॥ ১৯ ॥
আমি সেদিন সন্ধ্যায় বাবা, মা ও ভাইবোনদের সঙ্গে রিষড়ার বাগানবাড়িতে চলে গেলাম। পরদিন ছিল রবিবার, ২৬ জানুয়ারী —আমাদের স্বাধীনতা দিবস। সারা সকাল আমরা—বাবা, মা ও আমি—খুবই উৎকণ্ঠায় কাটালাম। বেলা বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে বাবা বেশ অস্থির হয়ে পড়লেন—সব কিছু প্ল্যানমত ঠিক হল কিনা, তখনও কেন কেউ খবর নিয়ে আসছে না, ইত্যাদি। খাওয়াদাওয়ার পর আমরা বসে যখন জল্পনা-কল্পনা করছি তখন কলকাতার একটা গাড়ি এসে ঢুকল। আমার দুই জ্যাঠতুতো-খুড়তুতো ভাই ব্যস্তসমস্তভাবে বাড়ির ভিতরে এলেন।
গাড়ির আওয়াজ পাওয়ামাত্র আমি অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। একজন সোজা বাবার ঘরে গিয়ে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন। জ্যাঠতুতো দাদাটি রসিক লোক ছিলেন, ঠাট্টা-তামাশা ভালবাসতেন। তিনি আমার ঘরে এসে আমাকে ঠেলা দিয়ে অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বারবার বলতে লাগলেন—‘জানো, রাঙাকাকাবাবুকে আজ সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ আমার ঘুম তত ভাঙেই না, অন্য দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বললাম—‘আঃ, কি সব বাজে কথা বলছ!’ তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগলেন —‘না, না—এটা ঠাট্টা নয়, সত্যিই রাঙাকাকাবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা সব জায়গায় খুঁজে দেখেছি, এমন কি বাড়ির চিলের ছাত পর্যন্ত। মেজকাকাবাবুকে খবর দিতে এসেছি।’
আমি শেষ পর্যন্ত উঠলাম এবং ধীরে ধীরে বারান্দায় বেরোলাম, বাবাও বেরিয়ে এলেন এবং গম্ভীরভাবে সকলের সামনে বললেন— ‘সুভাষকে পাওয়া যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বললেন যে, তিনি যত শীঘ্র সম্ভব কলকাতায় যেতে চান। কলকাতা গিয়েই খোঁজখবর করবার প্ল্যান ঠিক করবেন। দুইজন বার্তাবাহককে আগেই ফিরে যেতে বলে নিজে প্রস্তুত হয়ে নিলেন।
সেই ওয়ানডারার গাড়িতে আবার বাবাকে পাশে বসিয়ে আমি কলকাতার পথে রওনা হলাম। বুঝতে পারলাম গাড়িতে বাবা তাঁর প্ল্যান মনে মনে ঠিক করছিলেন। কথাবার্তা বেশী বললেন না। বাবাকে নিয়ে আমি সোজা এলগিন রোডের বাড়িতে এলাম। বাবা রাঙাকাকাবাবুর অফিস-ঘরে বসলেন। সেখানে সকলেই কি হয়েছে সে সম্বন্ধে নিজস্ব ‘রিপোর্ট’ ও মতামত দিতে লাগল। বাবা নাম করে করে কয়েকজন পারিবারিক বন্ধুকে খবর দিতে বললেন। একে একে অনেকেই এসে পড়লেন। যেমন সত্যরঞ্জন বক্সী, সুরেশ-চন্দ্র মজুমদার, পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী, নৃপেন্দ্রচন্দ্র মিত্র প্রভৃতি। আত্মীয়দের ভিড় তো হলই। শলাপরামর্শ চলতে লাগল। মা-জননী তাঁর নিজের ঘরে মোটামুটি শান্তভাবেই বসে ছিলেন। বাবা তাঁর সঙ্গে দেখা করে এলেন। মা-জননীকে কিছু বলার ছিল না—এটাই হল বাবার কাছে এক কঠিন পরীক্ষা। কিছুক্ষণ পরে বাবা দলবল নিয়ে উডবার্ন পার্কের বাড়িতে এলেন ও নিজের অফিস ঘরে বসলেন। বন্ধুরা বাবার উপর নানারকম পরামর্শ, উপদেশ ও মতামত বর্ষণ করতে লাগলেন ও বাবা পরম ধৈর্যভরে সব কিছু শুনে গেলেন। তারপর কয়েকটি টেলিগ্রাম পাঠালেন ও কলকাতার কয়েকটি জায়গায় খোঁজখবর করার জন্য বিশেষ করে আশ্রম, মঠ, মন্দির ইত্যাদি বেছে নিলেন।
এলগিন রোডে ও উডবার্ন পার্কে আমি যতটা সম্ভব অন্তরাল থেকে এবং বোকা সেজে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছিলাম—খানিকটা উপভোগও করছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমারও ডাক পড়ল। অফিস-ঘরে সকলের সামনে বাবা আমাকে বললেন, এঁরা বলছিলেন কেওড়াতলার শ্মশান ও কালীঘাটের মন্দিরের দিকটা একটু দেখে আসা উচিত। তুমি অমুককে সঙ্গে নিয়ে ওয়ানডারার গাড়িটা করে একটু দেখে এসো। আমি খুব বাধ্য ছেলের মত একটি দল নিয়ে ওয়ানডারার গাড়িতে চড়ে রাঙাকাকাবাবুকে ‘খুঁজতে’ বার হলাম। কেওড়াতলায় দেশবন্ধুর সমাধি-মন্দিরটা ঘুরে ঘুরে আমরা দেখলাম। নেশায় মশগুল কতকগুলি বিচিত্র মানুষ সেখানে জমিয়ে বসে আছে —দেখে বড় দুঃখ হল। তারপর গেলাম কালীঘাটের মন্দিরে। সেখানেও বিফলমনোরথ হলে একজন সঙ্গী কাছেই তাঁর বিশেষ পরিচিত একটি কালীভক্ত বাবার কাছে যাবার প্রস্তাব করলেন। লম্বা সরু গলির শেষ প্রান্তে তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম। পাশেই কালীমূর্তি। খবর শুনে তিনি চ্যালেঞ্জিং সুরে আমার সঙ্গীকে বললেন—‘আমি আগেই বলিনি কি যে, সুভাষবাবুকে সংসারে বেঁধে রাখতে পারবে না। দেখলে তো তাই হল!’ অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর তিনি বললেন যে, চন্দননগরের কাছে অমুক মন্দিরে খোঁজ করে দেখতে পার। তবে সারা রাত মায়ের পূজার পর সকালের দিকে তিনি আরও সঠিক করে বলতে পারবেন। বাড়ি ফিরে আমাদের নিষ্ফল যাত্রার কথা বাবা ও অন্যান্যদের জানালাম।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকের ভিড়ও কমল, বাবা তখন সুরেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন, সংবাদটি খবরের কাগজে পরদিন সকালে ছাপা হবে কিনা, যদি হয় তো কি বলা হবে সেটা বিবেচনা করতে। শেষ পর্যন্ত তাঁরা একটি খসড়া তৈরি করলেন এবং সুরেশবাবু সেটি নিয়ে বিদায় হলেন।
পরদিন ২৭ জানুয়ারি, কঠিন পরীক্ষার দিন। প্রথমত, রাঙা-কাকাবাবুর মামলা উঠবে; সকালেই খবরটি প্রচার হয়ে যাওয়ায় কোর্টের ব্যাপারটা সহজ হল। দ্বিতীয়ত, পুলিশের প্রতিক্রিয়া কিরকম হবে এবং তারা কি করবে? বোঝাই গেল বাংলাদেশের পুলিশ একেবারেই হকচকিয়ে এবং বোকা বনে গিয়েছে। এলগিন রোডের বাড়িতে পৌঁছতেই তাদের অনেক দেরি হল। তাদের কাছে বারবার করে রাঙাকাকাবাবুর গৃহত্যাগের অলীক কাহিনীটি শোনানো হল। যথা, তিনি দশদিন যাবৎ নির্জনবাসে ছিলেন। রাত্রের খাবার অভুক্ত পড়ে থাকায় সন্দেহ হয় এবং পর্দা সরিয়ে দেখা যায়, তিনি নেই। বিকালে গাড়ি-বারান্দার ছাদে দাঁড়িয়ে আমি পুলিশের একটি দলের পরীক্ষা দেখছিলাম। দেখলাম তারা পলায়নের পথ খুঁজছে বিশেষ করে বাড়ির পিছনে; এবং এক পাশের জমাদারের ছোট দরজার দিকে। তাদের আচরণ ও পরীক্ষার ধরন দেখে আমি আশ্বস্ব বোধ করলাম।
সেদিন কিংবা পরের দিন সন্ধ্যায় অল ইণ্ডিয়া রেডিও হঠাৎ ঘোষণা করে বসল যে, সুভাষচন্দ্র বসু, যিনি গতকাল থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন, ঝরিয়ার কাছে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাবা খবরটি শুনে বিচলিত হয়ে পড়লেন। আমাকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এরকম হওয়া সম্ভব কিনা। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘পুরা দশ দিন কেটে গেছে, এখন উনি ঐ অঞ্চলে থাকবেন কি করে!’ বাবা বললেন, ‘ধর যদি তার সব প্ল্যান ভেস্তে গিয়ে থাকে এবং যদি সে বাড়ি ফিরবার পথে ধরা পড়ে থাকে?’ আমি কিন্তু ঐরকম সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দিলাম। যাই হোক, বন্ধুদের পরামর্শে রারারিতে দাদাকে ( ডঃ অশোকনাথ বসু) টেলিফোন করা হল এবং ধানবাদ গিয়ে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে খোঁজ করতে বলা হল। কিছুক্ষণ পরেই আসোসিয়েটেড প্রেস অব ইণ্ডিয়া থেকে খবরটি ভিত্তিহীন বলে প্রচার করা হল। বাবা আমাকে বললেন মা-জননীকে খবরটি দিয়ে আসতে।
(২৭।১।৪১ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের প্রতিলিপি।)
পুলিশ ছাড়াও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব দলে দলে আসতে লাগলেন। ওঁদের সকলকে বারেবারে কাহিনীটি শোনানো হল এবং রাঙাকাকাবাবুর ঘরে নিয়ে গিয়ে সাজানো ব্যবস্থাটি দেখনো হল। রাঙাকাকাবাবুর ব্যক্তিগত ভৃত্যটি কিন্তু একটি বিপজ্জনক আবিষ্কার করে ফেলল। সে ইলাকে বলল যে, তিনি তো সবই ফেলে গেছেন কিন্তু তাঁর ফিতে-বাঁধা মজবুত জুতো জোড়াটি তো নেই! ইলা অপ্রস্তুত হয়ে তাকে বলে ফেলল যে, জুতো জোড়াটি রাঙাকাকাবাবু মেরামতের জন্য দিয়েছেন।
(২৭।১।৪১ তারিখে হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ডে প্রকাশিত খবরের প্রতিলিপি।)
এর পরের দু’মাস প্রতি দিন আমাদের গভীর উৎকণ্ঠা ও চাপা উত্তেজনায় কাটল। প্রায়ই রাত্রে বাবা খাওয়াদাওয়ার পর আমাকে ডাকতেন, মশারির মধ্যে বাবার বিছানায় বসে গুজগুজ করে কথাবার্তা হত। বাবা কোন সূত্র থেকে কি শুনছেন সব বলতেন— পুলিশের লোকেরা এই বলছে, অফিসারের মত এই, বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক দলগুলি এই প্রচার করছে—এমন কি, জ্যোতিষীরা কি বলছে—তাও। আমিও বিভিন্ন সূত্র থেকে যা সব শুনতাম বাবাকে জানাতাম। কথাবার্তা শেষ হলে আমাকে বাবার নির্দেশে আলো না জ্বেলে অন্ধকারের মধ্যে উপরতলায় শুতে যেতে হত, যাতে বাড়ির বাইরেকার সি আই ডি-র চরেরা জানতে না পারে যে, আমরা পিতা- পুত্র গভীর রাত পর্যন্ত কোন শলাপরামর্শ করছি।
এর পরে কিছুকাল ধরে এলগিন রোডের বাড়ীতে গিয়ে কতরকমের কথা যে শুনতাম তার ইয়ত্তা নেই। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে অনেকেই চুপচাপ থাকাই শ্রেয় মনে করেছিলেন—বিশেষ করে যাঁদের মনে নানা রকমের সন্দেহ ছিল। মা-জননীর দুশ্চিন্তা লাঘব করার উপায় না থাকায় বাবা বিশেষ দোটানার মধ্যে পড়েছিলেন। অনেকদিন পরে ঠাকুমা (বাসন্তী দেবী) আমাদের বলেছিলেন—সুভাষ চলে যাবার পর তোমাদের মা-জননীর সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখি, শরৎ এক পাশে চুপ করে গালে হাত দিয়ে বসে আছে এবং তার চোখ দিয়ে টস্ টস্ করে জল পড়ছে, পরে বুঝেছিলাম ব্যাপারটা জেনেও মাকে বলতে না পারায় শরতের ঐ অবস্থা হয়েছিল। কেউ কেউ বোধহয় যথার্থই বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন যে, রাঙাকাকাবাবু সন্ন্যাস নিয়েছেন। যেমন, আমার ধর্মপ্রাণ দিদিমা আমাদের ধর্ম- বিমুখতার নিন্দা করে একদিন বললেন—এইবার তোমাদের উচিত শিক্ষা হবে, দেখবে তোমাদের রাঙাকাকাবাবু নামাবলি গায়ে, মাথায় শিখা ধারণ করে মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে ফিরবেন। সম্পূর্ণ বিপরীত ও অভিনব মত শুনলাম এলগিন রোডের বাড়িতেই এক অতি নিকট-আত্মীয়ের মুখে। তিনি বললেন, সুভাষ রাজনৈতিক জীবনে সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে হতাশায় নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করেছে— তার মৃতদেহের খোঁজ করাই উচিত হবে। কারণ, সুভাষের পক্ষে ভারতবর্ষে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়, তাকে দেশের বাচ্চাকাচ্চারাও চেনে, রাস্তার ধারে মুড়ি কিনে খেতে গেলেও তো ধরা পড়ে যাবে
কিভাবে রাঙাকাকাবাবু এলগিন রোডের বাড়ি থেকে চলে গেলেন, তার উপর নানারকমের থিওরি শুনতে লাগলাম। যেমন, কেউ কেউ একটি গল্প প্রচার করলেন যে, একদিন সন্ধ্যায় দুইজন পাগড়িধারী শিখ ভদ্রলোক রাঙাকাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন কিন্তু তিনজন শিখ ভদ্রলোক। কেউ বললেন, তিনি নাকি ১৯শে জানুয়ারী এক জাপানী জাহাজে করে ছদ্মবেশে ও ছদ্মনামে খিদিরপুর ডক্ থেকে পাড়ি দিয়েছেন। ইদানী দিল্লীর ন্যাশনাল আরকাইভ্স্-এ পুলিশের পুরোনো কাগজ-পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখেছি যে দিল্লীর কর্তারাও প্রথম দিকে তাঁর খোঁজ করছিলেন সিঙ্গাপুর ও হংকং এলাকায়। আর একটা অভিনব গল্পও শোনা গেল—তিনি নাকি এক গভীর রাতে হুগলীর এক মাঝিকে অনেক বক্শিশ দিয়ে তাঁকে মাঝ দরিয়ায় নিয়ে যেতে বলেন— সেখানে এক ডুবো জাহাজ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। অলৌকিক ব্যাপারে বিশ্বাসী কেউ কেউ বললে যে, রাঙাকাকাবাবু যোগবলে সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে তাঁর ঘরের জানালা দিয়ে অদৃশ্য হয়েছেন।
এই ধরনের বিভিন্ন রকমের ব্যাখ্যা নির্লিপ্তভাবে আমাকে শুনে যেতে হত। কিন্তু কখনও কখনও আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত হতাম এবং প্রতিবাদ করবার ইচ্ছা জোর করে দমন করতে হত।
অবশ্য রাঙাকাকাবাবুর কোন কোন রাজনৈতিক সহকর্মী জন-সভায় অথবা ঘরোয়াভাবে বলতেন যে, সুভাষচন্দ্রের জীবনের একমাত্র তপস্যা ভারতের স্বাধীনতা অর্জন এবং তিনি হলেন কর্মযোগী। তিনি যেখানেই গিয়ে থাকুন না কেন, তিনি নিশ্চয়ই দেশের মুক্তির সন্ধানে গিয়েছেন। এ ধরনের কথা শুনতে আমার খুব ভাল লাগত।
বলাই বাহুল্য, খবরের কাগজে কি বেরোচ্ছে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি সব সময়েই ছিল। আমরা চাইছিলাম যে এটা ভালভাবে প্রচার হোক যে, রাঙাকাকাবাবু সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন। আনন্দবাজার ও হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড সম্বন্ধে চিন্তা ছিল কম, কারণ বাবা ও সুরেশচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের মধ্যে একটা বোঝাপড়া ছিল। কিন্তু সবক্ষেত্রে তো সংবাদপত্রের নীতি কি হবে তা বাইরে থেকে ঠিক করে দেওয়া যায় না। যেমন কলকাতার আর একটি বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী ইংরাজী দৈনিকে এমন এক সম্পাদকীয় লেখা হল যে, আমি তো রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। লেখকের বিশ্লেষণ অবশ্য তারিফ করবার মত হয়েছিল, কিন্তু আমার ভয় হল, আমাদের সাজানো গল্প বুঝি ধোপে টিকছে না। আমি বাবাকে সম্পাদকীয়টি থেকে পড়ে শোনালামঃ
“To say that he felt sick of the whole thing and wanted to leave his work where it was, is to do scant justice to the past of the man………… If the causes of his disappearance are full of mystery, no less are the circumstances surrounding it…………How is it that a patient supposed to be in such an extremely weak state of health, left his room, apparently unobserved by the inmates of his house? Is he in India and, if so where? When did he leave his place and when had he been last seen? ………it will remain a mystery that he was able to leave his room at all presumably without assistance and possibly at mid-winter night? On Saturday night it was raining heavily………His relatives believe that he must have left on Saturday, past midnight, when everybody was supposed to be asleep. The gates of the house were open no doubt but were guarded by two watch-dogs. How was it possible for Srijut Bose to leave the house under these circumstances?
“উনি সবকিছুর উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজের কাজকর্ম যেমন ছিল, ফেলে রেখে চলে যেতে চেয়েছিলেন—এ কথা বললে এই মানুষটির অতীতের প্রতি বিন্দুমাত্রও সুবিচার করা হবে না।⋯তাঁর অন্তর্ধানের কারণগুলি যদি রহস্যাবৃত হয় তবে অন্তর্ধানের সঙ্গে জড়িত পরিবেশ আরো বেশী রহস্যাবৃত। এটা কি করে সম্ভব যে ওঁর মত একজন রোগী, যার স্বাস্থ্যের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে বলা হচ্ছে—ঘর ছেড়ে চলে গেলেন আর বাড়ির লোকজনেরা তা দেখতেই পেল না? উনি কি ভারতবর্ষে আছেন? যদি থাকেন তো কোথায়? উনি কখন গৃহত্যাগ করলেন এবং কখন তাঁকে শেষ দেখা গিয়েছিল ?⋯এটা একটা রহস্য থেকে যাবে যে উনি, যেমন বলা হচ্ছে, কারো সাহায্য ছাড়া শীত-কালের মাঝ রাত্তিরে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যেতে পারলেন? শনিবার রাত্রে প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল—ওঁর আত্মীয়স্বজনদের বিশ্বাস যে, উনি নিশ্চয় শনিবারে মধ্যরাত্রের পর যখন সকলে, ধরে নেওয়া হচ্ছে, নিদ্রিত ছিল—তখন চলে গিয়েছেন। একথা ঠিক যে বাড়ির গেট খোলাই ছিল কিন্তু দু’টি পাহারাদার কুকুর তো বাড়ি পাহারায় নিযুক্ত ছিল। এই পরিস্থিতিতে কি ভাবে শ্ৰীযুত বোসর পক্ষে গৃহত্যাগ করা সম্ভব?”
দেশের নেতৃস্থানীয়দের অনুসন্ধানের উত্তরে বাবা অনেক ভেবে-চিন্তে বিভিন্ন ধরনের জবাব দিলেন। গান্ধীজী লিখলেন—“wire truth”, বাবা জবাব দিলেন—“Circumstances indicate renunciation।” রবীন্দ্রনাথের বেলায় বাবা একটু ব্যতিক্রম করলেন। লিখলেন—“Hope he will have your blessings wherever he may be”। রাজেন্দ্রপ্রসাদকে লেখা হল; “No news”।
মাস তিনেক পরে আমার বাবা ও মা কবির আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন। ততদিনে রাঙাকাকাবাবুর জার্মানীতে পৌঁছবার খবর এসে গেছে। রবীন্দ্রনাথ বাবাকে বলেছিলেন, “তুমি আমাকে বলতে পার” এবং বাবা তাঁকে রাঙাকাকাবাবুর আসল খবর দিয়েছিলেন। কলকাতায় ফিরে বাবা আমাকে জানান যে, রবীন্দ্রনাথ রাঙাকাকাবাবুর জন্য এতই উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, তিনি তাঁকে সত্য কথা না বলে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত আমাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় শেষ হল ৩১ মার্চ-এ। সন্ধ্যাবেলা উডবার্ন পার্কের দোতলার দক্ষিণের বারান্দায় মা ও বোনের সঙ্গে বসে গল্পগুজব করছি, বেয়ারা এসে একটি স্লিপ আমার হাতে দিল। স্লিপটা হাতে নিয়ে কিছু না ভেবেই অন্যমনস্কভাবে আমি জোরে জোরে পড়ে ফেললাম— Bhagat Ram, I come from frontier. পড়ে ফেলেই আমি চমকে উঠলাম। মা’র সঙ্গে আমার অর্থপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় হল।
এক মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, জোরে জোরে বললাম—‘আবার জ্বালাতে এসেছে! এ সেই কাশ্মীরের কার্পেট-ওয়ালাটা। বলছি দরকার নেই, তবুও ছাড়ছে না।’
নেমে এসে দেখলাম, সামনের বারান্দায় দু’জনে দাঁড়িয়ে আছেন, একজন নেহাতই যুবা, সুদর্শন ও গৌরবর্ণ। আর একজন খানিকটা বয়স্ক, মোটাসোটা ও পুরোপুরি বিলাতী ধরনের পোষাক পরা। যুবকটি বললেন, তিনিই স্লিপটি আমার কাছে পাঠিয়েছেন এবং গলা নামিয়ে আরও বললেন যে, তাঁরা সুভাষবাবুর খবর নিয়ে এসেছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি আমার ডাকনাম জানেন কিনা এবং আমি কি করি। দুটোরই সন্তোষজনক জবাব পাবার পর আমি তাদের পশ্চিম দিকে রাঙাকাকাবাবুর আগেকার অফিস-ঘরে নিয়ে গেলাম। ভগৎরাম বললেন যে, তিনিই পেশোয়ার থেকে কাবুল পর্যন্ত রাঙাকাকাবাবুর সাথী ছিলেন এবং কাবুল থেকে মস্কোর পথে তাঁকে রওনা করিয়ে দিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন। সেই দিনই রাঙা-কাকাবাবুর মস্কো পৌঁছবার কথা।
ভগৎরাম ঠিকই বলেছিলেন। নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর সংগ্রহ-শালায় সেই সময়কার জার্মান সরকারের পররাষ্ট্র বিভাগের যেসব নথিপত্র এসেছে, তার মধ্যে মস্কো থেকে জার্মান রাষ্ট্রদূত শুলেনবুর্গের ৩১শে মার্চের একটি টেলিগ্রাম আছে। শুলেনবুর্গ টেলিগ্রাম মারফত বার্লিনে জানাচ্ছেন যে সুভাষচন্দ্র বসু অরল্যাণ্ডো মাৎসোতা ছদ্মনামে সেইদিনই মস্কোতে পৌঁচেছেন এবং ১লা এপ্রিল শেষরাত্রে বার্লিন পৌঁচেছেন।
মূল জার্মান বার্তাটির বঙ্গানুবাদ দিলামঃ
“বোস আজ অরল্যাণ্ডো মাৎসোতা নামে ইতালীয় পাসপোর্ট নিয়ে এঞ্জিনিয়ার ওয়েঙ্গারের সঙ্গে দূতাবাসে এসেছিলেন। টেলিগ্রামের নির্দেশমত বোস ও ওয়েঙ্গারকে জানিয়েছি। ওয়েঙ্গার বলল যে, শোয়াৎর্স ও হিলপার্ট মাৎসোতার আসল পরিচয় জানে না। এখান থেকে কোন সাবধানবাণী দেবার প্রয়োজন নেই।
যাত্রার সময় ৩১শে মার্চ, ২৩-০৫ মিনিট; মালকিনিয়ায় পৌঁছানর সময় ১লা এপ্রিল, ২৩-১০ মিনিট। বোস এখনই পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান।
শুলেনবুর্গ”
সুভাষচন্দ্রের মস্কো পোঁছবার খবর দিয়ে জার্মান রাষ্ট্রদূত শুলেনবুর্গ ৩১।৩।৪১ তারিখে বার্লিনে যে তারবার্তা পাঠান, এটা তারই প্রতিলিপি।
ভগৎরাম বাবার কাছে বাংলায় লেখা রাঙাকাকাবাবুর একটি চিঠি ও দুটি লেখা নিয়ে এসেছেন। সেগুলি তিনি বাবাকে দিতে চান। বাবার সঙ্গে তাঁর দেখা করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন। স্লিপটিতে তিনি তাঁর আসল নাম লিখেছেন বলে সেটি নষ্ট করে দিতে বললেন।
আমি ভগৎরাম ও তাঁর সঙ্গীকে অপেক্ষা করতে বলে বাবার খোঁজে গেলাম। একটু পরেই বাবা স্নান সেরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। তিনি তাঁর অফিস-ঘরে যাবার আগেই আমি তাঁকে ধরলাম এবং পশ্চিমের ঘরে নিয়ে এলাম। ভগৎরাম আবার বাবাকে রাঙা-কাকাবাবুর খবর দিলেন এবং তিনটি লেখা বের করলেন। বাবা আমাকে লেখাগুলির দায়িত্ব নিতে বলে ভগৎরামকে আমাদের বাড়িতে আর না আসতে পরামর্শ দিলেন। ঠিক হল যে পরদিন ভোরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে তাঁরা বাবার সঙ্গে মিলিত হবেন এবং সেখানেই তাঁদের কথাবার্তা হবে।
ভগৎরামকে বিদায় দিয়ে বাবা আমাকে লেখাগুলি তিনতলায় নিজের ঘরে নিয়ে যেতে বললেন এবং সেগুলি ভাল করে পরীক্ষা করে পরে রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন।
লেখাগুলির মধ্যে প্রথমটি ছিল বাবার উদ্দেশে পেনসিলে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠি। চিঠিতে কোন স্বাক্ষর ছিল না, কিন্তু হাতের লেখা ও ভাষার দিক থেকে কোন সন্দেহ ছিল না। দ্বিতীয়টি ছিল কালি-কলমে ইংরেজীতে দেশবাসীর উদ্দেশে লেখা—Message to My Countrymen, from somewhere in Europe. এটিতে রাঙাকাকাবাবুর পুরো সই ছিল এবং তারিখ দেওয়া ছিল ১৭ মার্চ, ১৯৪১। কিছু দিন পরে এটি ছাপিয়ে নানা জায়গায় বিতরণ করা হয়েছিল। তৃতীয়টি ছিল একটি দীর্ঘ প্রবন্ধঃ Forward Bloc— its justificat on.
পেনসিলে লেখা এই প্রবন্ধটি পরে প্রকাশিত হয়েছে এবং মূলটি নেতাজী রিসার্চ ব্যুরোর সংগ্রহশালায় আছে।
বাবাকে লেখা বাংলা চিঠিতে রাঙাকাকাবাবু লিখেছিলেন যে, তিনি আবার যাত্রা শুরু করছেন, তবে “পথে অনেক দেরী হয়ে গেল এই যা দুঃখ।” পথে নানা রকমের অসুবিধারও ইঙ্গিত চিঠিতে ছিল এবং পত্রবাহক (ভগৎরাম) যে তাঁর অনেক সেবা করেছেন তারও উল্লেখ ছিল। শেষে বাড়ির সকলে কুশলে আছেন এই আশা প্রকাশ করে বাবাকে ও ‘মেজবৌদিদি’কে প্রণাম জানিয়েছিলেন। চিঠির নীচে তাঁর “কন্যা’র জন্য অর্থাৎ ইলার জন্য দু’লাইন লিখেছিলেন এবং সেটা তাকে দেখাতে বলেছিলেন। কিছুদিন পরে ইলা কলকাতায় এলে আমি চিঠির সেই অংশটি তাকে দেখিয়েছিলাম।
“Message to My Countrymen”-এ রাঙাকাকাবাবু তাঁর বিদেশ যাত্রার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সাধারণ ও সহজভাবে কিছু বলেছিলেন। গোপন যাত্রার সময় সাহায্য করার জন্য বর্মা ও চীনের বন্ধুদের ধন্যবাদ দিয়েছিলেন! গেলেন আফগানিস্তান ও রাশিয়া হয়ে, ধন্যবাদ দিলেন বর্মা ও চীনের বন্ধুদের ! বলাই বাহুল্য, শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্যই তিনি এটা করেছিলেন। Messageটি প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরে খবরের কাগজে পড়লাম যে, বিহার গভর্নমেন্ট আপত্তিকর ইস্তাহার হিসাবে সেটি বাজেয়াপ্ত করেছেন।
অনেক রাত পর্যন্ত সবগুলিই বেশ কয়েকবার পড়লাম, বহু দিনের সঞ্চিত উদ্বেগ কেটে গেল এবং এক বিরাট সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত আমার মানসচক্ষে ভেসে উঠল।