॥ ৫ ॥
আমাদের এই গোপন শলাপরামর্শ শুরু হবার অল্প ক’দিনের মধ্যেই রাঙাকাকাবাবু একদিন আমাকে খুব শান্তভাবে একটা কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন। উনি জানতে চাইলেন, যে কাজের ভার উনি আমাকে দিচ্ছেন তা আমি বাবা-মাকে না জানিয়ে করতে পারব কিনা। আমার কিছুক্ষণ একটা অস্বস্তি বোধ হল, তারপর মৃদু গলায় বললাম, ‘ঠিক আছে।’ কিছু দিনের মধ্যেই অবশ্য আমি বুঝেছিলাম যে, তিনি আমাকে পরীক্ষা করবার জন্য ঐ প্রশ্নটি করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত আমাকে তখনই এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়নি। বাবার শরীরটা কিছু দিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না বলে বাবা সবেমাত্র তিন সপ্তাহের ছুটিতে কালিম্পং চলে গিয়েছেন। মা-ও ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে আমার বড়দাদার কাছে বারারিতে (ধানবাদের কাছে) বড়দিনের ছুটি কাটাতে চলেছেন।
বাবার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, তাঁর ‘মেজদা’ জীবনে কোনদিন তাঁর কোন কাজে বাধা দেননি। বরঞ্চ যে-কোন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্তে মেজদার কাছ থেকে উনি পেয়েছেন উৎসাহ ও সমর্থন। আজ যদি মেজদা তাঁর নিজের শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার জন্য ওর ছোট ভাইয়ের এই বিপদের পথে পাড়ি দেওয়া সমর্থন না করেন, তবে উনি কঠিন সমস্যায় পড়ে যাবেন। আমার মনে আছে, বাবা জানুয়ারির গোড়ায় কলকাতায় ফেরার আগে রাঙাকাকাবাবু দুই-তিনবার লেট-ফি দিয়ে কালিম্পং-এর ঠিকানায় শেয়ালদায় দার্জিলিং মেল ট্রেনে বাবাকে লেখা চিঠি পোস্ট করেছেন। পোস্ট অফিসের মারফত চিঠি না পাঠালে হয়ত সেন্সর এড়িয়ে যাওয়া যাবে এই মনে করেই সম্ভবত তিনি এরূপ করতেন।
বাবা-মা যত দিনে কলকাতায় ফিরলেন তত দিনে অন্তর্ধানের প্ল্যান অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং আমিও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছি। আমাকে আর বাবা-মাকে কিছু বলতে হল না। রাঙা-কাকাবাবুই যা বলবার ওঁদের বললেন। ছেলের নিরাপত্তার কথা ভেবে যে বিশেষ চিন্তিত বা বিচলিত হয়েছেন তা কিন্তু তাঁরা প্রকাশ করলেন না। তবে এই পরিকল্পনার মধ্যে যে বিপদের ঝুঁকি আছে সে সম্বন্ধে ওঁরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন এবং এর সাফল্য সম্বন্ধে রাঙা-কাকাবাবু যতটা নিশ্চিত ছিলেন, ওঁরা ততটা ছিলেন না।
বেশ কিছুকাল পরে ১৯৪২-এ আমি যখন ধরা পড়লাম, তখন বাবা সুদূর দাক্ষিণাত্যে জেলে বসে আমার বিপদের কথা ভেবে বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। আমি যখন অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজবন্দী, তখন জেল থেকে লুকিয়ে পাঠানো বাবার একখানা চিঠি আমার হাতে আসে। তাতে বাবা আমাকে অনেক চমকপ্রদ খবর দেন। বাবা জানতে পেরেছিলেন যে, ততদিনে নেতাজীর অন্তর্ধানে আমার ও মিয়া আকবর শাহের ভূমিকা ব্রিটিশ সরকার মোটামুটি সবই জেনে ফেলেছে। তাই সেই চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন যে, আমার অসুস্থতা বলতে গেলে শাপে বর হয়েছে, আমি সে সময় জেলে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। বাবা লিখলেন যে, তা না হলে আমাকে এত দিনে রেড ফোর্টে বা লাহোর ফোর্টে নিয়ে যাওয়া হত। আরো কিছুকাল পরে ১৯৪৪-৪৫এ বাবা যখন শুনলেন যে, আমাকে কোন অজ্ঞাতস্থানে বন্দী করে রাখা হয়েছে, উনি তখনই বুঝেছিলেন যে, আমাকে লাহোর ফোর্টে নেওয়া হয়েছে। সে সময় তাঁর জেল ডায়েরীতে অত্যন্ত মর্মস্পর্শীভাবে আমার জীবন-সংশয়ের কথা লেখা আছে। আর ১৯৪৪-৪৫ সালে যখন আমার কোন খবর দীর্ঘদিন পাওয়া যায়নি, তখন আমার মা তো আমাকে মৃত বলেই ধরে নিয়েছিলেন।