ভানুমতীর খেল

ভানুমতীর খেল

ভানুমতীর খেল ছাড়া আর কি, বিরক্তকণ্ঠে বললে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী।

অশরীরী ছাড়া কারো পক্ষে আরুণিকে খুন করা সম্ভব নয়। সুতরাং এটা খুন নয়, আত্মহত্যা।..বলে, কফির কাপে প্রচণ্ড শব্দে চুমুক দিল সে।

কথা হচ্ছিল আমার বৈঠকখানায়। আড্ডার আসর জমিয়েছিল বন্ধুবর ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ হিসাবে ওকে আমার কলমে ঠাই দিয়েছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে, আমার চাইতে ওর নামই বেশি। যাক সে কথা।

নির্ভেজাল সেই আড্ডার আসরে ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হল আমার আর একটি গোয়েন্দা বন্ধু–জয়ন্ত চৌধুরী। সরকারের নুন খেয়ে গোয়েন্দাগিরি করে বলে ইন্দ্রনাথ তাকে যখন তখন ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বিধিয়ে বিঁধিয়ে উপহাস করে। বলে–রামভক্ত হনুমান, সরকারভক্ত জাম্বুবান।

সেদিনও এই জয়ন্ত এসে আমাদের খোশগল্পের আসরটি পণ্ড করে দিল। এমন একটা অবিশ্বাস্য অপঘাত কাহিনি বর্ণনা করল যা আত্মহত্যা ছাড়া কিছুই নয়। অথচ লোকান্তরিত লোকটার পরিচিতবর্গের জবানবন্দী থেকে মনে হয় হত্যা। বেশ ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে আটঘাট বেঁধে হত্যা।

তাই জয়ন্ত চৌধুরীর মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। গরুখোঁজা খুঁজে বার করেছে ইন্দ্রনাথকে। এক নিঃশ্বাসে বিবৃত করেছে আদ্যপান্ত ঘটনাটা। সবশেষে মন্তব্য করেছে–একে যদি হত্যাকাণ্ড বলতে হয় তো বলব ভানুমতীর খেল। অথচ ছোটকর্তা টিটকিরি দিয়ে বললেন কিনা জয়ন্ত, তুমি এবার রিটায়ার করো। এটা সাজানো আত্মহত্যা। আসলে খুবই ইনটেলিজেন্ট মার্ডার। আমার ইনটেলিজেন্স নিয়ে এ হেন কটাক্ষ, বলুন দিকি বৌদি, সহ্য করা যায় কি?

গৃহিণী কবিতা মুখ টিপে হেসে বলেছে–সত্যিই তো।

ইন্দ্রনাথ, তোর কী মনে হয়, গলার শির তুলে চেঁচিয়ে বলেছে জয়ন্ত। |||||||||| তোর কী মনে হয়, সেটা বল। ইজ ইট এ মার্ডার? তাই যদি হয়। প্ল্যানচেট করে পি সি সরকারের প্রেতকে নামালেই হয়–আমাকে কেন? কুহক বিদ্যেটা আমি শিখিনি। ইন্দ্রজাল আর রহস্যের জাল কি এক জিনিস হল?

ইন্দ্রনাথ তখন গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। ঠোঁটের কোণে ঝুলছিল আধপোড়া কচি। ধোঁয়ার সুতো কাঁপতে কাঁপতে স্পর্শ করছিল কড়িকাঠ। ওর কবি কবি মুখটিও উথিত সেইদিকে–স্বপ্ন-ছাওয়া চাহনি নিবদ্ধ কড়িকাঠের টিকটিকিটার ওপর। বলল উদাস গলায়–জয়ন্ত, টিকটিকিটা দেখেছিস?

টিকটিকি! জয়ন্ত খাবি খেল যেন।

স্কাইলাইট থেকে বেরিয়ে কড়িকাঠ বরাবর হাঁটছে টিকটিকিটা। আমি যদি ওকে মনে করি হত্যাকারীর হাত, তাহলেই তো হত্যার সমাধান হয়ে যায়।

টিকটিকি! হত্যাকারীর হাত। ইন্দ্রনাথ আমার মাথার অবস্থা ভালো নয়। বেশি ইয়ার্কি মারলে তোকেই খুন করে বসতে পারি।

চোখ নামিয়ে প্রশান্ত হাসল ইন্দ্রনাথ। টানাটানা চোখে কৌতুক উপচে পড়ল। বলল বুদ্ধিদীপ্ত ধীর কণ্ঠে–জাম্বুবান কি সাধে বলেছি!

ফের।

ছোটকর্তা ঠিকই বলেছেন, এটা হত্যা, আত্মহত্যা নয়।

কীভাবে? কীভাবে? কীভাবে? তড়াক করে লাফিয়ে চিলের মতো চেঁচিয়ে উঠল জয়ন্ত। এমন জোরে চেঁচালো যে টিকটিকিটা সুড়ুৎ করে উধাও হল স্কাইলাইটের ফোকরে! সেইদিকে আঙুল তুলে বলল ইন্দ্রনাথ–ওই ভাবে!

হেঁয়ালির আগের ঘটনাটা এবার বলা যাক।

ফিরোজা থিয়েটার এই রহস্যকাহিনির অকুস্থল। থিয়েটারটি ব্রিটিশ আমলের। অনেক ইতিহাস, অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই প্রমোদ নিকেতন দীর্ঘ একশো বছর ধরে আমোদ বিতরণ করে এসেছে রসিকদের মধ্যে। ফিরোজা থিয়েটারের চাইতে বড় থিয়েটার হালে তৈরি হয়েছে শহরে। কিন্তু এমন জমকালো কোনওটাই নয়। এ থিয়েটারে প্রবেশ করলেই মনের মধ্যে যেন সাতটা কোকিল গান গেয়ে ওঠে। মান্ধাতা আমলের লিফটে চড়ে তিনতলায় ওঠবার পর বিশাল নাট্যশালার বিশালতা মাথা ঘুরিয়ে দেয়। সাহেবদের কাণ্ডই আলাদা। এ-হেন ফিরোজা থিয়েটারে নতুন নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। মহড়া শেষ হতে হতেই রাত আটটা বেজে যায়। রোজই বাড়ি ফিরতে রাত হয় তপন আর সুলতার।

তপন ফিরোজা থিয়েটারের বাঁধা বাজিয়ে আর গাইয়ে। ওর দরাজ গলায় গান আর সুরেলা পিয়ানো সঙ্গীত না থাকলে কোনও নাটকই জমে না। চেহারাটিও ভালো। তাই স্টেজেও নামতে হয়। নাটক লেখা হয় সেইভাবেই। সুলতা ওর নতুন বিয়ে করা বউ। রূপসী। ফিরোজা থিয়েটারের যা কিছু নাটক রচনার দায়িত্ব ওর কাঁধে। সুলতার সংলাপ এত মিষ্টি, এত তেজালো, এত নাটকীয়, যে দর্শকরা ওর নামে পাগল।

ফিরোজা থিয়েটারেই দুজনের পরিচয়। প্ৰণয় এবং পরিণয়।

সেদিনও রাত করে ফ্ল্যাটে ফিরল তপন আর সুলতা। সুলতা শাড়ি পালটে টান টান হল শয্যায়, উদরাগ্নি হোটেলেই নিভিয়ে আসা হয়েছিল। সুতরাং জামা খুলতে গিয়ে তপন চমকে উঠল। মানিব্যাগটা ফেলে এসেছে স্টাফরুমে।

সুলতার তখন ঘুম এসে গেছে। মানিব্যাগ স্টাফরুমে পড়ে আছে শুনে জড়িত কণ্ঠে বলল–কালকে গেলেই পাবেখন। এসে শুয়ে পড়ো।

তপন বললে–তা হয় না। মানিব্যাগ ভর্তি টাকা রয়েছে। ড্রেসিং রুমেও চাবি দেওয়া থাকে না। সকালে ঝাড়ুদার আসে। তার চাইতে আমি এখুনি গিয়ে নিয়ে আসি। এই তো তিন মিনিটের রাস্তা। যাব আর আসব।

এসো, বলে পাশ ফিরে পাশবালিশে পা তুলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সুলতা। রাত তখন দশটা। ফিরোজা থিয়েটার খাঁ-খাঁ করছে। সামনের ফটক দিয়ে প্রবেশ করল তপন। সিঁড়ি বেয়ে উঠল দোতলায়। দেখল, সামনেই লিফট। লিফটম্যান নেই। অসময়ে কোনওদিনই থাকে না। বলতে গেলে সারা ফিরোজা থিয়েটারে একটি মাত্র প্রাণী ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি থাকে না। নাম তার ইস্পাহানি।

ইস্পাহানি সম্বন্ধে দু-চার কথা এই সুযোগে বলে নেওয়া যাক। কেন না, দুর্ভেদ্য এই অপঘাত-রহস্যে বড় রকমের স্থান জুড়ে রয়েছে এই মানুষটা।

ইস্পাহানির বয়স সত্তরের ওপরে। লোকে বলে তার চোখে ছানি পড়েছে। কিন্তু সে তা মানতে রাজি নয়। ইস্পাহানির চুল সাদা, দাড়ি লাল, ভুরু কালো। সব চাইতে আশ্চর্য তার দৈর্ঘ্য। এ রকম বেঁটে গুড়গুড়ে বামন মূর্তি পিগমিদের দেশে পাওয়া যায়। কলকাতার পথে ঘাটে পাওয়া যায় না। মাত্র আড়াই ফুট লম্বা বাঁটকুল মূর্তি–তার ওপর চুল-দাড়ি-ভুরুর রং তিন রঙের।

ইস্পাহানিকে সংগ্রহ করেছিলেন ফিরোজা থিয়েটারের মুসলমান মালিক পারস্যের পথ থেকে। থিয়েটারের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে তার চাকরি হয় পঞ্চান্ন বছর আগে। ক্রমে ক্রমে প্রকাশ পায় তার অসাধারণ প্রভুভক্তি যা নাকি সারমেয়দের সমতুল্য। এরকম বিশ্বাসভাজন ভক্তি এ যুগে বিরল। তাই রাত্রি নিশীথে গোটা ফিরোজা থিয়েটারের রক্ষণাবেক্ষণের ভার তার একার–আর কারো নয়।

তিনতলায় ইস্পাহানির ঘর। রাত গম্ভীর হলেই দরজা খুলে চারপাইয়ের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে থাকে সে। আর আলবোলা সাজিয়ে ভুরুক ভুরুক করে তামাক খায়। এইটাই একমাত্র নেশা ইস্পাহানির। বিয়ে-থা সে করেনি।

একটা কথা আবার পুনরাবৃত্তি করা যাক। দরজা খুলে তাম্রকুট সেবন করে ইস্পাহানি। কারণ নাকি ধোঁয়ায় তার দম আটকে আসে। এটা তার বহু বছরের অভ্যেস।

খোলা দরজার বিপরীত দিকে আর একটা ঘর। এ-ঘর জাঁদরেল নায়ক আরুণির। ফিরোজা থিয়েটারে এমনি ঘর আরো আছে। করিডরের দু-পাশে সারি সারি স্টাফ রুম। থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিজনের বরাদ্দ একটি বিশ্রাম ঘর। কমন গ্রীনরুমে অনেকেই যেতে চায় না–নিজের নিজের ঘরই তাদের পছন্দ। ড্রেসিংরুম বলতে এই স্টাফরুমকেই বোঝায়। তিনতলার ওপরে ছাদ।

রাত দশটায় স্টাফরুম থেকে নিজের মানিব্যাগ উদ্ধার করে লিফটে উঠল তপন। কিন্তু নির্জন নিশ্চুপ থিয়েটার ভবনে একা-একা লিট চালানোর ছেলেমানুষি হঠাৎ পেয়ে বসল ওকে। দোতলা থেকে নীচে না নেমে সটান উঠে গেল তিনতলায়। কোলাপসিবল গেট-এ ফাঁক দিয়ে দেখল ইস্পাহানির দরজা খোলা। আলো জ্বলছে। তামাকের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। যথারীতি তাম্রকুটের নেশায় আবিল হয়েছে বৃদ্ধ।

আরো দেখল, আরুণির ঘরের দরজাও দুহাট করে খোলা। সে ঘরেও জ্বলছে আলো।

লিফট চালিয়ে একতলায় নামল তপন।

রাস্তায় বেরিয়ে কিছুদূর যেতে না যেতেই একটা গাড়ি উল্কাবেগে এসে ব্রেক কষল ফটকের সামনে। দরজা খুলে হন্তদন্ত হয়ে নামলেন ডক্টর লুঙ্খা। ফিরোজা থিয়েটারের স্টাফ ডক্টর।

একটু বিস্মিত হল তপন। এত রাতে জনহীন থিয়েটারে কার চিকিৎসার দরকার পড়ল? পরক্ষণেই চিন্তা মুছে গেল মন থেকে ঘুমের দৌরাত্ম্যে।

ঘুম একেবারেই ছুটে যেত চোখ থেকে যদি আরুণির ঘরে উঁকি দিত তপন। দেখত, কড়িকাঠ থেকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে একটা সদ্য-ঝুলন্ত দেহ।

আরুণির দেহ!

পরের দিন সকালে হইচই পড়ে গেল ফিরোজা থিয়েটারে। ডক্টর লুথরা বললেন টেলিফোনে তলব করেছে আরুণি স্বয়ং। টেলিফোন অবশ্য তিনি নিজে ধরেননি। ধরেছিল ওঁর দাসী মন্থরা। মন্থরাকে জেরা করল জয়ন্ত চৌধুরী। আমতা-আমতা করে মন্থরা বললে–এজ্ঞে, তিনিই আরুণিবাবু কিনা জানব কেনে? বললেন তো আরুণিবাবু বলছি, ডাক্তারবাবুকে এক্ষুনি থিয়েটারে পাঠিয়ে দাও। ভীষণ বিপদ।

জয়ন্ত মুখ ভেংচে চমকে উঠেছিল–কেমনে আবার জানবে? আরুণিবাবু? কখনো ফোন করেননি ডাক্তারবাবুকে? করেছিলেন তবুও গলা চিনতে পারলে না?

ভয়ে কাঁটা হয়ে বললে মন্থরা–এজ্ঞে, তার গলা তো ভারি। মনে তো হয় উনি নন।

অর্থাৎ কেসটা ঘোরালো হল। অন্য কেউ যদি ফোন করে থাকে, তাহলে সে কে? সেই কি নাটের গুরু হত্যাকারী না, আত্মহত্যার চাক্ষুষ সাক্ষী?

উভয়ক্ষেত্রেই তপন ফেঁসে যাচ্ছে। পুলিশের ছোটকর্তার তীব্র ধারণা মেনি মুখো ওই গাইয়ে বাজিয়ে লোকটা হয় হত্যাকারী, নয় হত্যাকারীর শাগরেদ। আরে বাবা, তুমি যদি অতই সাচ্চা পার্টি হবে তো খামোকা লিফট চালিয়ে তিনতলায় উঠতে গিয়েছিলে কেন? তোমার ঘর তো দোতলায়? তাছাড়া, কোনওদিন তোমার মানিব্যাগ নিতে ভুল হয় না, ভুল হল সেইদিনই যেদিন চিত্রগুপ্ত তাঁর জাবদাখাতায় তেঁড়া মারলেন আরুণির নামের পাশে?

কিন্তু এর পাল্টা যুক্তিও আছে। তপনকে কেউ দেখেনি ফিরোজা থিয়েটারে রাত দশটায়। তা সত্ত্বেও সে কবুল করেছে। না করলেও পারত। সে যদি নাটের গুরুই হবে তো যে–খবর কেউ জানে না, সে-খবর পুলিশকে বলে খাল কেটে কুমির ডাকবে কেন?

তাছাড়া, ডক্টর লুথা বলছেন, আরুণির হৃদপিণ্ড পরীক্ষা করে তিনি তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন। ধুকধুক করে তখনও হার্ট কাজ করে চলেছিল–নিঃশ্বাস যদিও পড়ছিল না। এরকম অবস্থা নাকি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ার মিনিট দু-তিন পর পর্যন্ত থাকে। উনি কোরামিন ছুঁড়েও অবশ্য হার্ট আর চালু করতে পারেননি। তাছাড়া, ঘাড়ের কাছে মেরুদণ্ডর হাড় ভেঙে গিয়ে যার মৃত্যু ঘটেছে, তার হার্টে কোরামিন দিয়েও কোনও লাভ ছিল না। তবে একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

ডাক্তার যখন ফোন পান, তখনো জীবিত ছিল আরুণি। সে কড়িকাঠে ঝুলেছিল, ডাক্তার তার কাছে পৌঁছোনোর মিনিট দু-তিন আগে।

কিন্তু সে সময়ে তপন ছাড়া আর কেউ তো আসেনি থিয়েটারে?

সুতরাং হয় তপন হত্যাকারী, না হয় আরুণি নিজেই আত্মঘাতী হয়েছে। ঠিক তার আগেই গলা পালটে ফোন করেছে ডাক্তারকে অভিনেতার পক্ষে যা অসম্ভব নয় মোটেই।

আরও তথ্য প্রকাশ পেল।

মদ্যপান করেছিল আরুণি। জিনের বোতল আর গেলাস ছিল ঘরের মধ্যেই। জিনের মধ্যে মেশানো ছিল পেমবুটাল। ঘুমের ওষুধ। এত বেশি মাত্রায় ছিল যে মরবার আগে বেহুঁশ হয়ে গিয়েছিল আরুণি।

বেহুশ হয়ে গিয়েছিল। হুঁশ ছিল না। তবে ফোন করেছিল কে? নিশ্চয় সে নয়। তাহলে?

হত্যাকারী।

কিন্তু হত্যাকারী ঘরে ঢুকল কী করে? ডাক্তার পৌঁছোনোর দু-তিন মিনিট আগে দড়ি থেকে ঝোলানো হয়েছে বেহুঁশ দেহটাকে। সে সময় দরজার দিকেই তাকিয়েছিল ইস্পাহানি। আরুণি বাবুর ঘরে কাউকে সে ঢুকতে দেখেনি। বেরোতেও দেখেনি। মোটে দু-তিন মিনিটের তো মামলা।

অথচ ডাক্তার এসে দেখল তখনো হার্ট চলছে আরুণির।

ইস্পাহানি আরও বলল। নটা নাগাদ ক্যাসানোভা এসেছিল আরুণির ঘরে। আরুণি তখন সবে পাবলিক বার থেকে সুরার নেশা নিয়ে ফিরেছে। রোজ রাতের মতোই আর এক প্রস্থ মাল টানা শুরু করেছে স্টাফরুমে। এমনি সময়ে এল ক্যাসানোভা।

ক্যাসানোভা! ঐতিহাসিক নাম! চরিত্রহীনতায়, লাম্পট্যে, নারী বিলাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক ক্যাসানোভা। এ নাম তার পিতৃদত্ত নাম নয়। ধর্মেও সে খ্রিস্টান নয়। কিন্তু তবুও তার নাম ক্যাসানোভা হয়ে গিয়েছে ক্যাসানোভা নাটকে নায়কের সফল অভিনয়ের পর। একাদিক্রমে পাঁচশো রজনী অভিনয়ের পর স্তাবকদের দৌলতে আসল নামটি বিস্মৃত হল মুগ্ধ দর্শকরা…লোকে মুখে চালু হয়ে গেল ক্যাসনোভা নামটা।

সেই ক্যাসানোভা এসেছিল আরুণির ঘরে। বিদায় নিয়েছিল আধঘণ্টা পর। তারপর ইস্পাহানি আর কাউকে দেখেনি সে ঘরে ঢুকতে।

অথচ রাত দশটায় প্রাণবায়ু বিলীন হল আরুণির। ক্যাসানোভা বিদায় নিয়েছে সাড়ে নটায়। সুতরাং সে নিরপরাধি। তপন লিফটে থেকে নামেনি। ইস্পাহানির সামনে আসেনি–সুতরাং সে-ও নিরপরাধ।

আরুণির অপঘাত মৃত্যুর হেতু তাহলে একটাই–সুইসাইড।

জয়ন্ত এই পর্যন্ত এসে তদন্তে যবনিকা টানতে চেয়েছিল।

কিন্তু প্রশ্ন উঠল কশেরুকার ভাঙা হাড়টা নিয়ে। ডাক্তার বললেন–নিশ্চয় কেউ নীচ থেকে দু-পা ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়েছিল। ফলে কশেরুকার হাড় ভেঙেছে। অথচ মৃত্যুকালীন কষ্ট লাঘবের জন্যে গলা ঘিরে তুলোর প্যাড রেখেছিল আরুণি–তারপর ছিল দড়ি। মৃত্যুপথযাত্রীর পক্ষে এটুকু আরামের আয়োজন হাস্যকর সন্দেহ নেই, কিন্তু বিরল ঘটনাও নয়।

কেসটা তাহলে আত্মহত্যার।

কিন্তু পা ধরে টেনে কশেরুকার হাড় ভাঙল কে?

জানা গেল আরো একটা তথ্য। আরুণির ট্রাউজার্সের তলার দিকে গোড়ালির ঠিক ওপরে ভাঁজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে সেখানে দেখা গেল পাটের ফেঁসো। অর্থাৎ দুটো পা শক্ত করে বেঁধে ছিল কেউ। হয়তো হ্যাঁচকা টান দিয়ে কশেরুকার হাড় ভেঙে চম্পট দেওয়ার সময় খুলে নিয়ে গিয়েছে পায়ের দড়ি।

অদ্ভুত! অদ্ভুত! ঘাটে এসেও তরী ডুববে নাকি? আত্মহত্যার ফতোয়া দিয়ে ইনভেসটিগেশন শিকেয় তুলতে চেয়েছিল জয়ন্ত, কিন্তু…!

জেরার মুখে অবশ্য প্রকাশ পেয়েছিল কতগুলো চাঞ্চল্যকর সংবাদ।

আরুণি মদ ভালোবাসত। আর ভালোবাসত সুন্দরী মেয়ে। চরিত্রে সে ক্যাসানোভা। মদের চাট হিসেবে রূপসী নাহলে তার দিবস রজনী অন্ধকার। এহেন আরুণি প্রথমে ঝুঁকেছিল সুলতার দিকে। কিন্তু সুলতা ঝুঁকেছিল তপনের দিকে। তপনও চেয়েছিল সুলতাকে সুতরাং যথাসময়ে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। বিয়ের পরেই একদিন স্টেজের মহড়ায় নাটকের পাট সংলাপের পরিবর্তে নিজস্ব সংলাপ ব্যবহার করল আরুণি। কদর্য ভাষার সংলাপ নিক্ষিপ্ত হল তপনের উদ্দেশ্যে।

কেলেঙ্কারি বেশিদূর এগোবার আগেই সুলতা স্বামীকে নিয়ে বেরিয়ে এল স্টেজ থেকে। পরের দিন সুলতার ফ্ল্যাটে গিয়ে তপনের কাছে ক্ষমা চেয়ে এল আরুণি। অকপটে বললে, ঈর্ষায় অন্ধ হয়ে ব্যর্থতার জ্বালায় আর মদের নেশায় মাথা ঠিক রাখতে পারেনি সে।

তপন ভুলে গেল বিষয়টা। ভুলল না কেবল সুলতা। বললে–ওগো, আমরা মেয়েরা পুরুষদের হাড় পর্যন্ত দেখে ফেলি। আরুণি মোটেই অনুতপ্ত হয়নি। তুমি কিন্তু সাবধানে থেকো বাপু!

তপন ঘাবড়ে গিয়ে বলেছে–কী করে থাকব বলো?

রিভলভারটা কোথায়?

স্টিল আলমারিতে। কেন?

কোমরে গুঁজে রেখো।

ধ্যাৎ! বিচ্ছিরি রকমের উঁচু হয়ে থাকে। নাটক লিখে লিখে তোমার কল্পনাশক্তি বিপজ্জনকভাবে বেড়ে গেছে দেখছি।

মাসখানেক পরেই কিন্তু ঘটল ছোট্ট একটা ব্যাপার।

যে সময়ে নিজের ঘরে ঢোকার কথা নয়, সেই সময়ে হঠাৎ ঘরে এসে পড়েছিল তপন। ঢুকেই দেখল, কী আশ্চর্য। ওর ক্রিমের জার থেকে চুরি করছে আরুণি। আঙুলে তুলে তুলে রাখছে নিজের জারে।

অভাবনীয় দৃশ্য। প্রথমে থতমত খেয়েছিল আরুণি।

পরক্ষণেই বলেছে সপ্রতিভভাবে–কিছুতেই মেক আপ উঠছে না আমার ক্রিমে। তাই তোমার ক্রিম নিয়ে একটু ট্রাই করছিলাম, বলে, তপনের মন্তব্য শোনার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল আরুণি।

ফ্ল্যাটে ফিরে সুলতাকে ক্রিম বৃত্তান্ত জানাল তপন। বলল–আরুণির মাথায় ছিট আছে।

তাই কি? ভুরু কুঁচকে ভারি মিষ্টি করে বললে সুলতা। অতই যদি ওর ক্রিমের ওপর লোভ তো জারটা ওকে দিয়ে দিও। আমি তোমার জন্যে ক্রিমের শিশি কিনে এনেছি। এই দ্যাখো।

নতুন ক্রিমটা বাস্তবিকই উঁচুদরের। সুতরাং বিনা দ্বিধায় সেইদিন থেকেই বাতিল হয়ে গেল পুরোনো ক্রিমের শিশি। দিন কয়েক পরে হঠাৎ ক্যাসনোভা বললে–ধুত্তোর, আমার ক্রিমটা গেল ফুরিয়ে, তপনদা, একটু ক্রিম ধার দেবেন?

তপন উদার গলায় বললে–ধার কেন, একেবারেই দান করছি। এই নাও! তোমার সুলতাদি আমাকে একটু নতুন শিশি এনে দিয়েছে বলে, পুরোনো ক্রিমের জারটা চালান করে দিল ক্যাসানোভাকে।

ক্রিম পেয়ে ক্যাসানোভা তো মহা খুশি। দামি দামি ক্রিম ছাড়া আজেবাজে ক্রিম ব্যবহারের বিরোধী সে। কারণ, তার একজিমা। থুতনির ঠিক তলায় বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বিশেষ এই চর্মরোগটিতে অনামী ক্রিম লাগাতে চায় না বলেই এত খুঁতখুঁতে সে!

ক্রিমের ব্যাপার মিটল এখানেই। ইতিমধ্যে আবার একটা কেলেঙ্কারি ঘটল স্টেজের পেছনে–পর্দার অন্তরালে।

মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারি। মূলে সেই একজনই–লম্পট আরুণি!

ক্যাসানোভা রোমান্টিক অভিনয়ে বিখ্যাত। চেহারাটিও তার লেডি কিলার টাইপের। রীতিমতো রোমিও রোমিও একহারা ছিপছিপে চেহারা। মাথাভরা ঢেউ খেলানো চুল। নাক-মুখ চোখা চোখা, বুদ্ধিদীপ্ত। রং সাহেবদের মতো টকটকে লাল। ক্যাসানোভা চরিত্রকে সে জীবন্ত করেছিল শুধু চেহারার রোমান্স দিয়ে।

চেহারা যার রোমান্টিক তার অন্তরেও রোমান্স থাকা স্বাভাবিক। রোমান্স-সরোবরে হিল্লোল জাগিয়েছিল থিয়েটারেরই একটি মেয়ে। ক্যামেলিয়া। ক্যামেলিয়া যিশুর উপাসক। কিন্তু আচারে আচরণে তা বোঝা মুশকিল। ক্যামেলিয়া ফর্সা নয়–কালো। কিন্তু কালোবরণ মেয়ে যে চোখ জুড়োতে পারে, ক্যামেলিয়া তার প্রমাণ। তার পদ্মদীঘির মতো টলটল চোখ, ঢলঢলে মুখশ্রী আর কলকলে কণ্ঠস্বর শুনে প্রেক্ষাগৃহ মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ে, পুরুষরা মোহিত হয়, নারীরা ঈর্ষান্বিত।

সেই ক্যামেলিয়াকে সহসা স্টেজের পেছনে দড়ির গাদায় ফেলে আরুণি..ক্যামেলিয়ার কোমল তনু ননী দিয়ে গড়া নয়। আরুণির কবল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে দেরি লাগেনি। ক্ষতির মধ্যে ব্লাউজটা একটু ছিঁড়ে গিয়েছিল। আর এগোতে পারেনি আরুণি।

সমস্ত ব্যাপারটা ঘটল অতি নিঃশব্দে। ঠিক সেই সময়ে সুলতা এসে পড়ে সেখানে। আঁচল দিয়ে বুক ঢেকে হাঁপাতে হাঁপাতে ক্যামেলিয়া তখন বেরিয়ে আসছে অন্ধকারের মধ্যে থেকে। পেছনে টলমলায়মান আরুণি–দুই হাত তখনো সামনে প্রসারিত–মুখে মদের গন্ধ। সুলতাকে দেখেই যেন জোঁকের মুখে নুন পড়েছিল। সুট করে উধাও হয়েছিল আরুণি।

উনিশ বছরের সদ্যফোঁটা ক্যামেলিয়া তখন কেঁদে ফেলেছিল সুলতার কাঁধে মাথা রেখে। সুলত চেয়েছিল ব্যাপারটা থিয়েটার কর্তৃপক্ষের কানে তোলা হোক। পাঁচ কান হোক এবং আরুণিকে বিদেয় করা হোক। সে থাকতে এ-থিয়েটারে নারীর ইজ্জৎ অক্ষুণ্ণ রাখা অসম্ভব।

ক্যামেলিয়া কিন্তু রাজি হয়নি। বলেছে–না সুলতাদি, কেলেঙ্কারি বাড়িয়ে লাভ নেই। কেলেঙ্কারিতে মেয়েরা পুড়ে মরে, পুরুষদের গায়ে আঁচ লাগে না। কথাটা সত্যি।

জয়ন্ত প্রশ্ন তুলেছিল–বেশ তো, ধরা যাক, আরুণি সুইসাইড করেনি, মার্ডাড হয়েছে। কিন্তু কেন? বিনা লাভে কেউ মানুষ খুন করে না। আরুণিকে খুন করে কার কী স্বার্থসিদ্ধি হচ্ছে, তা দেখা যাক।

কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরোলো তখনি।

আরুণির ব্যাঙ্ক ব্যালান্স নেহাত কম ছিল না। অকৃতদার নায়কের তহবিল কখনো শূন্য থাকে না। মা কমলা যেন কাঁপ ভরে টাকা দিয়েছিলেন তাকে। আরুণির মৃত্যুতে এ-টাকা পাচ্ছে তার একমাত্র ভাই অরণ্যকুমার।

অরণ্যকুমার থাকে দার্জিলিংয়ে। বহুবার বিদেশ সফর করেছে সে। সারা পৃথিবী নাম জানে তার। সেতারের জাদুকর অরণ্যকুমার যে-ছবিতে মিউজিকের ভার নেয়, তা সুপারহিট করে।

আরুণির মতো সে মদ বা মেয়েমানুষের ভক্ত নয়। কিন্তু তবুও তার ভঁড়ার শূন্য। অর্থ সঞ্চয় করা তার কোষ্ঠিতে লেখেনি। কারণ আর কিছুই নয়–মানুষটা অসম্ভব খামখেয়ালী। নিত্য নতুন উদ্ভট খেয়ালের পেছনে টাকা উড়িয়ে সে ফতুর। তার ওপর অতিরিক্ত মাত্রায় দুমুখ। ফলে মিউজিক ডিরেকশনের অফার নিয়ে কেউ চৌকাঠ মাড়াচ্ছে না ইদানীং। দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে। দু-দুটো ছবির মিউজিক অর্ধেক শেষ করে সে-নাকি গা ঢাকা দিয়েছিল হিমালয়ের অন্য অঞ্চলে। আরুণি ইহলোক ত্যাগ করেছে, এ-খবর তাকে জানানো হয়েছিল টেলিগ্রাম মারফৎ। জবাব এল ফিরতি টেলিগ্রাম। অদ্ভুত সেই টেলিগ্রামের বাংলা মানে এই,

উল্লসিত হলাম। অনেক মাসের প্রতীক্ষা সফল হল। সত্যিই কি আত্মহত্যা? খবরদার আমাকে যেন বিরক্ত করা না হয়।

অরণ্যকুমার

জয়ন্ত যথাসময়ে জেরা করেছিল তাকে। জিগ্যেস করেছিল সৃষ্টিছাড়া এই টেলিগ্রামের প্রকৃত অর্থ কী? কেন সে ভায়ের মৃত্যুতে এত উল্লসিত? অরণ্যকুমার জানিয়েছিল, শুধু সেতার দিয়ে একটা অভিনয় প্রোগ্রাম মঞ্চস্থ করতে চেয়েছিল সে। টাকা চেয়েছিল আরুণির কাছে, পায়নি। জয়ন্ত তখন বলেছিল, এর পরিণাম কিন্তু খুব খারাপ। পুলিশ তাকেই সন্দেহ করছে ভাই-ঘাতক হিসেবে। শুনে বিষম কৌতুক অনুভব করেছিল অরণ্যকুমার। শুধু জিগ্যেস করেছিল–আরুণির টাকাগুলো কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?

রাগে ফুলতে ফুলতে ফিরোজা থিয়েটারে ফিরে এসেছিল জয়ন্ত। তখনি জানতে পেরেছিল, ক্যামেলিয়ার ওপর বলাৎকারের গোপন সংবাদ।

খটকা লেগেছিল জয়ন্তর মনে। তবে কি প্রিয়তমার ওপর বলাৎকারের প্রতিশোধ নিয়েছে ক্যাসানোভা? কিন্তু কী করে?

এর দুদিন পরেই সুলতার পীড়াপিড়িতে আর্যমতে ক্যাসানোভার সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল ক্যামেলিয়ার।

বিয়ের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খুন হতে হতে বেঁচে গেল সুলতা।

.

ক্যামেলিয়া বলেছিল–সুলতাদি, বিয়ের ইচ্ছে তো দুজনেরই। কিন্তু দুজনেই পিছিয়ে যাচ্ছি দুটো কারণে।

যথা? জিগ্যেস করেছিল সুলতা।

ক্যামেলিয়া যদি ফর্সা হত, তাহলে কথাটা বলতে গিয়ে আরক্ত হত। কালো বলে হল বেগুনি। আঁচলের খুঁট আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল–কি-ই বা বয়স আমার। এই সময়ে বাচ্চাকাচ্ছা হওয়া মানেই কেরিয়ার নষ্ট হওয়া। হেসে ফেলল সুলতা–এই ব্যাপার! একেবারেই ছেলেমানুষ তুমি। ওটা কোনও ওজোর নয়। বাচ্ছা না চাইলে হবে কেন?

কিন্তু–

আবার কিন্তু কি?

ক্যাসানোভার শরীর মোটেই ভালো যাচ্ছে না।

একজিমা বেড়েছে বলে?

না না। দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে, চোখে অন্ধকার দেখছে একটু পরিশ্রম করলেই, পেটের অসুখ তো লেগেই রয়েছে।

ও সব হল ব্যাচেলারের রোগ। বিয়ের জল পড়লেই সেরে যায়, বলে সস্নেহে ক্যামেলিয়ার চিবুক ধরে নেড়ে দিয়েছিল সুলতা।

বিয়ের পর পার্কস্ট্রিটের অভিজাত রেস্তোরাঁয় ম্যারেজ-ডিনার দিল ক্যাসানোভা। খানাপিনার টেবিলে বসে এই কথারই জের টেনে নিয়ে বললে সুলতা–ক্যামেলিয়া বিয়ে করে এক ঢিলে দু-পাখি মারল।

পাখি দুটোর নাম? শুধোলো তপন।

ক্যাসানোভার কাহিল শরীর এবার ক্যামেলিয়া-টনিকে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

আর?

বর্বর দুপেয়ে নারী শিকারিদের লোলুপ নজর ক্যামেলিয়ার ওপর আর পড়বে না।

চামচ নামিয়ে রেখে মৃদুকণ্ঠে বললে ক্যাসানোভা–আপনি আরুণির কথা বলছেন তো? সে তো আগেই মরেছে।

টেবিল নিস্তব্ধ। তারপর বলল সুলতা–তুমি কিছু বলেছো বুঝি ক্যাসানোভাকে?

স-ব, দুষ্টু হেসে বলল ক্যামেলিয়া। না বললে পেট ফুলে মরেই যেতাম। এমন ঢঙে কথাটা বলল ক্যামেলিয়া যে টেবিলের প্রত্যেকেই দুম করে ফেটে পড়ল দমকা হাসিতে হাসতে হাসতে বললে সুলতা–আরুণির মৃত্যুটা যেন মাধ্যাকর্ষণের ত্রিশঙ্কুর-পাওয়া।

কথাটার মানে?–খুক খুক করে হাসতে হাসতে শুধোলো ইন্সপেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী। ভোজসভায় হাজির থাকতে বাধ্য হয়েছিল সে কর্তব্যের তাগিদে। সদ্য মরেছে একটা মানুষ, এর মধ্যেই বিয়ের এত ঘটা কেন বাপু?

সুলতা ঠোঁট উল্টে বললে–মানে আবার কি? মাধ্যাকর্ষণের টানে আছাড় খেলে জানি ঘাড়ের হাড় ভাঙে। কিন্তু আরুণি মাধ্যাকর্ষণকে কলা দেখিয়ে শূন্যে ঝুলল ত্রিশঙ্কুর মতো, অথচ ঘাড়ের হাড়টি ভাঙল মট করে।

তবে হাড়টা ভাঙল কী করে? কড়িকাঠের ধাক্কায়? উল্টো মাধ্যাকর্ষণ নাকি?

গম্ভীর ভাবে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল জয়ন্ত। এ প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই। জানার সুযোগও পেল না। দুদিন পরেই হত্যাকারী হানা দিল সুলতার ফ্ল্যাটে।

তপন ফিরোজা থিয়েটারে গিয়েছে। সুলতা মার্কেট থেকে ফিরেছিল ফ্ল্যাটে। দরজা বন্ধ করে এক কাপ কফি বানাচ্ছে আর গুণ গুণ করে গান গাইছে। ফিরোজা থিয়েটারে কেও যেতে হবে এখুনি। এমন সময়ে দরজায় টক-টক-টক শব্দ হল।

অন্যমনস্কভাবে এক পাল্লার ফ্লাসডোর ঈষৎ ফাঁক করেছিল সুলতা। কিন্তু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে কিছু দেখবার আগেই একটা হাত দেখা গেল। হাতে খানিকটা কালো কাপড়। চক্ষের নিমেষে সুলতার চোখে চেপে ধরল হাতটা। আর একটা হাত বেষ্টন করল কণ্ঠনালী। হাতের অধিকারী প্রবেশ করল ভেতরে এবং একইভাবে চোখ আর গলার ওপর যুগপৎ চাপ বৃদ্ধি করে চলল সর্বশক্তি দিয়ে। কোনওরকম শব্দ করতে পারল না সুলতা। বুঝল সে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। ফুসফুসটা বাতাসের অভাবে যেন ফেটে যাচ্ছে। পুরোপুরি অজ্ঞান হওয়ার আগে দরজার বাইরে শুনল মেয়েলি কণ্ঠের ডাক–সুলতা আছো? তারপর আর কিছু মনে নেই সুলতার।

জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর দেখল, সে শুয়ে আছে লাগোয়া বাথরুমে। গলায় বেশ ব্যথা। অতিকষ্টে দরজা পেরোলো সুলতা। শোবার ঘরে কেউ নেই। খাবার ঘর শূন্য। বসবার ঘরও তাই। তেপায়ার টুলটার ওপর জেডপাথরের কনফিউসিয়াসের মুর্তি চাপা ছোট্ট একটা চিরকুট ছাড়া ঘরের মধ্যে বেমানান কিছুই চোখে পড়ল না। চিরকুটটা তুলে নিল সুলতা। গোটা গোটা হরফে মেয়েলি ছাঁদে একটি মাত্র পংক্তি:

সুলতা, নতুন নাটকের একটা কপি এনো। প্রকাশক চেয়েছে।

আখতার ফিরোজা থিয়েটারের পুরোনো নায়িকা। এখন ছোটখাটো পার্ট করে। স্বামীর বইয়ের কারবার। সুলতার সব নাটক বেরোয় ওইখান থেকেই।

জ্ঞান হারানোর ক্ষণ-পূর্ব ডাটা মনে পড়ল। আখতারের গলাই বটে। হত্যাকারী ওই ডাক শুনেই ওকে টেনে নিয়ে গেছে বাথরুমে। আখতার দরজা খোলা দেখে ভেতরে এসেছে। শোবার ঘরে, খাবার ঘরে, বসবার ঘরে কাউকে না পেয়ে চিরকুট রেখে গেছে।

আচ্ছন্নের মতো খাবার টেবিলে বসে পড়ল সুলতা। কফি কাপটা টেনে নিল ঠোঁটের কাছে।

.

ফিরোজা থিয়েটারে ফোন এল তপনের নামে। ডাকছে সুলতা।

কী ব্যাপার ডার্লিং? উচ্ছল কণ্ঠে বলল তপন। এত দেরি কেন?

ক্লান্ত কণ্ঠে বলল সুলতা–ওগো, আমাকে কফির মধ্যে বিষ খাইয়ে মারবার চেষ্টা চলছে। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।

.

তীব্র অ্যাকোনাইট মিশানো ছিল কফির কাপে। রাসায়নিক পরীক্ষায় ধরা পড়ার অনেক আগেই স্বাদের তারতম্য থেকে সন্দেহ হয়েছিল সুলতার। কফির কাপ ঠোঁটের কাছে টেনে নিয়ে ভাবছিল–হাতে পেয়েও তার ধড়ে প্রাণটা রেখে গেল কেন হত্যাকারী? দয়া? উঁহু! নিশ্চয় অন্য পন্থায় নিকেশ করার আয়োজন করে গেছে। কফির কাপে বিষ মিশিয়ে দিয়ে যায়নি তো? গরম কফির কাপ টেবিলেই ছিল কিনা…

চুমুক দেয়নি সুলতা। আঙুলে করে এক ফোঁটা নিয়ে জিভের ডগায় রেখেছিল। চিন চিন করে উঠেছিল স্বাদ-সচেতন রসনা-কেন্দ্রগুলো। এ-স্বাদ তার প্রিয় কফির স্বাদ নয়। একটু তফাৎ আছে।

তাই বেঁচে গেল সুলতা।

কিন্তু ধনেপ্রাণে মারা পড়ার উপক্রম হল জয়ন্ত বেচারী। একি ফ্যাসাদ! একটা খুনের (!) নিষ্পত্তি হতে না হতেই আবার একটা খুনের প্রচেষ্টা! তবে কি আরুণি সত্যিই নিহত হয়েছে? সুলতা হয়ত জানে হত্যাকারীর পরিচয়–তাই তার মুখ বন্ধ করার জন্যেই বিষ নিয়ে হত্যাকারী ফের নেমেছে হত্যার আসরে? কে সেই হত্যাকারী? আখতার? কিন্তু হত্যার চেষ্টা করে কেউ চিরকুট রেখে নিজের নাম লিখে ঘোষণা করে যায়? ধুত্তোর! ঠিক এই সময়ে আরও একটা কথা মনে পড়তেই মাথা ঘুরে গেল জয়ন্তর। আখতারের ড্রেসিংরুমে নেমবুটাল ভর্তি শিশি থাকত। কারণ নিদ্রাহীনতা ছিল তার ক্রনিক ব্যাধি। আরুণির অপঘাত-মৃত্যুর কিছুদিন আগে নেমবুটাল ভর্তি শিশিটা চুরি গিয়েছিল তার ঘর থেকে। আরুণির মৃত্যু হওয়ার পর জানা গেল, তার জিনের বোতলে মেশানো ছিল নেমবুট।

আসলে হয়তো আদৌ চুরি যায়নি শিশিটা সন্দেহের আওতা থেকে রেহাই পাবার জন্যেই সাফাই গেয়েছে আখতার!

কিন্তু আখতার খুন করবে কেন? প্রৌঢ়ার ওপরেও কি নজর দিয়েছিল লম্পট আরুণি?

.

আরও দুদিন পর সাংঘাতিক একটা কাণ্ড ঘটল ফিরোজা থিয়েটারে। জোর কদমে রিহার্সাল চলছে। তপন দোতলায় নিজের ঘরে স্বরলিপি ওলটাচ্ছে। এমন সময়ে পাংশুমুখে উঁকি দিল ক্যামেলিয়া–ওকে দেখেছেন?

কাকে? ক্যাসানোভাকে?

হ্যাঁ। শরীরটা খারাপ করছে বলে হঠাৎ কোথায় যে গেল!

শরীর খারাপ ছিল? তাহলে বাড়ি গিয়েছে।

না, না। বাড়ি যাওয়ার হলে আমাকে বলত। দুজনের একসঙ্গেই যে বাড়ি ফেরার কথা। বলতে বলতে ক্যামেলিয়া কেঁদে ফেলে আর কি। তপনদা ও কোথায় গেল?

ক্যামেলিয়ার ভীতির কারণ অনুমান করা যায়। আরুণির রহস্যজনক মৃত্যুর এখনো কিনারা হয়নি। অথচ সুলতার প্রাণ নিয়ে টানাটানি আরম্ভ হয়ে গেছে। আবার মরণের ডংকা বাজায়নি তো হত্যাকারী? এবার হয়তো ক্যাসানোভার প্রাণ

উঠে পড়ল তপন। উদ্বিগ্ন ক্যামেলিয়াকে নিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজল সারা ফিরোজা থিয়েটার।, ক্যাসানোভা ফটক পেরোয়নি। অথচ থিয়েটারেও নেই। তবে গেল কোথায়? হনুমানের মতো ছাদ থেকে লক্ষ্য দিয়ে চম্পট দেয়নি তো?

শেষের সম্ভাবনাটা এসেছিল জয়ন্ত গোয়েন্দার উর্বর মগজে। থিয়েটারেই হাজির ছিল সে নতুন কোনও সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টায়। ছাদ থেকে লক্ষ্য প্রদানের সম্ভাবনাটা মাথায় আসতেই খেয়াল হল, সব দেখা হয়েছে–শুধু ছাদটা দেখা হয়নি।

ছুট! ছুট! ছুট! জিরাফ-দৌড় দৌড়ে লম্বা লম্বা লাফ মেরে লোহার মই পেরিয়ে ছাদে পৌঁছোলো জয়ন্ত তপন আর ক্যামেলিয়া।

আরুণির ঘরের কড়িকাঠ ফুঁড়ে উঁচু স্কাইলাইট আর লিফট-এর কলকজা ঢাকা ছোট্ট শেডটার মাঝামাঝি জায়গায় মুখ থুবড়ে শুয়েছিল সুদর্শন ক্যাসানোভা। হাত কয়েক দূরে খানিকটা বমি। সারা দেহে কোনও চোট নেই। দেহে প্রাণ নেই। শুধু একটু ফিকে বিস্ময় লেগে আছে রোমান্টিক মুখে।

.

ক্যামেলিয়া ফিট হয়ে গিয়েছিল। প্রাণহীন আর জ্ঞানহীন দুটি দেহকে লোহার মই বেয়ে নীচে নামানো হল অতি কষ্টে। জয়ন্ত বিদ্যুত্বাতির নীচে দেখল, ক্যাসানোভার জিভ অস্বাভাবিক ফোলা, চোখের পাতাও লাল এবং ফুলো, হাতের চেটো কর্কশ এবং খড়িওঠা আঙুলের নখ ঘিরে সাদা পাটি। একজিমা থুনির নীচ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দুই গালে।

আর্সেনিক পয়জনিং। একদিনের বিষক্রিয়া নয়–দীর্ঘদিনের। সবকটা লক্ষণই তাই। বিশেষ করে চর্মরোগ। অথচ আগে একজিমা থাকায় অতটা গা দেয়নি ক্যাসানোভা। যদি দিত, চর্মরোগের অকস্মাৎ বিস্তার নিয়ে যদি ডাক্তার কনসাল্ট করত, তাহলে প্রাণটা বেঘোরে যেত না। বেচারা!

সন্দেহ এসে পড়ল ক্যামেলিয়ার ওপর। এ-ধরনের মেয়েরা সব পারে। স্ত্রী ছাড়া খাবারে বিষ মেশাবে কে? ঘেয়ো স্বামীকে বোধহয় মনে ধরেনি। তাই

সুতরাং ভানুমতীর খেল নিয়ে অর্ধোন্মদ জয়ন্ত গোয়েন্দা একজন ছোটখাটো গোয়েন্দা মোতায়েন করল ক্যামেলিয়ার পেছনে। তারপর চলে এল আমার ডেরায় ইন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়ে। জরুরি অবস্থায় যোগাযোগের জন্যে আমার টেলিফোন নাম্বার দিয়ে এল ক্ষুদে গোয়েন্দাকে।

শুধু সেই জন্যেই বেঁচে গেল একটা প্রাণ!

.

এই পর্যন্ত ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করেছিল ইন্দ্রনাথ রুদ্র। এমন শান্ত সুন্দর স্বপ্নিল চোখে তাকিয়ে সিগারেট টানছিল যে মনে হচ্ছিল যেন কালিদাস, শেক্সপীয়ার, রবীন্দ্রনাথ একযোগে ভর করেছেন তার কল্পনাকেন্দ্রে। সবশেষে উদাস গলায় অবতারণা করেছে টিকটিকি প্রসঙ্গ। টিকটিকিটা ছাদের স্কাইলাইট দিয়ে এসে, কড়িকাঠ বরাবর হাঁটছিল।

ইন্দ্রনাথ তখন বলেছিল, টিকটিকিটাকেই যদি হত্যাকারীর হাত কল্পনা করা যায়, তাহলেই তো সমাধান হয়ে যায় হত্যা রহস্যর।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বিকট বিশ্রী গলায় পেঁচিয়ে জানতে চেয়েছিল জয়ন্ত গোয়েন্দা কীভাবে? কীভাবে? কীভাবে?..

চেঁচামেচিতে বোধহয় ভড়কে গিয়েই অথবা ঘরের বাতাস অপছন্দ হওয়ায় ঠিক সেই মুহূর্তেই সুড়ুৎ করে স্কাইলাইট দিয়ে উধাও হয়েছিল টিকটিকিটা। ইন্দ্রনাথ সেইদিকে আঙুল তুলে বলেছিল– ওইভাবে।

.

শুনে চেঁচাতেও ভুলে গেল জয়ন্ত গোয়েন্দা। পুলিশী হুংকার বিস্মৃত হয়ে অসহায়ের মতো চাইল কবিতার দিকে, আমার দিকে। নীরবে যেন বলতে চাইল–দ্যাখো, তোমাদের ইন্দ্রনাথের ফচকেমিটা দ্যাখো। মরছি নিজের জ্বালায়, এখন কি ইয়ার্কি করবার সময়।

কবিতার শিরদাঁড়া কিন্তু সিধে হয়ে গিয়েছিল টিকটিকির দিকে ইন্দ্রনাথ আঙুল তুলতেই। অক্ষম লেখক স্বামীর এই সক্ষম গোয়েন্দা বন্ধুটিকে সে চেনে। ও জানে, প্রগলভ ইন্দ্রনাথ যখন সহসা দুর্বোধ্য হয়ে যায়, নিজেই একটা ধাঁধা হয়ে যায়, তখনি বুঝতে হবে ওর ভেতরের ধাঁধা আর ধাঁধা নেই–সরল হয়ে গিয়েছে।

কন্দর্পকান্তি ইন্দ্রনাথ রুদ্রর ওপর তাই অবিচল আস্থা আর অপরিসীম ভক্তি আমার গৃহিণীর। বাইরে কিন্তু বিরাম নেই খুনসুটির। সম্পর্কটি ভারি মধুর, আমার বেশ লাগে ওদের কপট কলহ দেখতে।

ইন্দ্রনাথের টিকটিকি-ধাঁধা শুনেই তাই মুখিয়ে উঠল আমার সুন্দরী বধূ। ডাগর চোখ ঘুরিয়ে গোল মুখ আরও গোল করে যেন তুবড়ি ফোঁটালো শাণিত রসনায়–ঠাকুরপো, তুমি মার্চ মাসে জন্মেছো নিশ্চয়? ওই সময়ে রবি মীন চিহ্নে ছিল নিশ্চয়?

হকচকিয়ে গেল ইন্দ্রনাথ–কেন? কেন? কেন?

জিভের মোচড় দিয়ে অদ্ভুতভাবে ভেংচে বললে কবিতা–কেন? কেন? কেন? কেন? ওই সময়ে যারা জন্মায়, তারা মদ আর মাদক দ্রব্যে অত্যন্ত আসক্ত হতে পারে। তা কি মহাশয়ের জানা নেই?

কিন্তু–

কিন্তু আবার কি? তেড়ে উঠল কবিতা–কোকেন গাঁজার নেশা না থাকলে এই রকম একটা সিরিয়াস মোমেন্টে টিকটিকি নিয়ে অর্বাচীনের মতো কেউ কথা বলে?

আরে বউদি, অসহায় কণ্ঠস্বর ইন্দ্রনাথের–সমস্যার সমাধান তো গল্প শুনতে শুনতেই করে ফেলেছি। তাই–

তাই বিভ্রান্ত জয়ন্ত ঠাকুরপোকে আরও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছ? দর বাড়াচ্ছো, না?

কি মুশকিল! কি মুশকিল!

মুশকিল আসান তো তোমার হাতেই বন্ধু, গৃহিণীর হাতে বন্ধুবরের নাকানিচোবানির দৃশ্য দেখে ব্যঙ্গ কণ্ঠে বললাম আমি–আরুণি যদি নিহতই হয়ে থাকে তো হত্যাকারীর নামটা বলে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

ধাঁ করে যদি বলেই দিলাম, তাহলে সাসপেন্স রইল কোথায়?

আইভরি থাকলে কিন্তু তখন তর সইত না, টিটকিরি দিল কবিতা।

আইভরি মানে মিস আইভরি লাহা। ইন্দ্রনাথ রুদ্রর সুযোগ্যা সহকারিণী।

শার্লক হোমস ক্লাব মামলায় তার আবির্ভাব ঘটেছিল বিপুল বিস্ময়, কৌতুক আর রহস্যের মধ্যে দিয়ে। এক খোঁচাতেই কাজ হল।

দু-হাত মাথার ওপর তুলে বলল ইন্দ্রনাথ–আর না, বউদি, সারেন্ডার করছি। হত্যাকারীর নাম–

ঠিক সেই সময়ে ঝন ঝন করে বাগড়া দিল টেলিফোনটা। খপাং করে রিসিভার তুলল কবিতা, ধরন দেখে মনে হল রিসিভার ছুঁড়ে মারতে পারলেই বাঁচে তারের অপর প্রান্তের মানুষটিকে।

কাকে চাই? জয়ন্ত চৌধুরীকে? আছেন।

লাফিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলল জয়ন্ত। মিনিটখানেক পরে নামিয়ে রাখল। ঘুরে দাঁড়িয়ে বললে অদ্ভুত স্বরে–আমার টিকটিকির ফোন। ক্যামেলিয়ার পেছনে গিয়েছিল ন্যাশানাল লাইব্রেরির রিডিং রুমে। ক্যামেলিয়া সেখানে বিষবিজ্ঞানের বই নিয়ে আর্সেনিক পয়জনিংয়ের চ্যাপ্টার খুলে পড়ছে। আশ্চর্য! ক্যামেলিয়ার মতো মেয়ে মানুষ খুন করে?

মেয়েরা সব পারে, সুযোগটাকে লুফে নিয়ে কবিতার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে যেন শোধ তুলল ইন্দ্রনাথ। ওরা দেবী হতে পারে, দানবীও হতে পারে।

শ্লেষটা দাগ কাটল না কবিতাকে। বিমূঢ়কণ্ঠে ও বললে–ক্যামেলিয়া? দুদিন যেতে না যেতেই নিজের হাতে বরণ করল বৈধব্য?

পা নাচাতে নাচাতে বললে ইন্দ্রনাথ–বলিহারি যাই মেয়েদের বুদ্ধিকে। বউদি, সাসপেন্স কিন্তু শেষ হল না–সবে শুরু হল।

আবার সাসপেন্স!

কী করি বলো। আমি নিরুপায়। জয়ন্ত জিপ এনেছিস?

কেন?

আর একটা খুন ঠেকাতে হবে। বলতে বলতে গম্ভীর হয়ে গেল ইন্দ্রনাথ। তপন-সুলতার টেলিফোন নাম্বার জানা আছে?

আছে।

ডায়াল কর..কে ধরেছে? বলতে বলতে সর্বাঙ্গ টানটান হয়ে উঠল ইন্দ্রনাথের।

রিসিভার নামিয়ে বলল জয়ন্ত–একটু আগে একটা চিরকুট এসেছিল তপনের নামে। চিরকুটে বলা হয়েছে অমুক ঠিকানায় যেন এক্ষুনি চলে আসে তপন।

কে বলেছে?

জয়ন্ত চৌধুরী।

জয়ন্ত চৌধুরী! মানে জাল চিঠি। তুই তো এখানে, বলতে বলতে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল ইন্দ্রনাথ। চুল খামচে ধরে বললে–কি গাধা আমি! খামোকা সময় নষ্ট করলাম এতটা! এখুনি না বেরোলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঠিকানাটা মনে আছে?

আছে।

ভানুমতীর খেল

চল।

দুড়দাড় করে দুই বন্ধু নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

.

ঠিকানায় যথাসময়ে পৌঁছোল দুজনে।

বাড়িটা ন্যাশনাল লাইব্রেরীর ধারে কাছেই। নির্জন পাড়া। বাড়িটা দোতলা। একতলায় থাকে একটা পাঞ্জাবি পরিবার।

হুড়মুড় করে দোতলায় উঠল দুই গোয়েন্দা। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা ঝুলছে বাতাস কে বলল জয়ন্ত–হ্যারে, এ যে গ্যাসের গন্ধ!

তুই বাতাস শুঁকবি না, দরজা ভাঙবি? খেঁকিয়ে উঠল ইন্দ্রনাথ। উৎকণ্ঠায় মেজাজ তিরিক্ষে হলে যা হয় আর কি।

জয়ন্ত দরজার পাল্লার দিকে চেয়ে বললে–মজবুত দরজা রে। তার চাইতে তালাশুদ্ধ কড়া উপড়ে আনা যাক।

বলে, জিপ থেকে হাতখানেক লম্বা একটা লোহার রড নিয়ে এল সে। কড়ায় ঢুকিয়ে সামান্য চাড় দিতেই খসে পড়ল কড়া।

নিস্তব্ধ ঘরগুলো যেন নিঃশব্দে হেসে উঠল ওদের উদভ্রান্ত মুখচ্ছবি দেখে। কোনও ঘরে কেউ নেই।

অথচ তীব্র হয়েছে গ্যাসের গন্ধ। বাকি ছিল একটা ঘর। রান্নাঘর। শেকল খুলে ভেতরে ঢুকতেই পাওয়া গেল তপনকে জ্ঞানহীন, কিন্তু তখনো প্রাণহীন নয়।

.

গ্যাসের চাবি বন্ধ করে দরজা জানলা খুলে দিল ইন্দ্রনাথ। পাখা চালিয়ে দিয়ে জল ছিটে দিতেই চোখ মেলল তপন। বলল তার আহাম্মকের মতো আচরণ বৃত্তান্ত। জয়ন্ত চৌধুরীর হস্তলিপির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। তবুও শমন পেয়ে ছুটে এসেছিল এই ঠিকানায়। কারণ আর কিছুই নয়। ঠিকানাটি তার পরিচিত। সঙ্গে এনেছিল রিভলভার।

ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। ঢুকতেই পেছন থেকে ডাণ্ডা পড়ল মাথায়। তারপর আর কিছু মনে নেই।

রিভলভারটা? নেই। কোমরে নেই, ঘরের কোথাও নেই। যাওয়ার সময়ে হত্যাকারী নিয়ে গেছে হত্যার আর একটা হাতিয়ার।

ঘড়ির দিকে তাকিয়েই চমকে উঠল তপন–সর্বনাশ! আজকে যে আমাদের শো শুরু হচ্ছে। ইন্টারভ্যালের পর থেকেই যে পিয়ানোয় বসতে হবে আমাকে।

এই অবস্থায়? চটে গিয়ে বললে জয়ন্ত। প্রাণটা ফিরে পেয়েছেন স্রেফ ইন্দ্রনাথের বুদ্ধির জোরে। এখনো টলছেন আপনি। এখন বাজনা আসবে?

আসবে। গোঁয়ারের মতো দরজার দিকে টলতে টলতে এগিয়েছে তপন। আজকের প্রথম শোয়ে হাজির আমাকে থাকতেই হবে।

.

শো আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। চাপা উত্তেজনায় থমথম করছে ফিরোজা থিয়েটার গ্রীনরুম। তপন এখনও আসেনি।

ইন্টারভ্যাল হয়ে গেল। তবুও তপন এল না। নিঃসীম শংকায় ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেলল সুলতা। থিয়েটার কর্তৃপক্ষ শংকিত হলেন অন্য আশংকায়। দর্শকরা চেয়ারগুলো আস্ত রাখবে কি তপনের মিউজিক না শোনার পর? এতদিন ধরে ফলাও করে বহু বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে তপনের নাম দিয়ে। এখন? কিন্তু তপন এল। পর্দা ওঠবার আগেই ঝড়োকাকের মতো সে এল। দুপাশে জয়ন্ত আর ইন্দ্রনাথ। ড্রেসিংরুমে গেল না। মেকআপও নিল না, এসেই বসল পিয়ানোয়। বিশাল হলঘর গমগম করে উঠল তার হাতের জাদুতে।

হারানো রিভলভারটা আবির্ভূত হল তার মিনিট কয়েক পরেই।

সহসা তপনের খেয়াল হল কোথায় যেন কী একটা গণ্ডগোল হয়েছে। ডাণ্ডার মার আর গ্যাসের বিষে মুমূর্ষ হয়েও সঙ্গীত-সুধায় সে চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল মিনিট কয়েকের মধ্যেই। আত্মবিস্মৃত হয়ে পিয়ানোর রীডের ওপর আঙুল চালনা করছিল ক্ষিপ্রবেগে।

আচম্বিতে ওর মনে হল সামনের সারির শ্রোতারা ঈষৎ উন্মনা হয়েছে। তাদের কান এখন পিয়ানোর দিকে নেই–সারি সারি চোখগুলো গেঁড়ির চোখের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

সম্বিৎ ফিরতেই তপন দেখল বিস্ফারিত চোখগুলো তার দিকে নিবদ্ধ নয়–নিবদ্ধ তার পেছন দিকে।

সুতরাং কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকিয়েছিল তপন নিছক কৌতূহল বশে। এক পলকে যা দেখল কাজ হল তাইতেই। পিয়ানো ছেড়ে ছিটকে গেল তপন। একলাফে মঞ্চ থেকে প্রেক্ষাগৃহ, সেখান থেকে দরজা। পিস্তল নির্ঘোষটা শোনা গেল দরজায় পৌঁছোনোর আগেই! আশ্চর্য! এ-রকম নাটকীয় কাণ্ডর পর হট্টগোলে ফেটে পড়া উচিত ছিল প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু যুগটা নিওরিয়ালিজম্-এর। নাটকটিও নতুন। সুতরাং দর্শক সাধারণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবল পিয়ানো ছেড়ে চম্পট দেওয়াটা বোধ হয় নাটকেরই অঙ্গ। ভাবল, নতুন চমক। অনেকে তো শতমুখে তারিফ করার জন্যে যুৎসই বুলি সাজাতে আরম্ভ করে দিল মনের মধ্যে।

কিন্তু সামনের সারির দর্শকরা ভ্যাবাচাকা খেয়ে ভাবল–তাইতো! এ আবার কি ধরনের নিওরিয়ালিজম! সিরিয়াস মুহূর্তে একী ছন্দপতন! তারা যে স্বচক্ষে দেখেছে রিভলভারটাকে পেছনের উইংসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখেছে নলচের মুখে আগুন–শুনেছে ফায়ারিংয়ের পিলে চমকানো আওয়াজ।

বেশি কিছু বোঝবার আগেই পর্দা নেমে এসেছিল হুড়মুড় করে। বিদ্যুৎবেগে মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিল দুই গোয়েন্দা-ইন্দ্রনাথ আর জয়ন্ত। রিভলভার সমেত গ্রেপ্তার করেছিল–

ক্যামেলিয়াকে!

তপন? না, মরেনি। আহতও হয়নি। আনাড়ির বুলেট তাকে স্পর্শও করেনি।

নাটক আবার শুরু হয়েছিল। তপন ফের বসেছিল পিয়ানোর সামনে।

মৌজ করে সিগারেট সেবন করতে করতে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল ইন্দ্রনাথ–ওহে সরকারি টিকটিকি, ক্যামেলিয়াকে যেন আরুণি-নিধন আর স্বামীবধের অপরাধে নির্যাতন কোরো না। দুদিনের মধ্যে বিধবা হয়েছে বেচারা, পাগল হতে বেশি দেরি নেই।

আমতা আমতা করে বলেছিল জয়ন্ত–মাই ডিয়ার ইন্দ্রনাথ, ক্যামেলিয়া কিন্তু তপনকে খুন করবার চেষ্টা করেছিল ডাণ্ডা মেরে, গ্যাস দিয়ে আর গুলি করে।

তাতো করবেই। বলে আর দাঁড়ায়নি ইন্দ্রনাথ। ঊর্ধ্বশ্বাসে উধাও হতে হতে শুধু বলেছে–ভানুমতীর খেল-এর ঐন্দ্রজালিকের নামটি যদি জানতে চাও কাল সকালে এসো মৃগাঙ্কর বৈঠকখানায়। কফি আর মাছের কচুরীর নেমন্তন্ন রইল। আর হ্যাঁ, সঙ্গে আনবে তপন আর সুলতাকে।

মাছের কচুরীর পাহাড় বানিয়ে ফেলেছিল গৃহিণী। একদা বোম্বাই বাসিনী কোটিপতির দুহিতা যে পাঁচকশালায় প্রবেশ করলে ইন্দ্রের শচী হয়ে যায়–তা যে-না মাছের কচুরি চেখেছে, সে বুঝবে না।

উদগার তুলে হট কফিতে চুমুক দিল তপন। শুধোলো–এবার বলুন ইন্দ্রনাথবাবু, আরুণিকে খুন করেছে কে?

আপনি, বলে কঁচির নতুন প্যাকেট ছিঁড়ল ইন্দ্রনাথ।

ঠং করে একটা শব্দ হল। কাপ নামিয়ে রেখেছে তপন। চোয়ালটা শিথিল হয়ে ঝুলছে অদ্ভুতভাবে। আর, সুলতা অস্ফুট চিৎকার রোধ করার জন্যে হাত চাপা দিয়েছে মুখে।

ধীরেসুস্থে প্যাকেট ছিঁড়ল ইন্দ্রনাথ। দেশলাইয়ের খোলে ঠকঠক করে ঠুকল সিগারেটের প্রান্তদেশ। ঠোঁটে ঝুলিয়ে অগ্নিসংযোগ করল অপর প্রান্তে। বলল এক মুখ ধোয়া ছেড়ে–আপনাদের অনেকেরই বিশ্বাস মিঠে চেহারার ওই ক্যামেলিয়াই এতগুলি খুনের নায়িকা। বিশেষ করে তাকে যখন হাতে-নাতে ধরা গেছে তপনবাবুকে খুন করার প্রচেষ্টায়। ঠিক কিনা?

দুবার, শুকনো গলায় বলল তপন, দুবার সে চেষ্টা করেছিল আমাকে প্রাণে মারবার।

খুব একটা অন্যায় করেনি। ও আপনাকে ঘৃণা করত। ঘৃণার কারণ আর কিছুই নয়। আমরা জানবার অনেক আগেই ও জেনে ফেলেছিল, তার স্বামীকে বিষ দিয়ে মেরেছেন আপনি।

কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল তপন। বিন্দু বিন্দু ঘাম দাঁড়িয়ে গেল কপালে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আচ্ছন্নের মতো। সুলতাও উঠে দাঁড়াল একই মুখচ্ছবি নিয়ে।

বিহ্বল কণ্ঠে বললে তপন–আপনার তাহলে বিশ্বাস, আরুণিকেও মেরেছি আমি?

তা আর বলতে, প্রসন্ন কণ্ঠে বলল ইন্দ্রনাথ। পরিহাসের বাষ্পও নেই কথার সুরে–আরুণিকেও খুন করেছেন আপনি।

সুলতা হিসহিসিয়ে উঠল সপিনীর মতো–আপনি…আপনি মানুষ না জানোয়ার?

প্রত্যুত্তরে অ্যাশট্রেতে ছাই ঝাড়ল ইন্দ্রনাথ। বলল একই রকম হৃষ্টকণ্ঠে-ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ক্যামেলিয়া গিয়েছিল আর্সেনিক দিয়ে কীভাবে মানুষ খুন করা যায়, তা জানতে। তখনি সে জেনেছিল, চামড়ার মধ্যে দিয়েও আর্সেনিকের বিষক্রিয়া হয়। মনে পড়েছিল থুনির আর গালের একজিমা ঢাকবার জন্যে রোজ ঘন্টাখানেক ধরে মেক আপ করত ক্যাসানোভা। আরও মনে পড়ল, যে ক্রিম দিয়ে মেক আপ করা হত, সেটি দান করেছিলেন আমাদের তপনবাবু। ক্রিমটিতে যে সাদা আর্সেনিক বোঝাই, তা আমি কাল রাতে REINSGH টেস্ট করে দেখেছি। থিয়েটার থেকে ক্রিমের নমুনা এনে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, জল, তামার তার আর বুনসেন বার্নার নিয়ে বসেছিলাম আমার এক কেমিস্ট বন্ধুর ল্যাবোরেটরিতে। ক্যামেলিয়া কিন্তু এক্সপেরিমেন্টের ধার ধারেনি। মিথ্যে চিরকুট লিখে তপনবাবুকে নিয়ে গেছে নিজের ডেরায়। তারপর গ্যাস দিয়ে মারতে চেয়েছিল ভদ্রলোককে। জয়ন্তর স্যাঙাৎ যদি টেলিফোনে তার ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বিষবিজ্ঞান অধ্যয়নের সংবাদটি না জানাতো, তাহলে এতক্ষণে তপনবাবুর মড়া নিয়ে কাটা ছেঁড়া আরম্ভ হয়ে যেত পুলিশ মর্গে। শুনেই বুঝেছিলাম শোকে পাগল হয়ে গিয়েছে ক্যামেলিয়া। বাঘিণীসত্ত্বা জেগেছে। তাই ভয় পেয়ে দৌড়েছিলাম। ক্যামেলিয়া যাবার সময়ে তপনবাবুর রিভলভার নিয়ে পালিয়েছিল বোধ হয় নিজে মরবার জন্যে। কিন্তু তাঁকে জ্যান্ত অবস্থায় পিয়ানো বাজাতে দেখে গুলি ছুঁড়েছিল থিয়েটারের মধ্যেই।

এতগুলো কথা বেশ খুশি খুশি স্বরে বলে থামল ইন্দ্রনাথ। তারপর বললে হাসি মুখে–তপনবাবু, সুলতা দেবী, আপনাদের অহেতুক উদ্বেগের মধ্যে রাখতে চাই না। বসুন আপনারা। শুনে রাখুন, দু-দুটো মরণফাঁদ পাতা হয়েছিল ফিরোজা থিয়েটারে। দুটোকেই অপারেট করেছেন একা তপনবাবু। দুটোর মধ্যে একটা পাতা হয়েছিল অবশ্য শুধু তপনবাবুর জন্যেই।

ঢোঁক গিলল তপন। সুলতার সাদা মুখে আবার রক্ত ফিরে আসতে দেখা গেল।

নিজের মনেই বলল তপন–দুটো মরণ ফাঁদ…

হ্যাঁ। কারণ এ মামলায় হত্যাকারীর সংখ্যা দুই–এক নয়।

কী বলছ ঠাকুরপো? এতক্ষণে মুখ খুলল কবিতা। দুজন হত্যাকারী?

দুই হত্যাকারীই এখন মৃত, শান্ত স্বর ইন্দ্রনাথের।

আরুণি আর ক্যাসানোভা! ছিপিখোলা সোডার বোতলের মতো বিস্ময় ধ্বনি করল তপন।

হ্যাঁ। ক্যাসানোভা খুন করেছে আরুণিকে। আরুণি আপনার প্রাণ নিতে গিয়ে নিয়েছে ক্যাসানোভার। ভাগ্যের কি পরিহাস দেখুন। মরবার পরেও ঘাতককে মেরে গেল আরুণি।

কপালের ঘাম মুছতে মুছতে সুলতা বললে–কিন্তু আমার ওপর চড়াও হওয়ার সখ হল কার?

ক্যাসানোভার। কারণ একটা বেস কথা বলে ফেলেছিলেন ম্যারেজ ডিনারে। মনে পড়ছে?

বেফাঁস কথা! কী?

জয়ন্তকে জিগ্যেস করেছিলেন, তবে হাড়টা ভাঙল কী করে? কড়িকাঠের ধাক্কায়? উল্টো মাধ্যাকর্ষণ নাকি?

আমি তো বুঝতেই পারছি না সে কথার সঙ্গে–

বুঝিয়ে দিচ্ছি। প্রথমে ক্যাসানোভা বধের দুর্বোধ্য জায়গাগুলো বোঝবার চেষ্টা করা যাক। প্রথম থেকেই জানতাম ক্যামেলিয়া নির্দোষ। স্বামীকে সে ভালোবাসত। খুন করা তার কল্পনাতীত। অথচ স্বামীর খাবারে বিষ মেশানোর সব চাইতে বেশি সুযোগ তারই। কিন্তু বিষ দেওয়ার জন্যে কেউ বিয়ে করে না। তাহলে? কাজটা অন্য কারো। আর্সেনিককে ক্যাসানোভার দেহে ঢোকানো হয়েছে অন্য কোনও পথে। কী পথে? ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল চামড়ার মধ্যে দিয়ে আর্সেনিক পয়জনিংয়ের নজির নতুন নয়। বহুবিধ কসমেটিকস এর মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে ফেস ক্রিমের মাধ্যমে এ দুর্ঘটনা বহুবার ঘটেছে অতীতে। আরও মনে পড়ল, একজিমার দাগ ঢাকবার জন্যে মেক আপ নিয়ে মেহনৎ করাটা খুবই স্বাভাবিক ক্যাসানোভার পক্ষে। মনে পড়ল দানবীর তপনবাবুর ক্রিমদানের বৃত্তান্ত। নিজের অজান্তে বিষাক্ত ক্রিম দিয়ে মেরে ফেলেছেন ক্যাসানোভাকে। তাই বলছিলাম ক্যাসানোভার হত্যাকারী ওঁকেও বলা চলে।

তপনবাবু, এই সব কারণেই প্রথমে আপনাকেই সন্দেহ করেছিলাম। কী হল? মন খারাপ হল নাতো? জানেন তো, আমরা গোয়েন্দারা ভূশণ্ডির কাক। সর্বজ্ঞ মহাপুরুষ যেন–অন্তত আমার লেখক বন্ধু মৃগাঙ্কর গল্পগুলো পড়ে এইরকম মিথ্যে ইমেজ খাড়া হয়ে যায়। আসলে তা নয়, আমরা সন্দেহ করি সবাইকেই। তারপর বাদ দিতে থাকি একে একে। আপনিও বাদ পড়লেন দুটি কারণে। প্রথমতঃ আপনার অকুণ্ঠ সরলতা এবং প্রাণ ভোলা কথাবার্তা। বিষাক্ত ক্রিমের জার জেনে শুনে কেউ অর্পণ করলে এতটা সহজ হতে পারে না। দ্বিতীয়তঃ ক্যাসানোভাকে মেরে আপনার লাভ কী? কিছু না। ক্যামেলিয়াকে নিয়ে ক্যাসানোভার সঙ্গে আপনার কোনও প্রেমের ত্রিভুজ গড়ে ওঠেনি। ফলে, ওর ওপর কোনও বিদ্বেষ নেই আপনার। অবশ্য জ্যাক দি রিপারের মতো উন্মাদ খুনে যদি হন আপনি, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। আপনার ড্রেসিংরুমে আরুণি গিয়েছিল নিজের জার থেকে বিষযুক্ত ক্রিম আপনার জারে চালান করতে। কিন্তু আপনি বুঝলেন উল্টো। আপনাকে বোঝানোও হল–ক্রিম ফুরিয়ে গিয়েছে আরুণির। তাই কঁচুমাচু মুখে সটকে পড়ল ঈর্ষাকাতর নায়ক। এ-কাহিনীতে অবশ্য সে খল নায়ক। প্রতিযোগিতায় আপনার কাছে হেরে–

প্রতিযোগিতা কেন বলছেন? ক্ষীণকণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় সুলতা। প্রেমের? আমি কি তাকে প্রেম করতাম?

সরি। আমি তা মনে করিনি। যাই হোক, ঈর্ষার বিষে জ্বলেপুড়ে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে গিয়েছিল আরুণি। বিষযুক্ত ক্রিম কিছুদিন ব্যবহার করলেই তপনবাবু অসুস্থ হতেন, ডাক্তার দেখাতেন, আর্সেনিক পয়জনিং ধরা পড়ত–কিন্তু এমনই পাথর চাপা কপাল লোকটার, হাতে নাতে ধরা পড়ল আপনার কাছে। তারপরেও বেচারির বুদ্ধিশুদ্ধি তালগোল পাকিয়ে গেল আপনি দিব্বি সুস্থ থাকায়। ও হয়তো চেয়েছিল বিষযুক্ত ক্রিম ফিরিয়ে নিতে–কিন্তু কেন নেয়নি সে রহস্য আমি উদ্ধার করতে পারিনি।

ওই ঘটনার পর থেকে আমার জিনিসপত্র আলমারিতে তালা দিয়ে রাখতাম, বলল তপন।

ঠিক। ওই জন্যেই সে ক্রিম পুনরুদ্ধার করতে পারেনি, অথচ ক্রিমের বিষাক্ত ফলাফলও দেখতে পায়নি।

সে জন্যে আমি কৃতজ্ঞ আমার স্ত্রীর কাছে, বলল তপন। সেইদিনই ও নতুন ক্রিমের জার না আনলে ওকে আজ বিধবা হতে হত। তবে হ্যাঁ, ক্যামেলিয়া সধবা থেকে যেত।

সাময়িকভাবে থাকত, বলল ইন্দ্রনাথ। আর্সেনিক পয়জনিংয়ে না মরলেও ফাঁসির দড়িতে মরত ক্যাসানোভা…আরুণির অনেক আগে থেকেই ক্যাসানোভার শরীরে বিষ ঢুকতে শুরু করেছিল বলেই সন্দেহের আঁচ থেকে রেহাই পেয়েছেন তপনবাবু। নইলে ধরে নেওয়া যেত, আপনি ক্যাসানোভাকে খুন করেছেন এই কারণে যে ক্যাসানোভা জানত আপনি আরুণিকেও খুন করেছেন। কিন্তু আসলে তা তো হয়নি। আরুণির প্রাণপাখি উড়িয়ে দিয়েছিল একজনই–ক্যাসানোভা।

কাষ্ঠহেসে বললে তপন–কিন্তু আপনি যে বললেন আমিই–

দমা করে বেতাল শব্দ হল। ঝনঝন করে নেচে উঠল টেবিল ভর্তি কাপডিস প্লেট চামচ। দেখা গেল, বিপুল মুষ্টাঘাত করেছে ইন্সপেক্টর জয়ন্ত চৌধুরী। আর চেঁচাচ্ছে গাঁকগাঁক করে–কিন্তু কীভাবে? কীভাবে? কীভাবে?

এইভাবে, বলে শুরু করল ইন্দ্রনাথ রুদ্র।

.

আরুণির ওপর ক্যাসানোভার বিতৃষ্ণার কারণটা আর একবার ঝালিয়ে নিই। সুলতা দেবী সেই দৃশ্যের উপসংহারটুকু দেখেছিলেন। ক্যামেলিয়াকে আরুণি ধর্ষণ করতে চেয়েছিল, তাই না?

মুখ লাল হল সুলতা দেবীর। কবিতা বললে–মরণদশা আর কি! কথার ছিরি ছাঁদ নেই।

ইন্দ্রনাথ বললে–তাই আরুণির প্রাণপাখিকে উড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প নিল ক্যাসানোভা। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের প্রাণ পাখিটিও যাতে সকালে ফাঁসির দড়িতে না উড়ে যায়, তাই আটঘাট বাঁধল সে। উদ্ভট নাটক করে করে ব্রেনের মধ্যে তার গজগজ করছিল উদ্ভট বুদ্ধি, তাই–

নাটকটা আমার লেখা, গম্ভীর মুখে বলল সুলত। এবং সেটা উদ্ভট নয়।

ওই হল গিয়ে। তাই একটা বিটকেল প্ল্যান ডালপালা মেলে ধরল ক্যাসানোভার উর্বর মস্তিষ্কে। ওর প্রথম কাজ হল, কড়িকাঠে একটা হুক পেঁচিয়ে লাগানো, সেই হুক থেকেই পরে খলনায়ক আরুণিকে ঝুলতে দেখা গেছে। সুযোগের অভাব ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠাসহকারে সূচনা পর্ব সমাপ্ত করেছে ক্যাসানোভা। হুকটা আরুণির চোখে পড়লেও বিপদ নেই। হুক নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। আরুণিও নিশ্চয় ঘামায়নি।

এর পরের ধাপে বেশ খানিকটা নেমবুটাল জোগাড় করতে হল ক্যাসানোভাকে। আখতারের ঘর থেকে শিশি ভর্তি নেমবুটাল সরাতে বেগ পেতে হল না মোটেই। বেশ খানিকটা ড্রাগ জিনের বোতলে মিশিয়ে রেখে দিল আরুণির ঘরে। ভুল করল সেইখানেই। কেননা নেমবুটাল মেশাতে হলে বোতলের মদে মেশাতে হবে। অথচ বোতলটি পরে পাওয়া যাবে এবং সন্দেহের উদ্রেক ঘটাবে। তাই ক্যাসানোভার প্ল্যান ছিল নিশ্চয় কামফতে হওয়ার পর নেমবুটাল মিশোনো মদের বোতল সরিয়ে সেখানে নিরীহ জিনের একটা বোতল রাখা, কিন্তু বোতল পালটা-পালটি করার মুহূর্তটি যেই এল বেমালুম বিষয়টি বিস্মৃত হল ক্যাসানোভা। অতি বড় হুঁশিয়ার অপরাধীও কিছু না কিছু ভুল করে। ক্যাসানোভাও সাজানো আত্মহত্যার দৃশ্যে রেখে গেল মার্ডারের স্পষ্ট সূত্র।

যথা সময়ে বাইরে রেস্তোরাঁয় খেয়ে দেয়ে মাল টেনে ড্রেসিংরুমে এল আরুণি ফের জিনের বোতল ট্র্যাক করার সাধু অভিলাষ নিয়ে। ঘুমের ওষুধের কাজ শুরু না হওয়া পর্যন্ত সবুর করল, তারপরে উঠে এল ছাদে বেশ খানিকটা দড়ি নিয়ে। ওঠবার সময়ে দেখে গেল, লিফষ্টা প্ল্যানমাফিক দোতলাতেই আছে–একতলায় নেই। ও জানত, বুড়ো ইস্পাহানি লিফট-র কলকজায় হাত দিতে চায় না কখনও বিগড়ে গিয়ে মাঝখানে আটকে যায় এই ভয়ে। অত রাতে ফিরোজা থিয়েটারে যে কেউ আসবে না–তাও জানত ইস্পাহানি। সুতরাং যেখানকার লিফট, সেইখানেই রেখে সে তামাক খাবে নিজের ঘরে বসে, সেই ফাঁকে ঘরের স্কাইলাইটের কাছেই লিফট-এর কলকজায় কেরামতি করতে পারবে ক্যাসানোভা।

বটে! আচম্বিতে সটান হয়ে বসল জয়ন্ত।

ঠাকুরপো! বুঝেছি, সবিস্ময়ে বলল কবিতা।

কিন্তু যেই আমি বিজ্ঞতা জাহির করতে গেলাম, ইন্দ্রনাথ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললে–হ্যাঁ, ধরেছো ঠিক তোমরা। কিন্তু তপনবাবু যদি লিফট নাও চালাতেন, ক্যাসানোভা চালাত। তার কাজটা আপনি সেরে দিলেন দেখে সে অবশ্য অবাক হয়েছিল যথেষ্ট।

দড়ির একটা প্রান্ত সে বাঁধল হয় লিফট-এর কলকজার সঙ্গে, না হয় লিফট-এর মাথায়। দড়িটা কতখানি লম্বা রাখলে লিফট-এর টানে আরুণির মুণ্ডু ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে না, সেটা অবশ্য হিসেব করে মেপে রেখেছিল ক্যাসানোভা। তাই অপর প্রান্তটা গলিয়ে আনল স্কাইলাইটের ফোকর দিয়ে, ঝুলিয়ে দিল মেঝের ওপর। স্কাইলাইট দিয়েই আরও দুটি জিনিস ঘরে ফেলল সে। খানিকটা তুলো আর দু-গাছা দড়ি। আগে থেকেই একটা উপযুক্ত উচ্চতার টুলও রাখা হয়েছিল ঘরের মধ্যে।

মঞ্চসজ্জা সম্পূর্ণ হল। নাটকের সংলাপ বা ওই জাতীয় কিছু নিয়ে সফল নায়ক আরুণির সঙ্গে আলোচনার জন্যে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল আগে থেকে। কারো মনে সন্দেহ না আনার জন্যেই এই ব্যবস্থা। আরুণির ঘরে এল কাঁটায় কাঁটায় নটায়। চেয়ারে দাঁড়িয়ে একগাছি দড়ি বাঁধল কড়িকাঠের হুকে। অপর প্রান্তে রইল একটা ফঁস। এমনভাবে ফাঁস তৈরি হল যাতে গিঁটটা চোয়ালের খাঁজে পড়ে।

এরপর আর একগাছি দড়ি বাঁধা হল আরুণির কোমরে। অন্য প্রান্তটা গলিয়ে আনল কড়িকাঠের হুকের মধ্যে দিয়ে এবং টান মারল হেঁইও বলে। নেমবুটালে অচেতন আরুণি দুলতে দুলতে উঠল শূন্যে। ত্রিশঙ্কুর মতো তাকে শূন্য মার্গেই রেখে দড়ির প্রান্তটা বাঁধল দরজার কড়ায়। টুলটা এমন ভাবে রাখল হুকের নীচে যাতে আরুণির পায়ের ভর রইল টুলের ওপরে। আবার উঠল চেয়ারে। গলা ঘিরে তুলোর পটি দিয়ে মুণ্ডুটা গলিয়ে দিল ফাসের মধ্যে। তুলোর পটির ওপর আলতো করে এঁটে দিল দড়ির ফাস।

সুইসাইড যারা করে, তাদের কেউ কেউ মৃত্যুকালেও একটু আরাম পেতে চায়। ক্যাসানোভার তাতে সুবিধে হল। কেননা, আরুণির মৃত্যুর যে সময় নির্ধারণ করেছিল ক্যাসানোভা, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার ছিল বই কি।

চেয়ার থেকে নামল ক্যাসানোভা। আরুণির কোমর থেকে খুলল দড়ির বাঁধন। সঙ্গে সঙ্গে দেহটা হেলে পড়ল। পা রইল টুলে–ফস রইল গলায়। কিন্তু দম বন্ধ হল না তুলোর দৌলতে। এ ভাবে অনেকক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা যাবে আরুণিকে। দেহের খানিকটা ওজন টুলের ওপর পড়ায় গলায় ছাপ পড়ছিল অনেক কম।

তারপর লিফট-এর সঙ্গে বাঁধা দড়ির প্রান্তটা তুলে আনল ক্যাসানোভা। বাঁধল আরুণির পায়ে। ট্রাউজার্সের ক্রিজ নষ্ট হয়েছিল ওই জন্যেই। পাটের ফেঁসো নিয়েও কতই না গবেষণা করেছে জয়ন্ত। একবারও খেয়াল হয়নি স্রেফ ধোঁকা দেওয়ার জন্যেই পায়ের চামড়ার ওপর না বেঁধে ট্রাউজার্স সমেত দড়ি বেঁধেছিল ক্যাসানো।

এরপর টুলের পায়া ঘিরে একটা দড়ি জড়ালো ক্যাসানোভা। দড়ির দুটোপ্রান্তই বেঁধে রাখল স্কাইলাইটের শিকে। সবশেষে মুছল চেয়ারটা।

কাজ শেষ। ঘর থেকে বেরিয়ে এল ক্যাসানোভা। রাত তখন সাড়ে নটা। ইস্পাহানি ওকে এগিয়ে দিল নীচতলায়। একটু অপেক্ষা করে ক্যাসানোভা গেল পাবলিক টেলিফোন বুথে। ফোন করল ডক্টর লুথাকে আরুণির নাম নিয়ে। জরুরি দরকার, এখুনি আসতে হবে। একজন ডাক্তারকে অকুস্থলে হাজির না করলে এত আয়োজন ফেঁসে যেতে পারে। ডাক্তারের সার্টিফিকেট থাকা চাই এই মর্মে যে, হা ক্যাসানোভা বেরিয়ে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরে মারা গিয়েছে আরুণি। তিনি আসার মিনিট কয়েক আগেই তার প্রাণপাখি উড়েছে।

থিয়েটারে ফিরে এল ক্যাসানোভা। বাড়ি থেকে থিয়েটারে আসতে ডক্টর লুথার কমিনিট সময় লাগে, সে হিসেব তার জানা। তাই ঠিক সময়ে থিয়েটারে এল সে লিফষ্টা নীচে নামিয়ে আরুণির দম বন্ধ করার জন্যে। কিন্তু গিয়ে কি দেখল? না আমাদের তপনবাবু তার হয়ে অপকর্মটি নিজেই করছেন অর্থাৎ লিফ্ট নামাচ্ছেন। ফলে আরুণিকে আর স্বহস্তে বধ করতে হল না ক্যাসানোভাকে।

মাগে! অস্ফুট কণ্ঠে বলল সুলতা। তপন কেবল টোক গিলল শুকনো গলায়।

ঘাবড়াবেন না, তপনবাবু না জেনে যা করেছেন তার জন্যে আপনাকে দায়ী করা চলে না কোনও মতেই। যাই হোক, লিফট নীচে নামতেই তিনতলায় আরুণির গোড়ালিতে বাঁধা দড়িতে টান পড়ল। টানের চোটে গোড়ালি গিয়ে পৌঁছোল স্কাইলাইটের ইঞ্চি কয়েক দূরে। ঘাড়ের পেছনটা কড়িকাঠের কোণে লাগতেই মট করে ভাঙল সারভাইকালভারটিব্রা অর্থাৎ কশেরুকার একটা হাড়।

চটপট ছাদে উঠল ক্যাসানোভা। স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে খুলে দিল গোড়ালির বাঁধন। পেণ্ডুলামের মতো দোদুল্যমান হল আরুণির লাস। দড়িটা টেনে নিল ক্যাসানোভা। শিকে বাঁধা দড়ির দুপ্রান্ত ধরে টান দিতেই উলটে পড়ল টুলটা। দড়ির একপ্রান্ত ধরে টেনে বার করে নিল ক্যাসানোভা। ঘরের মধ্যে ঝুলতে লাগল কেবল আরুণির দেহ।

সুলতা দেবী, কি বেস কথা বলেছিলেন এখন বুঝছেন তো? জয়ন্তকে জিগ্যেস করেছিলেন, হাড়টা ভাঙল কী করে? কড়িকাঠের ধাক্কায়? উল্টো মাধ্যাকর্ষণ নাকি? শুনেই টনক নড়েছিল ক্যাসানোভার। চোরের মন বোঁচকার দিকেই থাকে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছিল, আপনি ওর গুপ্তরহস্য জেনেছেন। তাই পরলোকে যাওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়ল আপনার।

কি বেইমান! বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আমিই বিয়ে দিলাম ওদের–সুলতা ফুঁসে উঠল।

ইন্দ্রনাথ ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে বললে–কি সুন্দর প্ল্যানখানা দেখেছেন। জটিল সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিষ্কার তকতকে। খোঁচ নেই কোথাও। সমস্ত ঘটনাটা ঘটতে লেগেছে দশ মিনিট। ইস্পাহানির দরজা খোলা ছিল আগাগোড়া, তার চোখও ছিল এই দিকে। শুধু একটা খটকা লেগেছিল আমার। টুলটা উলটে পড়ার শব্দ শুনে ইস্পাহানি কেন উঠে আসেনি। এলে ক্যাসানোভার জবর সাক্ষী জুটতে। থিয়েটারে গিয়ে কারণটা আবিষ্কার করলাম। ইস্পাহানি বার্ধক্য হেতু কানে একটু কম শোনে। ক্যাসানোভার হিসেবে এ সম্ভাবনাটা ছিল বলেই ডাক্তারকে হাজির করেছিল টেলিফোন করে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেই আঁচ করতে পারেনি, যাকে খতম করার জন্যে এত জোগাড়যন্ত্র তারই দেওয়া আর্সেনিক বিষে সে নিজেই খতম হয়ে চলেছে তিল তিল করে। একেই বলে ভগবানের মার, দুনিয়ার বার।

ইন্দ্রনাথ থামল। উৎপাত-যন্ত্র টেলিফোনটাও যেন এতক্ষণ ধরে রুদ্ধশ্বাসে শুনছিল ওর বচন-মালা। রহস্যোঘাটন পর্ব সমাপ্ত হতে না হতেই এমন আওয়াজ করে উঠল যে কান ঝালাপালা হয়ে গেল ঘরশুদ্ধ সকলের।

ধরল কবিতা। বলল–জয়ন্ত ঠাকুরপো, লালাবাজারের ফোন। তোমার ব বিপুল উৎসাহে লম্ফ দিয়ে রিসিভার ধরল জয়ন্ত। কান পেতে শুনল কিছুক্ষণ, তারপর মেঘ গর্জনের মতো বলল গুরুগম্ভীর গলায়–কেন্স সেট হয়ে গেছে, স্যার। আমি আসছি।

ইন্দ্রনাথ কাষ্ঠ হেসে বললে–বাহাদুরিটা তুই-ই নিস্ রে। প্রোমোশন হবে। আর আমাকে দিস শুকনো ধন্যবাদ।

মাভৈঃ, অভয় দিলাম। আমি তোকে দেব তুই যা চাস।

গল্পের নাম কী দেবে? বচন ফকিরের কল্কে? টিটকিরি দিল কবিতা।

ভানুমতীর খেল, দরজার কাছ থেকে বলল জয়ন্ত এবং বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেল ভোজরাজ কন্যা ভানুমতীর মতোই।

* বিচিন্তা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা, ১৯৭৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *