॥ ১৩ ॥
সেই বিশেষ দিনটি শেষ পর্যন্ত এসে পড়ল। আমি যেন একটা ঘোরর মধ্যে সব কাজ করে যাচ্ছিলাম। তবে আমার ভেতরের চাপা উত্তেজনা আমি বাইরে প্রকাশ করছিলাম না। শেষের দিকে রাঙাকাকাবাবু আমাকে একদিন বললেন—‘আমি অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে যাচ্ছি, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অনেক দিন—হয়তো কুড়ি বছর আমি দেশে ফিরতে পারব না, তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।’ আমার ভাগ্যে কি ঘটবে সে সম্বন্ধে অন্তর্ধানের দিন যত এগিয়ে এল ওঁর মতামত একটু পালটে গেল। প্রথম দিকে উনি যেন ভেবেছিলেন পুরো ব্যাপারটায় গোপনীয়তা রক্ষা করা সম্ভব হবে। আমি খুব বিপদে পড়ব না। কিন্তু যাবার আগে উনি দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। এক, ‘যদি কোনমতে তোমরা চার-পাঁচ দিন চেপে রাখতে পারো, আমি পগার পার হয়ে যাব।’ দ্বিতীয়ত, এই অন্তর্ধানে আমার ভূমিক বেশী দিন গোপন থাকবে না, কারণ, প্রকাশ হয়ে যাবার সূত্র অনেক। তাই আমাকে বলেছিলেন, পুলিশের নির্যাতন ও দীর্ঘদিন কারাবাসের জন্য প্রস্তুত থাকতে। আমার দিকে একটু চেয়ে বলেছিলেন—‘কি আর হবে, যুদ্ধ যতদিন চলে, জেলে থাকবে। যেমন দেশের অনেকেই আছে।’
আগেই বলেছি, ওয়ানডারার গাড়িটি সেদিন সার্ভিস হচ্ছিল। সার্ভিস হতে এত অসম্ভব সময় নিতে লাগল যে, আমি অস্থির হয়ে পড়লাম, বেশ সন্ধ্যা হয়ে যাবার পর গাড়ি সার্ভিস হয়ে এল। আমি মালপত্র গুছিয়ে রাখলাম।
আমি যখন প্রস্তুত হচ্ছি, দেখি বাবা ধীরপদক্ষেপে তিনতলায় উঠে এলেন এবং আমাকে খোলা ছাদে ডেকে নিয়ে গেলেন। বাবার মুখ-চোখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। বাবার সঙ্গে জীবনে আর আমার এর চাইতে ভাবগম্ভীর আলোচনা কখনও হয়নি। প্রথমেই আমাদের পরিকল্পনা সম্বন্ধে কয়েকটি তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করলেন, আমি বেশ বুঝতে পারলাম পুরো পরিকল্পনাটি বাবার নখদর্পণে। আমাদের ছাদটি আলোকিত হয়েছিল। বাবা আমাকে প্রথমেই শেখালেন, এরকম খোলাখুলিভাবে লোকচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে যাকে বলে Conspiracy under the lamp-post করলে সেটাই সবচাইতে সফল হয়! আমি বুঝতে পারছিলাম, আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাবা বেশ বিচলিত হয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে কাজের ভার নিয়েছি সেটা ঠিকমত করতে পারবে তো? আমি বাবাকে বললাম, গাড়ি চালাতে আমি ভালবাসি। আমার নিজের উপর এবং আমার গাড়ির উপর পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এরপর বাবা বললেন, ওঁর নিশ্চিত বিশ্বাস যে, চন্দননগরে ফরাসী পুলিশ চোরাই মাল নিয়ে যাচ্ছি কিনা দেখার জন্য আমাদের চ্যালেঞ্জ করবেই। আর একবার চ্যালেঞ্জ করলে রাঙাকাকাবাবুর এই ছদ্মবেশ কি টিকবে! যাই হোক, স্থির হল, বারারি পৌঁছে বউদিদির স্বাস্থ্য কেমন আছে জানিয়ে আমি বাবাকে একটা টেলিগ্রাম করে দেবো। বাবা এরপর ধীরে ধীরে নীচে নেমে গেলেন।
পরে আমি মা’র কাছে শুনেছিলাম যে, বাবা সে রাত্রে প্রায় দুটো পর্যন্ত জেগেছিলেন এবং একবার ঘর আর একবার রাস্তার দিকের ছোট বারান্দা, ক্রমাগত এই করেছেন। তিনি ভেবেছিলেন, আমরা উডবার্ন পার্কের বাড়ির সামনে দিয়ে যাব। ওয়ানডারার গাড়ির পরিচিত আওয়াজ শোনবার আশায় তিনি জেগেছিলেন। কিছু শুনতে না পেয়ে বাবা আমাদের কি হল ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত শুতে গিয়েছিলেন। যাই হোক, সে রাত্রে আমি নীচে নেমে এসে ঠাকুরের কাছে তাড়াতাড়ি খাবার চাইলাম। বললাম, ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে—শুয়ে পড়ব। আমি যতক্ষণ খেলাম মা চুপ করে আমার পাশে বসে রইলেন। তারপর আমি মা’র সঙ্গে ঘরে গিয়ে পথের খরচার জন্য কিছু টাকাপয়সা নিলাম। মা শুধু বললেন— ‘জানি না বাবা, তোমরা কি সব করছ!’ আর একটু ক্ষীণ হাসি হাসলেন। বাড়িতে অন্য গাড়ির যে ড্রাইভারটি ছিল, তাকেও সে সময় একটু সরাতে পারলে ভাল হয়। ড্রাইভারটি বাইরে খেতে যেত। মাকে ব্যবস্থা করতে বললাম—তিনি ড্রাইভারকে খেতে যাবার ছুটি দিলেন।
আমি ওয়ানডারার গাড়ি গ্যারাজ থেকে বার করে এক পাশে প্যানট্রির দরজার কাছে পার্ক করলাম। গাড়িবারান্দার কাছে সদর দরজায় সব সময় অন্তত একজন লোক থাকত। মালপত্র বার করে গাড়িতে তুলবার সময় তার চোখ এড়াতে হবে। মালপত্র নামিয়ে আনাটা আমি ভাগে ভাগ করলাম। প্রথমে তিনতলা থেকে দোতলায়, তারপর দোতলা থেকে একতলায়। পথের মধ্যে মাঝে মাঝে বাক্সটা অন্ধকারে লুকিয়ে ফেলছিলাম। বাড়ির ছোট ভাইবোনদের ও চাকর-বাকরের নজর এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিনিসগুলো গাড়িতে তুলতে পারলাম।
তখন রাত্রি সাড়ে আটটা হবে, আমি যাবার জন্য তৈরী হলাম। যেন বিশেষ কিছুই হয়নি এমনি মুখ করে গাড়ি-বারান্দায় এসে সেখানে যে ভৃত্যটি ছিল তাকে বললাম, আমি একটু রিষড়ার বাগান বাড়িতে যাচ্ছি। যদি বেশী দেরি হয়ে যায় তবে রাত্রিটা ওখানেই কাটাব, রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত দেখে ওরা যেন আর অপেক্ষা না করে গেট বন্ধ করে দেয়।
আমি গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এলগিন রোডের দিকে না গিয়ে উল্টো দিকে গাড়ি ঘোরালাম। লোয়ার সার্কুলার রোডে একটি পেট্রল স্টেশনে ঢুকে গাড়িতে তেল ভরে নিলাম। চাকার প্রেসারটি ঠিক আছে কিনা দেখলাম ও ব্যাটারি চেক্ করলাম, তারপর চৌরঙ্গী দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এসে পশ্চিম দিক থেকে এলগিন রোডের বাড়িতে ঢুকলাম। আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই গাড়ি চালিয়ে এলগিন রোডের বাড়িতে ঢুকে গেলাম আর বাড়ির পিছন দিককার সিঁড়ির কাছে গাড়ি পার্ক করলাম।
কোটটা গাড়িতে রেখে আমি নিতান্ত নিরুদ্বিগ্ন মুখ করে দোতলায় উঠে গেলাম।