দুঃস্বপ্ন
রায়চৌধুরী-দম্পতির বসবার ঘরটি সত্যিই অপরূপ। রীতিমতো বিলাসবহুল উপকরণে সুসজ্জিত। নরম মখমল আঁটা সোফা, আয়নার মতো চকচকে পালিশ করা নীচু হালফ্যাশানের চেয়ার, ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত শ্বেত প্রস্তরে খোদিত গ্রিক ভাস্কর্যের রম্য নিদর্শন ঘরের আবহাওয়াকেও যেন বিলাস-সৌরভে সুরভিত করে তুলেছে। দেওয়ালে ঝুলছে, বহুমূল্য ভেলভেটের পর্দা, পর্দার ওপর সোনালি সুতোর ফুল-লতা-পাতা। ঘরের মেঝেতে পা ডুবে যাওয়া পুরু গালিচা-বাস্তবিকই এ ভবনের সুন্দরী কত্রী-ঠাকরুনের মনোরঞ্জনে সক্ষম অপরূপ এই কক্ষটি। রূপসী স্ত্রীর সকল খেয়াল এবং চাহিদা মেটাতে কুন্তল রায়চৌধুরী কোনওদিন বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেননি–তার বিপুল সম্পদের শেষ কানাকড়িও বোধ করি এ জন্যে ব্যয় করতে তিনি কুণ্ঠিত ছিলেন না। আর বাস্তবিকই, মনিকা তার জন্যে যে স্বার্থত্যাগ করেছে তার প্রতিদানে কুন্তল রায়চৌধুরী যে তার জন্যে এতটা করবেন এ তো স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের মধ্যে নৃত্যশিল্পে, বিশেষত ভারতনাট্যম-নৃত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন মনিকা দেবী, কয়েকটি জনসম্বর্ধিত চিত্রেও পরিচয় দিয়েছেন তার নিপুণ অভিনয় দক্ষতায়–সুনাম সুযশের শিখরে তিনি উঠে বসেছিলেন, অর্থ তাঁর চরণে যেত গড়িয়ে–এ সবের মোহ ত্যাগ করে কুন্তল রায়চৌধুরীর প্রেমে মুগ্ধ হয়ে এলেন তার ঘরে ঘরণী হয়ে। যশোজ্জ্বল জীবনের সবকিছু মনিকা দেবী ছেড়ে এসেছেন–সে সব পূরণ করবার প্রাণপণ চেষ্টা করেন কুন্তল রায়চৌধুরী। এ জন্যে তিনি তার অর্থকে মনে করেন ধূলিসম। কেউ হয়তো মনে করতে পারেন যে তিনি প্রেমের চেয়ে বড় করে দেখেছিলেন মনিকা দেবীর অনিন্দ্য রূপ আর অগাধ খ্যাতিকে। প্রেমের ফাটল তিনি অর্থের প্রলেপ দিয়ে জুড়ে দেওয়ার প্রয়াস পেতেন। কিন্তু তা যারা ভাবেন, তাঁরা ভ্রান্ত। কেননা, একঘর দর্শকের সামনেও তাঁর অকুণ্ঠ ভালবাসার প্রমাণ দিতে তিনি কোনও দিন কুণ্ঠিত হননি।
কিন্তু কক্ষটি বাস্তবিকই অপূর্ব। প্রথম দৃষ্টিতেই কক্ষটিকে দেখে মনে হবে যেন শিল্পী চোখে স্বপ্নাঞ্জন লেপন করে ঘরটি সজ্জামণ্ডিত করেছেন। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার পর কতকগুলো অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য প্রত্যেকেই উপলব্ধি করবে। ঘরটি নিস্তব্ধ–অত্যন্ত নিস্তব্ধ। পুরু গালিচার ওপরে কোনও পদশব্দ শ্রুত হয় না। ঘরের মৃদু নীলাভ আলোর আবহাওয়া কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠেছে। মনিকা রায়চৌধুরী এই কক্ষটিতে প্রতিদিন আসতেন, ঘণ্টা দু-চার থাকতেন–কিন্তু যতক্ষণ থাকতেন তিনি, ততটুকু সময় একাকী মগ্ন হয়ে থাকতেন এই অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যে এবং এই রহস্যময় ঘরের চারটি দেওয়ালের মধ্যে মনিকা রায়চৌধুরী হয়ে উঠতেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং রীতিমতো বিপজ্জনক মহিলা।
বিপজ্জনক–হ্যাঁ একমাত্র এই শব্দটিই প্রয়োগের উপযুক্ত। কোমল মখমলের ওপর অধশায়িতা তার নিখুঁত অবয়ব দেখে সে সন্দেহ কার মধ্যে উপস্থিত হবে? সুগঠিত কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চিবুকটি দক্ষিণ হস্তের ওপর ন্যস্ত করে তিনি আড় হয়ে শুয়েছিলেন। তাঁর দীঘল কিন্তু ম্লান দুটি চক্ষু, প্রশংসনীয় কিন্তু অনমনীয় দুটি আঁখির দৃষ্টি, সম্মুখে বিস্তৃত–অটল সঙ্কল্পে স্থির সে দৃষ্টি। অবোধ্য শঙ্কার ছায়াবিজড়িত, ভয়াবহ সে দৃষ্টি। অনিন্দ্যসুন্দর তার আননটি শিশুর মতো কমনীয়, কিন্তু তবুও তাঁর ওই পেলব নমনীয়তার নীচে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে এক অনির্বচনীয় অথচ সুনিশ্চিত ভাব প্রকাশ, যে প্রকাশভঙ্গি বলে দিচ্ছে তার অন্তরে ক্রীড়া করছে এখন কুটিল চক্রান্তের দানবীয় উল্লাস। লক্ষ্য করা গেছে, এই বিশেষ ক্ষণটিতে কুকুরেও তাঁর কাছ থেকে এসেছে সরে, কোল থেকে অবুঝ শিশুও নেমে পালিয়েছে নিরাপদ দূরত্বে। যুক্তির অতীত এমন অনেক সহজাত ভাবাবেশ মনুষ্যকুলে আছে যা একেবারেই বুদ্ধির অগম্য।
বিশেষ করে এই অপরাহ্নে তিনি বেশ একটু বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাঁর হাতে একটি লিপিকা, সেটি তিনি বারংবার পড়েছেন এবং পড়তে পড়তে তার টানা-টানা নিখুঁত ভুরু দুটি হয়ে উঠেছে ঈষৎ কুঞ্চিত, সরস ওষ্ঠাধর দুটি হয়ে উঠেছে ঈষৎ কঠিন। অকস্মাৎ তিনি চমকিত চক্ষু তুললেন এবং দেহের চিতা সম ভয়াবহতা শঙ্কার ছায়াপাতে কোমল হয়ে উঠল। হাতের ওপর ভর দিয়ে তিনি উঠে বসলেন, দরজার ওপর স্থির হয়ে রইল তার চক্ষু দুটি। নিবিষ্ট মনে তিনি শুনছিলেন–শুনছিলেন এমন কিছু যা তার মনে জাগ্রত করত আতঙ্ক। মুহূর্তের জন্য তাঁর ভাবব্যঞ্জক মুখের ওপর খেলে গেল একটুকরো সুমিষ্ট হাসি। তারপরেই ভীত চক্ষে তিনি লিপিকাটি দ্রুতহস্তে ব্লাউজের ভেতরে ঢুকিয়ে দিলেন। ব্লাউজ থেকে হাত সরিয়ে নেওয়ার পূর্বেই উন্মুক্ত হয়ে গেল দরজা এবং ক্ষিপ্র চরণে কক্ষে প্রবেশ করলেন একটি সুদর্শন যুবক।
কুন্তল রায়চৌধুরী, তাঁর স্বামী! ইনিই সেই পুরুষ যিনি আজ তাঁর নবীন এবং অভিনব এক অভিজ্ঞতার একমাত্র প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
কুন্তল রায়চৌধুরীর বয়স প্রায় বছর তিরিশ, দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো, বাহুল্যবর্জিত আঁটসাঁট পোশাক সুগঠিত দেহটিকে জড়িয়ে আছে। হাতদুটি বুকের ওপর ভাঁজ করে দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন তার স্ত্রীর সুন্দর মুখপানে। কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে তখনও মনিকা রায়চৌধুরী তার স্বামীর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন। নির্বাক এই দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যে যেন প্রকাশ পেল ভয়ঙ্কর কিছু সম্ভাবনার। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে দৃষ্টির ভাষা দিয়ে প্রশ্ন করলেন এবং প্রত্যেকেই যেন দৃষ্টির মধ্যে দিয়েই খুঁজে পেলেন তার উত্তর। কুন্তল রায়চৌধুরী যেন জিগ্যেস করলেন, এ কী করলে তুমি? প্রত্যুত্তরে মনিকা দেবী যেন উত্তর দিলেন, তুমি জেনেছ কতটুকু? অবশেষে সম্মুখে অগ্রসর হলেন কুন্তল রায়চৌধুরী, স্ত্রীর পাশেই মখমলের কুশনের ওপর বসলেন এবং আলগোছে একটি সুগঠিত কান ধরে স্ত্রীর মুখটি নিজের পানে ফেরালেন।
মনি, আমায় তুমি বিষ দিচ্ছো?
আতঙ্কভরা মুখে এবং প্রতিবাদভরা দৃষ্টি নিয়ে মনিকা রায়চৌধুরী স্বামীর স্পর্শ থেকে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠলেন। এত দারুণ বিচলিত হয়েছিলেন তিনি যে, কথা বলতে পারছিলেন না–চঞ্চল হাত আর অস্থির অবয়বাদির মধ্যে প্রকাশ পেল তাঁর অন্তরের বিস্ময় আর ক্রোধ। কুন্তল রায়চৌধুরী আবার আর একটি প্রশ্ন করলেন এবং এইবার তার কণ্ঠে প্রকাশ পেল নিবিড় আন্তরিকতা।
কিন্তু কেন?
তুমি পাগল হয়েছে! উন্মাদ! রুদ্ধশ্বাসে বললেন মনিকা।
স্বামীর উত্তর তার রক্ত জমিয়ে দিল, অসহায় নৈঃশব্দ্য নিয়ে তিনি স্বামীর মুখপানে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন–তার বিবর্ণ ওষ্ঠাধর দুটি ঈষদোন্মুক্ত এবং গণ্ডদ্বয় রক্তহীন–পকেট থেকে একটি ছোট্ট বোতল বার করে কুন্তল রায়চৌধুরী স্ত্রীর চোখের সামনে ধরলেন।
তোমার জুয়েল-কেস থেকে পেলাম।
দুবার মনিকা দেবী কথা বলতে গেলেন, দুবারই হলেন ব্যর্থ। অবশেষে তার আকুঞ্চিত ওষ্ঠাধরের ফাঁক দিয়ে একটির পর একটি শব্দ এল বেরিয়ে
তোমাকে বিষ দিইনি। আবার কুন্তল রায়চৌধুরীর হাত প্রবিষ্ট হল পকেটে। একটা কাগজ বার করলেন, ভাঁজ খুললেন এবং স্ত্রীর সামনে ধরলেন।
ডাঃ মিত্রের সার্টিফিকেট। বোতলের তরল পদার্থে বার গ্রেন অ্যান্টিমনি আছে। যে কেমিষ্ট এটা বিক্রি করেছে, সে আমার সাক্ষী হবে।
মনিকা রায়চৌধুরীর মুখটি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। বলবার মতো আর কিছুই নেই। মারাত্মক ফঁদে পড়লে অসহায় হিংস্র প্রাণী যেভাবে তাকায়, তিনিও শুধু সেইভাবে রইলেন তাকিয়ে।
ঠিক আছে? জিগ্যেস করলেন কুন্তল রায়চৌধুরী। কোনও উত্তর এল না, কিন্তু মনিকা দেবীর মুখভাব দেখে মনে হল তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
কেন? জিগ্যেস করলেন কুন্তল–আমি জানতে চাই, কেন? কথা বলতে বলতে তিনি লক্ষ্য করলেন মনিকার ব্লাউজের ফাঁকে লিপিকার একটা কোণ। চক্ষের নিমেষে তিনি সেটা ছিনিয়ে নিলেন। হতাশভাবে চিৎকার করে মনিকা চেষ্টা করলেন লিপিকাটি ফিরে পেতে, কিন্তু একহাতে কুন্তল সেটি ওপরে তুলে ধরলেন এবং অপর হাতে স্ত্রীকে শক্ত করে ধরে লিপির ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিলেন।
সোম! বললেন রুদ্ধশ্বাসে? এ যে সোম!
লুপ্ত সাহস আবার ফিরে পেলেন মনিকা দেবী। গোপন করার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁর মুখটি কঠিন এবং দৃঢ় হয়ে উঠল। শাণিত ছুরিকার মতো ধারালো হয়ে উঠল চক্ষুদুটি।
হ্যাঁ, সোম। মাই গড! শেষকালে সোম।
উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে দ্রুত পায়চারী করতে লাগলেন কুন্তল। অপরেশ সোম! যে পুরুষটির সারাজীবন স্বার্থত্যাগ, সৎসাহস এবং শ্রেষ্ঠ পুরুষের উপযুক্ত গুণগরিমায় সমুজ্জ্বল, যে পুরুষটিকে তিনি তার অন্তরের স্বর্ণমণ্ডিত আসনে বসিয়েছেন, সেই অপরেশ সোমও শেষে এই নারীর কবলে পড়েছেন এবং এমন স্থানে উপনীত হয়েছেন যে বন্ধুর সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতেও তিনি সর্বতোভাবে প্রস্তুত। অবিশ্বাস্য, কিন্তু তবুও ওই লিপিকার আবেগময় মিনতিপূর্ব ভাষায় তাঁর স্ত্রীকে একটি কপর্দকশূন্য পুরুষের সাথে পলায়ন করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। অপরেশ সোম–একদিন যার হাতে কুন্তল রায়চৌধুরী হাত মিলিয়েছেন সখ্যের বন্ধনে, নিবিড়তর করেছেন পরিচয়–সেই সোম আজ লিখেছেন এই লিপিকা! কিন্তু পত্রের প্রতিটি শব্দ থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে কুন্তলের মৃত্যু অন্তত সোম মোটেই কল্পনা করছেন না। সমস্যার এ পৈশাচিক সমাধান উদ্ভূত হয়েছে একজনের কুটিল মস্তিষ্ক থেকে, যেখানে শয়তানই একমাত্র তার বাসের উপযুক্ত স্থান বলে মনে করে।
লক্ষ জনের মধ্যেও স্বতন্ত্র ছিলেন কুন্তল রায়চৌধুরী। দার্শনিক, চিন্তাশীল পুরুষ, প্রত্যেকের জন্য তাঁর উদার হৃদয়ে সঞ্চিত থাকত অপার সহানুভূতি। কিন্তু মুহূর্তের জন্য বিষিয়ে উঠল তার অন্তর। সেই মুহূর্তটিতে তিনি অপরেশ সোম এবং স্ত্রীকে হত্যা করতে পারতেন এবং কর্তব্যনিষ্ঠ দৃঢ়-সঙ্কল্প পুরুষের মতো মৃত্যুর সম্মুখীন হতে দ্বিধাবোধ করতেন না। কিন্তু পায়চারী করতে করতে ইতিমধ্যেই যুক্তিস্নিগ্ধ চিন্তাধারায় স্তিমিত হয়ে এল তার মানসিক উগ্রতা। সোমের অপরাধ কি? তাকে দোষ দেবেন কী করে? এই নারীর মোহলীলা তাঁর অজানা নেই। মোহ-বিস্তার শুধু তার অপরূপ দৈহিক সৌন্দর্যের দ্বারা নয়; পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার কৌতূহল জাগ্রত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা এর আছে; পুরুষটির অন্তরতম বিবেককে ইনি খুঁচিয়ে জাগিয়ে তোলেন এবং তিনি যে তাকে উচ্চাশা আর মহান কর্তব্যের দিকে অনুপ্রাণিত করে নিয়ে যাচ্ছেন, এই জাতীয় ধারণা পুরুষটির মনে প্রবেশ করিয়ে দিতে পারেন। মনিকা দেবীর মোহপাশের মারাত্মক চাতুর্যই হল ওইখানে। কুন্তলের মনে পড়ল নিজের ক্ষেত্রে কীভাবে এ মোহ তাঁকে বেষ্টন করেছিল। মনিকা দেবী, যতদূর কুন্তলের বিশ্বাস, সে সময় বন্ধনহীনই ছিলেন। তারপর তাদের বিবাহ হল সাঙ্গ। কিন্তু ধরা যাক, তিনি বন্ধনহীন ছিলেন না, ধরা যাক তিনি বিবাহবন্ধনে পূর্ব হতেই ছিলেন আবদ্ধ এবং ধরা যাক ঠিক এইভাবেই তিনি তার চিত্তকে বন্দি করেছিলেন। এরপর কি তিনি তখন ক্ষান্ত হতে পারতেন? পারতেন কি অপূর্ব বাসনা নিয়ে দূরে সরে যেতে? কখনই না। অন্তরের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও তিনি তা করতে পারবেন না। তাহলে যে বন্ধুটি আজ এই একই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার ওপর মনকে তিনি কেন তুলবেন বিষিয়ে? অপরেশ সোমের কথা চিন্তা করে অনুকম্পা আর সহানুভূতিতে তার অন্তর পূর্ণ হয়ে গেল।
আর ওই নারীটি? পাশেই অর্ধশায়িতা এই সেই মোহিনী, হতভাগ্য সুন্দরী নারী–স্বপ্ন তার চূর্ণ, ষড়যন্ত্র তার উদঘাটিত, ভবিষ্যৎ তার অন্ধকার এবং বিপদসঙ্কুল। আর তবুও যে মহিলাটি তাঁকে বিষ প্রয়োগ করতে প্রস্তুত হয়েছে, তার জন্যেও তার চিত্ত হল আর্দ্র। তিনি ওর জীবনেতিহাসের কিছুটা জানেন। তিনি জানেন, ওর চাতুর্য, ওর সৌন্দর্য বাধা কাকে বলে তা জানে না। আর আজ একজন তার পথের প্রতিবন্ধক হয়েছেন, তাই ও উন্মাদের মতো নিমর্ম ষড়যন্ত্রে সে প্রতিবন্ধক দূর করতে হয়েছে বদ্ধপরিকর। অত্যন্ত প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত রাজবংশে কুন্তল রায়চৌধুরীর জন্ম। সারাটা জীবন তিনি শিক্ষা, কৃষ্টি আর শান্ত পরিবেশের মধ্যে মানুষ হয়েছেন। পক্ষান্তরে মনিকা দেবীর সারা জীবনে উদ্দামতা, আলোক-উচ্ছ্বাসের উল্লাসে ভরপুর, প্রকৃতির অমোঘ ধর্মানুযায়ী তারা ক্ষণেকের জন্য পরস্পরের প্রতি আকর্ষিত হয়েছেন, কিন্তু স্থায়ী বাঁধন অসম্ভব। এ বিষয়ে তাঁর চিন্তা করে দেখা উচিত ছিল, উপলব্ধি করা উচিত ছিল এই পরিণামের। তাঁর শিক্ষিত এবং সংযত মস্তিষ্কের ওপর এখন নির্ভর করছে সকল দায়িত্ব। সমস্যাপীড়িত অসহায় নাবালকদের ওপর যেভাবে মনটি অনুকম্পায় ভরে ওঠে, মনিকা দেবীর পরিণামের কথা ভেবে কুন্তলেরও চিত্ত দ্রবীভূত হয়ে উঠল। এতক্ষণ তিনি নীরবে ঘরের মধ্যে পায়চারী করছিলেন, ওষ্ঠ দৃঢ়বদ্ধ, হস্ত দুটি মুষ্টিবদ্ধ–শেষকালে হাতের তালুতে নখের দাগ গেল বসে। এখন তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে মনিকার পাশে বসলেন এবং মনিকার ঠান্ডা নিরাসক্ত হাতটি নিজের ওপর তুলে নিলেন। তার মস্তিষ্কে একটি চিন্তা হল জাগ্রত। সাহস না দুর্বলতা? প্রশ্নটি তার কানে বেজে উঠল, চোখের সামনে মূর্তি পরিগ্রহ করল এবং যেন কল্পনার চোখে দেখতে পেলেন যে জগতের সম্মুখে বড় বড় অক্ষরে সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
কঠিন দ্বন্দ্ব, কিন্তু জয়ী হলেন তিনি।
মনিকা, আমাদের দুজনের মধ্যে একজনকে পছন্দ করে নিতে হবে তোমাকে। সোম যদি তোমাকে সুখী করতে পারে, তাহলে আমি সরে যাব।
বিবাহ-বিচ্ছেদ? রুদ্ধশ্বাসে মনিকা বললেন।
বিষের বোতলটি বেষ্টন করে ধরল কুন্তলের হাতটি? একেও তুমি ভাবতে পার। বললেন তিনি।
কুন্তলের ওপরে চোখ তুললেন মনিকা দেবী। নতুন এক অদ্ভুত প্রভায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল তার চক্ষুদুটি। এ মানুষটি এতদিন তার কাছে ছিল অপরিচিত। সেখানে সংযত, বাস্তবধর্মী, দৃঢ়চিত্ত কুন্তল রায়চৌধুরী অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তার স্থলে তিনি যেন দেখতে পেলেন মহাবীর এক শহীদকে, যিনি স্বার্থলেশশূন্য চিত্তধর্মের অমানবিক উচ্চতায় উন্নীত। তীব্র কালকূটের বোতলটি তিনি দুহাতে চেপে ধরলেন।
আমাকে ক্ষমা করো তুমি!
মৃদু হাসলেন কুন্তল : এখনও সেই ছোট্ট খুকিটিই আছ দেখছি।
দু-হাত কুন্তলের দিকে বিস্তার করলেন মনিকা। ঠিক সেই সময়ে দরজায় টোকার শব্দ শোনা গেল এবং ঘরে প্রবেশ করলো একটি পরিচারিকা। এই রহস্যময় কক্ষে যেভাবে প্রত্যেকে করে চলাফেরা, ঠিক সেই রকম অদ্ভুত নিঃশব্দে সে প্রবেশ করল। ট্রের ওপর একটি কার্ড। মনিকা সে দিকে এক লহমা তাকালেন।
অপরেশ সোম! আমি দেখা করবো না।
লাফিয়ে উঠলেন কুন্তল :
অভ্যর্থনা করে নিয়ে এসো। এই মুহূর্তে।
কয়েক মিনিট পরে দীর্ঘ, উন্নতনাসা, প্রশস্ত ললাট একজন যুবাপুরুষ ঘরে প্রবেশ করলেন। স্মিত বদনে প্রফুল্ল ভঙ্গিতে তিনি ঘরে ঢুকলেন। কিন্তু যখন দরজা তার পেছনে হল রুদ্ধ এবং সম্মুখের মুখ কটির ওপর পরিস্ফুট হল স্বাভাবিক ভাবপ্রকাশ, তখন ধীরে-ধীরে তার মুখ থেকে মিলিয়ে গেল হাসির শেষ রেশটুকুও। দুজনের মুখ পর্যায়ক্রমে দেখে নিলেন। বললেন, মতলব কী?
কুন্তল এবং তার কাঁধের ওপর একটি হাত রাখলেন।
বদ মতলব অন্তত নয়–কুন্তলের জবাব।
বদ মতলব?
আমি সব জানি। কিন্তু আমাদের অবস্থা পাল্টাপাল্টিভাবে হয়ে গেলে আমিও তাই করতাম।
এক পা পিছিয়ে গেলেন সোম এবং প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে মনিকার দিকে তাকালেন। মনিকা মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন, তারপর মনোরম গ্রীবাটি পুনরায় সোজা করলেন।
মৃদু হাসলেন কুন্তল :
স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ফাঁদ পেতেছি বলে শঙ্কার কোনও কারণ তোমার নেই। এ বিষয়ে আমাদের খোলাখুলি কথা হয়ে গেছে। শোন অপরেশ, চিরকাল তুমি স্পোর্টসম্যান। এখানে এই বোতলটা দেখ। কীভাবে এটা এল এখানে, তা নিয়ে চিন্তা করো না। যদি আমাদের মধ্যে একজন এটা পান করে তাহলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মনি, এবার বেছে নাও।
রহস্যময় ঘরটিতে সক্রিয় হয়েছিল আরও একটি রহস্যঘন শক্তি। কক্ষের মধ্যে উপস্থিত ছিল চতুর্থ একটি পুরুষ। যদিও জীবন-নাটকের সঙ্কটম মুহূর্তে তিনটি প্রাণী তার সম্বন্ধে মোটেই চিন্তা করেনি, করবার অবসরও ছিল না। কতক্ষণ ধরে সে সেখানে আছে, কতটুকু সে শুনেছে, কেউ বলতে পারে না। তিনটি প্রাণীর ক্ষুদ্র দল হতে বেশ খানিকটা দূরে দেওয়াল-গাত্রে সে গুঁড়ি মেরে বসেছিল। ভয়াবহ সর্পাকৃতি তার গঠন, নীরব এবং দক্ষিণ হস্তের ঈষৎ স্পন্দন ব্যতীত সর্বদেহ-স্থির। একটি চতুষ্কোণাকৃতি বস্তুর অন্তরাল থেকে সে রয়েছে দৃষ্টির অগোচরে এবং একটি কৃষ্ণবস্ত্র এমনভাবে বস্তুটিকে আচ্ছাদিত করেছে যে তারও অবয়বাদি লক্ষ্য করা যায় না। নিবিষ্ট মনে নাটকের প্রতিটি আবেগময় মুহূর্ত সে গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করছে, তার মধ্যস্থতা করার সময় প্রায় আসন্ন। কিন্তু অপর প্রাণীত্রয় তার বিষয়ে চিন্তা করল খুবই অল্প। নিজেদের অভিনীত উদ্বেগ আর শিহরণময় নাটকে তারা এমন গভীরভাবে মগ্ন যে, চক্ষু এড়িয়ে গেল তাদের চেয়েও অধিকতর সক্রিয় একটি শক্তির, যে শক্তি যে-কোনও মুহূর্তে দৃশ্যের পরিচালনা-ভার তুলে নিতে পারে স্বহস্তে।
প্রস্তাবে প্রস্তুত, অপরেশ? কুন্তল প্রশ্ন করলেন। দীর্ঘ পুরুষটি মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন।
না! না! চিৎকার করে উঠলেন মনিকা।
ছিপি খুলে ফেললেন কুন্তল। পাশের টেবিল থেকে এক প্যাকেট তাস তুলে নিলেন। কার্ড এবং বোতল রইল পাশাপাশি।
মনিকার ওপর আমরা দায়িত্বটুকু ছেড়ে দিতে পারি না। বললেন তিনি ও এস অপরেশ, তিনের মধ্যে একটি বেছে নাও।
অপরেশ টেবিল অভিমুখে অগ্রসর হলেন। অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিলেন মৃত্যুনিদেশী তাসগুলি। স্ত্রীলোকটি হাতের ওপর ভর দিয়ে সম্মুখে ঝুঁকে পড়লেন এবং উদভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে রইলেন তাকিয়ে।
আর ঠিক এই সময়ে যেন বজ্রপাত হল। আগন্তুক উঠে দাঁড়িয়েছে। বিবর্ণ এবং গম্ভীর সে।
আচম্বিতে তিনজনেই তার উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন। প্রত্যেকে তার দিকে ফেরালেন মুখ। চোখে তাঁদের ব্যগ্র অনুসন্ধিৎসা। আগন্তুক শান্ত, বিষণ্ণভাবে তাঁদের দিকে তাকাল। কর্তৃত্বব্যঞ্জক তার আকৃতি।
একি হলো? একসাথে প্রত্যেক শুধোলেন। রাবিশ! উত্তর দিলে সে রাবিশ! সমস্ত রীলটা আবার আমাদের আগামীকাল তুলতে হবে!
* রহস্য-পত্রিকায় প্রকাশিত। বৈশাখ ১৩৬৩।