করিনি। ভয় এমন জিনিস। ভয়ে শুনেছি অনেক কিছু ছোট হয়ে যায়। হাত-পাও যে ছোট হয়ে আসে এই প্রথম দেখলাম।

—আজ্ঞে হ্যাঁ, জুতো পায়ে ঢুকেছে।

—দেখেছ কেমন দাওয়াই দিয়েছি। আমার মেয়ে ফোন ধরেছিল। তোমার গলা চেনে না; কিন্তু তোমার নাম অন্তত হাজার বার শুনেছে আমার মুখে। একদিন এসো না। সকাল থেকে থাকবে, খাবে, হইহই করবে, বেড়াবে, মালু ভীষণ বেড়াতে ভালবাসে অথচ সঙ্গী পায় না।

মহা জ্বালায় পড়া গেল তো। একটু রেগেমেগেই বলতে হল—এখানে তো সারারাত থাকা যায় না। আপনি কেয়ারটেকারকে একবার ফোন করে বলুন—কেন, কীভাবে আটকে গেছি, তা না হলে সন্দেহ করে পুলিসের হাতেই দিয়ে দেবে। একটু তাড়াতাড়ি করুন, রাত প্রায় নটা বাজল।

—আরে সে তুমি ভেবো না। কেয়ারটেকার আমার দেশের লোক। আরে তুমি তো এক কাণ্ড করেছ হে, এই দেখো মালু শুনে হাসছে, বলছে ঘুম বটে। শুনতে পাচ্ছ না ওর হাসি।

ওঃ কী যন্ত্রণা। আমি একবার হ্যা হ্যা করে হেসে বললুম—শুনেছি, শুনেছি; আমি ছাড়ছি কেয়ারটেকারকে বলুন।

ফোন ছেড়ে, বড় কতার ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসে, পোঁ পোঁ করে দুবার ঘুরে নিলুম। সেই নির্জন অফিস ঘরে আমি একা। চারিদিক অন্ধকার। এই বড় বাড়ি থেকে অনেকেই লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। হঠাৎ ঘরের বাইরে করিডরে একটা খসখস আওয়াজ শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সেই সব অশরীরী আত্মাদের কেউ নয়তো। গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এল। টেবিলের উপর একটা ফাইল খড়খড় করে উঠল।

সাড়ে নটা নাগাদ ঘর থেকে মুক্তি পেলুম। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন—এই সেই জুতো। আর কয়েক ঘণ্টার জন্য বাড়ি যাবেন, না এখানেই শোবার ব্যবস্থা করে দেব! বুঝলাম রসিকতা করছেন। একটা মাত্র লিফ্‌ট চলছিল, একজন মাত্র যাত্রী। নীচে নেমে গেলাম। রাতের অফিস পাড়া। রাস্তায় একটাও লোক নেই। বিশাল বিশাল বাড়ির আনাচে কানাচে অন্ধকার লেপটে আছে। খালি একটা ট্রাম পেয়ে গেলুম। একেবারে ড্রাইভারের পেছনে একটা সিটে জানালার ধারে আরাম করে বসলুম, ভয়ানক ধকল গেছে। কী যাচ্ছেতাই ব্যাপার। দরওয়ান, লিফটম্যান এমনভাবে দেখছিল—যেন আমি একটা চিড়িয়াখানার জীব।

ট্রামটা বেশ জোরেই চলছিল। ফুর ফুর করে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। জুতো দুপাটি খুলে রেখে, পা দুটোকে একটু উঁচু করে সামনে ঠেসিয়ে দয়ের মতো করে বসেছিলুম। ভয়, আবার না ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝে মাঝে চোখ বুজে আসছিল। আবার জোর করে চোখ খুলে রাখার চেষ্টা করছিলুম। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি একটা জায়গায় নিজেকে রেখে, পথটুকু পার করে দিলুম। ট্রাম প্রায় গন্তব্যস্থলে এসে গেছে। পা নামাতে গিয়ে একটু শঙ্কিত হলুম। এতক্ষণ পা দুটো সিটের মাঝখানে শূন্যে ঝুলছিল, হয়তো রসস্থ হয়ে ফুলে উঠেছে, এখন যদি পা না ঢোকে। ভয়ে ভয়ে পা নামালুম। না কোনও অসুবিধেই হল না। জুতো দুটি পরম করুণাময় ঈশ্বরের কৃপায় একজোড়া খড়মে পরিণত হয়েছে। খুবই সাত্ত্বিক জিনিস। খড়ম পায়েই উঠে দাঁড়ালুম। ট্রামে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। দূরে এক কোণে কনডাক্টর হিসেব মেলাচ্ছে। ব্রহ্মদৈত্যের মতো খড়ম পায়ে খটাস খটাস করতে করতে শেষ ট্রাম থেকে নেমে এলুম। কানে এল কনডাক্টরের মন্তব্য—আজব কলকাতা। কত রকমের ফ্যাশান যে উঠবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *