রক্তের শয়তান
ইন্দ্রনাথ রুদ্র প্রাইভেট ডিটেকটিভ। অতএব সে সবজান্তা। এইরকম একটা ধারণা স্বয়ং ইন্দ্রনাথের মধ্যেই উঁকিঝুঁকি মারছিল নিশ্চয়। নইলে ইদানীং কথায় কথায় নিজের জয়ঢাক নিজে পিটবে কেন?
সত্যি কথা বলতে কি, হামবাগ ভাবটা আমি দু-চক্ষে দেখতে পারি না। সুনাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্রনাথের চরিত্রেও হামবড়া জিনিসটা আসছে দেখে মেজাজ খিঁচড়েছে কতবার।
সেদিন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলাম যখন ইন্দ্রনাথ টিপ্পনী কাটল আমার লেখা নিয়ে। এই একটি ব্যাপারে কে খোঁচা মারলে আমি আর শিব হয়ে বসে থাকতে পারি না। গিন্নিকেও রেয়াত করি না।
ফট করে ইন্দ্রনাথ বলে বসল, মৃগাঙ্ক হল লেখক, আর আরশুলা হল পাখি।
বলুন দিকি, অর্ধাঙ্গিনীর সামনে এ জাতীয় কথায় মেজাজ ঠিক রাখা যায়? আমিও ঠিক রাখতে পারলাম না।
রেগে তিনটে হয়ে বললাম, রবার্ট ব্লেক যদি গোয়েন্দা হয়, তুমিও তাহলে ডিটেকটিভ।
পাল্টা আক্রমণের জন্য তৈরি ছিল না ইন্দ্রনাথ। কিন্তু মানুষটা তো মহা ঘুঘু। ভাঙবে তবু মচকাবে না। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এমন হাসিমুখে তাকাল যেন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের লীগ খেলা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বলল স্মিত মুখে, রবার্ট ব্লেকের সঙ্গে আমার মিল কোথায়?
ম্যাজিক দেখানোয়। সূত্র নেই, যুক্তি নেই–কেবল ভেলকি। ছছাঃ! বলে যেন কিস্তিমাত করেছি এমনি একটা ভাব দেখানোর জন্যে জম্পেশ টান দিলাম সিগারেটে এবং ফুকফুক করে ছোট ছোট কয়েকটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লাম কড়িকাঠের দিকে।
আড়চোখে দেখলাম, সকৌতুকে আমাকে দেখছে ইন্দ্রনাথ। একটু হুঁশিয়ারও হলাম, কেননা, ওর টানা টানা চোখে যে জিনিসটার জিমনস্টিক দেখলাম, নাম তার দুষ্টুবুদ্ধি।
কবিতা টুং-টাং করে চামচ নাড়ছিল কফির পেয়ালায়। কান খাড়া করে শুনছিল দুই বন্ধুর বাকযুদ্ধ। যেন মল্লবীরের পাঁয়তাড়া।
হঠাৎ কবিতাকেই ডাক দিল ইন্দ্রনাথ। বলল, ও বউদি, করছ কী?
কফি। তোমার এবং আমার আরশুলা পতিদেবতার।
বেশ বুঝলাম, কবিতা রাগাতে চায় আমাকে। বুঝেও, রেগে গেলাম। কোন অ্যাংগেলে ওকে ঘায়েল করব ভাবছি; রান্নার দিক দিয়ে, না রূপের দিক দিয়ে, এমন সময়ে ইন্দ্রনাথ ফের বলল কবিতাকে, বউদি, তোমার আরশুলা পতিদেবতার চরিত্রের একটা বিবরণ শুনবে?
আমার চরিত্রের বিবরণ? কী বলতে চায় ইন্দ্রনাথ? বিষম ভাবনা হয়ে গেল আমার। ইন্দ্রনাথের কিন্তু হৃক্ষেপ নেই আমার দিকে। বলছে, রবার্ট ব্লেকের ঠাকুরদা এলেও যা বলতে পারবে না, ম্যাজিশিয়ান ইন্দ্রনাথ রুদ্র এবার তাই বলবে। কি দেখে বলবে জানো?
মুখ দেখে? তেরছা চোখে তাকিয়ে বলল কবিতা।
আরে না, ও-মুখে আছে কি যে দেখব?
আমার শ্রীহীনতা নিয়ে এত বড় একটা খোঁচাও গায়ে মাখলাম না।
উদ্বেগ আমার চারিত্রিক খোঁচা নিয়ে। ইন্দ্রনাথ রুদ্র আমার কলেজ ফ্রেন্ড। স্কটিশ চার্চে পড়বার সময়ে সহপাঠিনীদের সঙ্গে একটু-আধটু রঙ্গ- ইতিহাস আছে বইকি। হতভাগা সেসব ফাঁস করলেই গিয়েছি।
ইন্দ্রনাথ কিন্তু সেসবের ধার দিয়েও গেল না। বল, সিগারেট টানার স্টাইলটা দেখেছ?
কবিতা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে নিল, আবার রিং ছাড়া হচ্ছে!
ইন্দ্রনাথ বললে, হা, রিং। ধোঁয়ার রিং। মানে কি জানো?
রিং মানে আংটি, ভুরু নাচিয়ে কবিতা বলল, আংটি মানায় নরম আঙুলে। নরম আঙুল হয় পরী-হুঁরীদের। পরী-হুঁরীরা জন্ম নেয় ধোঁয়া থেকে। ধোঁয়ার আংটি তাদের জন্যে।
মন্দ বলোনি। বলল ইন্দ্রনাথ, লেখকের বউ তে। কল্পনায় ম্যাজিশিয়ান। কিন্তু আমি যা বলব, তা মনোবিজ্ঞানীদের কথা। ধোঁয়ার আংটি যারা রচনা করে, তাদের চরিত্রের একটা বিশেষ প্যাটার্ন আছে।
যেমন? কবিতা বিলক্ষণ কৌতূহলী। ইন্দ্রনাথের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।
এদের বিশ্বাস করা যায় না–এদের ওপর আস্থা রাখা যায় না।
হাততালি দিয়ে কবিতা বললে, একদম খাঁটি কথা। আর কি?
ধোঁয়ার আংটি যতই দুলতে-দুলতে ওপরে উঠছে, ততই যেন বুক দশহাত হচ্ছে লেখক মহোদয়ের। কীরকম তাকিয়ে আছে দেখছ আংটিগুলোর দিকে? কেন জানো? মনে মনে ফন্দি আঁটছে। সে ফন্দি নিজেকে নিয়ে।
নির্জলা সত্য। কবিতা বিলক্ষণ উল্লসিত।
আরও আছে, বউদি। এ জাতীয় লোকেরা নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে আর কারও ব্যাপারে মাথা গলানোর গরজ দেখায় না। কারণ, এদের ভাবনার মুখ বাঁকানো থাকে ভেতর দিকে। বাইরের কারও কথা শুনে সায় দিলেও জানবে মনে থেকে সায় দেয় না।
এগজ্যাক্টলি! আমার স্বার্থপর চরিত্ৰকাহিনি শুনে যেন আহ্লাদে আটখানা হল কবিতা।
ঠাকুরপো, হাড়ে ঘুন ধরিয়ে আমি যা জেনেছি, পাঁচ মিনিটে তুমি তা জানলে কী করে?
ওই যে বললাম, সিগারেটে টান মেরে রিং ছাড়ার বহর দেখে। শুনলে মনে হয় যেন খড়ি পেতে গুণে বলছি। অথচ একটু পড়াশুনো থাকলেই এমনি চমক লাগানো যায়। মনে হয় যেন ম্যাজিক। রবার্ট ব্লেকের কীর্তি। তাই না মৃগাঙ্ক?
রাগের চোটে তখন আমার মুখে কথা সরছে না। সিগারেট খাওয়াও মাথায় উঠেছে। তাই কেবল কটমট করে তাকালাম বউয়ের হাসি মাখানো বড় বড় চোখ দুটোর দিকে।
ইন্দ্রনাথ বললে, ভায়া, রাগ করছ কেন? পেট থেকে পড়েই কি কেউ ডিটেকটিভ হয়? নিজেকে তৈরি করতে হয়। তুমি তো জানো, আমি কলেজের বই যত না পড়েছি, তার দশগুণ পড়েছি দশরকম সাবজেক্ট নিয়ে। পড়ার নেশায় পড়েছি। আজকের ডিটেকটিভ পেশায় তা কাজে লাগছে। সুতরাং রবার্ট ব্লেক বলে আমাকে ব্যঙ্গ করা কেন বন্ধু?
আমি কি বলব ভেবে না পেয়ে তারস্বরে বললাম, কফি দাও।
মুখ টিপে হেসে কফি এগিয়ে দিল কবিতা এবং ঠিক সেই সময়ে ডিংডং শব্দে ঘণ্টাধ্বনি হল সদর দরজায়।
একটু পরেই একটা কার্ড এসে পৌঁছোল আমার সামনে। আইভরি কার্ড। উঁচু উঁচু হরফে নাম লেখা–ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম। নামের পাশে কয়েকটা ডিগ্রি।
খিঁচড়োনা মেজাজ নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলাম, জাম্বুলিঙ্গম! কে জাম্বুলিঙ্গম? আমি চিনি না। বলোগে যা, দেখা হবে না।
ও আবার কি অসভ্যতা! ধমকে উঠল কবিতা। তোমার মতো জাম্বুবানের সঙ্গে দেখা করতে জাম্বুলিঙ্গম আসবে না তো কে আসবে? বঙ্কা, পাঠিয়ে দে বাবুকে।
বঙ্কা বিদায় হল এবং অনতিকাল পরেই ঘরে ঢুকল যেন সাক্ষাৎ জাম্বুবান। শুনেছি, ত্রেতাযুগে ভল্লুকরাজ নাকি দারুণ যোদ্ধা ছিল। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকেও একুশ দিন নাজেহাল হতে হয়েছিল জাম্বুবান কে পরাস্ত করতে।
তা জাম্বুলিঙ্গম নামধারী দৈত্যাকার পুরুষটি ভল্লুকরাজ আখ্যার উপযুক্ত ব্যক্তিই বটে। মিশমিশে রং। দরজায় মাথা-ঠেকে যাওয়া তালঢ্যাঙা বপু। ছাইরঙের টেরিন সুট। হাতে ছড়ির মতো লিকলিকে একটা ছাতা। বাঁটটা মোষের শিংয়ের। দেখলে ছড়ি বলেই ভ্রম হয়।
ভল্লুকরাজকে দেখেই একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। বালি-সুগ্রীবের প্রতিবেশীরা সাধারণত খর্বকায় শীর্ণ হন বলেই জানি। এমন রাবণ-বপু দেখব আশা করিনি।
তাই জাম্বুলিঙ্গম ঘরে ঢুকতেই আমি তীব্র গলায় বললাম, ইয়েস?
জাম্বুলিঙ্গম মোটা মোটা লেন্সের আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল আমার পানে। হাত তুলে নমস্কার করল। এবং বলল অতি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায়, আপনিই মৃগাঙ্কবাবু? লেখক?
আর একবার হকচকিয়ে গেলাম। স্নায়ুর ওপর আর এক নির্যাতন। জাম্বুবানের কণ্ঠে বাংলা ভাষা!
কাষ্ঠহাসি হেসে বললাম, হ্যাঁ, আমিই মৃগাঙ্গ রায়। বসুন। কী ব্যাপার বলুন তো?
জাম্বুলিঙ্গম বসল। ছড়ির মতো ছাতাটা রাখল সামনের টেবিলে। ভদ্রলোকের চেহারায়, চাহনিতে, কথায় বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। বলল রেশমমসৃণ ভারী গলায়, আমি আপনার কাহিনির বিশেষ ভক্ত।
আপনি? কৌতূহল আর বাগ মানল না।
হাসল জাম্বুলিঙ্গম, আশ্চর্য তাই না? যার চেহারা এমন কদাকার, যার মাতৃভাষা মিল, বাংলা ভাষায় তার এত ব্যুৎপত্তি থাকবে কেন?
না, না, আমি তা বলিনি–
মৃগাঙ্কবাবু, শুধু বাংলা নয়, ইন্ডিয়ার আরও চারটে ভাষা আমি অনর্গল বলতে পারি। ফ্রেঞ্চ আমার কাছে জল-ভাতের সমান। কিন্তু সেকথা যাক। আমি আপনার কাহিনির দারুণ ভক্ত। সেই সঙ্গে পরম ভক্ত আপনার বন্ধুর।
আমার বন্ধু?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ ইন্দ্রনাথ রুদ্র। যার বিস্ময়কর কীর্তি অলীক শার্লক হোমসকেও ম্লান করে দিয়েছে।
আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ক্ষীণ গোঁফ জোড়ার ওপর সগর্বে আঙুল বুলিয়ে নিল ইন্দ্রনাথ।
সুতরাং আবার কাষ্ঠহাসি হাসলাম। বললাম, ইন্দ্রনাথ রুদ্র আপনার সামনেই হাজির।
চকিতে চোখ ফেরাল জাম্বুলিঙ্গম। আমি আলাপ করিয়ে দিলাম, ইনিই ইন্দ্রনাথ রুদ্র যাঁর কীর্তি রবার্ট ব্লেককে টেক্কা দিয়েছে। আর ইনি আমার অর্ধাঙ্গিনী।
নমস্কার প্রতি নমস্কারের পর জাম্বুলিঙ্গম বলল, মৃগাঙ্গবাবু, আমি কিন্তু ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে রবার্ট ব্লেকের সঙ্গে তুলনা করি না। ওঁর সঙ্গে তুলনা চলে একমাত্র ফাদার ব্রাউন বা শার্লক হোমসের। ওঁর মস্তিষ্কই ওঁকে সে মর্যাদা দিয়েছে।
ঢোক গিলে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলাম, আপনি দেখছি মস্ত বৈজ্ঞানিক।
মস্ত নয় ক্ষুদ্র। আমার সমস্যাটা বৃহৎ।
সমস্যা?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম আপনার কাছে। উদ্দ্যেশ ছিল, ইন্দ্রনাথবাবুর ঠিকানা নিয়ে তাঁর কাছে হত্যে দেব। আমার সৌভাগ্য, এক মন্দিরেই দুই দেবতার দর্শন পাওয়া গেল।
খোসামোদে পাথর গলে, আমিও তুষ্ট হলাম। বললাম, সে কি কথা! অসুবিধে না থাকলে আপনার সমস্যা আমার সামনে বলতে পারেন। পুজোর লেখার খোরাক চাই তো!
হেসে ফেললেন জাম্বুলিঙ্গম। ঝকঝকে সাদা দাঁত মিশমিশে মুখে খুব খারাপ দেখাল না। বলল, সমস্যাটা রক্তের শয়তানকে নিয়ে।
রক্তের শয়তান! সে আবার কী?
ব্লাড ক্যান্সার। আমি রঙ্গ করে নাম দিয়েছি রক্তের শয়তান। আপনি লেখক মানুষ, আমার কৌতুকবোধের তারিফ করবেন নিশ্চয়?
তা করছি, বললাম, আমি, ব্লাড ক্যান্সার মানে, লিউকোমিয়ার এমন বাংলা উপাধি এর আগে শুনিনি। কিন্তু রক্তের শয়তানকে নিয়ে আপনি বিব্রত কেন?
কারণ, ব্লাড ক্যান্সার আমার গবেষণার বিষয়বস্তু বলে।
আপনি–
আমি ব্যাঙ্গালোর ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে আসছি। আসছি পার্সোনাল ক্যাপাসিটিতে। আমার সমস্যার গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বলতে গেলে একটু সময় লাগবে। তার আগে যদি সাউথ ইন্ডিয়ান ড্রিঙ্ক দিয়ে গলা ভেজানো যেত–
নিশ্চয়, নিশ্চয়! বিষম লজ্জিত হয়ে বললাম, কবিতা, কফি দাও।
জাম্বুলিঙ্গম বাগাড়ম্বরের ধার দিয়েও গেল না। বলল, আপনারা ১৩ জুলাইয়ের কাগজে একটা খবর নিশ্চয় দেখেছেন। খবরটা নিয়ে সম্পাদকীয়ও লেখা হয়েছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর তো। পড়েননি? বেশ, কাগজটা আমি সঙ্গে এনেছি। পড়ে শোনাচ্ছি।
বলে, বুক পকেট থেকে কাঁচি দিয়ে কাটা একটুকরো খবরের কাগজ বার করে ভারী গলায় পড়তে শুরু করল জাম্বুলিঙ্গম, রক্তের ক্যান্সার তথা লিউকোমিয়া নামক জটিল ও কঠিন রোগের নিরাময়কারক ঔষধ আবিষ্কার করিবার কৃতিত্ব যদি কেহ দাবি করেন, তবে বুঝিতে হইবে যে, তিনি মানব জীবনের কল্যাণ সম্ভব করিবার দুরূহ ও মহৎ একটি অঙ্গীকার সফল করিবার কৃতিত্ব দাবি করিতেছেন। দক্ষিণ ভারতের জনৈক চিকিৎসক সিদ্ধ চিকিৎসা-পদ্ধতির তথ্য সম্বলিত একটি পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন করিয়া এবং তদনুযায়ী গবেষণা করিয়া লিউকোমিয়ার ঔষধ আবিষ্কার করিয়াছেন বলিয়া সংবাদ প্রচারিত হইয়াছে। তিনি ভারত সরকারের বৃত্তিধারী গবেষক। সুতরাং, ভারতের সরকারি স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের আর কালবিলম্ব না করিয়া এই কৃতিত্বের যথার্থতা বিচার ও বিবেচনা করিয়া দেখা কর্তব্য। এই ঔষধ প্রস্তুত করিবার উপযোগী গাছগাছড়ার অভাব আছে বলিয়া গবেষক-চিকিৎসক যে মন্তব্য করিয়াছেন, তাহার গুরুত্ব ও যথার্থতা সম্বন্ধেও সরকারি কর্তৃত্বে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। কারণ দীর্ঘকালের গবেষণা ও কৃতিত্বে আবিষ্কৃত কোনও ঔষধের জন্য গাছগাছড়ার অভাব থাকিলে তাহা দূরীভূত করিবার ব্যবস্থা দ্রুত গ্রহণ করিতে হইবে। সরকারের পক্ষে সবার আগে জানিয়া লওয়া প্রয়োজন যে, আবিষ্কৃত ঔষধটি সত্যই যথার্থ নিরাময়কারণ ঔষধ।
জাম্বুলিঙ্গম তামিলনাড়ুর বাসিন্দা হয়েও যেরকম স্বচ্ছন্দ গতিতে পরিষ্কার উচ্চারণে খবর পড়ে শোনাল, তা অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর বহু সংবাদদাতার পক্ষেও সম্ভব হয় না।
খবর পড়া শেষ হতেই এই প্রথম ইন্দ্রনাথ মুখ খুলল, মোদ্দা বিষয় দাঁড়াচ্ছে এই সিদ্ধ চিকিৎসা পদ্ধতির পুরোনো পুঁথিতে ব্লাড ক্যান্সারের দাওয়াই লেখা আছে। সেই পুঁথি এবং দাওয়াই এখন পাওয়া গেছে। পেয়েছেন একজন দক্ষিণ ভারতীয় ডাক্তার। এই তো?
হুবহু।
আপনিই কি সেই ডাক্তার?
না, আমার বন্ধু। মালুমঙ্গলম।
আপনার সমস্যা আপনাকে নিয়ে, না আপনার বন্ধুকে নিয়ে?
আমাদের দুজনকে নিয়ে।
যথা?
খবরে যা বলা হয়েছে, তা আংশিক। সিদ্ধ চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা মালুমঙ্গলম একা করেনি। আমিও ছিলাম সঙ্গে। বছর তিনেক আগে দেশে ফিরেছি আমি। মালুমঙ্গলমের সঙ্গে যোগাযোগ তখন থেকেই। রুগি দেখার ফাঁকে ফাঁকে গাছগাছড়া নিয়ে নাড়াচাড়া করার বাতিক ওর অনেকদিনের। ওর বিশ্বাস, বিধাতা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, মানুষের রোগের ওষুধও সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীতেই তা আছে। প্রাচীন পুঁথি ঘেঁটে, উদ্যোগী হয়ে শুধু খুঁজে নিলেই হল।
দুরারোগ্য ব্লাড ক্যান্সারের দাওয়াই আবিষ্কারের গবেষণার শুরু তখন থেকেই। মালুমঙ্গলমের রিসার্চ ব্যাকগ্রাউন্ড নেই–আমার আছে। কিন্তু আমার প্রাচীন গাছগাছড়া সম্পর্কে কোনও জ্ঞান নেই– মালুমঙ্গলমের আছে। ফলে, জুটি বাঁধলাম দুজনে। আমার ডিগ্রির দৌলতে সরকারি বৃত্তিও জুটল। গবেষণাও অনেক এগোল। পরিশেষে ব্লাড ক্যান্সারের দাওয়াইয়ের সন্ধানও পেলাম।
সমস্যা শুরু ঠিক তার পরেই।
আমাদের গবেষণা কেন্দ্র কিন্তু কলকাতায় নয়–ব্যাঙ্গালোরে। গান্ধীনগরে মুনলাইট সিনেমার ঠিক পেছনে। ছোট্ট ল্যাবরেটরি। আমি, মালুমঙ্গলম আর প্রভাবতী। প্রভাবতী আমাদের ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্টও বটে, সেক্রেটারিও বটে। রিপোর্ট টাইপ করা থেকে শুরু করে কেমিক্যাল সংগ্রহ করা–সমস্তই প্রভাবতীর দায়িত্ব।
গত ১০ জুলাই রক্তের শয়তানকে ঢিট করার জবর দাওয়াইয়ের সন্ধান পেলাম আমি আর মালুমঙ্গলম। ১৯৩০ সালে স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমণ ভারতের মুখোজ্জ্বল করেছিলেন পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ এনে। ১০ জুলাই সন্ধের দিকে আমি আনন্দে আটখানা হয়ে বলেছিলাম মালুমঙ্গলমকে–ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ আনব তুমি আর আমি।
বিধাতা তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে হেসেছিলেন। নইলে পরের দিন সকালবেলা উধাও হবে কেন মালুমঙ্গলম?
বলে কবিতার হাত থেকে কফির পেয়ালা টেনে নিল জাম্বুলিঙ্গম।
ইন্দ্রনাথ চোখ ছোট করে শুনছিল। এবার বলল, উধাও হলেন?
হ্যাঁ। চুমুক না দিয়েই বলল জাম্বুলিঙ্গম, পরের দিন সকালবেলা ল্যাবরেটরিতে এসে দেখলাম, প্রভাবতীর টাইপরাইটারে একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা–জাম্বুলিঙ্গম, কাল রাতে রিপোর্ট ঘাঁটতে গিয়ে মাথা ঘুরে গেল। সিদ্ধ চিকিৎসা-পদ্ধতিতে এক জায়গায় মারাত্মক কথা লিখেছে। এ ওষুধ ব্লাড-ক্যান্সার সারায় বটে, কিন্তু বছর দুয়েকের মধ্যে মাথার গণ্ডগোল দেখা দিতে পারে। আমাদের গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে। তোমার সময় এবং সরকারের টাকা অপচয়ের কারণ আমি। বিবেকের দংশন আর আত্মগ্লানি সইতে না পেরে চললাম। শুনেছি, হিমালয় অঞ্চলে ব্লাড ক্যান্সারের ওষুধ আছে। যদি পাই, ফিরব। নইলে, এই যাত্রাই শেষ যাত্রা। এ মুখ আর কেউ দেখবে না। ইতিমালুমঙ্গলম। এগারোই জুলাই।
ইন্দ্রনাথ বলল, চিঠিটা দেখছি কণ্ঠস্থ করে রেখেছেন?
তা করেছি। মূল চিঠিও সঙ্গে এনেছি। এই দেখুন।
হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা কাগজটা নিল ইন্দ্রনাথ। সেকেন্ড কয়েক চোখ বুলালো এ-কোণ থেকে সে-কোণ পর্যন্ত।
বলল, টাইপ না করে হাতে লিখলেও তো পারতেন আপনার বন্ধু। টাইপ করলেন কেন? করলেনই যদি তো তলায় সই না করে টাইপ করে নিজের নাম লিখলেন কেন? আমার সন্দেহ হচ্ছে।
ও সন্দেহ আমার মনেও এসেছে। বলল জাম্বুলিঙ্গম, এসেছে বলেই আপনার দ্বারস্থ হয়েছি।
কীসের সন্দেহ বলুন তো? ইন্দ্রনাথ কৌতূহলী হল।
চিঠিটা কি সত্যিই মালুর লেখা?
কারেক্ট। কাজেই প্রাথমিক তদন্ত টাইপরাইটার থেকেই শুরু করা দরকার। তার আগে একটা প্রশ্ন। আপনি পুলিশে না গিয়ে সোজা কলকাতায় এলেন কেন? তদন্ত গোপন রাখতে চাইছেন কেন?
গোপন রাখতে চাই সরকারি বৃত্তি এর সঙ্গে জড়িত বলে। পাবলিক কেলেঙ্কারী কে চায় বলুন? আপনি যদি তার হদিশ বার করে দেন, তাহলে তো গোল চুকেই গেল। নইলে শেষ পর্যন্ত পুলিশকেই ডাকতে হবে।
কলকাতায় এলেন শুধু আমার কাছে?
না, মালুর খোঁজে। হিমালয় যেতে গেল এই পথই সহজ পথ। কলকাতায় কদিন ওকে থাকতেই হবে। নিশ্চয় অভিযানের কেনাকাটা করবে, ব্যবস্থা করবে। যে কটা সাউথ ইন্ডিয়ান ডেরা
আছে, তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। না পেয়ে আপনার খোঁজে এসেছি। ইন্দ্রনাথবাবু, আপনি পরের ফ্লাইটে ব্যাঙ্গালোর চলুন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মালু ব্যাঙ্গালোরেই রয়েছে।
ইন্দ্রনাথ সব শুনে কান-কাটা বেহায়ার মতো জিগ্যেস করল, আপনি জানেন নিশ্চয় গোয়েন্দাগিরি আমার পেশা?
জাম্বুলিঙ্গমও কম স্মার্ট নয়। সপ্রতিভ কণ্ঠে জবাব দিল তৎক্ষণাৎ, তৈরি হয়েই এসেছি আমি। বলে, ভেতর পকেট থেকে বার করল একটা চেকবই আর কলম। কত লিখব বলুন?
হাজার। নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিল ইন্দ্রনাথ।
সঙ্গে সঙ্গে চেক লিখতে শুরু করল জাম্বুলিঙ্গম।
চুপ করে বসে থাকা বোধহয় কোষ্ঠীতে লেখেনি ইন্দ্রনাথের। নইলে, হাত অত নিশপিশ করবে কেন? হাঁটুর ওপর সেকেন্ড কয়েক আঙুল বাজিয়ে টেবিলের ওপর থেকে টেনে নিল জাম্বুলিঙ্গমের ছাতাটা। মোষের শিংয়ের ছড়ি প্যাটার্নের বাঁট থেকে শুরু করে চোখ বুলানো হল লোহার ফেরুল পর্যন্ত। ইতিমধ্যে চেক লেখা শেষ করে চেকখানা এগিয়ে ধরল জাম্বুলিঙ্গম। ইন্দ্রনাথও ডান হাতে ছাতা বাড়িয়ে দিয়ে বাঁ-হাতে নিল চেকটা।
বলল, ভারি সুন্দর ছাতা তো! দেখে মনে হয় যেন ছড়ি।
ছাতা নিয়ে উঠে দাঁড়াল জাম্বুলিঙ্গম। ছড়ির কায়দায় একপাক ঘুরিয়ে নিল ছাতা। বলল ছোট করে, বিলতে যখন মেঘ করত, তখনি এ-ছাতা থাকত সঙ্গে। আজও থাকে সঙ্গে।
কে জানত, তখন যে এই ছাতা নিয়েই ভেল্কি দেখাবে ইন্দ্রনাথ রুদ্র এবং খোঁতা মুখ ভেঁতা করবে আমার?
.
মেঘলোক দিয়ে সেইদিনই দুজনে এল ব্যাঙ্গালোরে। এয়ারপোর্টে থেকে সিধে গান্ধীনগরের ল্যাবরেটরিতে গেল ইন্দ্রনাথ। প্রথমেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল টাইপরাইটারের ওপর। একটা সাদা কাগজ ঢুকিয়ে খটাখট করে নিজে কিছুক্ষণ টাইপ করল। তারপর ডাক পড়ল প্রভাবতীর।
প্রভাবতী দক্ষিণী ললনা হলেও রীতিমতো চটকদার। বিজ্ঞানের সাধনা করতে এসেও রূপের সাধনায় গাফিলতি নেই বিন্দুমাত্র। চোখে কটাক্ষ এবং অধরে লালসা কীভাবে জাগ্রত করতে হয়, সে কৌশল তার করায়ত্ত।
এ হেন অ্যাসিস্ট্যান্ট দেখে ভুরু কুঁচকে ছিল ইন্দ্রনাথ। এ মেয়েকে ক্যাবারে ড্যান্সে মানায়, ল্যাবরেটরিতে মানায় না।
কিন্তু কি আশ্চর্য, প্রভাবতীকে নিয়ে বিশদ জেরার ধার দিয়েও যায়নি ইন্দ্রনাথ। শুধু চেয়েছে, রিপোর্টের ফাইলটা। রোজকার গবেষণার প্রতিবেদন টাইপ হত প্রতিদিন। ফাইল নিয়ে নিতম্ব দুলিয়ে ভারী বুকে হিল্লোল তুলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রভাবতী। টানা টানা চোখে একবার মাত্র যৌবন বিজ্ঞাপিত তন্বীদেহ দেখে নিয়ে ফাইল খুলে বসেছে ইন্দ্রনাথ।
প্রথমেই দেখেছে ৯ জুলাইয়ের রিপোর্ট। তারপর ৮ জুলাইয়ের। তারপর ৭ জুলাইয়ের। তারপর ৬ জুলাইয়ের।
জাম্বুলিঙ্গম সামনেই দাঁড়িয়েছিল। বাংলায় বলেছে ইন্দ্রনাথ, ভদ্রমহিলাকে এখন যেতে বলুন। কথা আছে।
জাম্বুলিঙ্গম অমিল ভাষায় তৎক্ষণাৎ বিদায় দিয়েছে প্রভাবতীতে। হেলতে দুলতে নিতম্বিনী অন্তর্হিত হতেই শুনিয়েছে উদগ্র কণ্ঠে, কিছু পেলেন?
পেয়েছি। এ চিঠি ডক্টর মালুমঙ্গলম টাইপ করেননি। দু-নম্বর, ১১ জুলাই সকালে এ চিঠি টাইপ করা হয়নি। হয়েছে ৬ জুলাই, কি তারও আগে।
পুরু লেন্সের আড়ালে জাম্বুলিঙ্গমের চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়েই ছোট হয়ে এল, কী করে জানলেন?
৬ জুলাই পর্যন্ত পুরোনো রিবনে টাইপ হয়েছে। ৭ জুলাই নতুন রিবন মেশিনে বসেছে। মালুমঙ্গলমের চিঠি পুরোনো রিবনে টাইপ করা। তার মানে, উনি এ চিঠি এগারোই জুলাই ঝোঁকের মাথায় টাইপ করেননি। আর কেউ ৬ জুলাই কি তারও আগে টাইপ করে রেখেছিল।
উদ্দেশ্য?
তাকে সরানো। ডক্টর, আমার ভীষণ সন্দেহ হচ্ছে। উনি এখন কোথায়, স্বর্গে না মর্তে?
আপনিই বলুন। মালুমঙ্গলম থাকতেন কোথায়?
এই গান্ধীনগরেই। ব্যাচেলর তো। গোটা বাড়িতে একা থাকতেন। যাবেন?
চলুন।
.
চাবি কী করে সংগ্রহ হল এবং কতক্ষণ ধরে বাড়ি তল্লাসী হল, তার বিবরণ দিয়ে অযথা গল্পকে লম্বা করতে চাই না। তল্লাসীর শেষে কি পাওয়া গেল–শুধু সেইটুকু জানলেই পাঠক-পাঠিকার কৌতূহল জাগ্রত হবে।
একটা উইল। ডক্টর মালুমঙ্গলমের বিষয়সম্পত্তির বিলিব্যবস্থার নির্দেশ। ভদ্রলোক ব্যাচেলর ছিলেন বটে কিন্তু দরিদ্র ছিলেন না। বিবিধ কোম্পানির শেয়ার কেনাই ছিল দু-লক্ষ টাকার। এ ছাড়াও ব্যাঙ্কে নগদ টাকা আছে আড়াই লাখ। ম্যাঙ্গালোর আর ত্রিবান্দ্রামে ভূসম্পত্তির আর্থিক মূল্য কম করেও পঞ্চাশ হাজার টাকা।
এত টাকার বিষয়সম্পত্তি হেলায় ফেলে অদৃশ্য হয়েছেন ডাক্তার। সব চাইতে আশ্চর্য হল, যে-কোনও মানুষ অজ্ঞাতবাস করার আগে টাকাকড়ি সঙ্গে নেয়। বনবাসে গেলে অথবা আশ্রমবাসী হলে অবশ্য পয়সাকড়ির দরকার হয় না। কিন্তু যাচ্ছেন হিমালয় অভিযানে বিশল্যকরণীর সমতুল্য দুষ্পপ্য গাছগাছড়ার সন্ধানে। সেক্ষেত্রে টাকা ওড়ানো দরকার খোলামকুচির মতো।
অথচ, ভদ্রলোক বলতে গেলে এক কাপড়ে অভিযানে বেরিয়েছেন। না নিয়েছেন টাকা, নিয়েছেন সুটকেশ। ব্যাঙ্ক থেকেও টাকা তোলেননি।
অদ্ভুত কাণ্ড। তাই না? বুদ্ধিমান পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয় আঁচ করে ফেলেছেন ব্যাপারটা।
হ্যাঁ, ইন্দ্রনাথেরও তাই মত। জাম্বুলিঙ্গমও দ্বিমত হতে পারল না। ডক্টর মালুমঙ্গলম স্বেচ্ছায় হিমালয় যাননি। তাঁর অনিচ্ছাতেই যেতে হয়েছে। হিমালয়ে নয়–যমালয়ে!
অর্থাৎ তিনি গায়েব হয়েছেন। হয়তো গুমখুনও হয়েছেন। নোবেল প্রাইজ লাভের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই বোধ করি পরলোকের পথে রওনা হয়েছেন।
কিন্তু কাজটা কার? তার মৃত্যুতে লাভ কার? বিষয়-সম্পত্তির লোভে আকছার খুন হচ্ছে। ঠিকই। উইলে যার নাম রয়েছে, যাকে ডক্টর মালুমঙ্গলম তার সর্বস্ব দিয়ে গেছেন, তার অবর্তমানে, সে ব্যক্তিই হঠাৎ-ধনী হওয়ার দুর্জয় প্রলোভনে মানবহিতৈষী ডাক্তারকে যমালয়ের পথ দেখিয়েছে কি?
কার নাম ছিল উইলে? কল্পনাতীত সেই নাম দেখে জাম্বুলিঙ্গমের মতো কাঠখোট্টা মানুষও শিস দিয়ে উঠেছিল কেন?
কে জানত, চিরকুমার মালুমঙ্গলমের মনেও রং ধরেছে। প্রেমের ফুল ফুটেছে। দিবানিশি যিনি রুগি আর ল্যাবরেটরি নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন, কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবা যায়নি অন্তরের অন্দরে তিনি একটি নারীকে পূজা করে এসেছেন। জাম্বুলিঙ্গম তাই বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিল। কথা বলতে পারেনি অনেকক্ষণ।
ইন্দ্রনাথও কম অবাক হয়নি। শুকনো কাঠের মতো মন যাঁদের, শোনা যায় সেই কঠোর ব্রহ্মচারীরাই শেষ পর্যন্ত উর্বশী-রম্ভার মতো নর্তকীদের হাতে ঘায়েল হন। এক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। মালুমঙ্গলম মনে মনে যাকে ভালোবেসেছিলেন, মনের দিক দিয়ে তার সঙ্গে তাঁর কোনও মিল থাকতে পারে না।
মেয়েটির নাম প্রভাবতী। ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট ও সেক্রেটারি।
.
ইন্দ্রনাথ বলল, খটকা লেগেছে আমার মনে।
জাম্বুলিঙ্গম বলল, কেন?
ডক্টর মালুমঙ্গলমের ধোঁকা-চিঠি টাইপ করা হয়েছে প্রভাবতীর টাইপরাইটারে। এখন দেখা যাচ্ছে, উইলেও নাম রয়েছে প্রভাবতীর। তার মানে কী?
প্রভাবতী সরিয়েছে মালুকে?
এত সহজে তা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু অমন একটা সন্দেহ মনের মধ্যে ঘুরঘুর করে বইকি। তাই ভাবছিলাম, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে উইল পরখ করতে করতে ইন্দ্রনাথ বলল, ইনফ্রারেড ছবি তুলব।
ইনফ্রা-রেড ছবি কার?
কারও নয়। এই উইলের।
কেন? কেন ইন্দ্রনাথবাবু?
উইলে জালিয়াতি আছে কিনা দেখা দরকার। মেয়ে জাতটাকে আমি মশাই একদম বিশ্বাস করি না। যাদের গোঁফ নেই, তাদের বিশ্বাস করলেই ঠকতে হয়। তাই ইনফ্রারেড ছবি তুলব! ব্যবস্থা করবেন?
আলবৎ।
উঠল ইনফ্রারেড ফটোগ্রাফ। পাওয়া গেল আরও একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য।
উইলের যেখানে-যেখানে প্রভাবতীর নাম লেখা, সেখানে-সেখানে আসলে লেখা ছিল অন্য একটি নাম। সযত্নে সে নাম উঠিয়ে লেখা হয়েছে প্রভাবতীর নাম।
ডক্টর মালুমঙ্গলমের ইচ্ছা ছিল তার অবর্তমানে তার বিপুল ভূসম্পত্তির ওয়ারিশ হোক ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম। সম্পত্তির আয় থেকে যেন ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা চালানো হয় ব্যাঙ্গালোর ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায়। বিশেষ এই লাইনটি ছিল উইলের শেষের দিকে। পুরো লাইনটি কেমিক্যাল দিয়ে মোছা হয়েছে। কিন্তু যেখানে-যেখানে ছিল জাম্বুলিঙ্গমের নাম, সেখানে সেখানে বসানো হয়েছে প্রভাবতীর নাম।
থ হয়ে গেল ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম।
.
পুলিশ এল। প্রথমেই গ্রেপ্তার হল প্রভাবতী। তারপর মালুমঙ্গলমের বাড়ি তোলপাড় করা হল। শেষকালে একতলায় যে ঘরে কাঠ আর কয়লা গাদা করা থাকে, সেইখানে গিয়ে দেখা গেল, মেঝের ওপর বেশ কিছু সিমেন্ট বালি মাখা হয়েছে। শুকিয়ে পাথর হয়ে গেলেও দাগটা টাটকা।
কিন্তু গোটা বাড়িতে মেরামতির চিহ্ন কোথাও পাওয়া গেল না। সিমেন্ট-বালি লাগতে পারে, এমন কোনও কাজ বাড়িতে হয়নি।
।বিস্তর নাজেহাল হবার পর ইন্দ্রনাথ ধরিয়ে দিল রহস্যের চাবিকাঠি। বলল, কয়লার গাদা সরানো হোক।
ইন্সপেক্টর বললেন, কেন?
ইন্দ্রনাথ বলল, শার্লক হোমস এক জায়গায় বলেছে, সবকটা সম্ভব জায়গা খুঁজেও যদি হারানো জিনিস পাওয়া না যায়, তাহলে সব চাইতে অসম্ভব জায়গায় সেটা আছে। সুতরাং সরান না কয়লা আর কাঠের গাদা।
ইন্সপেক্টর বেশ জোরেই ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন। কিন্তু শেষমুহূর্তে সুবুদ্ধির উদয় হল। হল বলেই সমস্যার সুরাহা হল। নইলে মালুমঙ্গলমের লাশ আর পাওয়া যেত না।
কয়লার গাদা বেলচা দিয়ে পরিষ্কার করার পর দেখা গেল, সদ্য গাঁথা একটা ইটের কফিন। এক ফুট উঁচু। দেওয়াল থেকে এক ফুট ঠেলে এগিয়ে এসেছে। কয়লা ঢেকে ঢাকা হয়েছে এই কফিনকেই।
কফিন! হ্যাঁ, কফিন! শাবল মেরে ইট খসিয়ে ভেতরে পাওয়া গিয়েছিল মালুমঙ্গলমের বিকৃত মৃতদেহ।
সেই সঙ্গে একটা ছোরা। বুকের বাঁদিকে আমূল গেঁথেছিল ছোরাটা।
.
লোমহর্ষক কাহিনিটা শুনেছিলাম আমারই আড্ডাঘরে বসে কলকাতায়। তেলমুড়ি চিবোতে চিবোতে যথারীতি নিজের জয়ঢাক পিটছিল ইন্দ্রনাথ। আমি আর গৃহিণী বলতে গেলে কানখাড়া করেই শুনছিলাম।
ডক্টর মালুমঙ্গলমের লাশ আবিষ্কারের নাটক শোনার পর আরও দুটো আলুর চপ চেয়েছিল ইন্দ্রনাথ। তাইতেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কবিতা। খ্যাক করে বললে, একটাও দেব না।
কেন বউদি? আমার অপরাধ? ইন্দ্রনাথ যেন কতই আহত।
তুফান মেলের মতো গল্প বলা হচ্ছে কেন? ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসা হয়েছে নাকি?
এই কথা। আশ্বস্ত হল ইন্দ্রনাথ। আসল রহস্যে এখনও আসিনি বলেই তো বাঁই বাঁই করে বলছিলাম।
আসল রহস্যে এখনো আসোনি মানে? মালুমঙ্গলমের লাশটা কি তাহলে নকল বলতে চাও?
আহা লাশ নকল হবে কেন? লাশ কি নকল হয়? লাশ আসল–বিলকুল আসল। কিন্তু এ কাহিনির মোদ্দা পাঁচটুকুই তো শুরু করিনি এখনও।
থামাও নাটক। হেয়ালী করবার আর জায়গা পাওনি? প্রভাবতীকে গ্রেপ্তার করালে, লাশ বার করে ফেললে, জাল উইলের জালিয়াতি ধরে ফেললে–এরপর কি জট থাকতে পারে বুঝি না। কবিতা যেন সাক্ষাৎ দেবী চৌধুরাণী।
আছে বউদি, আছে। দেখবার চোখ থাকলেই দেখা যায়। আলুর চপের প্লেটটা এদিকে না আসা পর্যন্ত সে জিনিস বলা হবে না। ফলে আধখানা গল্প শুনে আধ-কপালে হয়ে থাকতে হবে। শুনলে অবশ্য চোখ কপালে উঠবে। না শুনলে আধ-কপালে হবে। বলো, কী করবে?
শুনব, বলে চপের প্লেট এগিয়ে দিল কবিতা।
ইন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে আরম্ভ করল, প্রভাবতী তো হাজতে গেল। সে কী কান্না মেয়েটার। কাঁদতে-কাঁদতে ফিট হয়ে যায় আর কি! তার বিরুদ্ধে অপরাধের ফিরিস্তি শুনে হাত-পা এমন ঠান্ডা হয়ে এল যে, শেষ পর্যন্ত ডাক্তার ডাকতে হল।
জাম্বুলিঙ্গম নিজেও কেমন জানি হয়ে গিয়েছিল। দিন-রাত ঘরে বসে থাকত। বাইরে বেরোত না। শক্ তো বটেই সাংঘাতিক শক্। ট্রিপ শ৷ বন্ধুর অপঘাত মৃত্যু। রাতারাতি কুবের হওয়া এবং প্রভাবতীর মুখোশ খুলে যাওয়া। কাজেই তিন ধাক্কা সামলাতে ও যখন কাহিল, আমি তখন কয়েকটা খোঁজ-খবর নিতে লাগলাম বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে।
কী খবর নিলাম, কোন অফিসে গেলাম, কার সঙ্গে দেখা করলাম–এসব শুনতে চাও কি? ইচ্ছে নেই। বেশ বাদ দিলাম। পুরো দুটো দিন টো-টো করে ফের গেলাম পুলিশ অফিসে।
সেই ফাজিল ইন্সপেক্টর এবার আমাকে সমীহ করে স্যার বলল। জিজ্ঞেস করল, কিছু জিজ্ঞাস্য আছে কিনা।
আমি বললাম, ফোরেনসিক রিপোর্ট এসেছে?
কীসের?
স্ট্যাবিংয়ের।
এসেছে। ছোরা যে মেরেছে, সে ল্যাটা। মানে, বাম হাতে ছোরা মারতে পোক্ত। রিপোর্টের মোদ্দা কথা হল এই। আর কিছু?
না। আমিও এইটুকুই শুনতে এসেছিলাম। আর একটা কথা বলতে এসেছিলাম। বলুন।
প্রভাবতীকে ছেড়ে দিন।
কেন?
ও নির্দোষ।
সে কী স্যার! ডক্টর মালুমঙ্গলমের ভাওতা চিঠি ও ছাড়া কে টাইপ করবে?
ও করেনি। অন্য কেউ করেছে ওর টাইপরাইটারে ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোর জন্যে।
ঢোক গিলল ইন্সপেক্টর কিন্তু উইলটা? উইলে তো প্রভাবতীই নিজের নাম লিখেছে আগের নাম মুছে।
সেটাও অন্য লোকের কারসাজি। দোষ চাপাতে চায় প্রভাবতীর কাঁধে।
তাও কি হয় স্যার। নিজের নাম নিজে ছাড়া কেউ জাল করে অন্যের উইলে?
করে বইকি।
প্রভাবতীর নাম উইলে বসিয়ে কারও লাভ আছে?
আছে বইকি।
কী বলছেন স্যার! আমার মাথা বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে।
ঘুরবে বইকি। বলে একখানা মার্কামারা হাসি হাসলাম। যে হাসি যুগ যুগ ধরে স্টুপি, পয়রো, হোমসরা হেসে এসেছে রহস্যের নাটকীয় পরিসমাপ্তির ঠিক আগের মুহূর্তে হাসলাম সেই হাসি। দেখেই তো ইন্সপেক্টর সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ হল।
আমি বললাম, দরজাটা বন্ধ করে বসুন। সিগারেট খান? খান না। তাহলে আমি পাইপ ধরাই। একটু সময় লাগবে। কেননা, আশ্চর্য একটা কাহিনি আপনাকে শোনাব। শুনিয়ে আমি বিদায় নেব ব্যাঙ্গালোর থেকে। বাকি কাজ আপনার। আমি শুধু খেই ধরিয়ে দিয়ে যাব। শেষ করার পালা আপনার। নামও হোক আপনার।
বলে পাউচ বার করলাম। একডালা টোব্যাকো নিয়ে ঠাসলাম বার্মিংহামের নতুন পাইপটায়। আর, আগাগোড়া হাঁ করে বসে রইল ইন্সপেক্টর।
বেশ কয়েকটা রাম-টান দেওয়ার পর বললাম, এ মামলার শুরু কলকাতায়–আমার এক লেখক বন্ধুর আড্ডাঘরে। ডিটেকটিভ জাতটা পেট থেকে পড়েই যে ডিটেকটিভ হয় না–এটাই মাথায় ঢোকাচ্ছিলাম বন্ধুবরের। এজন্যে পড়তে হয়, চোখ-মন-কানকে তৈরি করতে হয়। নইলে অনেক সূত্রই সামনে থেকেও কলা দেখায়। যেমন সিগারেট। সিগারেট যারা খায়, তারা কীভাবে আঙুলের ফাঁকে সিগারেট ধরে, কীভাবে ঠোঁটের গোড়ায় ঝোলায়, কীভাবে ধোঁয়া ছাড়ে, বা রিং ছাড়ে–এই দেখেই মানুষটার চরিত্র সম্বন্ধে অনেক কথা বলা যায়।
এমনি ধরনের অনেক জ্ঞান দিচ্ছি বন্ধুকে–না দিলে পাঠকসাধারণ ভালো জিনিস পাবে কেন লেখকের কাছ থেকে–এমনি সময়ে আড্ডাঘরে ঢুকলেন আমাদের ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম।
জাম্বুলিঙ্গমের ব্যক্তিত্ব আমাদের মুগ্ধ করল। তার বাচনভঙ্গি আমাদের মন কেড়ে নিল। তার বাংলা ভাষায় ব্যুৎপত্তি দেখে নিমেষে তাকে আপন করে নিলাম।
জাম্বুলিঙ্গম কলকাতা গিয়েছিলেন মালুমঙ্গলমের খোঁজে। না পেয়ে আমাকে পাকড়াও করলেন। আমার হাতে গোপন তদন্তের ভার দিতে চাইলেন।
জাম্বুলিঙ্গমের হাতে একটা বাহারি ছাতা ছিল এমন সুন্দর ছড়ি প্যাটার্নের ছাতা সচরাচর দেখা যায় না। ছাতাটা উনি নামিয়ে রেখেছিলেন মাঝখানের উঁচু টেবিলের ওপর। ফেরুলটা ফেরানো ছিল আমার দিকে। তাই বৈশিষ্ট্যটা নজরে এসেছিল।
অন্য কারো নজরে আসেনি। অমন যে ডাকসাইটে লেখক বন্ধু, যার গোয়েন্দা গল্প পড়ে পাঠকরা নাকি লেখককেই গোয়েন্দা বলে ধরে নেন, সেই লেখক বন্ধুরও নজরে আসেনি ছাতার তলার ফেরুলের অদ্ভুত বেয়াড়াপনা।
ফেরুল প্রসঙ্গে পরে আসছি। জাম্বুলিঙ্গমের কথার ফাঁকে ফাঁকে ফেরুটা দেখে নানা রকম কৌতূহল মনের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করল। তাই নির্লজ্জ ভাবেই অ্যাডভান্স চাইলাম পারিশ্রমিক বাবদ। উনি সঙ্গে সঙ্গে চেকবই বার করলেন। আমার সামনেই চেক লিখে দিলেন। আমার যা জানবার, সঙ্গে সঙ্গে জানা হয়ে গেল।
সব জেনেই ব্যাঙ্গালোরে এলাম। সব জেনেও ন্যাকা সেজে তদন্ত করলাম। প্রভাবতীকে নির্দোষ জেনেও তাকে ধরিয়ে দিলাম। কারণ, হাতে সময় নেওয়া। যাতে আমার গোপন তদন্তের অত্যন্ত গোপন অংশটুকু খুবই গোপনে নিজেই খুঁজে বার করতে পারি।
এই দু-দিনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সব জানলাম। কোন্ মন্ত্রগুপ্তির বলে এত কাণ্ড জানলাম, তা বলতে গেলে সাতকাণ্ড রামায়ণ শোনাতে হয়। সংক্ষেপে শুনে রাখুন। মালুমঙ্গলমকে খুন করেছেন এমন একজন ব্যক্তি, যাঁকে উনি সবচাইতে বিশ্বাস করেছিলেন। ধরতে পারলেন না? ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম।
ভেবেছিলাম এমন একটা বম্বশেল নিউজ শুনে আঁতকে উঠবে ইন্সপেক্টর। কিন্তু অতি আঘাতে চেতনা অসাড় হয়ে যায় শুনেছি। ভদ্রলোকেরও হল তাই। চোয়াল স্কুলে পড়ল। মুখ দিয়ে টু শব্দটি বেরোল না। ফ্যালফ্যাল করে কেবল তাকিয়ে রইল আমার পানে।
আমি বললাম–ইচ্ছে করেই বললাম, কী হল মশাই, অমন করছেন কেন?
প্রায় খাবি খাওয়ার মতো মুখব্যাদান করে বলল ইন্সপেক্টর, স্যার, আপনি ঠাট্টা করছেন?
আরে গেল যা, একটু বিরক্ত হয়েই বললাম আমি, ঠাট্টা করার সময় এটা?
ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম বাজে লোক নন তো।
আমি কি বলেছি বাজে লোক? বাজে লোক কখনও এমন উল্টো দিক থেকে কে সাজাতে পারে? অলপ্রুফ কে মশাই। ছুঁচ ফোঁটানোর জায়গা নেই। ব্রেন না থাকলে কেউ কর্ণাটক থেকে বঙ্গে দৌড়ে ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে অ্যাপয়েন্ট করে? কেন জানেন?
আজ্ঞে?
প্যাঁচের কেস বলে। ব্রেনি প্যাঁচ তো, জবর ব্রেন না হলে প্যাঁচ ধরতে পারত না। না ধরতে পারলে প্রভাবতীকে ফাঁসানো যেত না। প্রভাবতী না ফসলে জাম্বুলিঙ্গম কেটে বেরিয়ে যেতে পারতেন না। বুঝলেন?
আজ্ঞে না।
বুঝিয়ে দিচ্ছি। এ কেসের প্রথম প্যাঁচ হচ্ছে টাইপরাইটারের চিঠি। ইচ্ছে করেই পুরোনো রিবনে টাইপ করা হয়েছিল চিঠিটা। পরের দিন নতুন রিবন লাগানো হবে জেনেই পুরোনো রিবনে টাইপ করে রাখা হয়েছিল। ফলে, ইচ্ছে করেই একটা অসঙ্গতি রেখে দেওয়া হয়েছে। অসঙ্গতিটা ধরা পড়লে প্রভাবতীকে সন্দেহ হবে। কিন্তু ধরবার মতো ব্রেন তো চাই। তাই ডাক পড়ল ইন্দ্রনাথ রুদ্রের।
আবার খাবি খেলো ইন্সপেক্টর। আমি বললাম, এ কেসের দ্বিতীয় প্যাঁচ হল উইলের জালিয়াতি। নাম মুছে প্রভাবতীর নাম লেখা হয়েছে ইচ্ছে করেই। ইনফ্রারেড ফটো তুললেই তলায় অস্পষ্ট নামটা দেখা যাবেই। ফলে। সব সন্দেহ গিয়ে পড়বে প্রভাবতীর ওপর। কিন্তু ইনফ্রা রেড ছবি তোলার বিদ্যে বা আইডিয়া কজনের থাকে বলুন? যদি জালিয়াতিটা চোখ এড়িয়ে যায় স্থানীয় পুলিশের? তাই হত্যাকারীকে দৌড়তে হল কলকাতায়। আগাম টাকা দিয়ে ডেকে আনতে হল ইন্দ্রনাথ রুদ্রকে। ফলে, জালিয়াতি ঠিকই ধরা পড়ল। হত্যাকারীর পাচালো ফন্দিও পূর্ণ হল।
কিন্তু হত্যাকারী গোড়ায় ভুল করে ফেলেছিলেন ওই ছাতা সঙ্গে রেখে। বিলেত থেকে আনা ছাতা। আকাশে বৃষ্টির আভাস দেখলেই সঙ্গে রাখার অভ্যেস। তাই ছাতা নিয়ে গেলেন আমাকে দিয়ে তার প্যাঁচ ধরানোর বন্দোবস্ত করতে। পরিণাম কি হল জানেন? ভদ্রলোকের পুরো প্যাঁচটাই গোড়াতে আমি আঁচ করে ফেললাম। রগড় দেখতে এলাম ব্যাঙ্গালোরে।
ইন্সপেক্টর বিহ্বল কণ্ঠে বলল, স্যার, আমি কিসসু বুঝতে পারছি না।
কেউই পারে না। পারে না বলেই আমার নাম দেয় রবার্ট ব্লেক। যাকগে সেকথা। আপনাকে আর একটা পিলে চমকানো খবর শোনাই। ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম বলে যাকে আপনারা মাথায় তুলে নাচছেন, যাকে সরকার মোটা টাকার বৃত্তি দিয়ে বসে আছে ব্লাড ক্যান্সার গবেষণার জন্যে, তিনি আসল জাম্বুলিঙ্গম নন।
আসল জাম্বুলিঙ্গম নন! ইন্সপেক্টর ক্ষীণ কণ্ঠে মিনমিন করল, মানে?
মানে নকল জাম্বুলিঙ্গম। আসল জাম্বুলিঙ্গম সমুদ্রের তলায় বা হাঙরের পেটে।
কী বলছেন, স্যার?
অনেকগুলো টেলেক্স মেসেজ থেকে খবরটা জেনেছি। যে জাহাজে আসল জাম্বুলিঙ্গম দেশে ফিরছিলেন, সে জাহাজে প্রায় তারই মতো চেহারার আর একজন সাউথ ইন্ডিয়ান ছিলেন। নাম তাঁর কৃষ্ণস্বামী। কৃষ্ণস্বামীকে সনাক্তকরণের বড় চিহ্ন হচ্ছে তাঁর হাত। ভদ্রলোক অসম্ভব ল্যাটা ছিলেন। বাঁ-হাতেই সব কাজ করতে অভ্যস্ত ছিলেন।
ডক্টর জাম্বুলিঙ্গম ভারতের মাটিতে কোনওদিনই পৌঁছোননি। মদ খেয়ে এক ঝড়ের রাতে ডেকে মাতলামো করার সময় নাকি ভদ্রলোক সমুদ্রে পড়ে যান। আর পাওয়া যায়নি। অবশ্য কেউ তাকে পড়ে যেতে দেখেননি। লোকমুখে শোনা গিয়েছিল, মদ খেয়ে টলতে টলতে তিনি পায়চারি করছিলেন ডেকের ওপর ঝড়-জলের রাতে।
জাম্বুলিঙ্গমের মালপত্র কেবিনেই ছিল–শুধু পাশপোর্ট আর ডিগ্রি সম্পর্কিত কাগজগুলো ছাড়া। ধরে নেওয়া হয়েছিল, ওগুলো পকেটে নিয়ে ঘুরতেন ভদ্রলোক। ফলে সবশুদ্ধ সলিলসমাধি হয়েছে।
কিন্তু তা হয়নি। কৃষ্ণস্বামীর চেহারার সঙ্গে বেশ কিছু মিল ছিল জাম্বুলিঙ্গমের। ফটো তুললে তা ধরাই যেত না। তাই সস্তায় কিস্তিমাতের প্ল্যান এঁটেছিল কৃষ্ণস্বামী। জাম্বুলিঙ্গমের দীর্ঘদিনের সাধনার সিদ্ধিকে মুঠোয় আনতে সহজতম ফন্দি। ব্লাড ক্যান্সারের দাওয়াইয়ের একমাত্র আবিষ্কারক হতে চেয়েছিল একাই। ধোঁকা-চিঠিতে মিথ্যে লেখা হয়েছিল। ও ওষুধে মাথা খারাপ হওয়ার ব্যাপারটা স্রেফ বানানো।
ঝড়জলের রাতে কৃষ্ণস্বামীই ঠেলে ফেলে দিয়েছিল জাম্বুলিঙ্গমকে। এটা আমার অনুমান। পরে মিলিয়ে নিতে পারেন। তারপর জাম্বুলিঙ্গমের নাম লেখা কাগজপত্র পাসপোর্ট হাতিয়ে নিয়ে দেশে ফিরেছিল।
তারপর থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেখা গিয়েছে নকল ডক্টর জাম্বুলিঙ্গমকে। কথায় কথায় পাসপোর্ট খুলে ছবি দেখিয়েছে। চেহারায় ছবিতে কোনও অমিল নেই। সই নকল করতে একটু সময় লেগেছে অবশ্য। ডান হাতে সই করার প্র্যাকটিশ করতে হয়েছে। কারণ কৃষ্ণস্বামী ল্যাটা। জাম্বুলিঙ্গম নন।
বিশাল এই উপমহাদেশে জাম্বুলিঙ্গমের নাম লেখা কাগজপত্র আর পরিচয়নামা নিয়ে তাঁরই মতো কোনও জুয়াচোর ঘুরে বেড়ালে তাকে ধরার সাধ্য কারোর নেই–যদি না নিজে ধরা দেয়। অতি-চালাকেরই গলায় দড়ি পড়ে। তাই ধরা শেষ পর্যন্ত পড়তেই হল। যেচে শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখিয়ে নিজেই মরল।
এই পর্যন্ত বলে আমি উঠে পড়লাম। হাঁ-হাঁ করে ইন্সপেক্টর বললে, স্যার, আসল কথাটাই তো বলে গেলেন না। নকল জাম্বুলিঙ্গমকে গোড়া থেকেই সন্দেহ করলেন কেন?
বললাম তো ছাতার ফেরুল্ল দেখে।
কী ছিল ছাতার ফেরুলে?
কিছু ছিল না। শুধু একটা বিশেষ দিক ছিল।
ফেরুল ক্ষয়ে গিয়েছিল? তা তো যাবেই।
ওই যে বললাম, চোখ না থাকলে ডিটেকটিভ হওয়া যায় না। দরকারি অদরকারি সব কিছুই চোখে পড়া চাই। আমি দেখলাম, ফেরুলের যেদিকটা যেভাবে ক্ষয়েছে, সেদিকটা সেভাবে ক্ষইতে পারে তখনই, যদি ছাতার মালিক বাঁ-হাতে ছাতা নিয়ে হাঁটে।
ডান হাতে ছাতা নিয়ে ছড়ির মতো দুলিয়ে হাঁটলে ফেরুলের যেদিকটা বেশি ক্ষয়ে যায়, সেদিকটা থাকে ফেরুলের ওপর দিকে সামান্য ডাইনে ঘেঁষে।
কিন্তু বাঁ-হাতে ছাতা বা ছড়ি রাখলে ক্ষওয়ার দিকটা থাকবে সামান্য বাঁদিক ঘেঁষে।
নকল জাম্বুলিঙ্গমের ছাতার ফেরুলও দেখলাম সামান্য বাঁয়ে ক্ষওয়া। কিন্তু ছাতা বা ছড়ি তো সবাই ডান হাতেই রেখে পথ চলে–বাঁ-হাতে হাজারে একজনও রাখে কিনা সন্দেহ। তবে কি ভদ্রলোক ল্যাটা?
কৌতূহল হতেই পরখ করলাম। আগাম টাকা চাইলাম কায়দা করে। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চেক লিখলেন ডান হাতে–স্বচ্ছন্দগতিতে নয়। আড়ষ্টভাবে।
বুঝলেন তো? অজ্ঞাতসারে দীর্ঘদিনের অভ্যাসমত যিনি বাঁ-হাতে ছাতা রাখেন, তিনি যে ল্যাটা সেটা চেক লেখবার সময়ে প্রকাশ করতে চান না। কেন? কেন এই গোপনতা? কেন এত লুকোচুরি?
মনের মধ্যে ঘোর সন্দেহ নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে এলাম। মালুমঙ্গলমের লাশ আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত পাকা প্রমাণ পাইনি। ছোরা মারার ধরন দেখেই অনুমান করেছিলাম, হত্যাকারী বাঁ-হাত চালিয়েছে। অর্থাৎ ল্যাটা। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও তাই বলেছে।
সুতরাং নকল জাম্বুলিঙ্গম, মানে ল্যাটা কৃষ্ণস্বামীই আসল খুনি। প্রভাবতী নয়। বলে, পা বাড়ালাম চৌকাঠের দিকে।
ভ্যাবাচাকা ভাবে পেছন পেছন দৌড়ে এল ইন্সপেক্টর, স্যার, স্যার, কেস সাজাব কী করে?
সে ভার আপনার। আমার ভার ছিল মালুমঙ্গলমকে বার করা। টাকাও খেয়েছি তার জন্যে। নুন খেয়ে বেইমানি করতে পারব না। যার টাকা খেয়েছি, তার বিরুদ্ধে কী করে কেস সাজাই বলুন তো? বলে আর দাঁড়ালাম না। আমি।
.
কাহিনি শেষ করে সশব্দে ঢেকুর তুলল ইন্দ্রনাথ। বলল, বউদির তেলেভাজা খেয়ে আমার অম্বল হয়ে গেল।
বেইমান! বলল কবিতা।
* রোমাঞ্চ পত্রিকার প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৯৭১।