আমার বিয়ে

আমার বিয়ে

ঠিক যেমনটি চেয়েছিলুম। উচ্চতা, পাঁচফুট তিন ইঞ্চি। ফর্সা রঙ। সুশ্রী। ছিপপিছে। এম, এ পাঠরতা। পিতা সরকারের উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত। যোগাযোগের জন্যে বক্স নম্বর দেওয়া আছে। বয়েস তিরিশ। আমার বয়েস পঁয়ত্রিশ। আমার উচ্চতা, পাঁচ চার। আমার গায়ের রঙ মেটে ফর্সা। আমি এম. এ। ভূতের মতো নিঃসঙ্গ। আপনজন কেউ কোথাও নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন দু-এক ঘর আছে। তারা তাদের প্রয়োজনে আসে। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলেই চম্পট দেয়। তিরিশটা বছর ধরে আমি স্ট্রাগল করে, জীবনের এই পঁয়ত্রিশ বছরে একটা জায়গায় এসে স্থিত হয়েছি। পাকা চাকরি। মাইনে নেহাত খারাপ নয়। ছোট একটা ফ্ল্যাট হয়েছে। রোগজ্বালা তেমন কিছু নেই। মনটা মাঝেমাঝে খারাপ হয়। হুহু করে পাম্প দেওয়া কেরোসিন স্টোভের মতো। প্রথমে ভেবেছিলুম সংসার-টংসার করব না। সংসার মানেই বন্ধন। সংসার মানেই বোঝা। খাবদাব, বেড়িয়ে বেড়াব। দেখলুম, তাতে খরচ অনেক বেশি। বাইরে খেতে গেলে প্রচুর খরচ। থেকে থেকে পেটের অসুখ। লোকে সাহায্য চায়, চাঁদা চায় পাগল করে মারে। রাতে একলা বিছানায় ঘুম আসে না, ভয় ভয় করে। আমার আবার ভূতের ভয় আছে। গা ছমছম করে। মনে হয় মাথার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। পিঠে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। কানের কাছে ঠাণ্ডা নিঃশ্বাস ফেলছে। মনে হয় ফ্রিজের দরজা খুলে গেছে। এখন আমার একটা বিয়ে করা উচিত। কচি খুকি বউ নয়। বেশ বড়সড় একটা কমলালেবু রঙের বউ। গায়ের রঙ নয় শাড়ির রঙ। ঘরের ছিরিটাই ফিরে যাবে। মেয়েলি জিনিস। মেয়ে মেয়ে গন্ধ। এখানে ওখানে বড় বড় চুল। তার অন্তর্বাস। বিছানায় একটার জায়গায় দুটো বালিশ। টেবিলে জেন্টস ঘড়ির পাশে একটা লেডিজ ঘড়ি। চুড়ির শব্দ। কিছুটা বাস্তব, কিছুটা স্বপ্ন। জীবনের অন্য এক মানে।

বিজ্ঞাপনটাকে আন্ডারলাইন করলুম। এই আমার বউ। নাম নিশ্চয় অর্পিতা। অর্পিতা নামের একটা মেয়ের সঙ্গে আমার একটু প্রেম মতো হয়েছিল ছাত্রজীবনে। সামলাতে পারিনি। যারা আমার চেয়ে পকেট খরচের টাকা বেশি পেত, তারা আমাকে ল্যাং মেরে দিল। একটা মেয়েকে প্রেমের সরোবর থেকে খেলিয়ে তোলা কী সহজ কাজ রে বাবা! ওর চেয়ে ফুটবল খেলা অনেক সহজ। বিয়ে করা তো একেবারেই ইজি ব্যাপার। একটা টোপর মাথায় দিয়ে গোধুলি লগ্নে পিড়েতে গিয়ে বোস, ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে গরম গরম একটা মেয়ের মালিক। অর্পিতাকে আমার ভীষণ ভাল লেগেছিল। সুন্দর বড় বড় চোখ। ফুরফুরে তিন চারটে প্রেমপত্র লিখেছিল। আমার ভালবাসাকে এমনভাবে উস্কে দিয়েছিল যে, সেই সময় আমি এক খাতা ভয়ঙ্কর উদ্বেল কবিতা লিখে ফেলেছিলুম। ছন্দ না থাকলেও গভীর আবেগ ছিল। এত গাছ ছিল যে একটা জঙ্গল হয়ে যেত। এত ফুল ছিল যে তিরিশটা নার্সারি হয়ে যেত। ঘুড়ি আর মেয়ে বেশিক্ষণ হাতে ধরে রাখা যায় না। ছেলেবেলায় দেখেছি, একটা ঘুড়ি কেটে এসেছে, ধরেছি, পেছন থেকে তিনজন লাফিয়ে এসে খামচাখামচি। হয় কেড়ে নেবে, না হয় ছিঁড়ে দেবে। আমাদের সঙ্গে কিছু ব্যবসাদারের ছেলে পড়ত। বড়দা টাইপের। পকেটে অনেক পয়সা। অর্পিতাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মেয়েরা খেতে ভালবাসে, সিনেমা দেখতে ভালবাসে, উপহারে খুশি হয়। তিনটেই টাকার ব্যাপার। নো মানি নো লাভ। হানিদের মানি দিয়ে বশে আনতে হবে। একটা হিরো হিরো চেহারা চাই। গায়ে থাকা চাই ফাইন সেন্ট আর সিগারেটের গন্ধ। মজার মজার কথা বলতে হবে। কথায় কথায় পকেট থেকে চকোলেট বের করে খাওয়াতে হবে। অম্লানবদনে ফাইফরমাস খাটতে হবে। শরীরের শক্তি দেখাতে হবে। তোয়াজ করতে হবে। প্রেম করা কঠিন কাজ। ওর চেয়ে ব্যায়াম করা সহজ। প্রেম হতেও যতক্ষণ, চটকে যেতেও ততক্ষণ। কলেজে যেমন হাজিরার পার্সেন্টেজ থাকে, প্রেমেরও সেইরকম পার্সেন্টেজ থাকে। প্রেমিকার কাছে রোলকলের খাতা। পার্সেন্টেজ কম পড়লেই হয়ে গেল। নামকাটা সেপাই। অর্পিতা আমাকে মাসখানেক নাচিয়ে বুঝে গেল একেবারেই ফোঁপরা মাল। একটা টাকা নিয়ে কলেজে আসে। যাওয়া-আসা পঞ্চাশ-পয়সা, আর পঞ্চাশ পয়সায় প্রেম হয় না। অর্পিতার চারে অনেক বড়লোকের ছেলে ঘুরছিল। তারা আমাকে কনুইয়ের কানকি মেরে চারে ঢুকে গেল। আমি উদাস মুখে বসে রইলুম প্রেমের পুকুরপাড়ে।

বিজ্ঞাপনটা দেখে সেই ছাত্রজীবনের অর্পিতার কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটাকে সত্যিই আমি ভালবেসেছিলুম। ভাল না বেসে উপায় ছিল না। দুর্বার আকর্ষণ। সেই রূপকথার রাজকন্যার মতো। হাসলে মুক্ত ঝরে। কাঁদালে হিরে। দু’হাত দিয়ে হাঁটু ধরে, শরীরটাকে পেছনে হেলিয়ে যখন গাছতলায় বসে থাকত, মনে হত প্রেমের উপন্যাসের কোনও নায়িকা বসে আছে। ঘাড়ের কাছে জমাট রহস্যের মতো আলগা খোঁপা। পৃথিবীর সমস্ত স্নেহের মতো জমাট বুক। হারিয়ে যাওয়া কোনও নারীর মতো ভারী নিতম্ব। কালিদাসের নায়িকা। সূর্য ওঠা কপাল। ছোরার মতো নাক। অর্পিতা বাস্তব থেকে আমার স্বপ্নে চলে এসেছিল। স্বপ্নেই পেতে বসেছিল তার ঘরকন্যা।

খুব লজ্জা করছিল। তবু নিজের পরিচয় দিয়ে একটা চিঠি লিখে কাগজের বক্স অফিসের ডাব্বায় ফেলে এলুম। নিজের কথা নিজে লেখা যায়! সেই অসভ্যতাটাই করতে হল। আমার বংশপরিচয়, আমার রোজগার। আমার ভবিষ্যৎ, আমার স্বভাবচরিত্র। আমি কতটা মুক্তপুরুষ! আমার তিনকুলে কেউ নেই। আমাকে দেখতে কেমন। যেন সাবানের বিজ্ঞাপন। দেয়ালের সামনে খাড়া হয়ে মাথার ওপর দিয়ে পেনসিল চালিয়ে একটা দাগ মেরে স্কেল দিয়ে মাপতে বসলুম। হাইট পাঁচফুট সাড়ে চার ইঞ্চি। বিয়ের দরখাস্ত চলে গেল। এতকাল গাদাগাদা চাকরির দরখাস্ত হয়েছে, এইবার বিয়ের দরখাস্ত। চিঠিটা ছাড়ার পর থেকেই আমার মনে হতে লাগল, বিয়েটা হয়েই গেছে। নতুন শাড়ির গন্ধ পাচ্ছি। ঘরটা ভরা ভরা লাগছে। নিজেকে দেখাচ্ছে লাজুক লাজুক। একদিন অন্তর দড়ি কামাচ্ছিলুম। এখন রোজ কামাচ্ছি। গালে উল্টোদিকে হাত চালিয়ে দেখি মাখনের মতো মোলায়েম হয়েছে কি না! সব সময় বেশ ফিটফাট থাকার চেষ্টা করি। সপ্তাহে দু’বার শ্যাম্পু করি।

এক মাসের মধ্যে একটা উত্তর এসে গেল। মেয়েলি হাতের লেখা। পাকা কথা বলার আহ্বান। সঙ্গে একটা রঙিন ছবি। সেই ছবি থেকে সারাদিন চোখ ফেরাতে পারলুম না। মনে ধরার মতো মেয়ে। আয়নার সামনে ছবি আর আমি পাশাপাশি। দুটো মুখের প্রতিফলন, একেবারে মেড ফর ইচ আদার, সিগারেটের বিজ্ঞাপন। মেয়েটি যেন গাইছে, ওগো, আমি যে তোমার, আমি যে তোমার। এতদিন কোথায় ছিলে গোপাল আমার।

আমার এক বন্ধু ও তার স্ত্রীকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলাম। ছোটখাটো একটা ফ্ল্যাট। ছোট সংসার। মেয়ের বাবা নেই, মা আছেন। বেশ জাঁদরেল। খুব ব্যক্তিত্ব। মুখটা একেবারে সলিড। চোখে চশমা। কেঁচোর মতো একটা ছেলেও আছে। পশু চিকিৎসক। যে-ঘরে বসলুম, সেই ঘরের দেয়ালে নানারকম কুকুরের ছবি। মায়ের দাপটে ছেলে কেমন যেন খ্যাঁতখ্যাঁতে হয়ে আছে। কাঁচা ঘুম ভেঙে গেলে শিশুদের যেমন হয় সেই রকম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা আর মিষ্টি এসে গেল। আমরা যথারীতি বলতে লাগলুম, ‘এ আবার কেন? এ আবার কেন?’

ভদ্রমহিলা যেন ধমকে উঠলেন, ‘কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নাও।’

প্রথম থেকেই তুমি সম্বোধন। তা ভাল। শাশুড়ি তো জামাইকে তুমিই বলবেন। ভদ্রমহিলা আমার বন্ধুর বউকে বললেন, ‘চুল কেটেছ বুঝি। আজকালকার মেয়েদের এই এক মদ্দা ফ্যাশন হয়েছে। মনে করে কী ভালই না দেখাচ্ছে! চুল হল মেয়েদের শোভা।’

ভদ্রমহিলার ছেলে বললেন, ‘আজকাল আর বড় চুল কেউ রাখে না মা।’

ভদ্রমহিলা ছেলেকে এক দাবড়ানি দিলেন, ‘তুমি চুপ করো।’

ছেলের মুখটা গোবদা মতো হয়ে গেল। মা একটা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘রেখা চলে এসো।’ অদ্ভুত একটা ব্যাজার মুখে মেয়েটি ঘরে এল। মা বললেন, ‘মুখে একটু হাসি টেনে নমস্কার করো। মুখটা বেগুনের মতো করে রেখেছ কেন?’

মেয়েটি হাসল না, কেঠো একটা নমস্কার করে বসল।

মহিলা বললেন, ‘এই আমার মেয়ে। কর্মঠ কোনও ন্যাকামি নেই, আদিখ্যেতা নেই। অনেকটা আমার ধাতের। কোনও প্রশ্ন আছে তোমাদের? বোকা বোকা প্রশ্ন। মুড়িঘন্ট রাঁধতে পারে কি না। চাইনিজ জানে কি না! কার লেখা বই পড়তে ভালবাসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম কী?’

আমার বন্ধু আমার চেয়ে অনেক স্মার্ট। সে বলল, ‘একটাই প্রশ্ন, মাসে কতবার সর্দিকাশি হয়?’

মেয়ের মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘পাগল ছাড়া সুস্থ মানুষের যতবার হওয়া উচিত ততবারই হয়। একমাত্র পাগলদের অসুখ করে না।’

এ যেন ব্যাডমিন্টন খেলার চাপ্স। ভদ্রমহিলা আমার বন্ধুকে আর বল ফেরাতে দিলেন না।

মা মেয়েকে বললেন, ‘তুমি যেতে পারো।’ মেয়ে উঠে চলে গেল। খাওয়ার আগে আমাকে ভাল করে দেখে গেল। আমি চোখে যথেষ্ট প্রেম আনার চেষ্টা করলুম। কেমন এল বলতে পারব না। মেয়ে উঠে যাওয়ার পর মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘পছন্দ হয়েছে? হাঁ, কি না! ঝুলিয়ে রাখাটা আমি পছন্দ করি না।’

বন্ধু বলল, ‘যে বিয়ে করবে সে-ই বলুক।’

‘তোমরা তাহলে এসেছ কেন?’

‘একা আসতে লজ্জা পাচ্ছিল তাই।’

মহিলা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘বেশ! তুমিই বলো, পছন্দ হয়েছে?’

মেয়েটিকে আমার বেশ পছন্দই হয়েছিল। টেরিয়ে টেরিয়ে যা দেখার দেখে নিয়েছিলুম। এখন না হাসলেও পরে হাসবে। মায়ের চাপে ছেলে আর মেয়ে দুটোই কেমন হয়ে আছে। লাজুক লাজুক মুখে বললুম, ‘পছন্দ হয়েছে।’

‘তোমাকে কত দিতে হবে?’

‘আজ্ঞে, প্রশ্নটা ঠিক বুঝলুম না।’

‘ঠিকই বুঝেছ। দেনা-পাওনার কথা হচ্ছে। কী কী চাই? দাবি কত?’

‘এক পয়সাও নয়। আমার সবই আছে।’

‘পরে অশান্তি করবে না তো?’

‘সে ভয় নেই। আমি লোভী নই।’

মহিলা তখন ছেলেকে বললেন, ‘নাদু, পাঁজিটা নিয়ে এসো।’

পাঁজি এসে গেল। মহিলা তরতর করে পাতা উল্টে গেলেন। অবশেষে মুখ তুলে বললেন, ‘বাইশে অঘ্রাণ। ভাল দিন। গোধূলি লগ্ন। এখনও একমাস সময় আছে। বিয়ে তাহলে পাকা হয়ে গেল। তোমাদের যা করার করো। আমাদের যা করার করি। তোমার বরযাত্রী ক’জন আসবে?’

‘বেশি না। দশ বারো।’

‘খুব ভাল। এই বাজারে ভূতভোজন করিয়ে কোনও লাভ নেই।’

আমরা বেরিয়ে এলাম। বন্ধুর বউ বলল, ‘মেয়েটা ভালই। শরীরস্বাস্থ্য আছে। দেখতেও সুন্দরী। কিন্তু মেয়ের মা অস্বাভাবিক। অহঙ্কার মটমট করছে, ক্যাঁট ক্যাঁট কথা।’

বন্ধু বলল, ‘সে মরুকগে! বিয়েটা তো শাশুড়ির সঙ্গে হল না। এক এক মা এক এক রকম। ছেলেমেয়েকে ভদ্রমহিলাই মনে হয় মানুষ করেছেন। তাই একটা কর্তা কর্তা ভাব। কড়া মা।’

একটা মাস কেটে গেল। আমার কেউ কোথাও নেই। বন্ধু নির্মল আর তার স্ত্রী মিতাই সব করতে লাগল। কেনাকাটা, হ্যানাত্যানা। ফ্যাচাঙ তো অনেক। ওই ঘনিষ্ঠ দশ বারোজন ছাড়া কাউকেই বলা হবে না। অকারণ অশান্তি করে কোনও লাভ নেই। ব্যাপারটা চুপিচুপি সেরে নেওয়াই ভাল। আগের দিন মিতা তরিবাদি করে আইবুড়ো ভাত খাওয়াল। বিয়েরদিন সকালে নমোনমো করে গায়েহলুদও হল। একটা মিনিবাস ভাড়া করা হল। সেইটাতেই বর, বরযাত্রী একসঙ্গে যাবে, এইরকমই ঠিক হয়েছিল। মিতা বলল, ‘আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে। বরের গাড়ি আলাদা হবে। ফুল দিয়ে সাজতেও হবে। আমারা ছেলের তরফ। বিয়ে একবার, খরচও একবার’। মিতা আমার মা না-থাকার অভাব পূরণ করে দিল। কোমর বেঁধে একাই সব করছে। নিজেকেই নিজে অনেক কিছু দিয়েছি। একটা বক্স টাইপ খাট। স্টিলের আলমারি। নতুন প্রেসার কুকার। তিন ভাঁজ আয়না লাগানো ভাল একটা ড্রেসিংটেবল, আমার বউ এসে চুল বাঁধবে, সাজবে গুজবে। আমি তখন তার পেছনে এসে দাঁড়াব। আবেগে আদর করব। আয়না সাক্ষী। বেশ ভালই খরচ করেছি। মিতা হল পরিচালিকা। সে জানে জীবনের মতো একটা মেয়ে এলে সংসারটাকে কীভাবে সাজাতে হয়। রান্নাঘর থেকে শোবার ঘর মিতা সব সাজিয়ে গুছিয়ে ছবির মতো করে দিয়েছে। মিতা ভীষণ গুছনে মেয়ে। নিজের সংসারটাকে অলকাপুরীর মতো করে রেখেছে। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছে, মিতার মতো একটা বউ পেলে জীবনটা হয়ে যেত যন্ত্রসঙ্গীতের মতো। পরস্ত্রীর ওপর লোভ করা মহাপাপ।

পাঁচটার সময় মিতাই আমাকে সাজিয়ে দিল। সিল্কের ধুতি, পাঞ্জাবি। গায়ে সুগন্ধী স্প্রে। মিতাই চুলের স্টাইল করে দিল হেয়ার ক্রিম দিয়ে। মুখে লবঙ্গ দিয়ে চন্দনের ফোঁটা। পায়ে ঝকঝকে নিউকাট। হাতে কোঁচার ফুল। ভাল করে তাকিয়ে বলল, ‘বেশ দেখাচ্ছে। হঠাৎ ঠোঁটে একটা চুমু। ভিজে ভিজে। সারা শরীর শিউরে উঠল। নারীর স্পর্শের কী জাদু!

দোরগোড়ায় আকাশি রঙের গাড়ি। রজনীগন্ধার ঝালর ঝোলানো। তার পেছনে তাল তোবড়ানো একটা মিনি। নির্মলের হাতে টোপর। মিতার নির্দেশ, বরের গাড়ি যেন ছাগলগাদাই না হয়। ফাঁকা ফাঁকা যাবে। সূর্য অস্ত গেছে। পশ্চিম আকাশ আবীর-লাল। রজনীগন্ধার প্রেমিক সুবাস। দুধসাদা টোপরে অভ্রের চুমকি। গাড়ি থামল বিয়ে বাড়িতে। শাঁখ। উলু। মেয়ের মামা হাত ধরে বাসরে নিয়ে গিয়ে মখমলের গদিতে বসিয়ে দিলেন। খুব একটা হইচই নেই। লোকজন কম। একটু টানাটানির বিয়ে। হতেই পারে। সহায় সম্বলহীন বিধবা মহিলা যতটা পেরেছেন সাধ্যমতো করেছেন।

লগ্ন এসে গেল। আমার হাত ধরে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হল। একটু পরেই আমার জীবন বদলে যাবে। শ্রীর পাশে শ্ৰীমতী যোগ হবে। উল্টোদিকে বসে আছে লাল বেনারসী বউ। দারুণ দেখাচ্ছে। কাশীর পাকা পেয়ারার মতো গায়ের রঙ। গোলাপী গাল। একটা দুটো লাল ব্ৰনর ছিট। ভারী চোখের পাতা। নারকোল পাতা ঘেরা দীঘির মতো। একবার তাকাই তো পরক্ষণেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নি।

সম্প্রদান করবেন মেয়ের মা। তিনি বসে আছেন পাশে। পুরোহিতমশাই মন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনওটা উচ্চারণ হচ্ছে, কোনওটা হচ্ছে না। সম্প্রদান হবে, চার হাত এক হতে চলেছে। হঠাৎ কে আমাকে ভুঁইকুমড়োর মতো পিঁড়ে থেকে তুলে ধুম করে পাশে ফেলে দিল।

হই হই ব্যাপার। গুণ্ডামতো সাত আটটা ছেলে আমাদের ঘিরে ধরেছে। যে-ছেলেটাকে কম্যান্ডের মতো দেখতে, সে বলছে, ‘জগাকে নিয়ে এসে পিঁড়েতে বসা। সাতবছর প্রেম করার পর পাখি নিয়ে যাবে বেপাড়ার কেষ্ট। এটা মগের মুল্লুক! আমরা কী মরে গেছি! মালটাকে তুলে নর্দমায় ফেলে দিয়ে আয়।’

মেয়ের মা চিৎকার করছেন, ‘বাবা পল্লব, ফাইট দাও, ফাইট দাও। তোমার জিনিস তুমি লড়ে নিয়ে যাও। আর লড়ে! আমাকে তুলে বরণডালার ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। পেছনে কী একটা ফুটে গেছে। বরযাত্রীরা ভয়ে পালিয়ে গেছে রাস্তায়। নির্মল একটু লড়তে চেয়েছিল, কষকষে করে তার কান মলে দিয়েছে। জগা পিঁড়িতে বসে পড়েছে। মন্ত্র চালু হয়ে গেছে। পরাজিত রাজপুত্রের মতো আমরা রাস্তায়। রাস্তায় আরও একটা দল। তারা প্যাঁক দিচ্ছে। একজন আমার কাছাটা ফচাং করে খুলে দিল, ‘শালা কার ফল পাড়তে এসেছিলে, পেছনে হুড়কো দিয়ে দেব।’

মিতা বলল, ‘ডিফিট। আমরা হারব না। আজই বিয়ে হবে। গাড়ি ভবানীপুর।’

মিতা আমার পাশে। তার একটা হাত আমার কাঁধে। আমার বোনকে তোমার বিয়ে করতে আপত্তি আছে?

‘তোমার বোন তো তোমার মতোই হবে। তবে সে কি আমায় বিয়ে করবে!’

সেটা আমার ব্যাপার।

গাড়ি যাদবপুর থেকে ভবানীপুরের দিকে চলল। পেছনে বসে আছে হাফ-বিয়ে বর। পেছনে ফুটে গেছে কাজললতা। টোপরটা জগার মাথায়। মিতা আমাকে মায়ের মতো জড়িয়ে ধরে আছে। গাড়ি চলো ভবানীপুর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *