॥ ২১ ॥
সেই যে বাবার মেসেজ ছিল “দি মেডিকেল স্টুডেন্ট ইজ অল রাইট’—আমার মনে হয় এতে রাঙাকাকাবাবু বুঝলেন যে, আমাকে পুলিশ সন্দেহ করেনি এবং আমি মুক্ত আছি। তাই কিছুকাল পরে ওঁর কাছ থেকে সোজাসুজি বার্তা নিয়ে যে বিশেষ দল ভারতে এল তাদের আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। বাবা তখন জেলে।
তবে সেই বিশেষ দল যখন ভারতবর্ষের মাটিতে নামল এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল তখন আর আমি ঠিক মুক্ত নই— গৃহে অন্তরীণ। প্রকৃতপক্ষে তার অনেক আগেই আমার বন্দী-জীবন শুরু হয়েছে। ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত আমার বন্দী-জীবন নানাভাবে বিভক্ত ও বৈচিত্র্যময়।
৪২-এর আন্দোলনের সময় আমি প্রথম ধৃত হই। ৮ই আগষ্ট বোম্বাই-এ কংগ্রেসের সভায় Quit India প্রস্তাব পাশ হয়েছে খবর পেয়েই সেইদিন রাতে রাঙাকাকাবাবু আজাদ হিন্দ্ রেডিও থেকে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় দেশপ্রেমিক সব ভারতবাসীকে ঐ শেষ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে আহ্বান করেন।
প্রথমতঃ মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের একটি মিছিলের উপর পুলিশের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে আমি সপ্তাহ তিনেক শয্যাশায়ী ছিলাম। এর অল্পদিন পরেই আমি গ্রেপ্তার হই। যেদিন আমাকে ধরতে এল, ভোরবেলা দেখা গেল রাত থাকতে পুলিশ উডবার্ন পার্কের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। বাড়ির ভিতর সার্চ শুরু হবার আগে কোনমতে আমরা ভগৎরামের আনা বাংলায় লেখা রাঙা-কাকাবাবুর চিঠিখানা পুড়িয়ে ফেলতে সমর্থ হই। সেদিন এ কাজ করা ছাড়া উপায় ছিল না। আজ মনে হয় একটা অমূল্য দলিল নষ্ট হয়ে গেল। অন্য দু’টি লেখা বহু আগেই হস্তান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।
প্রেসিডেন্সী জেলে রাজবন্দী থাকার সময় আমি টাইফয়েড রোগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমার অসুস্থতা সত্য কিনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিয়ে আমাকে বন্দী অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়। রোগশয্যায় শুয়ে এই সময় আমি বাবার কাছ থেকে জেল থেকে গোপনে পাঠানো কয়েকটি বার্তা পাই। আগেই বলেছি, এই সময় বাবা আমাকে কতকগুলি চমকপ্রদ খবর পাঠান। তার মধ্যে একটি ছিল যে, গভর্নমেন্ট রাঙা-কাকাবাবুর অন্তর্ধানে আমার ভূমিকা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানে। বাবা এ কথাও লিখেছিলেন যে, হয়ত আমার গুরুতর অসুখ শাপে বর হয়েছে; নতুবা আমাকে হয়ত পুলিশ আগেই লালকেল্লা অথবা লাহোর ফোর্টে চালান দিত। কিঞ্চিৎ সুস্থ হবার পর আমি উডবার্ন পার্কের বাড়িতে অন্তরীণ হলাম। তার কিছুকাল পরে অন্তরীণ অবস্থাতে আমার বাড়ি থেকে কলেজ যাতায়াতের অনুমতি মিলল।
১৯৪১-এর শেষেই ষ্ট্যালিনগ্রাডে যুদ্ধের মোড় ফিরে গেল। ১৯৪৩-এর মার্চ-এপ্রিল মাসে বাড়িতে নজরবন্দী অবস্থায় রেডিও শুনছি। খুব ঘটা করে বার্লিন থেকে প্রচার করা রাঙাকাকাবাবুর একটি বক্তৃতা কেমন যেন ঠেকল। রাঙাকাকাবাবু প্রত্যেক বক্তৃতার প্রথমভাগে তাঁর পূর্বের বক্তৃতার পর দেশের ও বিদেশের ঘটনার পর্যালোচনা করতেন। দেখলাম এই বক্তৃতায় উনি পুরোনো কথা বলছেন—আগের বক্তৃতায় যে সব কথা শুনেছি সেগুলিই যেন আবার রেকর্ডে শুনছি। হঠাৎ মনে হল রাঙাকাকাবাবু ইউরোপে নেই— নিশ্চয়ই এশিয়ার পথে পাড়ি দিয়েছেন। মাকে আর বোন গীতাকে আমার অনুমান সেই রাতেই জানালাম। কি উপায়ে এশিয়ায় আসছেন অবশ্য আন্দাজ করা সম্ভব ছিল না। তখন মনে করেছিলাম হয়ত বিশেষ কোন ব্যবস্থা করে তুরস্ক ও সোভিয়েট সাইবেরিয়া হয়ে জাপানে আসবেন।
১৯৪৩-এর পূজার সময় স্বাস্থ্যোদ্বারের অজুহাতে মা ও ছোট ভাইবোনদের নিয়ে দাদার কাছে বারারিতে যাবার সরকারী অনুমতি নিলাম। যে ঘরে বসে দাদা ১৯৪১ সালের ১৭ই জানুয়ারী “মহম্মদ জিয়াউদ্দিন”-এর সঙ্গে আমার “পরিচয়” করিয়ে দিয়েছিলেন সেই ঘরে বসেই রেডিও মারফত সিঙ্গাপুর থেকে রাঙাকাকাবাবুর নিজের মুখে আজাদ হিন্দ্ গভর্নমেন্টের ঘোষণাপত্র পাঠ শুনলাম।
১৯৪৩ সালটা এইভাবে চলল। বছরের শেষের দিকে রাঙা-কাকাবাবুর বিশেষ বার্তাবহ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। মা-জননীর সবেমাত্র মৃত্যু হয়েছে, আমাদের অশৌচ চলছে। এমন সময় একদিন উডবার্ন পার্কে আমার সঙ্গে একজন দেখা করে রাঙা-কাকাবাবুর নিজের হাতে লেখা একটি বার্তা আমার হাতে দিলেন। নীচের তলার পশ্চিমের যে-ঘরে ভগৎরামের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছিলাম, সেই ঘরেই এই বিশেষ দূতের সঙ্গে কথা হল। এই ভদ্রলোকের নাম টি কে রাও, মাদ্রাজের অধিবাসী। উনি একটি ছোট দল নিয়ে সাবমেরিনে করে এসে কাথিয়াওয়াড় উপকূলে নেমেছেন। রাওকে রাঙাকাকাবাবু বলেছেন এই চিঠি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে। রাও বললেন, নেমেই আমরা নেতাজীর সঙ্গে রেডিও সংযোগ করেছি। ওঁর মায়ের মৃত্যু খবর ওঁকে রেডিও বার্তায় জানানো হয়েছে। রাও আমাকে সংক্ষেপে সিঙ্গাপুরের সব সংবাদ দিলেন, তাঁরা রওনা হবার কিছু আগেই আজাদ হিন্দ্ সরকার স্থাপিত হয়েছে। রাঙাকাকাবাবু যে অপূর্ব জন-সমর্থন পেয়েছেন তার কথাও বললেন। সেই প্রথম আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে ‘নেতাজী’র কথা শুনলাম, যাবার আগে রাও আমাকে ‘জয় হিন্দ’ অভিবাদন শিখিয়ে গেলেন।
টি কে রাও ছিলেন ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান আমিতে। ইনি উত্তর আফ্রিকার টোব্রুকের বিখ্যাত লড়াইয়ে রোমেলের বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। ইউরোপে স্থানান্তরিত হবার পর নেতাজীর ডাকে আজাদ হিন্দ্ ফৌজে যোগ দেন। জার্মানীতে আই এন এ-র যে ছোট দলটিকে সিক্রেট সার্ভিস ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপে ট্রেনিং দেওয়া হয়, রাও তাদের অন্যতম। রাঙাকাকাবাবু ইউরোপ ছেড়ে সাবমেরিনে রওনা হবার পর আই এন এ-র মেজর স্বামী এই বিশেষ ট্রেনিং-প্রাপ্তদের একটি ছোট দল নিয়ে একটি ব্লকেড রানার জাহাজে চড়ে এই যুদ্ধের মধ্যে জীবনমৃত্যু হেলা করে নেতাকে অনুসরণ করে পূর্ব এশিয়ায় হাজির হলেন। রাও ছিলেন এই দলে। টি কে রাও ও তাঁর সঙ্গীরা সব দিক থেকে দক্ষ এবং নেতাজীর বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন।
কলকাতায় রাও আমাকে তিন-চারটি নাম করে বললেন যে, আমি যেন এদের সঙ্গে রাও-এর যোগাযোগ করিয়ে দিই। যাঁদের নাম রাও করলেন তাঁদের কারুর সঙ্গেই যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া সম্ভব ছিল না—কেউ বা জেলে, কেউ বা কলকাতায় নেই, কেউ বা অসুস্থ, ইত্যাদি।
আমার পক্ষে রাওকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা নিরাপদ বা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, তখন আমাকে পুলিশ সর্বদাই অনুসরণ করে। আমাকে ঐ রকম অর্ধেক মুক্ত অর্ধেক বন্দী করে রাখাটা এখন মনে হয় পুলিশের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। তারা নজর রাখত কারা আমার কাছে আসে যায় বা আমি কি করি। বন্দী করে রাখার থেকে ওরা হয়ত এর ফলে বেশী লাভবান হয়েছিল।
আমি রাওকে বললাম, পরদিন মেট্রো সিনেমায় সন্ধ্যার শোর সময় আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। ইতিমধ্যে আমি সত্যরঞ্জন বক্সী মহাশয়ের ছোট ভাই সুধীররঞ্জন বক্সীর কাছে চলে গেলাম এবং রাও-এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগের ভার নিতে বললাম। সুধীরবাবু তৎক্ষণাৎ রাজী হলেন। উনি কর্পোরেশনে কাজ করতেন। সেখানেই অফিসের সময়ে রাও তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন ঠিক হল। আমি রাও-এর একটি ছদ্মনাম দিলাম—‘প্রসাদ’। এই নাম বললেই সুধীরবাবু বুঝবেন। ঠিক সেইমত সব হয়েছিল। তাঁদের দেখা হওয়ার পর কর্পোরেশন থেকে সুধীরবাবু ও ‘প্রসাদ’ দু’জনেই আমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন।
এই ব্যবস্থার খবর দিতে পরদিন মেট্রো সিনেমায় আমি রাও-এর সঙ্গে মিলিত হলাম, দু’খানা টিকিট কেটে ভিড়ের মধ্যে হেঁটে গিয়ে হলে পাশাপাশি বসলাম। ছবি শুরু হবার আগে সুধীরবাবুর সঙ্গে যা কিছু ব্যবস্থা হয়েছে আমি তাঁকে বুঝিয়ে দিলাম। নিউজ রীল হয়ে যাবার পরই আমি অন্ধকার হল থেকে বেরিয়ে এসে সোজা মেডিকেল কলেজে চলে গেলাম। রাওকে বলে গেলাম সিনেমা পুরোটা দেখতে। মেডিকেল কলেজে সেদিন সন্ধ্যায় একটি সোশ্যাল ছিল। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারী। আমি সেখানে প্রথামত স্বাগত বক্তৃতাও করলাম। কয়েক শত ছাত্রছাত্রী আমার সেখানে উপস্থিতির সাক্ষী হয়ে রইল। মাঝপথে নেমে রাও-এর সঙ্গে মেট্রোতে সাক্ষাৎ গোপন রয়ে গেল।
রাও-এর দলের সঙ্গে সুধীরবাবুর মাধ্যমে বি ভি-র বিপ্লবীদের যোগাযোগ হল। এরা যুক্তভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিল। মধ্য কলকাতার একটি বাড়ি থেকে নেতাজীর সঙ্গে সরাসরি রেডিও সংযোগ স্থাপিত হয়েছিল। আমি সন্ধ্যার পর বেড়াতে যাবার অছিলায় সুধীরবাবুর বাড়িতে প্রায়ই যেতাম এবং সুধীরবাবু আমাকে কাজ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল রাখতেন। বি ভি-র কয়েকটি তরুণ বিপ্লবী এই সময় অসীম সাহসিকতার ও আত্মত্যাগের পরিচয় দেয়। তাদের কথা আশা করি একদিন বিশদভাবে লেখা হবে।
১৯৪৪-এর ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের বিশেষ অনুমতি নিয়ে মা আর এক বোনকে সঙ্গে করে বাবার সঙ্গে দেখা করতে কুনুর নীলগিরি পাহাড়ের বন্দী নিবাসে গেলাম। সবেমাত্র আমি সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়েছি। সঙ্গে নিয়ে গেলাম রাঙাকাকাবাবুর চিঠি। সংক্ষিপ্ত বার্তাটি তিনি ইণ্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগের সিঙ্গাপুরের সদর দপ্তরের ছাপা কাগজে লিখেছেন, তারিখ ছিল—‘শ্ৰীশ্ৰীকালীপূজা, ২৯শে অক্টোবর ১৯৪৩’—‘পত্রবাহক বিশেষ জরুরী কাজে দেশে যাচ্ছেন’— ইত্যাদি। বাবার সঙ্গে ইন্টারভিউ-এর সময় কয়েক মিনিটের জন্য ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারটি বাইরে গিয়েছিলেন; সেই সুযোগে আমি বাবাকে সেই অমূল্য চিঠিখানি দেখাই এবং রাও-এর কাছে যে সব খবর আমি পেয়েছিলাম বাবাকে বলি। এইভাবে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে বাবাকে চিঠিখানি দেখাতে পারায় আমি পরম সন্তোষ লাভ করেছিলাম।
মাস তিনেক পরে আমি বুঝতে পারলাম যে, পুলিশ দিনে দিনে আমাদের চারধারে তার জাল গুটিয়ে আনছে। আমাকে অনুসরণ করার মাত্রা খুব বেড়ে গেল। বাবার উপরও চিঠিপত্র লেখা ও দেখা করার ব্যাপারে নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল। কিন্তু আমরা যেন খানিকটা বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম। আমি সুধীর-বাবুদের সঙ্গে যোগাযোগ আগেকার মত রক্ষা করে চললাম। শেষ পর্যন্ত এমন দাঁড়াল যে সর্বক্ষণ দু’জন পুলিশের লোক আমার পিছনে ছুটত। আমি মেডিকেল কলেজে যাই আসি—আমার কোটের পকেটে থাকে রাঙাকাকাবাবুর নিজের হাতে লেখা বার্তা। হাতে-নাতে ধরা পড়লে তো সর্বনাশ! সুতরাং আমাদের এক বিশ্বস্ত বন্ধুর হাতে চিঠিখানা দিয়ে এলাম। বললাম, আমাকে পুলিশ বড্ড শ্যাডো করছে, কখন কি হয়, চিঠিখানা আপনি রাখুন।
চিঠিটা হস্তান্তরের কয়েক দিন পরেই সুধীরবাবু ও আমি গ্রেপ্তার হই। সেই বন্ধুটি—শ্রীনরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, পরে আমাকে বলে-ছিলেন যে, চিঠিটি উনি নষ্ট করে দিতে বাধ্য হন। আবার একটি অমূল্য জিনিস হারিয়ে গেল।
কিন্তু সৌভাগ্যবশত প্রায় অনুরূপ আর একটি বার্তা আজও নেতাজী মিউজিয়মে রক্ষিত আছে। অপর একজন বার্তাবহ আর একটি চিঠি নিয়ে স্থলপথে সীমান্ত অতিক্রম করে দেশে আসছিলেন। যুদ্ধের মধ্যে তিনি কিছুতেই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারেননি যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর উনি কলকাতায় আসেন এবং যেহেতু রাঙা-কাকাবাবু আমার হাতে এই চিঠিটি দিতে বলেছিলেন, দেরিতে হলেও চিঠিটি আমার হাতে দেন। এই চিঠির ঠিকানা হলঃ ভারত-বর্মা সীমান্ত। আমাদের অনেক সৌভাগ্য, উত্তরকালের জন্য এটি আমরা সংরক্ষণ করতে পেরেছি।
পত্রবাহকের হাতে সুভাষচন্দ্রের গোপন চিঠির প্রতিলিপি
পুলিশের জাল আমাদের উপর অবধারিতভাবে নেমে আসছে বুঝতে পেরে রাও-এর দলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয় এবং ওরা গা ঢাকা দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে আমাদের অনেকেরই জীবন রক্ষা হয়। আমার চার্জসীটে অভিযোগের মধ্যে and others কথা দু’টি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল—and others ছিল নেতাজীর প্রেরিত দল। কিন্তু রাও-এর দলকে ধরতে না পারায় সরকারের পক্ষে অভিযোগ প্রমাণ করা শক্ত হয়ে পড়ল। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪-এর অক্টোবরে কলেজ যাওয়ার পথে পুলিশ আমাকে ঘিরে ফেলল এবং গাড়িতে তুলে লর্ড সিন্হা রোডে নিয়ে গেল। পরে আমাকে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হল এবং আমাকে নীচে বসিয়ে রেখে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হল। এবারও আমার মা সময়মত কিছু গোপনীয় কাগজপত্র বাথরুমের মধ্যে পুড়িয়ে ফেলতে সমর্থ হয়েছিলেন।
পুলিশ আমাকে নিয়ে কোন অজানা গন্তব্যস্থানে চলে গেল। এরপর সাড়ে সাত মাস আমায় নিঃসঙ্গ কারাজীবন যাপন করতে হয়েছে—তার মধ্যে সাড়ে তিন মাস লাহোর ফোর্টে। আমার মা বা পরিবারের কেউ জানলেন না আমি কোথায় আছি বা আদৌ বেঁচে আছি কিনা। বন্দীশালায় বাবার আমার সম্বন্ধে চিন্তার অবধি ছিল না। তাঁর জেল ডায়েরীর পাতা থেকে তাঁর গভীর দুশ্চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
January | Saturday 20 | 1945 |
After bath when I sat down to pray (at about 2.15 P.M.) my mind was very much troubled with thoughts of Sisir. Has anything serious happened to Sisir? I prayed to the Divine Mother with tears in my eyes and begged of Her to save Sisir. Will my prayers reach Her lotus feet?
At about 3.30 P.M. received Ami’s letter of the 14th. He says that there is still no news about Sisir and that he will be going up to Delhi as soon as he can get train accommodation. May his mission prove successful! During my afternoon nap, dreamt that father came to me. Has the dream any meaning, good or bad?
শরৎচন্দ্র বসুর জেলের ডায়েরীর একটি পাতা (জানুয়ারী ১৯৪৫)
সেই সময় আমি আমার বাবার যে গভীর বেদনার কারণ হয়েছিলাম তা আজ তাঁর জেল ডায়েরীর পাতা উলটিয়ে বুঝতে পারি। আবার ২২শে জানুয়ারী দেখতে পাই তিনি লিখছেনঃ
Monday
January 22, 1945
Yesterday and today my mind has been oscillating very much—sometimes I feel that Sisir is getting over the crisis, sometimes I feel just the opposite. My heart bleeds for my poor boy and his mother. Won’t the Divine Mother who has kept me in fetters save my poor boy? Won’t She teach me how to pray at Her lotus feet?
শরৎচন্দ্র বসুর জেলের ডায়েরীর আর একটি পাতা (জানুয়ারী ১৯৪৫)
আমার ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা এই রকম। এক রাএি কুখ্যাত লর্ড সিন্হা রোডের হাজতে কাটিয়ে পরদিন ভোর হবার আগে আমাকে একটি মিলিটারী এরোপ্লেনে তুলে দিল্লীর লালকেল্লায় নিয়ে যাওয়া হল। যে পুলিশ অফিসারটি আমার সঙ্গে ছিলেন, তিনি হাতকড়াটি আমাকে দেখিয়ে সাবধান করে দিলেন। এইভাবে আমার জীবনে প্রথম এরোপ্লেন চড়ার অভিজ্ঞতা হল। ব্রিটিশ গভর্নমেণ্টের খরচে—এই যা সান্ত্বনা।
দিল্লীর লালকেল্লার আণ্ডারগ্রাউণ্ড সেলে যখন আমাকে ঠেলে দেওয়া হল, হঠাৎ চোখে পড়ল দেওয়ালের গায়ে কয়লা দিয়ে আর কোন বন্দী বড় বড় অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে—Stone-walls do not a prison make—ইত্যাদি।
দিন দশেক সেখানে থাকার পর পাঞ্জাবী পুলিশের হেফাজতে ট্রেনে করে দিল্লী থেকে লাহোর। লালকেল্লার সেল থেকে লাহোর ফোর্টের ১২ নম্বর সেলের দরজা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত সেই বিশেষরকম চাবি লাগানো হাতকড়া আর খোলা হল না। আজ লিখতে বসে একটা বিচিত্র অনুভূতির কথা মনে পড়ছে। দিল্লী স্টেশনের জনবহুল প্ল্যাটফর্ম দিয়ে আমাকে নিয়ে চলেছে। হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা, দু’দিকে বন্দুকধারী সেপাই-সান্ত্রী। আমি ব্যাকুলভাবে একবার এদিক একবার ওদিক চাইলাম, যদি কেউ আমাকে দেখতে পায় এবং খবরটা অন্তত কারুর কাছে পৌঁছে দেয়।
সেই সময় আমি দেখলাম, এত লোক কত তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত, কিন্তু কেউ আমার দিকে ফিরেও দেখছে না। আমার মনে হল সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীন সরকার গঠন করেছেন দেশের বাইরে। মুক্তি-ফৌজ নিয়ে তিনি দেশের সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। কিন্তু হায়, তাঁর দেশবাসী এসব কিছুই জানে না। তারা নিরুৎসাহ নির্লিপ্ত মুখে তুচ্ছ কাজে ব্যস্ত। তাঁরই কাজে সামান্য জড়িত থাকার জন্য আমাকে বিদেশী সরকার প্রকাশ্যভাবে বেঁধে নিয়ে চলেছে। কিন্তু কেউ তাতে বিচলিত নয়।
লাহোর ফোর্টে চারদিকে গরাদ দেওয়া একটি খোলা খাঁচায় পুরো শীতকালটা আমার এক বস্ত্রে কাটল। খাঁচার বাইরে ছিল একটি হরিণ। সে কাছে এসে বড় বড় চোখ মেলে অবাক হয়ে আমাকে দেখত, যেমন আমরা চিড়িয়াখানায় জন্তু-জানোয়ারদের দেখি।
লাহোর ফোর্টে আমার অজ্ঞাতবাস যখন চলছে তখন কলকাতায় আমাদের আত্মীয় ও বন্ধুমহলে আমার গতিবিধি জানবার এবং সম্ভব হলে আমাকে উদ্ধার করবার চেষ্টা চলছিল। আমার মেজদাদা অমিয়নাথ দিল্লী গিয়েও খোঁজখবর করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সে সময়ে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ ভারতীয় বাঙ্গালী অফিসাররাও তাঁদের রাজভক্তি বজায় রেখে রূঢ়ভাবে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
এই ব্যাপারে উচ্চমহলের একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা উল্লেখ-যোগ্য। পরিবারের এক বিশেষ বন্ধু ও একজন নিকট-আত্মীয় ভারত গভর্নমেন্টের প্রাক্তন ল’মেম্বার ও আইন-ব্যবসায়ে বাবার ‘গুরুজী’ স্যার নৃপেন্দ্রনাথ সরকারের কাছে গেলেন। তাঁরা অবশ্য আমার গোপন কার্যকলাপের কথা কিছু জানতেন না। সরকার সাহেবকে তাঁরা বললেন যে আমি নিতান্তই ভালমানুষ, সাতে-পাঁচে থাকি না, ভারত গভর্নমেন্ট নিশ্চয়ই ভুল করে আমাকে বন্দী করে রেখেছেন। তাঁরা সরকার সাহেবকে সরাসরি লর্ড ওয়েভেলকে আমার বিষয়ে লেখবার অনুরোধ জানান। সরকার সাহেব বললেন, শরতের সম্বন্ধে কোন কথা তো ওরা কানেই তুলবে না। কিন্তু ছেলেটির সম্বন্ধে আমি লিখব। ওয়েভেল প্রথমতঃ উত্তর দিলেন যে তিনি হোম ডিপার্টমেন্টের গোপনীয় সব ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন না, তবে সরকার সাহেবের খাতিরে আমার ফাইলটা. চেয়ে পাঠাবেন। পরে ওয়েভেল লেখেন যে আমার সম্বন্ধে সরকার সাহেবের ধারণা ঠিক নয়, আমি একজন “dangerous boy” এবং আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর। তাঁরা চান যে আমার বিচার হোক এবং উপযুক্ত শাস্তি পাই, কিন্তু যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে তাঁরা তা করতে পারছেন না। ওয়েভেলের চিঠি স্যার নৃপেন আমার মাকে ডেকে দেখালেন, মা চিঠিখানা পড়ে নীরবে ফিরে এলেন।
নিয়মিত প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হবার আগে ফোর্টের ঝানু স্পেশ্যাল সুপারিণ্টেণ্ডেণ্টে মাঝে মাঝে খাঁচার বাইরে থেকে নানাভাবে আমার উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতেন। বলতেন, দেখ, এখানে তো কেবল অতি বিপজ্জনক ব্যক্তিদের আনা হয়—যারা গোপনে রাজ-দ্রোহাত্মক কাজে লিপ্ত, এককথায় যারা রিভলিউশনারি। তুমি এখানে এসেছ কেন? তারপর বলতেন, লাহোর ফোর্টে যারা আসে তাদের এখানে যুগ কেটে যায়। জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারা বড় একটা কেউ ঘরে ফেরে না।
সত্যি কথা, লাহোর ফোর্টে আমার যেন নিজের সত্ত্বাও ওরা রাখতে দেবে না। ওষুধের শিশির ওপর এক অদ্ভুত নাম দেখে একদিন বুঝলাম যে, ওরা আমার নামও বদলে দিয়েছে। ওরা বলল, ঠিকই তো, তোমার এখানকার নাম সন্সার চন্দ্। অর্থাৎ কোন রেকর্ডেই আমার আসল নাম থাকবে না। কে প্রমাণ করবে যে শিশির বসু বলে এখানে কেউ ছিল!
দীর্ঘ ইন্টেরোগেশনের শেষের দিকে আমি একদিন ফোর্টের কর্তা নাজির আহমদ রিজভিকে বলে ফেললাম, তোমরা আমার কেরিয়ারটাই নষ্ট করে দিলে। উত্তরে সে বললে—দেখ, তোমাকে একটা কথা বলব। আমার বাবাও এই লাহোর ফোর্টের অফিসার ছিলেন এবং তার সঙ্গে ছেলেবেলা থেকেই এখানে আসছি। আমি আমার অ-আ-ক-খ শিখেছি ভারতের শ্রেষ্ঠ বিপ্লবীদের কাছে—
I learnt my alphabets from India’s greatest revolutionaries.
তুমি ও আমি বিপক্ষ দলের লোক। তবুও আমি বলছি, লাহোর ফোর্টে কারুর কেরিয়ার নষ্ট হয় না। শুরু হয়। আমার এখানেই শুরু। এখানেই শেষ। কিন্তু তোমার জীবন এখানে শুরু।
আমারও কেমন মনে হল, লাহোর ফোর্টে নিগৃহীত হবার গৌরব লাভ করে আমি ধন্য। বহু যুগ আগে এক রাত্রে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে গিয়েছিলেন সিদ্ধিলাভের আশায়। তিনি ইতিহাসের পাতায় ফিরে এলেন গৌতম বুদ্ধ রূপে। আধুনিক কালে আর এক রাত্রে অন্য এক সিদ্ধিলাভের জন্য গৃহত্যাগ করলেন সুভাষচন্দ্র। ইতিহাসের পাতায় তিনি প্রত্যাগত নেতাজী রূপে। তাঁর সেই ঐতিহাসিক গৃহত্যাগে আমার যে অতি সামান্য ভূমিকা তা আমার জীবনকে ধন্য করেছে।