আদুরে খোকা

আদুরে খোকা

রাত তখন দুটো।

টেলিফোন এল শিকাগোর সীমানা ঘাঁটি থেকে। রাইটউড অ্যাভিন্যুতে ছোট্ট একটা পানাগারে এইমাত্র একটা রাহাজানি হয়ে গেল। টেলিফোনেই ঘটনাটার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনলাম কর্তব্যরত সার্জেন্টের কাছ থেকে।

জায়গাটা শহরের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। কাজেই চট করে একটা গাড়ি নিয়ে ঝটিতি পৌঁছে গেলাম অকুস্থলে। গিয়েই দেখা হয়ে গেল মার্টিন চৌয়ানস্কির সঙ্গে। দারুণ উত্তেজনায় প্রায় লাফাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। ধড়ে যে তখনও প্রাণটা রয়ে গেছে, এ জন্যেও আনন্দের অবধি ছিল না তার। ভয়ে প্রাণ উড়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের এবং সেই বৃত্তান্তই আমাকে বলতে পেরে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

দুটো বাজতে তখনও দশ মিনিট বাকি। দোকান বন্ধ করব করব ভাবছি, এমন সময়ে একটা লোক এসে হাজির। লোকটাকে আমি চিনিই না। ঠিক বন্ধের মুখে হুট করে আসার জন্যে মেজাজ খিঁচড়ে গেল আমার। তাই সাফ বলে দিলাম, চটপট এক ঢোক গিলেই বিদেয় হতে হবে। খদ্দের বেশি ছিল না তখন। কপোত-কপোতীর মতো একটি যুগল মূর্তি আর মের্ডাড বসাকি। মেডার্ড বসাকিকে তো আপনি চেনেনই। উনিও তো পুলিশ অফিসার। আজ রাতে ওঁর কোনও ডিউটি ছিল না।

লোকটাকে জিগ্যেস করলাম কী ধরনের সুরা তাকে দেব। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর-টুত্তর দিয়ে ফস করে এক জোড়া রিভলভার বার করে আমার দিকে তাগ করে ধরল সে। আর তার পরেই এক হুঙ্কার–টাকাগুলো বার করে দিলে কীরকম হয়?

শুনেই বসাতি হাত বাড়ালেন তাঁর রিভলভারের দিকে। লোকটা কিন্তু ভারী হুঁশিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে যেন কিছু হয়নি এমনি সবে বলে উঠল–আপনি বরং ওটা টেবিলের ওপরেই রেখে দিন। তা না হলে আজ রাতেই একজনকে অক্কা পেতে হবে।

আমিই বললাম বসাকিকে–শুনুন শুনুন, রিভলভারটা সরিয়েই রাখুন। আমি চাই না খামোকা একটা খুনোখুনি হয়ে যাক এখানে। নগদ যত টাকা আছে তা না হয় ওকে দিয়ে দিচ্ছি আমি।

কথা শুনলেন বসাকি। গোঁয়ার্তুমি করলেন না। বাস্তবিকই, আমাকে অথবা অন্য কাউকে বিপদে ফেলার ইচ্ছে তো ওঁর ছিল না।

বন্দুকধারী এবার বসাকিকেই উদ্দেশ্য করে বললেন,–ভালো মানুষের মতো রিভলভারটা আমার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিন দিকি মশাই। কথার সঙ্গে সঙ্গে ক্লিক করে শব্দ হল দুটো রিভলভারেরই।

প্রথম থেকেই লক্ষ্য করলাম লোকটা একেবারেই নিরুত্তেজ, নিরুদ্বেগ, আর সংহত। বসাকি রিভলভারটা বারের টেবিলের ওপর দিয়ে ঠেলে এগিয়ে দিলে পর নির্বিকারভাবে লোকটা তা তুলে নিয়ে গুঁজে রাখল পকেটে। তারপর আমাকে লক্ষ্য করে বললে–এবার স্মার্ট ছেলের মতো চটপট টাকা কড়িগুলো বার করে দিন তো। সবুজ রঙের যা কিছু নোট-ফোট আছে, তাই দিন। খুচরা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।

বাক্যব্যয় না করে কড়কড়ে ষাটটা ডলার তুলে দিলাম লোকটার হাতে। টাকাটা পকেটস্থ করেই এক দৌড়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল সে।

বসাকি এরপর এক মুহূর্তের বেশি সবুর করেননি। কিন্তু আততায়ী তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। কাজেই পথে বেরিয়ে লোকটার টিকিও দেখতে পাননি বসাকি। রাস্তায় শুধু তাল তাল অন্ধকারই ছিল না, ছিল অজস্র আঁকাবাঁকা সরু গলি। যে-কোনও একটার মধ্যে ঢুকে সটকান দেওয়া এমন কি আর কঠিন কাজ।

আমি আসার আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন বসাকি। খুব শিগগিরই তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। তবুও বন্দুকধারী আগন্তুকের নিখুঁত দৈহিক বর্ণনা পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না আমাকে। লোকটা ধূমকেতুর মতো যখন ঢুকে পড়ে মদ্যশালায়, তখন যে তরুণ-তরুণী দুটি ছিল ঘরের মধ্যে, তাদের কাছ থেকে এবং চৌয়ানস্কির মুখে যা শুনলাম, তা থেকেই লোকটা স্পষ্ট হয়ে উঠল মনের চোখে। বয়সে সে যুবাপুরুষ, কালো-কালো এক মাথা চুল, ছিপছিপে চেহারা–দেখতে শুনতে মন্দ নয়। পরনে তার কালো প্যান্ট। খাটো হাতা স্পোর্টস শার্টটা প্যান্টের ওপর এমনভাবে ঝুলিয়ে দিয়েছিল সে যে বেল্টে গোঁজা রিভলভার দুটো তাইতেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

বসাকি আসার আগেই বেশ বুঝেছিলাম লোকটাকে। বসাকির কাছে পরে শুনলাম লোকটার চেহারার আর এক দফা বর্ণনা। আর এরকম হরিণের মতো দৌড়োতে নাকি তিনি এর আগে আর কাউকে দেখেননি। ঘাঁটিতে বসে এ সম্বন্ধে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হল আমাদের মধ্যে। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল ফুলের তারিখ দেওয়া আমার রিপোর্টটাও সঙ্গে ছিল। লেফটেন্যান্ট ফ্র্যাঙ্ক পেপে রিপোর্টটার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে এক কথায় বলে দিলেন এ অপকর্ম কোনও মহাপ্রভুর।

বললেন–এ কাজ ওই বোম্বেটে কার্পেন্টার ছোকরার। এই নিয়ে সত্তরবার হল। কিন্তু ওকে আমি বার করবই। এই যদি আমার জীবনের শেষ গ্রেপ্তার হয়, তাহলেও জেনো, ওর রেহাই নেই।

বাস্তবিকই রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক পেপে। ঝানু অফিসার হিসেবে তার অভিজ্ঞতা তো বড় কম নয়। সহকর্মীরা তাঁকে যেমন ভালোবাসত, শ্রদ্ধা করত ঠিক তেমনি তাকে যমের মতো ভয়ও করত আর দু-চক্ষে দেখতে পারত না শিকাগোর অপরাধদুনিয়ার বাসিন্দারা। বেশ কয়েকবার গুলি-গোলা চলেছিল পুলিশ আর শহরের গুন্ডাদের মধ্যে। ফ্র্যাঙ্ক পেপে কিন্তু লড়াই-অন্তে এমন আটজন মূর্তিমানবকে শ্রীঘরে পাঠিয়েছিলেন, খুন-জখম আর ডাকাতির জন্যে যারা কুখ্যাত।

পেপের সঙ্গে কথাবার্তা, শেষ হলে পর ফিরে এলাম আমার অফিসে। ধার করলাম রিচার্ড কার্পেন্টারের ইয়া মোটা ফাইলটা। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে লোকটাকে খুঁজছি আমরা। উচ্চতায় সে পাঁচ-ফুট এগারো ইঞ্চি। ওজন ১৬৫ পাউন্ড। মাঝে মাঝে গোঁফ রাখে। কোটরে-বসা চোখ। বয়স ছাব্বিশ বছর। বিস্তর ডাকাতির মামলা ঝুলছে তার নামে। কিন্তু গত পনেরো মাস যাবৎ আরও ঘন ঘন আর বেশি সংখ্যায় রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে তার কীর্তিকলাপের ধরন দেখে মনে হয় শিকাগো শহরের বাইরে সে কোনও দিনই যায়নি। মুদিখানা, পেট্রোল পাম্প, পানাগার, হোটেল, লন্ড্রি ইত্যাদি ছোটখাটো জায়গায় ক্ষমতা জাহির করেই খুশি সে৷ ছদ্মবেশ ধারণের প্রচেষ্টা কোনও দিনই করেনি কার্পেন্টার এবং একলা কাজ করাই পছন্দ করে সে। এখনও কাউকে সে যমালয়ে পাঠায়নি বটে, তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস একদিন না একদিন সে তা করবেই।

অনেক তথ্যই জানা গিয়েছিল ওর সম্বন্ধে। প্রতিবারই ক্যাশ লুঠ করার সময়ে হুমকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিস্তল দুটো বার করে ফেলে ও। তারপর কোনও গাড়ির সাহায্য না নিয়েই চক্ষের নিমেষে অন্তর্হিত হয় নগদ সমেত। দারুণ চটপটে সে। দৌড়োতেও পারে হরিণের মতো অস্বাভাবিক দ্রুত বেগে। এবং যেখানেই তার আবির্ভাব হোক না কেন, রিভলভার দুটো সব সময়ে তার সঙ্গে থাকবেই। ভয় দেখাবার জন্যে পিস্তলের হ্যাঁমার ঠুকে ক্লিক ক্লিক্ শব্দ করাও তার আর একটা নিয়মিত নষ্টামি। বাঁধাধরা সূচি অনুসারেই কাজ চালিয়ে যায় কার্পেন্টার। দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় পঁচিশ ডলার দরকার পড়ে ওর। উদাহরণ স্বরূপ, কোনও জায়গায় চড়াও হওয়ার পর যদি একশো ডলার হাতে পারে কার্পেন্টার, তাহলে অন্ততপক্ষে চারদিন আর কোনও উৎপাত করতে শোনা যায় না ওকে। আবার কখন-সখন যদি এর দ্বিগুণ অর্থ পকেটস্থ করতে পারে, তাহলে তো পুরো এক হপ্তা পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে জিরিয়ে নেয়। মদ্যশালায় তার আবির্ভাব ঘটে শুধু রাত্রে–দোকান বন্ধ করার সময়ে। কেননা, এই সময়ে ক্যাশে যত টাকা জমা পড়ে, তত টাকা সারা দিনে অন্য কোনও সময়ে পাওয়া সম্ভব নয়। কোনও কোনও পানাগারে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সামনে বিয়ারের গেলাস নিয়ে ঝিমুতে থাকে ও। তারপর কাজ হাসিল করার পরেই গেলাসটি চুরমার করে দিয়ে যায় যাতে তার আঙুলের ছাপ গোয়েন্দাদের হাতে না পড়ে।

এইভাবে যাদের সিন্দুক ও হালকা করেছে তাদেরই একজনকে দিব্বি শান্তভাবে বলেছিল কার্পেন্টার–আরে মশাই নিজের মগজ খাটান। উত্তেজিত হবেন না, নাভার্সও হবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন কীরকম স্থির আমি। আপনাকে পরলোক পাঠানোর কোনও সদিচ্ছাই নেই আমার। কাজেই আমার মতোই নির্বিকার থাকুন। তবে, বেচাল দেখলেই আপনার ওই আস্ত মগজে একটা ফুটো করে দিতে এতটুকুও দ্বিধা করব না। আর এক মদের দোকানের মালিকের কাছে শুনেছিলাম, কার্পেন্টার নাকি ক্যাশ থেকে তিনশো ডলার হাতিয়ে নিয়ে উধাও হওয়ার পরেও খদ্দেররা বিন্দুবিসর্গ টের পায়নি। পুলিশ আসবার পরে টনক নড়ে তাদের।

একবার ক্যাশ লুঠের পরেই একজন ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে আশাহত করেছিল কার্পেন্টার। ড্রাইভারকে ও বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে যে, একটা মারমুখো লোকের কাছ থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে চাইছে সে। স্ত্রীর শোবার ঘরে নাকি কার্পেন্টারকে দেখতে পেয়েছিল লোকটা। তাই তার রক্তদর্শন না করলে নাকি স্বামী ভদ্রলোক শান্ত হবে না। কাজে কাজেই যত তাড়াতাড়ি এ অঞ্চল থেকে সটকান দিতে পারে সে, ততই মঙ্গল। ড্রাইভার ভাবলে বুঝি সত্যি সত্যিই আরোহীর জীবনরক্ষা করছে সে। কিন্তু এত ঝক্কি পোহাবার পুরস্কার মিলল মাত্র দশ সেন্ট বখশিশ! নিজের পরিবার ছাড়া, প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই একই রকম সঙ্কীর্ণমনা ছিল কার্পেন্টার। তাছাড়া, আরও একটা গুণ ছিল তার। বেশির ভাগ লুঠেরা খোলামকুচির মতো টাকা ছড়িয়ে দুদিনেই ফতুর হয়ে যায়। কিন্তু কার্পেন্টার ছিল বড় হিসেবী। অপচয় করা তার কোষ্ঠীতে লেখা ছিল না।

একবার খবর এল বেশ কয়েক মাস হল নর্থ ক্যারোনিলা অ্যাভিন্যুতে বোবা-কালাদের প্রতিষ্ঠান ক্র্যাকোভার হোম-এ আস্তানা নিয়েছে সে। জোর কানাঘুসো শুনলাম, এখানে গেলেই দর্শন মিলবে মহাপ্রভুর। বাড়িটা ঘেরাও করে ফেললাম আমরা। কিন্তু দেখা গেল দু-হপ্তা আগেই পাখি উড়েছে।

রাইটউড সরাইখানায় তার কুকীর্তির পর দু-মাস কেটে গেল। কিন্তু কোন গর্তে যে সে সেঁধিয়ে বসে রয়েছে, তার কোনও হদিশ পেলাম না আমরা। কার্পেন্টারের মার্জারের মতো ক্ষিপ্রতা আর তড়িৎ-তৎপরতায় প্রতিটি পুলিশকর্মী সজাগ হয়ে উঠেছিল। গায়ে এতটুকু আঁচ না লাগিয়ে পর-পর এতগুলি বে-আইনি কাজ করে সারা পুলিশবাহিনীকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছিল ও। শেষকালে সম্মেলনে বসলাম আমরা। নতুন কৌশল আর কর্মপদ্ধতির উদ্ভাবন করলাম। খুব সম্ভব মেয়েদের কাছ থেকেই পাওয়া যাবে তার বর্তমান ঠিকানা, এই আশায় এই ধরনের হেন মেয়ে নেই, যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়লাম আমরা। কিন্তু কার্পেন্টরের ছবি দেখা সত্ত্বেও কেউ চিনতে পারল না ওকে। শেষকালে বারমেড, সস্তা হোটেলের রিসেপশন ক্লার্ক, এবং অপরাধ দুনিয়ার ছিঁচকে চোর-ছ্যাচোড় থেকে শুরু করে রাঘব-বোয়ালদেরও রেহাই দিলাম না। কিন্তু বৃথাই। দেখা গেল, কার্পেন্টার বাস্তবিকই নির্বান্ধব। শিয়ালের মতো ধূর্ত সে। নিজের জীবিকা সমস্যার সমাধান করে সে নিজের বুদ্ধি-শক্তি দিয়েই–দুনিয়ার কারোর ওপর আস্থা নেই তার।

লোকটার সম্ভবপর গতিবিধি বিশ্লেষণ করার জন্যে হয়তো একজন মনোসমীক্ষকেরই দরকার ছিল আমাদের। অনেকবার এমন সম্ভাবনাও এসেছে আমাদের মাথায় যে হয়তো শহরতলীরই কোনও সম্মানজনক প্রতিষ্ঠানে দিনের বেলা ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে সে। আর রাতের বেলা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে কোনও কারখানায় দিনের তৎপরতা গোপন করার জন্যেই। কিন্তু শিকাগো শহরটা তো আর ছোট শহর নয়। কাজেই এত সহজে এরকম চিরুনি-আঁচড়ানো তল্লাশি পর্ব পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না কোনওমতেই।

কার্পেন্টারের জন্ম হয় ১৯২৯ সালে। অর্থনৈতিক নিস্তেজনার সেই সঙ্কটময় দিনগুলিতে শান্তি ছিল না পরিবারে। ঝগড়াঝাটি লেগেই ছিল বাবা আর মায়ের মধ্যে। শেষকালে বিবাহবিচ্ছেদ করে পৃথক হয়ে গেলেন ওর মা ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আর, তার কিছুদিন পরেই মোটর দুর্ঘটনায় মারা গেলেন ওর বাবা। রিচার্ড কার্পেন্টারের বয়স তখন মাত্র দশ বছর। জীবন-বীমা না থাকায় দারুণ চাপ পড়ল ওর মায়ের ওপর। অভাব-অনটনের নিত্য নেই নেই হাহাকারে দেখতে দেখতে বুড়িয়ে গেলেন তার মা। তবুও ভেঙে পড়লেন না ভদ্রমহিলা। কষ্টেসৃষ্টে কোনওমতে শান্তি বজায় রাখলেন ছোট্ট পরিবারটির মধ্যে। রিচার্ড, তোর দুই বোন, আর নিজে–এই নিয়ে ছিল তার ছোট্ট সংসার। ছেলেমেয়েদের মধ্যে রিচার্ডকেই তিনি বেশি ভালোবাসতেন। তাছাড়া, আশ্চর্য একটা সম্প্রীতিবোধ ছিল তিন ভাইবোনের মধ্যে। এমন বড় একটা দেখা যায় না। রিচার্ড কিন্তু মা বলতে অজ্ঞান। মা ছাড়া তার এক দণ্ডও চলত না। মায়ের কোলে বসে আদর পাওয়ার মতো লোভনীয় জিনিস তার কাছে আর কিছুই ছিল না। একদিন এইভাবেই কোলে বসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল রিচার্ড। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল–মা, নিজেকে বড় একা লাগছে আমার। আমাকে ছেড়ে যেও না। এরকম পরিস্থিতিতে সে যে মায়ের সবচেয়ে আদুরে হয়ে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য।

সংসারের টানাটানি আরও বৃদ্ধি পেল। শেষকালে নিরুপায় হয়ে মিল-অকির একটা অনাথ আশ্রমে রিচার্ডকে পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হলেন ওর মা। রিচার্ড কার্পেন্টারের পরবর্তী জীবনে যে কলঙ্কময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তার সূচনা কিন্তু এইখান থেকেই। রিচার্ডের সঙ্গে কেউই নিষ্ঠুর ব্যবহার করেনি। বরং যত্ন পরিচর্যার সীমা ছিল না সেখানে। কিন্তু বাড়ি থেকে অনেক দূরে থাকার ফলে তার মানসিক অশান্তির সীমা-পরিসীমা ছিল না। কাজেই শত চেষ্টাতেও ওর শিক্ষকেরা এদিক দিয়ে ওকে সুখী করে তুলতে পারেননি। কোনও রকম ত্রুটি ছিল না তার আচার ব্যবহারে। চোখে-মুখে এমন একটা ছেলেমানুষি মিষ্টিভাব ছিল যে ভালো না বেসে পারা যেত না। কিন্তু পড়াশুনোর দিক দিয়ে ক্রমশই পিছিয়ে পড়তে লাগল রিচার্ড। আপ্রাণ চেষ্টা করলেন শিক্ষকরা। কিন্তু কিছুতেই স্কুলের পড়াশুনোয় মন বসাতে পারল না রিচার্ড কার্পেন্টার।

ষোলো বছর বয়সে তার চাইতে অনেক কমবয়সি ছেলেদের ক্লাসে বসতে হল তাকে। সমবয়সি ছাত্ররা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, চেহারায়, পোশাকে নোংরা থাকার বদভ্যাস শুরু হয় এখান থেকেই। স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর ও ঘুরতে থাকে এক কাজ থেকে আর এক কাজে। কখনও হয়েছে জাহাজঘাটার কেরানী, কখনও ট্রাক-ড্রাইভার। কখনও নিয়েছে ডিশ ধোওয়ার কাজ এবং এই ধরনের আরও কত ছোটখাটো কাজ। কিন্তু কোথাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি ও। যতবার চাকরি গিয়েছে তার, ততবারই সহানুভূতির স্নিগ্ধ প্রলেপে মনের জ্বালা জুড়োনোর জন্যে ছুটে গেছে মায়ের কাছে। প্রতিবারই অভিযোগ জানিয়েছে বড়ই অসুখী আর নিঃসঙ্গ সে।

আঠারো বছর বয়েসে সৈন্যবাহিনীতে নাম লেখাল রিচার্ড কার্পেন্টার। কিন্তু মিলিটারি সম্পত্তিতে ক্ষতি করা থেকে শুরু করে এত রকম নিয়ম লঙ্ঘন আরম্ভ হল যে গার্ডহাউসেই বিস্তর সময় ব্যয় করতে হল ওকে। শেষকালে এ ধরনের অবাঞ্ছিত লোককে বরখাস্ত করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইল না। সৈন্যবাহিনী থেকে বেরিয়ে এল রিচার্ড কার্পেন্টার শুধু একটি জিনিস ভালোভাবেই রপ্ত করে এবং তা হচ্ছে পিস্তল চালানো। কিন্তু তার চরিত্রের আশ্চর্য দিকটুকু জানলে বাস্তবিকই অবাক হতে হয়। এ হেন লোকেরও আতীব্র আসক্তি ছিল সিরিয়াস সঙ্গীত, অপেরা সিম্ফনী আর কনসার্টে। বহু রবিবাসরীয় অপরাহ্নে ক্ল্যাসিকাল রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে ও মা-কে। ভালো ভালো রেকর্ড সংগ্রহের বাতিকেই উড়ে যেত ওর যাবতীয় উদ্বৃত্ত অর্থ।

অপরাধী জীবনের গোড়ার দিকেই দু-দুবার পুলিশ পাকড়াও করে রিচার্ড কার্পেন্টারকে। প্রথমবার সৈন্যবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর বেআইনীভাবে বিস্তল বহন করার অপরাধে। সৈন্যবাহিনীতে একসময়ে যারা কাজ করেছে, হামেশাই লুকিয়ে চুরিয়ে পিস্তল সঙ্গে রাখতে দেখা যায় তাদের। কাজেই কার্পেন্টারকেও একপ্রস্থ ধমকধামক দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। কঠিন শাস্তি হল না। এগারো মাস পরে বাড়ির মধ্যে বসে দুটো রিভলভার পরিষ্কার করছিল রিচার্ড। হঠাৎ বন্দুক থেকে গুলি ছুটে যায়–গুলি গিয়ে লাগে ওর মায়েরই গায়ে। কপাল ভালো, খুব গুরুতর চোট লাগেনি। কিন্তু পুলিশ যখন জানতে চাইল আসল ব্যাপারটা কী, তখন চটেমটে ওর মা পুলিশমহলকেই অভিযুক্ত করে বসলেন। তারা নাকি, খামোকা তার আদুরে ছেলেকে নাজেহাল করছে।

১৯৫১ সালে রিভলভার উঁচিয়ে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছ থেকে আট ডলার ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হল রিচার্ড কার্পেন্টার। মূল সাক্ষী কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানত না যে কার্পেন্টারই প্রকৃত অপরাধী। তা সত্ত্বেও গ্রেপ্তার করা হল ওকে। আটটা ডলার আর একটা রিভলভারও পাওয়া গেল ওর কাছ থেকেই। তাতেই আদালতের আর কোনও সন্দেহই রইল না কয়েদীর কুকীর্তি সম্বন্ধে। এক বছর কারাবাসের দণ্ড দিলেন ধর্মাবতার।

বড় কড়া দাওয়াই দেওয়া হল রিচার্ডকে। অন্তত সেইভাবেই শাস্তিটাকে নিয়েছিল ও। এক বছরের মধ্যে কোনও কয়েদীর সঙ্গেই বন্ধুত্ব করতে দেখা গেল না ওকে। মা মাঝে মাঝে আসতেন। সঙ্গে আনতেন মিঠাই আর কেক। কার্পেন্টার কাউকেই ভাগ দিত না এইসব খাবারদাবারের। খুপরির অন্যান্য কয়েদীরা আদুরে থোকা বলে খেপাত ওকে। ফলে, উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগল ওর মনের জ্বালা।

শ্রীঘর থেকে বেরিয়ে এসে কার্পেন্টার প্রতিজ্ঞা করল জীবনে আর কখনও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে খেলা করবে না। খুঁজে পেতে একটা ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাজ জুটিয়ে ফেলল ও। প্রতি হপ্তায় আশি ডলার রোজগার করতে লাগল কার্পেন্টার। চরিত্রের মধ্যে অতিনৈষ্ঠিক বৈশিষ্ট্যের অঙ্কুরও দেখা গিয়েছিল সে সময়ে। বারবনিতা বা জুয়াড়িদের ট্যাক্সিতে তুলত না ও। নিঃসঙ্গ নেকড়ের মতোই ভয়াবহতা ওর প্রকৃতির কন্দরে সুপ্ত ছিল তখন। কিন্তু মাঝে মাঝে দুই বোন আর একজন খুড়তুতে বোনকে নিয়ে প্রায়ই সিনেমায় যেত। স্কেটিং করতেও যেত সবাইকে নিয়ে। পরে এই খুড়তুতো বোনের কাছে শুনেছিলাম–রিচার্ড নিজে কিন্তু স্কেটিং জানতো না। তবুও রাত্রে আমাদের একলা ছেড়ে দিতে চাইত না ও। অনেক সৌভাগ্য থাকলে তবে এরকম ভাই পাওয়া যায়।

তিন বোনের জন্যে সুন্দর সুন্দর পোশাক কিনে আনত রিচার্ড। নিজে কিন্তু নোংরা অগোছালো বেশবাস পরেই দিন কাটিয়ে দিত। একটি মাত্র সুট ছিল ওর। জুতোর অবস্থাও ছিল শোচনীয়–ঘন ঘন মেরামত না করলে চলত না। রীতিমতো উত্তেজনার ঝেকে যখন সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলছে কার্পেন্টার, তখনও কিন্তু ওর ঠাকুরদা বিশ্বাস করতে চাননি যে রিচার্ড কার্পেন্টার একজন বিপজ্জনক প্রকৃতির অপরাধী। জোর গলায় বলেছিলেন বৃদ্ধ–ভারী ভালো ছেলে ছিল ডিকি। একটু খামখেয়ালী ছিল বটে কিন্তু তাতে কি আসে যায়? ও যখন ট্যাক্সি চালাত, তখন আমার জন্যে দুটো-তিনটে সিগার আনতে কোনওদিনই ভুল হত না ওর। বাজে সিগার নয় যথেষ্ট ভালো সিগার।

রিচার্ড কার্পেন্টারের পরিবারের সবাই ভাবলে ছেলেটির এত মানসিক অশান্তির মূল কারণ হল পুলিশের হয়রানি আর আদালতের সমবেদনার অভাব। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে আর একবার স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলল কার্পেন্টার। একটা মোটর চুরি করল ও। পরে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গাড়িটা ওরই হাতে। একটা মুদিখানায় হানা দিয়ে লুঠ করল একশো ডলার। এই ঘটনার পর থেকে আর কোনওদিন সে ফিরে আসেনি নিজের বাড়িতে। পরিবারের কারোর সঙ্গেও আর দেখা করেনি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে লাগল কার্পেন্টার। পায়ে তার ক্রেপসোলের জুতো। বেল্টে গোঁজা একজোড়া রিভলভার। পরপর দুঃসাহসিক রাহাজানির এক ভয়ঙ্কর তালিকার সূচনা কিন্তু এই ঘটনা দিয়েই শুরু।

পুরো আঠারো মাস সবার চোখে ধুলো দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে রইল রিচার্ড কার্পেন্টার। পুলিশ মহলের প্রত্যেকেই তখন খুঁজছে ওকে। তারপর এল ১৯৫৫ সালের আগস্টের সেই শোকাবহ দিনটি। আমার বন্ধু আর সহকর্মী ডিটেকটিভ মর্কি বাড়ি থেকে হেডকোয়ার্টার আসছিল মাটির তলার রেলে চেপে। ডাকাতির তদন্ত করাই ছিল চশমাচোখে মর্ফির একমাত্র কাজ। কার্পেন্টারের রাহাজানি সম্পর্কিত সবকটা স্টাফ মিটিংয়ে হাজির ছিল মর্ফি। কাজেই চলন্ত ট্রেনে বন্দুকধারী ছোকরাকে দেখে চিনতে ভুল হয়নি ওর। তৎক্ষণাৎ লম্বা লম্বা পা ফেলে রিচার্ডকে গ্রেপ্তার করে ফেলে ও। রুজভেল্ট রোড আর স্টেট স্ট্রিটের প্ল্যাটফর্মে কার্পেন্টারকে নিয়ে নেমে পড়ে মর্ফি। তারপর এক অসতর্ক মুহূর্তে পকেট থেকে কার্পেন্টারের ফোটোগ্রাফ বার করে যখন আসল লোকটার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই রিভলভার বার করে এক গুলিতেই মর্ফিকে খতম করে দিলে কার্পেন্টার। ফোটোগ্রাফ গিয়ে পড়ল মেঝের ওপর। উদ্যত রিভলভারের সামনে ভয়চকিত জনতাকে স্থাণুর মতো দাঁড় করিয়ে রেখে ও গিয়ে উঠে পড়ল একটা মস্ত গাড়ির মধ্যে সাবওয়ে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দিয়েই বাইরে যাচ্ছিল গাড়িটা। দরজা খুলেই ভেতরে উঠে পড়ে কার্পেন্টার। বিদ্যুৎ গতিতে আবার কার্তুজ ভরে নেয় রিভলভারে। এবং পরক্ষণেই ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে নলচেটা স্থির করে রেখে গর্জে ওঠে চাপা কণ্ঠে–এইমাত্র কয়েকজনকে খুন করে এলাম আমি। চেঁচামেচি না করে গাড়িটা না চালিয়ে গেলে আপনাকেও খুন করব আমি।

গাড়িটা চালাচ্ছিলেন তেষট্টি বছরের বুড়ো মিঃ চার্লস এ কোপার। কার্পেন্টারের বজ্রগর্ভ হুমকি শুনেই আঁতকে উঠে প্রাণ হাতে নিয়ে বায়ুবেগে গাড়ি চালালেন তিনি। দেখতে দেখতে পৌঁছে। গেলেন শিকাগোর সবচেয়ে সরগরম স্থান লুপ, ডিয়ারবর্ণ আর ম্যাডিসন স্ট্রিটের কেন্দ্রে। একলাফে গাড়ি থেকে নেমেই উল্কাবেগে উধাও হয়ে গেল কার্পেন্টার।

প্রথমেই যে পুলিশ প্রহরীটির সঙ্গে দেখা হল, তার কাছেই হাউ হাউ করে কোর্পার সাড়ম্বরে বর্ণনা করলেন এইমাত্র কি ভয়ঙ্কর ঘটনাটা ঘটে গেল। আঙুলের ছাপের বিশেষজ্ঞ এসে কোপারের গাড়ি থেকে উদ্ধার করলেন তালু আর তিনটে আঙুলের ছাপ। কার্পেন্টারের ছাপের সঙ্গেই তা হুবহু মিলে গেল।

পুলিশ অফিসারকে নিকেশ করেছে কার্পেন্টার। কাজেই পুলিশ ফোর্সের প্রত্যেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলে তার পায়ে বেড়ি পরানোর। যেভাবেই হোক ফাঁদে ফেলতে হবে কার্পেন্টারকে, কিন্তু প্রতিজ্ঞা করা যত সহজ, তাকে পূরণ করা ততটা সহজ নয়। একটা বাড়তি সূত্র অবশ্য পেয়েছিলাম। মিঃ কোপারের কাছে শুনেছিলাম হানাদার লোকটার মুখটা নাকি রোদে পোড়া তামাটে রঙের–প্রায় কালোই বলা চলে। স্থির করলাম, লেক মিচিগানে বেলাভূমিতে যে-কটা সমুদ্রস্নানের স্থান আছে, সবকটাতেই একবার আমার যাওয়া দরকার। এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া, লাগলেও লেগে যেতে পারে।

কিন্তু কিছুই হল না। চাঞ্চল্যকর গল্পে বোঝাই রইল খবরের কাগজের পাতাগুলো। আমাদের কাছেও এল এন্তার মিথ্যা সংবাদ। শিকাগোর একটি সংবাদপত্র পাঁচ হাজার ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে বসল। এমনকী সাহায্য করার জন্যে এফ. বি. আই. (Fedral Bureau of Investigation) কয়েকজন এজেন্টকেও পাঠিয়ে দিলে আমাদের দপ্তরে। সবই হল। কিন্তু কার্পেন্টারের টিকি দেখা গেল না কোথাও।

ডিটেকটিভ মর্ষি নিহত হওয়ার তিনদিন পর পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন একটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত হলে। মজার ব্যাপার কী জানেন? যে ছবিটা দেখতে গিয়েছিলেন ক্লারেন্স কের, তার নামও কিন্তু কল মি লাকি।

সিনেমা হলে ঢুকেই ক্লারেন্স-এর চোখ পড়ল একটা লোকের ওপর। পেছনের সারিতে নাক ডাকিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছিল লোকটা। এক নজরেই রিচার্ড কার্পেন্টারকে চিনতে পেরেছিলেন ক্লারেন্স। গোলমাল না করে বউকে বললেন, গাড়িতে ফিরে তার জন্যে অপেক্ষা করতে।

ইতস্তত করতে লাগলেন তার স্ত্রী। তার ইচ্ছে ছিল ফোন করে পুলিশ ফৌজ ডেকে আনা। কিন্তু ক্লারেন্সের সেই এক গোঁ–কাজটা যখন আমারই আওতায় পড়ছে, তখন আমি একাই সামলাতে পারব তা।

মাত্র বছরখানেক হল পুলিশ ফোর্সে যোগদান করেছিলেন ক্লারেন্স। নবাগত তিনি, অভিজ্ঞতাও ছিল অল্প। তাই বুদ্ধিমতী স্ত্রীর পরামর্শ শুনলেই ভালো করতেন। ঘুমন্ত কার্পেন্টারকে ঝাঁকুনি দিয়ে কড়া গলায় শুধোলেন ক্লারেন্স-এটা কি ঘুমোবার জায়গা?

নিজের চরকায় তেল দিন। ঘুম জড়ানো স্বরে উত্তর এল তখুনি।

আমি পুলিশ অফিসার। লবিতে আসুন আমার সঙ্গে।

ধীর পদে উঠে এল কার্পেন্টার। এমনভাবে এল, যেন তখনও পুরোপুরি ভাবে জেগে ওঠেনি ও। এক হাতে রিভলভার আর এক হাতে ব্যাগ নিয়ে সজাগ হয়ে রইলেন ক্লারেন্স।

ঘুম-ঘুম স্বরে আবার বলে ওঠে কার্পেন্টার–বাইরে বড় গরম, তাই ঠান্ডায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বে-আইনী কিছু তো করিনি।

লবিতে প্রবেশ করে দুজনে। ঠিক এই সময়ে হোঁচট খাওয়ার ভান করেই রিভলভার বার করে সোজা ক্লারেন্সের বুকের ওপর গুলিবর্ষণ করলে কার্পেন্টার। ক্লারেন্সও পাল্টা গুলিবর্ষণ করলেন বটে, কিন্তু গুলিটা লাগল পলায়মান কার্পেন্টারের পায়ে। তিরবেগে ও ছুটে গেল জরুরি অবস্থায় বাইরে বেরোনোর দরজার দিকে। আড়াইশো লোক বসা থাকলেও তখনও বেশ অন্ধকার বিরাজ করছিল সিনেমা হলেন মধ্যে। পটাপট শব্দে জ্বলে উঠল আলোগুলো কিন্তু আবার পাঁকাল মাছের মতোই হাত ফস্কে অদৃশ্য হয়ে গেল রিচার্ড কার্পেন্টার।

গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ শুনেই লবির দিকে ছুটে গেলেন ক্লারেন্সের স্ত্রী। রাস্তা দিয়ে একজন যাজক যাচ্ছিলেন–ফায়ারিংয়ের শব্দে তিনিও বিলক্ষণ আঁতকে উঠেছিলেন। আসবার সময়ে তাঁকেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলেন ক্লারেন্স পত্নী। এসে দেখলেন টমাস ব্র্যান্ড নামে একজন মেডিক্যাল ছাত্র প্রাথমিক শুশ্রূষা করার পর চেষ্টা করছেন কেরের বুক থেকে ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা রক্তস্রোত বন্ধ করতে। ক্লারেন্সের চেতনা তখন বিলুপ্ত প্রায়। সেই অবস্থাতেই দুর্বোধ্য ভাবে বিড়বিড় করে চলেছেন–কার্পেন্টার…কার্পেন্টার..আমি চিনেছি ওকে, কার্পেন্টার…।

সেন্ট মেরী অফ নাজারেথ হাসপাতালে পুরো পাঁচ ঘণ্টা অপারেশন টেবিলে শুইয়ে রাখা হল ক্লারেন্স কের-কে। শিকাগোর সবচেয়ে নামকরা বুক আর হৃদযন্ত্র অস্ত্রোপচারক ডক্টর এডোয়ার্ড এ অ্যাভারী দুরূহ অস্ত্রোপচার করে জীবনরক্ষা করলেন ক্লারেন্সের। অত্যন্ত পল্কা সুতোর ওপর ঝুলছিল তার জীবন। কেননা হৃদযন্ত্রের কাছেই একটা ধমনী জখম হয়েছিল গুরুতরভাবে। পরে ডক্টর অ্যাভারী আমাদের বলেছিলেন–হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে কের-কে। বুক ফুঁড়ে বুলেটটা বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সঙ্কুচিত হয়েছিল ওর হৃদয়যন্ত্র। তা না হয়ে যদি প্রসারিত হয়ে থাকত, তাহলেই কিনারা কেটে বেরিয়ে যেত গুলিটা–সেক্ষেত্রে ওর মৃত্যু ছিল অবধারিত। কিন্তু এখন আর কোনও ভয় নেই।

কার্পেন্টারের এই সর্বশেষ পাশবিক কুকীর্তির খবর ফলাও আকারে ছড়িয়ে পড়ল খবরের কাগজ, টেলিভিশন আর রেডিও মাধ্যমে। সে যে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে, সে সম্বন্ধেও মন্তব্য করতে ছাড়ল না খবর পরিবেশকরা। কিন্তু এই একটিমাত্র সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই পুলিশ হিমসিম খেয়ে গেল! কোন কোটরে যে সেঁধিয়েছে আহত কার্পেন্টার, তার কোনও হদিশই পেল না পুলিশমহল। জখম অবস্থায় গাড়ি না নিয়ে বেশি দূর যাওয়া কার্পেন্টারের পক্ষে সম্ভব নয় নিয়ে। সেইজন্যেই আশা ছিল এবার জনসাধারণের পূর্ণ সহযোগিতা পাওয়া যাবে। তাছাড়া, কম করে ষাটটা পুলিশ স্কোয়াডকেও মোতায়েন করা হয়েছিল খুনে বন্দুকবাজকে পাকড়াও করার জন্যে। প্রতিটি হাসপাতালে খবর চলে গিয়েছিল–যে-কোনও মুহূর্তে ক্ষতস্থান চিকিৎসার জন্যে কার্পেন্টারের আগমন ঘটতে পারে। রেলপথ আর বাস স্টপেজেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিল গোয়েন্দারা। আজে-বাজে লোকের কাছ থেকে টেলিফোন মারফত কয়েকটা লোমহর্ষক গল্পও শুনলাম। তারা নাকি স্বচক্ষে দেখেছে রাস্তার অন্যদিক দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে চলেছে খুনে কার্পেন্টার। কেউ কেউ তাকে লুকিয়ে থাকতে দেখেছে বিশেষ কোনও ফ্ল্যাটে অথবা দোকানের মধ্যে। সে নাকি নতুন একপ্রস্থ পোশাক কেনবার চেষ্টা করছে, লেক মিচিগানের নৌকোয় তাকে নাকি উঠতে দেখা গেছে, এবং নিশ্চিন্তভাবে সে-ই নাকি একটা মালবাহী গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে–এমনও দেখা গেছে। জনা ছয়েক তরুণকে হাতকড়া লাগিয়ে টেনে আনল পুলিশ। কিন্তু কার্পেন্টারের সঙ্গে তাদের মুখের কোনওরকম সাদৃশ্যই পাওয়া গেল না। একজন আঁতকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে খবর আনলে একটা সিনেমাবাড়ির ছাদে নাকি খুনেটাকে দেখতে পেয়েছে সে। সঙ্গে সঙ্গে স্কোয়াডের অফিসাররা বাড়িটা ঘেরাও করে তল্লাশী করলে তন্নতন্ন করে। পরিশেষে ছাদের ওপর পাওয়া গেল শুধু দুজন অর্ধ বসনা তরুণীকে–রৌদ্র-সুখ উপভোগ করছিল তারা।

এ হেন গদ্যময় পরিস্থিতিতে কার্পেন্টার গ্রেপ্তার হলে বাস্তবিকই ক্লাইমাক্স থেকে বঞ্চিত হত এই চমকপ্রদ কাহিনি। কিন্তু এরপর যা ঘটল, তাকে হলিউডি রীতি ছাড়া আর কিছু বলা চলে না–অলীক উপন্যাস যেন চাঞ্চল্যকর বাস্তবে রূপান্তরিত হল। যে রাত্রে সিনেমার মধ্যে পুলিশকর্মী ক্লারেন্স কের গুলিবিদ্ধ হলেন, ঠিক সেই রাত থেকেই বিচিত্র এই কাহিনির মধ্যে জড়িয়ে পড়ল একটা অতি সাধারণ মার্কিন পরিবার–ট্রাক-ড্রাইভার লিওনার্ড পাওয়েল, তার বউ আর সাত বছরের ছেলে রবার্ট আর তিন বছরের মেয়ে ডায়ানা। ওয়েষ্ট পোটোমাক অ্যাভিন্যুতে এদের নিবাস।

সেই রাতেই উৎসব ছিল পাওয়েলের বাড়িতে। সাড়ম্বরে ডিনারের আয়োজন করেছিল পাওয়েল তার নবম বিবাহ বছরে পদার্পণ উপলক্ষ্যে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন নিয়ে ফুর্তিতে উচ্ছল হয়েছিল তারা রাত দশটা পঁচিশ মিনিট পর্যন্ত। অতিথিরা যখন বিদায় নিলে, তখন পাওয়েলের ছোট মেয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছে, আর ছেলে অন্য ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছে। দারুণ গরম পড়েছিল সে রাত্রে–গাছের পাতা নড়ানোর মতো হাওয়াও বইছিল না। রান্নাঘরে গিয়েছিল লিওনার্ড রেফ্রিজারেটর থেকে কোল্ড ড্রিংক বার করার জন্যে, এমন সময়ে পর্দা লাগানো দরজায় টোকা মারার শব্দ শুনতে পেল ও! সামনেই দাঁড়িয়েছিল রিভলভার হাতে রিচার্ড কার্পেন্টার। লিওনার্ড ওর দিকে ফিরতেই তুহিন-শীতল স্বরে বলল–জানেন তো আমি কে?

নীরবে মাথা হেলিয়ে লিওনার্ড জানালে, হ্যাঁ, সে জানে।

এইমাত্র আরও একজন পুলিশের লোককে গুলি করে এলাম আমি। আমি যা বলি, তা যদি করেন তো কোনও ক্ষতি হবে না আপনার। আর তা যদি না করেন, যদি দরজাটা খুলতে না চান–এইখান থেকেই আপনাকে গুলি করব আমি। খুলে দিন দরজাটা।

কয়েক মাস আগে মদ্যশালায় পুলিশ কর্মী বসাকির যে রিভলভারটা পকেটস্থ করেছিল কার্পেন্টার, সেইটাই অকম্পিত হাতে উঁচিয়ে ধরে সে লিওনার্ডের দিকে।

স্বর শুনেই রান্নাঘরে ছুটে এসেছিল মিসেস পাওয়েল। খুব ধীরস্থিরভাবে সংক্ষেপে বলে উঠল লিওনার্ড–ডার্লিং, উত্তেজিত হয়ো না। এরই নাম কার্পেন্টার। ও বলছে, ওর কথামতো কাজ করলে ও গুলি করবে না। আমাদের কোনও ক্ষতিই হবে না। চেঁচিও না।

অন্য ঘরে টেলিভিশন সেটটা চালিয়ে দিল ববি। কথা বলার শব্দ কানে আসতেই সচকিত হয়ে ওঠে কার্পেন্টার। সুধোয়–ওঘরে কে?

আমাদের দুই ছেলেমেয়ে। ববি এখন টেলিভিশন দেখছে। কিন্তু এখুনি এ-ঘরে আসবে ও শুভরাত্রি জানাতে। পিস্তলটা পকেটে রাখলে ভালো করতেন। ওকে বুঝিয়ে বলব-খন আমাদেরই বন্ধু আপনি। ও তা বিশ্বাস করবে। গণ্ডগোলও করবে না। কিন্তু রিভলভার দেখিয়ে ভয় পাইয়ে দিলে হয়তো ও চেঁচিয়ে কান্নাকাটি করতে পারে।

ববি ঘরে ঢুকতেই রিভলবার আড়ালে সরিয়ে রাখল কার্পেন্টার। মদে জড়ানো গলায় আস্তে আস্তে কয়েকটি কথাও বলল তার সঙ্গে। কোনও কিছু সন্দেহ না করে শুতে চলে গেল ববি।

পর পর দু-গেলাস জল খেল কার্পেন্টার। তারপর মিসেস পাওয়েলকে হুকুম করলে ক্ষতস্থান বাঁধার জন্যে একটা ব্যান্ডেজ নিয়ে আসতে। লিওনার্ড নিজে থেকেই ওষুধের দোকানে গিয়ে বীজবারক (অ্যান্টিসেপটিক) কিনে আনতে চাইল। কিন্তু কার্পেন্টার বড় হুঁশিয়ার। বাড়ি ছেড়ে বেরোনো তো দূরের কথা, একটু বেচাল দেখলেই ভয়ংকর পরিণতির সম্ভাবনাটা সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দিলে সে।

এরপর ট্রাউডার খুলে ফেলে আহত ঊরুর ওপর ব্যান্ডেজ বাঁধলে কার্পেন্টার। কের-এর প্রথম বুলেটটা মাংসর মধ্যে দিয়ে গেলেও দ্বিতীয় বুলেটটা গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে–এতটুকু আঁচড়ও লাগেনি। মিসেস পাওয়েলকে দিয়ে টোস্ট আর কফি তৈরি করিয়ে আনল ও। কিন্তু খেল খুব অল্পই।

ক্ষুগ্নিবৃত্তি এবং ক্ষতস্থান শুশ্রষার পর লিভিংরুমে গিয়ে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গে টেলিভিশন দেখতে বসল কার্পেন্টার। প্রোগ্রাম বন্ধ করে বিস্তারিতভাবে তার সর্বশেষ কীর্তির বুলেটিন প্রচারিত হওয়ার সময়ে নেকড়ের মতো দাঁত বের করে হি-হি করে হেসে উঠল কার্পেন্টার।

ট্রাক চালানোই লিওনার্ড পাওয়েলের পেশা। ছ-ফুট চার ইঞ্চি উঁচু বিশাল শরীরে শক্তি বড় কম নেই। ওজনও কার্পেন্টারের চাইতে কম করে ষাট পাউন্ড বেশি। কিন্তু খুনে কার্পেন্টারের মন তো নয়–যেন একটা শক্তিশালী রাডার যন্ত্র। রাডার-মন দিয়ে পাওয়েলের চিন্তাশক্তি আঁচ করে নিয়ে প্রাকুটি করে চিবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–ও চেষ্টা করবেন না। বউ আর বাচ্চাগুলোর কথা মনে রাখবেন সবসময়ে।

দেহের প্রতিটি তন্তুতে নিঃসীম ক্লান্তির গুরুভার নামলেও রীতিমতো হুঁশিয়ার রইল কার্পেন্টার। অনেকক্ষণ পরে পাওয়েল বললে এবার ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে প্রতিবেশীদের সন্দেহ হতে পারে। খড়খড়ির পাখিগুলো নামিয়ে দিতে হুকুম করল কার্পেন্টার। জানলার আর আলোর ওপরেও আবরণ টেনে দেওয়া হল তার নির্দেশে। দেখতে দেখতে ভ্যাপসা গরমে উনুনের মতোই তপ্ত হয়ে উঠল ঘরটা।

বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল পুলিশ সাইরেনের তীক্ষ্ণ তীব্র শব্দ–আশপাশের অঞ্চল তন্নতন্ন করে খুঁজছিল ওরা। যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছে, এমনিভাবে বিড়বিড় করে ওঠে কার্পেন্টার–আমার সম্বন্ধে খুব বেশি মাথা ঘামাবেন না আপনারা। শুধু এইটুকুই জানিয়ে রাখতে চাই, প্রথম গুলিটা আমি ছুঁড়িনি। যাকগে, ও নিয়ে আর এখন ভেবে লাভ কি।

তন্ময় হয়ে টেলিভিশন শুনতে লাগল কার্পেন্টার। কের তখনও জীবিত ছিল কিনা, সেই খবরই জানার জন্যেই কানখাড়া করে বসে রইল অনেকক্ষণ। তারপর বলল–শুধু একটি দুঃখ রয়ে গেল আমার জীবনে। এমন কোনও কাজ করে গেলাম না যার জন্যে আমার মা আর বোনেরা গর্ববোধ করতে পারে। অত্যন্ত নোংরা আর উদ্ধৃঙ্খল জীবনযাপন করেছি আমি। কিন্তু এখন বড় দেরি হয়ে গেছে। হয় ওই টিকটিকিগুলোর গুলিতে আমাকে মরতে হবে, আর না হলে ইলেকট্রিক চেয়ার তো রয়েছেই। মরবার আগে অন্তত একবারের জন্য মাকে দেখতে পেলে অনেকটা শান্তি পাব আমি।

বন্ধুর মতোই সমবেদনার সুরে বলে লিওনার্ড–চেষ্টা করলে আমার তো মনে হয় অনেক ভালো থাকতে পারতে তুমি, সবার ভালোবাসাও পেতে। তোমার বর্তমান হাল দেখে, এত কষ্ট দেখে, বাস্তবিকই দুঃখ হচ্ছে আমার।

সঠিক মনোবিদ্যা প্রয়োগ করেছিল লিওনার্ড। সমবেদনার স্নিগ্ধ ছোঁয়া পেলেই সবকিছু ভুলে যেত কার্পেন্টার। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে উঠল–আজ সারারাত এখানেই থাকব আমি। কাল রাতও থাকব। অন্ধকার হলে তবে বেরুব। ততক্ষণে টিকটিকিগুলো নিশ্চয় এ অঞ্চল ছেড়ে অন্য অঞ্চলে যাবে আমাকে খুঁজতে।

ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘুমোবার ইচ্ছে ছিল কার্পেন্টারের। সেক্ষেত্রে তার রক্ষণাবেক্ষণের ভারটা থাকত নাকি ওদের ওপরেই। কিন্তু মায়ের মন কেঁপে উঠল তাতে। মরিয়া হয়ে এই বলে বোঝালে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ছোটমেয়ে অচেনা মুখ দেখে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে পারে। তাহলেই মহাবিপদ। যুক্তিটা মনে ধরল কার্পেন্টারের। কাজেই বদ্ধ ঘরে পাওয়েল দম্পতির সঙ্গেই রাত কাটানোর আয়োজন করল ও।

একটির পর একটি ঘণ্টা কাটতে থাকে। আরও গুমোট হয়ে উঠতে থাকে ছোট্ট ঘরটা। রিভলভারটা হাতেই রেখেছিল কার্পেন্টার। ঘুম-ঘুম চোখেও সজাগ রেখেছিল দৃষ্টি। ঘুমের দাপটে চোখ দুটো একেবারেই বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্যে সারারাত সে কি প্রানান্তকর প্রচেষ্টা তার!

পরের দিন ভোরবেলা লিওনার্ড বললে–আমাকে কাজে বেরুতে হবে। না বেরুলে কোম্পানি আর পাড়াপড়শীরা অনেক প্রশ্ন করতে পারে। অপলক চোখে লিওনার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে কার্পেন্টার শুধু বললে–যাচ্ছেন যান, কিন্তু মনে রাখবেন বাড়িতে রইল আপনার স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে। আমি যদি আপনি হতাম, তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে আহাম্মকের মতো কিছুই করতাম না। বুঝেছেন?

লিওনার্ড বুঝেছিল। সাড়ে ছটার সময়ে বেরিয়ে গেল সে। রাত্রেই তো আপদ বিদেয় বাড়ি থেকে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে ফোন করলেই চলবে খন। ওইটুকু সময়ের মধ্যে বেশি পথ আর যেতে হচ্ছে না বাছাধনকে। লাঞ্চ খাওয়ার অবসরে স্ত্রীকে ফোন করল লিওনার্ড সব শান্ত। কোনও হাঙ্গামা নেই।

দিনের বেলা কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিল কার্পেন্টার। ঘুম থেকে উঠে এক পেট খেয়েও নিল। তারপর গোঁফটা কামিয়ে ফেলে মুখ পরিষ্কার করে ফেলল। মিসেস পাওয়েলের ভয়ার্ত মুখচ্ছবি দেখে নিশ্চিন্ত ছিল কার্পেন্টার। নিদারুণ আতঙ্কে এমনই অন্তর-কঁপুনি শুরু হয়েছিল তার যে কোনওরকম বিপদের সম্ভাবনাই ছিল না ওদিক থেকে। সেইদিনই বিকেলে মিসেস পাওয়েলের মা এল মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই সময়টা ছেলেমেয়েদের শোবার ঘরে ঘাপটি মেরে রইল কার্পেন্টার।

দারুণ উদ্বিগ্ন মন নিয়ে কাজ থেকে ফিরে এল লিওনার্ড। সঙ্গে এনেছিল সেইদিনকার দৈনিকের সর্বশেষ সংস্করণ! কাগজটা ছিনিয়ে নিল কার্পেন্টার। তারপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল নিজের সম্বন্ধে টাটকা সংবাদ জানার আগ্রহে। আর তখনই অবস্থায় গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলে উঠল ও–অন্ততপক্ষে আরও দুদিন এ জায়গা ছেড়ে বেরোনো চলবে না। এখানে থাকার জন্যে আপনাদের খরচপত্রও আমি পরে পুষিয়ে দেব কিছু টাকা পাঠিয়ে।

ডিনার তৈরি করে ডাক দিল মিসেস পাওয়েল। কিন্তু অচেনা লোকের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খেতে ছেলেমেয়েরা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করায় কালো আঙুর আর শাকসজীভরা প্লেটটা নিয়ে সামনের ঘরে উঠে এল কার্পেন্টার। ইতিমধ্যে খেতে খেতে ফিসফাস করে কি শলাপরামর্শ করে নিল পাওয়েল দম্পতি। তার পরেই লিওনার্ড উঠে গেল অন্য ঘরে কার্পেন্টারের কাছে। গিয়ে বললে যে তার ছেলেমেয়েদের একটা নিয়মিত অভ্যাস আছে। প্রতিদিন রাত্রে বাড়ির সামনে গিয়ে ওরা মা আর দাদু-দিদিমার সঙ্গে কিছুক্ষণ বসে থাকে। সে রাতেও ওদের যাওয়া দরকার। দুই কঁধ ঝাঁকিয়ে অনুমতি দিল কার্পেন্টার।

কিছুক্ষণ পরে লিওনার্ড বলে উঠল–এই যাঃ, ভুলেই গিয়েছিলাম। শ্বশুরের সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত কিছু কথা কইবো বলেছিলাম। আমারই যাওয়া দরকার নীচে। তা না হলে উনি নিজেই উঠে আসবেন।

কার্পেন্টার বললেন,–অত কথায় কাজ কি। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে আপনার ফিরে আসা চাই। ভুলে যাবেন না আপনার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা আমার রিভলভারের পাল্লার মধ্যেই রয়েছে।

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এল লিওনার্ড। পরক্ষণে গোটা কয়েক লম্বা লাফে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির পেছনে এসে ইঙ্গিতে স্ত্রীকে ডেকে বলে দিল ছেলেমেয়ে আর তার বাবা-মাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে। ঠিক এইরকমটিই আশা করছিল মিসেস পাওয়েল। তারপর কী করা উচিত তা তাকে না বললেও চলত। রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল লিওনার্ড। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে খেলায় মগ্ন ছেলেমেয়েদের চিৎকার করে সাবধান করে দিলে–পালাও এক্ষুণি–বন্দুক নিয়ে আসছে একটা খুনে গুন্ডা।

ঠিক নটা বেজে এক মিনিটের সময়ে টেলিফোন পেলাম লিওনার্ড পাওয়েলের। ডিটেকটিভদের চিফ ফ্রাঙ্ক ও সুলিভ্যান টেলিফোন পেয়ে ছোট্ট করে বললেন লিওনার্ডকে–গ্যাট হয়ে বসে থাকুন। আমরা আসছি। তৎক্ষণাৎ বেতার বার্তা চলে গেল তিরিশটা পুলিশের গাড়িতে। প্রত্যেকেই চতুর্দিক থেকে এগিয়ে আসতে লাগল পাওয়ালের ফ্ল্যাটের দিকে। কয়েক মিনিট পরেই সার্জেন্ট মিকলাজ-এর গলা শুনলাম :

কার্পেন্টার…কার্পেন্টার…ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে এসো। বাড়ি ঘেরাও করে ফেলেছি আমরা। সরে পড়ার কোনও সুযোগই নেই।

জানলার সামনে আবির্ভূত হল কার্পেন্টার। দড়াম করে সার্জেন্টের দিকে গুলিবর্ষণ করেই সাঁৎ করে সরে গেল আড়ালে।

মিকলাজ এবার চিৎকার করে হুশিয়ার করে দিলে বাড়ির অন্যান্য বাসিন্দাদের। সবাই যেন মেঝের ওপর শুয়ে পড়েন–পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করবে কার্পেন্টারের ওপর। ইতিমধ্যে প্রায় হাজার দুয়েক উৎসুক লোক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল রাস্তার ওপর। সবার সামনেই আবার কার্পেন্টার দেখিয়ে দিয়ে গেল তার অসমসাহসিকতা আর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা। পাওয়েলদের জানলা থেকে আচম্বিতে সে লাফিয়ে উঠল শূন্যপথে–চার ফুট দূরেই ছিল পাশের বাড়ির জানলাটা। জনতা এবং পুলিশ কিছু বোঝবার আগেই দারুণ শব্দে খোলা জানলাটার ওপর আছড়ে পড়ল সে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল সার্সির কাঁচ, অক্ষত রইল না তার মুখ আর হাত। চক্ষের নিমেষে ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল কার্পেন্টার। ঘরের মধ্যে যে কজন ছিল, তারা তো ভয়ে কাঠ হয়ে প্রায় মিশে গেল দেওয়ালের সঙ্গে। কোনও দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ও। সেখান থেকে সিঁড়ি টপকে পৌঁছোল আর এক ফ্ল্যাটে। মূর্তিমান বিভীষিকার মতো রিচার্ড কার্পেন্টারকে ধেয়ে আসতে দেখে সে ঘরের বাসিন্দারা আগেই উধাও হয়েছিল।

বাইরের বিস্ময়বিহ্বল দৃশ্য দেখার লোভ সম্বরণ করতে পারল না কার্পেন্টার। তাই জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই কালি পটকার স্তূপে আগুন লাগার মতো প্রচণ্ড শব্দে এক ঝাঁক পুলিশের গুলি ছুটে এল তাকে লক্ষ্য করে। সাঁৎ করে কার্পেন্টার আড়ালে সরে এল বটে, কিন্তু টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সার্সির কাঁচ আর ঝাঁঝরা হয়ে গেল কাঠের ফ্রেম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্কোয়াড অফিসাররা ঢুকে পড়ল বাড়ির মধ্যে।

মেঝের ওপর বসেছিল কার্পেন্টার। পুলিশ অফিসারদের রণমূর্তি দেখেই নিরীহ নাগরিকদের মতোই বলে উঠল–আমি না, আমি না, আমাকে আপনাদের দরকার নেই। আমি তো এইখানেই থাকি।

কিন্তু এ ধোঁকাবাজিতে ভোলবার পাত্র নয় অফিসার। হিড়িহিড় করে সিঁড়ির ওপর দিয়ে ওকে টেনে নামিয়ে আনা হলে নীচে। একবার তো ফস্ করে রিভলভারটা বার করে ফেলেছিল আর কি! তবে তাতে সুবিধা করা গেল না। রাস্তায় টেনে নামানোর পরও মানুষ-নেকড়ের মতোই ও প্রাণপণে ধস্তাধস্তি করতে থাকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। হইহই করে এগিয়ে এল মারমুখো জনতা। আর সে কি চিৎকার–মারুন, মারুন, খুন করে ফেলুন খুনে ছুঁচোটাকে!

ঠেলেঠুলে পুলিশের গাড়িতে তুলে দিলাম ওকে, মিনিট কয়েক পরেই চার্জরুমে দেহতল্লাস করা হল ওর। পাওয়া গেল এই কটা জিনিস : দুটো রিভলভার, ছটা ৩৮ কার্তুজ, এক প্যাকেট অ্যাসপিরিন, হাতঘড়ি, পাঁচটা চাবি, দুটো পাঁচ ডলারের নোট আর খুচরো আটটা সেন্ট।

বিচার শুরু হলে কার্পেন্টারের হাত-পা বেঁধে এবং কোমরবন্ধনীর সঙ্গে পুরু চামড়ার ফিতে লাগিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল তাকে। বড় বিশ্রী দেখাচ্ছিল ওকে দাড়ি না কামানোর জন্যে আর চুল না আঁচড়ানোর জন্যে। শুনানির সময়ে আগাগোড়া একজন আত্মীয়ার সঙ্গে কথা কইল কার্পেন্টার। স্টেট প্রসিকিউটর জোর গলায় বললেন, রিচার্ড কার্পেন্টার আইনত সুস্থ মস্তিষ্ক। বেশ কয়েকজন মনোসমীক্ষককে ডেকে তিনি প্রমাণ করে দিলেন কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, তা বোঝার টনটনে জ্ঞান আছে তার। কৌসিলীর সঙ্গে সহযোগিতা করার মতো বুদ্ধিবিবেচনারও অভাব নেই।

আর তাই, ডিটেকটিভ উইলিয়াম মর্ফিকে হত্যার অপরাধে ১৯৫৬ সালের ১৬ মার্চ আদুরে খোক পুলিশ-হন্তা রিচার্ড ডি কার্পেন্টারকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হল শুনে কেউই অবাক হননি।

* জন ফ্লানেগান (শিকাগো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) রচিত কাহিনি অবলম্বনেও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *