॥ ১ ॥
লাহোর ফোর্ট, ১৯৪৪ সালের নভেম্বর। প্রায় দু’ মাস নিঃসঙ্গ ও বিভীষিকাময় কারাবাসের পর আমার সেলের দরজা খোলা হল। পিছমোড়া করে হাতকড়া লাগিয়ে ফোর্টের কর্তৃপক্ষ দিল্লী থেকে আগত দুই উচ্চপদস্থ ইংরাজ অফিসারের সামনে আমাকে হাজির করলেন। তাঁদের মধ্যে একজন আমাকে নানারকম রাজদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত করে শেষে প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা, তোমার কাকার দেশত্যাগের আগে তোমার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল, তাই না? প্রশ্নটির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পেরে আমি একটু ঘুরিয়ে জবাব দিলাম—যে-কোন ভারতীয় পরিবারে কাকা-ভাইপোর সম্পর্ক সাধারণত ঘনিষ্ঠই হয়ে থাকে। শুনে আমার প্রশ্নকর্তা চাপা গর্জন করে উঠেছিলেন। তার পরেই আমাকে একটি চার্জশীট দেওয়া হল।
নেতাজী যখন ১৯৪০-এর ডিসেম্বরে দেশত্যাগ করবার বিরাট সিদ্ধান্ত নিলেন, তারই পটভূমিকায় আমার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা একটু অপ্রত্যাশিতভাবে গড়ে উঠেছিল। তাঁর বেশ বিরাট ভাইপো-ভাইঝি পরিধির মধ্যে আর বিশেষ করে আমার ভাইবোনদের কাছে আমাদের রাঙাকাকাবাবুর বরাবরই একটি বিশেষ স্থান ছিল। আমার বাবা ও মা—শরৎচন্দ্র ও বিভাবতী, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে সুভাষচন্দ্রকে যে চোখে দেখতেন এবং যে-কোনও পরিস্থিতিতে যে বিশেষ স্নেহ-প্রশ্রয় দিতেন, তার ফলে আমাদের মনে তাঁর প্রতি একটা বিশেষ পক্ষপাত সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য এ ছাড়াও রাঙাকাকা-বাবুর ব্যক্তিগত চরিত্র-মাধুর্য ও তাঁর ছোট ঘোট ভাইপো-ভাইঝিদের খেলার সাথী হয়ে তাদের সব ছেলেমানুষিতে হাসিমুখে যোগ দিতে পারার আশ্চর্য ক্ষমতা এই পক্ষপাতের অন্যতম কারণ ছিল। তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, বাবা-মা’র উৎসাহ ও দৃষ্টান্ত এবং রাঙাকাকাবাবুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব সত্ত্বেও তাঁর প্রতি আমার মনের সভয় শ্রদ্ধা ও নিজের ভীরু-স্বভাবের জন্য অনেক দিন পর্যন্ত আমাদের মধ্যে একটা সাধারণ মাখামাখির ভাব কখনোই সম্ভব হয়নি। পরিবারের আর সকলে, এমনকি বাইরের লোকও খুব সহজেই যা করতে পারত, তা আমার দ্বারা সম্ভব হত না। বোধহয় নিজের অক্ষমতা ঢাকবার জন্য আমি নিজেকে এই বলে বোঝতাম যে, এরকম একজন অতি অসাধারণ ও দুর্লভ ব্যক্তির সঙ্গে কাকা-ভাইপোর সাধারণ অন্তরঙ্গতার কোন স্থান নেই।
পরিবারের পরবর্তী জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে ওঁর উৎসাহ ছিল গভীর—তা তাদের চরিত্র ও রুচি যার যেমনই হোক না কেন। বিশেষ করে আমার ভাইবোনেদের ক্ষেত্রে রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁর মতানুসারেই আমাদের বাবা-মা আমাদের শিক্ষার পদ্ধতি ঠিক করতেন—যেমন ছবি আঁকার ব্যবস্থা, সঙ্গীত-শিক্ষার ব্যবস্থা, লাঠি ও ছোরা খেলা শেখানোর জন্যে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি। আমার অন্তর্মুখিতা ভেদ করার জন্য তিনি বারবার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একেবারে শেষ সময়ের আগে সক্ষম হননি। তিনি আমাকে “দি সাইলেন্ট বয়” উপাধি দিয়েছিলেন এবং বলতেন, আমি নাকি শুধু monosyllable-এ কথা বলি আর যতই খোঁচাখুঁচি করা হোক না কেন, কেবল নিঃশব্দে মাথা নাড়ি ও হাসি। এইরকম অবস্থাই অনেক দিন ধরে চলেছিল, যদিও আমি নিজের মনে বালক-বয়স থেকেই ওঁর জীবন ও কর্মধারা অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ও ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতাম। আমার বিশ্বাস তিনি এ কথা জানতেন।
রাঙাকাকাবাবুর সম্বন্ধে আমার যে প্রথম স্মৃতি, তার সঙ্গে ১৯৪০-৪১ সালের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের ঐতিহাসিক দিনগুলির এক আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। সেটা ছিল বহু দিন আগে ১৯২৭ সালের কথা, উনি বর্মার বন্দিদশা থেকে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে ফিরে এসেছেন। আমি তখন নেহাতই বালক, তাঁর বিছানার পাশে বসে আমি অবাক বিস্ময়ে ওঁর দিকে, ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, আমার মনে হত যেন এক যোগী পুরুষ আমাদের পরিবারের মাঝে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৪০ সালে আবার ওঁর অসুস্থ শয্যাপার্শ্বে বসে রাতের পর রাত ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হত, কী যেন এক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। এ যেন জীবন্ত বিপ্লবের ছবি, আদর্শের বেদীমূলে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদনের এক অতুলনীয় মূর্তি।
যখনকার ঘটনা বলছি, ১৯২৭ সাল, তখন আমরা আমাদের বাবা-মা ও রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে বর্তমান নেতাজী ভবনের পাশেই, ৩৮/১ এলগিন রোডে ভাড়া-বাড়িতে বাস করি। ১৯২৮ সালে বাবা ১নং উডবার্ন পার্কে বাড়ি করলেন। রাঙাকাকাবাবু আমাদের সঙ্গে উডবার্ন পার্কে বাস করতে লাগলেন। ১৯৩২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হলেন এবং ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত প্রবাসে বা অন্তরীণে কাটল। বাবা-মার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগের কিন্তু কোনও অবস্থাতেই ছেদ পড়ল না। ১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পাবার পর তাঁর মা, আমাদের মা-জননী প্রভাবতীর ইচ্ছানুসারে তিনি আমাদের সাবেক বাড়ি ৩৮/২ এলগিন রোডে বাস করতে লাগলেন। দুই বাড়ির—১নং উডবার্ন পার্ক ও ৩৮/২ এলগিন রোড—দূরত্ব খুবই কম, তিন মিনিটের পথ।
এই সঙ্গে আর একটি স্মৃতিও তাৎপর্যপূর্ণ। রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড ১৯২৭ সালে শিলং-এর শৈলনিবাসে লুকোচুরি খেলা। আমাদের ভাইবোনদের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি পালিয়ে বেড়াতেন এবং আমরা সকলে মিলে তাঁকে ধরবার চেষ্টা করতাম। খেলার সময় তিনি প্রায়ই ক্লান্ত হবার ভান করে শুয়ে পড়তেন এবং হঠাৎ ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেন। যে বিরাট লুকোচুরি খেলায় আমি পরবর্তী জীবনে তাঁর সঙ্গী হলাম,তাতে তফাতটা হল, আমি তাঁর পক্ষে, বিপক্ষে নয়।
১৯২৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে আমার সম্পর্কের বিস্তৃত বিবরণ এই কাহিনীর জন্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে কি ভারে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সাহচর্য ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক গড়ে উঠল, তার একটা আভাস হয়ত দিতে পারি। আমার মা’র হাত ধরেই রাঙাকাকাবাবুর রাজনৈতিক অথবা জনসেবার কাজের সঙ্গে ছেলেবেলায় আমার প্রথম পরিচয়। মহিলা সভায়, স্বদেশী যাত্রায়, ব্যায়াম ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অথবা সেবাকার্যের সাহায্যে নানারকম অনুষ্ঠানে আমি মা’র আঁচল ধরে রাঙাকাকাবাবুর বক্তৃতা শুনতে যেতাম। সেই সময় তিনি শুদ্ধ বাংলায় ঠেকে ঠেকে দার্শনিকের মত লম্বা লম্বা বক্তৃতা করতেন। বক্তৃতার অনেক কিছুই বুঝতাম না। তাঁর মুখের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মত কেবল তাকিয়ে থাকতাম।
১৯২৮-এর কলকাতা ‘কংগ্রেসের সময় আমাদের কাছে রাঙা-কাকাবাবুর এক নব-আবির্ভাব হল। সামরিক পোষাকে যখন তিনি উডবার্ন পার্কের সিঁড়ি দিয়ে নামতেন, সে দৃশ্য কোন অবোধ বালকের কাছেও অপূর্ব ও অবিস্মরণীয়! দুপুরে কাজের অবসরে বাড়ি ফিরতেন; রোদে-পোড়া মুখ টক্টকে লাল। দোতলার মাঝের ঘরে ইউনিফর্মের জ্যাকেট ও বেল্ট পালঙ্কের উপর ছুঁড়ে ফেলে বিশ্রাম নিতেন এবং মা তাঁর খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বালক বা বৃদ্ধ, এ ছবি যাঁরা দেখেছেন, আজাদ হিন্দ্ ফৌজের সর্বাধিনায়কের রূপ তাঁদের কাছে অভূতপূর্ব নয়।
তাঁর দেশত্যাগের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৮-৩৯ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। সেই সময় আমি রাজনীতিতে সত্যিকারের উৎসাহ নিতে আরম্ভ করেছি এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক তত্ত্ব সম্বন্ধে পড়াশুনাও আরম্ভ করেছি। ১৯৩৮ সালে হরিপুর কংগ্রেস থেকে ফিরে রাঙাকাকাবাবু আমাকে একটা আপাতদৃষ্টিতে সরল অথচ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ কাজের ভার দিলেন। এর ফলে যেন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি হল। উনি আমাকে একান্তে ডেকে বললেন, আমি যেন নিয়মিত মস্কো রেডিও শুনি। বিশেষত ভারতীয় ঘটনাবলী ও আমাদের জাতীয় আন্দোলন সম্পর্কে ওরা কি বলে বা কিভাবে রিপোর্ট করে তা নজর করি এবং ওদের প্রচারের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে ওঁকে ওয়াকিবহাল রাখি। বহু দিন ধরে আমি মাঝ রাতে এবং ভোর রাতে মস্কো রেডিওর অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার শুনতাম। প্রায়ই রেডিওর উপরেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা এসে আমাকে জাগিয়ে দিতেন এবং সুভাষের পাল্লায় পড়েছি বলে রসিকতা করতেন। দুঃখের বিষয়, সেই সূত্র থেকে কৌতূহলোদ্দীপক বা উৎসাহব্যঞ্জক বিশেষ কিছু আমি শুনিনি এবং রাঙাকাকাবাবুকেও জানাতে পারিনি।