॥ ১৫ ॥
দীর্ঘ প্রতীক্ষার এক ফাঁকে রাঙাকাকাবাবু আমাকে বলে দিয়েছিলেন যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি যেন প্রথমত দক্ষিণমুখো যাই—যদিও আমাদের গন্তব্য উত্তরে। ডান দিকে মোড় নিয়ে তো বাড়ি থেকে বেরোলাম, তারপর এলগিন রোড ছেড়ে আবার ডান দিকে ঘুরে এলেন্বি রোড দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগুলাম। আমাদের কাছাকাছি কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে বলে মনে হল না। এলগিন রোড ও উডবার্ন রোডের মোড়ে তক্তাপোশ পেতে সি. আই. ডি-র লোকেরা তাদের হেড কোয়ার্টার পেতেছিল। আমরা যখন বেরিয়ে গেলাম, তারা সম্ভবত কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামে ঘুমুচ্ছিল। দুই রাস্তার মোড়ের ঐ পর্যবেক্ষণ-কেন্দ্রটির উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য এক ঢিলে দুই পাখি মারা। সেখান থেকে বসু পরিবারের দুটো বাড়ির উপরই নজর রাখা যেত। আর দরকার পড়লে চট করে যে-কোন বাড়ির সামনে উপস্থিত হওয়া যেত। যাই হোক, তাদের কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল এবং দুই পাখিই তাদের অজান্তে উড়ে গেল।
এলেন্বি রোড ধরে খানিকটা এগিয়ে বাঁ হাতে জাস্টিস চন্দ্ৰমাধব রোড ধরলাম এবং ল্যান্সডাউন রোডে পড়লাম। রাঙাকাকাবাবু সেই যে গাড়ির দরজা ধরে বসেছিলেন, এলেন্বি রোডে পড়বার পর দরজাটি বন্ধ করলেন। ল্যান্সডাউন রোড ধরে উত্তরে ঘুরে লোয়ার সার্কুলার রোডে পড়লাম। কিছুক্ষণ ধরে আমি একটু পর পর পিছন ফিরে দেখতে লাগলাম, কোন গাড়ি আমাদের অনুসরণ করছে কিনা। পিছন দিকে কোন আলো দেখা গেলেই আমি সন্দিগ্ধভাবে দেখছিলাম। রাঙাকাকাবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কেন আমি সন্দিহান হচ্ছি এবং কেউ আমাদের ফলো করছে বলে মনে করছি কিনা।
আমাদের প্ল্যান ছিল সকাল হবার আগেই ধানবাদ পৌঁছাব অথচ রওনা হতেই কত দেরি হয়ে গেল! এতে আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। এদিকে খুব বেশী স্পীডে গাড়ি চালাবার ঝুঁকিও আমি নিতে চাই না। মনের অস্থিরতায় এবং সময় ও স্পীড সম্বন্ধে মনে মনে একটা প্ল্যান করবার উদ্দেশ্যে আমি একটু পরে পরেই ড্যাশবোর্ডের ঘড়িতে টর্চের আলো ফেলে সময় দেখছিলাম। লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে এসে শেয়ালদার কাছে গাড়ির গতি কমিয়ে দিতে হল। কারণ এক ঝাঁক ঘোড়ার গাড়ি রাস্তার এ-পাশ ও-পাশ ঘোরাঘুরি করছিল। এরা আমাদের আরও দেরি করিয়ে দেবে— এই কথা বলতে বলতে আমি আর একবার টর্চের আলো ড্যাশ-বোর্ডের ঘড়িতে ফেললাম। রাঙাকাকাবাবু আমাকে সাবধান করলেন, ‘টর্চের আলো ওভাবে ফেলে না, ড্যাশবোর্ড থেকে আলো এসে আমার মুখে পড়ছে।’
হ্যারিসন রোড ধরে এগিয়ে যেতে যেতে আমরা বুঝতে পারলাম সারা কলকাতা ঘুমুচ্ছে—আর ভয়ের কারণ নেই, শুধু হাওড়া ব্রিজের কাছে এসে গোটা দুয়েক ট্যাক্সি আর কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি আবার চোখে পড়ল।
তখনকার দিনেও গঙ্গা নদী পার হয়ে গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোডে পড়তে হলে দুটো ব্রিজ ছিল—হাওড়া ব্রিজ ও দক্ষিণেশ্বরের পাশ দিয়ে উইলিংডন বা বালী ব্রিজ। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে গিয়ে বালী ব্রিজের দ্বিতীয় রাস্তাটি বেশ ভাল ছিল এবং আমরা সাধারণত রিষড়ার বাড়ি যেতে ঐটিই ব্যবহার করতাম, কিন্তু ব্রিজ পার হতে টোলের পয়সা দিতে হত। পয়সা নিতে টোলের লোকেরা বড় কাছে আসত। কি জানি যদি চিনে ফেলে, তাই ঐ ব্রিজ দিয়ে যে যাব না, আগেই আলোচনা করে ঠিক করা ছিল। হাওড়া ব্রিজ পার হবার সময় ও তারপরে হাওড়ার এবভোখেবড়ো রাস্তা দিয়ে যাবার সময় গাড়িটা যেন বড্ড বেশী আওয়াজ করতে লাগল, নিঝুম রাতে গাড়ির এই আওয়াজে আমার অস্বস্তি হতে লাগল—কেউ যেন শুনে ফেলবে। শিল্প-এলাকা পার হবার সময় পথে মাঝে-মধ্যে সশস্ত্র পুলিশও চোখে পড়ল। তারা আমাদের চলন্ত গাড়ির দিকে নির্লিপ্ত-ভাবে চেয়ে দেখল। চেনা জায়গাগুলি পার হবার সময় আমরা বলা-বলি করতে করতে যাচ্ছিলাম—এই লিলুয়া পার হলাম—উত্তরপাড়া, বালী, কোন্নগর—এবার আমাদের রিষড়া, এই শ্রীরামপুর ইত্যাদি।
ঘণ্টা খানেক ড্রাইভ করার পর আমি রাঙাকাকাবাবুকে বললাম, ‘আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন না!’ রাঙাকাকাবাবু বললেন, ‘না। সেটা তোমার পক্ষে ভাল হবে না। গাড়ির একমাত্র আরোহী যদি ঘুমিয়ে পড়ে তা হলে যে ড্রাইভ করছে, তারও ক্লান্তি এসে যায়। তার চাইতে চালকের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলে তাকে সঙ্গ দেওয়া উচিত।’ তিনি এই সূত্রে তাঁর কতকগুলি মোটরে করে লম্বা লম্বা ট্যুরের কথা বললেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করলেন যে, রাত জেগে মোটরে ভ্রমণ তাঁর অভ্যাস আছে।
আসবার সময় ইলা থার্মোফ্লাস্ক ভরে কফি দিয়েছিল। রাঙা-কাকাবাবু মাঝে মাঝে আমাকে কফি অফার করতে লাগলেন। এমন কি, যখন আমি লেভেল ক্রসিং-এ গাড়ি থামিয়েছি, কাপে কফি ঢেলে আমার মুখের কাছে ধরে রইলেন। কি আর করব! ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে খেলাম।
সেই দীর্ঘ পথ পার হতে মাঝে মাঝে টুকিটাকি নানারকম কথাবার্তা হয়েছিল। হঠাৎ একবার রাঙাকাকাবাবু বললেন, ‘ডি ভ্যালেরার এস্কেপের গল্প জানো তো?’
বললাম, জানি। সেই কেকের ওপর চাবির ছাপ দিয়ে জেলের ভেতর পাচার করে দেওয়া—তারপর সেই ছাপ থেকে চাবি তৈরি করে নেওয়ার কাহিনী তো? আমি আবার শেষের ক’দিনে কতকগুলি বিখ্যাত এস্কেপের কাহিনী পড়ে নিয়েছিলাম।
রাঙাকাকাবাবু হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললেন, ‘জানো, আজ রাত্রে বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান আমি আর একটু হলে বাতিল করে দিতাম।’ পরিবারের কয়েকজনের মনে ওঁর গতিবিধি যে সন্দেহজনক ঠেকেছে তাতেই উনি এ কথা ভেবেছিলেন। বললেন, ‘দেখ, এসব ক্ষেত্রে কি করতে হয় জানো? যখন এমন পরিস্থিতি হয় যে, কারুর মনে গভীর সন্দেহ জেগেছে, যাকে পাশ কাটিয়ে যাবার উপায় নেই এবং যে অন্যথায় সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়ে আরও ক্ষতি করতে পারে। তাকে খানিকটা বলে নিজের দলে নিয়ে নিতে হয়, তা হলে সে মুখ বন্ধ করে থাকে। কিন্তু এই পলিসি মেনে চলার একটা সীমা আছে। আমি ইতিমধ্যেই একাধিকবার এরকম করতে বাধ্য হয়েছি এবং সামনে অনেক রাস্তা পড়ে রয়েছে। একটি লোককে সিক্রেট্টি বলার আগে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হয়—তার বন্ধু-বান্ধব, জীবনযাত্রার ধরনধারণ ইত্যাদি। বাড়ির আর একজনকেও আর এর মধ্যে জড়িয়ে নেওয়া সম্ভব নয়, তা হলে কিছুই গোপন থাকে না।’
রাঙাকাকাবাবু আরও বলে দিলেন—‘তুমি রোজ সন্ধ্যাবেলা যেমন এলগিন রোডের বাড়িতে যাও ঠিক সেইরকম যাতায়াত বজায় রাখবে।’ আমি কলকাতায় ফিরবার পর বাবাও আমাকে একই উপদেশ দিয়েছিলেন। যারা এই গোপন গৃহত্যাগের কথা জানে, রাঙাকাকাবাবু বললেন যে, তাদের যেন ফিরে এসে বারে বারে বলি ব্যাপারটার গোপনতা রক্ষা করে চলতে। ইংরেজীতে তিনি বলতেন —They must keep their mouth shut.
আবার আমাদের আত্মীয়পরিজন ও বন্ধুবান্ধব গোষ্ঠীর মধ্যে কয়েকজনের নাম করে তাদের সম্বন্ধে আমাকে সতর্ক থাকতে বললেন।
বর্ধমানের পথে একটি রেলের বন্ধ লেভেল ক্রসিং-এ আমি হঠাৎ গাড়ির ব্রেক কষতে এক ঝলক পেট্রল বেশী এসে পড়াতে এঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। রাঙাকাকাবাবু উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন। আমি ওঁকে আশ্বস্ত করে বললাম, দু-এক মিনিট অপেক্ষা করলে ঠিক হয়ে যাবে। উনি তখন আমার জন্য কফি ঢালতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। গাড়ি যথারীতি স্টার্ট নিল। ট্রেনও তো অনেকক্ষণ চলে গেছে, কিন্তু লেভেল ক্রসিং-এর গেট আর খোলে না। শীতের রাতে লোকটি ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি গাড়ি থেকে নেমে দরজায় ধাক্কাধাক্কি ও বিরাট হাঁকডাক আরম্ভ করলাম এবং লোকটিকে প্রায় টেনে বার করলাম। রাঙাকাকাবাবু অপরিচিত লোকের এত কাছে যাওয়া ও কথাবার্তা বলা মোটেই পছন্দ করলেন না।
গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। চলতে চলতে পরদিনের প্রোগ্রাম সম্বন্ধে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। বারারিতে পৌঁছে উনি বাড়িতে কিভাবে ঢুকবেন আর ইন্সিওরেন্সের এজেন্ট হিসাবে কি অভিনয় করবেন তা আমাকে বিশদভাবে বুঝিয়ে দিলেন। আমাদের আকস্মিক আগমনের কথা আমার দাদা কিছু জানতেন না। তাই পৌঁছেই আমি দাদাকে কি বলব তা পাখি পড়ার মত বারবার আমাকে শিখিয়ে দিলেন।
আগে কথা হয়েছিল, বারারি পৌঁছে আমি বাবাকে টেলিগ্রাম করব—Boudidi better, no cause for anxiety, রাঙাকাকাবাবু একটু ভেবে নিয়ে আমাকে টেলিগ্রাম করতে বারণ করলেন। উনি বললেন, এতে মিছামিছি গভর্নমেন্টের কাছে একটা রেকর্ড থেকে যাবে যে, আমি কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম, তা ছাড়া বাড়ির লোকজন অনেকে হয়ত আমার অনুপস্থিতি লক্ষ্যই করবে না; তাদের অকারণ সজাগ করে দিয়ে কি লাভ!
আমি মোটের উপর মাঝারি স্পীড বজায় রেখে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। হাওড়া থেকে বর্ধমান পর্যন্ত গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড বেশ আঁকাবাঁকা। রাঙাকাকাবাবু তাঁর আরও অনেক লঙ ডিস্ট্যানস্ ট্যুরের কথা—পাঞ্জাব, ইউ পি অথবা পশ্চিম ভারতে—একটু-আধটু বলছিলেন। দেরি করে রওনা হবার ফলে পৌঁছতেও দেরি হয়ে যাবে এই কথা ভেবে আমরা দু’জনেই ব্যস্ত হচ্ছিলাম। আমি মাঝে মাঝে এক হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে পথের পাশের মাইল-স্টোনগুলো দেখে নিচ্ছিলাম। গাড়ির মাইলের মিটার ঠিক কাজ করছিল না।
বর্ধমান পৌঁছতে প্রায় রাত চারটে হল। ঘুমন্ত শহর ও রেল-স্টেশন। আমি রাঙাকাকাবাবুকে দেখালাম। বর্ধমানের পর রাস্তাটা সোজা হয়ে এল, আমি স্পীড বাড়িয়ে দিলাম। গাড়িটাও যতই গরম হল, ততই যেন ভাল চলতে লাগল। যখন ডাকাতির জন্য কুখ্যাত দুর্গাপুরের জঙ্গল পার হয়ে এলাম, তখন ল্যান্ডস্কেপের চেহারা পালটে গেল—লাল মাটি ও সুদীর্ঘ বৃক্ষশ্রেণী। চারিদিক চাঁদের আলোয় যেন ভেসে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম বড় অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়েছি—আমার পক্ষে খুবই রোমান্টিক পটভূমি। বেশ জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি—ডাকাত নয়, এক পাল মোষ রাস্তা পার হচ্ছে। ব্রেক কষতে গাড়িটা কর্কশ আওয়াজ করে থামল। আর একটু হলেই মোষের দলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যেত। মোষগুলো ভয় পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গাড়ির চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর রাস্তা থেকে নেমে গেল। আমার বুক ধকধক করছিল। আড়চোখে রাঙাকাকাবাবুর দিকে তাকালাম। দেখি, উনি শান্ত ও অবিচলিত রয়েছেন। তখন আবার গাড়ি ছুটিয়ে দিলাম।
আসানসোলের কাছাকাছি যখন এলাম, সবে ভোর হয়ে আসছে, —চারিদিক কুয়াশায় আচ্ছন্ন, শহরের একটু বাইরে একটা পেট্রল স্টেশন দেখতে পেয়ে আমি পেট্রল ভরে নিতে চাইলাম। রাঙা-কাকাবাবু এটা একেবারেই পছন্দ করলেন না। পেট্রল ভরতি টিনটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘না নিলেই নয়?’ আমি বললাম, ‘একটা টিন রিজার্ভ থাকা ভাল, কোন ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়।’ কেউ তাঁকে দেখে ফেলে এটা রাঙাকাকাবাবু চাইছিলেন না। আমি এমনভাবে গাড়ি রাখলাম যাতে যে-লোকটি পেট্রল দিচ্ছে সে গাড়ির পিছন দিকে থাকে। যতক্ষণ পেট্রল দিল তার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলে তার দৃষ্টি আমার দিকে ধরে রাখলাম। আসানসোল শহর যত তাড়াতাড়ি পারি পার হয়ে এলাম।
আসানসোল থেকে ধানবাদের পথে খটখটে সকালবেলার রোদ্দুরে ড্রাইভ করতে হল। এই প্রথম আমার মনে হল, রাঙাকাকাবাবুর ছদ্মবেশটা সত্যিই ভাল। রাস্তা সোজা কিন্তু উঁচুনীচু—সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের মত। যখন নীচের দিকে আছি দূরের রাস্তা আর দেখা যায় না। গাড়ি নিয়ে লুকোচুরি খেলার মত মনে হয়। গাড়িঘোড় কিছু কিছু চলতে আরম্ভ করেছে। উল্টো দিক থেকে কয়েকটা গাড়ি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। সকাল হতেই আমি রাঙা-কাকাবাবুর সেই কাশ্মীরী টুপিটা মাথায় পরেছিলাম। এতে আমার মনে একটু নিরাপত্তার ভাব এসেছিল।
গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড থেকে রাস্তা যেখানে ধানবাদের দিকে বেঁকে গিয়েছে তার কিছু আগে গোবিন্দপুর নামে গ্রামে একটা চেকপোস্ট ছিল। আমি যখন ড্রাইভ করে আসছি, দেখতে পেলাম ধীরে ধীরে বাঁশের গেটটি পথ বন্ধ করে নেমে আসছে। আমি গাড়ির গতি কমিয়ে দিলাম। একটি লোক পাশের ছোট ছাউনি থেকে পেন্সিল আর নোটবই হাতে গাড়ির দিকে এগিয়ে এল। তার পরই আবার লোকটি সরে গেল, গেটও উপরে উঠে গেল। আমি স্পীড দিয়ে বেরিয়ে গেলাম। রাঙাকাকাবাবুকে বললাম, ‘আমার গাড়ির নম্বর নিল।’ মনে হল তিনি উদ্বিগ্ন হলেন। অন্তত তিনবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘ঠিক দেখেছ? নম্বর নিয়েছে?’ আমি ওঁকে আশ্বস্ত করলাম যে, এটা একটা রুটিন ব্যাপার। ক’দিন আগে এ পথ দিয়ে যেতে আমি এটা লক্ষ্য করেছিলাম।
দিনের আলোয় ধানবাদ শহরের মধ্য দিয়ে যেতে আমার অত্যন্ত অস্বস্তি হচ্ছিল এবং যতটা পারি জোরে চালাচ্ছিলাম। চেনা শহর, যদি আমাদের কেউ দেখে ফেলে! ধানবাদ ছেড়ে বারারির পথ ধরলাম। এলাকাটা অবশ্য আমি ভাল করে ক’দিন আগেই দেখে গিয়েছি। তা সত্ত্বেও রাস্তা যদি ভুল করি এই ভয় মনে মনে ছিল। আমি অধীরভাবে কতক্ষণে বারারিতে দাদার বাড়ি দেখতে পাব আশায় প্রত্যেকটি মোড় গুনতে লাগলাম। যখন দূর থেকে বারারির বাড়ি ও তার পিছনে কোক্ ওভেন প্লাণ্টের প্রকাণ্ড চিমনি দেখা গেল, আমি যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।
আমি দূর থেকে তাঁকে বাড়িটা ঠিক চিনিয়ে দিতে পারব কিনা, রাঙাকাকাবাবু বারবার আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন। পাশাপাশি ঠিক এক ধরনের দু’টি বাড়ি ছিল, একটি আমার দাদার, আর অন্যটি ঐ একই কারখানার একটি ইংরাজ অফিসারের। ভুল হলে আর নিস্তার নেই।
তখন সকাল সাড়ে আটটা হবে। কথা ছিল দাদার বাড়ির কিছু দূরে আমি রাঙাকাকাবাবুকে নামিয়ে দেবো। ওঁকে বাড়িটা চিনিয়ে দিয়ে আমি একাই ড্রাইভ করে বাড়িতে ঢুকব। যতটা দূরে রাঙা-কাকাবাবু গাড়ি থেকে নেমে যাবেন, আমি মনে করেছিলাম ও চেয়েছিলাম, ততটা দূরে তিনি নামলেন না। আমি বাড়ি ঠিক চিনিয়ে দিয়েছি এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হবার পর বাড়ি থেকে চার শ’ গজ মত দূরে আমি গাড়ি একবার দাঁড় করালাম ও রাঙাকাকাবাবু নেমে পড়লেন।