পায়রাকুঠীর রহস্য

পায়রাকুঠীর রহস্য

আসলে বাড়িটা সাহেব বাড়ি। অনেককাল আগে যখন সাহেবরা রাজত্ব করত এদেশে, এবাড়ি তখনকার তৈরি। মোটা মোটা থাম। এত মোটা যে দু-হাতেও আঁকড়ে ধরা যায় না। চুনবালির তৈরি হলেও দারুণ মজবুত, কামান দাগলেও ভাঙতে সময় লাগবে।

দুশো বছরের পুরোনো বাড়ি। কিন্তু আজও যেন নতুন। সামনে পেছনে ডাইনে বাঁয়ে প্রকাণ্ড বাগান। জনসন সাহেব যদ্দিন ছিলেন, সেখানে ফুলের বাহার দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন শুধু জঙ্গল।

জনসন সাহেবের বউ মারা যেতেই মনের দুঃখে তিনি বিলেতে চলে যান। বাড়িটা জলের দরে কিনে নেয় নীলমাধব সিংহ। ভদ্রলোক পকেটে তামার পয়সা নিয়ে এসেছিল ব্যবসা করতে। কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ের গায়ে তখন মিলিটারি ব্যারাক বসেছে। হরদম গাড়ি যাতায়াত করছে। রাস্তার ঠিক ধারে একটা পেট্রল পাম্প খুলে বসতেই দুদিনেই ফুলে লাল হয়ে গিয়েছিল সিংহমশায়।

সে আজ অনেকদিনের কথা। সিংহমশায় এখন মরে হেজে স্বর্গে। এত বড় বাড়িটা দিয়ে গিয়েছিল দুই ছেলেকে। বেণীমাধব আর ননীমাধবকে। দুজনেই দুধরনের মানুষ। বেণীমাধব শুধু পায়রা ওড়ায়। পায়রাকে এমন শিক্ষা দেয় যে অনেক মাইল দূর থেকে ছেড়ে দিলেও ঠিক উড়ে আসে কবুতর খোপে। বাড়ির মধ্যে ঘরে ঘরে নাকি শুধু পায়রার খোপ বানিয়েছে সে। দামি দামি পায়রা কিনে নিয়ে যাচ্ছে দেশ-বিদেশের লোকরা গোপনে খবর পাঠানোর জন্যে। পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে ছেড়ে দিলেই হল–ঠিক উড়ে ফিরে যাবে নিজের জায়গায়। পায়রা রেস জেতবার জন্যেও খদ্দের আসছে দামি দামি গাড়ি চেপে। আর আসছে নানারকমের লরি আর ভ্যান–পায়রাদের খাবার নিয়ে।

পাহাড়ি মানুষরা তাই সাহেব বাড়ির নাম দিয়েছিল–পায়রাকুঠী। দিনরাত পায়রা উড়ছে, নামছে বকবকম করছে সেখানে। এ নাম সে বাড়িকেই মানায়। মাঝে মাঝে পেল্লায় মোটর হাঁকিয়ে পায়রাদের নিয়ে অনেক দূরে চলে যেত বেণীমাধব। পাহাড়ের ওদিকে গিয়ে পায়রাগুলোকে ছেড়ে দিয়েই জোরে মোটর হাঁকিয়ে ফিরে আসত পায়রাকুঠীতে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যেত নীল আকাশ থেকে দল বেঁধে পতপত করে নেমে আসছে ফেলে আসা পায়রার দল।

পায়রার মাস্টার বেণীমাধব বিয়ে-থা করেনি। বেণীমাধবের ভাই ননীমাধবও করেনি। বেণীমাধব পায়রা নিয়ে মশগুল। ননীমাধব মঠ-মন্দির নিয়ে উদাসীন। একমুখ দাড়ি, গেরুয়া বসন, রুদ্রাক্ষের মালা–এই ছিল ননীমাধবের সম্বল। মাঝে মাঝে আসত দাদার কাছে। স্টেশন থেকেই শোনা যেত তার হর-হর-ব্যোম-ব্যোম ডাক। হেঁটেই আসত। দুপাশের লোক সরে যেত তাকে দেখে। কেউ কেউ পেন্নাম ঠুকত ভক্তিভরে। মৃদু হেসে সবাইকেই নমস্কার করত ননীমাধব।

পায়রাকুঠীতে তাই কোনও রহস্য ছিল না। কিন্তু সংসারে কিছু রহস্যসন্ধানী আছেন মামুলী বস্তুর মধ্যে থেকেও যাঁরা চমকপ্রদ চক্রান্তকে উদ্ধার করতে পারেন। যেমন আমাদের ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। চেহারাটা কবি কবি হলেও স্বভাবটা ঈগলপাখির মতো। শিকারকে ফসকাতে দেয় না।

এ কাহিনি সেই ইন্দ্রনাথ রুদ্রেরই।

.

পায়রাকুঠীর সিকি মাইল পূবদিকে থাকেন মিসেস শিকদার। বিধবা। ভীষণ মোটা। কিন্তু অনেক টাকার মালিক। জমিজমা বিস্তর। দেখাশুনার জন্যে এমন একজনকে রেখেছিলেন যিনি সারাজীবন আরবের মরুভূমিতে কাটিয়েছেন ভারত সরকারের চাকরি নিয়ে। তারপর রিটায়ার করে ফিরে এসেছেন দেশে দুই ছেলেকে মানুষ করার জন্যে।

শোভনলাল তার নাম। মেজর শোভনলাল। আকারে বেঁটেখাটো। ল্যাটা, কিন্তু রীতিমতো কর্মঠ। কম কথা বলেন। কেননা তার মনে অনেক দুঃখ। অল্প বয়েসেই বউ মারা যান দুই ছেলেকে রেখে। ছেলেদের মুখ চেয়েই আর বিয়ে করেননি শোভনলাল। কিন্তু ছেলেদের শ্রদ্ধা ভালোবাসাও পাননি।

মদন আর বিজন ছেলেদুটি হয়েছে বিশ্ববকাটে। মা না থাকলে যা হয় আর কি। বাপ চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, ছেলেরা ছিল বোর্ডিং হাউসে। কিন্তু সেখানে সুশিক্ষার বদলে কুশিক্ষাই শিখছে শুনে শোভনলাল ছেলেদের এনে রাখলেন নিজের কাছে কিন্তু ছেলেদের দু-চোখের বালি হয়ে রইলেন।

অথচ ছেলেদের ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি শোভনলাল। মা-মরা ছেলেদের মায়ের মতোই স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করার জন্যে আরবদেশের এক শেখ সাহেবের মোটা মাইনের চাকরির প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করলেন। মিসেস শিকদারের ফল আর ফুলের বাগান দেখাশুনোর চাকরি নিলেন নামমাত্র মাইনেতে। সারা জীবন মরুভূমিতে কাটানোর জন্যে বাগান তৈরির দিকে ঝোঁক ছিল অনেকদিন থেকেই। শেষ জীবনের শান্তির আশায় তাই নিজেই ফল ফুলের চারা লাগাতেন, জল দিতেন, ফুল তুলতেন। এত কষ্ট করতেন শুধু দুই ছেলের মুখে চাঁদের হাসি ফোঁটানোর জন্যে।

ছেলেরা কিন্তু তাকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে যেত। এতদিন শাসন না পেয়ে যারা বজ্জাতের বাড়ি হয়েছে, হঠাৎ শাসন তাদের সইবে কেন? তাই বেশিরভাগ সময় কাটাত বাইরে–পায়রাকুঠীতে–

নিঃসন্তান বেণীমাধব মদন আর বিজনকে খুব ভালোবাসত। পায়রাকে কীভাবে শিখিয়ে পড়িয়ে চিঠি বওয়াতে হয়, তা হাতেনাতে দেখিয়ে দিত। মদন আর বিজনও তো তাই চায়। লেখাপড়া ডকে উঠল। দিনরাত পায়রাকুঠীর পায়রা নিয়ে ব্যস্ত রইল মাঠে ঘাটে।

তিতিবিরক্ত হয়ে গেলেন শোভনলাল। বেশ বুঝলেন ছেলেরা শাসনের বাইরে চলে গেছে। সারা জীবন তিনি বাবার কর্তব্য করেননি–এখন কি পারবেন? মনে মনে নিজেকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন ছেলেদের এই অধঃপতনের জন্যে। ভাবতে লাগলেন সত্যি সত্যিই শেখ সাহেবের চাকরিটা নিয়ে ফের আরবের মরুভূমিতে ফিরে যাবেন কিনা।

এই সময় একদিন সন্ধে নাগাদ শহর থেকে ফিরে স্টেশনে নামলেন শোভনলাল। কাঁধে ঝোলা নিয়ে রাস্তায় পা দিয়েছেন, এমন সময়ে দেখলেন মিসেস শিকদার তার ফিয়াট গাড়িটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গেটের কাছে।

শোভনলালকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন–আমার সঙ্গে আসুন, কথা আছে।

ফিয়াট এসে থামল মিসেস শিকদারের বাড়িতে। গাড়ির মধ্যে একটা কথাও বলেননি ভদ্রমহিলা। শোভনলাল নিজেও কম কথার মানুষ। তাই চুপচাপ চেয়েছিলেন জানলা দিয়ে বাইরে।

গাড়ি থেকে নামবার পর মিসেস শিকদার ভেতরে গিয়ে বললেন,–আপনি আজ এখানেই খেয়ে যান।

কিন্তু–মৃদু আপত্তি জানালেন শোভনলাল।

কোনও কিন্তু নয়। খেতে খেতে কথা বলব। বলে মিসেস শিকদার রান্নাঘরে চলে গেলেন। বসবার ঘরে একা বসে রইলেন শোভনলার। হাতের ব্যাগটা পাশের সোফায় রেখে ভাবতে লাগলেন, কী এমন দরকার পড়ল মিসেস শিকদারের যে স্টেশন থেকে তুলে আনলেন গাড়িতে? ভদ্রমহিলা একা থাকেন। বিধবা তো, ভীষণ পিটপিটে। ঝি-রাঁধুনি একদম বরদাস্ত করতে পারেন না।

ভাবতে ভাবতে আনমনা ভাবে বাঁ-হাতে চারমিনার সিগারেটের নতুন প্যাকেট বের করে কাগজটা ছিঁড়ে মেঝেতে ফেললেন এবং একটা সিগারেট ঠোঁটের ডগায় ঝুলিয়ে নিলেন।

ছেঁড়া কাগজটা কিন্তু মেঝেতেই পড়ে রইল এবং সেইটাই হল তার মৃত্যুবাণ।

.

যা বলতে চেয়েছিলেন মিসেস শিকদার, তা খানিকটা আঁচ করতে পেরেই অত আড়ষ্ট হয়েছিলেন শোভনলাল। কথাটা অনেকদিন ধরেই বলি বলি করেও বলতে পারছেন না। কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে শোভনলাল জেনে ফেলেছেন মিসেস শিকদারের মূল অভিপ্রায় কী।

খারাপ কিছু নয়। কিন্তু এই বয়েসে নিতান্তই অশোভন। বিশেষ করে ছেলেরা আর কচিখোকা নেই। শৈশবে যারা মা হারিয়েছে, অন্য মায়ের হাতে তাদের তুলে দেওয়া যায় কী?

হ্যাঁ, মিসেস শিকদারের এই হল মনোগত অভিপ্রায়। তার বিরাট সম্পত্তি তিনি মদন আর বিজনকে দিয়ে দিতে চান–কিন্তু মা হিসেবে। ওদের ভালো বোর্ডিংস্কুলে রেখে লেখাপড়াও শেখাতে চান, কিন্তু শর্ত ওই একটাই। শোভনলালের মন সায় দেয়নি মিসেস শিকদারের এ-হেন উদারতায়। গর্ভধারিণী মায়ের স্থান কি অন্য মা এসে পূরণ করতে পারে?

রান্নাঘর থেকে ফিরে এলেন মিসেস শিকদার। ভীষণ মোটা হলেও ভদ্রমহিলা হাঁটাচলা করেন লঘুচরণে–দেহের ওজন নিয়ে কাতর নন মোটেই। শাড়ির খুঁট দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে হাসিমুখে বললেন–আপনি কঁচা লঙ্কার ঝাল খান তো?

খাই, চারমিনার নামিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন শোভনলাল–তার আগে একটা জবাব চাই।

বলুন, হাত মুছতে মুছতে বললেন মিসেস শিকদার।

আমাকে কি বলতে চান?

সটান প্রশ্ন শুনে সটান চেয়ে মুচকি হাসলেন মিসেস শিকদার–ধরুন মদন আর বিজনের ভার নেওয়ার প্রস্তাব।

সেটা সম্ভব নয়, রুক্ষকণ্ঠে কথাটা বলতে চাননি শোভনলাল। তবুও গলাটা বড় কর্কশ শোনাল। তাই পরক্ষণেই মোলায়েম হবার চেষ্টায় হেসে বললেন–ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাকে ভাবতে দিন।

গম্ভীর হয়ে গেলেন মিসেস শিকদার-মদন আর বিজনের মুখ চেয়েই কি বলছেন? চোখের সামনে ছেলেদুটো বয়ে যাচ্ছে দেখেও চুপ থাকতে পারছেন? তাছাড়া আপনাকেও দেখাশুনা করবার জন্যে…

ধাঁ করে রক্ত গরম হয়ে গেল শোভনলালের। মিলিটারি মেজাজ তো। রাগলে আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। উঠে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে শুধু বললেন–আপনি নির্লজ্জ বেহায়া হতে পারেন, আমি নই। সবচাইতে বড় কথা, মদন আর বিজন আমার ছেলে–আপনার নয়। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ নাই-বা দেখালেন।

বলেই আর দাঁড়ালেন না শোভনলাল। ছিটকে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। হন হন করে সটান ফিরে এলেন নিজের বাড়ি।

সে-রাতে আর ঘুমোতে পারলেন না শোভনলাল। বুঝলেন, মিসেস শিকদারের চাকরি খতম হয়ে গেল এইখানেই। কাল থেকে অন্য কাজের ধান্দায় বেরুতে হবে।

তার চাইতে বরং আরব দেশেই ফিরে যাওয়া যাক। আরব ভাষাটা তার চোস্ত ভাবে জানা আছে বলেই ওদেশে চাকরির বাজারে তার এত চাহিদা। শেখ সাহেবের মিলিটারি উপদেষ্টা হিসেবেই বাকি জীবনটা মরুভূমিতেই কাটানো যাক। ছেলেরা থাকুক বোর্ডিং হাউসে। এর বেশি আর কি বা করবেন শোভনলাল? তাঁর সব চেষ্টাই তো ব্যর্থ হল।

রাত তখন দুটো। বালিশে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন মেজর শোভনলাল।

.

পরের দিন সকালে পুলিশ তলব করল মেজরকে।

পুলিশ? অবাক হলেন শোভনলার। ভারত সরকারের আস্থাভাজন অফিসার ছিলেন এককালে। পুলিশ তাকে সমীহ করে সেই কারণেই। সাতসকালে কেন তবে তলব পড়ল?

কারণটা জানা গেল পুলিশ জিপ থেকে নামবার পর। জিপ গিয়ে দাঁড়াল মিসেস শিকদারের বাড়ির উঠোনে। সেপাইসান্ত্রী গিজগিজ করছে বাগানে। উৎসুক জনতা উঁকিঝুঁকি মারছে ভেতরে। বসবার ঘরে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন শোভনলাল।

পিঠ উঁচু সেকেলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন স্থূলকায়া মিসেস শিকদার। চোখদুটো খোলা–পাতা নড়ছে না–চোখের মণি স্থির প্রাণের চিহ্ন নেই।

বাঁদিকের রগে দুটো পাশাপাশি ফুটো। রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে ক্ষতমুখে এবং গালের ওপর।

দারোগা বিষেণচাঁদ স্থির চোখে চেয়েছিলেন শোভনলালের মুখের দিকে–মুখের ভাবান্তর লক্ষ্য করছিলেন।

এখন আঙুল তুলে দেখালেন মিসেস শিকদারের ডান দিকে। শোভনলালের চামড়ার ব্যাগটা রয়েছে সেখানে। কালকে ফেলে গেছিলেন–হঠাৎ মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় নিয়ে যেতে ভুলে গেছিলেন।

চিনতে পেরেছেন? কাঠখোট্টা গলা বিষেণাদের।

হ্যাঁ, আমার ব্যাগ, যন্ত্রচালিতের মতো বললেন শোভনলাল।

আপনি কাল এখানেই ছিলেন?

হ্যাঁ।

চারমিনার সিগারেট কি আপনিই খান?

হ্যাঁ।

কাল নতুন প্যাকেট কিনেছিলেন?

হ্যাঁ। কী করে জানলেন?

মেঝে থেকে দুটো প্যাকেট ছেঁড়া কাগজ তুলে দেখালেন বিষেণচাঁদ।

আপনার সিগারেটের প্যাকেট থেকে ছেঁড়া। কিন্তু মেজর, বিধবাকে গুলি করতে গেলেন

কেন?

ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে রইলেন শোভনলাল।

একটা কথাও বলতে পারলেন না।

.

শোভনলালের ভাগ্যক্রমে ইন্দ্রনাথ রুদ্র সেই সময়ে ও-অঞ্চলে গিয়েছিল একটা চোরাই নটরাজ মূর্তির সন্ধানে। মূর্তি উদ্ধার করার পর দারোগা বিষেণাদের ফাঁড়িতে গিয়েছিল বিদায় নিতে, এমন সময় শুনল একটা যাচ্ছেতাই রকমের খুন হয়েছে গতকাল।

বিধবা খুন। কিন্তু টাকাকড়ি গয়নাগাটির জন্য নয়। মিসেস শিকদারের হাতের হিরের আংটি, গলার সোনার হার, এবং কোমরের চাবি স্পর্শ করা হয়নি। লোহার সিন্দুকের লাখখানেক টাকা আর জড়োয়ার গয়নাও কেউ লোপাট করেনি। নিয়ে গেছে শুধু বিধবার প্রাণটা।

।কেন? বিষেণচাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সরেজমিন তদন্তে নিজেই এসেছিলেন ইন্দ্রনাথ। স্রেফ কৌতূহল মেটানোর জন্যে। চৈত্র সংক্রান্তির ঢাক বাজলেই যেমন গাজনের সন্ন্যাসীর পিঠ চড়চড় করে, কোথাও কোনও খুন-জখম-চুরি-রাহাজানির খবর শুনলেই ইন্দ্রনাথের পা দুটোও সুড়সুড় করে ওঠে।

বিধবা হত্যাকাণ্ড রীতিমতো রহস্যজনক। শোভনলালের ব্যাগ পাওয়া গেছে অকুস্থলে–নিষ্প্রাণ বিধবার দেহের ঠিক পাশেই। সোফার হাতলে, দরজার গায়ে আঙুলের ছাপের ছবি তুলে দেখা যাচ্ছে। হুবহু মিলে যাচ্ছে–শোভনলালের আঙুলের ছাপের সঙ্গে। শুধু একটা জিনিস এখনো মিলিয়ে দেখা যায়নি–মৃতদেহ নিয়ে কাটা ছেঁড়া করে ময়না তদন্ত করলে সে রিপোর্টও পাওয়া যাবে। গুলি দুটো রগ ফুড়ে মাথার মধ্যে রয়ে গেছে। সেই গুলি শোভনলালের রিভলভারের গুলির সঙ্গে মেলে কিনা দেখতে হবে। কিন্তু বিধবাকে মেরে শোভনলালের লাভ কী? চাকরিটা তো গেল। টাকা-পয়সাও লুঠ করা হয়নি। তবে?

শোভনলাল আর মদন-বিজনের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলার পর ফাঁড়িতে ফিরে এল ইন্দ্রনাথ। বিষেণচাঁদ বললেন–কী হে টিকটিকি, কিছু পেলে?

বিষেণচাঁদ এককালে ইন্দ্রনাথের সঙ্গে স্কটিশচার্চ কলেজে একই ক্লাসে বি-এসসি পড়েছিলেন, সেইসূত্রেই তুমি বলেই সম্ভাষণ করেন ইন্দ্রনাথকে।

ইন্দ্রনাথ বললে–শোভনলাল নির্দোষ।

চোখ নাচিয়ে বললেন বিষেণচাঁদ–কী করে বুঝলে হে গণৎকার?

রগের বাঁ-পাশে ফুটো দেখে।

হেঁয়ালির মানে বুঝেই হেসে বিষেণাদ বললেন–সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি।

শুধু একটা প্রমাণ লক্ষ্য করোনি।

কোনটা বৎস?

চারমিনারের এই ছেঁড়া কাগজদুটো।

বলো কি হে? আমিই তো দিলাম তোমাকে।

শোভনলাল একটা প্যাকেটের কাগজ ছিঁড়েছিলেন। আর একটা প্যাকেটের কাগজ কে ছিঁড়ল?

নিশ্চয় শোভনলাল।

মোটেই না।

কী করে বুঝলে?

সেটাই তো আমার মন্ত্রগুপ্তি, রহস্যগম্ভীর হেসে বলল ইন্দ্রনাথ। ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলে না পড়েও যে ডিটেকটিভ হওয়া যায়, সে প্রমাণ এইবার তোমায় হাতেনাতে দেব।

.

নিশুতি রাত।

পায়রাকুঠীর বিশাল বাগানের অযত্নবর্ধিত ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে এগুচ্ছে একটি কৃষ্ণকালো কৃশ মূর্তি। মার্জারের মতো লঘুচরণ তার। এক হাতে পেনসিলটর্চ। আরেক হাতে মিশমিশে রিভলভার।

এখন আর তার পরনে মুগার পাঞ্জাবি নেই। কবি-কবি দেহ আবৃত কালো ট্রাউজার্স আর নাইলন পুলওভারে ইন্দ্রনাথ রুদ্র নিশীথ অভিযানে বেরিয়েছে।

কৃশ কিন্তু ব্যায়ামপটু ইন্দ্রনাথ পিচ্ছিল গতিতে এসে দাঁড়াল জলের পাইপের তলায়। বেল্টের আংটায় টর্চ ঝুলিয়ে রিভলভার রাখল চামড়ার খাপে। তারপর গিরগিটির মতো সরসর করে উঠে গেল ছাদে।

একঘণ্টা পরে ফের পাইপ বেয়ে নেমে এল ইন্দ্রনাথ। নিঃশব্দ চরণে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকারে।

অন্ধকারে ইনফ্রারেড ফোটোগ্রাফ তুললে ইন্দ্রনাথের মুখে তখন দেখা যেত আশ্চর্য হাসি। যুদ্ধ জয়ের শব্দহীন অট্টহাসি।

.

সকালে বিষেণাদকে ঘুম থেকে টেনে তুলল ইন্দ্রনাথ।

বলল–তোমার হাতে সেপাই কজন আছে?

হকচকিয়ে গিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বললেন বিষেণচাঁদ-ইয়ার্কি মারছ নাকি?

আমার হাতে আর সময় নেই। নটার ট্রেনেই কলকাতা ফিরব। তাই যা বলবার তোমাকে বলে যাচ্ছি।

এবার ঘুম ছুটে গেল বিষেণাদের চোখ থেকে। বললেন–কি বলবে?

বলব যে তোমার চাকরি যাওয়া উচিত। তোমার মতো একটা গর্দভ পাঁঠা উজবুককে দারোগা বানিয়ে আমাদের সর্বনাশ হচ্ছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! তোমার নাকের ডগা দিয়ে এতবড় কাণ্ডটা হচ্ছে, কোনও খবরই রাখো না?

ভীষণ ভড়কে গিয়ে এবং দারুণ রেগে গিয়ে বিষেণচাঁদ তেড়ে উঠলেন–খবরদার ইন্দ্রনাথ, মুখ সামলে কথা বলবে।

তুমি মুখ সামলে কথা বলবে। নাদাপেটা হাঁদারাম কোথাকার! পায়রাকুঠীর রহস্য অ্যাদ্দিনেও মাথায় আসেনি কেন?

পায়রাকুঠীর রহস্য!

আজ্ঞে হ্যাঁ, পায়রাকুঠীর রহস্য! শুনেছ কোনওদিন এই আক্রাগন্ডার বাজারে শুধু পায়রাদের খাওয়ানোর জন্যে লরি-লরি খাবার আসে তেরপল চাপা দিয়ে? হেঁড়েমাথায় এতদিন কেন খেয়াল হয়নি যে পৃথিবীর সব গুপ্তচর আর বিপ্লবীরা একটা-না-একটা উদ্ভট রকমের পেশা নিয়ে লোকের চোখে সাধু সেজে থাকে? স্পাইরা সাজে আর্টিস্ট, বিপ্লবীরা কয়লাওলা, কেউ খোলে পোলট্রি, কেউ করে মাছের ব্যবসা। পায়রা ট্রেনিং সেন্টারের আড়ালেও যে এরকম একটা ব্যাপার চলছে না, এটা মাথায় আসেনি কেন মেড়াকান্ত হাঁদারাম?

ইন্দ্রনাথ! ইন্দ্রনাথ! কী বলতে চাইছ তুমি?

নিজে গিয়ে দেখগে যাও। পায়রাকুঠী ঘেরাও করো আর্মড পুলিশ দিয়ে। সাংঘাতিক গুলিগোলা চলতে পারে। মিসেস শিকদারের হত্যাকারীকেও সেখানে পাবে।

কে? কার কথা বলছ?

বেণীমাধব।

প্রমাণ?

সিগারেটের প্যাকেট ছোঁড়া এই কাগজ দুটো।

ব্রাদার, আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে।

মাথায় গোবর থাকলে ওই রকমই হয়। আগেই তোমাকে বলেছিলাম, দুটো প্যাকেট ছেঁড়া হয়েছিল ওখানে। একটা শোভনলাল ছিঁড়েছেন–আর একটা অন্য কেউ।

কি করে বুঝলে অন্য কেউ?

আচ্ছা ইডিয়ট তে। প্রত্যেকেই সিগারেটের প্যাকেট ছেড়ে বিশেষ এক কায়দায়। পাশাপাশি দুটো ছেঁড়া কাগজ রেখে মুখে মুখে মেলালেই মাইক্রোসকোপের তলায় তফাতটা ধরা পড়ে। তুমি আমায় দুটো কাগজ দিয়েছিলে। একটা হুবহু মিলে গেল শোভনলালের প্যাকেটের কাগজের সঙ্গে। আর একটা মিলল বেণীমাধবের চারমিনার প্যাকেটের কাগজের সঙ্গে।

তুমি–

আমি পায়রাকুঠী থেকেই আসছি। শোভনলাল যে খুনি নন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ কিন্তু রগের বাঁদিকের গুলির চিহ্ন। কেন জানো তো?

এতক্ষণে হাসি ফুটল বিষেণাদের মুখে। বললেন–শোভনলালের ল্যাটা বলে। ল্যাটা হাতের গুলি রগের ডানদিক দিয়ে মাথায় ঢুকত।

যাক খানিকটা বুদ্ধি আছে তাহলে। আর হ্যাঁ ভালো কথা। ননীমাধবকেও গ্রেপ্তার করতে ভুলো না।

সন্ন্যাসী ননীমাধবকে? কেন বন্ধু, কেন?

কেননা বেণীমাধব শুধু অস্ত্রাগারের মালিক। লরি আর ভ্যান বোঝাই পায়রার খাবার আসত হে, আসত শুধু রিভলভার, বোমা, নাইট্রোগ্লিসারিন আর বন্দুক। পাঠাত এই ননীমাধব। সে-ই যে এই গুপ্ত দলের অধিনায়ক।

অ্যাঁ! বলো কী হে! কিন্তু বিধবাকে মারা হল কেন বুঝলাম না তো?

অস্ত্রাগারের সন্ধান জেনে ফেলেছিলেন বলে। শোভনলালকে ডেকে সেই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন মিসেস শিকদার। কিন্তু শোভনলাল রেগে চলে এলেন। তার পরেই বেণীমাধব এল। মিসেস শিকদারকে চেয়ারে বসা অবস্থাতেই সামনে দাঁড়িয়ে গুলি করল বাঁ-রগে। চেনাজানা ছিল বলেই ভদ্রমহিলা চুপ করে বসেছিলেন সোফায়,–ভাবতেও পারেননি বেণীমাধব এসেছে তাঁকেই নিকেশ করতে। তারপর চারমিনারের প্যাকেট ছিঁড়ে সিগারেট ধরিয়ে ফিরে গেল পায়রাকুঠীতে।

আর তুমি সেই প্যাকেট ছেঁড়া কাগজটা দেখেই বুঝলে–

যে ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুলে পড়েও তোমাদের মাথা কত মোটা হয়। বিদায় বন্ধু, ফির মিলেঙ্গে।

যথাসময়ে পায়রাকুঠীতে হানা দিল আর্মড পুলিশ। ঘরে ঘরে পায়রার খোপের বদলে পাওয়া গেল কেবল বাক্স বোঝাই আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র।

* রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয় সংখ্যা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *