ম্যারিঅন-এর ঘটনা
কাপড়ের আবরণে মাথা-মুখ ঢাকা যেন চলমান প্রেতমূর্তিগুপ্ত সমিতির সদস্য–এদের আমি দেখেছিলাম। সাদা পোশাক পরে ছিল সবাই। ঘোড়ায় চেপে স্রোতের মতো এসেছিল তারা। প্রদোষের ম্লান আলোয় ঘোড়সওয়ার মূর্তিগুলোকে সাক্ষাৎ শয়তানের মতো দেখাচ্ছিল। আমার তখন বয়স খুব অল্প। নেহাতই ছেলেমানুষ। ফ্লোরিডার মেরিয়ানার কাছাকাছি একটা গ্রামে আমি থাকতাম। অনেক রাত আমার জীবনে এসেছে, কিন্তু সে রাতটাকে আমি আজও ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি কীভাবে মাথা-মুখ আচ্ছাদিত লোকগুলো একটা জ্বলন্ত ক্রশ ঝুলিয়ে দিয়েছিল ক্যাথলিক গির্জের বাইরে; তারপর ভেতরকার উপাসনারত সবাইকে হুকুম করেছিল বাইরে বেরিয়ে আসতে। বয়স তখন খুবই অল্প হলেও এ-সবের অর্থ যে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ সূচনা, তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার ছিল।
ক্যাথলিক, নিগ্রো, ইহুদি–এদের প্রত্যেককে ঘৃণা করত মাথামুখ ঢাকা এই লোকগুলো। গায়ের রং যাদের সাদা নয়, দক্ষিণদেশের মানুষ না হলেও যারা তাই মনে করে নিজেদের–এদের প্রত্যেককে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত এরা, এই মাথা-মুখ আচ্ছাদিত লোকেরা। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের গ্রামের সবার এবং খেত-খামারের চাষি মানুষদের অন্তরে বিভীষিকা রচনা করে এসেছে এই কু ক্লক্স ক্ল্যান-য়েরা।
ছেলেবেলায় প্রথমদিকের স্মৃতি, বিশেষ করে এই সবের স্মৃতি কোনওদিনই মুছে যায় না মনের পট থেকে। পঞ্চাশ বছর আগেকার ঘটনা হলেও আজও আমি যখন জীবনে প্রথম দেখা মাথা-মুখ ঢাকা সেই লোকগুলোর কথা মনে করি, স্নায়ুতে স্নায়ুতে উপলব্ধি করি সেদিনকার রক্তজমানো আতঙ্ক।
পরে এদের সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য আমি জেনেছিলাম। জেনেছিলাম কীভাবে গৃহযুদ্ধের সময়ে সর্বপ্রথম শুরু হয় কু কুক্স ক্ল্যান-য়ের তৎপরতা। তারপর দাসত্ব প্রথা লোপ পাওয়ার পর আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে এরা। সে সময়ে অজ্ঞতা, আতঙ্ক আর কুসংস্কার–এই সবকটিকেই কাজে লাগাত ওরা। অনেক নিগ্রোর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ক্ল্যান্সমেনরা সত্যি সত্যিই সাদা ভূত এবং তাদের অলৌকিক ক্ষমতাও তাই সীমাহীন।
কলেজে পড়ার সময়ে ক্ল্যানদের তৎপরতা সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য আমি পড়েছিলাম। এদের বিচিত্র অনুষ্ঠান-পদ্ধতি যা শুনলে উপকথা বলে মনে হয়, এদের মৃত্যুর শপথ এবং কোনও সভ্যের নাম ফাঁস করে দেওয়ার দুঃসাহস যে দেখায় তার প্রতি পাশবিক দন্ডদানের বিধান–সবই আমি জানতে পারলাম। কশাঘাত এবং লাঞ্ছনার সে এক গা শিউরোনো কাহিনী। গ্র্যান্ড ইম্পিরিয়েল উইজার্ড অ্যান্ড মোগল ইত্যাদি গালভরা নামগুলো শুনলে হাসি পেলেও কিন্তু বাস্তবিকই এদের অস্তিত্ব ছিল। ধর্মগত এবং জাতিগত বিদ্বেষকে জিইয়ে রাখার জন্যে যারা জীবন পণ করেছে, এ নাম ছিল তাদেরই।
তারপর বহু বছর পরের কথা। বড় হয়েছি আমি। দেহ-মনে পরিপূর্ণতা লাভ করেছি এবং অপরাধী সন্ধানী হিসেবে কিছু সুনামও হয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে আমাকে পাঠানো হল একটা কু ক্লক্স ক্ল্যান হত্যার তদন্তে। সমাজের দুষ্ট ব্রণস্বরূপ আমেরিকার রীতিনীতির পরিপন্থী এই গুপ্ত সমিতির কফিনে আরও এটা পেরেক পোঁতার জন্যে আমার সর্বশক্তি বিনিয়োগ করা সংকল্প নিয়ে রওনা হলাম আমি।
১৯৩০ সালের ৭ আগস্ট ইন্ডিয়ানার ম্যারিঅনে পৌঁছোলাম আমি। বিধির কি বিড়ম্বনা। এক সময়ে এই ম্যারিঅনের নামডাক ছিল অন্য কারণে। অবরুদ্ধ দক্ষিণ অঞ্চল থেকে বহু নিগ্রো ক্রীতদাস মাটির তলার রেলপথ দিয়ে সটকান দিয়েছিল এইখান দিয়েই।
ম্যারিঅনের ঘটনাটা আসলে দু-পরিচ্ছেদে ভাগ করা একটিমাত্র কাহিনি–যার শুরু এবং শেষ মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। ফেয়ারমন্ট জায়গাটা খুব কাছেই। ফেয়ারমন্টের একটি খামার থেকে একটি ছেলে তার আঠারো বছরের বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার জন্যে এসেছিল ম্যারিঅনে। ঘটনার শুরু এইখান থেকেই। সিনেমা দেখতে গিয়েছিল দুজনে। তারপর একটা ড্রাগ স্টোরে দাঁড়ায় সোডা খাওয়ার জন্যে। সেখান থেকে দুজনে গাড়ি হাঁকিয়ে যায় মিসিসিনউয়া নদীর দিকে। গাড়ি দাঁড় করানোর পর নদীর ধারে দুজনেই একটু ফুর্তিউচ্ছল হয়ে ওঠে। লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীরা এ ধরনের পরিবেশে এসে যেরকম আনন্দে মেতে ওঠে, এ-ও তাই। কিন্তু এ হেন কবিতার ছন্দপতন ঘটল আচম্বিতে আতঙ্ক আর বিভীষিকার এক ঘন কালো মেঘের আবির্ভাবে। আচমকা এক ঝটকায় খুলে গেল গাড়ির দরজা এবং একটা ছায়ামূর্তি, নিগ্রো বলেই মনে হয়েছিল তাকে, একটা রিভলভার তুলে ধরল দুজনের পানে।
গুরু গম্ভীর গলা শোনা যায়, ওহে খোকাখুকুরা, বেয়াড়াপনা করলেই বিপদে পড়বে। ভালো চাও তো গুটি গুটি নেমে এসো দিকি গাড়ির ভেতর থেকে।
বিনা দ্বিধায় হুকুম তামিল করে ছেলেটি। মেয়েটি গাড়ির মধ্যেই বসে থাকে। এবার পিস্তলধারীর সংকেত পেয়ে অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আরও দুজন ছায়ামুর্তি। ছেলেটির পকেট হাতড়ে তাকে কপর্দকহীন করে ওরা–খুচরোগুলোও নিতে ভোলে না। তারপর দলের পাণ্ডার হুকুম হয় মেয়েটিকে দেখাশুনা করার। ওদের মধ্যে একজন সুট করে ঢুকে পড়ে গাড়ির ভেতর এবং পর মুহূর্তে মেয়েটির ভয়ার্ত চিৎকার ভেসে আসে ছেলেটির কানে। মরিয়া হয়ে ওঠে সে। নিজের বিপদ তুচ্ছ করে আচমকা এক মোক্ষম ঘুসি বসিয়ে দেয় পিস্তলধারীর মুখের ওপর।
এ কাজে রীতিমতো সাহসের দরকার বিশেষ করে একজন অল্পবয়সি ছেলের পক্ষে এতখানি সাহস দেখানো বড় সোজা কথা নয়।
একটু টলে ওঠে পিস্তলধারী। তার পরেই সামলে নিয়ে পর পর তিনবার গুলিবর্ষণ করে। হাতে এবং পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে আছড়ে পড়ে ছেলেটি। ক্ষতমুখ দিয়ে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তের মধ্যে গড়িয়ে গিয়ে জ্ঞান হারায় সে।
হানাদার তিনজন তিরবেগে দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়ে নিজেদের গাড়িতে। পুরোনো মডেলের একটা টি ফোর্ড গাড়ি। এবং সাংঘাতিক ভাবে আহত ছেলেটির পানে এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়েই ঝড়ের মতো বেগে গাড়ি চালিয়ে উধাও হয় সব্বাই।
প্রিয়তম ছেলেটির পায়ে নতজানু হয়ে বসে পড়ে মেয়েটি। ঘটনার আকস্মিকতায় এমনই অভিভূত হয়ে পড়েছিল বেচারি যে প্রথমেই আর্তস্বরে চিৎকার করে ওঠে সে। কিন্তু তার চিৎকার শুনে ছুটে আসার মতো লোক ধারে কাছে কেউই ছিল না। শেষকালে নিরালা জায়গাটা ছেড়ে সে দৌড়তে থাকে একটা খামারবাড়ি লক্ষ্য করে সাহায্যের আশায়। রাত তখন দশটা কুড়ি মিনিট।
গুলিবর্ষণের এই দৃশ্যটি যেখানে ঘটে, সে জায়গাটি ম্যারিঅনের বাইরে। কাজেই শহরের পুলিশরা সাফ বলে দিলে তদন্তটা পড়ছে কাউন্টি কর্তৃপক্ষের এক্তিয়ারে। ডাক পড়ল স্টেট হাইওয়ে পেট্রলের। শেষে ঠিক হল গ্রান্ট কাউন্টির শেরিফ জেক ক্যাম্পবেল হাতে নেবেন এই কেস।
ক্যাম্পবেল লোকটি ছিলেন ঝানু পুলিশ অফিসার। সাহসেরও তার অভাব ছিল না। এবং অভাব যে বাস্তবিকই নেই, তা প্রমাণিত হয় তাঁর খুঁড়িয়ে চলার ধরন থেকেই। পিস্তলযুদ্ধে গুরুতরভাবে পায়ে চোট পেয়েছিলেন ক্যাম্পবেল। এ কেস যখন হাতে নিলেন, তখন ডাক্তারেরা উঠে পড়ে লেগেছেন ছেলেটির জীবন বাঁচানোর জন্যে। মেয়েটির জবানবন্দি থেকে ঘটনার নিখুঁত বিবরণও পাওয়া গিয়েছিল।
গুলিবর্ষণের পরেই সেই রাত্রে ম্যারিঅনে হাজির ছিলেন ক্যাম্পবেল। একটা সেকেলে মডেলের টি ফোর্ড গাড়ির মধ্যে তিনজন নিগ্রোকেও দেখেছিলেন। ওয়াশিংটন স্ট্রিট বরাবর বিকট স্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে গাড়ি চালাচ্ছিল ওরা। ওদের এই হুল্লোড় আর আচরণ দেখে তখন কিন্তু উনি বিশেষ কিছু ভাবেননি। উনি জানতেন, মেজাজ খিঁচড়ে গেলে, খুব মুষড়ে পড়লে মানুষমাত্রই, তা সে কালো হোক আর সাদাই হোক, একটু বেসামাল হয়ে ওঠে। হাবভাবে আচার ব্যবহারে তখন অনায়াসেই একটা বেখাপ্পা বেয়াড়া ভাব লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক, টি মডেল গাড়িটাকে দাঁড় করালেন উনি। দেখলেন, রেজিস্ট্রেশন হয়েছে টম শিপ-এর নামে। এই কাণ্ডর একটু পরেই ক্যাম্পবেল এবং তাঁর ডেপুটিরা রওনা হলেন টম শিপ-এর ঠিকানা খুঁজে বার করার জন্যে শহরের যে অঞ্চলে কালো চামড়ার লোকেরা থাকে সেই দিকে।
কোঠা বাড়িটায় রঙের কোনও বালাই ছিল না। আধা-অন্ধকারের মধ্যে বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন বয়সের ভারে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেচারী নিজেকে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে রাখার মতো শক্তিও তার নেই। গ্যারেজের ভেতরে হানা দিতেই ফোর্ড গাড়িটা চোখে পড়ল পুলিশ অফিসারদের। অ্যাক্সেলের চার পাশে ঘাস এবং গুল্ম লেগেছিল। মিসিসিনউয়া নদীর তীরে গেলে যে ধরনের ঘাস-গুল্ম পাওয়া যায়–ঠিক সেই রকমের।
পর্দা দেওয়া দরজাটা লাথি মেরে দুহাট করে খুলে ফেললেন ক্যাম্পবেল। এলোমেলো বিছানার ওপর জামাকাপড় পরেই চিৎপাত হয়ে শুয়ে ছিল টম শিপ। ঘুম ভাঙানোর পর সে স্বীকার করলে, হ্যাঁ, এক স্মিথ আর হার্ব ক্যামেরন নামে দুই বন্ধুর সঙ্গে সে একটু ফুর্তি করতে বেরিয়েছিল বটে। শিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ক্যাম্পবেল। ডেপুটিরা পাকড়াও করে আনলেন স্মিথ আর ক্যামেরনকে।
আব্রাহাম স্মিথের বয়স উনিশ বছর। আর হার্ব ক্যামেরনের বয়স মাত্র ষোলো। উপবাসশীর্ণ ফিনফিনে চেহারা তার। হাতকড়া লাগিয়ে দুজনকে নিয়ে যাওয়া হল ম্যারিঅনের পুরোনো আদালত ভবনে। লাল ইট আর গ্রানাইট দিয়ে তৈরি সে বাড়ি।
নদীতীরে গুলিবর্ষণের অকুস্থলে এবং তার পরের ভয়াবহ উপসংহার নিয়ে তদন্তে ব্যস্ত থাকার সময়ে ক্যাম্পবেল অনেক কথা আমায় বললেন সে রাতের ঘটনা প্রসঙ্গে। কিন্তু গ্রেপ্তার করবার পর সেই রাতেই ডেপুটিরা এই তিনটি কালোচামড়া ছেলেদের নিয়ে আসলে কি যে করছিলেন, তার কোনও বৃত্তান্তই আমি বার করতে পারলাম না কারও কাছ থেকে। শুনেছিলাম থার্ড ডিগ্রি নামক পদ্ধতিটিও বাদ যায়নি। কেউ কেউ বললে, ছেলেগুলোর পেট থেকে স্বীকরোক্তি আদায় করার পর নাকি বেদম হাঁপিয়ে পড়েছিলেন ডেপুটিরা।
নদীতীরে প্রেমিক-প্রেমিকার ওপর চড়াও হওয়ার কথা স্বীকার করেছিল টম শিপ। বাকি দুজনেই স্বীকার করেছিল, হ্যাঁ তারাও ছিল টম শিপ-এর সঙ্গে।
ম্যারিঅনের সীমানার বাইরে কু কুক্স ক্ল্যান-এর সভার নির্ধারিত সময় ছিল ৭ আগস্টের রাত দুটো। সবাই মিলিত হবার পর নিষিদ্ধ জিন-এর স্রোত বয়ে গেল নির্বাধে। সেই সঙ্গে চলল নিগ্রোদের প্রতি অবাধে বিষেণচাঁদগার। আলোচনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে শেষ পর্যন্ত মতলব স্থির হয়ে গেল : ঠিক হল, দল বেঁধে সবাই হামলা দেবে জেলের মধ্যে। সভা যখন ভঙ্গ হল, তখন বেশির ভাগ ক্ল্যানসমেন-ই মদে চুর চুর এবং নষ্টামির জন্যে উদগ্রীব। জেলার প্রত্যেককে ডেকে তুলে বিরাট দল গড়ার পরিকল্পনাও হয়েছিল। স্লোগান তৈরি হল, কুত্তা নিগারগুলোকে যেভাবেই হোক পাঠাতে হবে যমালয়ে!
সকাল দশটা নাগাদ আদালত ভবনের দিকে যে-কটা রাস্তা এসেছে, সবকটায় জড়ো হল কাতারে কাতারে লোক। পিল পিল করে আরও লোক আসছিল ম্যারিঅনের বাইরে থেকে। রাগে গনগনে প্রত্যেকেরই মেজাজ। সত্যি কথা বলতে কি আসন্ন হাঙ্গামার সম্ভাবনায় দেখতে দেখতে থমথমে হয়ে উঠল চারপাশের আবহাওয়া। জেলের বাইরে জনতা যে কিছু গোলমাল শুরু করার জন্যেই ওত পেতে রয়েছে, এ সম্পর্কেও হুঁশিয়ার করে দেওয়া হল শেরিফ ক্যাম্পবেলকে। কয়েদিদের চুপিসারে ম্যারিঅনের বাইরে পাচার করে দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হল তাঁকে।
কিন্তু নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাস রাখতেন শেরিফ। তাই জবাব দিলেন–অর্থাৎ সবাই ভাবুক যে ভয়ের চোটে ল্যাজ গুটিয়ে সরে পড়ছি আমি। ওসব কিসসু হবে না। এ অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ভেদ্য জেল হল এইটা। কারও ক্ষমতা নেই দরজা ভেঙে এর ভেতরে উৎপাত করবে।
দারুণ ভুল করেছিলেন ক্যাম্পবেল। কেননা, খুব জোর ঘণ্টা তিনেক, কি তারও একটু পরেই জয়জয়কার পড়ে গেল সেই আইনের। যে আইন কোনও আইনের পরোয়া না করে নিজ হাতেই তুলে নেয় অপরাধীকে দণ্ড দেওয়ার গুরুভার। কড়া রোদ্দুরের মধ্যে ঝুলতে লাগল দু-দুটো নিষ্প্রাণ দেহ। আনুষ্ঠানিক বিচার প্রহসন বেমালুম কেটে হেঁটে সংক্ষিপ্ত করে আনলে জনতা। রক্তের তৃষ্ণা মিটোনোর এই বীভৎস দৃশ্যে কিন্তু একটি জাতীয় রক্ষীও উপস্থিত ছিল না একাজ থেকে তাদের নিবৃত্ত করার জন্যে।
জেলের ওপর সর্বপ্রথম হামলা শুরু হয় চারজন মাথা মুখ ঢাকা ক্ল্যানসমেন-এর প্রচেষ্টায়। রাস্তার কোণ থেকে লোহার ট্রাফিক সিগন্যালটা মাটি খুঁড়ে তুলে আনে ওরা। তারপর, শুরু হয় আদালত ভবনের লোহার খিলমারা ওককাঠের ভারী দরজাটার ওপর আঘাতের পর আঘাত। কিন্তু এক চুলও নড়ে না পাথরের মতো শক্ত দরজাটা। বাধ্য হয়ে লোহার খেটে নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয় ওরা। রীতিমতো ঘামতে ঘামতে বিস্তর গালিগালাজ বর্ষণের পর আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়ে তাদের প্রচেষ্টা।
ইতিমধ্যে একটা কঁদুনে গ্যাসের বোমা এসে পড়ে জনতার মাঝে তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্যে। কিন্তু একজন অতি-তৎপর ক্ল্যান হাঙ্গামাকারী চট করে বোমাটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিলে যেদিক থেকে এসেছে সেইদিকেই। দরজা-ভাঙার খেটে এবার আর ব্যর্থ হয় না। দরজার পাশে পাশে গাঁথুনিতে ফাটল দেখা যেতেই মুহুর্মুহু বিজয়ের উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে এদিকে-সেদিকে। হুড পরা একজন চিৎকার করে ওঠে–ওহে হাত লাগাও সবাই, বাস্টার্ডদের এবার আমরা হাতের মুঠোয় পাব। হাতে হাতে চালান হয়ে গেল জিন মদের একটা বোতল। উইজার্ড অর্থাৎ জাদুকরের পোশাকের নীচ থেকে বেরিয়ে এল একটা দড়ি। এবং আরও রাশি রাশি লোক ছুটে এল হাত লাগানোর জন্যে।
জেলের বাইরের পৈশাচিক উল্লাসে উন্মত্ত হাঙ্গামাকারীদের নিরোধ করা যাবে না–এমন ধারণা কিন্তু তখনও জেলের ভেতরে শেরিফ ক্যাম্পবেলের মাথায় আসেনি। আগের চাইতেও জনতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। কাণ্ড দেখার জন্যে গাড়ির ছাদে ওপরেও উঠে পড়েছিল বিস্তর মানুষ। কেউ কেউ আবার আদালত ভবনের দরজা ভাঙার দৃশ্যটা ছেলেমেয়েদের দেখানোর জন্যে তাদেরকে তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধের ওপর। এ হেন হামলা স্বচক্ষে দেখে বিকৃত তৃপ্তি পাওয়ার জন্যে এসেছিল অনেকে। এ কাজে অংশ নেওয়ার অত সাহস তাদের ছিল না। বাধা দেওয়ার মতো সাহস বা সদিচ্ছাও কারও ছিল না।
জানলা থেকে তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ক্যাম্পবেল–থামো! দরজার দিকে আমি মেশিন গানের মুখ ঘুরিয়ে রেখেছি। প্রথমেই যে ঢুকবে, তার আর নিস্তার নেই।
বিকট চিৎকার আর উল্লাসধ্বনির মধ্যে অব্যাহত থাকে হামানদিস্তা পেটার মতো দমাদম শব্দ। শেষকালে খসে পড়ে পাথর আর ইটের বাঁধুনি এবং বিজয়মাল্য এসে পড়ে কু ক্লক্স ক্ল্যানদের গলে। ধুলো আর চুন-বালি-শুরকির কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হুড়মুড় করে জনতা ঢুকে পড়ে ভেতরে। তারপর যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তা উন্মাদদের প্রলয়নাচন ছাড়া আর কিছুই নয়।
বেপরোয়া জনতার ওপর গুলি চালানোর ভয় দেখালেও শেষ পর্যন্ত তা আর করলেন না ক্যাম্পবেল। এ সম্পর্কে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসা বাস্তবিকই বড় সহজ কাজ নয়। উনি জানতেন ভিড়ের মধ্যে তাঁর বন্ধু আছে, প্রতিবেশী আছে, হয়তো দু-একজন আত্মীয়ও আছে। কয়েদিদের প্রতিরক্ষার জন্যে জন বারো কি তারও বেশি মানুষকে সাবাড় করাটা ন্যায়সঙ্গত কিনা, তা তাঁকে ভাবতে হয়েছে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই। এবং তার চাইতেও দরকারি হল এই যে জনতার ওপর বেধড়ক গুলি চালিয়েও কি কয়েদিদের বাঁচাতে পারেন উনি?
মাথা মুখ ঢাকা ভেল্কিবাজরা শেরিফের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় চাবির থোকা। খুলে যায় গারদের দরজা। দুজন চেপে ধরে টম শিপকে। অজ্ঞান হতে তখন তার বেশি দেরি নেই। একজন তাকে শক্ত হাতে ধরে রাখে, আর একজন ঘুসির পর ঘুসি বসিয়ে যেতে থাকে তার মুখের ওপর। টানতে টানতে ওকে আনা হয় বাইরে। আদালত ভবনের সিঁড়ির ওপর থেকে লাথি মেরে গড়িয়ে দেওয়া হয় নীচের লনে। তারপর যখন দড়ির ফাঁস পরানো হয় ওর গলায়, তখন পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়েছে সে। গাড়ির ছাদের ওপর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে গলা চিরে চিৎকার করতে থাকে–খুন করো ওকে! খুন করো ওকে!
এক মুহূর্তের মধ্যেই গাছ থেকে ঝুলতে থাকে টম শিপ। তারপর টেনে আনা হয় এব স্মিথকে। দু-হাত তার পিছনে বাঁধা। একজন মাতাল জড়িয়ে জড়িয়ে জিগ্যেস করে–কিহে কালো শয়তান, কীরকম লাগছে তোমার? দড়ির অন্য প্রান্তের ফসটি ওক গাছের একটা শাখার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনা হয়। এবং নিষ্করুণভাবে ফাসবদ্ধ এই নিগ্রো ছোকরাও খুব দ্রুত ত্যাগ করে তার শেষ নিঃশ্বাস।
ষোলো বছরের হার্ব ক্যামেরন একজন স্ত্রীলোকের সেলে লুকিয়ে পড়ে রেহাই পেয়ে যায় সে যাত্রা। চুরির জন্যে স্রেফ দশদিনের হাজতবাসের গল্প ওরা বিশ্বাস করেছিল কিনা, অথবা ওরকম হাড্ডিসার ছোকরার জন্য দড়ির অপচয় করাটা ওরা অনুচিত মনে করেছিল কিনা তা কেউ বলতে পারবে না। এমনও হতে পারে যে দু-দুটো খুনের পর জনতার হত্যালালসা এবং হাঙ্গামাতৃষ্ণা অনেকাংশে মিটে গিয়েছিল।
এই ভয়াবহ গল্প বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ার পর দুনিয়ার পুলিশরা এসে হাজির হল ম্যারিঅনে। জাতীয় রক্ষীবাহিনীও এল। কিন্তু তখন ক্ল্যানসমেনদের কেউই আর ছিল না সেখানে অন্তত হুড়-পরা অবস্থায় নয়। অপরাধীদের খুঁজে বার করার চেষ্টায় আমি যখন কাজ শুরু করলাম, তখনও কিন্তু বেশ গরম ম্যারিজনের আবহাওয়া। রুচিশীল নাগরিকেরা যে এই বীভৎস হাঙ্গামার জন্যে খুব মুষড়ে পড়েননি, এমন কল্পনাও যেন কেউ না করেন। এমনকী একজন পুরুতও হত্যাকারীদের সনাক্ত করতে যারা পারে তাদের প্রতি আবেদন করার সময়ে প্রকাশ করে ফেলেছিলেন, বহুজনের মতের সঙ্গে তাঁরও মতের মিল আছে এ বিষয়ে। উনি বলেছিলেন, খ্রিস্টের নামে বলছি, জনতার ভয়াবহ জয়লাভের ফলে যারা অত্যাচারিত, তাদের সম্পর্কে সত্য কথা শুনতে চাই আমরা।
সামরিক আইনের আওতায় এসে পড়ে ম্যারিঅন। জনতা আইনের নিয়ম লঙ্ঘন করার মতো সাহস যাদের আছে, তাদেরকে নিয়ে চার হপ্তা ধরে একনাগাড়ে আমি চেষ্টা করলাম ন্যায়চক্রকে ঘূর্ণমান রাখতে। কিন্তু এত তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য যারা দেখেছে, তাদের অত জিজ্ঞাসাবাদ করেও আমি এমন দুজন সাক্ষী পেলাম না যারা দলের পাণ্ডাদের নাম বলতে রাজি আছে। দুজন তো দূরের কথা, এরকম লোক আমি একজনকেও পেলাম না। কেউই বলল না–আমি দেখেছি–নিগ্রোদের গলায় ফাঁস পরাতে। আমি ওকে চিনি। ভালোভাবেই চিনি। আমার ভুল হতে পারে না এবিষয়ে। বহুবার তার গলাও আমি শুনেছি।
গুজব শোনা গেল, ক্ল্যান পান্ডারা জর্জিয়া পালিয়েছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে আর করণীয় কিছুই ছিল না। পরবর্তী কর্মপন্থাকে কার্যকরী করতে গেলেই আমাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা দুই দেশের মধ্যে সন্ধি সম্বন্ধে আবদ্ধ অপরাধ। অর্থাৎ আন্তঃ প্রদেশ কিডন্যাপিং অথবা আন্তঃপ্রদেশ যোগাযোগ। কিন্তু তা অসম্ভব ছিল। গভর্নমেন্টের পক্ষেও করণীয় কিছু ছিল না। কাজে কাজেই কেসটা ছেড়ে দেওয়া হল প্রদেশ কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের হাতে।
জেম্স এম ওগডেন নামে এক সাহসী অ্যাটর্নি জেনারেল শেষ পর্যন্ত ম্যারিঅনের ক্ল্যানদের দলপতি হিসেবে দুজন পুরুষকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণাদির অভাবে কোর্ট এ অভিযোগ নাকচ করে দেয়।
হার স্বীকার করার পর ম্যারিঅন ছেড়ে এসেছিলাম আজ হতে প্রায় পঁচিশ বছর আগে। এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে দক্ষিণ অঞ্চলে, সুদিন এসেছে, উন্নতি ঘটেছে। যদিও হেথায়-সেথায় এখনও জাতিবিদ্বেষ ফুটে রয়েছে দুষ্ট কীটগ্ন ফুলের মতো, তবুও বেশির ভাগ আমেরিকান তাকিয়ে আছেন সেই সুদিনের দিকে যেদিন এই বিষ চিরতরে মুছে যাবে সমাজের বুক থেকে।
* জন কোন্যালী (আমেরিকা) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।