মসলার যুদ্ধ – ৯

নয়

প্রথমে পোর্তুগীজ, তারপর ডাচ এবং সর্বশেষে ইংরেজরা মসলার খোঁজে মসলার দেশ ইন্দোনেশিয়ায় এসে প্রবেশ করল।

ইংল্যাণ্ডে মসলার প্রচুর চাহিদা ছিল। তাদের শরৎকাল থেকে বসন্তকাল পর্যন্ত নোনা-মাংস খেয়ে থাকতে হোত। ভাল টাটকা মাংস তাদের কপালে খুব কমই জুটত। জেলেদের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের বেশী করে মাছ খেতে বাধ্য করা হোত, যেটা তারা কমই পছন্দ করত। মাছগুলোকে একটু মুখরোচক করে তোলবার জন্য তাদের ঝাল মসলার প্রয়োজন পড়ত। সেদিক দিয়ে আমাদের চেয়ে তাদের মসলার চাহিদা ছিল বেশী। তা ছাড়া তারা বেশী মসলামিশ্রিত মদটা বেশী পছন্দ করত।

পোর্তুগীজদের সরিয়ে দিয়ে ডাচরা তাদের একচেটিয়া মসলার বাণিজ্য দখল করে নিল। ইউরোপের নানা দেশের বণিকরা তাদের কাছ থেকে মসলা আমদানি করত। ইংরেজরাও সেই সূত্রেই মসলা পেয়ে আসছিল। কিন্তু একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ পেয়ে ডাচদের লোভের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। ১৫৯৯ খ্রীস্টাব্দে তারা যখন এক পাউন্ড গোল মরিচের দর ৩ শিলিং থেকে ৮ শিলিং- এ চড়িয়ে দিল, ইংরেজ বণিকরা তখন বেঁকে বসল। তারা স্থির করল। তারা প্রাচ্যের মসলার বাজারের মধ্যে ঢুকে পড়বে।

ডাচদের ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রতিষ্ঠির এক বছর আগে ইংরেজদের ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রাচ্যে একচেটিয়াভাবে বাণিজ্য করবার জন্য রাণী এলিজাবেথের কাছ থেকে সনদ পেয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবার মসলা-বাণিজ্যে নামল। কোম্পানীর প্রথম জাহাজ ১৬০১ খ্রীস্টাব্দের ২৪-এ জানুয়ারী তারিখে এই উদ্দেশ্যে প্রাচ্য অঞ্চলে যাত্রা করল। এই জাহাজ মসলার সন্ধানে ইন্দোনেশিয়ার আচিন ও সুমাত্রায় গিয়ে পৌঁছল।

আড়াই বছর পরে ১৬০৩ খ্রীষ্টাব্দে নভেম্বর মাসে জাহাজটি ১০ লক্ষ ৩০ হাজার পাউণ্ড গোলমরিচ নিয়ে ইল্যাণ্ডে ফিরে এল। এর পরে আরও কয়েকবার কোম্পানীর জাহাজ মসলা-দ্বীপ থেকে মসলা নিয়ে এসেছে। কিন্তু কোম্পানীর এতে বিশেষ সুবিধা হচ্ছিল না। ব্যবসাটা একতরফা ভাবে চলছিল। মসলার মূল্য বাবদ দেশের অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে থেকে অর্থ আসছিল না। ইংল্যাণ্ডের তখনকার অর্থনীতিবিদরা এ ব্যাপারে আপত্তি জানাচ্ছিলেন।

কিন্তু এই সমস্ত মসলা-দ্বীপে কোম্পানীর নিজস্ব লোক যারা ছিল, তারা একটা নতুন পন্থা উদ্ভাবন করল। তারা জানাল, এই সব দ্বীপে ভারতীয় বস্ত্রের খুবই চাহিদা। ভারত থেকে বস্ত্র নিয়ে এসে যদি বান্টাম ও মালাক্কাস দ্বীপে বিক্রী করা যায়, তাহলে তা থেকে যা মুনাফা হবে, তাই দিয়ে প্রচুর মসলা কিনে নেওয়া যাবে। ইংরেজি বণিকরা এই যুক্তিটা মেনে নিল এবং এই উদ্দেশ্যে ১৬১২ খ্রীস্টাব্দে ভারতবর্ষের সুরাট বন্দরে একটা বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপন করে বসল। কিভাবে তারা সুরাটে ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে নিয়েছিল, ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাধারণ পাঠকও তা জানে।

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী চৌদ্দ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে মসলার বাণিজ্য করছিল। কিন্তু ১৬১৫ খ্রীষ্টাব্দে ডাচদের চাপে তাদের ইন্দোনেশিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হোল। এর পর তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল। ইংরেজ বণিকদের মসলার বাণিজ্যের এইখানেই ইতি।

ভারতবর্ষ ও ইন্দোনেশিয়া দ্বীপপুঞ্জের ইতিহাসে মসলার ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানকার মসলা পরপর তিনটি ইউরোপীয় শক্তিকে আকর্ষণ করে নিয়ে এসেছে। বাণিজ্য করতে এসে শেষ পর্যন্ত এর সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসল।

এই মসলা-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কত শক্তির উত্থান পতন ঘটেছে। বণিকদের মুনাফার তৃষ্ণা মিটাতে গিয়ে কত মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তদের রক্ত তিন সমুদ্রের জলে মিশে আছে।

এই মসলা-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কত দেশ তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে, কত মানুষের মর্যাদা ধূলায় লুণ্ঠিত হয়েছে। এই মসলার যুদ্ধ সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উপর কঠিন আঘাত হেনেছে। যে-চাষীরা মসলা উৎপন্ন করত তাদের জমি আর স্বাধীন জীবিকা থেকে উচ্ছন্ন করে দিয়ে নিঃসম্বল কুলীতে রূপান্তরিত করেছে। তাদের সম্পদ তাদের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে— অপনা মাংসে হরিনা বৈরী।

এই মসলার যুদ্ধ রক্তাক্ত, হিংস্র, বীভৎস! আবার এই মসলার যুদ্ধ প্রাচ্যের পরিবর্তনহীন পশ্চামুখী সমাজের সামনে বৃহৎ বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বদ্ধ জীবনের উপরে দুরন্ত ঝটিকার আলোড়ন জাগিয়েছে, প্রচণ্ড অত্যাচারের শক্তি স্বপ্ন-দেখা ঘুমন্ত মানুষকে চুলের ঝুঁটি ধরে টেনে তুলেছে!

ওটাও সত্য। এটাও সত্য। কোনটাই মিথ্যা নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *