মহানিষ্ক্রমণ – ৯

॥ ৯ ॥

আমরা নির্দেশমত সব কাজ করে গেলাম। আমি আর মিয়া আকবর শাহ একসঙ্গে ওয়াছেল মোল্লার দোকানে ঢুকলাম, কিন্তু উনি যখন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন, আমি পিছিয়ে পড়ে দূর থেকে নিরাসক্তভাবে দেখতে লাগলাম। উনি এক জোড়া ঢিলে পাজামা আর একটা কালো ফেজ জাতীয় টুপি কিনলেন। প্যাকেটটা গাড়ির পিছনের সীটে হেলাভরে ফেলে রাখা হল। এরপর আমরা মির্জাপুর স্ট্রীটে যে হোটেলে উনি ছিলেন সেখানে গেলাম। ওঁর মালপত্র তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে রওনা দিলাম। গিয়ে দেখলাম রাঙাকাকাবাবুর সেক্রেটারি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। উনি মিয়া-সাহেবকে নামিয়ে নিলেন। আমি ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে যেতে বললাম। আমরা স্টেশন চত্বর ছেড়ে বের হয়ে যাবার আগেই ড্রাইভারের নজরে পড়ে গেল পিছনের সীটে প্যাকেটটা। সে বলতে লাগল যে দৌড়ে গিয়ে এখনও প্লাটফর্মে প্যাকেটটা পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে। কি মুশকিল, আমি এমন ভান করলাম যেন এত ঝামেলা আমার ভাল লাগছে না। আমি বললাম, এখন বাড়ি যাওয়া যাক। যা কিছু জিনিস পড়ে আছে, পরে ডাকে ভদ্রলোককে পাঠিয়ে দিলেই হবে।

আমাকেও অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে কিছু কেনাকাটা করতে হল, রাঙাকাকাবাবুই অবশ্য এর জন্য টাকা দিলেন। হ্যারিসন রোডের একটা দোকান থেকে একটি মাঝারি সাইজের স্যুটকেস, একটা অ্যাটাচি কেস, বিছানার জন্য হোলড-অল্‌ কিনলাম। স্যুটকেস ও অ্যাটাচি কেসের উপর আমি M. Z. লিখিয়ে নিলাম। আর কিনলাম নিউ মার্কেট থেকে একজোড়া ফ্লানেলের শার্ট আর টয়লেটের জিনিসপত্র। রাঙাকাকাবাবুর নির্দেশমত আমি অবজ্ঞাভরে সব দেশী জিনিস ত্যাগ করে কেবলই ব্রিটিশ মেক-এর যাবতীয় জিনিস-পত্র কিনলাম। বালিশ, বিছানার চাদর, লেপ ইত্যাদি যোগাড় করলাম চঁদনী চক থেকে। উনি যে ধরনের সুগঠিত কাবুলী চপ্পল চাইছিলেন, তা পেতে আমার যথেষ্ট বেগ পেতে হল। শেষ পর্যন্ত নিউ মার্কেটের একটা চীনা দোকান থেকে এক জোড়া কিনে ফেললাম।

রাঙাকাকাবাবু য়ুরোপে যে গরম কাপড়জামা পরতেন তা থেকে একবার কিছু কিছু বেছে নিতে চাইলেন। সে সব জামাকাপড় থাকত উডবার্ন পার্কের বাড়িতে মা’র হেফাজতে। মা কলকাতা ছেড়ে যাবার আগে আমি আলমারীর চাবিটা কোথায় থাকে জেনে রেখেছিলাম। বলেছিলাম, রাঙাকাকাবাবু একবার সব জামাকাপড় দেখতে চেয়েছেন, অনেক দিনের মত জেলে চলে যাবেন তো, তাই। ওঁর ভৃত্য এসে কাপড়ের পুঁটুলি নিয়ে এ-বাড়ি ও-বাড়ি করতে লাগল, তার থেকে উনি কিছু গরম জামাকাপড় ও একটি গলাবন্ধ কোট নিলেন, ওই রকম একটা কাপড়ের পুঁটুলির ভিতরে করে আমি ওঁর হোলড-অল্‌টা পাঠিয়ে দিলাম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দরকার হবে মনে করে উনি ওটা কাছে রাখতে চাইছিলেন।

জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র ছাড়া, অ্যাটাচি কেসে ঢোকাবার জন্য আমার হাতে দু’কপি পবিত্র কোরান গ্রন্থ, কিছু ঔষধ—মৃতসঞ্জীবনী সুধা, মিস্টল্‌ এবং ভাজা মসলার কোটা ইত্যাদি দিয়েছিলেন।

ওঁর জন্য কিছু ভিজিটিং কার্ড ছাপাতে গিয়ে আমাকে প্রথমে স্টেজ অ্যাক্‌টিং করতে হল। কি লেখা হবে তা নিজের হাতে লিখে দিয়ে আমাকে বললেন ঐ লেখাটা কপি করে নিয়ে ওঁর হাতের লেখাটা নষ্ট করে ফেলতে। উনি আমাকে বললেন—যখন কার্ডের অর্ডার দিতে যাব তখন যেন এমন ভাব দেখাই যে নিজের জন্যই অর্ডার দিতে যাচ্ছি। অতএব একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি স্যুট পরে, মাথায় ফেল্‌ট হ্যাট দিয়ে সাহেব সেজে বাড়ি থেকে বার হলাম। সে সময়ে আমার বয়সী ছেলের পক্ষে এই ধরনের পোষাক পরা প্রচলন ছিল না। এক পাহাড়ে বা শীতের জায়গায় গেলে আলাদা কথা। বাড়ি থেকে বার হবার মুখেই এক মাসতুতো দাদার সঙ্গে দেখা।

একটা ডিনারের নেমন্তন্ন আছে বলে আমার পোষাক সম্বন্ধে তাঁর প্রশ্ন এড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। চৌরঙ্গী থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে রাধাবাজারে এক দোকানে উপস্থিত হলাম, কাউন্টারের লোকটির সঙ্গে ইংরেজীতে কথা বলে কার্ডের অর্ডার দিলাম। আবার কার্ড নেবার দিন একইভাবে সেজেগুজে ডেলিভারি নিলাম ও কার্ড মালিকের হাতে পৌঁছে দিলাম। কার্ডে লেখা ছিলঃ

MOHD. ZIAUDDIN

Travelling Inspector,
The Empire of India Life Assurance Co. Ltd.

Permanent Address:

Civil Lines

Jubbulpore.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *