নিয়োগ প্রথা

নিয়োগ প্রথা

প্রথাটা নতুন কিছু নয়। অনেক প্রাচীন। নিয়োগ-প্রথার বহু নজির আছে ভারতের পৌরাণিক ইতিবৃত্তে। বিবাহিতা নারী পরপুরুষের সাহচর্যে সন্তানসম্ভবা হতে পারে এই প্রথায়।

পুরাণে যা আছে, তা কি সামাজিক কদর্যতা হতে পারে? বিদুর এবং পাণ্ডুর মতো ব্যক্তিরা যদি নিয়োগ প্রথা অনুযায়ী পরভৃত সন্তান হয়েও সমাজ শিহরামান হতে পারেন, তবে একালেও তা সম্ভব হবে না কেন?

ভয়ঙ্কর সেই অ্যাকসিডেন্টের পর থেকেই এ চিন্তা যেন উর্ণনাভের মতো জাল বুনে চলেছে আমার মগজে। চিন্তার জট যতই জটিল হয়েছে, নিয়োগ প্রথা ততই উঁকিঝুঁকি মেরেছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে।

অভিশপ্ত সেই দুর্ঘটনায় মানুষ বাঁচে না। কিন্তু ভোগান্তি আমার কপালে আছে। নইলে বেঁচে গিয়ে মরে থাকব কেন?

ভাবছেন বুঝি হেঁয়ালি করছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ও জিনিসটা আমার চরিত্রে নেই। তাই কাগজ কলম নিয়ে বসেছি বিচিত্র এই আত্মকাহিনি লিখতে।

পড়তে-পড়তে আপনার মনে হতে পারে উদ্ভট, অলীক, অবিশ্বাস্য। মনে হতে পারে, ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গিয়েছে আমার। তাই অসম্ভব কাহিনির অবতারণা করে ইন্ধন জোগাচ্ছি পঙ্গু কল্পনাকে।

পঙ্গু! সত্যিই আমি আজ পঙ্গু। কিন্তু কল্পনায় নয়। হাত-পা-চোখের মতো কোনও প্রত্যঙ্গও পঙ্গু নয়। পঙ্গু কেবল আমার পৌরুষ।

হ্যাঁ, আমার পৌরুষ। যে পৌরুষ প্রতিটি নারীর কাম্য। আজ তা অনুপস্থিত আমার মধ্যে। সংক্ষেপে বংশরক্ষায় আমি অক্ষম। বীজশূন্য আমার পুরুষ দেহ। তাই তো বলছিলাম, ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনা আমাকে নবজীবন দেয়নি–দিয়েছে জীয়ন্ত-মৃত্যু।

তা সত্ত্বেও বিয়ে করেছিলাম অলকানন্দাকে। কারণ অলকানন্দা এমনই মেয়ে যাকে দেখলেই বিয়ে করতে সাধ যায়। আমি প্রচণ্ড নাস্তিক। ঈশ্বর মানি না। স্বর্গ, মর্ত, পাতালের অস্তিত্ব স্বীকার করি না। কিন্তু শুধু আপনাকেই বলি, স্বর্গ বলে যদি সত্যিই কোনও দেবলোক থাকে এবং সেখানকার দেবসভায় উর্বশী কি তিলোত্তমাকে বিউটি-কনটেস্টে টেক্কা দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে স্বচ্ছন্দ্যে আমার বউ অলকানন্দাকে আপনারা নিয়ে যেতে পারেন। ইন্দ্র প্রমুখ বহু সৌন্দর্য-রসিকের মুন্ডু ঘুরিয়ে দেবার মতো রূপ নিয়ে মর্তে জন্মগ্রহণ করেছিল মানবী অলকানন্দা।

তবে হ্যাঁ, এই মুহূর্তে তাকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কেন, তা বলার জন্যেই এই উদ্ভট আত্মকাহিনির অবতারণা।

অলকানন্দার জন্ম গরীবের ঘরে। কিন্তু আমার আবির্ভাব অতি ধনী পরিবারে। সেইসঙ্গে ছিল আমার প্রয়াস এবং নাস্তিকতাবাদ। আমার বিশ্বাস, প্রকৃত নাস্তিক না হলে খাঁটি অসৎ হওয়া যায় না। আমার বিবেকেও ও সবের বালাই নেই।

ফলে যাবতীয় অপকর্মে আমি হাত পাকিয়েছি। বিবেককে টাকার আফিং খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। তা না হলে পৌরুষহীন হয়েও অলকানন্দাকে বিয়ে করলাম কী করে?

টাকার জোরে তো বটেই। মেয়েদের চরিত্র যতই দুৰ্জ্জেয় হোক না কেন, একটা ব্যাপারে তারা অতিশয় অকপট। সেটি হল অর্থ। রৌপ্যমুদ্রার পর্বত এদেরকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

তাই অতি সহজেই অলকানন্দা আমার ঘরনী হল। জেনে শুনেই হল। তার নারী জীবনের চরম সাধ মেটাতে আমি অপারগ জেনেও হাসিমুখে সে বরমাল্য দিল আমার গলায়। চোখে চোখ রেখে হেসেও ফেলল।

আরও আছে। অলকানন্দা আমার চাইতে কত বছরের ছোট জানেন। তিরিশ বছরের। আমি পঞ্চাশ ছাড়িয়েছি। কোথায় বানপ্রস্থ অবলম্বন করব, তা না পাণিপীড়ন করে বসলাম অলকানন্দার। হঠাৎ ওকে চোখে পড়ায় মাথার মধ্যে যেন দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। সারা জীবনে অনেক মেয়ে মানুষ ঘেঁটেছি। কিন্তু এমন আহা মরি রূপ তো দেখিনি।

প্রেম? উঁহু। এ শর্মার অন্তর পাথর দিয়ে বাঁধানো। এ সব মেয়েলী ছেনালীপনা আমার আসে না। প্রেম-টেম নয় মশায়। বড়লোকের সংগ্রহবাতিক বলতে পারেন। হীরে মুক্তোর মতো দামি দুষ্প্রাপ্য জিনিস দেখলেই ছোঁ মেরে এনে কোষাগারে রাখার বদখেয়াল। এ খেয়াল আমারও আছে। কারণ আমি বড়লোক। অর্থের জাদু বলে সমাজের শীর্ষস্থানীয়। কাজেই ঠাটবাট বজায় রাখার জন্যে একজন অনিন্দ্য সুন্দরী প্রয়োজন বই কি।

অলকানন্দাকে সংগ্রহ করলাম সেই কারণেই। দামি দামি ফার্নিচারের মতোই তাকে সাজিয়ে রাখলাম আমার সাজানো ঘরে। কেউ মুগ্ধ হল, কারো চোখ টাটাল, কেউ ঘনঘন যাতায়াত আরম্ভ করল আমার প্রাসাদে।

আমি কিন্তু নির্বিকার রইলাম। বিকার দেখিয়েই বা লাভ কি আমার? ভোগস্পৃহা থাকলেও ভোগক্ষমতা তো আমার নেই।

কিন্তু অলকানন্দার ছিল। অলকানন্দা বিশ বছরের পূর্ণ যুবতী। আজন্ম দারিদ্র্য ভোগ করার পর সহসা ঐশ্বর্যের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে। ভোগ-কামনার সকল উপাদানই তিলতিল করে প্রলুব্ধ করেছে তাকে।

না, না, আপনারা যা ভাবছেন, এ গল্প সে গল্প নয়। ভাবছেন এরপর সব সংসারে যা হয় এ সংসারেও বুঝি তাই হল। অলকানন্দা যুবক প্রেমিক সংগ্রহ করে হয় চম্পট দিল, অথবা, ভোগের পথে গা ভাসালো।

কিন্তু অলকানন্দা সে সবের ধার দিয়েও গেল না। সে দরিদ্র ছিল বটে, কিন্তু বুদ্ধিহীনা ছিল না। সে জানত ওসব পিচ্ছিল পথে একবার পা দিলে সামলানো বড় মুশকিল। আমাকে ছাড়া যায়, কিন্তু আমার বিপুল বৈভবকে হাত ছাড়া করা যায়?

ওই যে বললাম, নারীজাতি যতই দুর্জেয় হোক, একটি বিষয়ে তারা নেহাতই অকপট। সেটি অর্থ। তারা সব ত্যাগ করতে পারে, পারে না কেবল অর্থ। কারণ, এই অর্থর বনেদেই তো সংসার। অর্থ থাকলেই প্রেম থাকে, কর্তব্য থাকে, সংসারেও টান থাকে।

পাঠিকারা নিশ্চয় ভ্রকুঞ্চন করছেন। মুণ্ডপাতও করছেন। কিন্তু আত্মকাহিনিতে মিথ্যে বলতে নেই। আমার কথা আমি বলে যাই। সত্যি মিথ্যে বিচারের ভার আপনাদের।

হ্যাঁ, যা বলছিলাম। অলকানন্দা কোনওদিন তার যৌবনের ক্ষুধা নিয়ে অশান্ত হয়নি। অস্থির হয়নি। বাইরে মন দেয়নি।

তাই ধীরে ধীরে আমার মনের মধ্যে যে চিন্তাটার অঙ্কুর দেখা দিল, তা আমি আত্মকাহিনির গোড়াতেই বলেছি।

নিয়োগ-প্রথা। পুরাকালে যা ঘটেছে। একালে তা ঘটবে না কেন? পরপুরুষের বীজ গ্রহণ করে নারী সন্তানবতী হয়েছে সেকালে–একালে হলে দোষ কি? হলেই বা পরভৃত সন্তান। আমার বিপুল বৈভবের একজন উত্তরাধিকারী তো প্রয়োজন।

তাছাড়া পুরাণ তো আমাদের শেখায়। সমস্যায় সুরাহার পথ দেখায়। নিয়োগ-প্রথাও কি আমার পারিবারিক জীবনে সমাধানের পথ নয়? স্ত্রী-কে সন্তানবতী করা অপারগ স্বামীর পক্ষেও সম্ভব এবং সে বিধান তো প্রাচীন পুরাণেই রয়েছে।

পাঠক-পাঠিকার মধ্যে যাঁরা মনোবিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা বোধকরি অন্য সন্দেহ করে বসেছেন। ভাবছেন, আমি Sadist। বিকৃত রুচির দাস। নইলে ঘরের বউকে নিয়োগ-প্রথার রাস্তা দেখাবো কেন?

আবার বলি, আত্মকাহিনীতে মিথ্যে বলতে নেই। তাই বলি, এজাতীয় একটা কেতাব অনেকদিন আগে আমার হাতে এসেছিল। নানারকম বিকৃতি আর অপরাধের ঘটনা পড়তে মন্দ লাগেনি। শুনেছি, তরুণী ভার্যাদের অনেক বৃদ্ধ উৎসাহিত করে তরুণমহলে গা ভাসাতে। গোপনে সেই দৃশ্য দেখে নাকি আবেশে বিহ্বল হয়ে পড়ে অক্ষম স্বামী পুঙ্গবা।

মিথ্যে বলব না। নিয়োগ-প্রথার কল্পনা ঠিক এই জাতীয় না হোক, বিচিত্র একটা অনুভূতি বারংবার জাগ্রত করেছে আমার সর্বদেহে। আমি পঙ্গু। আমি নির্বীজ। কিন্তু যখনি অন্তরের কন্দরে লালন করেছি নিয়োগ প্রথার সুখাবহ চিন্তাকে, মনের সিনেমায় ছবি দেখেছি অলকানন্দার স্বেদসিক্ত আবেশ বিহ্বল তন্বীরূপকে, তখনি প্রতিটি লোমকূপে অদ্ভুত একটা শিহরন অনুভব করেছি। অনাস্বাদিতপূর্ব এ শিহরণের ব্যাখ্যা আমি জানি না। কিন্তু এ রোমাঞ্চর সঙ্গে যেন তুলনা হয় না কোনও কিছুর।

বিকৃতি? হতে পারে। কথায় বলে, কানা, খোঁড়া, কুঁজো–তিন চলে না উজো। মানে, এই তিন পঙ্গু কখনো সোজা পথে চলে না। আর আমার মতো পঙ্গু বেঁকা পথে চলব, এ আর আশ্চর্য কি। দেহ-বিকৃতি থেকেই যে মন-বিকৃতি।

সে কথা থাক। অলকানন্দার কোল জোড়া হবে, অলকানন্দা সুখী হবে, আমার উত্তরাধিকারী আসবে, এই কল্পনাই হয়তো বিচিত্র সুখানুভূতিতে আমার মগজ ভরিয়ে তুলত–এমন একটা ব্যাখ্যাও তো হতে পারে?

তাই নিয়োগ-প্রথার কল্পনা প্রতিবারই আনন্দ দিয়েছে আমাকে। উন্নাসিক ব্যক্তিরা হয়তো শিউরে উঠবেন। ছিঃ ছিঃ, এ যে সামাজিক কদর্যতা।

কিন্তু আমি মানুষটাই যে কদর্য। বাইরে নয়। বাইরে আমি সুপুরুষ, মহান এবং উদারচেতা। কিন্তু আমার ভেতরে যে কদর্যত মৌচাকের মতো বাসা বেঁধে আছে। সংসারে হেন কদর্য কাজ নেই, যাতে আমি হাত পাকাই নি। সুতরাং, নিয়োগ-প্রথার কল্পনা আমাকে উল্লসিত করবে, এইটাই হয়তো স্বাভাবিক।

সব চাইতে আশ্চর্য কী জানেন? আমি কদর্য হতে পারি, কিন্তু অলকানন্দা নিশ্চয় নয়। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। অতএব তার মতো ডানাকাটা রূপসীর ভেতরটাও দেবীজনোচিত হবে–এইটাই কি আপনারা ধরে নিয়েছেন।

আশ্চর্য সেইখানেই। অলকানন্দাকে নিয়োগ-প্রথার প্রস্তাব বেশিক্ষণ বুঝাতে হয়নি। যুক্তিতর্কের জাল বিছিয়ে বসেছিলাম ওর মস্তিষ্কধোলাই করব বলে। নিয়োগ-প্রথার দাওয়াই গুলে না খাওয়ালে সাড়া দেবে কেন মেয়েটা?

হায়! হায়! কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, অলকানন্দা আমার চাইতেও স্মার্ট। প্রথমে হাঁ করে শুনছিল। তারপর চোখ কপালে তুলে মুখখানা সিঁদুরের মতো লাল টকটকে করে ফেলল। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে বললে–যাঃ!

আমি আবার সেই শিহরণটা অনুভব করলাম মেরুদণ্ডের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। ওকে বুকের কাছে টেনে নিলাম। তুলতুলে গালদুটো টিপে দিলাম। কালো জামের মতো কালো-কালো চোখ দুটোর পানে তাকিয়ে নিবিড়কণ্ঠে বললাম–ঠাট্টা নয় অলকানন্দা। মহাভারতে যা আছে, তা কি খারাপ?

বলে, আবার বোঝাতে শুরু করলাম কীভাবে বিদুর পাণ্ডু এবং আরও অনেকে পরভৃত সন্তান। এই ভারতবর্ষের পুণ্য মাটিতে যুগ-যুগ ধরে চলে এসেছে নিয়োগ-প্রথা। বহু পুণ্যবতী সন্তানবতী হয়েছে এই প্রথায়। মোটেই ক্ষুণ্ণ হয়নি সতীত্বের আদর্শ। কেন হবে? পতির নির্দেশেই তো পরপুরুষের সঙ্গসুখ গ্রহণ করেছে। পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা..

ছলনা জিনিসটা নাকি মেয়েদের একচেটিয়া। সুতরাং অলকানন্দাও যৎসামান্য ছলনা করল বইকি। সতীত্বপনা না দেখালে স্বামীর মন রাখা যায় না যে। তা ছাড়া, এ প্রস্তাব অলকানন্দার কাছে মেঘ না চাইতেই জল পাওয়ার সামিল। ঐশ্বর্য, স্বামী কোনওটাই হাত ছাড়া হচ্ছে না। কিন্তু হাতের মুঠোয় আপনা হতে এসে যাচ্ছে একটা বাড়তি সুখ।

দেহসুখ।

কাজেই রাজি হল অলকানন্দা। ঠিক হল দয়িত নির্বাচনের ভার অলকানন্দার। বল্লভবরণ করবে সে কেবল সন্তানবতী হওয়ার জন্যে–তারপর আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না।

সাধারণ গৃহস্থের কাছে এ জাতীয় দাম্পত্যচুক্তি সত্যিই কল্পনাতীত। রক্ষণশীল পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয় এই মুহূর্তে আমার মুখে নিষ্ঠাবান ত্যাগ করতে পারলে পরম উল্লসিত হতেন। কিন্তু আমি নিরুপায়।

তা ছাড়া অলকানন্দার কথাটা ভাবুন। আমার অতি কদর্য প্রস্তাব সে ফেলতে পারেনি। সাদরে গ্রহণ করেছে। যৌবন-নিপীড়িত দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণু দিয়ে ভোগ করেছে।…তারপর!

তার পরের কথা পরে বলব।

আপাতত শুনুন অলকানন্দার কাহিনি। আমি তাকে গ্রীন সিগন্যাল দেবার পর অলকানন্দা প্রজাপতির মতোই উড়তে শিখল। তার ওড়ার বিবরণ মাঝে মাঝে কানেও এল। কিন্তু আমি কর্ণপাত করলাম না, বরং সেই গোপন শিহরণে রোমাঞ্চিত হলাম। রঙিন সে সব কাহিনি দিয়ে এ কাহিনি ভরাতে চাই না। অলকানন্দা রূপসী, অলকানন্দার স্বামী ধনবান, অলকানন্দা সমাজের শীর্ষস্থানীয়া– সুতরাং অভাব ঘটল না মধুমক্ষিকা বাহিনীর। অলকানন্দা পরমানন্দে বিভোর হল।

এই গেল আমার আত্মকাহিনি প্রথম পর্ব। এবার শুনুন দ্বিতীয়পর্ব।

অলকানন্দা যথারীতি পার্টিতে গিয়েছে। আমি সারাদিনের কাজকারবার সেরে বাড়ি ফিরেছি। রোজকার অভ্যেস মতো সুরার পাত্র নিয়ে বসেছি। সারা পৃথিবী চষে আনা সেরা সেরা মদিরা পাবেন আমার আলমারিতে। নেমন্তন্ন রইল। যে দিন খুশি আসতে পারেন।

খুব মন দিয়ে একটা নতুন ককটেল পাঞ্চ করছিলাম। পাঁচরকম সুরা মিশিয়ে, তাতে বরফখণ্ড ভাসিয়ে, বিটার আর লেমনজুসের ছিটে দিয়ে অপূর্ব এক গেলাস ককটেল বানালাম। এক চুমুক টেনে এত ভালো লাগল যে আঃ ধ্বনিটা পরম আমেজেই বেরিয়ে এল সরল কণ্ঠ দিয়ে।

ঠিক তখনি পেছন থেকে কে যেন বললে–হয়েছে? এবার ফিরুন। আর কতক্ষণ দাঁড়াবো?

মিথ্যে বলব না। আচমকা কণ্ঠস্বর আমাকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিল। কিন্তু কি জানেন, গুরুর দয়ায় আমার মন চমকালেও বাইরেটা কখনো চমকায় না। তাই ধীরস্বরে পেছন ফিরলাম।

ফিরে দেখলাম, একটা কিম্ভুতকিমাকার মানুষ দাঁড়িয়ে আমার পাঁচ হাত পেছনে। হাতে একটা রিভলভার।

লোকটাকে কিম্ভুতকিমাকার বললাম অন্য কারণে। আজকাল কি এক ফ্যাশান হয়েছে মোটা মোটা জুলপি রাখার। মানাক আর না মানাক, মুখ সরু হোক কি চেহারা লিকপিকে হোক–জুলপি রাখতেই হবে। জুলপিধারী ভাবে না জানি কি খোলতাই হয়েছে মুখশ্রী। আর আমি ভাবি, চিড়িয়াখানার বনমানুষ, না, সার্কাসের সঙ?

তা, সেদিন যা দেখলাম, তাকে জুলপি না বলে গালপাট্টা বলা উচিত। দু-গাল জুড়ে ইয়া মোটা দাড়ি। চিবুকে একটাও চুল নেই। গোঁফও নেই। চুলের বহর কেবল দু-গালে। ফুলো ফুলো গাল। মাথার মাঝখানটা গড়ের মাঠের মতো পরিষ্কার। কানের ওপর কয়েকগাছি চুলের সংখ্যা গুনে বলা যায়। সার্সির কাঁচে নাক চেপে ধরলে ডগাটা যেরকম বিচ্ছিরি থ্যাবড়া দেখায়, এর নাসিকাগ্রও তাই। চোখ দুটোতে ডাহা বোকামি মাখানো।

এহেন মানুষকে কিম্ভুতকিমাকার বলব না তো কাকে বলব?

বোকা হোক, গাধা হোক, সঙ হোক, বিদঘুঁটে হোক–একটা বিষয়ে আনাড়ি নয় আগন্তুক। রিভলভার ধরার কায়দা দেখলেই মালুম হয়, জিনিসটা ও হাতে ভালোই চলে। আগুন নিয়ে খেলাটা যেন জলভাত তাঁর কাছে।

তাই একটু ভাবিত হলাম বইকি। যার চোখে ডাহা বোকামি মাখানো, চেহারাখানা গালফুলো গোবিন্দমার্কা, তার হাতে মানুষ মারার যন্ত্র বিপজ্জনক নয় কি?

কিন্তু ওই যে বললাম গুরুর দয়া। তাই ভাবনাটাকে চোখের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিলাম । বরং একটু মোলায়েম হাসলাম। গেলাস দুলিয়ে ককটেল মেশাতে লাগলাম। ফলে, কাঁচের গেলাসে বরফ লাগায় টুং টাং বাজনা বাজতে লাগল। মিষ্টিচোখে এমন ভাবে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলাম নাড়ুগোপাল আগন্তুকের যেন কন্দর্পকান্তি উত্তমকুমারের আবির্ভাব ঘটেছে আমার সামনে।

আর একটা চুমুক দিলাম গেলাসে। না, মশাই না। হাত কাঁপেনি। কঁপবে কেন? কুকাজে আমিও কি কমপোক্ত?

ধীরে সুস্থে বললাম–কী ব্যাপার? খুন করা হবে নাকি আমাকে?

গালপাট্টাধারী ফ্যাসফেসে গলায় বললে–তবে না তো কি জামাই আদর করব?

বেশ, বেশ, বলে, ফের চুমুক দিলাম তারিয়ে তারিয়ে। তারপর মিষ্টি মিষ্টি করে বললাম– কেন মরবো, সেটা না জেনে মরাটা কি ঠিক হবে? কে পাঠিয়েছে?

গালপাট্টার মুখের আর কোনও কথা নেই। রিভলভারের নলচেটা অবশ্য আমার বুকের দিকেই ফেরানো। নলচের অন্ধকার গর্তের সঙ্গে কেন জানি না পাতালের সুড়ঙ্গর সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে হল। জগতে পাপপুণ্য বলে কোনও বস্তু যদি থাকে, পরকালের অস্তিত্ব যদি মেনে নিতে হয়। তাহলে পাতালের পথই তো আমার পথ। নরকের কুণ্ডই তো আমার শেষ পরিণতি। কীর্তির কাহিনি আজ শোনাতে বসেছি।

আবার বললাম–তোমার নাম জানি না। ভাই মস্তান, বলেই ডাকা যাক। রাগ করলে নাকি? করলেই বা কি। করলেও গুলি করবে। না করলেও গুলি করবে। শোনো মস্তান, আমার শত্রুদের নাম আমি জানি। আমি পটল তুললে লাভ কার-কার, তাও জানা। তাই অনুমান করতে পারি, কার ভাড়া খাটছো তুমি। বলব?

গালপাট্টা নীরব।

আমার বউয়ের, বললাম আমি। হাসিমুখেই বললাম। অবাক কাণ্ড তাই না? আরে মশাই, গালপাট্টা নিজেও তাজ্জব বনে গেল আমার হাসি দেখে, আমার ঠান্ডা মাথায় কথা বলা দেখে। বেচারী জানবে কী করে যে বাঁদুরে বুদ্ধিতে জুড়ি নেই আমার?

তাই সেকেন্ড কয়েক হাঁ করে তাকিয়ে রইল গালপাট্টা। তারপর ফুলো গালে টোল ফেলে ফ্যা-ফ্যা করে হেসে ফেলল। ধরেছেন ঠিক। কেন জানেন?

কেন আবার। আমার টাকা।

গালপাট্টার বোকা বোকা চোখেও এবার যেন একটা বিরাট কৌতুক দেখা গেল–শুধু তাই?

আবার কি?

মশায়ের বয়সটা খেয়াল আছে?

তা আছে বইকি। এ বছরের বসন্তকালে বাহান্ন হবে।

বসন্ত! বলে, এমন একটা নোংড়াচুমকুড়ি ছাড়ল গালপাট্টা যে এই প্রথমে একটু রাগ হল আমার। ছেড়ে বলল–বউটার বয়স কত?

বাইশ।

আই-আই! আবার সেই হলদে হাসি ইডিয়ট! বাহান্নর সঙ্গে বাইশ। আর কি চান স্যার? শুধু–এই দোষেই তো নেড়িকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো উচিত আপনাকে। বুড়ো বয়েসে মেয়ের বয়সি মেয়েকে নিয়ে শুতে লজ্জা করে না?

মহাবাচাল খুনে তো। রিভলভারটা হাতে না থাকলে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াতাম শূয়ারকে। তাও তো আসল ব্যাপারটা জানে না হতভাগা। আমি তেঁড়া পুরুষ–একথা জানা থাকলে না জানি কি খিস্তিটাই শুনতে হত।

ককটেলটা মন্দ মেশেনি। আর এক চুমুক খেলাম। জিভ দিয়ে ঠোঁট মুছে নিয়ে বললাম–মস্তান, কথাটা খাঁটি বলেছো। বছর খানেক পরে ডাইভোর্স করার প্ল্যান নিয়ে বিয়েটা করেছিলাম। রফা একটা করতাম। মোটা টাকার রফা।

গালপাট্টা বলল–চেখে চেখে বেড়ানোর সখ আছে মনে হচ্ছে?

টাকা থাকলেই থাকে। আমার টাকা আছে, মেয়ে মানুষের সখ আছে। মদ খাওয়ার সখ আছে। কিন্তু মরবার সখ নেই।

সখ আপনার ডবকা বউটারও আছে। ফুর্তির সখ। দেখেননি কেন অ্যাদ্দিন?

আমি মিশমিশে রিভলভারের অন্ধকার ফুটোর দিকে চেয়ে বললাম–মস্তান, জীবনে কটা খুন করেছ?

ডজন ডজন।

ফাইন। খুন করাটা কারো পেশা, কারো নেশা। তোমার কোনটা?

নেশা। ভীষণ ভালো লাগে খুন করতে।

সুরার নেশায় চোখে রং ধরলেও মন আমার হুঁশিয়ার। ওই একটা কথার মধ্যেই গালপাট্টার চরিত্র জানা হয়ে গেল আমার। সেকেন্ড। কয়েক নির্নিমেষে চেয়ে রইলাম ওর নির্বোধ কিন্তু অটল চাহনির পানে।

তারপর হেসে বললাম–দু-মিনিট তো হয়ে গেল হে। গুলি করো।

করব, করব। তাড়াহুড়ো করলে ভাল্লাগে না।

তাই বলো। তিলে তিলে মারতে চাও। সেইটাই তোমার আসল আনন্দ, ঠিক কিনা?

ওরে আমার গণৎকার রে।

গণৎকার নয় হে। রতনে রতন চেনে। যাক, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে কী? না, আমি যতক্ষণ না ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তোমার পায়ে ধরছি, ততক্ষণ আমাকে জইয়ে রাখবে।

তাতো বটেই, তবে তারও একটা সীমা আছে তো।

তা আর বলতে। লোহার নার্ভকে টলানো যায় না। বরং গুলি করা ভালো। যাক, এক গেলাস চলবে নাকি?

চলবে। তবে আমার সামনে ঢালুন গেলাস।

সাবাস মস্তান। হুঁশিয়ার খুনে তুমি ভাবছ বিষ মিশিয়ে দেব?

দিতেও তো পারেন।

কথা বাড়ালাম না। আর এক গেলাস ককটেল পাঞ্চ করলাম ওর সামনেই। গালপাট্টা কড়া নজর রাখল আমার নড়াচড়ার ওপর। বেচাল দেখলেই ট্রিগার টিপতে দ্বিধা করবে না।

বরফ ভাসিয়ে এগিয়ে দিলাম গেলাস। হাত বাড়িয়ে গেলাস ধরল না মস্তান। বলল টেবিলে রাখুন। ঠিক আছে। চেয়ারে বসুন।

আমি বসলাম। মস্তান এগিয়ে এল। গেলাস নিয়ে বসল ইজি চেয়ারে। এক চুমুকে না খাওয়া পর্যন্ত কোনও কথা বললাম না।

এক চুমুকেই মেজাজ শরিফ হবে জানতাম। এ জিনিস মস্তানের চোদ্দো পুরুষও খেয়েছে কিনা সন্দেহ।

তারপর বললাম–অলকানন্দা এখন কোথায়?

কে?

অলকানন্দা। আমার বউ।

পার্টিতে। ডজন খানেক ছেলেবন্ধু নিয়ে হয়তো ঢলাঢলি করছে এই মুহূর্তে। দেখলেও ভালো লাগে। তা না আপনি..বুড়োহাবরা…।

তার মানে, আমি যখন গুলি খাব, অলকানন্দা তখন পার্টি নিয়ে মশগুল।

কষ্ট হচ্ছে?

মোটেই না। ভাবছি প্ল্যানটা ফাইন। ডজনখানেক ইয়ার সাফাই দেবে ওর হয়ে। পুলিশ অলকানন্দার ডগাও ছুঁতে পারবে না।

ঠিক ধরেছেন। বুদ্ধিটা আমার।

গোবর গণেশের বুদ্ধি! মনে মনেই বললাম আমি। মুখে বললাম–ব্রিলিয়ান্ট প্ল্যান। পুলিশ আসবে। আমার ঝাঁঝরা লাশ দেখবে। দেখে কী বলবে? খুনে-ডাকাতের কাণ্ড? তাই তো?

তা তো বটেই, গেলাসটা সামনের ককটেল টেবিলে রাখল মস্তান।

আপনার হার্টটা ফুটো করবার পর গেলাসটা ধুয়ে রেখে দেব মদের আলমারিতে। আমার আঙুলের ছাপ যেখানে লেগেছে, যাবার আগে সব মুছে দিয়ে যাব রুমাল দিয়ে। লেগেছে তো শুধু দরজার হাতলগুলোয় আর এই গেলাসে।

দামি দামি দু-চারটে জিনিস সঙ্গে নেবে নিশ্চয়? নইলে পুলিশ বলবে কেন ডাকাত পড়েছিল?

ও সব ছ্যাচড়ামোর মধ্যে আমি নেই। কিছুই নেবো না আমি। পুলিশ ভাববে, ভয়ের চোটে পালিয়েছে ডাকাত। গুলি করেই এমন প্যানিক হয়ে ছিল যে জিনিস নেবার সময় পায়নি।

দেওয়ালের ছবিটা দেখে নিল মস্তান।

ন্যাংটা ছবি, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়েই বলল।

ফ্রান্সের নামকরা পেন্টারের আঁকা ছবি। দাম কত জানো?

গালপাট্টা নীরব।

চল্লিশ হাজার টাকা, বললাম আমি।

শুনেই, গালপাট্টার নির্বোধ চাহনি চকিতের জন্যে ফের নিবদ্ধ হল অয়েল পেন্টিংয়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে পিচ্ছিল চাহনি পিছলে ফিরে এল আমার ওপর।

বলল–লোভ দেখাচ্ছেন? চল্লিশ হাজার টাকা চাট্টিখানি কথা নয়। তবে কি জানেন, আগে আমার জান, পরে টাকা। ছবি নিয়ে ফ্যাসাদে পড়ি আর কি। ও ছবি যেখানে নিয়ে যাবো, আপনার চিহ্নও সঙ্গে সঙ্গে যাবে, তারপর? ফাঁসি কাঠ? না, স্যার না। একটু থামল গালপাট্টা। হাসল। টোল পড়ল ফুলো গালে-বুঝেছি।

কী বুঝেছি।

ছবি দিয়ে প্রাণটা ফেরত চাইছেন?

ক্ষতি কি?

গালপাট্টা সবেগে ঘাড় নাড়ল বাচ্চা ষণ্ডের মতো–দেখুন স্যার, খুন করাটা আমার ব্যবসা। ব্যবসায় বেইমানি করলে আর কেউ কাজ দেবে?

শূন্য গেলাসটা নামিয়ে রাখলাম ককটেল টেবিলে। ঠান্ডা গলায় বললাম, মস্তান, কি চাও তাহলে? ভয়ে কাঁপছি দেখলে খুশি হবে?

কাঁপতে আপনাকে হবেই। ঢের ঢের হেঁকর দেখেছি। শেষকালে তো কেঁদে কুল পায় না।

কাঁদলেই গুলি করবে বুঝি? ঈষৎ শক্ত হল গালপাট্টার বোকা চাহনি–কেন মিছে কেরদানি দেখাচ্ছেন? বুক তো ঢিপ ঢিপ করছে। এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন কলির ভীম আর কি।

বাঃ, বেশ গুছিয়ে বলো তো মস্তান। দেখে তো বোঝা যায় না এত কথা পেটে আছে। যাক, তুমি কি ভাবো তোমার হুমকি শুনেই ঊ্যা করে কঁদবো?

ভ্যাঁ না করলেও চ্যা তো করবেন। মরার আগেই আধখানা প্রাণ বেরিয়ে আসবে। কত তালেবরকে কাত করলাম এইভাবে।

সর্বস্ব দিয়েও কেউ যদি প্রাণ ভিক্ষা চায়?

বৃথা।

মানুষ হিসেবেও তো মানুষকে দয়া করা যায়?

আমি অমানুষ। আমার ছেলেবেলায় আমাকে কেউ দয়া করেছিল? মানুষের মতো কেউ বাঁচতে দিয়েছিল?

মস্তান, ছবিটা আর একবার দেখো। ছবির পেছনে কি আছে জানো?

বলুন না। ঘাড় না ফিরিয়েই বলল মস্তান।

দেওয়াল সিন্দুক।

গালপাট্টা ঘাড় ফিরালো না।

নগদ দেড়লাখ টাকার নোট পাবে সিন্দুকে।

দেড়লাখ!

হ্যাঁ, দেড়লাখ। সারা জীবনেও যা রোজগার করতে পারবে না।

বলে, গেলাস হাতে নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। গেলাম অয়েল পেন্টিংয়ের সামনে। গোপন বোতাম স্পর্শ করতেই কজার ওপর ঘুরে গেল অতবড় ছবিটা যেন দরজার পাল্লা।

দেওয়াল সিন্দুকের ঠিক মাঝখানে নম্বরী হাতল। পাক দিলাম গুনে গুনে। সিন্দুক খোলার কোড নম্বর আমি ছাড়া কেউ জানে না। অলকানন্দাও নয়।

খট করে আওয়াজ হল। সবুজ আলোটা জ্বলে উঠেছে। অর্থাৎ চিচিং ফাঁক। আলিবাবা আর চল্লিশ দস্যুর সেই রত্নগুহার দ্বার যেন উন্মোচিত।

হাতল ধরে টান দিলাম। নীচের খুপরি থেকে বার করলাম বড় খামটা। হাতের গেলাসটা রাখছিলাম সিন্দুকের ভিতরে। পাল্লা বন্ধ করে নম্বরী হাতল ঘুরিয়ে দিতেই পুট করে নিভে গেল সবুজ আলোটা। যার অর্থ, সিন্দুক বন্ধ হয়ে গেছে। কামান দাগলে যদি খোলে।

ফিরে দাঁড়ালাম। দেখি, পলকহীন চোখে আমার প্রতিটি মুভমেন্ট লক্ষ্য করছে গালপাট্টা। তর্জনী চেপে বসেছে মিশমিশে হাতিয়ারের ট্রিগারে।

বিচলিত হলাম না। এগিয়ে এসে খামটা ফেলে দিলাম ওর সামনে।

কিছুক্ষণ যেন বোবা হয়ে রইল গালপাট্টা। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বললে–কিনতে চান আমাকে?

সিগারেট কে তুলে নিয়ে একটা সিগারেট বাছলাম অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। তারপর গম্ভীর গলায় বললাম–না।

তবে টাকা আনলেন কেন?

একেবারেই উচ্ছন্নে যে যায়, তাকে টাকা দিয়েও কেনা যায় না।

টাকার খাম আনলেন কেন তাহলে? কঠিন স্বর গালপাট্টার।

জবাব দিলাম না। লাইটার টিপে সিগারেট জ্বালালাম। একমুখ ধোঁয়া সিলিং লক্ষ্য করে ছাড়লাম। তারপর খামটা তুলে উপুড় করে ধরলাম ককটেল টেবিলের ওপর।

ভেতরে থেকে যা বেরুল, তা নোটের তাড়া নয়–কাগজের তাড়া।

বোগাস পেপার, ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট নাচিয়ে নাচিয়ে বললাম একই রকম গম্ভীর গলায়। সেই সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যেন একটা ধাক্কা খেল গালপাট্টা। নির্বোধ চাহনিতে এই প্রথম দেখলাম ইস্পাতের ছুরি।

খানিকটা সময় নিলেন বুঝলাম, আরক্ত মুখ মস্তানের। কেন?

তোমার গেলাসটা রেখে এলাম সিন্দুকের ভেতর। টাকা আনার অছিলা না করলে পারতাম না।

ওটা আপনার গেলাস–আমার নয়।

আবার হাসলাম আমি–নাহে, ওটা তোমারই গেলা। পুলিশ এসে যখন দেখবে, ফাঁকা সিন্দুকে শুধু একটা খালি গেলাস, টনক নড়বেই। আঙুলের ছাপও নেবে। কারণ, খুনের তদন্তে মদের গেলাস থাকাটার মানে অনেক।

চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইল গালপাট্টা–অসম্ভব। সমানে নজর রেখেছি আপনার ওপর। গেলাস সরাতেই পারবেন না।

আবার হাসলাম আমি–বার দুয়েক ছবিটার দিকে ঘাড় ফিরিয়েছিলে মনে আছে?

সে তো দু-এক সেকেন্ডের জন্যে।

দু-এক সেকেন্ডেই যথেষ্ট। গেলাস পাল্টাপাল্টি করতে কতক্ষণ লাগে?

অসম্ভব দেখলাম, কপালে ঘামের আভাস দেখা দিয়েছে গালপাট্টার।

বললাম–পুলিশ আসবে। গেলাসও পাবে। আঙুলের ছাপের ছবি উঠবে। তোমার ঠিকানাও মিলবে। তারপর? যথা সময়ে দুলবে ফাঁসির দড়িতে। পরকালে ফের দেখা হবে আমাদের। তখন না হয় শোনা যাবে ফাঁসিকাঠে দাঁড়ানোর যন্ত্রণা কাহিনি। এর চাইতে গুলি খেয়ে মরা ভালো, তাই? ভালো কথা, ফাঁসিতে ঝোলার গল্প-টল্প এর আগে শুনেছ?

মস্তানের তর্জনীর দিকে নজর গেল। আঙুল কাঁপছে। আঙুল চেপে বসেছে ট্রিগারের ওপর।

সিগারেটে আবার একটা জম্পেশ টান দিলাম। বললাম–তোমার শেষ অবস্থা দেখে শেয়াল কুকুরেও কাঁদবে হে। তোমার ধারণা নিশ্চয় অন্যরকম। ভেবেছ অনেক টাকা পাবে। পায়ের ওপর পা তুলে কাটাবে শেষ জীবন। সবাই তাই ভাবে। মরীচিৎকার পেছনে সবাই দৌড়োয়। তোমার কপালে যে কি দুর্গতি–

গলায় এতটুকু আঁঝ দেখালো না গালপাট্টা। সহজভাবে বলল–সিন্দুক খুলুন। নইলে মরবেন।

আমি আওয়াজ করেই হেসে উঠলাম–মরবার সময়ে আর ঠাট্টা করো না, মস্তান। সিন্দুক খুললেও মরতে হবে, না খুললেও মরতে হবে। তাই না?

আধ মিনিটটাক চেয়ে রইল গালপাট্টা। তারপর বলল–কী করতে চান গেলাস নিয়ে?

আমি জানি, এখন তুমি আমাকে মারতে পারবে না। ছেড়ে দেবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে গেলাস সমেত হাজির হব প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে৷ গেলাস থেকে ফটো তুলে নেব তোমার আঙুলের ছাপের। সেই ফটোর সঙ্গে একটা কাগজে লিখে রাখব আজকের ঘটনার বিবরণ। চেহারার বর্ণনা। আরও অনেক কিছু। আঙুলের ছাপ আর তোমার কীর্তি কাহিনি লেখা কাগজটা একটা খামে ভরে গালা দিয়ে মুখ এঁটে দেব। আমার অ্যাটর্নিকে বলে রাখব, যদি কখনও আমার শোচনীয় মৃত্যু ঘটে এবং মৃত্যুর কারণ অ্যাকসিডেন্ট বলেও মনে হয়, যেন খামটা পুলিশ দপ্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়।

একই ভাবে চেয়ে রইল গালপাট্টা। তারপর বুকভর্তি শ্বাস নিয়ে বললে–দরকার কি অত হাঙ্গামার? আমি চলে যাচ্ছি। জীবনে আমার ছায়াও আর দেখবেন না।

মাথা নেড়ে বললাম–তা হয় না। আমার ভবিষ্যৎ আমাকেই দেখতে হবে তো। গায়ে যাতে আঁচড়টি না লাগে, তার জন্যেই এই প্ল্যান।

কি যেন ভাবল গালপাট্টা। বলল–সোজা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন?

কারণ আছে বইকি।

দুশ্চিন্তায় কালো হয়ে এল গালপাট্টার মুখ। চোখ নামাল হাতের রিভলভারের ওপর। আপন মনেই ঘাড় নাড়ল একবার। তারপর রিভলভার রেখে দিল প্যান্টের পকেটে। বলল–আমি না হয় যাচ্ছি। কিন্তু আপনার বেবুশ্যে বউটা তো ছাড়বে না। আবার কাউকে টাকা খাইয়ে পাঠাবে আপনাকে খতম করার জন্যে।

তা তো পাঠাবেই।

মারবে অন্য লোক, আর ফাঁসিতে ঝুলবো আমি?

তাই তো হবে।

গালপাট্টার মুখে আর কথা নেই।

অবশ্য নাও হতে পারে, বললাম আমি। ধরো যদি অলকানন্দা আর নতুন খুনে জোটাতে পারে।

ভাড়াটে খুনের কি অভাব আছে কলকাতায়? ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। আর আপনার গোলগাপ্পা বউটা তো মুড়িমুড়কির মতো টাকা ছড়ায়।

যদি আর ছড়াতে না পারে?

টাকা তো আপনার…ওঃ! বলেই একদম চুপ মেরে গেল গালপাট্টা।

মিষ্টি মিষ্টি হাসলাম আমি–মাথায় ঢুকেছে?

গালপাট্টা জবাব দিল না। তবে ডুবন্ত মানুষ খড়কুটো দেখলেও যেন আকুল হয়–এর চোখেও দেখলাম সেই আলো–আশার আলো।

বললাম–অলকানন্দা এখন কোথায়, তুমি জানো?

জানি। রেডনাইট ক্লাবে। রাত এগারোটা পর্যন্ত ওখানেই থাকবে।

রাত এগারোটা? ফাইন। ভালো সময়। তার ওপর অমাবস্যার রাত। অন্ধকারে কাছের মানুষও দেখা যাবে না। রেডনাইট ক্লাবের ঠিকানা জানো?

না। গালপাট্টার চোখ ঠেলে বেরিয়ে এল।

সদর স্ট্রিটে, বাড়ির নম্বরটা বললাম। চার তলার ফ্ল্যাটে কুখ্যাত নাইট ক্লাব। তোমার চেনা উচিত ছিল।

আধ মিনিট দুজনে তাকিয়ে রইলাম দুজনের পানে।

বললাম খুব মিষ্টি করে–তোমার জান বাঁচানোর জন্যে আর একটা জান নিতে হবে। অলকানন্দা বেঁচে থাকলে তুমি মরবে।

এগারোটার সময়ে আপনাকে কোথায় পাবো, স্যার? উঠে দাঁড়িয়ে বলল গালপাট্টা।

আমার ক্লাবে। চার পাঁচ জন বন্ধুকে নিয়ে তাস পিটব। খবর যখন পৌঁছোবে, সবাই মিলেই শুনব। একটু থেমে ফের বললাম–কী খবর মস্তান?

আপনার বউ গুলি খেয়ে মরেছে। নেকড়ের মতো হেসে ফেলল গালপাট্টা। একটা কথা জিগ্যেস করব, স্যার?

করো।

বউকে ভালোবাসেন?

ককটেল টেবিলে জেড পাথরের ভারী সুন্দর একটা নারী মূর্তি সাজানো ছিল। মূর্তিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে-দেখতে বললাম–অনেক দাম দিয়ে অনেক শখ করে কিনেছিলাম এটা। এখন শখ মিটে গেছে। আর ভালো লাগে না। ভাবছি ফেলে দেব। নতুন মূর্তি কিনব।

বিদায় হল গালপাট্টা। হাতে অনেক সময়। ক্লাবে যাওয়ার আগে মদের গেলাসটা ডিটেকটিভ এজেন্সিতে জমা দিয়ে এলাম।

সিন্দুকে যে গেলাস রেখেছিলাম–সেটা নয়। সে গেলাসে আমার আঙুলের ছাপ ছাড়া আর কোনও ছাপ ছিল না।

যে গেলাসটা গালপাট্টা ককটেল টেবিলে রেখে বিদায় নিল–নিলাম সেই গেলাস।

গেলাসের কাছে শুধু চোখেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মস্তানের আঙুলের ছাপ।

* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *