অরণ্যদেবী

অরণ্যদেবী

আমার শ্বশুরমহাশয়ের সহিত গল্প করিতে করিতে আর একটি উষ্ণ কচুরি গলধঃকরণ করিয়া ফেলিলাম। জামাতা বাবাজীবনের পরিতোষ বিধানের জন্য দীর্ঘদিন পরে শ্বশ্রূমাতা শরীরের যাবতীয় ক্লেশ উপেক্ষা করিয়া সাতসকালেই পাকশালায় প্রবেশ করিয়া এমন সব পদ প্রকাশ করিতেছেন যাহাতে প্রাণ সম্পর্কে আমার আর সামান্যতমও মমতা নাই। ‘এমনি চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভাল’—রূপান্তরিত হইয়াছে—এমন অপূর্ব হিং-এর কচুরি যটা পারি খেয়ে মরি।

অদূরে একটি আরামকেদারায় শ্বশুরমহাশয় ড্রেসিংগাউন পরিয়া মধ্যযুগীয় মহাপুরুষের মতো বসিয়া আছেন। চতুষ্পার্শ্বে চ্যূত বৃক্ষপাত্রের মতো সংবাদপত্রের স্খলিত অংশ পাখার বাতাসে পক্ষবিস্তার করিবার প্রয়াস পাইতেছে। কোনওটিকে শ্রীচরণে, কোনওটিকে গুরু নিতম্বে চাপিয়া স্বাধীনতা হরণের চেষ্টা করিতেছেন। ওষ্ঠদেশে একটি পাইপ ঝুলিতেছে। অবশ্যই নির্বাপিত; কারণ আমি দেখিয়াছি, ওই বিলাতি বস্তুটি মানুষকে ধূম্রপান হইতে বিরত রাখিবার জন্যই সাহেবরা নির্মাণ করিয়াছিলেন। অগ্নিসংযোগে ওই ওষ্ঠচুল্লিটিকে ধরাইবার চেয়ে একটি রন্ধন চুল্লি ধরানো অনেক সহজ কার্য। সেই কারণেই বয়স্কদের জন্য কাষ্ঠনির্মিত এক ধরনের মহার্ঘ চুচুক ভিন্ন আর কিছুই নয়। আমার ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শ্বশুরমহাশয় সারা দিবসই ওটিকে আগলাইয়া থাকেন। ইন্ডিয়ান ফরেস্ট সার্ভিসের উচ্চপদে অভিষিক্ত ছিলেন। দুর্দান্ত যৌবনে বৃক্ষ আর ব্যাঘ্ৰ, এই ছিল তাঁর সঙ্গী। হাজার হাজার কুক্কুট তাঁহার জন্য জীবন বিসর্জন দিয়াছে। কারণ তিনি মনে করিতেন পুরুষের মতো পুরুষ অর্থাৎ যাহারা নর শার্দূল তাহারা প্রোটিনভূক হইবে। অস্থি ও পেশি এই দুটিই তাহাদের সম্বল। কুক্কুট মাংস জঠরে প্রবেশ করিয়া দুই ভাগে বিভাজিত হইবে, ক্যালসিয়াম দেহস্থ অস্থিসমূহকে বংশের ন্যায় পুষ্ট করিয়া কাঠামোটিকে সবল করিবে আর অ্যামিনো অ্যাসিড পেশি নির্মাণ করিয়া তাহার উপর বসাইবে আর ব্রেন নামক সম্পদটি বর্ধিত হইবে। পুঁইশাক, কুমড়া, কচু, ঘেঁচু সৃষ্টির আবর্জনা বিশেষ। গবাদিপশুরা গ্রহণ করুক, দুগ্ধ করিয়া মানবজাতির সেবা করুক। নারীরা মৎস্যের মুণ্ডসহ ছ্যাঁচড়া প্রস্তুত করিয়া গ্রহণ করিলে আপত্তি নাই। কারণ তাহাদের মেটাবলিক পাওয়ার জোরদার। তাহারা ইচ্ছা করিলে সজিনা ও ডেঙ্গোডাঁটা চিবাইতে পারে, কারণ তাহারা একটা লইয়া যত ব্যস্ত থাকিবে পুরুষের পক্ষে ততই মঙ্গলের। তাহারা কিঞ্চিৎ শান্তিতে নিজকার্যে নিরত থাকিতে পারিবে। হিসাব অতি সহজ—উহাদের দিক হইতে যতগুলি মুরগি বাঁচিবে, ততগুলি এইদিকে তন্দুরি হইবে। নারীগণ কোমল হইবেন, তাঁহাদের মসৃণ ত্বক হইবে, দেহ লালিত্যপূর্ণ হইবে, সুতরাং তাঁহাদের আহার্যে ঘাস-পাতার পরিমাণ অধিক হওয়া উচিত। তাঁহারা পেশি বাগাইয়া লম্ফঝম্ফ করিলে পুরুষরা তাহাদের প্রেমে আর পাগল হইবে না। এই মতে তিনি আজও অবিচল। সেই কারণে কচুরি স্পর্শ করেন নাই। দুইটি বৃহদাকার মর্তমান কলা, একটি অখণ্ড পাঁউরুটি ও এক গেলাস দুগ্ধ দিয়া সকাল শুরু করিয়াছেন। কালো কফি পছন্দ করেন বলিয়া, এক ফ্লাস্ক কালো কফি পার্শ্বেই মজুত রহিয়াছে। বিশ্ব-পরিস্থিতি যত অশান্ত হইতেছে, তাঁহার কফি সেবনের মাত্রাও তত বাড়িতেছে। মমতার কী হইবে ভাবিয়া এই মুহূর্তে অতিশয় উত্তেজিত। বীরাঙ্গনা আবার আন্দোলনে ঝাঁপাইতে চলিয়াছে, পালোয়ানকে কেন্দ্র করিয়া সিবিআই-এর সহিত রাজ্যসরকারের ধুন্ধুমার বাঁধিবে, প্রধানমন্ত্রীর পঁচাত্তর হইল, ইউ পি-তে মায়াবতী কী-ই বা করিতে পারিবেন, মুখ্যমন্ত্রী বিদেশি পুঁজি ক্যাপচার করিতে পারিবেন কি না, অর্জুন বলিতেছেন, কেন্দ্র ইচ্ছা করিয়া রাজীব-হত্যা মামলা পিছাইতেছে—সব মিলাইয়া পরিস্থিতি অতিশয় জটিল, অতএব তিনি ফ্লাস্কের দিকে হাত বাড়াইতেছেন। একটি কথাই বার বার বলিতেছেন, যাহার যাহাই হউক মমতার মস্তকে আবার ডাণ্ডা মারিলে কী হইবে! চৌচির হইয়া যাইবে, যাহাকে বলে ফুটিফাটা। কাহারও মস্তক লইয়া এ মতো দস্যুতা সভ্য-সমাজে বরদাস্ত করা যায় না। যৌবন থাকিলে দোনলা লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়িতাম। যে বাঘ মারিয়াছে সে গোটা কতক দুষ্ট মানুষকেও মারিতে পারিবে। উত্তেজনার আধিক্যে পাইপের ডাঁটি কামড়াইয়া ধরিয়াছেন।

আমার পার্শ্বে বসিয়াছিলেন, আমার জ্যেষ্ঠ শ্যালিকা। পিতার উত্তেজনা দেখিয়া স্মরণ করিবার চেষ্টা করিলেন, ব্লাড প্রেসারের ঔষধ সেবন করানো হইয়াছে কি না!

আমার এই জ্যেষ্ঠ শ্যালিকার কিঞ্চিত পরিচয় দিবার প্রয়োজন আছে। অধ্যাপিকা। মনস্তত্ত্ব তাঁহার বিষয়। উজ্জ্বল ছাত্রী ছিলেন। অধ্যাপনায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করিয়াছেন। তিনবার বিলাত গিয়াছেন; কিন্তু কোনও অহঙ্কার নেই। জোরে কথা বলেন, স্পষ্ট কথা বলেন। ন্যাকামি সহ্য করিতে পারেন না। শ্বশুরমহাশয়ের প্রথম সন্তান সেই কারণে তাঁহার গুণাবলী সমস্তই পাইয়াছেন। তেজস্বিনী। হুঙ্কার ছাড়িলে সমস্ত হনুমানই পালাইবে। বস্তুত তাহাই হইয়াছিল, যে-কারণে তাঁহার বিবাহ করা হইল না। ছাত্রজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক রোমিও প্রেম নিবেদন করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদের মধ্যে তিনজনকে কয়েকদিন চিকিৎসালয়ের শয্যায় শুইয়া থাকিতে হইয়াছিল, একজনকে পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাহিতে হইয়াছিল। ইহার পর আর কেহ সাহস করে নাই। প্রকৃত পুরুষ তিনি খুঁজিয়া পান নাই। তাঁহার বিচারে তাঁহার পিতাই আদর্শপুরুষ। বাকি সকলে হয় উন্মাদ না হয় অর্ধোন্মাদ। যৌন বিকারগ্রস্ত, ব্যভিচারী। ইহাদের জবীন একটি সুড়ঙ্গের পথ ধরিয়া চলিয়াছে। কেহই উন্মুক্ত প্রান্তরের পথিক নহেন। ইহাদের দৃষ্টিতে নারী ভোগের সামগ্রী। জীবনের উদ্দেশ্য—আহার, নিদ্রা, মৈথুন। শয়তানদের খপ্পরে একবার পড়িলে আখের মতো চিবাইয়া ছিবড়া করিয়া দিবে। পুরুষ তাঁহার করুণার পাত্র।

আমাকে তিনি কোন কারণে স্নেহ করেন আমার বলিবার সাধ্য নাই; কারণ আমি মনস্তত্ত্ব বুঝি না, উদরের তত্ত্ব কিঞ্চিৎ বুঝি। ভগবান জিহ্বা দিয়াছেন কেবলমাত্র শব্দ উচ্চারণের জন্য নহে, তাহা হইলেও স্বাদ দিবেন কেন। স্বাদু বস্তুসকল গ্রহণ করিতে হইবে, পরিপাক করিতে হইবে, তাহার পর আবার গ্রহণ করিতে হইবে। স্বল্প আয়ু, বহু খাদ্য, বহ্বশ্চ বিঘ্না, অতএব জীবের নহে, জিভের নষ্ট করিবার মতো সময় নাই। একাগ্র আন্তরিকতায় আহারে মনোনিবেশ করাই জীবের কর্তব্য।

বিবাহের রাত্রেই বাসরঘরে তিনি আমার নাম রাখিলেন মহিষাসুর। তাহাতে আমি ক্ষুব্ধ তো হইই নাই বরং অতিশয় আনন্দিত হইয়াছিলাম। ইহার পর একদিন আমাকে বলিয়াছিলেন, ফুলঝুরি জাতিতে বাজি হইলে যেমন নিরাপদ, সেইরূপ তুমি জাতিতে পুরুষ হইলেও নারীদের পক্ষে নিরাপদ। তোমার সহিত নিভৃতে সময় কাটানো যায় নির্ভয়ে। এই প্রকার চরিত্র-পত্র পাইয়া আমি যাহার পর নাই আহ্লাদিত হইয়াছিলাম। সেই দিন আমি অনুভব করিয়াছিলাম, প্রকৃতই আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। যাহারা উদরাময়ে ঘন ঘন আক্রান্ত হইয়া থাকে তাহারাই অতিশয় কামুক হয়—একথা আমাকে বলিয়াছিলেন আমার শ্বশুরমহাশয়। জানি না, কোন দর্শন হইতে তিনি এই সিদ্ধান্তে আসিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ডিসপেপসিয়ার সহিত ডিমেনসিয়ার যোগ আছে। সেক্স এক প্রকার ডিমেনসিয়া। তাঁহার মতো পদমর্যাদাসম্পন্ন স্বচ্ছল তা তাঁহার কনিষ্ঠা কন্যাটির সহিত কেন আমার বিবাহ দিলেন, সে সম্পর্কে তাঁহার মন্তব্যটি স্মরণীয়—যাহারা বলশালী, স্বাস্থ্যবান, হাঁউ হাঁউ করিয়া খাইতে ভালবাসে, তাহাদের মগজ কম হইলেও মানুষ হিসাবে সৎ ও সংযমী।

জ্যেষ্ঠ শ্যালিকা মনোযোগ সহকারে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় পাঠ করিতেছিলেন। একমাত্র তিনিই সর্বাগ্রে সম্পাদকীয় পাঠ করেন। ইহার চেয়ে কষ্টসাধ্য আর কিছুই নাই। একশত বুকডন, দুই শত বৈঠক দেওয়া ইহার চেয়ে সহজ কর্ম। তিনি শুধু পাঠ করেন না, শক্তিশালী হইলে পাঠ করিয়া সকলকে শুনান, দুর্বল হইলে ঘন ঘন আক্ষেপ করিতে থাকেন, যেন পুত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হইয়াছে।

জ্যেষ্ঠ শ্যালিকাকে আমি বড়দি বলি। তিনি প্রশ্ন করিলেন, ‘মহিষাসুর কটা কচুরি নামালে?’ কী উত্তর দিব! আমি তো গণনা করি নাই। টপাটপ খাইয়া গিয়াছি। নীরবে হাসিতে লাগিলাম, অপরাধী শিশুর ন্যায়।

বড়দি কহিলেন, ‘কচুরিটা মায়ের; কিন্তু পেটটা তোমার। এখনও অনেক খাওয়া বাকি। দুপুর আছে, বিকেল আছে, রাত আছে। পেটে একটু জায়গা রাখো।’

আমি লজ্জা পাইলাম। দেখিয়াছি গঙ্গার ইলিশ আসিয়াছে। শ্বশ্রূমাতা ফাটাইয়া দিবেন, সন্দেহ নাই। ইলিশের প্রতি আমার দুর্বলতা সর্বজনবিদিত। পুচ্ছ দেশ হইতে শুরু করিয়া মুণ্ডে উপনীত হইবে। অনেকেই অনেক প্রশংসা পাইয়া থাকেন অনেক অনেক কারণে। কেহ এভারেস্টে উঠিতেছেন, কেহ টেনিস জয় করিতেছেন, কেহ জিন-নামক বস্তুটির রহস্য উদ্ধার করিতেছেন, আমি আমার শ্বশ্রূমাতার প্রশংসা অর্জন করিয়াছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। তিনি একটি কথাই বারেবারে বলেন, ‘বিনয়কে আমার খাইয়ে সুখ অছে। কোনও কিছুতেই না করে না। যা-ই দাও তা-ই ভাল। একালে এমন আনন্দ করে কাউকে আমি খেতে দেখিনি।’ এইরূপ প্রশংসার পরেই তিনি প্রশ্ন করিবেন, ‘বলো বিনয় আজ স্পেশ্যাল কী খাবে!’ সঙ্গে সঙ্গে আমি হয়তো বলিব, চালতার অম্বল, কি আমড়াপোস্ত। এইগুলিকে বলা হইয়া থাকে, এগজোটিক পদ। সহসা যাহা সর্বত্র পাওয়া যায় না।

শ্বশুরমহাশয় ক্ষণ পূর্বেই দেবীর ভবিষ্যৎ ভাবিয়া কফি ব্রেক লইয়াছিলেন ও সংবাদপত্রে পুনরায় মনোনিবেশ করিয়াছিলেন, হঠাৎ উল্লসিত হইয়া উঠিলেন। কী একটি পাঠ করিয়াছেন। চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন—‘রায় বাঘিনী, রায় বাঘিনী।’

তিনি আমার শ্বশ্রূমাতাকে এই নামেই সম্বোধন করিয়া থাকেন। তাঁহার সহিত আমার সম্পর্ক বন্ধুর মতো। সেই কারণেই একদিন দ্বিপ্রহরে ভুরিভোজের পর নামরহস্যটি জানিতে চাহিলাম। মৃদুভাষী, কোমল স্বভাবের, সুন্দরী মহিলাটির সহিত ব্যাঘ্রের সাদৃশ্য তিনি কোথায় খুঁজিয়া পাইলেন!

শ্বশুরমহাশয় যাহা বলিলেন তাহার অর্থ এই দাঁড়ায়, ইহা ব্যাজ স্তুতি। অর্থাৎ মাজার অপেক্ষাও ভীরু প্রাণীটিকে ব্যাঘ্র বলা। উদাহরণও দিয়াছিলেন, ‘অতি বড় বৃদ্ধপতি সিদ্ধিতে নিপুণ। কোনও গুণ নাই তাঁর কপালে আগুন। কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ। কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।’ আরও বলিয়াছিলেন, ইহার অন্য দিকও আছে—বাঘিনী বলিতে বলিতে মিউ মিউ স্বভাবটি যদি পালটায়।

দুজনার অসামান্য প্রেম পূর্বেও লক্ষ করিয়াছি, আজও লক্ষ করিলাম। শ্বশ্রূমাতা হাত মুছিতে মুছিতে রন্ধনশালা হইতে স্বামীর আহ্বানে ছুটিয়া আসিলেন। অতিশয় মধুর কণ্ঠে বলিলেন, ‘কী বলছ?’

শ্বশুরমহাশয় উল্লসিত কণ্ঠে বলিলেন, ‘বুঝলে, আর ভাবনা নেই গো। অবশেষে বেরুল!’

‘কী বেরুল!’

‘সুগারের যম। ডায়াবিটিস হলে আর চিন্তার কোনও কারণ নেই। প্যাংক্ৰিয়াস ট্রানসপ্লান্টেশান চালু হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা কায়দা বের করে ফেলেছেন। প্যাংক্ৰিয়াসটাকে একটা পলিমারের চাদর দিয়ে মুড়ে তার ভেতর ইনসুলিন প্রডিউসিং সেল বসিয়ে দিচ্ছেন। স্টার্চ খেলেই সুগার, স্টার্চ খেলেই সুগার, আর হচ্ছে না। মনের আনন্দে খেয়ে যাও, রসগোল্লা, পান্তুয়া, সন্দেশ। কত বড় একটা দুশ্চিন্তা চলে গেল বলো তো! তাহলে আজ রাতে তোমার সেই বিখ্যাত ছানার পায়েস হয়ে যাক।’

শ্বশ্রূমাতা এই সংবাদে অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। তাঁহার উজ্জ্বল মুখমণ্ডল আরও উজ্জ্বল হইল। ইহা অবশ্যই একটি সংবাদের মতো সংবাদ। শ্বশ্রূমাতা মাঝেমধ্যেই সুগারের ভয়ে ভীত হইতেন; কারণ তাঁহাদের বংশে এই ব্যাধিটি আছে। তাঁহার আর দাঁড়াইবার অবসর নাই। আমার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া কিঞ্চিৎ ক্ষোভ প্রকাশ কিরলেন; কারণ আমি মাত্র পনেরোটি কচুরি খাইয়া হাত গুটাইয়াছি।

জ্যেষ্ঠ শ্যালিকা বলিলেন, ‘আমি থামতে বাধ্য করেছি। তা না হলে, ও তিরিশে ওঠার তালে ছিল। দুপুরে তো খেতে হবে! তুমি তো আজ আবার ইলিশ ঢুকিয়েছ!’ অন্যায় কী করিয়াছেন, তাহা বোধগম্য হইল না। বর্ষাকালে মেঘে ঢাকা আকাশের ছায়ায় বসিয়া ইলিশের স্বাদে যদি উন্মত্তই না হইতে পারিলাম, তাহা হইলে মনুষ্যজীবন ধারণের অর্থ কী হইল!

বিশাল এক পেয়ালা চা পরম পরিতোষে পান করিয়া গাত্রোৎপাটন করিলাম। যে বারান্দায় বসিয়াছিলাম তাহা অনেকাংশে লতাবিতানের ন্যায়। অতি মনোরম পরিকল্পনায় বিরচিত। কুসুমসকল ফুটিয়া আছে। সবুজ পত্রশোভা। অকস্মাৎ কোথা হইতে উড়িয়া আসিতেছে একটি দুটি টুণ্টুক পক্ষী। লতার প্রান্ত ধরিয়া দোল খাইয়া গান গাহিয়া চলিয়া যাইতেছে। জায়গাটা স্বর্গের সহিত তুলনীয়। এই সবই আমার শ্বশুরমহাশয়ের স্বহস্তে রচিত। তাঁহার মাত্রাতিরিক্ত অরণ্য প্রেমের কারণে আমি তাঁহার নাম রাখিয়াছি অরণ্যদেব। তিনি এই উপাধি পছন্দ করিয়াছেন ও জামাতাদের জাতিতে তিনি আমাকে ফক্কড় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন। তাঁহার আরও একটি জামাতা আছেন, আমার মেজ শ্যালিকার স্বামী। তিনি তরুণ আই. এ.এস। উচ্চ সরকারি পদে প্রতিষ্ঠিত। চশমাধারী, গম্ভীর; একটি বিধ্বস্ত সরকারি জিপে চড়িয়া জেলার প্রশাসন সামলাইয়া থাকেন। মাঝেমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের জাগ্রত জনতা, ইটপাটকেল ও লগুড় সহযোগে তাঁহাকে আদর করিয়া যায়। সেই সোহাগে কিছুদিন দাঁত চিরকুটাইয়া পড়িয়া থাকিয়া পদাধিকার বলে উঠিয়া দাঁড়ান। পুনরায় কোনও ইস্যুতে আবার শয্যাগ্রহণ করেন। কবে না বিধবা হইতে হয় ভাবিয়া মেজ শ্যালিকা সিঁথিতে সিন্দুর ধারণ করেন না। বলেন, সিন্দুরে অ্যালার্জি। অবশ্য হইও সত্য, শ্বশুরমহাশয়ের মধ্যম কন্যাটি অতিশয় অহঙ্কারী। অহঙ্কারের কারণ, স্কুল ফাইনালে প্রথম হইয়াছিলেন, পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রিতে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। অহঙ্কারের কারণ থাকিলেও অহঙ্কারী না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। শাস্ত্র বলিতেছেন, বিদ্যা বিনয়ং দদাতি। তিনি তাহার বিপরীত পথেই চলিয়াছেন। ফল ভাল হইবে বলিয়া মনে হয় না। কারণ আমি বাংলা অথবা সংস্কৃতে নহে, খাস ইংরাজিতে পাঠ করিয়াছি—বাইবেলের লেখা—Pride goeth before destruction, and an haughty spirit before a fall. ধ্বংস হইবার পূর্বলক্ষণ অহঙ্কার আর উগ্রচণ্ডার দমাস করিয়া পতন হইবেই হইবে। তাঁহাদের জীবনে এমন ঘটুক, আমি তাহা কখনই চাহিব না। আমার মন সেরূপ নহে; কিন্তু আমি ভয় পাই। যদি ঘটে!

মেজ শ্যালিকা বিবাহের রাতে আমাকে অতিশয় অপমান করিয়াছিলেন। আমি অদ্যাদি তাহা ভুলিতে পারি নাই। আমার দোষ ছিল না, এমন বলিতেছি না, তবে বিবাহের রাত্রে শ্যালিকাদের সহিত রঙ্গ-রস করা চলে! আমি কেমন করিয়া জানিব, ফিজিক্সে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট, আই.এ.এস পত্নী। তিনি সর্বসমক্ষে, উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তোমরা একটা লোফারকে জামাই করলে!’

আমি স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলাম। জলভরা তালশাঁস হাতেই ধরা রহিল। রাত গভীর হইল। রণক্লান্ত সৈনিকরা এধারে, ওধারে কুম্ভকর্ণ। আমার স্ত্রী ফোঁস ফোঁস করিয়া উঠিল। আমি তাহাকে বুঝাইতে গেলাম—আমি লোফার নহি।

আমার স্ত্রী বলিল, ‘আমার মেজদি চিরকালের লোফার। বিয়ের পরে এত অহঙ্কার যে নিজের বাপ-মাকেও মানুষ ভাবে না। বড়দি তো ওদের সঙ্গে কথাই বলে না। তুমি কিছু মনে করোনি তো!’

নারীর কথা গায়ে মাখিতে নাই। কেহ মুখ হলসা, কেহ ভেতরবুঁদে। গ্রাম্য প্রবাদেই তো আছে—

মুখহলসা, ভেতরবুঁদে, কানতুলসে, দীঘলঘোমটা নারী,

পানাপুকুরের শীতল জল বড় মন্দকারী।

নারী কটর কটর কথা বলিবে, ফ্যাঁস করিবে, ফোঁস করিবে, পুরুষকে সহ্য করিতেই হইবে, তাহা না করিলে সব সংসারই তো ছাতরাইয়া যাইবে। বিবাহের বছর না ঘুরিতেই আদালত। আইনজীবীদের পোয়াবারো। মারিলেও কলসির কানা তাহা বলিয়া কী প্রেম দিব না।

আমার স্ত্রীর নাম অরুণা। বাসরঘরে তাহার গোল গোল হাত দুটি চাপিয়া ধরিলাম। আকাশগাঙ্গে ত্রয়োদশীর চাঁদ সাঁতার কাটিতেছে। প্রথম বসন্তের উতলা কোকিল দেবদারু শাখায় কুহু কুহু রবে হৃদয়ের আকুতি প্রকাশ করিতেছে। পুরনো বন্ধুরা প্রথম রাত্রে ফস্টিনষ্টি করিয়া যে যেমন পারিয়াছেন শয়ন দিয়াছেন। আমি আর অরুণা পরস্পরের দিকে তাকাইয়া প্রভাতের অপেক্ষা করিতেছি। হঠাৎ আমার প্রেম জাগিল। সন্তর্পণে মুখচুম্বন করিলাম। তালশাঁস সন্দেশটি দুই ভাগ করিয়া দুইজনে চুকুর চুকুর করিয়া খাইলাম। আমার স্থূল বুদ্ধিতে মনে হইল, সন্দেশ বস্তুটি চুম্বন অপেক্ষা অনেক স্বাদু।

এই প্রাককথনের প্রয়োজন হইল এই কারণে, বুঝাইতে চাহিতেছি, অপর জামাতা অপেক্ষা কেন আমি প্রিয়! মেজ জামাতা ভেতরকুঁদে, মেজ কন্যা মুখহলসা। ইনি কথা বলিতে চান না, কারণ পার্সোনালিটি লিক করিয়া যাইবে, উনি এত কথা বলেন, যেন উত্তপ্ত মরুপ্রান্তরে বালির ঝড় উঠিয়াছে। অঙ্গে আলপিনের ন্যায় বিধিতেছে। অহঙ্কার করিবার মতো কিছু নাই বলিয়া, আমার অহঙ্কার নাই। আমি মজুর শ্রেণীর মানুষ। খাইতে ও খাটিতে ভালবাসি। শুইবামাত্র নিদ্রা যাই। কখনও কোনও স্বপ্ন দেখি নাই; কিন্তু দেখিতে ইচ্ছা করে। পেট পুরিয়া খিচুড়ি খাইয়া শুইয়াছি, তথাপি স্বপ্ন আসে নাই। এমনি হতচ্ছাড়া আমি।

এখন প্রশ্ন হইল, আমার সহিত অরুণার বিবাহ হইল কেন! দুইটি কারণ আমি দেখিতে পাইতেছি। মধ্যম জামাতা এই পরিবারের সুখ বিধান করিতে পারে নাই। পদমর্যাদার রেশমগুটিকার মধ্যে রেশমকীট হইয়া সাফারি স্যুট পরিয়া বসিয়া আছেন। ফাইল, রিপোর্ট মেমোরেন্ডাম, পোস্টিং, প্রেমোশন ইত্যাদি ইংরাজি বস্তুর মধ্যে ডুবিয়া আছেন। তাঁহার জগতে দুই ভিন্ন তিনের অস্তিত্ব নাই। তিনি আর তাঁহার মন্ত্রী। রাইটার্স বিলডিং-এ যাইতেছেন, তথা হইতে নিজের বাংলোয় ফিরিয়া আসিতেছেন। যাইতেছেন, আসিতেছেন, আসিতেছেন যাইতেছেন। প্রাণ হস্তে লইয়া প্রশাসন চালাইতেছেন। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, কোনওটিই যথাযথ হইতেছে না। ফলে ক্রমশই গম্ভীর হইতে গম্ভীরতর হইতে হইতে একটি সরকারি লগ-বুকে পরিণত হইয়াছেন। শ্বশুরালয়ে কখনও আগমন করিলে এমন একটি ভাব করেন যেন শোকসভায় আসিয়াছেন।

আমার শ্বশুরমহাশয়ের তিনটিই কন্যা। চতুর্থটি পুত্র হইলেও হইতে পারিত। সাহস করেন নাই। তাঁহারা একটি পুত্রসম জামাতা চাহিয়াছিলেন, সেই কারণেই আমাকে পিক আপ করিয়াছিলেন। আমাকে একটি অরণ্যসম্পদ বলিয়া গণ্য করা চলে। আমি আমার পিতার কাষ্ঠের ব্যবসায় তদারকি করিতাম। সরকারি জঙ্গল যখন নিলাম হইত, তখন সেই নিলামে দর হাঁকিতে আমিই যাইতাম। বয়সের কারণে পিতা আর পারিতেন না।

বলিতে দ্বিধা নাই, মহিষাসুর হইলেও আমার বিলক্ষণ কবিতা প্রীতি ছিল। দু-একটি অক্ষম কবিতা লিখিবার চেষ্টা করিয়াছি। বিখ্যাত সাহিত্যপত্রে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করিয়াছি, পত্রপাঠ ফিরত আসিয়াছে। আর একটি বিষয়েও আমার অনুরাগ ছিল, উহা সঙ্গীত। ওস্তাদ ধরিয়া শিখি নাই। স্বশিক্ষিত। যে কোনও সঙ্গীত একবার শুনিলেই আমি গাহিতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যন্ত আমি গিয়াছি। ইচ্ছা করিলে চাকুরি করিতে পারিতাম। পিতা আমাকে মারাত্মক একটি কথা বলিলেন—অন্যের বাসন মাজার চেয়ে নিজের বাসন নিজেই মাজো না।

শাস্ত্র বলিয়াছেন, যাহার সহিত যাহার বিবাহ হইবে তাহা নাকি পূর্বেই ঈশ্বর ঠিক করিয়া রাখেন। তাহা হইলে উদাহরণ হিসাবে আমার বিবাহের কথা বলিতেই হয়। আত্মকথন অতিশয় অশোভন কর্ম। করিতেই হইতেছে, তাহা না হইলে বিষয়টি স্পষ্ট হইবে না।

এক বৎসর কি তাহার কিছু পূর্বে একটি জঙ্গলে নিলাম ধরিতে গিয়াছি। কয়েকদিন থাকিতে হইবে। শাল, সেগুন, শিমুল, মেহগনির নিবিড় অরণ্য। ভয়ঙ্কর মনোরম। কয়েকঘর আদিবাসী ছাড়া কেহ কোথাও নাই। সভ্যতাও নাই, অসভ্যতাও নাই। বনবিভাগের বাংলোয় আশ্রয় লইয়াছি।

এক দিবস প্রাতে বৃক্ষমূলে বসিয়াছি। তাহার ঊর্ধ্বদেশ দেখিতে পাইতেছি না। চতুষ্পর্শে শুষ্কপত্র, বৃক্ষশাখা। খাবলা খাবলা রৌদ্র। পিপীলিকার রেলগাড়ি। কাঠবিড়ালির লাঙুল আস্ফালন। পক্ষীদের সামগান। মনে অতিশয় ভক্তিরসের সঞ্চার হইল। তখন আমি উচ্চকণ্ঠে রামপ্রসাদী গান ধরিলাম নির্ভয়ে। বৃক্ষ ভিন্ন কোনও শ্রোতা নাই। কোথাও কোনও সংবাদপত্রের সমালোচক ঘাপটি মারিয়া বসিয়া নাই। অতএব আমার ভয়েরও কোনও কারণ নাই। যে-গানটি আমি গাহিতেছিলাম তাহা হইল—‘মন কেন তুই ভাবিস মিছে। মা যার আনন্দময়ী সে কী নিরানন্দে থাকে।’ প্রথমে প্রসাদী সুরেই গাহিতেছিলাম। তৎপরে ভাব কিঞ্চিৎ তরল হইতেই গানটিকে নানা সুরে বসাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। প্রথমে কালোয়াতি, তাহার পরে হিন্দি চলচ্চিত্রানুগ সুরে পরিশেষে ইংরাজি পপ সুরে। বৃক্ষতলে বেশ মাতিয়া উঠিয়াছি, এমন সময় অরণ্যের বামপার্শ্বে খচরমচর শব্দ হইল। ভাবিলাম, সুরে মোহিত হইয়া কোনও বৈরাগী ব্যাঘ্ৰ বুঝি আসিতেছে। আমি কিন্তু সঙ্গীত বন্ধ করি নাই। মরিতে হইলে গাহিতে গাহিতেই নারদ ঋষির ন্যায় ঢেঁকিতে চড়িয়া বৈকুণ্ঠে যাইব। গোলকবিহারী আমাকে সহকারী করিয়া লইবেন। যে-প্রাণীটি সম্মুখভাগে আসিয়া, জিহ্বা নির্গত করিয়া হ্যা হ্যা করিতে লাগিল, সেটি একটি বিশাল আকৃতির অ্যালসেসিয়ান। কালো কুচকুচে গাত্রবর্ণ। কোথা হইতে নেকড়ের এই বংশধরটি আসিল বুঝিতে পারিলাম না। পাছে ঘাঁক করিয়া কামড়াইয়া দেয়, সেই ভয়ে সঙ্গীত বন্ধ না করিয়া ইংরাজি সুরেই রামপ্রসাদী গাহিতে লাগিলাম। বিদেশি প্রাণী বিলাতি সুরই পছন্দ করিবে। ইহাই ছিল আমার অনুমান।

অতঃপর বামদিকে আবার মচমচ শব্দ। আড়ে তাকাইলাম। স্বপ্ন দেখিতেছি না তো! সপরিবারে আধুনিক রামচন্দ্র বনবাসে আসিলেন কী। সম্ভ্রান্ত দর্শন এক ভদ্রমহোদয়। ওষ্ঠের দক্ষিণ কোণে প্রলম্বিত একটি ৎ আকৃতির পাইপ। পরিধানে হাফপ্যান্ট ও কলারসহ তোয়ালে গেঞ্জি। পায়ে বুট জুতা। সঙ্গে চারজন হালকেতার রমণী। তিনজন মাথায় মাথায় যুবতী। অতিশয় আকর্ষণীয়া। অন্যজন মাতৃমূর্তি।

আমি তৎক্ষণাৎ বৃক্ষতল হইতে উঠিয়া, হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিলাম। হইতে ভদ্রলোক অত্যন্ত খুশি হইয়া কহিলেন, ‘কে তুমি?’

বিনীত হইয়া বলিলাম—‘আজ্ঞে আমি বিনয়।’

পিতা প্রায়ই শুনাইতেন, ‘বিদ্যা বিনয়ং দদাতি।’ তিনি কাষ্ঠব্যবসায়ী হইলেও গণিতশাস্ত্রে এম এসসি করিয়াছিলেন। আমার পিতামহ কালবিলম্ব না করিয়া আমার মাতার পাণিগ্রহণ করাইয়া কাঠের ব্যবসায়ে বসাইয়া দিলেন। সারা দিবস করাতকলের কর্কশ শব্দ। কাঠের গুঁড়া ও ভেষজ সুগন্ধের মধ্যে ঋষির মতো বসিয়া থাকেন। সম্প্রতি সাহিত্যকর্মে লিপ্ত হইয়াছেন। অরণ্যের অভিজ্ঞতা লিখিতেছেন। রচনায় বিভূতিভূষণের প্রভাব থাকিলেও স্বকীয়তা আছে।

আমি বিদ্বান নহি; কিন্তু বিনয়ী। বিনয় আমার রক্তে।

ভদ্রমহোদয় প্রশ্ন করিলেন, ‘কোথাকার বিনয়?’

‘আজ্ঞে কলকাতার বিনয়।’

‘এখানে এলে কী করে?’

‘নিলাম ধরতে এসেছি।’

‘আই সি। তোমার গলা তো বেশ ভাল, তা গানটাকে অমন চটকাচ্ছ কেন?’

বিনয়ে বিগলিত হইয়া, কাচুমাচু মুখ করিয়া বলিলাম, ‘গাছ ছাড়া তো কোনও শ্রোতা নেই, তাই সাহস করে একটু একসপেরিমেন্ট করছিলুম। সেই একই পুরনো সুরে গাওয়া হয়। একটু আধুনিক করার কথা ভাবছিলুম।’

ভদ্রলোক পাইপ নাচাইতে নাচাইতে বলিলেন, ‘না, ভাববে না। গাছ শ্রোতা নয়, এমন কথাটা তুমি ভাবলে কেমন করে? গাছের তুমি জানো কী! তোমার তো মরা কাঠ নিয়ে কারবার! জ্যান্ত গাছের খবর তুমি কতটা জানো?’

আমি কিঞ্চিৎ চুপসাইয়া গিয়া অধ্যাপক সম্মুখে অজ্ঞ ছাত্রের ন্যায় মাথা চুলকাইতে থাকিলাম। অল্পবয়সী তিন সুন্দরী আমার তিরস্কার বেশ উপভোগ করিতেছেন। বয়োঃজ্যেষ্ঠার করুণা হইয়াছে। তিনি বলিলেন, ‘শুধু শুধু বকছ কেন?’

বুঝিলাম স্বামী স্ত্রী। তিন কন্যাকে লইয়া পরিদর্শনে বাহির হইয়াছেন। কলিকাতার কোনও বড় মানুষ নির্জনতা উপভোগের মানসে সপরিবারে বনবাসে আসিয়াছেন।

ভদ্রমহোদয় স্ত্রীকে বলিলেন, ‘গাছের অপমান আমি সহ্য করতে পারি না।’

আমাকে প্রশ্ন করিলেন, ‘শুধু কাঠ নিয়েই আছ, না লেখাপড়াও কিছু করেছ?’

নিজের কথা বলিতে লজ্জা করে, তথাপি বলিলাম, ‘আজ্ঞে, এম এসসি।’

তিনি হতচকিত হইয়া বলিলেন, এম এসসি! কোন সাবজেক্ট!’

‘কেমিষ্ট্রি।’

তিনি এইবার ধমকাইয়া উঠিলেন, ‘কেমিস্ট্রির এম এসসি, জঙ্গলে মরতে এসেছ কেন?’

তাঁহার স্ত্রী বলিলেন, ‘তুমি এসেছ কেন?’

‘ফরেস্ট সার্ভিস নিয়েছি বলেই এসেছি। আই লাভ ফরেস্ট।’

আমি বুঝিলাম ভদ্রমহোদয় এই জঙ্গলমহলের সর্বেসর্বা। হয়তো চিফ কনজারভেটার। আমি কালবিলম্ব না করিয়া একেবারে পায়ে হাত দিয়া প্রণাম করিতে করিতে বলিলাম, ‘আমিও গাছ ভীষণ ভালবাসি।’

ওষ্ঠে পাইপ ঝুলিতেছে তাঁহার। দুই হাতে ধরিয়া আমাকে তুলিয়া বুকে গ্রহণ করিলেন। বিশাল বক্ষদেশ। আমার উপর বাহু দুটি চাপিয়া ধরিয়া পেশিদ্বয় অনুভব করিতে করিতে বলিলেন, ‘ফাইন ইয়াংম্যান। রেগুলার ব্যায়াম করো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘আজ করেছ?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

তিনি কন্যাত্রয়ের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘বুঝেছ একেই বলে ডিসিপ্লিন! তোদের মতো নয়। এই যে অরুণা! আজ গানে বসল তো, সাতদিন অফ।’

আমি বলিলাম, ‘গাছের বিষয়ে কী বলছিলেন! শুনতে ইচ্ছে করছে।’

‘আমার সঙ্গে চলো, তোমাকে আমি চলতে চলতে বলছি। আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি, দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। তাহাই হইল। আমাদের সামনে চলিয়াছে বিশাল অ্যালসেসিয়ান। তাহার পশ্চাতে আমরা। একবার মাত্র অরুণার দিকে তাকাইয়াছি। মনে হইল চক্ষু তারকায় একটা হাসির ভাব খেলা করিতেছে। অনুমান করিবার চেষ্টা করিলাম, এই হাসির কী কারণ থাকিতে পারে। আমার মাতা বলিতেন, আমার চোখ দুইটি হাতির মতো। আমার জ্যেষ্ঠা ভগিনী ক্রোধ হইলে বলিত, আমার নাসিকা লেপচাদের মতো। আমার পিতা অতিশয় অসন্তুষ্ট হইলে বলিতেন, একটি শাখামৃগ।

কোনও কথাই হইতেছে না। হাঁটিতেছি। শুষ্ক পত্রনিচয়ের শব্দ। যেন অরণ্যের অদৃশ্য প্রাণীসকল পাঁপড় ভাজা চিবাইতেছে। কনজারভেটার মহাশয় ওষ্ঠের কৌশলে ধূম্রপানের পাইপটিকে নানা কায়দায় ওষ্ঠোপরি নাচাইতে নাচাইতে সহধর্মিনীর স্কন্ধোপরি বামহন্ত রাখিয়া রাজা ক্যানিউটের ন্যায় মহানন্দে বক্ষঃদেশ প্রশস্ত করিয়া হাঁটিতেছেন। তিন কন্যা আমার সহিত সন্তোষজনক দূরত্ব রাখিয়া নিজেদের মধ্যেই আলাপ-আলোচনা করিতে করিতে চলিয়াছেন। সন্দেহ হইতেছে, আলোচনার বিষয়বস্তু আমি নহি তো! তিন যুবতী একত্রিত হইলে তাহাদের শক্তি শতগুণ বাড়িয়া যায়। অচেনা পুরুষের নানাবিধ অসঙ্গতি লইয়া মশকরা করা অসম্ভব নহে। ছাত্র জীবনে এই অভিজ্ঞতা আমার কয়েকবার হইয়াছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হইলে তাহারাও ‘প্যাঁক’ দিতে পারে। আমি জঙ্গলবাসী টার্জান হইলেও ছাত্রজীবনের সামান্য পড়াশুনার অভ্যাস বজায় আছে। কেন আছে তাহাও বলিতেছি। আমার ইংরাজির অধ্যাপক ছিলেন অতিশয় ধর্মপ্রাণ। বিবাহ করেন নাই। অল্প আহার করিতেন। সুযোগ উপস্থিত হইলেই মঠ-মিশনে গিয়া বক্তৃতা শুনিতেন। তাঁহার জীবনের ব্রতই ছিল, পঠন-পাঠন, শ্রবণ-মনন। ইহার ফলে তিনি মরণোত্তর পুরস্কার পাইয়াছিলেন—ভুস করিয়া স্বর্গে গমন। মৃত্যুর পরে সকলেই একবাক্যে একটি কথাই বলিলেন—‘মিসফিট।’ যাহা হউক তিনি আমাকে একদিন বলিলেন—এইটি পড়ো, ও হৃদয়ে চিরকালের জন্য গাঁথিয়া রাখো। আমি মুখস্থ করিয়াছি; কিন্তু হৃদয়ে গিয়াছে এমন কথা বলিতে পারি না, কারণ, ‘কা-লেস্টা-রল’ ভিন্ন অন্য কিছু হৃদয়ে যাইতে পারে না। ডাক্তারবাবুরা তাহাই বলেন। অবশেষে উহাতেই হৃদয় তিনবার ভুক ভুক শব্দ করিয়া মোক্ষ লাভ করে। আমার অধ্যাপক মহাশয়ের তাহাই হইয়াছিল। তিনি আমাকে তৎকালে যে জ্ঞান দিয়াছিলেন, তাহা এইকালে অজ্ঞান অথবা দুর্জ্ঞান বলিয়াই বিবেচিত হইবে। তথাপি, বলিব যখন বলিয়াছি, বলিয়াই ফেলি, উৎস এক সুফী সাধক, তাঁহার নাম, আল, ঘাজালি। তিনি বলিতেছেন, যাহা বলিয়াছেন, তাহার বাংলা করিলে, এই দাঁড়াইবে, উট মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। হস্তী মনুষ্য অপেক্ষা বৃহত্তর প্রাণী, সিংহ শতগুণ পরাক্রমশালী, গবাদিপ্রাণী মনুষ্য অপেক্ষা অধিক ভোজ করে, পক্ষী বহুগুণ ক্ষিপ্র ও তৎপর প্রাণী। তাহা হইলে, মানুষের গর্ব কোথায়। মানুষ এই বলশালী, ভোজনশীল, দ্রুতগামী প্রাণীদের মধ্যে আসিল কেন! একটি মাত্র কারণে। মানুষ আসিয়াছে শিক্ষা করিবার জন্য, জ্ঞান আহরণ করিয়া জ্ঞানী হইবার জন্য। সেই উপদেশ অনুসারে মনস্তত্ত্বের বই লইয়া কিছুকাল নড়াচড়া করিয়াছিলাম। কোনও একটি গ্রন্থে পাঠ করিলাম, আমার দিকে কেহ তাকাইলেই আমি খোঁড়াইতে থাকি। তাহা না হইলে আমি স্বাভাবিকভাবেই পথ চলি। তিন কন্যার হাস্যোল্লাস দেখিয়া আমার মনে ওই কথাটিই উঁকি মারিল। যেহেতু উহারা তাকাইতেছে, সেইহেতু আমি নায়কের মতো হাঁটিতে পারিতেছি না, সেইহেতু উহারা হাসিতেছে। আমার রাগ হইতেছিল। মনে মনে তাহাদের উদ্দেশে বলিতেছিলাম, ‘বড়লোকের বিটি লো, লম্বা লম্বা চুল। এমন খোঁপা বেঁধে দেব…’। মনে মনে আবার মুখও ভেঙাইতে লাগিলাম। কারণ বড়লোকি চাল, আঁতলামো ইত্যাদি আমি সহ্য করিতে পারি না।

আমি ক্রমশই আমার দূরত্ব বাড়াইতে লাগিলাম। পিছনে বা সামনে যাইবার পথ নাই। আমার সম্মুখে কনজারভেটার মহাশয়, সস্ত্রীক। পশ্চাতে তিন কন্যা। অতএব আমি ক্রমশই বামপার্শ্বে সরিতে লাগিলাম। বৃক্ষ অপেক্ষা মিশুক বন্ধু আর নাই। গাছের ফাঁকে ফাঁকে, রৌদ্র ও পত্রের আলোছায়ার আলপনা গায়ে মাখিতে মাখিতে, পাখির কুজন শুনিতে শুনিতে, আরও গভীরে সরিতে সরিতে এক সময় মারিব কাট। ইহাই ছিল আমার পরিকল্পনা।

আমার ভাগ্যবিধাতার পরিকল্পনা ছিল অন্যরূপ। পুণ্যাত্মা প্রাণী স্বর্গে গমন করে। অবশ্য ধূম হইয়া। পুড়িতে পুড়িতে চিতা হইতে রকেট যোগে মহাকাশে। আমার হইল উলটা। আমি সশরীরে পাতালে চলিলাম। কিছু বুঝিবার অবসরই পাইলাম না। পত্রাচ্ছাদিত একটি গভীর গর্তে ধীরে ধীরে তলাইয়া যাইতেছি, এইটুকুই বোধগম্য হইল। অনুভূতি হিসাবে মন্দ ছিল না। ডালপালা ও প্রচুর শুষ্কপত্রাদি ভেদ করিয়া আমার দেহ নামিতেছে। কতদূরে গিয়া শেষ হইবে জানি না। রক্ষা করো, রক্ষা করো, বলিয়া চিৎকার করিতে পারিতেছি না; কারণ মহিলারা রহিয়াছেন। ভীরুতা ও কাপুরুষতা অপেক্ষা মৃত্যু এই ক্ষেত্রে কাম্য। উহারা এমনিই হাসিতেছে, আমাকে এই অবস্থায় দেখিলে; তালি বাজাইয়া অট্টহাস্য করিবে।

চিৎকার না করিলেও, আমার হঠাৎ অদৃশ্য হইয়া যাওয়া তাহারা লক্ষ করিয়াছে ও তিনজনে সমস্বরে চিৎকার জুড়িয়াছে, ‘বাবা, ফাঁদে পড়েছেন ভদ্রলোক। বাঁচাও, বাঁচাও।’ চিৎকার করিতে করিতে তিন কন্যা ছুটিয়া আসিয়াছে। ইতিমধ্যে আমার পদদ্বয় ভূতল স্পর্শ করিয়াছে। উপরদিকে তাকাইবার চেষ্টা করিয়া ব্যর্থ হইলাম। পাতা, ডাল, মৃত্তিকা, কঙ্কর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট, দৃষ্টি আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে। অন্ধ হইবার সম্ভাবনা। এমন প্রাকৃতিক আলিঙ্গন আগে অথবা পরে কখনও পাই নাই। সর্পদংশনের সম্ভাবনাও রহিয়াছে। বুঝিলাম, অদ্যই শেষ রজনী। ব্রেকফাস্ট করিয়াই বিদায় লইতে হইল, লাঞ্চ আর ডিনার হইল না। এতকাল আমি খাইয়াছি, এইবার আমাকে খাইবে।

বুঝিতে পারিলাম, গর্তমুখে সকলে সমবেত হইয়াছেন। কনজারভেটার সাহেব মনে হয় পাইপ ধরাইবার চেষ্টা করিতেছিলেন। তাঁহার স্ত্রী সাবধান করিতেছেন। শুকপত্রে আগুন লাগিয়া গেলে, অমন ছেলেটা স্রেফ কাঠকয়লা হইয়া যাইবে। মা হইয়াছেন তো সেই কারণেই অপত্য স্নেহ জাগিতেছে। কনজারভেটর মহাশয় বলিতেছেন, আমাকে জঙ্গল শিখিয়ো না। বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়া না দিলে, বাঘধরা ফাঁদ থেকে ছেলেটাকে টেনে তুলব কী করে! গর্তটার ডেপথ্ জানো! গত বছর এইটাতেই সেই বাঘটা পড়েছিল। কান্নিক মারতে মারতে এদিকে এল কী করে! ছোকরার এলেম আছে। তোমরা ঠিক এই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে থাকো মার্কার হয়ে। আমি লোকজন ধরে আনি।’

আমি স্বয়ং চেষ্টা করিতে লাগিলাম উঠিবার জন্য। কোটি কোটি শুষ্কপত্রের করমচর শব্দ ভিন্ন আর কিছুই হইল না। বুঝিলাম গুরুতর পতন হইলে উঠিবার আর উপায় থাকে না। শুনিলাম, তিন কন্যাদের একজন বলিতেছে, ‘এখনও বেঁচে আছে। আর একজন বলিতেছে, ‘মরে গেল।’ তৃতীয়জন বলিল, ‘একবার ডেকে দেখলে হয়। এই যে, কী করছেন!’

এই অতি বিপন্ন অবস্থাতেও একটি সম্ভাবনার কথা চিন্তা করিয়া বড়ই আনন্দ পাইলাম, গভীর রাত্রে এই গর্তে যদি একটি বাঘ আসিয়া পতিত হয়, তাহা হইলে আমাকে ভোজন করিতে তাহার কয়দিন সময় লাগিবে! পায়ের দিক হইতে শুরু করিবে, না মাথার দিক হইতে! একটি অখণ্ড মৎস্য আমি কীভাবে আহার করি তাহা ভাবিবার চেষ্টা করিলাম। ব্যাঘ্রের ভোজ পদ্ধতি আমার জানা নাই।

গর্তমুখে উচ্ছাস শুনিলাম, ‘ওই যে কপিল আসছে হাতি নিয়ে।’

হাতি কী করিতে পারে, তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিলাম। গর্তে পড়িলেও মস্তকটি তো হারাই নাই। হাতি হইল প্রকৃতির ক্রেন। শুণ্ডটি পত্রাদি ভেদ করিয়া গহ্বরে প্রবিষ্ট করাইবে, তৎপরে আমি হোসপাইপের মতো সেই বস্তুটিকে আঁকড়াইয়া ধরিব।

তাহাই হইল। উপর হইতে নির্দেশ আসিল। শুণ্ড নামিতেছে। পত্ররাশি ভেদ করিয়া, হাপরের মতো বাতাস ছাড়িতে ছাড়িতে সেই উত্তোলন যন্ত্র আসিতেছে। নির্দেশ আসিল, ‘পাকড়ো’। একটি হড়হড়ে, খাঁজ কাটা, খাঁজ কাটা নালীক আমার মুখমণ্ডল স্পর্শ করিল। অর্থাৎ নাসিকা দ্বারা আমাকে চুম্বন করিল। নিরামিষ গন্ধ পাইলাম। সদ্য সদ্য থোড় অথবা মোচা ভক্ষণ করিয়া শ্বাস ফেলিলে যে রূপ হয়। কনজারভেটার মহাশয় ইংরাজিতে নির্দেশ নামাইলেন, ‘ট্রাই টু ক্লাইম্ব দি ট্রাঙ্ক।’ আমার তখন জীবনের ইচ্ছা প্রবল হইয়াছে। দম বন্ধ হইয়া আসিতেছে। কয়েক সহস্র নানা জাতীয় পিঁপড়া জীবন্ত খাদ্য ভাবিয়া পিকনিক শুরু করিয়া দিয়াছে। শরীরের সর্বত্র তাহারা চাখিয়া দেখিতেছে। ট্রাউজারের অন্তরালে দেহকাণ্ড বাহিয়া তাহারে অগ্নিপ্রবাহ ধাবমান। মর্মে মর্মে বুঝিলাম কত সত্য সেই বাণী—‘পাপের বেতন মৃত্যু।’ কিঞ্চিৎ পূর্বে আমি কাহাকেও অহঙ্কারী, বড়মানুষের কন্যা, আদুরী ইত্যাদি ভাবিয়াছি, মনে মনে মুখ ভেঙাইয়াছি।

প্রত্নতাত্ত্বিক অথবা পুরাতাত্ত্বিকরা ভূগর্ভ হইতে অতীতের কোনও নিদর্শন, ভাঙা কলস অথবা মূর্তি উত্তোলিত হইলে যে-রূপ সহর্ষ উল্লাস প্রকাশ করেন, হস্তীশুণ্ড সহায়ে আমার ক্রমপ্রকাশকে তাঁহারা ঠিক সমান মর্যাদা দিলেন। তিন কন্যা তিনদিকে ঠিকরাইয়া গেলেন, আমার ভয়ে নহে, আমার গাত্র সংলগ্ন পোকামাকড় দেখিয়া। আমাকে জলৌকাও ধরিয়াছে। রক্ত শুষিতেছে তাহার অনুভব করিতে পারিতেছি। আমি উত্তোলিত হইলেও ভূমি স্পর্শ করিবার সুযোগ তখনও হয় নাই। ঐরাবতপৃষ্ঠে বসিয়া আছি যুবরাজের ন্যায়। হস্তীর মাহুত কপিল যেই তাহাকে সিট-ডাউন ক্যাপটেন বলিল, তখন সে বসিল। আমি ঐরাবত পৃষ্ঠ হইতে অবতীর্ণ হইয়া সমবেত জনতাকে স্যালুট করিলাম। কনজারভেটার সাহেব প্রশ্ন করিলেন, ‘আর ইউ অল রাইট?’

তাঁহার কনিষ্ঠ কন্যাটি অতিশয় উদ্বেগ মিশ্রিত গলায় বলিল, ‘আপনার লাগেনি তো! ভাল আছেন তো!’

আমি হৃদয়ের সুগন্ধ পাইলাম। বুঝিলাম গর্তে পতিত হইবার পূর্বে কন্যার যে দৃষ্টিবাণ বিদ্ধ করিয়াছিল, তাহা ছুঁড়িয়াছিল সেই বালক, ‘কিউপিভ’। ইহাকেই ইংরাজগণ কাব্যাদিতে বলিয়াছেন—লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। আমি উজবুকের ন্যায় বিপরীত ভাবিয়া দূরত্ব বাড়াইতে বাড়াইতে গবাদি পশুর ন্যায় গর্তে পতিত হইলাম। অবশ্য শাস্ত্র বলিতেছেন, প্রেমও এক দুরন্ত গহ্বর! একটি দুর্লঙ্ঘ ফাঁদ বিশেষ।

অজস্র পিঁপড়ার অবিরত দংশনে সর্বাঙ্গ জ্বলিতেছে। থাকিয়া থাকিয়া অঙ্গের এমন প্রত্যঙ্গে কামড়াইতেছে যে চমকাইয়া চমকাইয়া উঠিতেছি, তথাপি বলিলাম, ‘না, লাগেনি। ভালই আছি।’

—‘তাহলে অমন ছটফট করছেন কেন?’

—‘কামড়াচ্ছে। শতশত পিঁপড়ে।’

সমবেত সিদ্ধান্ত এই হইল, যে অবিলম্বে আমাকে অবগাহন স্নান করিতে হইবে। দংশনকারীদের জলে চুবাইয়া মারিতে হইবে। তাহার পর সর্বাঙ্গে কোনও স্নিগ্ধ প্রলেপ। অতএব আবার ঐরাবতপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া দুলিতে দুলিতে করলা নদীর দিকে চলিলাম। কনজারভেটার মহাশয় নির্দেশ দিলেন, দ্বিপ্রহরের ভোজনে আমার নিমন্ত্রণ।

করলা অতিশয় দুঃসাহসী নদী। অবগাহন করিতে করিতে সামান্য দার্শনিক হইয়া পড়িলাম। ভাবিলাম, শুরু আর শেষ, এই লইয়াই জীবন। মায়ের কোল হইতে বলটি লাফাইয়া পড়িল, তাহার পর গড়াইতে গড়াইতে, একদিন ফটাস। খেল খতম। হস্তী তাহার শুণ্ড দিয়া আমার শরীরে জল স্প্রে করিতেছে। আর আমার ভিতরে একটি শ্রুত সঙ্গীতের কলি গুনুর গুনুর করিতেছে—প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ ঢেউ দিল ঢেউ দিল রে। আকুল হিয়ার দুকূল বুঝি ভাঙল রে!

এতটা আশা করি নাই। অদূরে বাঁধের উপরে একটি জিপ গাড়ি আসিয়া থামিল। দেখিলাম কনজারভেটার সাহেব ও অরুণা নামিতেছে। অনাবৃত শরীরটিকে জলে ঢুকাইয়া দিলাম। বেদিং বিউটি হইবার ইচ্ছা নাই। তাঁহারা আমার জন্য নুন তোয়ালে, ধুতি, পাঞ্জাবি, অন্তবাস আনিয়াছেন। অরুণা একেবারে সম্মুখে আসিল না। পিতারূপী মহান পর্বতের আড়াল হইতে বলিল, যথেষ্ট হইয়াছে, আর জলকেলি করিবার প্রয়োজন নাই। বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া আমি যেন সুবোধ বালকের মতো তাহাদের অনুগামী হই। বেলা যথেষ্ট হইয়াছে। হস্তীর পার্টিশানের অন্তরালে পোশাক পরিবর্তন করিয়া জিপে উঠিলাম। সাহেবই গাড়ি চালাইতেছেন। আমরা দুইজনায় পিছনে বসিয়াছি। উথালপাথাল গাড়ি চলিতেছে। আমরা দোলাদুলি করিতেছি। পাশাপাশি বসিলে চটকাচটকি হইবার প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। বসিয়াছি সামনাসামনি। আসন সেইভাবেই স্থাপিত।

যখনই অরুণার পানে তাকাইতেছি, তখনই দেখিতেছি সে আমার দিকে তাকাইয়া আছে। তাকাইতেছি, তাকাইয়া আছে। যখন তাকাইতেছি না, তখনও তাকাইয়া আছে। এমন নজরবন্দী অবস্থায় বসিয়া থাকার দুঃসহতা মর্মে মর্মে অনুভব করিতেছি। হঠাৎ অরুণা হাসিতে শুরু করিল। খলখল, খিলখিল হাসি।

থাকিতে না পারিয়া প্রশ্ন করিতেই হইল, ‘হাসছেন কেন?’

উত্তরে হাসিই নির্গত হইল।

আবার প্রশ্ন করিলাম, ‘হাসছেন কেন?’

সাহেব গাড়ি চালাইতে চালাইতে বলিলেন, ‘ওর একটাই রোগ, হাসি।’

এই কথা শুনিয়া অরুণার হাসি আরও প্রবল হইল, বিষম খাইয়া কাশির মতো। অবশেষে কুচি কুচি যে প্রশ্ন বাহির হইয়া আসিল তাহা একত্রিত করিলে এই দাঁড়ায়, আমি কী হাঁটিতে হাঁটিতে নিদ্রা গিয়াছিলাম যে গর্তের মধ্যে গপাক করিয়া পড়িয়া গেলাম।

সাহেব উত্তর দিলেন, ‘ও কী করবে! গাছ মানুষকে টানে। টানতে টানতে গভীরে নিয়ে যায়। নিরালা নির্জনে। কানে কানে কথা বলে। বিরাটের কথা। বিশালের কথা। সময়ের কথা, মহাকালের কথা। এক একটা গাছের বয়স জানিস!’

‘আপনি যে তখন আমাকে গাছ সম্পর্কে কী বলব বলছিলেন!’

‘সে-সব কত কথা! বিশাল মহাভারত। তোমাকে যেটা বলতে চাই, সেটা হল গাছ আর গান। বিদেশি দুই বিজ্ঞানী গাছ নিয়ে নানারকম পরীক্ষা করছিলেন। গাছের কী কোনও বোধবুদ্ধি আছে! সূক্ষ্ম অনুভূতি আছে। একটা ঘরে বৃত্তাকারে ফুলের টব, গাছের টব রাখলেন। সব টবেই সমবয়সী ছোট ছোট গাছ। সেন্টারে তাঁরা একটা মিউজিক সিস্টেম রাখলেন। প্রথমে বাজালেন রক মিউজিক। শুধু রক নয়, ‘অ্যাসিড রক’। গাছগুলো সব বিপরীত দিকে হেলে গেল। তার মানে অসহ্য লাগছে। সেই গান বন্ধ করে বেশ মিষ্টি নরম স্প্যানিশ সুর বাজালেন—লা পালোমা। কড়া তাল ও ছন্দের গান। স্টিল ড্রাম দিল অনুষঙ্গ। গাছগুলো আবার হেলে গেল বিপরীতে। এইবার একটু কম, দশ ডিগ্রি। এইবার তাঁরা বেহালা চাপালেন। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, গাছগুলো গান শোনার জন্য প্লেয়ারের দিকে পনেরো ডিগ্রির মতো ঝুঁকে পড়েছে। এইবার তাঁদের মনে হল, পশ্চিমী ও ভারতীয় রাগসঙ্গীত বাজিয়ে দেখা যাক, কী প্রতিক্রিয়া হয়। প্রথমে বাজালেন বাখ। অদ্ভুত ব্যাপার হল। গাছগুলো যেন শোনার জন্য স্পিকারের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি হেলে পড়েছে। ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, যখন তাঁরা রবিশঙ্করের সেতার বাজালেন। গাছগুলো স্পিকারের ওপর একেবারে শুয়ে পড়ল। পুরো নব্বই ডিগ্রি হেলে গেল জমির দিকে। কী বুঝলে?’

আমি ‘আজ্ঞে’ বলিয়া নীরব হইলাম।

তিনি বলিলেন, ‘গাছকে যা-তা ভেবো না। গাছ হল আত্মা। গাছ কাঁদে, গাছ হাসে, গাছ বিষণ্ণ হয়। এক একটা বৃক্ষ এক একজন সাধক। লেখা-পড়ার অভ্যাসটা বজায় রেখেছ, না ছেড়ে দিয়েছ?’

‘আজ্ঞে না। বজায় রেখেছি। পড়তে আমার ভীষণ ভাল লাগে।’

‘কী পড়ো?’ গল্প, উপন্যাস।’

‘আজ্ঞে না, গল্প উপন্যাস একেবারে ভাল লাগে না।’

‘কী পড়ো তাহলে?’

‘ইতিহাস, বিজ্ঞান, জীবনী। ভ্রমণও পড়ি।’

গাড়ি চালাইতে চালাইতে অরণ্যদেব কথা বলিবার সময় মাঝে মাঝে পিছন ফিরিয়া তাকাইতেছিলেন। অরুণা বলিল, ‘বাবা! আবার সেইরকম হবে গাড়িসুদ্ধ হড় হড় করে খাদে নেমে যাবে। বারে বারে পেছনে তাকাচ্ছ কেন? না তাকিয়ে কথা বলো না।’

‘ধুর! একবার হয়েছে বলে কী বার বার হবে! আই হ্যাভ এ নোজ ফর ড্রাইভিং। আই পজেস সিকথ সেনস।’

অরুণা আমার দিকে তাকাইয়া স্নেহময়ী জননীর ন্যায় হাসিল। বুঝিলাম, পিতাকে সে পুত্ৰাধিক স্নেহ করে। অরুণা একেবারে আমার সম্মুখে বসিয়া আছে। আমি দুষ্ট প্রকৃতির হইলে নায়িকার ন্যায় টান টান এই সুন্দরীর সহিত তাহারই পিতার পশ্চাদ্দেশে বসিয়া পুরুষোচিত অথবা পুরুষজাতীয় যে-সকল অপকর্ম করিতে পারিতাম, তাহা বলিতেছি। করি নাই কিন্তু; কারণ অরণ্যে অরণ্যে বৃক্ষাদির সমাবেশে দিনাতিপাত করিতে করিতে আমি সভ্য হইয়াছি, সুসংস্কৃত হইয়াছি। বৃক্ষ সমূহের ভূমি হইতে আকাশে উঠিবার তীব্র সনাতন তেজ আমি আত্মস্থ করিয়াছি। সন্ধিলগ্নে আলো আর আঁধারের মায়ায় দেবাদিদেব মহাদেবকে যেন বহুবার প্রত্যক্ষ করিয়াছি। বৃষারূঢ় সেই সাক্ষাৎ যোগী, চারুচন্দ্রাবতংসং, পরশুমৃগ বরাভীতিহস্তং আপন খেয়ালে মগ্ন হইয়া কাল থেকে কালে চলিয়াছেন। কোন চক্ষে সেই দর্শন হয় তাহা আমি বলিতে পারিব না। তথাপি সংস্কারে যে পুরুষ বসিয়া আছে পশু হইয়া, সেই তো কুব্জা। বারে বারে কু বুঝাইতে চায়। রাই পক্ষে কেহ নাই। তেমন হইলে আমার পক্ষে যাহা করা স্বাভাবিক হইত, তাহা হইল হাঁটুতে হাঁটুতে ঘর্ষণ। পদ দ্বারা পদ স্পর্শন। লোলুপ দৃষ্টিতে সমুন্নত দুই বগিরির মধ্যবর্তী উন্মোচিত সঙ্কটশ্রণির শোভাদর্শনে বিমুগ্ধ হওয়া। ওই চলিয়াছে তৈমুর-চেঙ্গিজ। অশ্বারোহী লুটেরার দল। আমি স্বেচ্ছায় না করিলেও যন্ত্রযান তাহার ছন্দ এমন হারাইতেছে, যে আমরা থাকিয়া থাকিয়া সামনে ঝুঁকিয়া পড়িতেছি। ললাটে ললাটে ঠোকাঠুকি হইবার উপক্রম। অরুণার কপালের টিপ আমার ত্রাটক সাধনার সহায় হইতেছে। দৃষ্টি উহাতেই নিবদ্ধ রাখিয়াছি। এক সময় গাড়ি এমন টাল খাইল অরুণা হুড়ম করিয়া আমার কোলে আসিয়া পড়িতে পড়িতেও পড়িল না।

কনজারভেটার সাহেবের পশ্চাৎপটে এত কাণ্ড হইতেছে, আত্মভোলা মানুষটির কোনও খেয়াল নাই। গড়গড় করিয়া গাড়ি চালাইতেছেন। ওষ্ঠদেশে পিডিং পিডিং করিয়া পাইপ নাচিতেছে। হঠাৎ প্রশ্ন করিলেন, ‘ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সাড়া শব্দ নাই কেন? জঙ্গলের একটা নেশা আছে। ঘুম পাড়িয়ে দেয়। গাছের মেমারি আছে জানো? গাছ মনে রাখতে পারে।’

অরুণা বলিল, ‘মটোর গাড়িতে গাছের গুঁড়ি ধাক্কা মারে।’

সাহেব কহিলেন, ‘উলটো বল্লি, গাছে কোন দুঃখে মারবে! মারে গাড়ি। দুঃখ মানুষকে ধরে না, মানুষই দুঃখকে ধরে। আজ পর্যন্ত মানুষ যত অত্যাচার গাছের ওপর করেছে, গাছ তার সিকির সিকিও করেনি।’

আমি বলিলাম, ‘মেমারির কথা বলিতেছিলেন।’

‘ইয়েস, ইয়েস মেমারি। ভলাডিমির সোলোউখিন তাঁর বই ‘গ্রাসে’ লিখেছেন, গাছ নিয়ে গুনারের পরীক্ষার কথা। গাছ চিৎকার করে না, মারামারি করে না, মদ্যপান করে মাঝরাতে মাথা ফাটাফাটি করে না, বিশাল ছুরি বের করে বন্দুক বুকে বসায় না, সৈন্যসামন্ত নিয়ে অন্যের রাজ্য আক্রমণ করতে ছোটে না। বৃক্ষের প্রশান্ত জগতে আছে নীরব অনুভূতি, নিভৃত মর্মবেদনা। সাইলেন্ট সাফারিংস। উদাহরণ চাই! প্রমাণ চাই। প্রমাণ ছাড়া তো মানা যায় না। পরীক্ষা করা হল একটা জিরানিয়াম প্ল্যান্টের ওপর। একজন সেই গাছটাকে ছুঁচ দিয়ে খোঁচাল, পাতা ছিড়ল, আগুন দিয়ে ছেকা দিল। একটা কাণ্ড থেঁতলে দিল। এরপর আর একজন এলেন। তিনি শুরু করলেন পরিচর্যা। আহত গাছের সেবা। পনেরো কুড়ি দিনের মধ্যে গাছটা সুস্থ হল। এইবার ইলেকট্রোড ফিট করা হল গাছটায়। অনেকটা ইসিজি যন্ত্রের মতো একটা যন্ত্র। অত্যাচারী এসে গাছটার সামনে দাঁড়ানো মাত্রই দেখা গেল, গাছটা যেন ভয়ে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। যন্ত্রে তার স্পন্দনের ঢেউ বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে। রাগে ছটফট করছে। পারলে ছুটে পালায়, কি লাফিয়ে পড়ে নির্মাতাকারীর গলা টিপে ধরে। যাকে বলে ভায়োলেন্ট রি-অ্যাকশান। এইবার সেই গাছটার সামনে যেই এসে দাঁড়ালেন শুশ্রুষাকারী, গাছের অনুভূতি অমনি শান্ত হয়ে গেল। সমস্ত ঢেউ স্থির। ভীষণ ভাললাগায় আচ্ছন্ন। গ্রাফের কাগজে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সরল রেখা। গাছটা যেন বলতে চাইছে, ইউ আর এ গুডম্যান, লাভিং ম্যান। আই লাভ ইউ। গাছের কথা বলে শেষ করা যাবে না। বৃন্দাবনের মানুষের কী বিশ্বাস জানো! বৃন্দাবনের প্রতিটি গাছ এক একজন সাধক। চাইনিজরাও একই কথা বলে। বলে, গাছের চেয়ে বড় সাধক কে আছে! একাসনে স্থির লক্ষ্য-আকাশ। ভূমি থেকে উঠছে ভূমার দিকে। গাছের তলায় বসে সাধন-ভজনের আলাদা আনন্দ। সত্তর সালের অক্টোবরে প্রাভদায় একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। প্রাবন্ধিক বলছেন, মস্কোর অ্যাকাডেমি অফ এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেসে তিনি একটা পরীক্ষা দেখেছিলেন। একটা বার্লির চারার শিকড় গরম জলে চোবানো হয়েছে। পাতা আর কাণ্ড সব ঠিক আছে। কোনও বিকৃতি নেই; কিন্তু পরীক্ষাযন্ত্রে দেখা যাচ্ছে, গাছটা যন্ত্রণায় কাঁদছে। বিশেষ এক ধরনের ভয়েস রেকর্ডার ব্যবহার করা হয়েছিল। খুব সূক্ষ্ম সুরে ধরা পড়ল বার্লি চারার কান্না। তুমি খুব অন্যায় করছ। জঙ্গল ইজারা নিয়ে নির্বিচারে গাছ কেটে ব্যবসা করছ! নট গুড। ভেরি ব্যাড। তোমাকে আমি মাস মার্ডারার বলতে পারি।’

সাহেব হুঁউ করিয়া একটি শব্দ করিলেন। ভাবিলাম বলি, গাছ না কাটিলে খাইব কী! গাছ হইতে কাঠ, কাঠ হইতে আসবাবপত্র। কাঠ হইতে মণ্ড প্রস্তুত করিয়া কাগজ। সভ্যতা তো কাগজের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। দলিল তৈয়ারি না করিলে ভূমির উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইবে কী করিয়া। সন্ধিপত্র, চুক্তিপত্র তো কাগজেই রচিত হইবে। প্রেমপত্র কাগজেই লিখিত হইবে। মানবজাতির ইতিহাস কাগজেই ধরা থাকিবে! আরও বলিতে ইচ্ছা করিল, গোটা পৃথিবীটাই যদি অরণ্য গ্রাস করিয়া ফেলে, তাহা হইলে মানুষ বসবাস করিবে কোথায়! জিপ গাড়ি কোথায় চলিবে! আমি বলিলাম না; কারণ আমার লজ্জা করিল।

গাড়ি গোঁত করিয়া বাংলোয় প্রবেশ করিল। ক্যাঁচ করিয়া ব্রেক মারিলেন। গাড়ি স্থির হইল। জামাতার পোশাকে অবতরণ করিলাম। শঙ্খ বাজিল না। তখনও তো বুঝি নাই, এই যে ঢুকিলাম আর বাহির হইবার পথ পাইব না! অরুণা বলিল, চলুন, ভেতরে চলুন। এত গাছের কথা শুনলুম, যে নিজেকে এখন গাছ মনে হচ্ছে।’

সুদৃশ্য বাংলোটি আমার অতিশয় পছন্দ হইল। উদ্যানপরিবৃত, সুসজ্জিত। অর্থ ও প্রতিপত্তি থাকিলে মানুষ এক টুকরা স্বর্গ রচনা করিতে পারে। আলোকিত, ঝলসিত, লতাশোভিত বারান্দায় উপবেশন করিলাম। ভোঁ ভোঁ করিয়া ভোমরা উড়িতেছে। এই প্রাণীটি আমার অতিশয় প্রিয়। দেখিলেই মনে হয় একটি লিচুর বীজ ডানা মেলিয়া উড়িতেছে। বাতাসে রন্ধনের সুবাস ভাসিয়া আসিতেছে। কনজারভেটার সাহেব স্নানে গিয়াছেন। তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা অতিশয় গম্ভীর মুখে প্রশ্ন করিলেন, আমি কোনও শারীরিক অস্বস্তি বোধ করিতেছি কি না! গম্ভীর হইলেও তাঁহার এবম্বিধ প্রশ্নে আমি কোনও আপনজনের সন্ধান পাইলাম। পারিবারিক সূত্রে যাঁহারা আপনজন তাঁহারা সকলেই লেনেঅলা। প্রয়োজনে দন্তবিকশিত করিয়া আসেন। পৃষ্ঠদেশে হস্ত বুলাইয়া, যাহা বুঝিয়া লইবার তাহা বুঝিয়া লইয়া কিয়দ্দিনের জন্য পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেন। ছিন্ন চপ্পল পরিয়া আসিয়া ভুল করিয়া আমার নতুনটি পরিয়া হাওয়া হইয়া যান। বয়স হইলে মানুষের বিভ্রম হইতেই পারে। মানুষ সম্পর্কে আমার পিতার পরিষ্কার ধারণা। তাহাদের দুই জাতি—লেনেঅলা আর দেনেঅলা। প্রতিটি মানুষ ব্যাঙ্কের কাউন্টার। দুইটি ফোকর, একটিতে ডিপোজিট অন্যটিতে উইথড্রল। জমা পড়িতেছে, তুলিয়া লইতেছে।

আমার শরীরে নানারূপ প্রদাহ হইতেছে, তথাপি বলিলাম, সম্পূর্ণ সুস্থই আছি, তখন তিনি আমাকে বলিলেন, জড়ভরতের ন্যায় বসিয়া না থাকিয়া সর্বত্র বিচরণ করিলে আমার ভালই লাগিবে। রমণীসুলভ লজ্জা পরিহার করাই শ্রেয়। এই বাংলোর পশ্চাতে ও দুই পার্শ্বে বহুবিধ আকর্ষণ। পিছন বাগানে বৃহদাকার রাজহংসের দল অবিরত প্যাঁকোর প্যাঁকোর করিতেছে। সুদৃশ্য, স্নানযোগ্য জলাশয় বর্তমান। তাহাতে কুমুদিনী হাসিতেছে। একটি কুঞ্জবন আছে। পিতার নির্মাণ। জ্যোৎস্না রাত্রে পরীরা তথায় নৃত্যগীতাদি করিলেও করিতে পারে।

আমি তৎক্ষণাৎ সেই মনোরম অঞ্চলটির উদ্দেশ্যে চলিলাম। যাইবার পথে পাকশাল। কন্যায়ের জননী সস্নেহে আমার দুই হস্তে দুইটি গরম বেগুনি ধরাইয়া দিলেন। দেখিলাম অরুণা অলিন্দে বসিয়া কী করিতেছে, তাহার মস্তকে একটি চকচকে রবারের টোপর। তাহার মধ্যে কেশদাম লুক্কায়িত। মুখমণ্ডল হলুদ পদার্থে আবৃত। অনুমানে বুঝিলাম ভেষজ রূপচর্চা হইতেছে। দুগ্ধ, ময়দা ও হলুদ সহযোগে প্রলেপটি প্রস্তুত করা হইয়াছে। চকিতে তাকাইয়া ঝটিতি উদ্যানে নিষ্ক্রান্ত হইলাম। অপূর্ব সেই উদ্যানের শোভা। দুগ্ধধবল রাজহংসসকল সদম্ভে বিচরণ করিতেছে। একটি বকুলের তলে রক্তলাল বেদী। কয়েকটি পারগোলা স্থানে স্থানে নির্মিত হইয়াছে। শোভা দেখিয়া আমি হতভম্ব। অতঃপর আর একটি দৃশ্যে আমার বাক্যরোধ হইয়া গেল। কনজারভেটর সাহেব কোদাল দিয়া মাটি কোপাইতেছেন। ঘর্মাক্ত কলেবরে আমার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘ইয়াংম্যান শীত আসছে ফুল ফোটাতে হবে।’

আমি বলিলাম, ‘ছেড়ে দিন আমি কুপিয়ে দিচ্ছি।’

তিনি বলিলেন, ‘এইটাই আমার আনন্দ। আমার একসারসাইজ। কাঁধ আর কোমর খুব ফিট থাকে। বয়েসে ওই দুটোই তো ট্রাবল দেয়।’

তিনি আবার কোদাল চালাইতে লাগিলেন। মাটি খাবলা খাবলা হইতে লাগিল। অদ্ভুত সোঁদা সোঁদা গন্ধ। মৃত্তিকার গন্ধে গণতন্ত্রের সুবাস। মনে হইতেছিল ধুতি পাঞ্জাবি খুলিয়া নামিয়া পড়ি। অবশেষে তাহাই হইল। মালকোচা মারিয়া নামিয়া পড়িলাম। তিনি কোপাইতে লাগিলেন, আমি ইনকিলাব ধ্বনি দিতে দিতে মাটির ঢেলা চূর্ণ করিতে লাগিলাম মহানন্দে। কখনও থ্যাবড়াইয়া বসিয়া পড়িতেছি, কখনও শুইয়া পড়িতেছি।

কনজারভেটার সাহেব একসময় বলিলেন, ‘তুমি দেখছি পাগলামিতে আমার ওপরে যাও।’

ব্যাপারটা এতই জমিল যে আহারে বসিতে প্রায় তিনটা বাজিয়া গেল। এতই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া উপাদান খাদ্যসকল গোগ্রাসে খাইতে লাগিলাম। কাহারওপানে তাকাইবার অবসর নাই। সকলে একত্রেই বসিয়াছি, কিন্তু অর্জুন যেমন মৎস্যের চক্ষুটিই দেখিয়াছিলেন বাণবিদ্ধ করিবার সময় সেইরূপ আমিও খাদ্যই দেখিতেছি, অন্যান্য খাদকদের দেখিতে পাইতেছি না। তবে অরুণার অনর্গল কথা কানে আসিতেছে। তাহার মাতা বলিতেছেন, ‘খেতে খেতে অত কথা বলিস কেন? বিচ্ছিরি অভ্যেস। আমার ছেলেটাকে দেখ!’

ছেলে সম্বোধনে আমি এমত অভিভূত হইলাম, চক্ষে জল আসিয়া গেল। মাত্র অর্ধদিবসের পরিচয়ে তাঁহারা আমাকে এতটাই আপন করিবেন তাহা ভাবিতে পারি নাই। কতবার যে কত পদ লইলাম হিসাব রহিল না। অবনত মস্তকে ঘাড় নাড়িতেছি ও পাতে আসিয়া পড়িতেছে। নিমেষে উদরে। কুম্ভকর্ণের দ্বিতীয় সংস্করণ বলিয়া নিজেকে মনে হইতেছে। বড়দি থাকিয়া থাকিয়া উৎসাহ দিতেছেন, ‘চালিয়ে যাও ভাই, এমন মানুষকে খাইয়েও আনন্দ।’ মেজদি একবার মাত্র বলিলেন, বেশি ভোজন করিলে মানুষের পরমায়ু কমিয়া যায়। দীর্ঘদিন যদি খাইতে চাও তাহা হইলে কম খাও। এই মন্তব্যের জন্য সকলেই তাঁহাকে ধমক দিলেন। এক ভোজনবীর দিল খুলিয়া খাইতেছে, ইহা আমাদের কম সৌভাগ্য! ‘ব্র্যাভো, ব্র্যাভো, চালিয়ে যাও।’

আহারাদির পর শেষবেলার স্নিগ্ধ আলোকে উদ্যানে ঘুরিতে লাগিলাম, কদম্ব ও কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় ছায়ায়। দু-এক কলি গান ভাঁজিবার চেষ্টা করিলাম। উদর অতিরিক্ত পূর্ণ থাকায় সঙ্গীতের পরিবর্তে উদগার উঠিতে লাগিল। হঠাৎ শুনিলাম নারীকণ্ঠ, ‘ব্যর্থ চেষ্টা। ভর পেটে গান হয় না ভাই।’

তাকাইয়া দেখিলাম বড়দি। একটি বেদীর উপর বসিয়া সোয়েটার বুনিতেছেন। ডাকিয়া আমাকে পার্শ্বে বসাইলেন। আলুলায়িত কুন্তলে দেবী সরস্বতীর মতো দেখাইতেছে। অদূরে একটি রাজহংস তাঁহার বাহনের ন্যায় স্থির হইয়া আছে। নারীর প্রতি আমার আসক্তি নাই; কিন্তু সুন্দরী রমণী দেখিতে আমার ভাল লাগে। বড়দির পার্শ্বে অতি সঙ্কোচে আড়ষ্ট হইয়া বসিয়া আছি। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাইতে পারিতেছি না।

তিনি বলিলেন, ‘তোমার কি পেট ব্যথা করছে?’

‘আজ্ঞে না। আমার পেটে কোনও সমস্যা নেই।’

‘তাহলে অমন সিঁটিয়ে বসে আছ কেন?’

উত্তরে আমি নির্বোধের মতো হ্যা হ্যা করিয়া হাসিলাম।

তিনি প্রশ্ন করিলেন, ‘তোমার মনে পাপ আছে?’

এই প্রশ্নের উত্তর দিবার মতো বুদ্ধি আমার নাই। মন আছে। নানা কথা মনে রাখিবার মমতা আমার আছে। ব্যবসায় বুদ্ধিও আমার কম নয়। পিতার ব্যবসা যোগ্যতার সহিত চালাইতেছি। যথেষ্ট সমৃদ্ধি ঘটিয়াছে। তথাপি পাপ কাহাকে বলে, পুণ্য কাহাকে বলে আমার বোধে নাই। আমি হাত কচলাইতে লাগিলাম।

তিনি বলিলেন, ‘মেয়েদের সঙ্গে তুমি সহজ হতে পারো না। সকালে আমাদের ভয়ে তুমি গর্তে পড়ে গেলে। এখন তোমাকে বসতে বললুম, দাঁড়ের পাখির মতো ঝুলছ। কিসের এত ভয় বাছা! মেয়েরা বাঘ না ভালুক!’

এই কথা শুনিয়া আমাকে আমার ছাত্রজীবনের একটি ঘটনা বলিতেই হইল। পাড়ারই এক কন্যা আমারই শ্রেণীতে মহিলা বিদ্যালয়ে পড়িত। তাহার সহিত আমার পরিচয় হইয়াছিল। পুস্তক ও খাতাপত্রের আদানপ্রদান হইত। হইতেছে, হইতেছে। কোথাও কোনও গোলযোগ নাই। এইবার সেই রমণী কী সর্বনাশা কাণ্ড করিল! আমারই একটি খাতার ভিতরের কোনও একটি পাতায় সে আমারই উদ্দেশে একটি প্রেমপত্র লিখিয়া রাখিয়াছিল। তাহাতে ‘প্রিয়তম’, ‘শত চুম্বন’, ‘চটকুমটকু’, ‘ইলিবিলি’ ইত্যাদি নির্বোধশব্দের প্রতুল প্রয়োগ ছিল। আমি পত্রটি দেখি নাই। দেখিলে দুষ্ট দন্তের ন্যায় উৎপাটিত করিতাম। সন্ধ্যাবেলা পড়াইতে আসিয়া আমার গৃহশিক্ষক উহা আবিষ্কার করিলেন। দেখিলাম মনোযোগ সহকারে কিছু একটা পাঠ করিতেছেন। ভ্রূদ্বয় কুঞ্চিত হইতেছে। অতঃপর এমনই উল্লসিত হইলেন যেন কলম্বাস সাহেব আমেরিকা আবিষ্কার করিয়াছেন। চেয়ার ত্যাগ করিয়া ক্রোধে কিয়ৎক্ষণ নৃত্য করিলেন। যতই প্রশ্ন করি, কী ভুল হইয়াছে বলুন সংশোধন করিব। ততই তিনি একটি মাত্র শব্দ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, চরিত্রহীন। অবশেষে আমার পিতার অনুমতি লইয়া, একাই একশো হইয়া উত্তম-মধ্যম পিটাইতে লাগিলেন ও ইংরাজিতে যাহা বলিতে লাগিলেন, তাহার অর্থ, টাকা হারাইলে কিছুই হারায় নাই, স্বাস্থ্য হারাইলে কিছু হারাইল, চরিত্র হারাইলে সর্বস্ব হারাইল। প্রহৃত হইতে হইতে মনে হইয়াছিল, প্রেম নামক আমেরিকায় আমি শেষ রেড ইন্ডিয়ান। প্রহারে সর্বশরীর রক্তিম। সেই হইতেই নারী সম্পর্কে আমি অতিশয় সাবধানী। কী হইতে কী হইয়া যাইবে কে বলিতে পারে!

সব শ্রবণ করিয়া তিনি মুচকি হাসিলেন ও দ্রুত কয়েক ঘর সোয়েটার বুনিলেন। ওই হাসি যে বিধাতারই হাসি তখন তাহা বুঝি নাই। দুইটি চপল কাঠবিড়ালি আমাদের প্রদক্ষিণ করিয়া বৃক্ষের কাণ্ড বাহিয়া আবার উপরে চলিয়া গেল। রাজহংস প্যাঁক করিয়া বাহবা দিল।

দূরে দেখিলাম, অরুণা একটি বল লইয়া বাঘা অ্যালসেসিয়ানটিকে দৌড় করাইতেছে। একবার তাকাইয়াই চক্ষু ফিরাইয়া লইলাম, আবার তাকাইলাম। চক্ষুদ্বয় যেন কম্পাসের কাঁটা। সদাই উত্তরে মুখ ফিরাইতে চায়। বড়দি বোধকরি আমার এই চৌর্যবৃত্তি লক্ষ করিতেছিলেন। একটি দ্ব্যর্থবোধক প্রশ্ন ছুঁড়িলেন, ‘কেমন লাগছে?’

আমি চমকাইয়া বলিলাম, ‘ভীষণ ভাল। যেন স্বর্গে আছি।’

‘দু-একটা অপ্সরা থাকলে আরও ভাল হত! কী বলো?’

আমি হাসিলাম। তিনিও হাসিলেন। আমিও আবার হাসিলাম। ইতিমধ্যে কুকুরের সহিত ছুটিতে দুটিতে অরুণা আমাদের দিকে চলিয়া আসিল। জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস পড়িতেছে। আমি অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলাম। মন যেন মনে মনে বলিল, আহা! কী সুন্দর! পুরুষের চক্ষু, নারীর বক্ষ। নিয়ন্ত্রণে আনিব কী করিয়া।

অরুণা বেশ একটু তিরস্কারের ভঙ্গিতে বলিল, ‘বসে আছেন কী! একটু দৌড়াদৌড়ি করতে পারছেন না। বাতে ধরবে যে!’

সঙ্গে সঙ্গে আমি দাঁড়াইয়া উঠিয়া, তীরবেগে যে-কোনও একদিকে দৌড়াইতে লাগিলাম। কুকুরটি আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছে। খচরমচর শব্দ হইতেছে। কনজারভেটার সাহেব বিপরীত দিক হইতে আসিতেছিলেন। তিনি অবাক হইয়া বলিলেন, ‘পারো বটে।’

হঠাৎ দেখিলাম, তিনিও আমার সহিত ছুটিতে লাগিলেন। দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হইয়া গেল। কে হারে কে জেতে। সেই বিশাল উদ্যানের এক প্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তের দূরত্ব কম হইবে না। আমিই প্রথম হইতে পারিতাম; কিন্তু বয়সের প্রতি সম্মান জানাইবার জন্য ইচ্ছা করিয়া হারিয়া গেলাম। এই পরাজয়ে জয়ের অধিক তৃপ্তি অনুভব করা যায়। আমাদের দৌড় সেই বেদীর কাছে শেষ হইল, যে স্হলে বড়দি সোয়েটার বুনিতেছিলেন। তিনি তাঁহার পিতাকে বলিলেন, ‘পারো বটে।’ তাহার পর পৃষ্ঠদেশে সোয়েটারটি ফেলিয়া মাপ লইতে লইতে বলিলেন, ‘তোমার জন্মদিনে এইটা উপহার দোবো।’

একপাশে অরুণা বসিয়াছিল। সে বলিল, ‘কেমন দৌড় করালুম!’

বড়দি বলিলেন, ‘ভারী বাধ্য ছেলে, বলা মাত্রই ছুট।’

সাহেব বলিলেন, ‘চলো, এইবার একটু গাছের পরিচর্যা করা যাক।’

বড়দি বলিলেন, ‘চা আসছে। চা খেয়ে যা করার করো।’

অরুণা বলিল, ‘এতকাল তো আমিই তোমার অ্যাসিস্টেন্ট ছিলুম, আজ আমাকে ত্যাগ করলে!’

‘ত্যাগ করব কেন? তিনজনে মিলে করব। আজ সার দিতে হবে। তুই তো গন্ধ, গন্ধ বলে নাকে চাপা দিবি।’

গাছ কাটা কাঁচি, জল সেচনের ঝারি, সারের ক্যান, খুরপি প্রভৃতি বাহির হইল। সুদৃশ্য পেয়ালায় সুগন্ধী চা-পান করিয়া আমরা তিনজনে মার্চ করিয়া কর্মস্থলের দিকে যাত্রা করিলাম। সেই পরিবার ভক্ত অ্যালসেসিয়ানটিও আমাদের সহিত মহানন্দে নাচিয়া নাচিয়া চলিল। বেলা শেষের আলোয় বাংলোটিকে পটে আঁকা ছবির মতো দেখাইতেছে। মনে মনে ভাবিলাম, জীবন কত সুখের। পৃথিবী কত সুন্দর! পরিশ্রম করিব, প্রকৃতিকে ভালবাসিব ও মানুষের ভালবাসায় বাঁচিয়া থাকিব। ক্রমে এক সুখী বৃদ্ধ হইব, তখন অনন্তের ধ্যান করিতে করিতে মরিয়া যাইব।

গাছের ডাল কাটিতে কাটিতে ঘাস নিড়াইতে নিড়াইতে, অরুণার সহিত যথেষ্ট সখ্যতা জন্মাইল। কাছাকাছি, পাশাপাশি বসিলেই যে এইরূপ হইবে, এমন কোনও কথা নাই। অরুণা অতিশয় সরল। সেই কারণে, সে কখনও আমাকে ধমকাইতেছে, অপদার্থ বলিতেছে, কয়েকবার হাঁদা বলিয়াছে, মাটি মাখা হাতে তিনবার মাথায় চাঁটি মারিয়াছে। আমার সব কার্যই ধূম ধড়াক্কা টাইপের। ধরিয়া আনিতে বলিলে বাঁধিয়া আনি। ঘাস নিড়াইতে বলিয়াছিল, ঝুঁটি ধরিয়া এমন টান মারিলাম কয়েকটি পুষ্প চারা উৎপাটিত হইয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে অরুণা বলিল, ‘অকাজের শিরোমণি’। তাহার পিতা সব দেখিতেছেন, শুনিতেছেন ও ঠোঁটের ফাঁকে ফাঁকে মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। একবারও ভাবিতে পারিতেছি না, এই রমণী কী আমাকে বশীকরণ করিয়াছে! নারী রজ্জুবিশেষ। অসীম তাহার বন্ধনশক্তি।

অবশেষে রাত্রি আসিল। আমি আমার বাংলোয় প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হইলাম। সেই স্থলে আমার যথা সর্বস্ব পড়িয়া আছে। আমার সহিত সদাসর্বদা একখণ্ড গীতা থাকে। আমার শক্তির উৎস। উহার মধ্যে বসিয়া শ্রীভগবান বলিতেছেন, কর্মে তোমার অধিকার কর্মফলে নহে। কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।

আমি বিনীতভাবে বলিলাম, ‘এবার তাহলে আমি আসি।’

মেজ কন্যাটি ছাড়া সকলেই সমস্বরে হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, ‘যাবে মানে! কোথায় যাবে?’

অরুণা যোগ করিল, ‘এবার তাহলে বাঘে খাবে।’

সেই মুহূর্তে শিল্পী শিল্পী চেহারার ফিনফিনে এক যুবক, বগলে তম্বুরা লইয়া প্রবেশ করিলেন। এক গাল হাসিয়া বলিলেন, ‘ইমনের সময় চলে যায়। এখুনি না বসতে পারলে ধরা যাবে না। তাই ছুটতে ছুটতে আসছি।’

সাহেব বলিলেন, ‘ছোটাছুটির প্রয়োজন নেই। বসে পড়ে ধরে ফেলল।’

তিনি কাল বিলম্ব না করিয়া বসিয়া পড়িলেন। তম্বুরা ম্যাও ম্যাও শব্দ জুড়িল। সুর বাঁধা হইতেছে। অরুণা আমার কানে কানে কহিল, ‘কত রকমের পাগল আছে? এখানকার ফরেস্ট অফিসার।’

তিনি ততক্ষণে তম্বুরা উঁচাইয়া ফেলিয়াছেন। বাম কর্ণ বাম হস্তের দ্বারা চাপিয়া, মুখ ব্যাদান করিয়া বিশাল এক হুঙ্কার ছাড়িলেন, যেন রাত্রির অরণ্যে রয়ালবেঙ্গল ডাকিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ মেজকন্যা ঘর ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। যাহাকে দ্রুত পলায়ন বলা যাইতে পারে। যেন প্রকৃতই বাঘে তাড়া করিয়াছে। গায়ক লক্ষ করিয়াছেন, সুর ভাঁজিবার ফাঁকেই বলিলেন, ‘যাঃ পালিয়ে গেল।’

সাহেব বলিলেন, ‘উচ্চাঙ্গের জিনিস সকলের সহ্য হয় না। ডোন্ট মাইন্ড! গো অন।’

তিনি তখন একটি উৎকট তান মারিয়া বলিলেন, ‘এইসব কাজকর্ম আমি অরুণাকে দিয়ে যাব। এসব গুরুমুখী বিদ্যা।’

মন্তব্যটি শায়েরির মতো নিক্ষেপ করিয়া তিনি পুনরায় সঙ্গীতের বন্দিশে আসিলেন। মন্দ গাহিতেছেন না। যথপরোনাস্তি আবেগ ঢালিতেছেন। কেমন যেন সন্দেহ হইল, এই আবেগের উৎস কোনও নারী, এবং তিনি এই ঘরেই বিদ্যমান। আমার অঙ্গুলিতে ত্রিতালের ছন্দ খেলা করিতেছিল। এক সময় বলিয়া ফেলিলাম, তবলা থাকিলে বাজাইবার চেষ্টা করিতাম।

‘আপনি তবলা বাজাতে পারেন?’ অরুণা বিস্ময় অথবা ব্যঙ্গ প্রকাশ করিল।

আমি মস্তক অবনত করিয়া অপরাধীর ন্যায় হাতকচলাইতে লাগিলাম।

এক জোড়া তবলা আসিল, হাতুড়ি ও পাউডার আসিল। আমার গুরুর নাম স্মরণ করিয়া বসিয়া পড়িলাম। তবলায় হাত লাগাইবা মাত্র আমার অন্তরে এক ওস্তাদের সত্তার প্রকাশ ঘটিল। একটি রেলা ছাড়িতেই সকলে হই হই করিয়া উঠিলেন। সাহেব বলিলেন, ‘আরে এ তো শান্তাপ্রসাদ!’ ঘরানাটি তিনি ঠিকই ধরিয়াছেন। আমি তাঁহারই শার্গিদ।

অরুণা সোফা হইতে নামিয়া আমার বামপার্শ্বে কিয়দ্দূরে বসিল। গায়ক কটমট করিয়া তাহার দিকে তাকাইলেন। তৎক্ষণাৎ বুঝিয়া ফেলিলাম, হরধনু কাহার জন্য ভঙ্গ হইবে! গায়ক তম্বুরা মিয়াও মিয়াও করিতে করিতে বলিলেন, ‘অরুণা, ওখানে কেন! আমার পাশে এসে বোসো। তোমাকেও গাইতে হবে।’

অরুণা পরিষ্কার বলিল, ‘আজ আমার গলার অবস্থা খুব খারাপ। আপনি একাই করুন।’

ভদ্রলোক বজ্রাহতের ন্যায় কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হইয়া থাকিয়া তেড়ে গান ধরিলেন, তারানা সহযোগে, তুম নানা, তোম নানা। আমিও ছাড়িবার পাত্র নহি। অদৃশ্য একটি প্রতিযোগিতা শুরু হইল। অনেকেই শ্রোতা, আমরা একজনকেই শোনাবার চেষ্টা করিতেছি, সে হইল অরুণা। অকারণেই আমি অরুণাকে জয় করিবার চেষ্টা করিতেছি। আমার মন দুর্বল হইয়াছে। মনে হইতেছে, বহুকাল পরে আমি পুনরায় প্রেমে পড়িলাম। অখিলবন্ধু মহাশয়ের সেই গানটি আমার মনে ভাসিতেছে—ও দয়াল বিচার করো, আমায় গুণ করেছে আমায় খুন করেছে। মেয়েটির মহিমায় আমি মোরোব্বা হইয়া গিয়াছি। আমার মাতা যাহা বলিতেন আজ বুঝিতেছি তাহা অতিশয় সত্য। সন্ধ্যাকালে মেয়েদের বাতাস গায়ে লাগিলে মানুষ বশীভূত হইয়া যায়। কামরূপ কামাক্ষায় যত মেষ ঘুরিতেছে তাহারা সকলেই এককালে মনুষ্য ছিল, ওই স্থলের সুন্দরী রমণীরা তাহাদের মায়ায় সকলকে মেষ বানাইয়া ছাড়িয়াছে।

গায়কের সহিত আমার জবরদস্ত সঙ্ঘর্ষ শুরু হইয়াছে। আমি এমন ছন্দে এমন বোল ছাড়িতেছি যে, তিনি সামলাইতে পারিতেছেন না। মাঝে মাঝে সম চাপিয়া, আড়ি মারিয়া আমাকে কাহিল করিবার চেষ্টা করিয়া নিজেই ফাঁপরে পড়িতেছেন। আমার ভিতরে অসম্ভব এক শক্তি আসিয়া গিয়াছে। বিদ্যুৎ গতিতে এক মাত্রার ভিতরেই এমন বোল ভাগ করিতেছি যে নিজেই অবাক হইয়া যাইতেছি। জায়গায় জায়গায় শ্রোতারা ফটফট করিয়া হাততালি দিতেছেন।

পরিশেষে অনুরোধ আসিল, তুমিও একটি গান গাও। গায়কমহাশয় ব্যঙ্গের সুরে বলিলেন, ‘আপনি আবার গানও করেন বুঝি!’

ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা শুনিলে আমি ক্ষিপ্ত হইয়া যাই। এই স্বভাবটি আমার উত্তরাধিকার। আমার পিতাকে যখন পরিচিতজনেরা উপহাস করিয়া বলিয়াছিলেন, কাঠের ব্যবসায় গুজরাতিদের সহিত তুমি পারিবে না, কেন কাঠের চিতায় অকালে চড়িবার প্রয়াস পাইতেছ! আমার পিতা এই শুনিয়া করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে বলিয়া ঝাঁপাইয়া পড়িলেন।

আমি অন্য কোনও সহজ গান ধরিবার পরিবর্তে, ধরিয়া বসিলাম মিশ্রখাম্বাজে একটি ঠুংরি—লাগে তোসে নয়ন। উন্মুক্ত গবাক্ষে রাতের অরণ্য ঘন হইয়া আছে। চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত। পরিচ্ছন্ন বাতাস। জোনাকির বিন্দু বিন্দু আলো নৃত্য করিতেছে। সুর লাগাইবা মাত্র, ঈর্ষা, দ্বেষ, দ্বন্দ্ব যাহা কিছু ছিল সকলই ঘুমাইয়া পড়িল। সদ্যোজাত প্রজাপতির ন্যায় আমি সুরের আকাশে ভাসমান হইলাম। লাগি তোসে নয়ন, মোরিয়ালি উমারিয়া। সুরে এমনই নিমজ্জিত হইলাম, সেই ঘরখানি অদৃশ্য হইল। তাহার পরিবর্তে রচিত হইল একটি দরবার। জাফরির পরপার্শ্বে উমরাওজান। স্বর্ণখচিত জোব্বায় বাদশাহ ময়ূর সিংহাসনে। পাত্রমিত্র, সভাসদাদি। আমার দুই চক্ষে ভাবাশ্রু টলটল করিতেছে। গানটি শেষ করিয়া সঙ্গে সঙ্গে বাগেশ্রীতে ধরিলাম, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে। গানটি সম্পূর্ণ করিতে পারিলাম না। রবীন্দ্রনাথকে দেখিতে পাইলাম, সৌম্যদর্শন ঋষি এক একাকী দাঁড়াইয়া আছেন দুস্তর এক নদীর তীরে। অন্ধকারে ভাসিয়া যাইতেছে একটি তরণী। আবেগ সামলাইতে না পারিয়া আমি ছুটিয়া বাহিরের উদ্যানে চলিয়া গেলাম। চন্দ্রোদ্ভাসিত অরণ্য আমাকে আহ্বান করিতেছে, ওরে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা। সুরের ঠেলা ও অরণ্যের আহ্বানে আমি প্রকৃতই দৌড়াইতে আরম্ভ করিলাম। কোথায় যাইতেছি জানি না। বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ শ্রেণী একপদে জৈন সাধকদের মতো দণ্ডায়মান। ঝিঝির তার সপ্তমে বাঁধা গলায় তীব্র সঙ্গীত। কোনও এক জাতির প্রাণীর করাত দিয়া কাঠ চিরিবার মতো শব্দ। কখনও কোথাও পত্রাবলী ভেদ করিয়া এক ঝলক চাঁদের আলো ভূমিতে নামিয়া আসিয়াছে মায়ামুকুরের ন্যায়। ঝমঝম শব্দে মল বাজাইয়া কোথাও নাচিতেছে শজারু সুন্দরী। মত্ত হস্তীযূথ দূরে কোথাও সমবেত বৃংহণে বনভূমি কম্পিত করিতেছে। অবশ্যই মৈথুনের উল্লাসে। ছায়ান্ধকারে ভল্লুক কোথাও মাতাল হইয়া শুইয়া আছে কি না বুঝিতে পারিতেছি না। আমি অদ্ভুত এক নেশায় আচ্ছন্ন হইয়া চলিয়াছি। স্বর্গের সমস্ত অপ্সরা একত্রিত হইয়া অরুণার মূর্তি ধরিয়া, জ্যোৎস্না রঙের আঁচল উড়াইয়া আমাকে ইশারায় ডাকিতেছে। লোকালয় পরিত্যাগ করিয়া, বৃক্ষের জগৎ অতিক্রম করিয়া, চলো যাই কোনও স্রোতস্বতীর তীরে। পরপারে নীল পর্বতের ক্রোড়ে ঘুমাইয়া আছে অন্ধকার অরণ্য। শত শত বিদেশি আত্মা আলোকের ফুলকি হইয়া উড়িতেছে। তিক্ত গন্ধের আমেজে আমার নেশা ক্রমশই চড়িতেছে। পথের শেষে যদি মৃত্যু থাকে তাহা হইলেও আমার ভয়ের কোনও কারণ নাই। এমনি চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভাল, সে মরণ স্বরগ সমান।

অকস্মাৎ আমি এক নদীর কূলে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। উপল বিছানো ঢালু তটভূমি সেই নদীতে নামিয়া গিয়াছে। অস্ফুট মন্ত্রোচ্চারণের মতো শব্দ করিয়া নদী চলিয়াছে, উপলে উপলে চরণচিহ্ন ফেলিয়া। দুগ্ধধবল চন্দ্রকিরণে স্নাত চরাচর। আকাশ এক নীল মায়া। ইহাতেই বিস্ময়ের শেষ নহে, দিগন্তে উদ্ভাসিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। শীর্ষে তুষার মুকুট। ধ্যানে বসিয়াছেন দেবাদিদেব মহাদেব।

এক নিঃশ্বাসে জলের কিনারায় নামিয়া পড়িলাম। কোনও ভয় নাই। বন্যপ্রাণী জলপান করিতে আসিবে সেই আশঙ্কায় এতটুকু বিচলিত হইলাম না। এই রাত্রি আমার জীবনের শেষ রাত্রি হইলেও আমার কেনও দুঃখ নাই। মনে হইল, এই স্থান হইতেই জীবাত্মা পরমাত্মার দিকে যাইতে পারে।

আমি একটি শিলাখণ্ডের উপর উপবেশন করিলাম। ধীরে ধীরে আমি ধ্যানমগ্ন হইতেছি। আমার শরীরের বহিরাবরণ ক্রমে ক্রমে প্রকৃতির সহিত মিশিয়া যাইতেছে। অরণ্য, পর্বত, জল, স্থল সব একাকার হইতেছে। রেণু রেণু আলোকধারা এক তানে একই ছন্দে নৃত্য করিতেছে। এমন বিশাল অনুভব আমার কখনও হয় নাই। আমার কণ্ঠ হইতে সুর নিঃসৃত হইল। ইমন কল্যাণে দূর আকাশের রজত মৌলি কাঞ্চনজঙ্ঘাকে শোনাইতে লাগিলাম রবীন্দ্রনাথের গান,

মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে

আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।।

তুমি আছ, বিশ্বনাথ, অসীম রহস্যমাঝে

নীরবে একাকী আপন মহিমানিলয়ে।।

অনন্ত এ দেশকালে, অগণ্য এ দীপ্তলোকে,

তুমি আছ মোরে চাহি—আমি চাহি তোমা-পানে।

স্তব্ধ সর্ব কোলাহল, শান্তিমগ্ন চরাচর—

এক তুমি, তোমা-মাঝে আমি একা নির্ভয়ে।।

একবার, দু’বার, বার বার আমি গানই গাহিলাম। সুর ধ্বনি-প্রতিধ্বনি হইয়া ভাসিয়া চলিল। আজ আমি বড় এক শ্রোতা পাইয়াছি। ‘দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে—। আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।।’

এক সময় হঠাৎ আমি চমকিত হইলাম। পাখীর কুজনে বনভূমি মুখর হইল। চন্দ্র তাহার মায়া অঞ্চল গুটাইয়া লইয়াছে। কাঞ্চনজঙ্ঘার রজতমুকুট ক্রমে স্বর্ণমুকুটে পরিণত হইতেছে। রাত্রি বিদায় লইল। কোনও বন্য প্রাণী আমাকে আক্রমণ করে নাই। পরপারে তাহারা আসিয়াছিল। জলপান করিয়া চলিয়া গিয়াছে।

আমি উঠিলাম। পথ চিনিয়া আমাকে বাংলোয় ফিরিতে হইবে। যতদূর স্মরণে আছে, সোজাই আসিয়াছিলাম। সেইভাবেই ফিরিতেছিলাম। অরণ্যে পথ হারানো অতি সহজ ব্যাপার। অনেকক্ষণ আসিবার পর রাস্তায় উঠিলাম। কিছুক্ষণ হাঁটিবার পর, একটি গাড়ির শব্দ পাইলাম। পিছন দিক হইতে আসিতেছে। পথ দিবার জন্য এক পার্শ্বে সরিয়া গেলাম। জিপ গাড়িটা দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই, আরোহীরা সমস্বরে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, ‘ওই যে, ওই যে যাচ্ছে!’

গাড়িটা আমার পার্শ্বে আসিয়া ক্যাঁচ করিয়া থামিল। আরোহীরা সকলেই লাফ মারিয়া নামিলেন। কনজারভেটার সাহেব, অরুণা, বড়দি, রাতের সেই গায়ক, একজন ফরেস্ট গার্ড। কাহারও মুখে কোনও কথা নাই। কয়েক হস্ত ব্যবধানে দাঁড়াইয়া স্থির দৃষ্টিতে তাঁহারা আমাকে দেখিতেছেন। আমিও দেখিতেছি। হঠাৎ অরুণা চিৎকার করিয়া বলিল, ‘আপনাকে মারা উচিত। অসভ্য স্বার্থপর!’ বলিয়াই, সে ফুপাইয়া কাঁদিয়া ফেলিল। কনজারভেটার সাহেব পাইপ চাপিয়া বলিলেন, ‘কোথায় কাটালে সারারাত? আমরা তোমার বাংলোতে সারারাত ছিলুম। ফরেস্ট গার্ডরা গোটা জঙ্গল বারে বারে খুঁজে এল। ছিলে কোথায়!’

বড়দি বলিলেন, ‘তোমার মাথায় কী আছে?’

অরুণা জলভরা বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকাইয়া আছে। দীর্ঘ আঁখিপল্লব জলসিক্ত। আমি কোনও উত্তর দিতে পারিতেছি না। যাহা করিয়াছি তাহা এমনি ব্যক্তিগত যে সেই আবেগ বুঝিবার ক্ষমতা এঁদের নাই। অন্যরকম ভাবিবেন।

গায়ক ফরেস্ট অফিসার সহসা বলিলেন, ‘মনে হয়, মাথায় একটু ছিট আছে।’

সাহেব তাঁহার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘তোমার বুঝি তাই মনে হচ্ছে !’

ভদ্রলোক থতমত হইয়া গেলেন। পাণ্ডর মুখে সকলের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাইয়া বলিলেন, ‘আমি তাহলে যাই।’

সাহেব বলিলেন, ‘অবশ্যই! তোমার তো অফিস আছে!’

তিনি বলিলেন, ‘আমার কর্তব্য আমি করে গেলুম।’

‘যে কোনও শিক্ষিত মানুষের তাই তো করা উচিত ঘোষাল। তোমার সার্ভিস বুকে এ-কথা আমি লিখব।’

‘একটা কথা সার, অরুণা সারারাত জেগে আছে, এইবার একটু বিশ্রাম না নিলে ওর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যাবে!

‘তুমি বলছ?’

‘দেখছেন না, কী রকম ইমোশনালি আপসেট।’

‘তুমি বুঝি ইমোশন পছন্দ করো না! জানোয়ারেরও ইমোশন আছে।’

ভদ্রলোক নির্বাক হইয়া হাঁটিতে লাগিলেন। সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকিয়া হাঁটিতেছেন। দৃশ্যাটি আমাকে আহত করিল। যে ফুল আমি তুলিব ভাবিয়াছিলাম, সেই ফুল অন্য কেহ তুলিয়া লইলে কেমন লাগিবে! অরুণার প্রতি ভদ্রলোকের আসক্তি জন্মিয়াছিল। প্রেম ক্রমশই দানা বাঁধিতেছিল। আমি কী করিব! রমণীর মন বোঝে কাহার সাধ্য। ঈশ্বরও হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন।

সাহেব ইশারায় জানাইলেন, অবিলম্বে গাড়িতে উঠিয়া পড়ো। তোমার অতিশয় বাঁদরামিতে আমরা অতিষ্ঠ বোধ করিতেছি। গাড়ি তিনিই চালাইতেছিলেন। আমি তাঁহার পার্শ্বে উপবেশন করিলাম। দুই কন্যা পিছনের আসনে। অরুণা পিতার পশ্চাতে, বড়দি আমার পিছনে। তাঁহার বামহস্ত আমার স্বন্ধে স্থাপন করিয়াছেন। সেই হাত হইতে আমার প্রতি তাঁহার অসীম স্নেহ ঝরিয়া পড়িতেছে। গাড়ি স্বগর্জনে বনানীর পথ চিরিয়া চলিতেছে। রাত্রি যেমন সুন্দর, প্রভাতও সেইরূপ সুন্দর। সদ্যোজাত একটি দিবস মহা হর্ষে কালের দোলনায় আলো-ছায়ার পোশাক পরিয়া দোল খাইতেছে।

বড়দি আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিস ফিস করিয়া প্রশ্ন করিলেন, ‘কী হয়েছিল কাল রাতে!’

আমি কী বলিব বুঝিতে না পারিয়া নীরব রহিলাম।

অরুণা কিঞ্চিৎ ব্যঙ্গের গলায় বলিল, ‘কী আর হবে, নেশা ভাঙ করে পড়েছিল কোথায়। বরাতে বাঘের পেটে যাওয়া লেখা আছে, কে ঠেকাবে!’

বড়দি বলিলেন, ‘তুই বডড রেগে আছিস।’

অরুণা বলিল, ‘রাগব না! সারাটা রাত আমরা জেগে বসে রইলুম। মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাওয়ার অবস্থা। প্রথমে ভাবলুম, বাবু সিগারেট খেতে গেছেন। ধোঁয়া ছেড়ে আসছেন। ও বাবা, এগারোটা বাজল, বারোটা বাজল। রাত কাবার।

বড়দি বলিলেন, ‘ভূতে ধরেছিল।’

তবু আমি কিছু বলিলাম না। বোবার শত্রু নাই। আমার একান্ত ব্যাপার। আমি গোপনেই রাখিব। আমার মস্তকের প্রকোষ্ঠে কিছু দুষ্ট বুদ্ধি আছে। ছাত্রাবস্থায় সেই বুদ্ধির জ্বালায় শিক্ষকমহাশয়রা অতিষ্ঠ হইতেন। সেই বুদ্ধির প্রকাশ ঘটিল। মনে হইল, একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতে এই দুই কন্যার প্রশ্নের উত্তর আছে। অকস্মাৎ সেই গানটি ধরিলাম :

কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে,

তখন তুমি ছিলে না মোর সনে ॥

যে কথাটি বলব তোমায় ব’লে কাটল জীবন নীরব চোখের জলে

সে কথাটি সুরের হোমানলে উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে—

তখন তুমি ছিলে না মোর সনে ॥

ভেবেছিলেম আজকে সকাল হলে

সেই কথাটি তোমায় যাব বলে।

ফুলের উদাস সুবাস বেড়ায় ঘুরে পাখির গানে আকাশ গেল পূরে,

সেই কথাটি লাগল না সেই সুরে যতই প্রয়াস করি পরানপণে

যখন তুমি আছ আমার সনে ॥

গানটি শেষ হওয়া মাত্র অরুণা বলিল, ‘নির্লজ্জ এখনও গান গাইছে। গলায় এখনও গান আসছে।’

বড়দি বলিলেন, ‘ছেলেটা সত্যিই ভাল গায়। কাঠের কারবার না করে শুধু গান নিয়ে থাকলেই তো পারো!’

সাহেব বলিলেন, ‘প্রোফেশনাল হয়ে গেলে গানে এই আবেগ আর থাকবে না।’

বাংলোর সামনে গাড়ি থামিল। নুড়ি বিছানো পথে নামিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর হইতে মা ছুটিয়া আসিলেন। আমার দিকে নীরবে তাকাইয়া রহিলেন। সেই দৃষ্টিতে স্নেহ, অভিমান, ক্রোধ সব মিশিয়া রহিয়াছে। এই পরিবারের সমস্ত মানুষ কোন ধাতুতে নির্মিত আমি বলিতে পারিব না। যে-কালে মাতা সন্তানকে হত্যা করিতেছে, স্বামী স্ত্রীকে পুড়াইয়া মারিতেছে, স্ত্রী পরপুরুষের প্রতি আসক্ত হইয়া স্বামীকে আর্সেনিক খাওয়াইয়া মারিতেছে, সর্বত্রই রক্তারক্তি কাণ্ড, সেই কালে অনাত্মীয় একটি ছেলের প্রতি এমন অকৃত্রিম ভালবাসা কেমন করিয়া আসিতেছে। সিদ্ধান্ত তাহা হইলে এই হইল, যে ভালবাসিবে সে ভালবাসিবেই। তাহার প্রকৃতিই এইরূপ। জল যেমন তরল, লৌহ যেমন কঠিন, কর্দম যেমন পিচ্ছিল, লঙ্কা যেমন কটু, আম্র যেমন মিষ্ট।

আমি তাঁহার পদ স্পর্শ করিয়া প্রণাম করিলাম। তিনি মুখ ফিরাইয়া বলিলেন, ‘যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলব না। তুমি আমাদের কথা ভাবো না! আমরা তোমার পর।’ তিনি দ্রুত ভিতরে চলিয়া গেলেন। আমি তাঁহাকে অনুসরণ করিয়া, একেবারে রন্ধনশালায় গিয়া পৌঁছাইলাম। সব সৌজন্য দূরে রাখিয়া, পশ্চাৎ হইতে তাঁহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিলাম, ‘মা, আমার ভুল হয়ে গেছে।’

সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার রাগ জল হইয়া গেল। চুল খামচাইয়া ধরিয়া মাথা ঝাঁকাইতে ঝাঁকাইতে বলিলেন, ‘এই জঙ্গলে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। কলকাতার ছেলে, জঙ্গলের তুই কী জানিস!’

ছোলার ডালের ধোঁকা ভাজা হইতেছিল। আমার মুখে একটি সাঁদ করাইয়া দিলেন। কেন জানি না, সেই মুহুর্তে কী কারণে মনে হইল, যাহাদের গেঁটে বাত আছে, তাহাদের কুমিরে ধরিয়া চর্বণ করিলে, এক সময় মরিয়া যাইবে ঠিকই; কিন্তু বড় আরামেই মরিবে।

দুই

দশটি শালিক একত্রে কচমরচর করিতেছিল। একটি বৃক্ষের শিকড়ে উপবেশন করিয়া তাহাই দেখিতেছিলাম। আর কিয়ৎক্ষণ পরেই নিলাম শুরু হইবে। বৃক্ষের ফাঁক দিয়া বনবিভাগের কার্যালয় দেখিতে পাইতেছি। উজ্জ্বল হলুদ রঙে রঞ্জিত। অনেকগুলি জিপ আসিয়াছে। নিলামে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হইবে। আমার কৌশল সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি প্রথম দিকে দর হাঁকি না। ধৈর্য ধরিয়া থাকি। যে সর্বোচ্চ ডাক ডাকিল, আপাত দৃষ্টিতে মনে হইল নিলাম শেষ, ঠিক তখনই পাঁচ হাজার চড়াইয়া দিয়া মুচকি মুচকি হাসিতে থাকি। দেখিয়াছি, শেষ হইতে আবার শুরু করিতে সকলেই ক্লান্তি অনুভব করেন।

বসিয়া বসিয়া শালিকের অনুরাগ, বিরাগের খেলা দেখিতেছি আর অরুণার কথা ভাবিতেছি। ভালবাসার কী অপূর্ব অনুভূতি। মানুষকে কেমন যেন হনুমানের মতো করিয়া দেয়। অরণ্যে বিচরণ করিতে করিতে দেখিয়াছি, বেলা শেযে, উচ্চ বৃক্ষশাখে বসিয়া আছে উদাস হনুমান। বাঙলার পাঁচের মতো মুখটি অনিশ্চিতের দিকে তুলিয়া। কলা-মুলার ভাবনা দূরে ফেলিয়া, দীর্ঘ লাঙ্গুলটিকে রজ্জুর মতো নিম্নে ঝুলাইয়া দিয়া সীতার কথা ভাবিতেছে। ভালবাসা বহুপ্রকার, সন্তানের মাতার প্রতি ভালবাসা,কন্যার পিতার প্রতি ভালবাসা, স্বামীর স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা, জীবের ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা, প্রেমিকের প্রেমিকার প্রতি ভালবাসা। বৃষ্টির পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা, তটের প্রতি উর্মির ভালবাসা, গোমাতার গোবৎসের প্রতি ভালবাসা। তালিকাটি ক্রমশই বড় করিতে লাগিলাম। আমি তোমাকে ভালবাসি, এই সহজ অথচ ভয়ঙ্কর কথাটি আমি অরুণাকে কোনওদিনই বলিতে পারিব না। আমার লজ্জা করিবে। আমি এই অপ্রকাশিত ভাবটি লইয়া মরিয়া যাইব। তবে কাহারও তো জানা উচিত। আমি শিমুলকে বলিয়াছি, যাহার মূলে বসিয়া আছি। প্রেম, পবিত্র প্রেম এক প্রকার পূজাই। ওইদিকে ঝানু ব্যবসায়ীরা ব্যবসার কথায় মশগুল, আমি এইদিকে বসিয়া বসিয়া রবীন্দ্রগীত গুনগুন করিতেছি :

আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে।

তোমার ভাবনা তারার মাতা রাজে ॥

নিভৃত মনের ছায়াটি ঘিরে

না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে

আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রনীরে

অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥

পশ্চাৎ হইতে পৃষ্ঠে একটি হাত আসিয়া পড়িল। চমকাইয়া তাকাইলাম। সেই গায়ক ফরেস্ট অফিসার। আমার পানে তাকাইয়া আছেন সদ্য স্বামীহারা বিধবার দৃষ্টিতে। আকাশের যেমন ভাষা নাই, সেইরূপ ভাষাহীন চোখে তাকাইয়া আছেন। আমি সসম্মানে উঠিয়া দাঁড়াইলাম।

নিজের দু’হাতের মুঠায় আমার হাত দুটি ধরিয়া কহিলেন, ‘তুমি সুখী হও।’

আমি বলিলাম, ‘আমি তো সুখীই। আমার কোনও দুঃখ নেই।’

‘তুমি আরও সুখী হও। তোমার কাছে আমি হেরে গেছি।’

‘কোনও খেলা তো হচ্ছিল না। হার-জিতের কথা আসছে কী করে!’

‘আসছে বই কী, আমি যে অরুণাকে ভালবাসি। অরুণাকে পেতে চাই।’

‘পেতে যখন চান, তখন অবশ্যই পাবেন। অরুণার বাবাকে বলুন।’

‘বলা যায় না। তাঁর আন্ডারে আমি চাকরি করি।’

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘সে তুমি বুঝবে না। সার্ভিসে র‍্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল আছে। আমি সাবঅর্ডিনেট। জাতে ছোট।’

‘তাহলে অরুণাকে বলুন। সে তার বাবাকে বলবে।’

‘অরুণা আমাকে ভালবাসে না।’

‘তাহলে তো ঝামেলা মিটেই গেল।’

‘আমি চেষ্টা করছিলুম। আমার সেই চেষ্টাটা তুমি শেষ করে দিলে।’

‘আজ বাদে কাল আমি তো চলেই যাব ; তখন তো ফাঁকা মাঠ। গোল দিন।’

‘অরুণা তোমাকে ভালবেসেছে। তুমি যাবে কোথায় ! যেখানেই যাও তুমি এইখানেই থাকবে।’

‘শোনেননি, আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড!’

‘সে হলেও আমি আর অরুণাকে ভালবাসতে পারব না। তার পা স্লিপ করেছে, মনে কাদা লেগে গেছে। ক্যারেকটার নষ্ট হয়ে গেছে। পরপুরুষে আসক্ত হয়েছে। দ্বিচারিণী, ব্যভিচারিণী, বিশ্রী।’

‘ব্যাস, তাহলে তো মিটেই গেছে।’

‘আমার কষ্টটা তুমি বুঝেছ? তুমি ভিলেন।’

‘হিন্দি ছবির মতো আপনি আমাকে ঢিসুম ঢিসুম করে শেষ করে দিন। দিয়ে, নায়িকাকে নিয়ে প্রস্থান করুন।’

‘মুশকিল হল, নায়িকা যে ভিলেনকে ভালবেসে ফেলেছে।’

‘তাহলে আপনি ভিলেন হয়ে যান।’

‘সে আমি পারব না। আমার আলাদা মেক। আমি পরাজিত হব তবু ছোটলোক হতে পারব না। মেয়েরা খুব নিষ্ঠুর হয়। অরুণা খুব চালাক। আমার কত মাইনে অরুণা জানে। তোমার রোজগার আমার চেয়ে অনেক বেশি। তোমার চেহারা আমার চেয়ে অনেক ভাল। তা ছাড়া, তবলার সঙ্গে আমি গান গাই না, তাই তুমি যখন বাজাচ্ছিলে, আমার দু’চারবার তাল কেটেছে। সেটা লক্ষ করে অরুণা ভুরু কুঁচকেছে। আর তুমি ঠুংরিটা গেয়ে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা মারলে। যাকে বলে, লাস্ট নেল অন দি কফিন। তুমি সি সার্পে গান গাও। তারার পঞ্চমে অনায়াসে গলা চলে যায়। সেই জায়গায় আমি সি, তারার গান্ধার অবদি সহজে গলা যায়, মধ্যমে ঠেলেঠুলে তুলতে হয়। অরুণা আর কেন আমাকে ভালবাসবে। কেউ রাজভোগ ফেলে গুঁজিয়া খাবে ! বুঝতে পারছ ব্যাপারটা! অরুণার কোনও দোষ নেই, দোষ তোমার।’ আমার সহিত নাটকীয় কায়দায় করমর্দন করিয়া তিনি চলিয়া যাইতে গিয়াও থমকাইয়া দাঁড়াইয়া পড়িলেন ও অভিশাপ দিবার ভঙ্গিতে বলিলেন, ‘তুমি কী সুখী হবে ! হবে না, হতে পারবে না। এই আমার শেষ কথা।’ এইবার অরণ্যের পথ ধরিয়া তিনি সবেগে হাঁটিতে লাগিলেন।

আমি আবার শালিকের খেলা দেখিতে লাগিলাম। আমার আদৌ আনন্দ হইতেছে না, বিষণ্ণ বোধ করিতেছি অতিশয়। একবার মনে করিলাম, নিলামে যাইব না, পরক্ষণেই মনে হইল, এখানে আমি প্রেম করিতে আসি নাই, পিতার কার্যে আসিয়াছি। বর্তমানকে অবহেলা করিলে, ভবিষ্যৎ প্রতিশোধ লইতে দ্বিধা করিবে না। অশ্বের পশ্চাৎভাগ অতিশয় বিপজ্জনক। পশ্চাতে চাঁট ছুঁড়িলে বীরও কুপোকাত হইবে। সময় এক ধাবমান অশ্ব। পৃষ্ঠে চড়িয়া না থাকিলে ধ্বংস অনিবার্য। সময় এক ধাবমান অশ্ব। এই কথা আমাকে আমার পিতা শিখাইয়াছেন, যিনি অতি সামান্য অবস্থা হইতে তাঁহার ভাগ্য গড়িয়া তুলিয়াছেন। তাঁহার সহিত তুলনা করিলে আমি অপদার্থ। আমি গদিতে আরোহণ করিয়াছি যুবরাজের মতো।

ইত্যাদি চিন্তা করিবা মাত্র আমার আলস্য অন্তর্হিত হইল। বনবিভাগের কার্যালয়ের দিকে ছুটিলাম। সেখানে উপস্থিত হইয়া নতুন এক খবর শুনিলাম, আদেশ আসিয়াছে, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হইতেছে, নির্বিচারে বৃক্ষছেদনের কারণে ভূমিক্ষয় হইতেছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমিতেছে, পৃথিবীর উত্তাপ বাড়িতেছে, অতএব আপাতত সব বন্ধ। সরকার নতুন কিছু ভাবিতেছেন। পরে জানা যাবে। এই সংবাদে অনেকেই শঙ্কিত হইলেন। ব্যবসা কি তাহা হইলে লাটে উঠিবে! খাট, পালঙ্ক, চেয়ার, টেবিল, জানালা, দরজা কিসে নির্মিত হইবে! আমার কিন্তু আনন্দ হইল। কনজারভেটার সাহেব আমাকে বৃক্ষসম্পর্কে নতুনভাবে ভাবিতে শিখাইয়াছেন। বৃক্ষছেদনও এক হত্যা কাণ্ড। ব্যবসা বন্ধ হইলে হইবে। কী করা যাইবে!

আনন্দে নাচিতে নাচিতে নিজের বাংলোয় ফিরিয়া আসিলাম। অরুণা ও বড়দি বারান্দায় বসিয়া আছেন। অরুণা আমাকে দেখিয়া বলিল, ‘আমি আসিনি। বড়দি এসেছে। আমাকে সঙ্গে এনেছে।’

আমি বলিলাম, ‘আপনি এলে কোনও ক্ষতি হত কী!’

বড়দি হাসিলেন মাত্র। কোনও কথা বলিলেন না। দরজা খুলিয়া তাঁহাদের ভিতরে আসিতে বলিলাম। তাঁহারা প্রবেশ করিতে করিতে বলিলেন, ‘বেশ গোছগাছ করে রেখেছ তো!’

আমি যেখানেই যাই আমার সহিত একটি দোতারা থাকে। নির্জন রাতে সবাই যখন নিদ্রামগ্ন, সেই সুযোগে আমি দোতারাটি বাজাইতে বাজাইতে খানিক নৃত্য করিয়া লই। ইহাতে আমার মন ভাল থাকে। লালনের গান গাই। রবীন্দ্রনাথ কী সাধে তাঁহাকে পছন্দ করিতেন, দেখো রে দিন রজনী কোথা হইতে হয়। কোন পাকে দিন আসে ঘুরে, কোন পাকে রজনী যায়!

অরুণা সেই দোতারাটি দেখিয়া অতিশয় উল্লসিত হইল। প্রশ্ন করিল, কোথা হইতে পাইলাম! বীরভূম হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলাম। এক বাউল আমাকে বাজাইতে শিখাইয়াছিলেন। বৃক্ষ পরিবেষ্টিত অরণ্যের কোনও মুক্তাঞ্চল পাইলে, আমি দোতারা বাজাইয়া নাচিতে থাকি। ইহা শুনিয়া, অরুণা আনন্দে আটখানা হইয়া, আমার বক্ষদেশে একটি চাপড় মারিয়া, তাহার দিদির সম্মুখেই ঘোষণা করিল, ‘এই জন্যই আপনাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে।’

বড়দিদি একটি তীর পরীক্ষা করিতেছিলেন। তীরটি এক বৃক্ষের কাণ্ডে প্রোথিত ছিল। আমি উদ্ধার করিয়াছিলাম। মৃত্যুর দূত হইলেও কাব্যময়। বড়দিদি বলিলেন, ‘আবার ইচ্ছে কেন? এবার বেসেই ফেল না। ঝুলিয়া রেখে লাভ কী!’

এই কথা শুনিয়া অরুণা তাহার দিদির পরিবর্তে আমাকেই আর একটি চপেটাঘাত করিয়া বলিল, ‘অসভ্য!’ তাহার মুখমণ্ডলে আবীরের বর্ণ খেলা করিতেছে। অবদমিত হাস্যের উদ্ভাস। বড়দিদি যেন ছিপিবন্দুক, ফটাস ফটাস করিয়া কথা বলিতে পছন্দ করেন। অরুণার মতো আমারও যথেষ্ট লজ্জা হইল।

আমি বলিলাম, ‘তাহলে একটু চায়ের ব্যবস্থা করি।’

বড়দিদি বলিলেন, ‘আপাতত তাই করো, পরে মণ্ডামিঠাই পাওনা রইল।’

ঘরের সংলগ্ন একটি প্যানট্রিতে সব আয়োজনই আছে। একটা প্রাইমাস স্টোভ। কেটলি, কাপ ডিশ, চা, গুঁড়া দুধ, সবই আছে। আমি স্টোভটি ধরাইবা মাত্রই, ফঁ, ফস করিয়া ক্রোধী শব্দ করিতে লাগিল। বিস্ফোরণের আশঙ্কা সদাসর্বদাই ; কিন্তু মানুষ বিপদ লইয়া খেলা করিতে পছন্দ করে।

অরুণা আমাকে ঠেলিয়া ঠলিয়া চায়ের জল চাপাইবে, আমি কোনওমতেই তাহা করিতে দিব না। কারণ স্টোভ যদি ফাটিয়া যায়, তাহা হইলে আমি মরিব, অরুণাকে মরিতে দিব না। সে আমাকে সরাইবে, আমি তাহাকে আসিতে দিব না। ওই ঘরে বড়দিদি দোতারাটি লইয়া লাগ্গুমাগুম, লাগ্গুমাগুম করিতেছেন, যেন আমাদের সঙ্ঘর্ষের আবহসঙ্গীত। অরুণা, ধ্যাততেরিকা বলিল, আমি বলিলাম, মহাজ্বালা। তাহার পর কী হইতে কী হইল, জল এতদূর গড়াইল যে, চায়ের জল পড়িয়া রহিল, আমরা সরিতে সরিতে দেওয়ালের প্রান্তে আসিয়া অদ্ভুতভাবে জড়াইয়া যাইলাম। সর্ব শরীর কম্পিত হইতে লাগিল। জীবন্ত, উষ্ণ এক রমণী আমার বক্ষলগ্ন। তাহার শ্বাসপ্রশ্বাস আমার কষ্ঠকূপ স্পর্শ করিতেছে। আমি পাপ করিতেছি, আমি অতিশয় অন্যায় করিতেছি। কাষ্ঠপুত্তলিকার ন্যায় দণ্ডায়মান। বড়দি আসিয়া পড়িলে সর্বনাশ হইবে। প্রাইমাস স্টোভ বলিষ্ঠ দৈত্যের ন্যায় ফুসিতেছে। অরুণা মুখ তুলিয়া ডাগর নয়নে আমার পানে নায়িকার মতো তাকাইয়া আছে। ইহা কী সাগর, ইহা কী আকাশ, ইহা কী তুষার প্রান্তর, আমি বুঝিতে পারিতেছি না। কোথা হইতে রামায়ণের দুই চরণ শ্লোক মনের প্রকোষ্ঠে পক্ষ ঝাপটাইয়া উড়িতে লাগিল। শরবিদ্ধ ক্রৌঞ্চকে দেখিয়া বাল্মীকির কণ্ঠ হইতে যাহা অনায়াসে, অতিচকিতে নিঃসৃত হইয়াছিল :

মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।

যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমধব্বীঃ কামমোহিতম ॥

কেন মনে হইল এমন চরণ দুটি! আমি কামমোহিত ও এই মুহূর্তে শরবিদ্ধ।

অরুণা অতঃপর আমার বক্ষদেশে অঙ্গুলির টোকা মারিতে মারিতে বলিতে লাগিল, ‘কেন তুমি আমাকে চা করতে দেবে না! বলো, কেন দেবে না?

‘আরে বোকা স্টোভটি যদি ফেটে যায়?’

‘ফাটলে তো তুমি মরবে!’

‘আমি মরি মরব, তুমি মরলে আমি ডবল মরব।’

বড়দি চিৎকার করছেন, ‘চা কী দার্জিলিং থেকে আসবে!’

এই ঘটনার তিনদিন পরে কনজারভেটার সাহেব বাগানের কাজ করিতে করিতে আমাকে বলিলেন, ‘শুনেছ বোধহয়, আমার ছোট মেয়ে এক কাণ্ড করেছে।’

আমি মাটি হইতে কাঁকর বাছিতেছিলাম। মহাশঙ্কায় তাঁহার দিকে তাকাইয়া প্রশ্ন করিলাম, ‘কী করেছে?’

তিনি অক্লেশে বলিলেন, ‘প্রেম করেছে।’

আমি অধোবদন হইলাম।

তিনি পুনরায় বলিলেন, ‘প্রেমের পর কী, তোমার জানা আছে কি?’

আমি তিনবার আজ্ঞে, আজ্ঞে করিলাম।

তিনি বলিলেন, ‘বিবাহ যার সঙ্গে প্রেম হয়, তার সঙ্গে বিবাহ দিতে হয়। এটা জানো না?’

‘জানি আজ্ঞে।’

‘তাহলে চুপ করে আছ কেন?’

উত্তর করিতে পারিলাম না। পালাইতে ইচ্ছা করিতেছিল।

তিনি বলিলেন, ‘আমি কলকাতা যাব।’

আমি নিরুত্তর।

তিনি প্রশ্ন করিলেন, ‘কেন যাব?’

‘নিশ্চয়, বিশেষ কোনও কাজ আছে।’

‘বাঃ, ধরেছ ঠিক। বুদ্ধি আছে। কাজটা কী?

আমি নিরুত্তর।

তিনি বলিলেন, ‘থেকে থেকে বোবা হয়ে যাও কেন?’

এইবার আমি উঠিয়া এক দৌড় মারিলাম। তিনি হাহা করিয়া হাসিতে লাগিলেন। অ্যালসেসিয়ানটি খেলা ভাবিয়া আমাকে অনুসরণ করিয়া ছুটিতে লাগিল। তাহার সহিত আমার অতিশয় সখ্যতা জন্মিয়াছে। আমি যতই ছুটিতেছি, ততই আনন্দ হইতেছে। সদ্যোজাত গোবৎসের ন্যায় মনে হইতেছে।

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,

তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,

বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান ॥

আমার মতো করিয়া আমারই একটি উপলব্ধি না বলিয়া থাকিতে পারিতেছি না। তাহা হইল, ভূমির আকাশ-প্রেম বৃক্ষ হইয়া উর্ধ্বগামী হইতেছে প্রতিনিয়ত। আকাশকে ভালবাসে বলিয়াই পাখির পক্ষ নির্গত হয়। ফুলকে ভালবাসে বলিয়াই প্রজাপতি বহুবর্ণ। এই অরণ্যে আসিলে বোঝা যায়, এই পৃথিবী ভালবাসার। প্রেমের পৃথিবী।

ভালবাসি, ভালবাসি

এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজায় বাঁশি ॥

রাত্রি আসিল। নির্জন বনস্থলীতে দুম করিয়া বন্দুকের শব্দ হইল। আমরা আহার করিতেছিলাম। সকলেই সচকিত হইলাম। একালে শিকার নিষিদ্ধ হইয়াছে। তাহা হইলে কে কাহাকে গুলি করিল। কনভারভেটার সাহেব আহার পরিত্যাগ করিয়া উঠিয়া পড়িলেন। আমিও উঠিয়া পড়িলাম। জিপ গাড়ি বাহির হইল। হেডলাইট জ্বালাইয়া শব্দ যেদিক হইতে আসিয়াছে আমরা সেইদিকেই চলিলাম। বনবিভাগের কর্মীদের আবাসনস্থলের সম্মুখভাগে কয়েকজন দাঁড়াইয়া আছেন। আমরা নামিলাম। সেই গায়ক ফরেস্ট অফিসার নিজেকেই নিজে হত্যা করিয়াছেন।

তাঁহার ঘরের দরজা বন্ধ। খোলা বাতায়ন পথে অভ্যন্তর ভাগ দেখা যাইতেছে। খাইবার টেবিলে পরিবেশিত আহার্য সকল। উজ্জ্বল আলোকে কক্ষ উদ্ভাসিত। বেতারযন্ত্রটি চলিতেছে। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আলাপ হইতেছে দরবারী রাগে। ফরেস্ট অফিসারের দেহটি বামপার্শ্বে হেলিয়া আছে। শুভ্ৰপাঞ্জাবির দক্ষিণপার্শ্বে রক্তে ভিজিয়া গিয়াছে। এই আত্মহত্যার সাক্ষীস্বরূপ কক্ষের এক কোণে তানপুরাটি দণ্ডায়মান। আমরা স্তব্ধ বিস্ময়ে দাঁড়াইয়া রহিলাম।

রাত্রি যখন প্রায় শেষ হইতেছে তখন পুলিশ আসিল। ভদ্রলোক লিখিয়া গিয়াছেন, ‘আমি পাগল। আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন, তাই বিদায় নিচ্ছি পৃথিবী থেকে। এই দেহ দাহ না করে এই অরণ্যেরই কোথাও যেন সমাহিত করা হয়। আমার তানপুরাটি যেন পাশে থাকে। এই আমার শেষ ইচ্ছা। চির বিদায়।’

বনভূমিতে দীর্ঘকাল পরে একটি নাটক হইয়া গেল। আত্মীয়-স্বজনেরা আসিলেন। একটি মহুয়া বৃক্ষতলে তাঁহার অন্তিম ইচ্ছা মতো তাঁহাকে সমাহিত করা হইল। অরুণা কয়েক দিবস গুম মারিয়া রহিল। সে যে কাহারও মৃত্যুর কারণ হইতে পারে এমন ধারণা তাহার ছিল না। আমি আমার মনের খাতায় লিখিলাম, সাগরকে ভালবাসিলে সকল নদীরই মৃত্যু হইবে। আগুনকে আলিঙ্গন করিতে চাহিলে পতঙ্গকে দগ্ধ হইয়া মরিতেই হইবে। রবীন্দ্রনাথ কী সর্বজ্ঞ ছিলেন। তাই কী লিখিলেন

হৃদয় দিতে চেয়ে ভেঙো না হৃদয়

রেখো না লুব্ধ করে, মরণের বাঁশিতে মুগ্ধ করে

টেনে নিয়ে যেয়ো না সর্বনাশায় ॥

আমার ফিরিবার দিন আসিয়া গেল। কনজারভেটার সাহেব বলিলেন, আমার সহিত তিনিও যাইবেন। কলিকাতার নিমতলা অঞ্চলে আমার পিতা অতিশয় সুখ্যাত ব্যক্তি। যোগেনদা বলিলে সকলেই এক বাক্যে চিনিবেন। প্রবীণ হইয়াছেন যথেষ্ট ; কিন্তু জনহিতকর কার্যে তাঁহার ক্লান্তি নাই। অর্থ উপার্জন করেন, পরার্থে অকাতরে ব্যয় করেন। যৌবনে দেহচর্চা করিয়াছেন, দাঙ্গার সময় মুক্ত তরবারি লইয়া স্বজাতির প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন। পরিপূর্ণ একটি জীবনের অধিকারী। একটি বৃহৎ দুঃখ পাইয়াছিলেন আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অকাল মৃত্যুতে। তিনি আমার পিতার চরিত্রের সমস্ত গুণই পাইয়াছিলেন। বলা যাইতে পারে দ্বিতীয় যোগেন। যেমন সাহসী, তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। কৃতী ছাত্র ছিলেন। পথ দুর্ঘটনায় তাঁহার জীবনদীপ এক ফুৎকারে নিবাপিত হইল। সেই নিদারুণ আঘাত আমার মাতা আজও সামলাইতে পারেন নাই। মাত্র সাতদিন পরে আমার দাদার বিবাহ হইবার কথা। পরিবার সেই আয়োজনে মাতিয়া ছিল। এমন সময় সংবাদ আসিল। আমরা হাসপাতালে ছুটিলাম। বধূবরণ না করিয়া মৃত্যুকে বরণ করিয়া আনিলাম। আমার মাতা জানাইলেন, আমার বিবাহের কথা কখনও উত্থাপন করিবেন না। যতদিন তিনি জীবিত থাকিবেন, গৃহে বিবাহের কোনও অনুষ্ঠান হইবে না।

সেদিন অপরাহ্ন বেলায় কনজারভেটার সাহেব আমাদের গৃহে উপস্থিত হইলেন। আমার পিতা মানুষকে অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য সুখ্যাত। আন্তরিকতায় শত্রুকেও মিত্র করিতে পারেন নিমেষে। এক্ষেত্রে তাহাই হইল, বরং অধিক হইল। সাহেব এমতো অভিভূত হইলেন, যে পদমর্যাদা বিস্মৃত হইয়া পদধূলি গ্রহণ করিতে উদ্যত হইলেন। পিতা তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে বক্ষে আলিঙ্গন করিলেন। সেই অবস্থায় সাহেব বলিলেন, ‘আজ থেকে আমরা বেয়াই হলুম।’ পিতা বলিলেন, ‘কী সৌভাগ্য!’

আমাদের গৃহটি অতিশয় আকর্ষণীয়। বৈভব আমাদের পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় নাই। আমার মাতা মা লক্ষ্মীকে ধরিয়া রাখিয়াছেন। পিতার সেবা ও কর্মযোগ বেদি রচনা করিয়াছে। কনজারভেটার সাহেব মুগ্ধ হইয়া দেখিতেছেন। দেখিতেছেন, তাঁহার কন্যার আবাসস্থলটি উত্তম। আমার মাতার প্রতিজ্ঞার সহিত একটি রফা হইল। তাঁহার আপত্তির কোনও কারণ নাই, কারণ বিবাহ হইবে উত্তরবঙ্গে। এই গৃহ হইতে হইবে না।

এই সময় আমার মনে হইল, আমার ফাঁড়া কাটিয়া গিয়াছে। দাদার মতো আমাকে অপঘাতে মরিতে হইবে না ; কারণ আমার জন্য একজন প্রাণ দিয়াছেন। সেই কথাটি আমি বলিতে পারিলাম না। পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি মনে ঘুরপাক খাইয়া গেল, ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ তুমি হে আমার প্রাণে, /মন যে কেমন করে মনে মনে তাহা মনই জানে ॥’

চাপা একটি উৎসবের পরিবেশ চেষ্টা সত্ত্বেও রোধ করা গেল না। গিল্টি করা ফ্রেমে দাদার বৃহৎ চিত্রখানি দেয়ালে প্রলম্বিত। ঠোঁটের কোণে অমলিন মৃত্যুঞ্জয়ী হাসিখানি। আয়ত দুইটি চক্ষু। রাত যত বাড়িতে থাকে ছবিখানি ততই জীবন্ত হইতে থাকে। আমার দিকে তাকাইয়া দাদা যেন বলিতে থাকে, আমার যতটুকু ছিল ততটুকুই ভোগ করিয়াছি। জীবনের দিন মুদ্রার মতো, সঙ্গে যাহা আনিয়াছিলাম তাহা খরচ করিয়াছি। ইহাই আমাদের নিয়তি। দুঃখ করিও না। জীবন তোমাকে যাহা দিতেছে তাহা গ্রহণ করো। গ্রহণ করিবার সময় স্মরণে রাখিও, গ্রহণ থাকিলে, বর্জন থাকিবেও। মনের দুয়ার উন্মুক্ত রাখিও।

সাহেব একটি বাংলো আমাদের জন্য ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। আরণ্যক পরিবেশে আমার মাতা অতিশয় মুগ্ধ হইলেন। বলিলেন, সুযোগ পাইলে এই স্থলে আসিয়া থাকিবেন। বিবাহের রাত্রে অরুণাদের গৃহটি আলোকমালায় সজ্জিত হইয়াছিল। পুষ্পের অপ্রাচুর্য ছিল না। চারিপার্শ্বে নিস্তব্ধ অরণ্য। বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ। তাহারই অন্তরালে আলোকের শোভা। শুষ্ক আবহাওয়া। অল্প শীতল বাতাস। পুষ্পের সুগন্ধ। লগ্ন পড়িয়াছিল অধিক রাত্রে। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতার বিবাহে পরিধান করিবেন বলিয়া পিতা একটি মুগার পাঞ্জাবি করাইয়াছিলেন। সেই পাঞ্জাবিটি পরিয়াছেন। তাঁহাকে সুন্দর দেখাইতেছে। মুখের ভাব দেখিয়া অনুমান করিতে পারিতেছি, হর্ষের মাঝেও বিষাদের ছায়া। স্মৃতি সহজে মুছিবার নহে। আমার মাতা অলক্ষে রোদন করিয়াছেন। আমি তাহা জানি।

শঙ্খের শব্দ ও উলুধ্বনিতে বনস্থলী কম্পিত হইল। যে কয়েকজন নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন ও আত্মীয় পরিজনদের হই হট্টগোল একসময় শান্ত হইল। আমার পিতা ও শ্বশুরমহাশয় জোট বাঁধিয়াছেন। আমার মাতাকে আমার শ্বশ্রুমাতা জড়াইয়া ধরিয়া অন্তঃপুরে প্রস্থান করিলেন। মেজদি আমাকে কটুকথা বলিয়া অদৃশ্য হইয়াছেন। বড়দি আমার কর্ণমর্দন করিয়া বলিলেন, ‘এই তোমার পুরস্কার। আমি একটু শোবার জায়গা খুঁজি এইবার।’ তিনিও চলিয়া গেলেন। আমি আর অরুণা বাসর জাগিতেছি।

এই সেই কক্ষ। সেই রাত্রে এই কক্ষেই সঙ্গীতের আসর বসিয়াছিল। আমি তবলা বাজাইতেছিলাম। তিনি গান গাহিতেছিলেন। আমি বাদ্যে তাঁহাকে হারাইতে চাহিয়াছিলাম, তিনি আমাকে হারাইয়া দিলেন। কক্ষের তিনটি গবাক্ষ উন্মুক্ত। একটি অরণ্যের দিকে। উৎসব মরিয়া গিয়াছে। ভারী নিদ্রা প্রায় সকলের উপরেই চাপিয়া বসিয়াছে। বাতাস বৃক্ষপত্র লইয়া খেলা করিতেছে। পেঁচকের কর্কশ চিৎকার। অরণ্যের দিকের গবাঙ্গে যতবার দৃষ্টি পড়িতেছে, মনে হইতেছে পরিচিত একটি মুখ সরিয়া গেল। যতবার তাকাইলাম ততবারই এক দর্শন। একটি মুখের ঝটিতি তিরোধন।

আমার ভয় নাই, তবু আমি ভীত হইলাম। ভাবিলাম, তবে কী তিনি মরেন নাই। অথবা সমাধি হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন। নিমন্ত্রিতদেরই একজন। উপবাসক্লান্ত দেহে অরুণা ঢুলিতেছিল। আমি ভয় পাইয়া তাহাকে জড়াইয়া ধরিতেই খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। শরীর আকিয়া বাঁকিয়া গেল। দুই হস্তদ্বারা আমাকে দূরে সরাইবার চেষ্টা করিতে করিতে বলিল, ‘সুড়সুড়ি লাগে সুড়সুড়ি।’

আমার ভূতের ভয় চলিয়া গেল। মহা ফাঁপরে পড়িয়া গেলাম! মহা লজ্জা। কেহই হয়তো ছুটিয়া আসিবেন না; কিন্তু ভাবিবেন, ছেলেটি ইতর, অসংযমী। বিবাহের রাত্রেই স্ত্রীকে সম্ভোগ করিতে চাহিতেছে। একেই আমি অপরাধ বোধে ভুগিতেছি, গবাক্ষে মৃত ব্যক্তির মুখ একবার নহে, বারে বারে দেখিয়াছি, তাহার উপর এই লজ্জার বোধ। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে একটি চুম্বন করিয়াছিলাম, তখন কাতুকুতু বোধ করে নাই।

রাগ হইল। কক্ষ ত্যাগ করিলাম। বাসরে আমার প্রয়োজন নাই। ভোরের আলো ফুটিতেছে। উৎসবের রাত বিদায় লইল। মালাগুলি শুকাইতে আরম্ভ করিয়াছে। কোথাও একটি দাঁড়কাক তাহার লৌহ চঞ্চুতে কর্কশ শব্দ তুলিয়া রাত্রিকে বহিষ্কারের আদেশ দিতেছে। আলোগুলি ম্লান হইয়া গিয়াছে।।

আমি বাহিরে আসিয়া আমার বরের বেশেই হাঁটিতে লাগিলাম। কে যেন আমাকে টানিতেছে। চলিতে চলিতে আমি সেই স্থলে আসিলাম। যেখানে একটি মহুয়া বৃক্ষের তলে এক ব্যর্থ প্রেমিক চিরনিদ্রায় শায়িত। কিন্তু, কী দেখিতেছি! এক রমণী সেই সমাধির বেদিতে একটি পুষ্পস্তবক রাখিয়া ভোরের আলোয় ভৈরবী রাগিনীর মতো স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন।

সন্নিকটে গেলাম। দেখিলাম, বড়দি। আমাকে দেখিয়া লজ্জা পাইলেন। দুই চক্ষে অশ্রু টলটল করিতেছে। সেই দৃশ্যে আমিও অশ্রু সম্বরণ করিতে পারিলাম না। দুঃখ লজ্জার ব্যবধান দূর করিয়া দিল। তিনি আমার হাত চাপিয়া ধরিলেন। সংযত হইয়া বলিলেন, ‘কথা দাও, যা দেখলে তা কাউকে বলবে না!’

‘কথা দিলুম।’ রুদ্ধ আমার কণ্ঠস্বর।

‘এই ছেলেটিকে আমিই ভালবেসেছিলুম। অরুণার কথা ভেবে স্পষ্ট করে বলতে পারিনি। তা ছাড়া বয়সে আমি কিছু বড়। যদি বলতে পারতুম, মানুষটাকে এইভাবে মরতে হত না। মানুষটা ভারী প্রেমিক ছিল। এটা আমার গোপন কথা। শুধু তুমিই জানলে। তুমি চলে যাও। আমি পরে আসছি।’

বনপথ ধরিয়া ফিরিয়া আসিলাম হৃদয়ে একটি রত্ন লইয়া, তাহার নাম প্রেম। বড়দির আপাত রুক্ষতা, পুরুষ বিদ্বেষ, অর্জিত জ্ঞান ও মনোবিদ্যার অন্তরালে একটি হৃদয় আছে। সে হৃদয় হীরকনির্মিত। কেহ জানে না। আমি জানি। তিনি ভোরের ভৈরবী।

আমি অতীতে গিয়াছিলাম। বর্তমানে ফিরিয়া আসি। আমার অরণ্যদেব শ্বশুরমহাশয় অবসর গ্রহণের পর লবণহ্রদে বড়লোকি করিতে গিয়া বিপাকে পড়িয়াছিলেন। অবশেষে গ্রামের পূর্বে বন দেখিয়া বনগ্রামে আসিয়া স্থিত হইয়াছেন। ইছামতীর পরপারেই সুন্দরবন। ব্যাঘ্ৰ থাকিলেও থাকিতে পারে। অরণ্যদেব স্মৃতি রোমন্থন করিয়া বাঁচিতে পছন্দ করেন না। প্রতি মুহূর্তে স্মৃতি রচনা করিতে চাহেন। আমার পিতৃদেব পরলোকে। অরণ্যদেবই এখন আমার আদর্শ ও আশ্রয়।

সমস্ত সংবাদপত্র একটানে একপাশে ফেলিয়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এইবার শুরু হইবে তাঁহার মজদুরি। এমন দিলখোলা, পরিশ্রমী মানুষ আমি কমই দেখিয়াছি। ভিতর হইতে বড়দি ডাকিলেন, ‘মহিষাসুর।’ কচুরি পরিপাকের জন্য আমার ব্যবস্থাও তিনি করিয়া রাখিয়াছেন।

চেয়ারের উপর টুল চড়াইলাম, তাহার উপর টলবল, টলবল করিতে করিতে দাঁড়াইলাম। টুলের পায়া দুটি বড়দি ধরিয়া আছেন, পাছে পড়িয়া যাই। সম্মুখের র্যাকে অনন্ত পুস্তকরাশি। সবই মনস্তত্ত্ব। মানুষের মনের খবরে ঠাসা।

সেই টুলের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় আমি দুহাত তুলিয়া রবীন্দ্রনাথেরই একটি গান ধরিলাম:

মনের মধ্যে নিরবধি শিকল গড়ার কারখানা।

একটা বাঁধন কাটে যদি বেড়ে ওঠে চারখানা ॥

এতক্ষণে অরুণার কণ্ঠস্বর পাইলাম, ‘খেপা খেপেছে।’ তাহার কাতুকুতু রোগ সারাইতে আমাকে যথেষ্ট কসরত করিতে হইয়াছিল। সোহাগ করিয়া অঙ্গ স্পর্শ করিলেই খিল খিল। কক্ষ পার্শ্বেই পিতা-মাতার অবস্থান। গভীর ক্ষোভে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তাহা হইলে বিবাহ করিয়া আমার এই হইল, সারা জীবন পাশবালিশ আলিঙ্গন করিয়াই আমাকে কাটাইতে হইবে। অদ্ভুত পরামর্শ দিয়াছিল, চোরেরা স্প্রে করিয়া গৃহস্থদের ঘুম পাড়াইয়া সর্বস্ব হরণ করে। আমি যেন তাহাই করি।

এই টুলে দাঁড়াইয়া সানন্দে সংবাদ দিতেছি, অরুণা মা হইবে। আজ তাহার সাধ ভক্ষণ।

বড়দি সাবধান করিলেন, ‘পড়ে মোরো না।’

আমি বলিলাম, ‘আই লাভ ইউ।’ আমার হস্তে এরিক ফ্রোমের একটি বই, দি আর্ট অফ লাভিং।

বড়দি বলিলেন, ‘মারব এক চড়।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *