॥ ১৭ ॥
দাদা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন আর আমি গোমোর দিকে গাড়ি চালিয়ে দিলাম। ওঁরা তিনজনেই পিছনের সীটে বসেছিলেন, আমার সঙ্গী ছিল আমার পাশের সীটে রাঙাকাকাবাবুর হোল্ড-অল্। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। দিল্লী-কালকা মেল মধ্যরাত্রির পর গোমো স্টেশনে আসে। আমাদের যেতে হবে মাত্র ত্রিশ মাইল। আমরা ধীরে-সুস্থে চলেছিলাম। রাস্তা অবশ্য গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডের মত অত ভাল নয়, সরু রাস্তা আর এবড়োখেবড়ো।
পথে আমরা দু’বার বেশ দীর্ঘ সময় থামলাম। একবার রাস্তার এক পাশে গাছের নীচে। বেশ একসার গরুর গাড়ি টুংটাং আওয়াজ তুলে যেন শোভাযাত্রা করে চলেছে দেখতে লাগলাম। সমসাময়িক ইতিহাসের একটা বিরাট অ্যাডভেঞ্চারের পটভূমি হিসাবে এই গরুর গলার ঘণ্টার টুংটাং সঙ্গীতের মূর্ছনা কেমন যেন আশ্চর্য বোধ হচ্ছিল।
দ্বিতীয়বার থামলাম গোমোর কাছাকাছি। চারিদিকে ধানের ক্ষেত চাঁদের আলোয় যেন ভেসে যাচ্ছে। অদূরে দিগন্তের গায়ে পরেশনাথ পাহাড়ের আবছা রূপরেখা।
গোমো স্টেশনের কাছাকাছি রাস্তাটা আরো খারাপ। স্টেশন-চত্বরে যখন পৌঁছলাম, ট্রেন আসার সময় প্রায় হয়েছে। দাদা আর আমি মালপত্র—হোল্ড-অল্, স্যুটকেস আর অ্যাটাচি কেস—নামিয়ে নিয়ে কুলির জন্য হাঁকডাক করতে লাগলাম। একজন ঘুমন্ত চেহারার কুলি এসে মালগুলো তুলে নিল।
‘আমি চললাম, তোমরা ফিরে যাও’—বিদায়-মুহূর্তে এই ছিল তাঁর শেষ কথা। আমি কেমন যেন নির্বাক্ ও নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে রইলাম, প্রণাম করার কথাও মনে এল না। রাত্রের গোমো স্টেশনের নির্জন ওভারব্রিজ দিয়ে রাঙাকাকাবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ দৃপ্ত অথচ ধীর ভঙ্গীতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন, আগে আগে চলেছে কুলি মাথায় মালপত্র নিয়ে—চিরদিনের মত এই ছবিটি আমার মনে মুদ্রিত হয়ে রইল। ওপারের সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাঙাকাকাবাবু প্ল্যাটফরমের দিকে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন।
ততক্ষণে মেল ট্রেনের গুম্গুম্ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আমরা গাড়ি নিয়ে একটু দূরে এসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। হুস্ হুস্ শব্দে ট্রেন এসে থামল ও আবার ছেড়ে দিল। আমরা কান পেতে ট্রেনের আওয়াজ শুনতে লাগলাম। তারপর ট্রেনের চাকার ছন্দোময় ঝঙ্কারের সঙ্গে অন্ধকারের বুকে একটা আলোর মালা দুলে দুলে দূরে চলে গেল দেখতে পেলাম।