॥ ৭ ॥
আমরা এক দিকে রাতের পর রাত ধরে বিভিন্ন পরামর্শ ও পরিকল্পনা করতে লাগলাম, অন্য দিকে রাঙাকাকাবাবু যাত্রার পথে যে সব বিভিন্ন ধরনের বাধা উপস্থিত হতে পারে তার মোকাবিলা করা ও লোকের মনে যাতে কোন সন্দেহের উদ্রেক হতে না পারে, তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনে উদ্যোগী হলেন। যেমন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায়, এমনকি চিঠিপত্রে উনি বারবার বলতে লাগলেন যে, ওঁকে তো শীগগিরই আবার জেলে ফিরে যেতে হবে। আত্মীয়-বন্ধু-সহকর্মী সকলের কাছে উনি আরো বারবার বলতে লাগলেন, যুদ্ধ শেষ না হলে তো ওঁকে ছাড়বে না, তাই ওঁর ব্যক্তিগত এবং জাতীয় যে সব কাজকর্ম আছে সব গুছিয়ে রেখে যেতে হবে। যেমন—ওঁর অনুপস্থিতিতে মহাজাতি সদন পরিকল্পনার কি হবে উনি আলোচনা করেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশন মহাজাতি সদনের জন্য জমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁর নামে লিখে দিয়েছিল। রাঙাকাকাবাবুর চিন্তা হল যে, ওঁর অন্তর্ধানের পরে ওঁর এই মানসগৃহ আইনের হাত থেকে অব্যাহতি পাবে না। একবার ভেবেছিলেন, ওঁর অ্যাটর্নীকে বলে এই সম্পত্তি একটা ট্রাষ্টি বোর্ডের কাছে হস্তান্তরিত করে যাবেন। কিন্তু বন্ধুমহলে অকারণে এতে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে ভেবে এই চিন্তা ছেড়ে দিলেন।
আলিপুর কোর্টে ওঁর বিরুদ্ধে দুটো কেস চলছিল—একটা কিছুকাল আগে একটি রাজদ্রোহাত্মক বক্তৃতার জন্য, অন্যটি ফরোয়ার্ড ব্লক পত্রিকার একটি সম্পাদকীয়র জন্য। যাতে কোর্টে কিছুতেই হাজিরা না দিতে হয়, এর জন্য উনি বিশেষ সচেষ্ট ছিলেন। হাজিরা না দেবার পক্ষে ওঁর ভগ্নস্বাস্থ্য বেশ জুতসই অজুহাত হল। কিছুদিন এ নিয়ে কোন অসুবিধা হল না। ওঁর চিকিৎসক ভাই সুনীলচন্দ্র বসু কলকাতা মেডিকেল কলেজের প্রধান চিকিৎসক ডাঃ মণি দে-কে কন্সালট করতেন এবং তিনি সহজেই কোর্টে দাখিল করার প্রয়োজনীয় মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে দিতেন। কিন্তু পরে যখন রাঙাকাকা-বাবুর শরীর একটু ভাল হল, তখন ওঁর ডাক্তার ভাই বেঁকে বসলেন। উনি বললেন, জেলে যাওয়া এড়াবার জন্য এইভাবে সুভাষের মেডিকেল কৈফিয়ত দেখানো অনুচিত। যদি ওঁর ডাক্তার ভাইয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা ওঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে মেডিকেল কলেজের প্রধান চিকিৎসক মেডিকেল সার্টিফিকেট না দেন তবে কী হবে! তাই এমন ব্যবস্থা করা হল যাতে ওঁর ডাক্তার ভাইকে পাশ কাটিয়ে মেডিকেল কলেজেরই একজন নাম-করা সার্জেন এবং রাঙাকাকাবাবুর ব্যক্তিগত বন্ধু ডঃ পঞ্চানন চ্যাটার্জিকে ডাকা হল। তিনি রাঙাকাকা-বাবুকে পরীক্ষা করে বিশেষ একটি সার্জিক্যাল অসুস্থতার কথা লিখে মেডিকেল সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেন।
আত্মীয়-স্বজন, আগন্তুক, বাড়ির ভৃত্যরা, সাদা পোষাকের পুলিশ যারা বাড়ির চারধারে প্রহরায় ছিল, এমন কি আমাদের ডাক্তার-কাকার পোষা অ্যালসেশিয়ান কুকুরটিরও গতিবিধি, বিশেষতঃ রাত্রিবেলার চলাফেরার উপর বিশেষভাবে নজর রাখা হল। বাড়ির ভিতরের এই নজর রাখায় ইলা সাহায্য করত, আমি নজর রাখতাম বাড়ির চারপাশে নিযুক্ত টিকটিকিদের উপর। বিশেষতঃ রাত করে উডবার্ন পার্কে ফিরে যাবার সময় ওরা কি করছে নজর করতাম। একজন বেকার আত্মীয় রোজই রাঙাকাকাবাবুর কাছে আসতেন। আমি কেন রোজ রাত্রে ওঁর কাছে যাই এ বিষয়ে তিনি অকারণে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং নানারকম প্রশ্ন করতে শুরু করেন। রাঙা-কাকাবাবু তাঁকে টাটা প্রতিষ্ঠানের বড় সাহেবের কাছে একটা পরিচয়পত্র লিখে জামসেদপুরে রওনা করে দিলেন। যাবার আগে এরকম দীর্ঘদিন বেকার থাকার বিড়ম্বনা সম্বন্ধে অনেক বোঝালেন, আর বলে দিলেন—যতদিন না চাকরি হয় কিছুতেই হাল ছাড়বে না এবং জামসেদপুর থেকে নড়বে না। এই প্ল্যান খুব ভাল কাজ করেছিল, ভদ্রলোকটি নেতাজীর অন্তর্ধানের পর চাকুরিহীন অবস্থাতেই কলকাতায় ফিরে এলেন।
তখন বাবা-মা কলকাতায় নেই। আমি একলা উডবার্ন পার্কে আছি। সে সময় বোম্বাই থেকে একজন পারিবারিক বন্ধু সস্ত্রীক রাঙাকাকাবাবুর অতিথি হিসেবে এসে উপস্থিত হলেন। আমার উপর উডবার্ন পার্কে এঁদের রাখবার ও দেখাশোনার ভার দেওয়া হল। এঁদের উপস্থিতির ফলে আমার এলগিন রোডে রাঙাকাকাবাবুর কাছে ঘন ঘন যাতায়াতের বেশ একটা নতুন অজুহাত তৈরি হল।
১৯৪০-এর বড়দিনে আমাকে একটা সহ্যশক্তির পরীক্ষা দিতে হল। রাঙাকাকাবাবু বললেন, সকালে উঠে গাড়ি চালিয়ে বর্ধমান চলে যাও। ওখানে রেল স্টেশনে দুপুরের খাওয়া খেয়েই আবার সোজা গাড়ি চালিয়ে কলকাতা ফিরে এসে কতটা ক্লান্ত হয়েছি তা রিপোর্ট করতে হবে। চলে গেলাম। ফিরে এসে রিপোর্ট করলাম, অবস্থা মোটামুটি ভালই।